25-07-2020, 11:40 PM
উৎসঃ নষ্টনারী গ্রন্থ
"" এক""
রবিবার সকালে একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকার উপায় নেই। মেয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে নিয়ে আটটার মধ্যে টালিগঞ্জে পৌঁছে দিতে হয় টিউটোরিয়ালে। দশটার সময় আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। দু ঘণ্টার জন্যে বাড়ি ফেরা যায় না। সময়টা কোথাও কাটাতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, খুব কাছেই অম্বরের বাড়ি। ওর বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
অম্বরের সঙ্গে পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে ও মানুষকে আপন করে নিতে পারে। আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সেতু তৈরি হতে বেশি সময় নেয়নি। সাধারণত পরিণত বয়সে চট করে বন্ধুত্ব হয় না। পরিচিত যে-কেউই হতে পারে। কিন্তু অম্বরের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম বলা যায়। পরস্পরকে আমরা সত্যিই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ। করেছি।
অন্য এক বন্ধু মারফৎ ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পার্ক স্ট্রীটের একটি পানশালায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে যে-যার কাজকর্ম সেরে জনা আটেক বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তি মিলিত হই ওই পানশালায়। পান করতে করতে শুধুই খােশগল্প হয় না সেখানে। হঠাৎ হঠাৎ এমন এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে, সাধারণত যা মদের টেবিলে একেবারেই বেমানান। বিদেশী সাহিত্য থেকে শুরু করে নাট্যচিন্তা, আর্টফিল্ম, নিধুবাবুর টপ্পার দু-একটি কলি ঢুকে পড়ে সকলের অজান্তে। ঠিক সময়ে পানশালায় উপস্থিত না হতে পারলে, পাছে কিছু হারাবার সম্ভাবনা। থাকে, সেটা মাথায় রেখে সকলেই সময়ের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। | দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অম্বরের বাড়িতে। অম্বরের বাড়িতে ইতিপূর্বে কয়েকবার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মিলিত হয়েছি। সাতসকালে ওর বাড়িতে এই প্রথম এলাম। ডােরবেল টিপতে অম্বর নিজেই দরজা খুলল। আমাকে দেখে মুহূর্তে ওর মুখমণ্ডল খুশির আলােয় জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। বিস্ময় এবং উচ্ছাসে একাকার হয়ে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। পরমুহূর্তেই হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভেতরে। একটা সােফায় আমাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার শ্যামল, দারুণ সারপ্রাইজ আজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল !
ওকে জানালাম আগমনের কারণ। মাত্র দেড় ঘণ্টা থাকব শুনে ওর মুখের আলাে একটু ম্লান হল। অবশ্য মুহূর্তের জন্যে। জিজ্ঞেস করল, কী খাবে বল। নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করে আসনি ?
