01-01-2021, 04:48 PM
** পাহাড়ি তনয়া **
-- Lekhak
শুধু অন্বেষার জন্য -
অন্বেষা, এই চিঠিখানা আমি কোনদিন তোমাকে পোষ্ট করবো না। কেননা তুমি বাংলা জানো না। কিন্তু যখনই মনে পড়ে তোমাকে, সমস্ত শরীর থেকে উঠে আসা এক পাহাড়ী ঘামের গন্ধ আমার মনকে অকারণে উন্মনা করে দেয়, মনে কি আছে তোমার, গত মার্চে, তোমার সাথে কাটানো সিকিমের পথে প্রান্তরের দিনগুলো? সেই যে আমরা মহাত্মা গান্ধী মার্গে বসে ব্লুশিপ রেঁস্তোরাতে খেয়েছিলাম সিজলার্স? আর দিয়াখো? সেখানে হালকা নীলচে আলো জ্বলছিল। জানলা থেকে দূরের পাহাড়চূড়ো আয় আয় বলে কাছে ডাকছিল। সেটা ছিল মধ্য মার্চের এক দুরন্ত দুপুর। বসন্ত তার সমস্ত রূপ আর যৌবনের পশরা সাজিয়ে কোন পাহাড়ী কাঞ্চীর মত দাঁড়িয়ে ছিল একটা দারুন যৌবনবতী ঝর্ণার পাশে।
অন্বেষা, তোমার ঠোঁটে অকারণে পুড়ছিল দামী ইম্পোর্টেড সিগারেট। তুমি মাঝে মধ্যে ধোঁয়া ছাড়ছিলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে। তোমার হালকা লালচে ম্যানিকিওর করা ঠোঁট থেকে কিছুটা বন্ধুত্ব উঠে এসে জমা হচ্ছিল আমার করতলে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম তোমার সমস্ত শরীরের দিকে। তোমার পরণে সিকিমি পোষাক। শরীরের অনেকখানি অনাবৃত। রেখেছো তুমি-হয়তো কোন পুরুষ পতঙ্গের মন ভোলাবে বলে। কেননা বিধাতা তোমার বিধিলিপিতে যে গদ্য রচনা করেছে, সেখানে তো ছন্দের কোন স্থান নেই। এমন ভাবেই তোমাকে রাতের সহচরী হয়ে মন ভোলাতে হয় এখান সেখান থেকে ছুটে আসা পুরুষ পর্যটকদের। সাজতে হয় তাদের কাগজের বউ। তারপর যেমন বসন্ত অবসানে ঝরে যায় মৌসুমী ফুলেরা, তেমন ভাবেই একদিন হারিয়ে যায় ঐসব পুরুষ পর্যটকদের দল।
বাসস্ট্যান্ডে শেষবারের মতন লাল রুমাল উড়িয়ে যাও তুমি। তোমার চোখ টলটল করে একটুখানি জল। সেই জল ওড়নাতে মুছে নিজেকে দাঁড়াতে হয় এক সুন্দরী স্বৈরিনীর বেশে।
হায় অন্বেষা। এ জীবন এভাবে সকলের জন্য শরীর বিলিয়ে দিয়ে, বিনিময় কি পাবে তুমি? হয়তো তোমার পার্স আরো একটু পৃথুল হবে চকচকে টাকার আলিঙ্গনে। হয়তো তোমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আরো একটু আহঙ্কারিক হবে ঐ পুরুষ সঙ্গীদের দেওয়া কোন আন্টিক উপহারে। কিন্ত রাতের শেষ যখন চোখের কোণে জমবে। আরো একটু বিষন্নতার কালি, যখন কিছুতেই ঘুম আসবে না। তখন কি ক্ষণকালের জন্য তোমার মনে হবে না - বৃথাই এই ব্যর্থ দিনযাপন। যদি আর একবার সুযোগ আসে তাহলে তুমি কোন এক পাহাড়ী তরুনীর মত তোমার প্রাত্যহিক জীবনকে সাজিয়ে তুলবে মৌসুমী ফুলের সহস্র বাহারে।
এসব তো কথার কথা অন্বেষা। আমিও জানি এইসব স্বপ্ন চিরদিন থেকে যাবে। তুমিও জানো তা। তার চেয়ে এসো, বর্তমানকে মুঠোবন্দী করে আমরা মেতে উঠি শরীর আর মন নিয়ে এক আশ্চর্য বাঘবন্দী খেলায়।
অন্বেষা, মনে কি আছে তোমার? দাঁড়িয়েছিলে তুমি একা সেই বাসন্তী সকালে? তোমার পরনে ছিল একটি রাতকালো পোষাক। অসম্ভব ফর্সা রঙ তোমার। সমস্ত শরীর থেকেই সেই অনাবিল আশ্চর্য সৌন্দর্যের দীপ্তি সহস্র হীরক প্রভায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আমি নেহাতই এক সখের ট্যুরিস্ট হিসাবে পা রেখেছিলাম সিকিমে-দেখতে তার বসন্ত বাহারে।
