17-03-2020, 04:44 PM
ভালবাসার রাজপ্রাসাদ
Written By pinuram
Disclaimer : এই কাহিনীর কিছু চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক, কিছু চরিত্র এবং ঘটনা বাস্তব। পুরানো হলুদ কিছু পাতা নিয়ে আবার করে সামনে আসা, এক নতুন ভাবে পরিবেশন করা এই গল্প।
ভুমিকাঃ
এই জীবন ছিল নদীর মতন গতি হারা দিশা হারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
ওগো আমি হয়ে গেছি তারা,
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
আগে ছিল শুধু পরিচয় ,পরে হল মন বিনিময়
আগে ছিল শুধু পরিচয় ,পরে হল মন বিনিময়
শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়
আমি যখনি ডাকি জানি তুমি দেবে সারা
এই জীবন ছিল নদীর মতন গতি হারা দিশা হারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম প্রেম
নিমন্ত্রন
সন ২০০০, শীতকাল ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। নভেম্বর মাসের ঠাণ্ডা শীত তখন ঠিক মতন পড়েনি। । বাইশটা বসন্ত পেরিয়ে, অভিমন্যু তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আবছা কুয়াশা মাখা মিষ্টি রোদ আর ঘাসের ডগায় শিশিরের চিকমিক যেন মন টাকে ব্যাকুল করে তোলে এক অজানা আনন্দের খোঁজে। দিনটা ছিল রবিবার। অভিমন্যু বসার ঘরে বসে আপনমনে খবরের কাগজ’টা পড়ছিল, না ঠিক পড়ছিল নয়, দেখছিল আর গরম চায়ে সুরত সুরুত করে চুমুক দিচ্ছিল। ওর মা রান্না ঘরে রান্না করছিলেন আরে বাবা বাজারে গেছিলেন।
ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। মা বললেন এক বার দেখতে, হয়ত পেপারওয়ালা মাসের টাকা নিতে এসেছে। অভি দৌড়ে নিচে গিয়ে দেখে যে দরজায় একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। অভি তাদের কাউকেই চেনেনা।
ভদ্রলোক অভি কে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মা বাড়িতে আছেন?"
মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় অভি যে মা বাড়িতে আছেন। ভদ্রলোক নিজের পরিচয়ে বললেন যে তিনি মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই হন। অভি ওদেরকে বাড়ির মধ্যে আসার জন্য বলল এবং বসার ঘরে বসতে বলে মাকে ডাকতে গেল।
মা বসার ঘরে ঢুকে অবাক, "আরে শশাঙ্ক, কি ব্যাপার? অনেক দিন পরে। এটা তোর বউ, মেঘনা? ভাল ভাল, তা অনেক দিন পরে কি মনে করে আসা হল?"
কথাবার্তায় জানা গেল যে, শশাঙ্ক অভির মায়ের খুব দূর সম্পর্কের ভাই হন। তাঁরা তিন ভাই, তিন বোন। ছোটো ভাই সুব্রতর বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রন করতে এসেছে। কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে, শশাঙ্কর ছোটো বোন তখন অবিবাহিতা আর তাঁরা এক উপযুক্ত পাত্রের খোঁজে করছেন। তাঁরা সবাই গ্রামের বাড়িতে এক যৌথ পরিবারে থাকে, গ্রামের নাম বসিরহাট। অভি’র মা একজন শিক্ষিকা, মায়ের কলেজও বসিরহাটে। মা যখন কলেজের চাকরি শুরু করেন তখন তিনি ওদের বাড়িতে থাকতেন। অভির জন্মের বছর দুই আগে, মায়ের ছোটো মাসি, শশাঙ্কের মা, এক কন্যে সন্তানের জন্ম দেন। মায়ের ছোট্ট কুট্টী বোন, শুচিস্মিতা। মায়ের মুখে অভি তার কথা অনেক শুনেছে, কেমন করে অভি কে নিয়ে সারাদিন খেলে বেড়াত শুচিস্মিতা।
