Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
09-12-2020, 01:04 PM
(This post was last modified: 09-12-2020, 05:09 PM by Trambak. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
অনেকদিন পর। কিছু বন্ধু আমার তিন বছর আগে লেখা গল্পটার রিপোস্ট অনুরোধ করেছেন। দিলাম
1
জব্বর ছিল কিন্তু প্ল্যানটা। ঠিক সন্ধ্যা পাঁচটা দশে সুহাসকে ফোন করলাম, দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে, ১২-B বোর্ডিং গেটের সামনে বসে। সামনে বিশাল জনসমুদ্র। তিনটে রিং আর ওপার থেকে ভদ্রমহিলার 'শ্বাসরুদ্ধ' কণ্ঠস্বর জানান দিলো যে 'অল ইস ওয়েল।' কল করার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে রঞ্জু বললো, "বাবা, আজ শুক্রবার, দু ঘন্টা মোবাইল বন্ধ রাখলে মা কিন্তু সন্দেহ করবে।" তাই............
"এই যে, ডেঙ্গু মিটিং শুরু হবে এক্ষুনি, কতক্ষন চলবে কে জানে?"
"হুঁ, তো?"
"বলছি যে মোবাইলটা অফ করছি, আমাকে পাবে না।" নিরৎসুক ভাবে জানাই।
"ও, পেছনে কিসের চিল্লামিল্লি হচ্ছে? তুমি এখন কোথায়?" উনি অনুসন্ধিৎসু।
খেয়েছে! একটু তাড়াহুড়ো করি, "এই মানে…, আমি মিনিস্ট্রিতে, মানে… প্রচুর লোক গিজগিজ করছে।"
"সকালে তো কিছু বললে না, হটাৎ?"
চোরাবালি আর কাকে বলে!
এর মধ্যেই হটাৎ বোর্ডিংয়ের জন্য জনৈক মহিলার ঘোষণা এবং সমগ্র ভারতবর্ষের জনতা একসাথে উঠে দাঁড়ালেন। প্রলয় এলো বলে।
এদিকে সুহাসিনীদেবী প্রশ্নবাণ চালাচ্ছেন, "কোথায় যেতে বলছে?"
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই...? শ্রীগুরুর কৃপায় মাথায় বুদ্ধি এলো, "মিনিস্টার এসে গেছেন, এবার আসি।" বলে দ্রুত ফোনের সুইচ অফ করলাম। ফাঁড়া কাটলো।
কপালের ঘামটা মুছে ফেললাম।
তিনি মোটেও জানেন না যে আমি হটাৎ করে পুণা এসে ওনাকে 'চমকে' দেব।
সাপের মতো আঁকা বাঁকা লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দিনের ঘটনাবলীর ওপর চোখটা বুলিয়ে নিলাম। সদাশয় সরকার বাহাদুরের সৌজন্যে শনিবার আচমকা ছুটি তদুপরি মঙ্গলবারে আবার ছুটি। মোদ্দা কথা, সোমবার ছুটি নিলে চারদিন। রঞ্জুকে অনেক বললাম সাথে আসতে কিন্তু আজকাল তার মতিগতি বোঝা ভার। সর্বক্ষন বিরক্ত ‘অকেজো' মা বাবার ওপর।
লক্ষ করলাম যে লাইনে খানিকটা পিছিয়ে গেছি। কিছু লোক মাঝখানে ঢুকে, ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠে (এমন ভাব যেন শেষের কুড়ি জনকে ওরা ছেড়ে চলে যাবে), পেল্লায় হ্যান্ডব্যাগগুলো মারাত্মক ভাবে ওপরে রেখে, এবং আমার পা মাড়িয়ে চূড়ান্তরূপে জানান দিলো যে আমরা নির্ভেজাল ভারতীয়।
বাকি আড়াই ঘন্টা কাটলো ছোটোখাটো জীবনমরণ সমস্যার মাধ্যমে যথা, আমার পার্শ্বস্থ দুই সহযাত্রী মাঝেমধ্যেই গুঁতো মারলেন আর্মরেস্টটার দখল নেবার জন্য আর 'গোদের ওপর বিষফোঁড়,' এয়ারহোস্টেস মহোদয়া মনে হলো ক্ষুন্ন হলেন কিছুই না কেনার দরুন।
শেষমেশ, প্লেন বাবাজি নামলেন ও থামলেন। মুহূর্তেরমধ্যে সর্ব মনুষ্যজাতি উত্তিষ্ঠ হলেন, কোথায় যাবেন ঈশ্বর জানেন। করিডোরে দাঁড়িয়ে রঞ্জুকে ফোনে ধরলাম। ভাবলেশহীন উদাসীন কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, "পৌঁছালে?"
"হুম। কোনো খবর?"
"ফোন এসেছিলো।"
"কিছু জিজ্ঞাসা করলো নাকি?"
"তোমার whereabouts জানতে চাইছিলো।"
"তা তুই কি বললি?"
"বললাম, জানি না। "
"ঠিক তো? আর কি বললি?"
"আর কিচ্ছু না! আমি জানি কি বলতে হবে, ultimately গন্ডগোলটা কিন্তু তুমিই করবে বাবা!"
লাইনটা কেটে দিলো! আজকালকার ছেলেমেয়েরা মা বাবাকে সম্মান দিতে জানে না। আমাদের ছোটবেলায় এরকম করলে কানটা..........., সে যাক গে।
পেছন থেকে একটা বলিষ্ঠ ঠেলা খেয়ে চিন্তাধারার সূত্রটা ছিন্ন হয়ে গেলো। ভিড়ের সাথে প্লেনের দরজার বাইরে প্রসব হলাম 'ডিম্বের' ন্যায়।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই 'ওলা' গাড়ি চড়ে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আর আধঘন্টা, ব্যাস!
এইবার সময়! সুহাসীনিকে ফোন করলাম। সেই তৃতীয় রিঙে হাঁফধরা আওয়াজ। সব ঠিক হ্যায়।
"কি, গাড়িতে নাকি?" ওর প্রশ্ন।
এবার অসংশয়ে বলে ফেললাম, "হ্যাঁ।"
"মিটিং হলো?"
প্রাণ খুলে হাসলাম, "ধুস! কিসের মিটিং আর আমার কথা শুনছেই বা কে, যা বলি সবই নাকচ হয়ে যায়? আমি তো ভালো চা আর টা খেতে গিয়েছিলাম। তোমার কি চলছে?"
"আরে শোনো না! তোমার ফোনের পরই আদির ফোন এলো। পুণা ক্লাবে একটা গেটটুগেদার আছে তাতে বস স্পেশাল ইনভাইট করেছেন।"
"কী করবে? চলে যাও। কারো বিবাহবার্ষিকী টার্ষিকী নাকি?"
"না বোধহয়। ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞাসা করবো তা তোমার মোবাইল তো সময় বুঝে অফ। তারপর হ্যাঁ বলে দিলাম, আদি এসেছে, কথা বলো।"
আদিত্যে, ছেলেটা ভালো, একটু উত্তেজনাপ্রবণ, সবসময় ব্যস্তসমস্ত ভাব। অল্প সময়ের মধ্যেই ওর ছটফটে গলা শুনতে পেলাম।
"স্যার, দিল্লির কি খবর, আপনাকে খুব মিস করি আমরা।"
"বাজে কথা, তোমরাই তো আমাকে ঠেলেঠুলে পাঠালে। যাই হোক, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমার বৌ কে?"
"স্যার, পুণা ক্লাবে গেটটুগেদার, অনেক রিকোয়েস্ট করতে হলো, তবে মানলেন।"
"কংগ্রাচুলেশন। আমার কথা তো উনি কক্ষনো শোনেন না। তা কখন শেষ হবে?"
"স্যার, ম্যাক্সিমাম দশটা। আমি ছেড়ে যাবো।"
"ঠিক আছে ভাই, নিয়ে যাও কিন্তু ফেরত দিয়ে যেও।"
"স্যার, কি যে বলেন, কথা বলুন ম্যাডামের সাথে।"
"তোমরা রাত্রে কি খাচ্ছ?" ওনার প্রশ্ন।
"কি আর খাবো, আমাদের তো আর পার্টি নেই।"
"ইশশ, কি জেলাস। তোমরাও গিয়ে পার্টি করো না, ‘ফ্যাটি বাও’ চলে যাও।"
"দেখি কি করি," বলে লাইন কেটে দিলাম।
পরিকল্পনাটা সামান্য পাল্টাতে হবে। প্রায় মিনিট পনেরো পৌঁছাতে বাকি এখনো। নিঃসন্দেহে, ওদের মিস করবো। যাকগে, আমার কাছে একটা চাবির গোছা থাকে আলাদা করে। অনেক রকম বিচিত্র প্ল্যান ভেঁজেছিলাম, ভেস্তে গেলো। আমাদের ফ্ল্যাটটা একটা কমপ্লেক্সের ভেতরে। গার্ডের চোখ এড়িয়ে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজাটা খুললাম।
ঘরের ভেতরটা ঠিক যেমন ছিল তেমনি পেলাম। তিনমাস আগে এইরকমই একটা সারপ্রাইস প্ল্যান করেছিলাম। যেইনা নক করেছি অমনি ভদ্রমহিলা সেজেগুজে বেরিয়ে এসে বলেলন, "এসেছো, খাবার তৈরী। হাতমুখ ধুয়ে নাও।"
কি রাগ না হচ্ছিলো! পরে বুঝলাম যে আমার অনেকগুলো ছোট ছোট ভুলের জন্য এই বিড়ম্বনা।
আশা করা যাক এইবার সেই বোকা বোকা ভুলগুলো এড়ান গেছে!