সিকিম তো চিরদিনই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তার লেক, তার গুল্ফা, তার ঝর্ণা, আর তার ফুল আর পাখী - সবকিছুই আমাকে মাঝরাতে উতলা করে দেয়। সেই সিকিমে পা রেখেই যে তোমার মত এক বান্ধবীর সাথে আমার দেখা হবে, ভাবতেই পারিনি তা।
একটু আগে শুনেছিলাম, চোখ খোলা রাখলে আর মনকে আকাশের মত বিস্তৃত করে দিলে নাকি সিকিম ভ্রমণের পথে প্রান্তরে এমন কত পাহাড়ী তনয়ার দেখা মেলে-অনায়াসে যারা হয়ে ওঠে হৃদয়ের অধিশ্বরী।
মনে শঙ্কা ছিল, সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি আমি। যদিও বেপরোয়া হিসাবে যথেষ্ট কুখ্যাতি আছে আমার। তারপর..... প্রেমিয়াংশি থেকে লাচুং। লাচুং থেকে ইয়ুমথাং। সেখান থেকে আবার গ্যাংটকে ফিরে আসা। পেনিয়াংশি - খেচিপেরি লেক - ইয়াকসাম - তাশিডিং। এভাবেই তো কেটে গেল কয়েকটি দিন।
কখনো বা ইনস্টিটিউট অব তিবেটোলজির প্রশস্ত চত্বরে দাঁড়িয়ে কোন এক ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অস্ফূটে উচ্চারণ করা প্রেমের কবিতা। কখনো অর্কিড স্যাংচুয়ারিতে সবে নামা সন্ধ্যের আধো অন্ধকারে তোমার শরীরের সাথে আমার শরীর মিলেমিশে একাকার করার অনাবিল অপার্থিব মূহূর্তে শব্দহীন মৌনতার মধ্যে মগ্ন থাকা। কখনো ডিয়ার পার্কে কোন বিরল হরিণের সাথে খেলা করতে করতে তোমার হাতে হাত রেখে ভালোবাসার অভিবাদন গ্রহণ করা। মনে কি আছে অন্বেষা? হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফ্টসের দোকানে দাঁড়িয়ে যখন তুমি সযত্নে চয়ন করছিলে তোমার প্রসাধন সামগ্রী, তখন আমি আমার দামী বিদেশী ক্যামেরাতে ধরে রেখেছিলাম সেই ঈষৎ কাতর অথচ উল্লসিত মুখচ্ছিবিখানি। কলকাতায় কোন এক নিভৃত নিরালায় যারা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। সেই রুমটেক মনোস্ট্রি, এখানে ইতিহাস যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পা রাখলে মনে হয় আমরা এখন হাজার বছর আগের পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছি। প্যাসিভিউ পয়েন্ট থেকে হিমালয়কে দেখা, রাতের গ্যাংটকের বুকে বেপরোয়া জীপ চালানো। তারপর ছাংগু। বরফের মাঝে এক আশ্চর্য প্রস্রবণ। সেখানেও এক পড়ন্ত বিকেলে তোমার মধ্যে আমি আবিষ্কার করেছিলাম চিরন্তন সখ্যতাকে।
অন্বেষা, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার। প্রতিটি রাত্রি তুমি আমাকে দিয়েছ অনাবিল আনন্দের স্বাদ। কখনো বা কোন এক সিকিম পানপাত্রে বিদেশী বীয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। রাত পোষাকে অনন্যা তোমার আশ্চর্য তনুবাহার দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি। তুমিও কি আশ্চর্য, অনুগত্যা রমণীর মত আমার প্রতিটি বেহিসাবী ছেলেখেলায় সন্মতি দিয়েছো তোমার সুস্নাত চোখের