আমি বললাম, তুমি ব্যস্ত হয়াে না। আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি।
ও বলল, তা বললে হয় নাকি? টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ করি। আমিও খাব।’
আমর অপত্তি অগ্রাহ্য করে ও টোস্টারে স্লাইজ পাউরুটি ভরে দিল। হট প্লেটে জল বসিয়ে ডিম ছেড়ে দিল। চট করে পাশের ঘরে গিয়েই ফিরে এল। হাতে একটা রামের বােতল। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই দুটো কাচের গ্লাসে রাম ঢেলে , একটা গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও, শুরু কর। আমি রুটিতে মাখন ডিমগুলাে ছাড়িয়ে বসছি।
আমি মদ আপত্তি জানিয়ে বললাম, ‘সাতসকালে মদ্যপানের কি দরকার। টোস্ট-ই তাে যথেষ্ট ছিল। সেন্টার টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে ও বলল, সকাল থেকে আমার দুটো হয়ে গেছে একটা কমােডে বসে, আর একটা দাড়ি কাটতে কাটতে। মদ্যপানের ব্যাপারে আমার কোনও সময়-অসময় নেই।
ও ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রেকফাস্ট রেডি করতে।
আমি লক্ষ্য করলাম, ঘরের আসবাবপত্রের কোনও ছিরিছাঁদ নেই। এক কোণায় দুটো পুরনাে সােফার সামনে একটা সেন্টার টেবিল। ঘরের মাঝখানে একটা খাবার টেবিল না চারপাশে গােটা ছয়েক চেয়ার। জানালায় রাখা জলের কুঁজো। সােফার উল্টোদিকের কোণে মেঝেয় রাখা টোস্টার আর হট প্লেট। একটা দেওয়াল আলমারির কাচের পাল্লা দুটো খােলা। একটা পাল্লার তিনটে কাচের মধ্যে একটা ভাঙা। আলমারিতে ঘি-এর শিশি, জেলি মাখন, কয়েকটা কাচের গ্লাস, কাপডিশ ইত্যাদি বিক্ষিপ্তভাবে রাখা।
আমি রামের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালাম। অম্বর রুটিতে মাখন লাগিয়ে ডিমের খােসা ছাড়াচ্ছে। খােসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, রাতে অন্তত দুবার উঠতে হয় প্রাকৃতিক তাড়নায়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঝটপট এক পেগ মেরে দিয়ে শুয়ে পড়ি। যদি কখনও তিনবার উঠতে হয় তাহলে তিন পেগ চেপে যায়। | আমি বললাম, এটা খুব বাজে অভ্যেস। তুমি এতটা অ্যাডিকশন চেক করার চেষ্টা কর।
অম্বর প্লেটে করে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ এনে টেবিলে রাখল। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। মদ আমাকে নিরন্তর খেয়ে চলেছে। নাও, গরম গরম টোস্ট আর ডিম খেয়ে নাও। | আমি জিজ্ঞেস করলাম, তােমার বউ মেয়েকে দেখছি না ! ওরা কোথায় ?
অম্বর বলল, আমরা পরিবারের তিনজন তিনটি গ্রহ। যে-যার নিজের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। সশব্দে হেসে আবার বলল, ‘ওপরে আছে। শীলা এখন মাকে রান্নার যােগাড় দিচ্ছে। আর মেয়ে টিভির সামনে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
একটা অস্বাভাবিক ভিত্তিহীন সম্পর্কের আভাস পেলাম আমি। অম্বরের মতন দিলখোলা হাসিখুশি পরিণত একজন ব্যক্তির ভেতরে কোথায় যেন সূক্ষ্ম খুঁজের একটা স্পর্শ করেছে। আমি বললাম, “তােমাদের এতবড় বাড়িতে সবাই ওপরে, তুমি একটি নিচের তলায় এক একা—
অম্বর আমাকে কথা শেষ করতে দিল না। বলল, ‘সেচ্ছা নির্বাসন বলতে পার। সকলের সঙ্গে থেকেও আমি একা। ওপরে দাদা বৌদি মা ছোটভাই বউ মেয়ে মােটমুটি একটা আলাদা পরিবার। একমাত্র মা ছাড়া কারাে সঙ্গেই আমার বিশেষ কথা হয় না। প্রতিদিন দু-বেলা মা-ই আমাকে খেতে দেয়। সংসার খরচের টাকাটা অবশ্য শীলাই দেয় মাসকাবারে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অম্বরের বুক ঠেলে। আমি বিষন্ন বােধ কালাম। অম্বর বলল, ‘পঁচিশ বছর আগে একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়ে আমার জীবন কলঙ্কিত হয়। সেই কলঙ্কের কালি আজীবন আমাকে কলুষিত করে চলেছে। আর আমিও নিরন্তর সেই কালি ধৌত করার চেষ্টা করে আসছি মদের প্রলেপ দিয়ে। সন্ধ্যায় তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে দুপুর দেড়টার সময় আমি লাঞ্চ করতে বেরই। লাঞ্চ করি তিনটেয়। তার আগে পাঁচ পেগ ড্রিংক করি। সাড়ে তিনটেয় অফিসে ফিরে দু ঘণ্টা কাজ করি। সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে অন্তত তিন পেগ পেটে চলে যায়। তারপর তােমাদের সঙ্গে বসে চার-পাঁচটা হয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে যতক্ষণ জেগে থাকি, ততক্ষণ চলতেই থাকে। রাতে যতবার উঠব ততবার এক পেগ করে মেরে দিই। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ঢেলে কমােড়ে গিয়ে বসি। তারপর দড়ি কাটতে কাটতে একটা। কাগজে চোখ বােলাতে বােলাতে একটা। স্নান সেরে তৈরি হতে হতে আরও একটা। এরপর খেয়ে-দেয়ে অফিস। অফিসে টেবিলের ড্রয়ারে একটা বােতল রাখা থাকে। হঠাৎ ইচ্ছে হলে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক আনিয়ে একটু ঢেলে নিই। মােটামুটি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই কালি খােবার কাজে মদকে ব্যবহার করে যাচ্ছি। কথা শেষ করে ম্লান হাসল অম্বর। আতঙ্কিত উদ্বেগে আমার মন ভারাক্রান্ত হল। অম্বর বলল, কালিটা বড্ড গাঢ়। মাঝখান থেকে মদ আমার শরীরটাকে দ্রুত চিতার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।
আমি বললাম, সব বুঝেও তুমি আত্মাহুতি দিচ্ছ কেন ?
ও বলল, একটা তুষার-চিতার জন্য। যেখানে পােড়ার পর শরীরটা হিমশীতল হয়ে যাবে। শান্ত হব—শান্তি পাব।
"" এক""
রবিবার সকালে একটু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকার উপায় নেই। মেয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাকে নিয়ে আটটার মধ্যে টালিগঞ্জে পৌঁছে দিতে হয় টিউটোরিয়ালে। দশটার সময় আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। দু ঘণ্টার জন্যে বাড়ি ফেরা যায় না। সময়টা কোথাও কাটাতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, খুব কাছেই অম্বরের বাড়ি। ওর বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
অম্বরের সঙ্গে পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে ও মানুষকে আপন করে নিতে পারে। আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সেতু তৈরি হতে বেশি সময় নেয়নি। সাধারণত পরিণত বয়সে চট করে বন্ধুত্ব হয় না। পরিচিত যে-কেউই হতে পারে। কিন্তু অম্বরের ক্ষেত্রে এটা ব্যতিক্রম বলা যায়। পরস্পরকে আমরা সত্যিই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ। করেছি।
অন্য এক বন্ধু মারফৎ ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল পার্ক স্ট্রীটের একটি পানশালায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে যে-যার কাজকর্ম সেরে জনা আটেক বন্ধু ও পরিচিত ব্যক্তি মিলিত হই ওই পানশালায়। পান করতে করতে শুধুই খােশগল্প হয় না সেখানে। হঠাৎ হঠাৎ এমন এমন প্রসঙ্গ এসে পড়ে, সাধারণত যা মদের টেবিলে একেবারেই বেমানান। বিদেশী সাহিত্য থেকে শুরু করে নাট্যচিন্তা, আর্টফিল্ম, নিধুবাবুর টপ্পার দু-একটি কলি ঢুকে পড়ে সকলের অজান্তে। ঠিক সময়ে পানশালায় উপস্থিত না হতে পারলে, পাছে কিছু হারাবার সম্ভাবনা। থাকে, সেটা মাথায় রেখে সকলেই সময়ের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। | দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম অম্বরের বাড়িতে। অম্বরের বাড়িতে ইতিপূর্বে কয়েকবার সান্ধ্যকালীন আড্ডায় মিলিত হয়েছি। সাতসকালে ওর বাড়িতে এই প্রথম এলাম। ডােরবেল টিপতে অম্বর নিজেই দরজা খুলল। আমাকে দেখে মুহূর্তে ওর মুখমণ্ডল খুশির আলােয় জ্যোতির্ময় হয়ে উঠল। বিস্ময় এবং উচ্ছাসে একাকার হয়ে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। পরমুহূর্তেই হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভেতরে। একটা সােফায় আমাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার শ্যামল, দারুণ সারপ্রাইজ আজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল !
ওকে জানালাম আগমনের কারণ। মাত্র দেড় ঘণ্টা থাকব শুনে ওর মুখের আলাে একটু ম্লান হল। অবশ্য মুহূর্তের জন্যে। জিজ্ঞেস করল, কী খাবে বল। নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করে আসনি ?
আমি বললাম, তুমি ব্যস্ত হয়াে না। আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি।
ও বলল, তা বললে হয় নাকি? টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ করি। আমিও খাব।’
আমর অপত্তি অগ্রাহ্য করে ও টোস্টারে স্লাইজ পাউরুটি ভরে দিল। হট প্লেটে জল বসিয়ে ডিম ছেড়ে দিল। চট করে পাশের ঘরে গিয়েই ফিরে এল। হাতে একটা রামের বােতল। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই দুটো কাচের গ্লাসে রাম ঢেলে , একটা গ্লাস আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও, শুরু কর। আমি রুটিতে মাখন ডিমগুলাে ছাড়িয়ে বসছি।
আমি মদ আপত্তি জানিয়ে বললাম, ‘সাতসকালে মদ্যপানের কি দরকার। টোস্ট-ই তাে যথেষ্ট ছিল। সেন্টার টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে ও বলল, সকাল থেকে আমার দুটো হয়ে গেছে একটা কমােডে বসে, আর একটা দাড়ি কাটতে কাটতে। মদ্যপানের ব্যাপারে আমার কোনও সময়-অসময় নেই।
ও ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রেকফাস্ট রেডি করতে।
আমি লক্ষ্য করলাম, ঘরের আসবাবপত্রের কোনও ছিরিছাঁদ নেই। এক কোণায় দুটো পুরনাে সােফার সামনে একটা সেন্টার টেবিল। ঘরের মাঝখানে একটা খাবার টেবিল না চারপাশে গােটা ছয়েক চেয়ার। জানালায় রাখা জলের কুঁজো। সােফার উল্টোদিকের কোণে মেঝেয় রাখা টোস্টার আর হট প্লেট। একটা দেওয়াল আলমারির কাচের পাল্লা দুটো খােলা। একটা পাল্লার তিনটে কাচের মধ্যে একটা ভাঙা। আলমারিতে ঘি-এর শিশি, জেলি মাখন, কয়েকটা কাচের গ্লাস, কাপডিশ ইত্যাদি বিক্ষিপ্তভাবে রাখা।
আমি রামের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালাম। অম্বর রুটিতে মাখন লাগিয়ে ডিমের খােসা ছাড়াচ্ছে। খােসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, রাতে অন্তত দুবার উঠতে হয় প্রাকৃতিক তাড়নায়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঝটপট এক পেগ মেরে দিয়ে শুয়ে পড়ি। যদি কখনও তিনবার উঠতে হয় তাহলে তিন পেগ চেপে যায়। | আমি বললাম, এটা খুব বাজে অভ্যেস। তুমি এতটা অ্যাডিকশন চেক করার চেষ্টা কর।
অম্বর প্লেটে করে টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ এনে টেবিলে রাখল। গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, এ জীবনে সেটা আর সম্ভব নয়। মদ আমাকে নিরন্তর খেয়ে চলেছে। নাও, গরম গরম টোস্ট আর ডিম খেয়ে নাও। | আমি জিজ্ঞেস করলাম, তােমার বউ মেয়েকে দেখছি না ! ওরা কোথায় ?