আমি একটা আরামকেদারায় বসে চিন্তা করতে লাগলাম। দু ঘন্টা কাটাতে হবে আর একটু ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছিল। আমি সাবধানে ব্যাগটা লুকিয়ে রেখে নিচে নেমে গেলাম। কেউ যেন কিচ্ছু জানতে না পায়। গার্ডটা এবারও আমাকে দেখতে পেলোনা। তারপর? অটো ধরে সোজা 'পাল্প জয়েন্ট', আমার অনেকদিনের ঠেক।
এই পাল্প জয়েন্টের বিষয় দুটো কথা না বললেই নয়। এইখানে, আমরা মানে আমি আর সুহাসিনী একসূত্রে বাঁধা পড়েছিলাম। আমরা দুজনেই ছিলাম কর্মচঞ্চল আর চোখে ছিল বেড়ানোর শখ। টাকা পয়সা ছিল কম আর বদভ্যাস ছিল অনেক তবু....... সুযোগ পেলেই আমরা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতাম পুনার আশেপাশে বিভিন্ন দুর্গগুলোতে। আমাদের জন্য পুরন্দর ছিল রোমান্টিক কেনিলওয়ার্থ, লোনাভালা ছিল গ্রেট ক্যানিয়ন আর কাত্রজের ঝর্ণাগুলো ছিল নায়াগ্রা।
আমরা মনেপ্রাণে ছিলাম 'সর্দার সদাশিবের' চেলা, আজও আছি।
সে কুড়ি বছর আগেকার কথা। আজ আমি চুয়াল্লিশ আর সুহাস একচল্লিশ।
সেই পাল্প জয়েন্টে বসে মনের আনন্দে, দু গ্লাস আখের রস, বাটার চিকেন, ম্যাংগো পাল্প প্লাস দুটো ইন্ডিয়া কিংস সাবাড় করলাম। এ সবই কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মানা।
গোল্লায় যাক মানা।
_____________
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
2
নটা পয়ঁতাল্লিশ। আমি পুণা ক্লাবের দিকে হাঁটা দিলাম। উদ্দেশ্য সারপ্রাইজটা সেখানে গিয়ে দেওয়া। সবে গেটে ঢুকেছি, দেখি আদিত্যর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেলো, সুহাশকে দেখতে পেলাম সামনের সিটে বসে কিন্তু ওরা আমাকে দেখতে পেলনা। কি মুশকিল, বোকারমতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দ্বিতীয় সিগারেটটা না খেলেই হতো। লোভে পাপ।
আবার প্ল্যান বদল।
আধঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে একটা বাসে চাপলাম, সেই নস্টালজিয়া ভরা পুণা বাস। ঠিক এগারোটায় বাড়ি পৌছালাম, দাঁড়ালাম দরজার সামনে। দারোয়ানজি পূনরায় অন্যত্র তাকিয়ে।
সেই আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন লক্ষ করেছিলাম যে সদর দরজাটা প্রচুর ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে তাই খুব করে WD ৪০ নামক একটা নবীন স্প্রে ব্যবহার করেছিলাম। তাই দরজা খুললো নিঃশব্দে, যেন রোলস রয়েস।
চমক দেবার সময় আগত। হুঁ হুঁ, বারে বারে ঘুঘু তুমি-------
বসার ঘরের কোনে একটা ছোট টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। ছায়াগুলো ঘরটাকে আরো অন্ধকার করে তুলেছে।
শুধু একটা শব্দ আসছে। আমার শোবার ঘর থেকে।
আমি পাথরের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মতন নিরুদ্যম নির্বিকার মানুষও বুঝল সে কিসের অস্ফুট আওয়াজ, কিসের শীৎকার, আমি বুঝতে পারলাম।
নির্মম দুঃস্বপ্ন? এমনও হয়?
অন্যদের হয় জানতাম। আমার কেন হতে যাবে? এতো নিশাস্বপ্ন, এখুনি ভাঙবে দেখো!
কি অবাস্তব পরিস্থিতি। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
আমি এখন কি করি? দৌড়ে যাই; চিৎকার করি বা বাইরে চলে যাই। কি করি?
আবার সেই আরামকেদারায় গিয়ে বসলাম, দ্বিতীয়বারের জন্য।
আমি বাকশক্তিহীন, আওয়াজটা আস্তে আস্তে কমছে। অন্তে নীরবতা।
কতক্ষন? জানি না। সময়টা দেখিনি। বোধহয় থেমে গেছে।
ক্ষীণভাবে বুঝলাম, আমি আমার বসার ঘরে বসে।
সারপ্রাইসটা সম্পূর্ণভাবে আমাকেই গ্রাস করেছে।
মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। আমার তো কোনো ফোন আসবে না। আমি চাই না যে ফোন আসুক।
দিনের সমস্ত ঘটনাগুলো যেন একটা ছন্নছাড়া সিনেমার স্ট্রিপের মতন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্লেন, গাড়ি, বাড়ি, পাল্প জয়েন্ট, টেলিফোন, গার্ড, রঞ্জু। আর আমি বসে আছি এখানে, কি করবো জানি না। কোনো প্রতিক্রিয়া কি দেওয়া উচিত?
আবার সেই ফোনের রিং, দূরে কোথাও। আমার কিচ্ছু যায় আসে কি?
শুধু তার একটা কথা কানে এলো, "কি বলছিস তুই?"
তার পর দীর্ঘ নীরবতা। আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে এসে ঢুকলো ঘরে। আমরা সামনাসামনি। ও আমার দিকে চেয়ে রইলো; আমিও।
কে বলবে কথা?
একটা ন্যুব্জ মানুষের আকৃতি নিঃশব্দে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। মাথা নীচু। একটা ছায়ামূর্তি। কোথায় সেই সুশ্রী, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সুঠাম ছেলেটা, যাকে আমি চিনতাম, ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম?
"আদির যাওয়া উচিত," আমি বললাম।
আমি নিজেকেই আশ্চর্য করে উঠে দাঁড়ালাম, স্বাভাবিক ভাবে বললাম, "আয়, তোকে ছেড়ে আসি।"
দরজাটা আরো একবার খুলে গেলো। আমি নামলাম, পেছনে তাকালাম না।
আদি হ্রস্ব কণ্ঠে বললো, "গাড়িটা বাইরে।"
একটু দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে উঠে ও আমার দিকে তাকালো, কিছু বলতে চায়।
"সাবধানে যাস।" আমি ফিরে গেলাম।
হটাৎ একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া শিরশিরিয়ে দিলো আমার সারা শরীর। আমার বুকের ভেতরের ঠান্ডাটা অনুভব করলাম।
এবার গার্ড আমায় দেখলো, "স্যার, আজ এলেন বুঝি?" ভালো আছেন?"
মাথা নাড়লাম।
"গেস্টদের বলবেন গাড়ি ভেতরে আনতে, আমি পার্ক করিয়ে দেব।"
"আচ্ছা" এই বলে আমি ঘরে ফিরলাম। আবার সেই বন্ধ দরজা। কি করি?
প্রায় বারোটা বাজে, হাসি পেলো। সময়টা যেন কেমন, শূন্যতা।
নক করবো, বেল বাজাব? দিশাহারা আমি
দরজাটা খুলে গেলো। প্রতিবারের মতো, শব্দহীন। ও একপাশে দাঁড়ালো দরজার।
বিষন্ন আতঙ্ক ওর চোখেমুখে, সারা শরীরে। আমরা দুজনে এক ভয়ঙ্কর নাটকের পাত্রপাত্রী, নাটক ভালোবাসি কিন্তু এই নাটকের টিকিট তো আমাদের কেনার কথা নয়। তবু, বসে আছি প্রথম সীটে। মিলনান্ত, বিয়োগান্ত নাকি প্রহসন?
দাঁড়িয়ে আছি, ও মুখ নিচু করে, বললো, "খেয়েছো?"
অন্যসময় হলে আজকের মেনুটা নিয়ে একচোট হয়ে যেত। আজ শুধু বললাম, "হ্যাঁ।"
"ঘুমাবে?"
"হ্যাঁ।"
বিহ্ববলভাবে শোবার ঘরে ঢুকলাম। এরমধ্যেই বিছানার চাদর পাল্টানো হয়েছে। শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে হাতের ওপর মাথাটা চেপে, জামাকাপড় না খুলেই।
ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার। এই কালিমা যে কত গাঢ় হতে পারে, আজ উপলব্ধি করলাম। আজ সমস্ত চেতনা স্তিমিত। গভীর আঁধার শুষে নিয়েছে আমাকে সম্পূর্ণভাবে।
বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, চোখটা খুলে গেলো, অন্ধকারটা কিছুটা সয়ে গেছে। আমার পিঠে ওর হাত আর মুখটা আমার হাতের ওপর, সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা। মুখটা ঘুরিয়ে দেখলাম, তার অবিরাম নীরব চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আমার হাত।
আমার কি করা উচিত?
এই নষ্ট মেয়েমানুষটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দি?
বা, চুপচাপ যেমন আছি তেমনি শুয়ে থাকি?
না, আমার সাথী, আমার প্রিয়া, তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দি?
আমি কি করি?
_________
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
3
ও কেন কাঁদছিলো?
আপনারা হয়তো এই প্রশ্নের উত্তরে উপহাসের একটি হাসি হাসবেন। সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত। কেন প্রতারক হাতেনাতে ধরা পরে কান্নাকাটি করে? অবশ্যই নিজেকে বাঁচাতে, প্রমাণ করতে যে সে যারপরনাই দুঃখিত। এক্কেবারে সঠিক ধারণা, এক্কেবারে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তাদের পক্ষে যারা সুহাসকে ঠিক জানেন না। আমি কিন্তু ওকে চিনি অন্যভাবে!
তখন আমাদের মেয়ের বয়স দুই। সুহাস সমস্ত জামাকাপড় নিজে সেলাই করতো। খুব দক্ষতার সাথে। এক সন্ধ্যায় আমি টিভি দেখছি, হঠাৎ একটা ক্ষীণ কিন্তু যন্ত্রণাকাতর আওয়াজ শুনে ছুটে গেলাম। দেখি, ছুঁচটা তার আঙুলের নখ আর হাড় ভেদ করে মেশিনে আটকে আছে। ও লজ্জিতমুখে বসে, ক্ষণিকের অমনোযোগিতায় এই বিভ্রাট। ও বিব্রত কেননা দোষটা তার। মুখে একটু বোকা বোকা হাসি কিন্তু চোখে কোনো জল ছিলোনা। সেই ছুঁচটা বের করতে বেশ অসুবিধা হয়েছিলো, ও টুঁ শব্দটি করেনি।
আমি ওকে কখনো কাঁদতে দেখিনি।
আজ ওর চোখে জল?