তারায়। আমি যখন হতে চেয়েছি মধ্যরাতের মাতাল ঘোড়সওয়ার, তুমি এক অভীপ্সায় খুলে দিয়েছো তোমার শরীরের সমস্ত রূদ্ধ দুয়ারগুলি। যেমন ভাবে এক পথহারা পথিক ঔ দূরের দূর্গম শৃঙ্গের আকর্ষণে এগিয়ে যায়, তেমনভাবেই আমি বারবার বিভ্রান্ত হয়েছিলাম তোমার শরীর সুষমায়, চমকিত হয়েছিলাম তোমার তনুবাহারের কুহক মায়ায়। অন্বেষা, বিদায় নেবার সেই সজল সঘন মূহূর্তে আকাশ জুড়ে একটু বৃষ্টির ইশারা ছিল কি? মেঘের কোণে কেই কি জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিষন্নতার নিষ্প্রভ প্রদীপ শিখাগুলি? সেদিন তুমি পরেছিলে, স্পষ্ট মনে আছে আমার, এক টকটকে লাল পোষাক। কামনার লাল রঙ বেয়ে ধেয়ে আসা ঐরাবতের মত সমস্ত বাসনা তোমার সমস্ত শরীর জুড়ে মেহুহীনের বেহালা হয়ে বাজছিল। অন্বেষা, তুমি আমার চোখে চোখ রাখতে পারো নি। আমি যখন শেষবারের মত স্পর্ষ করেছিলাম তোমার মধ্য অনামিকায়, পরিয়ে দিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার একটি ছোট্ট উপহার, সহসা তোমার মুখের পানে কি কোন এক বিধ্বংসী ঝড়ের সংকেত লেগেছিল, অন্বেষা? তুমি দুহাতে মুখ ঢেকেছিলে। তোমার চোখ থেকে ছুটে আসা বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণাগুলোকে আমার সামনে ক্ষণকালের জন্য উদ্ভাসিত হতে দাওনি তুমি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। আর ভেবেছিলাম তুমি তো এক স্বৈরিণী। কিছু অর্থের বিনিময়ে এমনভাবে যে কোন পর্যটকদের হাতে অনায়াসে তুলে দিতে পারো তোমার শরীরের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলি।
তাহলে এই কান্না, এই ক্ষণবিহ্বলতা, এই শোকের সকরুণ আর্তনাদ, এসব কি তোমার সাজানো ইচ্ছার অভীপ্সা? এমন ভাবেই তুমি তোমার পেশাদারী দক্ষতার মধ্যে আর একটু অভিমানের অঞ্জলী এনে ভোলাতে চাও পুরুষের মন আর এভাবেই স্ফীত করতে চাও তোমার বুকের খাঁজে লুকিয়ে রাখা পার্সটিকে।
বাস ছেড়ে দিয়েছিল। পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে ক্রমশই অদৃশ্য হয়েগেছিল তোমার অবয়বখানি। তখনো আমার হাতের মুঠোর মধ্যে তোমার পরশ। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে তোমার শরীরের ভালোবাসার টুপটুপ বৃষ্টিপাতের সকরুণ ঘন্টারধ্বনি। শহর কলকাতাতে পা রাখা সত্ত্বেও তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি অন্বেষা। এখানে অজস্র আলোর ঈশারার মধ্যে, অসংখ্যা বান্ধবীর শরীর সান্নিধ্যে দাঁড়িয়েও বারবার আমার মনে পড়ে যায় সিকিমের সেই দিগন্ত বিস্তৃত তুষার আচ্ছাদিত প্রান্তরগুলিকে। মনে পড়ে গুল্ফার অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে বাজিয়ে যাওয়া স্বর্ণঘন্টাধ্বনির শব্দগুলি, মনে পড়ে কোন এক মধ্যরাতে তোমার শরীর থেকে শেষতম ওম শুষে নিয়ে মেতে ওঠার সেই আশ্চর্য সান্দ্র কুয়াশাছন্ন মূহূর্তগুলি।
অম্বেষা বলো তো? এমন ভাবে এক যুবকের বেঁচে থাকার প্রতিটি প্রহরকে রক্তাত্ত করে বিনিময়ে কি পেলে তুমি? সীমাহীন শূন্যতা ছাড়া।।