অভিমন্যুর যখন দুষ্টুমি করার বয়স হল এবং কলেজ যেতে শুরু করল তখন অভির বাবা মা, কলকাতা চলে আসেন। অভির মনে সেই ছোটো বেলার কোন কথাই মনে নেই। সব তাই যেন এক স্বপ্ন ধোঁয়াটে।
অভির মা অভিকে বললেন যে, শুচিস্মিতা বাড়ির ছোটো মেয়ে সেই জন্য সব থেকে দুষ্টু ছিল। ওর চেয়ে শুধু অভি ছোটো ছিল তাই অভিকে নিয়ে ওর যত খেলাধুলা চলত। টানতে টানতে নিয়ে যেত আমের বাগানে, পুকুর পাড়ে, ধানের ক্ষেতে। অভি ছিল তার জলজ্যান্ত খেলার পুতুল, যাকে নিয়ে ওর সারাদিন কেটে যেত শুধু খেলায়।
গ্রামে সবারই বড় এবং যৌথ পরিবার হয়ে থাকে। শশাঙ্কের দেরও যৌথ পরিবার এবং ওদের এক ছেলে, নাম নীলাঞ্জন, ক্লাস ফোরে পড়ে।
মা শশাঙ্কের নিমন্ত্রন স্বীকার করলেন আর জানালেন যে তাঁরা সবাই সুব্রতর বিয়েতে যাবেন।
প্রথম দেখা
বিয়ের দিন ছিল দিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এক সুন্দর সকালে ওরা বেড়িয়ে পড়ল মায়ের মাসির বাড়ি, বসিরহাটের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কোলকাতা ছেড়ে, ধান খেতের মাঝ দিয়ে ছুটে চলতে লাগল। অভি জানাল্র পাশে বসে পুরান স্মৃতি রোমন্থন করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে গেল। কেমন দেখতে হবে সেই শুচিস্মিতা যে ওকে কোলে নিয়ে ছোটো বেলায় অনেক খেলা করেছে, শীতের রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচিয়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতে অভি একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অভি’র ঘুম ভাঙ্গল মায়ের ডাকে, "এই ওঠ। বসিরহাট এসে গেছে প্রায়। এর পরের স্টপেজে আমাদের নামতে হবে।"
বাস থেকে নামার পরে মা জানালেন যে শশাঙ্কর বাড়ি বড় রাস্তা থেকে প্রায় মাইল দুই তিন ভেতরে, এতটা রাস্তা হাটতে হবে তবে গিয়ে গ্রামে পৌঁছান যাবে। অভি জিজ্ঞেস করল যে কোন রিক্সা পাওয়া যায় কিনা।
প্রতিউত্তর অভির বাবা বললেন যে, "ব্যাটা, গ্রামের হাওয়া বাতাসে অনেক অক্সিজেন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নে, এই সুদ্ধ হাওয়া বাতাস কোলকাতায় পাবি না। এখানে তুই মাটির অনেক কাছে আছিস, হেঁটে চল।"
বাবার কথা তো আর অমান্য করা যায় না, অগত্যা অভি হাঁটতে শুরু করে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মা ওকে শুচিস্মিতার গল্প শুনালেন। সেই শুনে অভির মনে শুচিস্মিতাকে দেখার এক প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠল।