তার সেই চোখের জল অবিরল বয়ে চলেছে নিঃশব্দে। চোখ নিচু, মাথা নিচু, চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার হাতের ওপর, ও থামাবার চেষ্টা পর্যন্ত করছে না। সেই চোখের দিকে তাকাবার বা তার ভাষা পড়বার সাহস আমার নেই। সেই নীরব অশ্রু কি বলতে চায় জানি না, প্রস্তুতও না।
তবু তাকালাম ওর দিকে, ও আমার টিশার্টটা আঁকড়ে ধরলো। উল্টোদিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম... কষ্ট তো আমারও কম নয়।
সারাদিনের ক্লান্তি আর উদ্ভট অবাস্তব ঘটনাগুলো আমার চিন্তা করার শক্তি অসাড় করে দিয়েছিলো। একটা সামুদ্রিক আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম।
অদৃষ্টক্রমে চোখ জড়িয়ে এলো গাঢ় ঘুমে। হাতটা ভিজতেই থাকলো। নাঃ, ঘাম না।
ভোরের প্রথম আলো চোখে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ও পাশে ঘুমাচ্ছে, ছোট্ট এক শিশুর মতন, হাঁটুটা বুকের কাছে টানা। অক্ষম, দুর্বল, শক্তিহীন। কি ভেবে চাদরটা দিয়ে ওকে ঢাকা দিলাম। ও চাদরটা চেপে ধরলো। ঘুম ভাঙলো না।
রান্নাঘরে ঢুকে চা বানালাম। রান্নাঘরের ওই একটাই কাজ করার অনুমতি সুহাস আমাকে দিয়েছে, বরং কিছুটা প্রশ্রয়ও দেয়। কি মনে করে, দুজনের মতো জল নিলাম। দশ মিনিট ভেজাতেই সেই পুরনো গন্ধ ভেসে এলো, আগের মতোই। চুমুক দিয়ে দেখলাম, কোন অন্য স্বাদ তো মনে হলো না, তাহলে কি পালটেছে? কিছু কি আদৌ পাল্টালো?
যুক্তি বলে, সব, সব বদলে গেছে। শুধু আমার প্রতিক্রিয়াটি যথাযথ নয়। আমার নিজের ব্যবহার অদ্ভুত, জানি। আমার তো রাগে উন্মাদ হওয়া উচিত। সেই হবে সঠিক, সমর্থনযোগ্য ব্যবহার। সে স্থানে, আমি যেন এক পাথর; ব্যথা, অপমান, লাঞ্ছনা, সমস্ত বোধশক্তির ঊর্ধ্বে।
নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কোথায় গেল আমার সেই উদ্ধত মেজাজ?
পরিশেষে, বসে চিন্তা করলাম; নিজের আর আমাদের গত ২০ বছরের জীবনের পর্যালোচনা। হঠাৎ মনে হোল আমরা পরস্পরের সাথে যতটা সময় কাটিয়েছি তা মা বাবার সাথেও কাটাই নি। আশ্চর্য লাগলো ভেবে। আমরা একে অপরকে যতটা জানি; আমাদের ছোটোখাটো প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলি... তা বোধহয় তাঁরাও জানতেন না। ছোট, বড় কতকিছু একসাথে করেছি।
আমার মাথার ভেতরে যে জালটা তৈরী হয়েছিল তা সহসা পরিষ্কার হয়ে গেলো। আমার কি করা দরকার, তা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট।
এই উদ্ভট আচরণের ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। মনের গ্লানি, সংশয় আর নেই।
আমি শোবার ঘরে ফিরে আলতো করে ওকে জাগালাম। ও শূন্য চোখে তাকালো আমার পেছনের দেয়ালটাতে। আমি প্রথম কথা বললাম, যা আমি অজস্রবার আগে বলেছি, "চলো, চা তৈরী।"
মুহূর্তের জন্য ও অবাক হয়ে তাকালো। আর সমস্ত লজ্জা ঝাঁকবেঁধে ঘিরে ধরলোপরমুহূর্তেই। মাথাটা বিমূঢ়ভাবে নাড়িয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। ওর লম্বা কালো চুল অবিন্যস্ত, ভালো লাগছিলো। আমি বাইরে চলে এলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরে ও এসে ঢুকলো, আমরা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আর এক প্রস্থ চা নিয়ে। বিস্কুট দিয়ে চা খেলাম, বছরের পর বছর যা করে আসছি। যা ছিল সব তেমনি আছে। শুধু সুহাস চুপ করে বসে আছে, চোখদুটো কাপের দিকে নিবদ্ধ।
যদিও প্রথমটা আমার নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কানেই খাপছাড়া লাগলো, একটু ভেবে বললাম, "সুহাস, আমি কিছু বলবো আর তুমি মন দিয়ে শুনবে। শুনবে কি? শোনো, হঠাৎ একটা মুহূর্তের ঘটনা কখনও প্রকৃত সত্য হয় না। কালকের ঘটনা আমাদের জীবনের একটা মুহূর্ত মাত্র, তার ব্যতীত আর কিছু নয়। আমার জীবনে তোমার মূল্যায়ন একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কখনোই হবে না। কারণ আমি জানি, তুমি কে; তুমি আমার কি। যদি বলো দুঃস্বপ্ন, আমি মানতে রাজি। তার বাইরে কিছু না। কিছু পাল্টায়নি।"
সুহাসিনী ঘাড় নামিয়ে বসেই থাকলো। ওকে আমি কখনো এই রূপে দেখিনি, ওর মাথা সবসময় উঁচু। আজ ওর বিধ্বস্ত শরীরী ভাষা আমাকে অনেক বেশি দুঃখ দিলো; ও যা করেছে তার থেকেও।
"শুনছো! কি বলছি! ও কিছু নয়।"
ও উঠে দাঁড়ালো, তাচ্ছিল্যভরে বিড়বিড় করে, "কিছু নয়?" বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। ভেবেছিলাম সব ঠিক করে দেব। আমি কি ভুল করলাম?
কিন্তু আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আমাকে সাবধান করছে যে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানো দরকার। জবাবদিহি পরে হবে। অবস্থা যেন কোনোমতেই হাত থেকে বেরিয়ে না যায়।
ওকে খুঁজে পেলাম বিছানার পাশে বসে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে দিয়ে। ও চুপ করে বসে রইল, আবেগশূন্য, ভাবলেশহীন।
জীবন্মৃত।
ব্যাপারটা বেশি না ঘাঁটানোটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো আমার। পেছনের ঘরটার থেকে আমার ব্যাগটা উদ্ধার করে আনলাম। ভাবলাম, যদি ব্যাগটা বসার ঘরে ছেড়ে যেতাম, তাহলে হয়তো...........
ব্যাগে একটা 'আই প্যাড' এনেছিলাম, রঞ্জুর পরামর্শে। কিনেও এনেছিল ও।
কিছু করার নেই। ব্যাগটা খালি করলাম আর বাথরুমে অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করলাম।
বেরিয়ে দেখি, আমার প্রিয় ব্রেকফাস্ট 'লুচি আলুর ছেঁচকি।'
সেই আগের মতনই, তফাৎ একটাই, চারদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। যদিও বাড়ির প্রতিটি কাজ চলছে ঘড়ির কাঁটা ধরে।
আর একবার চেষ্টা করা যাক, "যাবে নাকি বিকালে ডিনার করতে?"
ও মুখ তুলে তাকালো। নিরুৎসুক দৃষ্টি... “কোথায়?”
আমি বেশ খানিকটা উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, "কেন! চাইনিজ রুম!"
এর পেছনে একটা কারণ ছিল। এই রেস্তোঁরাটার কথা যখনি আগে উঠেছে, সুহাস একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছে। বলেছে, "টাকা কামড়াচ্ছে, নাকি?"
এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো কথাবার্তা চালু করা যায়।
দেখলাম কী যেন ভাবছে। আমি বললাম, "অবশ্য, টাকার শ্ৰাদ্ধ, অন্য কোথাও যাওয়া যাক। "
ও একটু চুপ করে বললো, "না, তোমার পছন্দ, ওখানেই চলো।"
সন্ধ্যাটা বিপর্যয় বলা যেতে পারে অনায়াসে। ও চুপ করে বসে থাকলো। আমি একই কথা বলে গেলাম। ও প্রায় কিছুই খেলো না। আমি ওকে ‘আই প্যাডটা’ দিলাম। ওটা হাতে নিয়ে ও শুধু বললো, "এতো দামি জিনিস নিয়ে আমি কি করবো?"
অতি কষ্টে সময়টা কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
আবার সেই রাত, সেই বিছানা আর সেই নীরবতা। কিন্তু জাগতিক নিয়মে রাতের পর দিন; শনিবারে পর রবিবার আসতে বাধ্য।সকালে ঘুম ভেঙে দেখি বিছানা খালি। সাধারণতঃ আমি সবার আগে ভোরে ঘুম থেকে উঠি, দেরি হয়ে গেছে।
সুহাস টেবিলে বসে ছিল, আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, ওর কাছে বসলাম।
ও আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, "তুমি দিল্লি ফিরে যাও। "
ঘাবড়ে গেলাম, তবু হালকা মেজাজে বললাম, “সে তো মঙ্গলবার। যেতে তো হবেই ।"
আমার ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে বললো, "না, তুমি আজই ফিরে যাও।"
এই দুদিনে, প্রথমবার আমার মাথা গরম হয়ে গেল, হয়তো নিরাশায়, বলতে পারি না। দুত্তোর, আমি কি খেলার পুতুল যে তুমি যেমন চাইবে আমি তেমনি করতে বাধ্য? অনেক কষ্টে দাঁত চেপে বললাম, "কেন, কী ব্যাপার?"