সমাপ্ত
-- Lekhak
শুধু অন্বেষার জন্য -
অন্বেষা, এই চিঠিখানা আমি কোনদিন তোমাকে পোষ্ট করবো না। কেননা তুমি বাংলা জানো না। কিন্তু যখনই মনে পড়ে তোমাকে, সমস্ত শরীর থেকে উঠে আসা এক পাহাড়ী ঘামের গন্ধ আমার মনকে অকারণে উন্মনা করে দেয়, মনে কি আছে তোমার, গত মার্চে, তোমার সাথে কাটানো সিকিমের পথে প্রান্তরের দিনগুলো? সেই যে আমরা মহাত্মা গান্ধী মার্গে বসে ব্লুশিপ রেঁস্তোরাতে খেয়েছিলাম সিজলার্স? আর দিয়াখো? সেখানে হালকা নীলচে আলো জ্বলছিল। জানলা থেকে দূরের পাহাড়চূড়ো আয় আয় বলে কাছে ডাকছিল। সেটা ছিল মধ্য মার্চের এক দুরন্ত দুপুর। বসন্ত তার সমস্ত রূপ আর যৌবনের পশরা সাজিয়ে কোন পাহাড়ী কাঞ্চীর মত দাঁড়িয়ে ছিল একটা দারুন যৌবনবতী ঝর্ণার পাশে।
অন্বেষা, তোমার ঠোঁটে অকারণে পুড়ছিল দামী ইম্পোর্টেড সিগারেট। তুমি মাঝে মধ্যে ধোঁয়া ছাড়ছিলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে। তোমার হালকা লালচে ম্যানিকিওর করা ঠোঁট থেকে কিছুটা বন্ধুত্ব উঠে এসে জমা হচ্ছিল আমার করতলে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম তোমার সমস্ত শরীরের দিকে। তোমার পরণে সিকিমি পোষাক। শরীরের অনেকখানি অনাবৃত। রেখেছো তুমি-হয়তো কোন পুরুষ পতঙ্গের মন ভোলাবে বলে। কেননা বিধাতা তোমার বিধিলিপিতে যে গদ্য রচনা করেছে, সেখানে তো ছন্দের কোন স্থান নেই। এমন ভাবেই তোমাকে রাতের সহচরী হয়ে মন ভোলাতে হয় এখান সেখান থেকে ছুটে আসা পুরুষ পর্যটকদের। সাজতে হয় তাদের কাগজের বউ। তারপর যেমন বসন্ত অবসানে ঝরে যায় মৌসুমী ফুলেরা, তেমন ভাবেই একদিন হারিয়ে যায় ঐসব পুরুষ পর্যটকদের দল।
বাসস্ট্যান্ডে শেষবারের মতন লাল রুমাল উড়িয়ে যাও তুমি। তোমার চোখ টলটল করে একটুখানি জল। সেই জল ওড়নাতে মুছে নিজেকে দাঁড়াতে হয় এক সুন্দরী স্বৈরিনীর বেশে।
হায় অন্বেষা। এ জীবন এভাবে সকলের জন্য শরীর বিলিয়ে দিয়ে, বিনিময় কি পাবে তুমি? হয়তো তোমার পার্স আরো একটু পৃথুল হবে চকচকে টাকার আলিঙ্গনে। হয়তো তোমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আরো একটু আহঙ্কারিক হবে ঐ পুরুষ সঙ্গীদের দেওয়া কোন আন্টিক উপহারে। কিন্ত রাতের শেষ যখন চোখের কোণে জমবে। আরো একটু বিষন্নতার কালি, যখন কিছুতেই ঘুম আসবে না। তখন কি ক্ষণকালের জন্য তোমার মনে হবে না - বৃথাই এই ব্যর্থ দিনযাপন। যদি আর একবার সুযোগ আসে তাহলে তুমি কোন এক পাহাড়ী তরুনীর মত তোমার প্রাত্যহিক জীবনকে সাজিয়ে তুলবে মৌসুমী ফুলের সহস্র বাহারে।
এসব তো কথার কথা অন্বেষা। আমিও জানি এইসব স্বপ্ন চিরদিন থেকে যাবে। তুমিও জানো তা। তার চেয়ে এসো, বর্তমানকে মুঠোবন্দী করে আমরা মেতে উঠি শরীর আর মন নিয়ে এক আশ্চর্য বাঘবন্দী খেলায়।
অন্বেষা, মনে কি আছে তোমার? দাঁড়িয়েছিলে তুমি একা সেই বাসন্তী সকালে? তোমার পরনে ছিল একটি রাতকালো পোষাক। অসম্ভব ফর্সা রঙ তোমার। সমস্ত শরীর থেকেই সেই অনাবিল আশ্চর্য সৌন্দর্যের দীপ্তি সহস্র হীরক প্রভায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আমি নেহাতই এক সখের ট্যুরিস্ট হিসাবে পা রেখেছিলাম সিকিমে-দেখতে তার বসন্ত বাহারে।