অনেকক্ষণ হাঁটার পরে ওরা সবাই মায়ের মাসির বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়িটা বিশাল। মায়ের মেসোমশাই বেশ বড় চাষা ছিলেন, অনেক জমি জমা ছিল এককালে। অনেকদিন আগেই তিনি দেহরক্ষা করেছেন। মেসোমশাই মারা যাবার পরে, বড় ভাই সুমন্ত পরিবারের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। সংসারের জোয়াল কাঁধে পরাতে তিনি আর বেশি পড়াশুনা করতে পারলেন না, তিনি চাষ বাস করে বাকি ভাই বোনেদের পড়াশুনা করিয়েছেন এবং বোনেদের বিয়েথা দিয়েছেন।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মনে হল যেন এক জন সমুদ্রের মাঝে এসে পড়েছে অভি। চারদিকে লোকজনের হইহুল্লর, চেঁচামেচি, দৌড়া দউরি লেগে আছে। অভি সেই পরিবেশে একদম নতুন, কাউকেই সে চেনে না। মায়ের মাসিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মা। ঝুঁকে প্রনাম করল অভি। দিদু পরিবারের সবাইকে ডেকে অভির পরিবারের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিল। অভির চোখ থেকে থেকে শুচিস্মিতাকে খোঁজে, তার কোন দেখা নেই। অভির বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, জিজ্ঞেস করবে কি করবেনা যে শুচিস্মিতা কোথায়, জিজ্ঞেস করাটা বাতুলতা হতে পারে সেই ভয়ে জিজ্ঞেস করল না অভি। মা মেঘনা কে শুচিস্মিতার কথা জিজ্ঞেস করলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অভি। মেঘনা উত্তর দিলেন যে যেহেতু শুচিস্মিতা বাড়ির সব থেকে ছোটো মেয়ে তাই ছোটবেলা থেকেই অনেক চঞ্চল। ওর বাড়ির বিয়ে হয়ত কোথাও ওর বান্ধবীদের সাথে ঘুরছে বা আড্ডা মারছে।
ঠিক সেইসময়ে ওদের পাশ দিয়ে একদল মেয়ে গল্প করতে করতে আর ফুল হাতে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। মেঘনা ওদের মধ্যে একজন কে ডাক দিল, "পরী এই দিকে শোনো। উলুপি দি ডাকছে তোমাকে।"
মেয়েদের দলের মাঝ থেকে একটি সুন্দরী তরুণী এগিয়ে এল। লাল ঠোঁটে লেগে আছে মনমোহক হাসি। মেয়েটি ঝুঁকে মায়ের পায়ে প্রনাম করল। অভির মা, দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। তারপর মেয়েটির চিবুক ছুঁয়ে আদর করে কপালে একটা চুমু খেলেন।
মাতৃ সুলভ স্বরে বললেন, "পরী! আমার ছোট্ট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক দিন তোকে দেখিনি রে।"
অভি নিস্পলক চোখে মেয়েটির সৌন্দর্য সুধা পান করে চলেছে। মেয়েটির গায়ের রঙ বেশ ফর্সা যেন একটু আলতা ছোঁয়ান। পরনে একটি ছোটো হাতার হালকা গোলাপি রঙের জমকালো সালোয়ার কামিজ পড়েছে। মাথার লম্বা ঘন কালো চুল একটা হাত খোঁপা করে ঘাড়ের কাছে আলত করে বাঁধা। খোঁপায় জুঁই ফুল গোঁজা, আর সেই জুঁই ফুলের গন্ধে চারপাশ মাতোয়ারা করে তুলেছে। শীতের মিষ্টি রদ্দুর যেন ওর ত্বকের ওপরে পেছল খাচ্ছে। ডিম্বাকৃতি মুখাবয়াব, হাসলে দু’গালে টোল পরে, আর তাতে যেন হাসিটার সৌন্দর্য আরও শত গুন বেড়ে যায়। মেয়েটির রুপে মোহিত হয়ে যায় অভিমন্যু, হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর দিকে।
পরী একবার অভির হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে, মাকে প্রশ্ন করল, "এটি তোমার পুত্র অভিমন্যু, তাই না?"