অম্বর বলল, আমরা পরিবারের তিনজন তিনটি গ্রহ। যে-যার নিজের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। সশব্দে হেসে আবার বলল, ‘ওপরে আছে। শীলা এখন মাকে রান্নার যােগাড় দিচ্ছে। আর মেয়ে টিভির সামনে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
একটা অস্বাভাবিক ভিত্তিহীন সম্পর্কের আভাস পেলাম আমি। অম্বরের মতন দিলখোলা হাসিখুশি পরিণত একজন ব্যক্তির ভেতরে কোথায় যেন সূক্ষ্ম খুঁজের একটা স্পর্শ করেছে। আমি বললাম, “তােমাদের এতবড় বাড়িতে সবাই ওপরে, তুমি একটি নিচের তলায় এক একা—
অম্বর আমাকে কথা শেষ করতে দিল না। বলল, ‘সেচ্ছা নির্বাসন বলতে পার। সকলের সঙ্গে থেকেও আমি একা। ওপরে দাদা বৌদি মা ছোটভাই বউ মেয়ে মােটমুটি একটা আলাদা পরিবার। একমাত্র মা ছাড়া কারাে সঙ্গেই আমার বিশেষ কথা হয় না। প্রতিদিন দু-বেলা মা-ই আমাকে খেতে দেয়। সংসার খরচের টাকাটা অবশ্য শীলাই দেয় মাসকাবারে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অম্বরের বুক ঠেলে। আমি বিষন্ন বােধ কালাম। অম্বর বলল, ‘পঁচিশ বছর আগে একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গিয়ে আমার জীবন কলঙ্কিত হয়। সেই কলঙ্কের কালি আজীবন আমাকে কলুষিত করে চলেছে। আর আমিও নিরন্তর সেই কালি ধৌত করার চেষ্টা করে আসছি মদের প্রলেপ দিয়ে। সন্ধ্যায় তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে দুপুর দেড়টার সময় আমি লাঞ্চ করতে বেরই। লাঞ্চ করি তিনটেয়। তার আগে পাঁচ পেগ ড্রিংক করি। সাড়ে তিনটেয় অফিসে ফিরে দু ঘণ্টা কাজ করি। সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেরিয়ে তােমাদের সঙ্গে দেখা হবার আগে অন্তত তিন পেগ পেটে চলে যায়। তারপর তােমাদের সঙ্গে বসে চার-পাঁচটা হয়ে যায়। রাতে বাড়ি ফিরে যতক্ষণ জেগে থাকি, ততক্ষণ চলতেই থাকে। রাতে যতবার উঠব ততবার এক পেগ করে মেরে দিই। সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ঢেলে কমােড়ে গিয়ে বসি। তারপর দড়ি কাটতে কাটতে একটা। কাগজে চোখ বােলাতে বােলাতে একটা। স্নান সেরে তৈরি হতে হতে আরও একটা। এরপর খেয়ে-দেয়ে অফিস। অফিসে টেবিলের ড্রয়ারে একটা বােতল রাখা থাকে। হঠাৎ ইচ্ছে হলে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক আনিয়ে একটু ঢেলে নিই। মােটামুটি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই কালি খােবার কাজে মদকে ব্যবহার করে যাচ্ছি। কথা শেষ করে ম্লান হাসল অম্বর। আতঙ্কিত উদ্বেগে আমার মন ভারাক্রান্ত হল। অম্বর বলল, কালিটা বড্ড গাঢ়। মাঝখান থেকে মদ আমার শরীরটাকে দ্রুত চিতার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।
আমি বললাম, সব বুঝেও তুমি আত্মাহুতি দিচ্ছ কেন ?
ও বলল, একটা তুষার-চিতার জন্য। যেখানে পােড়ার পর শরীরটা হিমশীতল হয়ে যাবে। শান্ত হব—শান্তি পাব।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!