সিকিম তো চিরদিনই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তার লেক, তার গুল্ফা, তার ঝর্ণা, আর তার ফুল আর পাখী - সবকিছুই আমাকে মাঝরাতে উতলা করে দেয়। সেই সিকিমে পা রেখেই যে তোমার মত এক বান্ধবীর সাথে আমার দেখা হবে, ভাবতেই পারিনি তা।
একটু আগে শুনেছিলাম, চোখ খোলা রাখলে আর মনকে আকাশের মত বিস্তৃত করে দিলে নাকি সিকিম ভ্রমণের পথে প্রান্তরে এমন কত পাহাড়ী তনয়ার দেখা মেলে-অনায়াসে যারা হয়ে ওঠে হৃদয়ের অধিশ্বরী।
মনে শঙ্কা ছিল, সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি আমি। যদিও বেপরোয়া হিসাবে যথেষ্ট কুখ্যাতি আছে আমার। তারপর..... প্রেমিয়াংশি থেকে লাচুং। লাচুং থেকে ইয়ুমথাং। সেখান থেকে আবার গ্যাংটকে ফিরে আসা। পেনিয়াংশি - খেচিপেরি লেক - ইয়াকসাম - তাশিডিং। এভাবেই তো কেটে গেল কয়েকটি দিন।
কখনো বা ইনস্টিটিউট অব তিবেটোলজির প্রশস্ত চত্বরে দাঁড়িয়ে কোন এক ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অস্ফূটে উচ্চারণ করা প্রেমের কবিতা। কখনো অর্কিড স্যাংচুয়ারিতে সবে নামা সন্ধ্যের আধো অন্ধকারে তোমার শরীরের সাথে আমার শরীর মিলেমিশে একাকার করার অনাবিল অপার্থিব মূহূর্তে শব্দহীন মৌনতার মধ্যে মগ্ন থাকা। কখনো ডিয়ার পার্কে কোন বিরল হরিণের সাথে খেলা করতে করতে তোমার হাতে হাত রেখে ভালোবাসার অভিবাদন গ্রহণ করা। মনে কি আছে অন্বেষা? হ্যান্ডলুম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফ্টসের দোকানে দাঁড়িয়ে যখন তুমি সযত্নে চয়ন করছিলে তোমার প্রসাধন সামগ্রী, তখন আমি আমার দামী বিদেশী ক্যামেরাতে ধরে রেখেছিলাম সেই ঈষৎ কাতর অথচ উল্লসিত মুখচ্ছিবিখানি। কলকাতায় কোন এক নিভৃত নিরালায় যারা আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। সেই রুমটেক মনোস্ট্রি, এখানে ইতিহাস যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে পা রাখলে মনে হয় আমরা এখন হাজার বছর আগের পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছি। প্যাসিভিউ পয়েন্ট থেকে হিমালয়কে দেখা, রাতের গ্যাংটকের বুকে বেপরোয়া জীপ চালানো। তারপর ছাংগু। বরফের মাঝে এক আশ্চর্য প্রস্রবণ। সেখানেও এক পড়ন্ত বিকেলে তোমার মধ্যে আমি আবিষ্কার করেছিলাম চিরন্তন সখ্যতাকে।
অন্বেষা, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার। প্রতিটি রাত্রি তুমি আমাকে দিয়েছ অনাবিল আনন্দের স্বাদ। কখনো বা কোন এক সিকিম পানপাত্রে বিদেশী বীয়ারে চুমুক দিতে দিতে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। রাত পোষাকে অনন্যা তোমার আশ্চর্য তনুবাহার দেখে আমি ঠিক থাকতে পারিনি। তুমিও কি আশ্চর্য, অনুগত্যা রমণীর মত আমার প্রতিটি বেহিসাবী ছেলেখেলায় সন্মতি দিয়েছো তোমার সুস্নাত চোখের তারায়। আমি যখন