মা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ। তোর মনে আছে, ছোটো বেলায় তুই এর সাথে খেলতিস। তুই যেখানে যেতিস, তোর সাথে একেও টেনে নিয়ে যেতিস।"
পরী অভির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, "বাঃবা, অভিমন্যু তো অনেক বড় হয়ে গেছে।"
অভির দিকে তাকিয়ে এক মিষ্টি হাসল পরী। সেই হাসি দেখে অভির বুকের ভেতরের রক্ত ছলকে উঠল। আওয়াজ শুনে মনে হল যেন ওর কানে কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে।
মাকে জড়িয়ে ধরে পরী বলল, "উলুপিদি, আমার না খুব তাড়া আছে। আমি এখন যাচ্ছি, পরে তোমাদের সাথে কথা বলব।" তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি আমাকে পরী বলে ডাকতে পার। আমাকে বাড়ির সবাই পরী বলেই ডাকে। আমার এখন খুব তাড়া আছে, আমি তোমার সাথে পরে দেখা করব।"
মেঘনা পরীকে বলল, "তোমার কোন তাড়া নেই, পরী। তুমি শুধু আড্ডা মেরে বেড়াবে আর কিছু না।"
পরী মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "অঃ বৌদি, এইত সময় আমার আড্ডা মারার আর মজা করার।"
তারপরে পরী ওর বান্ধবীদের সাথে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। অভি নিস্পলক চোখে পরীর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। নাসারন্ধ্রে তখন শুধু জুঁইয়ের গন্ধ মম-মম করছে।
অভির মা অভিকে বললেন যে ঘুরে ফিরে সবার সাথে আলাপ পরিচয় করে নিত। নিজেরা চলে গেলেন ভেতরে। অভি একা একা কি করবে ঠিক ভেবে পেল না। একেবারে নতুন পরিবেশ নতুন মানুষজন, কাউকেই ও চেনেনা।
এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে উঠে গেল অভি। পড়ন্ত দুপুরের রোদে ছাদের ওপরে একা একা ঘুরতে ঘুরতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে গ্রামের শোভা দেখতে লাগল।হটাত করে চোখ গেল নিচে উঠানে। সেই মেয়েদের দল উঠানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। পরী কে দেখতে ঠিক এক রাজকুমারীর যেন সখী পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে সেই রকম লাগছে। অভির চোখ আবার যেন পরীর শরীরের আঁকিবুঁকি মাপার জন্যে আনচান করছে। পরীর গঠন যেন প্রাচিন এক বালি-ঘড়ির মতন। তিন তলার ছাদ থেকে অভি পরীর রুপ ব্যাস এইটুকুই দেখে মন শান্তি করতে হল।
পরীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে প্রেমে পরে গেছে অভি। এক অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তি বাঁ ভাললাগা যেন ওকে পরীর দিকে টানছে। কিছু পরে মেয়েদের দলটি উঠান ছেড়ে অন্য দিকে চলে গেল।
বিমোহিত সৌন্দর্য
অভি পুনরায় পরীর চিন্তায় হারিয়ে গেল, যদি পরী ওর সাথে দেখা করতে না আসে? কিন্তু না আসার ত কোন কারন খুঁজে পাচ্ছে না। অভি’ত পরীর আত্মীয় হয় মাত্র, দেখা করতে আসা বা কথা বলা দৃষ্টিকটু নয়।
সূর্যি পশ্চিম আকাশের দিকে ঢলে চলেছে। বাড়ির সকলে নিজেদের সাজসজ্জা নিয়ে ব্যাস্ত। বিয়ে বলে কথা তাই সবাই নিজেদের কে নিখুত করে তুলতে তৎপর। অভি বরযাত্রী। অভি জানতে পারল যে কনের বাড়ি বসিরহাট থেকে অনেক দূর, রানাঘাট নামক এক জায়গায়, বাসে প্রায় ঘন্টা চারেক লাগবে যেতে। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে।
বাঙ্গালীর প্রিয় পোশাক ধুতি পাঞ্জাবী। সাধারনত অভি ধুতি পাঞ্জাবী পরেনা, কিন্তু খুব কাছের কারুর বিয়ে হলে ধুতি পাঞ্জাবী পরে। অভি একটি ধাক্কা পাড়ের ধুতি আর তসরের পাঞ্জাবী পরে। গায়ে জড়িয়ে নেয় ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরি শাল। এই জন সমুদ্রে অভিকে একদম আলাদা লাগছে ওর পোশাকের জন্য। এককোনে দাঁড়িয়ে থাকে অভি, চারদিকে সাজ সাজ কোলাহল।
সূর্যি পশ্চিম দিগন্তে পাটে চলে গেছে। বিয়ে বাড়ি সহস্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। বিয়ের ভিড়ে অভি আবার একা সাথে শুধু পরীর মুখাবয়াব চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে হটাত করে কেউ অভির পাঞ্জাবির হাতা ধরে টান মারে। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছ।
অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি হল?"