ঠিক একইভাবে চোখ না সরিয়ে বললো, "আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হবে। তুমি এখানে থাকলে হবে না। তোমাকে যেতে হবে।"
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, তবু বোঝাবার চেষ্টা করলাম, "সুহাস! কিচ্ছু ভাবার নেই, সব ঠিক আছে। আমি বলছি। কেন বুঝতে পারছো না?"
ম্লান হেসে ও বললো, "তাই নাকি? সব ঠিক আছে? তোমার জন্য হতে পারে, আমার জন্য নয়!"
শেষবারের মতো চেষ্টা করলাম, চেঁচিয়ে বললাম, "হঠাৎ করে দিল্লি ফিরবো। রঞ্জু জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো?"
ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে ও আস্তে করে বললো, "ওকে সত্যিটাই বোলো।"
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
4
আমার কাছে আদৌ কি কোনো বিকল্প আছে? অনুনয় বিনয় করার সময় পেরিয়ে গেছে। দিল্লি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। রঞ্জুর প্রশ্নের উত্তর আপাতত আমার কাছে নেই! তাছাড়া আমার দ্বারা লুকোচুরি হয় না।
কিন্তু এখানে আর থাকা যাবে না, কোনোমতেই। নটার মধ্যেই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেলাম। কয়েকটা মাত্র কথা হলো আমাদের মধ্যে।
"আই প্যাডটা ফেরত নিয়ে যাবো কি?"
"ওরা কি ফেরত নেবে?"
"না।"
"তবে রেখে যাও।"
কোনো বাই বাই' কোনো হাত ধরা বা নিদেন পক্ষে, "পৌঁছে ফোন করে দিও" কিছুই হলো না।
কি মনে হয়? আমাকে লাথি মেরে তাড়ালো?
নিশ্চয়ই!
দোষটা কি আমার?
কক্ষনোই না!
এই অপমান কি আমার প্রাপ্য?
না, না, না।
একটা অটোরিকশা নিয়ে স্টেশন চলে গেলাম। অনেকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই। স্টেশনের বাইরে একটা ড্রাইভার প্যাসেঞ্জার খুঁজছে। বসে গেলাম। এক সহযাত্রী দুএকটা ছোটোখাটো প্রশ্ন করলো। আমি উত্তর দিলাম না।
দু দিন এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ালাম। মঙ্গলবার সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছালাম। রঞ্জু দরজা খুলে দিলো।
"মা’র আই প্যাডটা পছন্দ হলো?" ওর উৎসাহিত প্রশ্ন।
"খুব!"
"তুমি সব ফীচারগুলো দেখিয়েছো তো, তোমার তো অর্ধেক কথা মনে থাকে না?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ দেখিয়েছি, তুই আমাকে কি মনে করিস বল তো?" আমি বিরক্ত।
রঞ্জু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওর ফোন বেজে উঠলো? আমি ছাড়া পেলাম।
গতানুগতিক জীবন, কোনো উত্তেজনা নেই; দিনগত পাপক্ষয়। কিছুই বদলায়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে 'বদল' শব্দটা আমার রোজনামচায় একটা 'অবসেশন ' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দু সপ্তাহ কেটেছে, তার কোনো খবর নেই। আমি পাগলের মতো চুপি চুপি প্রতিটি বৈদ্যুতিন ঠিকানা চেক করি, প্রতিদিন। কিছু নেই। নিরুৎসাহ হয়ে পড়ছি। আজ আবার মঙ্গলবার, ঠিক চোদ্দদিন হলো। একটা ছোট্ট মেসেজ, 'চেক মেল্ '!
তড়িঘড়ি করে মেল্ খুললাম। একটা মেসেজ আর একটা এটাচমেন্ট।
"কিছদিনের ছুটি নিয়ে আসবে? জন পিন্টো এয়ারপোর্টে থাকবে।"
সঙ্গে প্লেনের টিকিট; ডাবোলিম, গোয়া ।
আমার হাতে চব্বিশ ঘন্টা, এসবের মানে কি? গোয়া কেন? যাই হোক, একটা 'ওকে' বার্তা পাঠিয়ে দিলাম।
ছুটি পেতে কোনো সমস্যা হলনা। রঞ্জুকে ফোনে করে জানালাম যে একটা বিশেষ সরকারি দরকারে আমাকে যেতে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ, ও কোনো অস্বস্তিকর জেরা করলো না। বিকালে আমরা দিল্লির 'সাকেত" মলে ডিনার করতে গেলাম। সামনেই 'ফ্যাবিন্ডিয়া', ঢুকে পড়লাম; একটা জ্যাকেট চোখে লেগে গেলো, রঞ্জুকে দেখলাম। ও চট করে দামটা দেখে ভুরুটাকে ছাত পর্যন্ত তুলে দিলো। যেমন মা তেমনি মেয়ে। চুলোয় যাক দাম, কিনে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম রঞ্জু আড়চোখে আমাকে দেখছে।
কাকভোরের এই অদ্ভুত আকস্মিক যাত্রা আমাকে চিন্তা করার পাথেয় যোগালো। কেমন যেন রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার। অনেকটা কিরীটি রায়ের গল্প। জন পিন্টো (নির্ঘাত দুঁদে পর্তুগিজ ডাকাত) আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? চোখটা কি বাঁধবে? তারপর? নিজের মনেই হেসে ফেললাম! পাশের ভদ্রলোক কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি একটু লজ্জা পেতেই উনি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনিও হয়তো কোনো রোমাঞ্চের পেছনে ধাওয়া করে চলেছেন!! সূর্যের প্রথম আলো আমার উত্তেজনা অনেকটা বাড়িয়ে তুললো।
ডাবোলিম এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিলাম। মুখে চুরুট, চোখে গগলস আর বিশাল দেহধারী লোকের সন্ধান করছিলাম। কৈ? নেই তো! একটা চটি পড়া প্যাংলা টেকো লোক একটা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আমার নামের বানান ভুল। 'পিন্টো' বলে হাঁক দিতেই সেই ভয়ঙ্কর ‘চটি পড়া’ গ্যাংস্টার আমার দিকে এগিয়ে এলো, মুখে হাসি। খোঁয়াড়ি সবে ভেঙেছে বলে বোধ হলো। এসেই সে বললো, 'নাস্তা করিঙ্গা ক্যা?"
একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে গাড়ি আমাকে গোয়ার দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে চলেছে। পিন্টো সাহেব দুঃখ করলেন, আজকালকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দল 'ফেনি'র গুণমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আগে আধ বোতলে যা নেশা হতো আজ দু বোতলেও তা হয় না। গোয়া উচ্ছন্নে গেছে। ওনার হা-হুতাশে সায় দিলাম, পাছে ঘুমিয়ে না পড়েন। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে আমরা কোথায় যাচ্ছি, তারপর ভাবলাম দেখাই যাক না এই রাস্তার শেষ কোথায়।
মারগাও পার হতেই আমার সন্দেহ হলো যে আমার গন্তব্যস্থল আমাদের এক অনেক পুরোনো জায়গা। বহু বছর আগে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর ক্যানকোনা আসতেই আমার মনে পড়ে গেলো আমাদের সেই পালোলেম বীচ, সেই আশ্চর্য সুন্দর জায়গা, যা কুড়ি বছর আগে আমরা খুঁজে বার করেছিলাম। আমাদের দাম্পত্য স্বপ্নের পূর্ণতা এখানেই, 'ডি'সুজার শ্যাকে।' 'এনচ্যান্টিং' সন্ধ্যার মাধুর্য্ আর সবথেকে বড় কথা যে এখানে পর্যটকদের ভীড় কম। যেমন ছিল তেমনি আছে। পিন্টোকে বললাম আমাকে এখানেই ছাড়তে, আমি জানি কোথায় যেতে হবে।
"তুমকো ডি'সুজা কা শ্যাক মালুম হ্যায় ক্যা?" পিন্টোর সওয়াল।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। পিন্টো একটা জীর্ণ কার্ড বের করে খুব নম্রভাবে বললো, "কার মাংতা তো ফোন করনে কা, পন রাত কো ছোড়কর ।" তারপর একটু ঝুঁকে বললো, "থোড়া ফেনি চলতা ক্যা?"
মাথাটা নাড়িয়ে বীচের ওপর হাঁটতে লাগলাম। পিন্টো উত্তম ফেনির সন্ধানে হাওয়া হয়ে গেলো।
এইবার, আসল কাজ।
ডিসুজার শ্যাকে পৌঁছতে মুহূর্তেকের জন্যে অবাক... সময় কি এখানে থমকে আছে? কুড়ি বছর আগে যেমনটি ছিল, এখনও সেই...
ডি'সুজার শ্যাকে একটা চমৎকার গাজীবো, দূর থেকে দেখতে পেলাম এক মহিলার আবছায়া অবয়ব, রঙিন কাপড়ে ঢাকা। রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। প্রায় পাঁচ মিনিট লাগলো হেঁটে পৌঁছাতে; এক্কেবারে সুহাসিনীর মুখোমুখি। অসম্ভব সুন্দরী দেখতে লাগছিলো ওকে। সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। ওর চুল, ওর জামাকাপড়, ওর হাঁটা চলা, সব।
ও নেমে এলো আমার সামনে, একটু হেসে ঝুঁকে আমার জ্যাকেটটা স্পর্শ করে অস্ফুটস্বরে বললো, "সুন্দর!"
আমি হতবাক, কি বলবো, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো।
আমার অবস্থাটা ও ভালোই বুঝলো, আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন দেখাচ্ছে আমায়?"