হতে চেয়েছি মধ্যরাতের মাতাল ঘোড়সওয়ার, তুমি এক অভীপ্সায় খুলে দিয়েছো তোমার শরীরের সমস্ত রূদ্ধ দুয়ারগুলি। যেমন ভাবে এক পথহারা পথিক ঔ দূরের দূর্গম শৃঙ্গের আকর্ষণে এগিয়ে যায়, তেমনভাবেই আমি বারবার বিভ্রান্ত হয়েছিলাম তোমার শরীর সুষমায়, চমকিত হয়েছিলাম তোমার তনুবাহারের কুহক মায়ায়। অন্বেষা, বিদায় নেবার সেই সজল সঘন মূহূর্তে আকাশ জুড়ে একটু বৃষ্টির ইশারা ছিল কি? মেঘের কোণে কেই কি জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিষন্নতার নিষ্প্রভ প্রদীপ শিখাগুলি? সেদিন তুমি পরেছিলে, স্পষ্ট মনে আছে আমার, এক টকটকে লাল পোষাক। কামনার লাল রঙ বেয়ে ধেয়ে আসা ঐরাবতের মত সমস্ত বাসনা তোমার সমস্ত শরীর জুড়ে মেহুহীনের বেহালা হয়ে বাজছিল। অন্বেষা, তুমি আমার চোখে চোখ রাখতে পারো নি। আমি যখন শেষবারের মত স্পর্ষ করেছিলাম তোমার মধ্য অনামিকায়, পরিয়ে দিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার একটি ছোট্ট উপহার, সহসা তোমার মুখের পানে কি কোন এক বিধ্বংসী ঝড়ের সংকেত লেগেছিল, অন্বেষা? তুমি দুহাতে মুখ ঢেকেছিলে। তোমার চোখ থেকে ছুটে আসা বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণাগুলোকে আমার সামনে ক্ষণকালের জন্য উদ্ভাসিত হতে দাওনি তুমি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। আর ভেবেছিলাম তুমি তো এক স্বৈরিণী। কিছু অর্থের বিনিময়ে এমনভাবে যে কোন পর্যটকদের হাতে অনায়াসে তুলে দিতে পারো তোমার শরীরের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলি।
তাহলে এই কান্না, এই ক্ষণবিহ্বলতা, এই শোকের সকরুণ আর্তনাদ, এসব কি তোমার সাজানো ইচ্ছার অভীপ্সা? এমন ভাবেই তুমি তোমার পেশাদারী দক্ষতার মধ্যে আর একটু অভিমানের অঞ্জলী এনে ভোলাতে চাও পুরুষের মন আর এভাবেই স্ফীত করতে চাও তোমার বুকের খাঁজে লুকিয়ে রাখা পার্সটিকে।
বাস ছেড়ে দিয়েছিল। পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে ক্রমশই অদৃশ্য হয়েগেছিল তোমার অবয়বখানি। তখনো আমার হাতের মুঠোর মধ্যে তোমার পরশ। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে তোমার শরীরের ভালোবাসার টুপটুপ বৃষ্টিপাতের সকরুণ ঘন্টারধ্বনি। শহর কলকাতাতে পা রাখা সত্ত্বেও তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি অন্বেষা। এখানে অজস্র আলোর ঈশারার মধ্যে, অসংখ্যা বান্ধবীর শরীর সান্নিধ্যে দাঁড়িয়েও বারবার আমার মনে পড়ে যায় সিকিমের সেই দিগন্ত বিস্তৃত তুষার আচ্ছাদিত প্রান্তরগুলিকে। মনে পড়ে গুল্ফার অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে বাজিয়ে যাওয়া স্বর্ণঘন্টাধ্বনির শব্দগুলি, মনে পড়ে কোন এক মধ্যরাতে তোমার শরীর থেকে শেষতম ওম শুষে নিয়ে মেতে ওঠার সেই আশ্চর্য সান্দ্র কুয়াশাছন্ন মূহূর্তগুলি।
অম্বেষা বলো তো? এমন ভাবে এক যুবকের বেঁচে থাকার প্রতিটি প্রহরকে রক্তাত্ত করে বিনিময়ে কি পেলে তুমি? সীমাহীন শূন্যতা ছাড়া।।
সমাপ্ত