ছেলেটি উত্তর দিল, "আমি নীলাঞ্জন। সবাই আমাকে দুষ্টু নামে ডাকে, আমি তোমার শশাঙ্ক মামার পুত্র।"
অভি হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় দুষ্টুর সাথে, "তোমার সাথে দেখা করে বেশ ভাল লাগল।"
দুষ্টু উত্তর দিল, "আমার ছোটো পিসি, পরী, তোমাকে উঠানে ডাকছে।"
অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, "কেন ডাকছে?"
ওদিকে মনে তখন ওর নাচন ধরেছে!
দুষ্টু একটি শয়তানি হাসি হেসে বলে, "দেখা করে নিজেই জিজ্ঞেস করে নিও কেন ডাকছে।"
এই বলে দুষ্টু পালিয়ে গেল।
অভি উঠানের দিকে পা বাড়াল। প্রত্যেক পদে ওর বুকের ধুকপুকানি শতগুন বেড়ে গেছে, হৃদয়টা যেন পাঁজর ফেটে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে। সেই শীতের রাতে অধির ব্যাকুলতায় অভির ঘাম দিয়ে দিল।
উঠানে পা রাখতেই অভি দেখতে পেল যে পরী আর কিছু মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই মহিলাদের মাঝে অভির মা ও বর্তমান। মাকে দেখে অভির বুকটা বেলুনের থেকে হাওয়া বেড়িয়ে যাওয়ার মতন চুপসে গেল।
মা ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল, "এদিকে আয়। সারা দিন কোথায় ছিলিস তুই?"
পরী ওর দিকে দুষ্টুমি মাখা হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "হ্যাঁ অভিমন্যু, সারাদিন কোথায় ছিলে?"
ওই হাসি দেখে, অভির মনে হল বলে ফেলে, "তোমার খেয়ালে ডুবে ছিলাম সারাদিন।"
মা ওকে জানিয়ে দিলেন যে বাস বিকেল ছ’টার মধ্যে ছেড়ে যাবে, যেখানেই থাকুক না কেন অভি যেন ঠিক সময়ে বাসে উপস্থিত থাকে।
পরী অভির পাশে এসে ওর মাকে বলল, "কোন চিন্তা করোনা উলুপিদি। ছোটো বেলায় ওকে যেমন দেখতাম ঠিক তেমনি করে দেখব আমি।"
পরীর দিকে তাকাল অভি। পরীর পরনে কালো রঙের জমকালো শাড়ি তাতে সোনালি সুতোর ভারী কাজ। রুপ দেখে মনে হল যেন আকাশ থেকে একটুকরো তারা মাটিতে নেমে এসেছে। পাশে দাঁড়িয়ে অভির বাজুতে হাত ছোঁয়াল পরী। হাতের ছোঁয়ায় অভির সারা অঙ্গে যেন বিদুত্য খেলে গেল। অভির নাকে পরীর সেই মনমাতান জুঁইয়ের গন্ধে ভরে উঠল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখ। টিয়ে পাখীর মতন নাক, টানা টানা কাজল কালো দুই চোখ, দুই ভুরু যেন কালো দুই চাবুক। ঠোঁট জোড়া যেন রসাল কোন ফল।
অভির দিকে তাকিয়ে পরী ইশারা করল ওর সাথে হাঁটতে। নির্বাক হয়ে এতক্ষণ অভি শুধু পরীকে দেখে যাচ্ছিল, ওর কথা শুনে হতবাকের ন্যায় ওর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
পরী ওকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার কি ছোটবেলার কোন কথাই মনে নেই?"
নির্বাক অভি মাথা নাড়ল, "না নেই।"
পরী, "তুমি নাকি পড়াশুনায় বেশ ভাল।"
অভি আবার মাথা নাড়ল, "হুম।"
পরী, "তোমাকে না এই ধুতি পাঞ্জাবিতে দারুন হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। তুমি কি সবসময়ে ধুতি পাঞ্জাবী পর?"
নির্বাক অভি আবার মাথা নাড়ল, "না"।
কথা কি বলবে অভি ওত বাক শক্তি হারিয়ে শুধু পরীর কথা শুনে যাচ্ছে।
পরী, "আমি গ্রাজুয়েসান ফিসিক্সে করেছি। শুনলাম তুমিও নাকি ফিসিক্সে গ্রাজুয়েসান করছ?"