ভেবেচিন্তে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম, "পরস্ত্রী।"
ও হেসে গড়িয়ে পড়লো, খুব খুশি। ওর মোহময় কণ্ঠস্বর, অঙ্গনারূপ, সংযম হারানোর পক্ষে যথেষ্ট।
ও হাত ধরে আমাকে টেনে নিলো সিঁড়ির ওপর, দুটো কৌচ পাশাপাশি রাখা। আমাকে শুইয়ে দিলো আর পেছন থেকে আমার চুলের ভেতরে ওর আঙ্গুলগুলো অনুভব করলাম। আঃ, কি আরাম। আস্তে আস্তে কপালটা টিপতে লাগলো, আমার চোখ বুজে আসছে। ওর চুলের গন্ধ, ওর নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর, কানে কানে আমাকে বললো, "কেমন আছো গো?"
চোখ খুলে তাকালাম ওর সুন্দর মুখের দিকে, কথা ফুটলো না। আমার এ কি অবস্থা!
ও অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায় হাত বুলোতে থাকলো। কোনো কথা নেই কারো মুখে।
সামনে বিশাল সমুদ্র, গাঢ় নীল রঙের খেলা চলছে বুকের ওপর, তবু প্রশান্ত। শান্ত আমরাও। আলোড়ন যা, সবই প্রচ্ছন্ন, লুক্কায়িত।
আজ সব কিছুই নিখুঁত, যেন নিৰ্ভুল সুরের মূর্ছনা। পরিবেশ, স্বাচ্ছন্দ্য, আবহাওয়া এবং এই মোহময়ী সুন্দরী নারী... আমার নারী।
প্রকৃতির নিয়মে এলো মধুর সন্ধ্যা যার উজ্জ্বল রঙের ঝলকানি ঢেলে দিলো গলানো সোনা। সন্ধ্যা বদলে হলো রাত; সমুদ্র পাল্টালো, ধীরগতিতে নামলো অন্ধকার!
দুজনে পাশাপাশি বসে। সুহাসিনী আজ মুহূর্তের জন্যেও আমার হাত ছাড়েনি, আঁকড়ে ধরে আছে। চোখ বন্ধ করে আমি এই নতুন নারীর স্পর্শ অনুভব করেছি আজ, আমার কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো নিবেদন নেই। ও নিঃসন্দেহে আমারই। কবিকল্পিত, অবাস্তব, কাল্পনিক। এ কোন স্বপ্ন?
রাত আরো অন্ধকার, আরো গাঢ, দুজন মানুষ, নির্বাক, শব্দহীন। শুধু সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জন। মধুর গর্জন!
আজ আমার কোনো রাগ, অভিমান, কিছু নেই। আজ এক নতুন জীবন।আজ আমি ফিরে পেতে চাই আমার সুহাসকে। সেই কুড়ি বছরের সুহাসকে।
আমি টেনে নিলাম ওকে আমার কাছে। ও বাধা দিলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম!
একটু তাকিয়ে ওই আমাকে বুকে টেনে নিলো, আমার ঠোঁটে আলতো চুমু খেলো, "তোমাকে আমি কিছু বলবো।শুনবে?"
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, "কি দরকার সুহাস, কি বলবে?"
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। তারপর কান্না ভেজা গলায় বললো, "আজ তোমার সুহাস, তোমায় সত্যিটা বলবে।"
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
5
শুনেছিলাম, চার্চের পাদ্রীরা কনফেশন শুনে থাকেন, কিন্তু আমি তো পাদ্রী নই। কি হবে আমার সত্যিটা শুনে?
উপায় তো নেই, মাথা নাড়লাম।
ও আমার কাছে এসে বসলো, হাতটা ধরে ছিল।
"সেই রাতে যখন তুমি আমাকে আদির সাথে দেখলে। সেটা প্রথমবার নয়। আমি আদিকে ভালোবাসি।
তোমার সাথে এই ২০ বছরের দীর্ঘ সময়, আজ এক প্রহেলিকা। জানো, প্রথম তিন বছর, আমরা দুজন দুই পৃথক, স্বতন্ত্র মানুষ, একসাথে থাকতাম মাত্র। পরবর্তী তিন বছরে আমরা চিনতে আরম্ভ করলাম নিজেদের, পরস্পরকেও। আমরা দুজন খুঁজলাম, ভালোবাসলাম, ভিন্নমতও হলাম। আমরা জোর ঝগড়া করতাম, কথা বন্ধ থাকতো, দুদিন পরই মিটমাট করে নিয়ে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতাম। কখনো দশদিন একটাও কথা হতো না আবার পরের দশদিন আমরা এক মন এক প্রাণ, এক দেহ। মনে আছে?
তুমি ট্যুর থেকে ফেরার দিন ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবতাম আজ কি পরব, কীভাবে সাজবো, কীভাবে তোমাকে চমকে দেব। তুমিও তাই ছিলে। একবার আমাকে ইমপ্রেস করতে একটা নকল 'রেব্যান' কিনেছিলে।
এই আবিষ্কারের দিনগুলো দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। আমাদের গ্রাস করলো ‘আদর্শ পরিবার’ নামক এক ভয়ানক ব্যাধি । হটাৎ লক্ষ করলাম যে আমাদের পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো গ্রহণযোগ্য হতে আরম্ভ করেছে। আইডিয়াটা ভালোই মনে হচ্ছে। আমাদের ঝগড়াঝাঁটি মন্ত্রবলে কমে গেলো। আমরা আদর্শ দম্পতি। আমি হলাম তুমি আর তুমি হলে আমি; আমাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র, আমাদের এন্টিটি হারিয়ে গেলো।
আমাদের এই একাত্ম হয়ে যাওয়াটা প্রভাব ফেললো আমাদের রোমান্সের ওপর। অফিস থেকে ফিরলে ভালো লাগে কিন্তু বুক ধড়ফড় করে না। আমরা পরস্পরের প্রতি যত্নবান হলাম কিন্তু ভুলে গেলাম প্রেম করতে। তোমার কথা ভাবতাম বেশি, তোমাকে ভালো দেখতে লাগছে কিনা, কি পরলে, চুল কাটলে কিনা তাই দেখতাম। ভুলে গেলাম নিজের কথা। কি করলে তুমি আমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না, ভ্রুক্ষেপই করতাম না; তুমিও তাই করলে। আমি সারাদিন একটা বেঢপ নাইটি আর তুমি খালি গায়ে একটা কদাকার বারমুডা পরে ভুঁড়ি বাগিয়ে ঘুরতে। আমার চোখে বা তোমার চোখে আমাদের যে দর্শনযোগ্য হওয়া উচিত, তা বেমালুম ভুলে গেলাম।
আমার পছন্দের জিনিস তোমার আজকাল বেশ ভালো লাগে। মজার কথা, তুমি অনেক কিছু বর্জন করেছো, কারণ আমি তা ভালোবাসি না। আমরাও ব্যাপারটা একই রকম। আমাদের দুই সত্তা রীতিমতো কোল্যাপ্স করে এক হয়ে গেছে। আমাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, পছন্দ, অপছন্দ সব এক! আমাদের আর তর্ক বিতর্ক হয় না, দুরকম তো ভাবিনা আর। দুজনেরই বক্তব্য এক। যেমন রঞ্জু বলে, 'তোমাদের দুজনেরই এক রা।'
কি ভয়াবহ পরিস্থিতি। কিন্তু সমাজের চোখে? আমরা 'ওয়েল এডজাস্টেড কাপল'; খাপ খাওয়া দম্পতি। "
সুহাসিনী চুপ করলো। ও কি বলছে? আমি তো জানতাম আমাদের বিবাহিত জীবন পারফেক্ট। সবই তাহলে মিথ্যা? রূপকথা?
ও আমার হাত ছেড়ে বারান্দার রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলো, আমি সঙ্গে গেলাম। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের ওপর। আজ আরব মহাসাগর শান্ত।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ও কী যেন ভাবলো তারপর আবার ও বলতে শুরু করলো, "সেইভাবেই, আমার লজ্জা আজ তোমার। তুমি আমাকে আদির সঙ্গে এক বিছানায় ধরে ফেললে। লজ্জা পেলে বেশি, রাগ করলে কম । লজ্জাটা আমার একার হওয়ার কথা ছিল, অথচ তুমি লজ্জিত হলে আমার তরফ থেকে, on my behalf । তুমি বেশি বিব্রত, যেন দোষটা তোমার; না জানিয়ে নিজের বাড়িতে এসে গেছো।
অসভ্য ছেলেকে বাঁচাতে বাবা যা করে তুমি তাই করলে, দোষটা ঢাকলে। অবৈধ প্রণয়ী বা নষ্ট স্ত্রীর ওপর স্বামীর রাগে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার অধিকার তুমি দাবি করলে না।
তুমি আদিকে কিছুই বললে না। ওকে শান্তভাবে ছেড়ে এলে। এমন ভাব করলে যেন ও একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। 'সিলি মিসটেক,' যা উপেক্ষা করা চলে।
কখনো তোমাকে জিন্স পরে ঘুমাতে দেখিনি, আরামের ব্যাপারে তুমি বেশ পিটপিটে। সারারাত অস্বস্তিতে, ঘুম হলো না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না, এ আমি কী করলাম? আমার সবসময় নিজের সংযমের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গর্ব ছিল, আমি কেন এটা ভাঙতে দিলাম। রাগে দুঃখে আমি কাঁদলাম, কিন্তু কোনো সান্তনা? নাঃ, পেলাম না। আমি হেরে গেলাম।
দিনভর তুমি আমাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলে, আমার দুঃখ তাতে হাজারগুণ বেড়ে গেলো। তুমি যদি রাগ করতে, জবাব চাইতে তাহলেও একটা কথা ছিল। তোমার চোখে রাগের চিহ্নমাত্র ছিল না, শুধু বিষন্নতা আর ভয়!! কেন? আমাকে হারাবার?
আমার দোষটা তোমার কাছে গৌণ, যেন কোনো ব্যাপারই নয়। আমাকে কোনো প্রশ্ন নয়। আদির সাথে আমার কি সম্পর্ক, তাও তোমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। তুমি ভীত, যদি আমি বলি, আমি চলে যাবো। যদি তাই বলতাম, তুমি যেতে দিতে, আমার ভালো লাগাতেই যে তোমার ভালো লাগা! আর তোমার খারাপ লাগা? কোনো ব্যাপারই নয়।
জানো, আমি সেই 'পুরোনো টুথব্রাশ', অনেকদিন ধরে আছি তোমার জীবনে, মায়া পড়ে গেছে, ফেলে দিতে পারছো না। যদিও কোনো কাজেরই নয়। তবু গুছিয়ে রেখে দিয়েছো, সেন্টিমেন্টের ব্যাপার; অভ্যাস।"
ওর গলাটা যেন ভেঙে আসছে? অনুভব করতে পারছি। কেন ও নিজেকে এতো ঘৃণা করে? আমি করি না।
ও খুব কষ্টে, কথা বলতে পারছে না আর, তবুও জোর করে ....
"যতবার তোমার দেওয়া গিফটটা দেখেছি, ততবার মনটা বিকল হয়েছে, নিজের কর্মের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। বেশি কিছু ভাবতে হয়নি। আদি অল্পবয়সী, তরুণ, আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য সব করতে পারে, এমনকি মারাত্মক কিছুও, হতে পারে অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক।
আর তুমি, তোমার অস্তিত্ব আমার প্রেমিক হিসেবে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি নিজের হাতে, সেই সুইচটা অফ করে দিয়েছিলাম। তুমি আমি তো এক। কিন্তু আদি? আমার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে, প্রচন্ড আবেগ সৃষ্টি করতে পারে। আমার সমস্ত সংযম, সমস্ত নিয়ন্ত্রণ নিমেষের মধ্যে ধূলিসাৎ করে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে রাখে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষমতা, যা আমার সমস্ত সংকল্প ভেঙে দেয়।
সেদিন কতবার চেয়েছি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, সেই পুরোনো দিনের মতো। কতবার ভেবেছি কাঁধে মাথা রেখে কাঁদি, ক্ষমা চাই অকপটে। কিন্তু তোমার চোখের দৃষ্টি, সেই দুঃখ, আমাকে থামিয়েছে। আমি জানতাম, তুমি সম্পূর্ণভাবে একমত হবে আমি যাই বলি না কেন। যা জবাবদিহি দেব, যা সত্যি, যা মিথ্যা বলবো, তা তুমি একবাক্যে মেনে নেবে। তোমার আদালতে আমি সবসময় নিরপরাধী, কারণ তুমি একচোখো, পক্ষপাতদুষ্ট হাকিম। তুমি কোনো বিচারকই নও, তোমার বিচার বিচারই নয়। “
স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। আমি পক্ষপাতদুষ্ট? আমি? জীবনের এক নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হলো বটে। নতুন করে চিনছি নিজেকে।
"সেই রবিবার, যখন তোমাকে চলে যেতে বললাম, সেদিন প্রথমবার তোমার চোখে রাগ ফুটে উঠলো। রাগ, ঘৃণা নয়। তুমি আমাকে উপহারের কথা জিজ্ঞাসা করলে। ওটা কি ফিরিয়ে দিতে পারি, তোমার স্পর্শ যে আছে তার মধ্যে। তার কি কোনো দাম হয়?
আর রঞ্জু? ও আমার সন্তান, আমার রক্ত, ওর আর আমার মধ্যে নয় মাসের সংযোগ। ও আমার প্রাণ কিন্তু আমার দুর্বলতা বা অক্ষমতা নয়। কখনোই নয়। আমি ওকে কোনো জবাবদিহি দিতে বাধ্য নই।
কিন্তু তোমার কাছে? আমি বাধ্য। আমরা দুজন, যাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই; এক হয়েছিলাম সমাজের এক অলঙ্ঘনীয় বন্ধনে, শপথ করেছিলাম যে এর মর্যাদা রক্ষা করবো। আমি পারিনি।
আমি প্রতারক, তুমি জানো। রঞ্জু জানে বা না জানে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আমি ওর মা, এক ভুলেভরা, অপূর্ণ মেয়েলোক। ঈশ্বর নই।
আমার বিষয়ে ওর ধারণা যা খুশি হতে পারে। কিন্তু তুমি কি ভাব আমার বিষয়ে আর আমি নিজের বিষয়ে কি ভাবি সেটাই জরুরি, সেটাই সমস্যা।
আমি আদিকেই কেন পছন্দ করলাম। অনেক ভেবেও এর উত্তর পাইনি। আজ দূর থেকে যখন দেখলাম তুমি আসছো সেই মুহূর্তে ধাঁধাটার সমাধান খুঁজে পেলাম। তোমাকে ওই জ্যাকেটে কি ভীষণ ফিট, হ্যান্ডসম আর ভালো দেখাচ্ছিলো। আমি উপলব্ধি করলাম যে আমি আদিকে দেখতে পাচ্ছি। তোমার ক্লোন, আদি তোমার যৌবনের রূপ। আমার অবচেতন মন আদির মধ্যে তোমাকে দেখতে পেয়েছিলো।
কিন্তু তাতে আমার অপরাধ কিছুমাত্র কম হয় কি? হয় না, হতে পারে না। কখনোই না।
সুহাস আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো, অস্ফুটস্বরে বললো, " আজ, আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই, আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত রূপ, সমস্ত দোষী হৃদয়ের অন্তঃস্থল দিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমার সেই বিচারকের কাছে নির্লজ্জ হয়ে মিনতি করি। আমায় ক্ষমা করো। আমার আত্মসমর্থনের যোগ্যতা নেই। অনুরোধ মাত্র, এই ঠক বেহায়া মেয়েমানুষটাকে যদি মার্জনা করো।
সমুদ্রের গর্জন যেন বেড়ে গেছে, জোয়ার এলো কি? ভোর হয়ে আসছে। সুহাস হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ওকে তুলে ধরলাম, আমার বুকের কাছে, কি সুন্দর ওর মুখটা, গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিলাম ওকে।
ওর চোখের কোনে জল।
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
6
স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে ওর শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, নিঃশাস প্রশ্বাস গভীর হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ওর সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ওর ঠোঁট, মুখ, পীঠ, হাত, সমস্ত। আমার সুহাস আজ আবার আমার। ওর হাতের স্পর্শও পাচ্ছি আমার ঘাড়ে, ওর অধর......, সমস্ত প্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আমায়। ওর পা আমার পায়ে ঠেকছে। এতটা উত্তেজনা; এতো ভালোবাসা; এও কি সম্ভব? স্বপ্ন?
কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ওকে বুকে ধরে? রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফুটছে, দিক্চক্রবালের রেখা দেখা যায় অদূরে।
'চোখ খোলো', আমি এখানে।
ওর দৃষ্টি, আমার অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছে। ওর মুখে হাসি, "ভেতরে চল।"
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। অনুভব করলাম আবার।
"পাগল, কি করছো? চলো।" বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে উঠলো।
কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, "তোমায় স্পর্শ করতে দাও, দেখি আমার সুহাসকে চিনতে পারি কি না! অন্ধ মানুষ যেমন শব্দ খোঁজে নিঃশব্দে, ছুঁয়ে দেখে ব্রেইলে!
সুহাসিনী আমার ঠোঁটটা ছুঁয়ে দুষ্টু ভাবে বললো, "তাই বুঝি, তাই চোখ বন্ধ!"
"তাই তো! আমার চোখ বন্ধ থাকলেই তো সুহাস কে চিনতে পারি। বুঝতে পারি নিঃসংশয়ে। "
সুহাস আরো কাছে টেনে নিলো আমায়, "চোখ খুলে আমায় বলো, কি দেখছো?"
চোখ খুললাম, দেখলাম সেই অসম্ভব সুন্দর মুখটা, আমার ঠিক মুখেরই কাছে। স্ফুরিত ঠোঁটটা একটু একটু কাঁপছে। শরীরের গন্ধ আমায় মাতাল করে তুলছে। এই নারী আমার চাই।
আস্তে করে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, "কি দেখছো?"
মুখে কথা ফুটছে না, অনেক কষ্টে বললাম, "সুন্দর নারীমূর্তি, সুন্দর হাসি, মোহিনী, আমার শরীরে আগুন ধরাতে এসেছে।"
"সেই মোহিনী তো তোমারি, ভেতরে এস। " ফিসফিস করে বললো ও।
"যাবো।"একটু দ্বিধা করলাম, "কিছু বলবো?"
"বল, কি বলবে, আজ আমি সব শুনবো।" বুকের ওপর মাথাটা রাখলো ও, জড়িয়ে ধরলো আরো জোরে।
কি করে বলবো? ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম মানসিক আবেগে। কথা বলা যে আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর দিকে তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিলো।
"তুমি জানো, পুণা ছাড়ার পর আমি কি করেছিলাম? যেন, আমি দিল্লি ফিরে যেতে পারিনি?"
"তুমি গোয়া এসেছিলে, আমি জানি।"
আমি অবাক, "তুমি জানো? কেমন করে?"
আমি জানতাম তুমি দিল্লি ফিরে যাওনি, ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।নিরুপায় হয়ে তোমার মোবাইল ট্র্যাক করেছিলাম।
"দুশ্চিন্তায় ছিলে? গত দু সপ্তাহ আমার ওপর দিয়ে কি গেছে তার কোনো ধারণা আছে তোমার? আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম না?
ও চুপ করে রইলো, দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো, "জানি।"
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষন, "তুমি কেন ডেকেছো জানি না, শুধু ইন্সট্রাকশন ফলো করছি। এখানে এলাম, তোমাকে পেলাম, আনকোরা নতুন রূপে।
ব্র্যান্ড নিউ সুহাসিনী, একদম নিখুঁত, মোহময়ী, এই স্বপ্নের বাড়িতে।
পারফেক্ট।
তুমি আমাদের কথা বললে। তোমার জীবনের দর্শন, এই দর্শন, এই ফিলসফি, তাও নতুন, তোমার মতন। তুমি কথা বলছো, আমি সম্মোহিত হয়ে শুনছি। যেন কুহকের দেশে এসেছি, যেন ইন্দ্রজাল। মোহিনী মায়া এলো। আঃ! কি আবোল তাবোল বকছি।
কিন্তু জানো? এ তো সুহাস নয়। আমি এ কার দিকে তাকিয়ে আছি, কার কথা শুনছি? আমি তো চিনি না। তুমি সুন্দর, তুমি নতুন, তুমি সেই সব যা আমি চাই, কামনা করি। এলে হৃদয় শিকারে, কিন্তু তুমি আমার সে সুহাস নও।
ওর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, "কি বলছো গো তুমি, কি বলছো?"
খুব কষ্ট একটা বুকে, "তোমার কথা শুনলাম, আগে কখনো শুনিনি। আমরা দুজনে এক হয়ে গেছি, আমাদের সত্তা এক গেছে হয়ে আর সেটাই আমাদের জীবনে এনেছে বিপর্যয়। যাকে বলে সেন্ট্রাল কোর অফ বিশৃঙ্খলতা। কি জটিল তত্ত্ব। আমি বুঝি না, বুঝতে চাইও না। এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন।
তুমি চাইছিলে আমি রাগ করি। দুঃখিত নয়, ব্যথিত নয়, ক্ষমাশীল নয়। তোমার চোখে এই কয়েকটা বৈশিষ্ট আমাকে মানায় না, তুমি চিন্তিত। হতে পারে। কিন্তু আমার চিন্তাধারা, আমার উপলব্ধি, তার কি কোনো মূল্য আছে?
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা একাত্ম হয়ে গেলাম। পরস্পরকে বরদাস্ত করতে লাগলাম, আরো সহিষ্ণু হলাম। নিজেদের প্রতি উদার হলাম, এক জন আর একজনের প্রতি যত্নবান হলাম। নিজেদের অজান্তেই ছোট ছোট আপোষ, ছোট ছোট রফা করলাম; সন্ধিস্থাপন হলো, যুদ্ধবিগ্রহ কমে গেলো।
কার জন্যে? আমাদের জন্যে। কাজটা কি খারাপ হলো? এই 'ছোটোখাটো ' দেয়ানেয়াগুলো করতে, আমাদের কি খুব অনুশোচনা হল? এই সামান্য স্যাক্রিফাইসগুলো আমাদের কি আরো কাছে নিয়ে আসেনি? আমি এতদিন তাই ভেবেছিলাম। আজ আমার মনে সংশয়, সবই কি ভুল?
তাই কোনো প্রশ্ন, কোনো জবাব চাইতে পারিনি। আমার মন বলেছিলো যে কোনো প্রশ্ন করাটা ভুল হবে কারণ আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে আমাদের একাত্মতাতেই, যা আমরা তৈরী করেছি অতি কষ্টে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে। কুড়ি বছরের চেষ্টায়। তাই তুমি যখন বললে চলে যেতে, আমি অবাক হলেও প্রশ্ন করতে পারলাম না। তুমি বলেছো, ব্যাস।
তুমি আমায় চলে যেতে বললে, আমি তোমাকে হারালাম। অন্তত, আমার তাই মনে হলো। তুমি বলছো আমার এই ধারণা অমূলক। সেদিন তা ছিলোনা কিন্তু।
তোমার মতে আমার রাগ না করাটাই তোমার দুখঃ। আর আমার কষ্ট কি জানো? তুমি আমাকে তোমার পাশে দাঁড়াতে দিলেনা। তোমার কষ্টে সান্তনা দেবার অধিকার আমার রইলো না। আমি পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক!! ঠিকই বলেছো। আমি কি বিচার করবো? যে সারাজীবনটা কাটিয়ে দিলো এই সংসারটাকে সাজাতে, অনেক দুঃখ অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে আমি তড়িঘড়ি শাস্তি দেব। এটা তো নিরপেক্ষ বিচারকও করেন না। সত্যি বলতে কি আমার কাছে এটা অচিন্তনীয়, অপবিত্র, অশুচি।
তুমি আদিকে ভালোবাসো, ভালো কথা। তুমি আমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসো, সেটাও ভালো। আমরা জীবনসঙ্গী, পরস্পরের মালিক নই। তুমি কি ভাবছো বা আমার কি ভাবা উচিত তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই।
কিন্তু তুমি যখন বল যে ও তোমাকে আমার বিগত যৌবনের রূপটা মনে করিয়ে দেয়, তখন আমার অসম্পূর্ণতা, আমার খুঁত, আমার ত্রুটিগুলো, বড়ো করে আমার চোখে ধরা পরে। মজার কথা, এই ত্রুটিগুলোর উৎস, আমাদের নীতিগত প্রয়াস আর প্রচেষ্টার পরিনাম। হয়তো আমরা একটু এক্সট্রা সুখী হতে চেয়েছিলাম। ভুল করেছিলাম, অজান্তেই ।
সবারই একটা নিজস্ব মতবাদ বা ফিলসফি থাকতেই পারে, নয় কেন? আমার আছে কি? হয়তো আছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস আমার নেই। কারণ, আমার সেই ভিন্ন ভাবনাধারা আমাদের এই দুজনের জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তাই, এই আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই।
আজ সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, তোমাকে আমি ফিরে পেয়েছি। আমার প্রিয়া আজ আমার বুকে, চোখ বুজে তার চুলের গন্ধ আমি পাচ্ছি। চোখ খুলে আমি বার বার তাকে দেখছি আর ভাবছি । আমি যে মানুষটাকে জানতাম কুড়ি বছর ধরে, সে তো তুমি নও। চোখ খুলে যাকে দেখছি, সে মহিলা আমার অপরিচিত।
তুমি আজ যা চাও আমিও তাই চাই কিন্তু তা যেন হয় আমার সুহাসকে সঙ্গে রেখে। আমার সেই সুহাস যে কখনো কোনো বুদ্ধির খেলা জানতো না। যার একমাত্র মগজাস্ত্র ছিল তার বিশাল হৃদয়। আজ হটাৎ আমরা দুজন দুই মেরুর প্রাণী।
একদিন তুমি আমাকে ঘরছাড়া করেছিলে আজ আমি নিজেকে ঘর থেকে তাড়াচ্ছি। তোমার দেওয়া সেই টুথব্রাশ উপমাটা খুব উপযুক্ত মনে হচ্ছে। আসলে আমিই সেই ‘পুরোনো টুথব্রাশ’ যাকে ফেলে দিলে কেউ ফিরেও তাকাবে না।
আমার কথা ফুরালো। আমি বিপর্যস্ত। আমি ক্লান্ত।
ও আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।নিজের মনেই তাকিয়ে আছে। দূরে কোথাও, কি দেখছে কে জানে!
আমি ব্যাগটা বের করে আনলাম। দুমিনিট লাগলো সব গোছাতে। এবার যাবার সময়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে, একবার ফিরে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে জল। মুখ ফিরিয়ে নিলাম, আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।
ও শুধু একটাই কথা বললো, "আমায় ক্ষমা করো, যেও না।"
আমি বেরিয়ে গেলাম।
পিন্টো অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে।
Posts: 18
Threads: 2
Likes Received: 117 in 17 posts
Likes Given: 4
Joined: Mar 2019
Reputation:
37
09-12-2020, 01:32 PM
(This post was last modified: 09-12-2020, 05:08 PM by Trambak. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
7
তিন মাস পার হয়ে গেছে। ভালোই চলছে সব। বরং বলা যায় 'চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। ' উঃ, আমার কোনো অসুবিধা কিন্তু হচ্ছে না। কোনো নালিশ, অভিযোগ নেই। কিছু না, কিছু না। জীবনে একজন কম, আপদ গেছে, ঝকঝকে জীবন।
কতটা ঝকঝকে? এই ধরুন, বৃষ্টিঝরা রাত? এই ধরুন যেমন আমার স্তিমিত মস্তিস্ক। ভালো, ভালো, বেড়ে চলছে।
এ আমি কী করলাম?
ডাবলিম পর্যন্ত রাস্তাটা যেন অস্পষ্ট মনে হলো। পিন্টো রাস্তায় দুটো কথা বললো, "বহুত শর্ট ট্রিপ স্যার?" আমার জবাব না পেয়ে একটু ভেবে বললো, "তুমারা গার্লফ্রেন্ড বহুত ঝকাস!" মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো, ইচ্ছা হলো লোকটাকে ঘুঁষি মেরে দি। আমার জীবনের একমাত্র বন্ধু আজ শুধুমাত্র মেয়েবন্ধু? চুপ করে গোঁজ হয়ে থাকলাম।
আজ আমি নিজের হাতে সেই সংযোগস্থলটা ভেঙে দিয়ে এসেছি। ভালোই করেছি।
টিকিট কেনার মাঝপথে খেয়াল হল যে ‘পুনার টিকিট’ বলেছি। তড়িঘড়ি করে বললাম দিল্লি। লোকটা অদ্ভুতভাবে তাকালো আমার দিকে তারপর মাথা নেড়ে দিল্লির টিকিট তৈরী করে দিলো। পুণা যাবার রাস্তা বন্ধ। কোনো ব্যাপার না।
দিল্লিতে বেশ ভালো কাটছে। সকালে ব্রেকফাস্ট, তারপর অফিস; লাঞ্চ, তারপর বাড়ি! সন্ধ্যায় একটু অসুবিধা হয়, সময়টা কাটতে চায় না। রাত্রে আর মেসে খেতে যাই না, আবার জামাকাপড় পরা, সে এক হ্যাপা! রঞ্জু আমাকে ঠেলে ঠুলে পাঠাবার চেষ্টা করত। আজকাল আর করে না। মাঝে মাঝে বাইরে খেতে যাই। ও কিছু জানেনা, ভাবে আমি ওজন কমাবার ধান্দায় আছি।
রঞ্জুর জন্যে খারাপ লাগে, ওকে নেগলেক্ট করছি বোধহয়। কিন্তু আমি কিছুতেই উৎসাহ পাই না।
সুহাসকে যতই ভুলতে চাই, ততই যেন ওর স্মৃতি আমাকে চেপে ধরে। আমার সমস্ত মন প্রাণ আর কিছু ভাবতে পারে না। আমি চেষ্টা করি, বিশ্বাস করুন, কিন্তু সে আমার মনের গভীরতম স্থানে বসে আছে। পারি না।
ওর চোখের জল, ওর ক্ষমা প্রার্থনা, আমার বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।
আমি রোজ ভাবি। আমার উর্বর মস্তিস্ক বলে, "ঠিকই করেছিস তুই, ভাবিস না, কী বা করতিস এছাড়া?" মন বলে, "শালা, তোর মতন নৃশংস, হিংস্র প্রাণী দুটো দেখিনি রে!" আগে মাথাটা জিতে যেত, আজকাল মনটা চেপে ধরছে। তীব্র অনুশোচনা আমাকে চোরাবালির ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে, চেষ্টা করছি উঠতে, আরো তলিয়ে যাচ্ছি।
ও আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।
সহজ কাজ তো নয়! আগে নিজের ঘর গোছানোর দরকার, তারপর অন্য কথা। দুর্বলচিত্ত হলে কি পারতো?
সাথীকে ফিরে পেতে কত কাঠখড় পোড়ালো! নিজেকে বদলালো, সুন্দর করে তুললো।
কার জন্যে ভাই, এইসব? আমার?
ও কোনো ভয়টয় না পেয়ে নিজের দিকটা অকপটে বলে ফেললো। আমার ওপর বোধহয় বিশ্বাস ছিল যে আমি নিশ্চই বুঝবো।
সরি দিদি, ঠিক বুঝতে পারলাম না তো! আপনি নিজের জীবনের কিছু ঘনিষ্ট অভ্যন্তরীণ কথা বললেন, আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে। না বললেও চলতো, তাও নিরর্থক ট্রাই নিলেন। জানি এসব বলতে প্রচুর মানসিক শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু 'সকলি গরলী ভেল।'
ধ্যাৎ? কি সব বাজে বকছি?
শেষমেশ, লাভটা কি হলো দিদি? পারলেন বোঝাতে?
পারলেন না। দুও দুও।
আমিও কি তার প্রতিদান দিয়েছি? দিলাম তো। সুন্দরভাবে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে এলাম। ও বললো, "ক্ষমা করে দাও, যেও না। " বয়েই গেলো।
আজ তিন মাস হয়ে গেলো? কোনো খবর নিইনি।
এ আমি কি করলাম। উদার, সহানুভূতিশীল জীবনসঙ্গী হিসাবে আমার যে একটা কর্তব্য ছিল সেটা আমি ধূলিসাৎ করে দিয়ে এলাম। আমার মুখোশটা সরিয়ে আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়লো। ঈর্ষাপরায়ণ, নিষ্ঠুর, কুচুটে।
আজ আমার সাহস নেই যে সুহাস কে ফোনে করি। ক্ষমা চাই। সে অধিকার আর নেই।
রঞ্জু আজ সাত দিনের জন্য পন্ডিচেরি গেলো, অবশ্য আমাকে আগেই জানিয়েছিল। তিন মাসে তৃতীয়বার। ওরও একটা ব্রেক দরকার, আপত্তি করি নি। আমি একা।
নাই কাজ তো খৈ ভাজ। অনেকদিন পর মেল চেক করলাম। একটা পাঁচদিনের পুরোনো মেল দেখে থমকে গেলাম। সুহাস লিখেছে, "তুমি নাকি ভালকরে খাওয়াদাওয়া করোনা আজকাল? এরকম কেন করো? আমার জন্যেই আজ তোমার এ অবস্থা। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনা। কী বলবো বল? কষ্ট পাচ্ছ, অযত্ন করোনা। যখনি বেল বাজে, ছুটে যাই। কিন্তু 'ভূমির' গানের মতন 'তোমার দেখা নাই রে।' একটু মজা করলাম, আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ভালোই আছি।"
আবার করে পড়লাম, তারপর আবার। সারারাত্তির। সকালে উঠে সোজা বসের সামনে।
বাঙালি। প্যাঁচার মত মুখ করে বললেন, "বলে ফেলো।"
"ছুটি চাই, পুণা যাবো।"
উনি বিরসবদনে খানিকক্ষণ তাকিয়ে, আমার জুনিয়র কে ডাকলেন, "আমার গাড়িটা নে, এটাকে বাড়ি নিয়ে যা, ব্যাগ প্যাক করে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবি, আমি টিকিট মেল্ করছি। যতক্ষণ প্লেন না যায়, এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। যদি বেরিয়ে আসে, ঠ্যাং খোঁড়া করে দিস।"
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "সুবুদ্ধি হয়েছে দেখছি।"
বলে তিনি আবার কাজে মন দিলেন।
দুপুর বারোটার ফ্লাইটে পুণা, তারপর বাড়ি। যাত্রাটা ঘোরের মধ্যে কাটলো। দরজার সামনে দাঁড়ালাম। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
বেলটা টিপলাম।
কঙ্কালসার একটা মূর্তি, এলোমেলো অগোছালো চুল, চোখের কোন কালী। ছায়ামূর্তি।
অভিনন্দন আমাকে, আমার কীর্তি!
বিবর্ণ, মৃতবৎ। সুহাসই বটে। একটু দেরি হয়ে গেলো কি?
একটু হাসলো, "জানতাম তুমি আসবে।"
আমি চেপে ধরলাম, শুধুমাত্র কয়েকটা হাড়। খায়টায় না মনে হয়। self flagellation, আত্মনিগ্রহ।
খুব কাঁদলো খানিকক্ষণ।
শেষে একটা উল্টো কথা বললো, "ক্ষমা করে দাও।"
শেষের দুটো কথা
বেল বাজছে, উঠে দরজাটা খুললাম, রঞ্জু একরাশ জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর পন্ডিচেরিতে থাকার কথা না?
ঢুকেই বললো, "দেখেছো মা'র অবস্থাটা?
আমি বলতে গেলাম, "তুই জানিস না......."
"বাবা, আমি সব জানি, মা বলেছে। তোমরা না, যাতা। "
সমাপ্তি
The following 15 users Like Trambak's post:15 users Like Trambak's post
• ashim, Avenger boy, Bichitro, Boti babu, ddey333, kingaru06, kublai, kunalabc, pcirma, Shreyasi23, Somnaath, S_Mistri, Uzzalass, WrickSarkar2020, অভিমানী হিংস্র প্রেমিক।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আমি বহুবার রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম এই গল্পটার জন্য , আপনি নিজে দিলেন অবশেষে
অনেক ধন্যবাদ
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
অদ্ভুত সব কান্ড কারখানা ,
ওটাও দিন
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(09-12-2020, 02:42 PM)ddey333 Wrote: আমি বহুবার রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম এই গল্পটার জন্য , আপনি নিজে দিলেন অবশেষে
অনেক ধন্যবাদ
মন খারাপ করেও শেষে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলার অদ্ভুত এক কাহিনী
এই গল্পটা বহুদিন ধরে মিস করছিলাম !!
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
এরকম প্রেমের গল্প আর একটাও পড়িনি ....
খুব জটিল !!
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
এরকম একটা গল্পে কারো কোনো কমেন্ট নেই , xossip ও ছিলোনা যতদূর মনে পরে ...
কি অদ্ভুত তাই না !!!
খারাপ লাগে ...
Posts: 273
Threads: 0
Likes Received: 106 in 86 posts
Likes Given: 2,260
Joined: Mar 2020
Reputation:
2
Dada ei golpo ta mane jewel!!!!
Just jewel!!!
Posts: 11
Threads: 0
Likes Received: 8 in 7 posts
Likes Given: 121
Joined: May 2019
Reputation:
0
গল্পের নামটা চেনা লাগছিলো, খানিকটা পড়ার পর বুঝলাম আগেও পড়েছি, ভাসা ভাসা মনে পড়ছিল,আবারও দারুন লাগলো। অব্যাক্ত ও ব্যাক্ত মানসিক টানাপোড়ন গুলি অসাধারণ।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,966 in 954 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
Good story.
Good ending.
Repped you.
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(29-10-2021, 03:48 PM)pcirma Wrote: Good story.
Good ending.
Repped you.
You should have given repu to the writer TRAMBAK actually , not me ...
Anyway thank you .
•
Posts: 4
Threads: 1
Likes Received: 2 in 2 posts
Likes Given: 0
Joined: Oct 2019
Reputation:
0
This is the first time i am writing in this forum. Just to inform you that this is one of the best short story I have ever read in my life.
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(30-10-2021, 01:55 AM)G44r4. Wrote: This is the first time i am writing in this forum. Just to inform you that this is one of the best short story I have ever read in my life.
Many thanks to you ,
Glad to know that we have quality readers like you amongst us here ...
•
Posts: 3,682
Threads: 14
Likes Received: 2,558 in 1,403 posts
Likes Given: 2,044
Joined: Apr 2021
Reputation:
530
পড়লাম গল্পটা .....
আমি ভাবতাম এখানে নন-ইরোটিক আমরা তিন জন লিখি । এখন দেখছি এই ব্যাক্তি আগেই লিখে বসে আছেন । গল্পটা এতোটাই সুন্দর এবং হৃদয়বিদারক যে একটানা পড়তে পারিনি । তবুও পড়ে শেষ করেছি । দুজন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক অসাধারণ ভাবে লেখা হয়েছে । কুকর্ম করে ধরা পড়ার পর দুটো মানুষ যে এইভাবেও কথা বলতে পারে বা বলা যায় সেটাই অভাবনীয়। লেখকের আরো লেখা পড়ার আগ্রহ জন্মালো ...
সাতটা লাইক , পাঁচটা রেপু দিলাম । কিন্তু কমেন্টের রিপ্লাই দিতে হবে । চাই চাই । না হলে ভীষণ রকমের গোঁসা করবো বলে দিলাম
❤️❤️❤️
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
•
|