অভি আবার মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ।"
পরী, "আমি আরও পড়তে চাই। আমার মা আমার বিয়ের জন্যে ছেলে দেখছে। আমি অনেক বলে কয়ে উলুপিদিকে ডাকিয়েছি। উলুপিদি হাইয়ার পড়াশুনা করে এখন কলেজে চাকরি করেন। উনি যে কলেজে চাকরি করেন সেই কলেজে আমি ছোটো বেলায় পড়তাম। আমি আশা করে আছি যে তোমার মা আমার মাকে বলে বুঝাবে যাতে আমি আগেও পড়াশুনা করতে পারি আর উলুপিদির মতন আমিও কলেজে টিচার হতে চাই।"
অভি চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি হাঁটার ফলে মাঝে মাঝে পরীর হাত অভির হাতের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝ আঙ্গুল গুলির একে ওপরকে ছঁচ্ছে। আঙ্গুলের সেই কোমল স্পর্শে অভির শিরদাঁড়ায় যেন বিদ্যতু খেলে যায়। বারে বারে অভির নজর পরীর মুখের দিকে চলে যায়।
পরী, "তোমার মাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। উলুপিদি বলেছেন যে ঠিক সময়ে আমার মাকে সব বুঝিয়ে বলবে যাতে আমার মা আমাকে আগেও পরাশুনার জন্য বারন না করে। আমি জানি যে আমার মা তোমার মায়ের কথা উপেক্ষা করতে পারবে না। আমি মায়ের মুখে শুনেছি যে তোমার মা নাকি আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসত আর আমার মা তোমার মায়ের সব কথা শুনত। সেইসব দিন চলে গেছে, আর আমাদের মাঝের ব্যাবধান অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন আগে তোমার মায়ের কথা উঠতে আমার মায়ের চোখে জল চলে আসে। আজও আমার মা উলুপিদির কথা মনে করে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। সেইসব শুনে আমার মনে হল যে আমি যদি উলুপিদিকে আমার মনের কথা খুলে বলি আর উলুপিদি যদি আমার মাকে বলে তাহলে আমার মা তোমার মায়ের কথা ফেলতে পারবে না।"
অভির দিকে তাকিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে, "তোমার কি মনে হয় অভিমন্যু? মা আমাকে পড়াশুনা করতে দেবে?"
নির্বাক অভি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে চেষ্টা করল, কি উত্তর দেবে, ওর কানে ত একবর্ণ ও কথা ঢোকেনি।
পরী একটু রাগত ভাবে বলল, "কি হল অভিমন্যু? তখন থেকে শুধু আমিই কথা বলে যাচ্ছি। তোমার কি জিব নেই নাকি না বোবা তুমি। তখন থেকে শুধু গরুর মতন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছ যে। কিছু’ত উত্তর দেবে নাকি?"
আকাশের দিকে তাকিয়ে অভি বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিল। বুকের মধ্যে সাহস জুগিয়ে দুম করে বললে ফেলল, "পরী তুমি ভারী সুন্দরী।" কথাটা বলে ফেলেই চোখ বন্ধ করে নেই অভি, এই বুঝি পরী ওর গালে সপাটে এক চড় কসিয়ে দেয়।
পরী ওর কথা শুনে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। অভির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তুমি তার মানে আমার কোন কথাই শোনোনি, তাইত। তুমি একদম শয়তান ছেলে, মনে মনে আবার আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে?"
অভির হাতে সজোরে একটা থাপ্পর মেরে বলল, "তুমি না খুব শয়তান।"
অভি মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, "না সেই কথা নয়। আমি তোমার কথা সব শুনেছি কিন্তু তুমি ভারী সুন্দরী দেখতে, পরী।"
পরী লাজুক হেসে উত্তর দিল, "দুষ্টু ছেলে, যাই হক, থ্যাঙ্কস ফর দা কমপ্লিমেন্টস।"
অভি জিজ্ঞেস করল, "তোমার বান্ধবীরা কোথায়, তুমি তাদের সাথে কেন নয়?"
পরী উত্তরে জানাল যে, ওর বান্ধবীদের বউভাতে নিমন্ত্রন করা হয়েছে। যেহেতু পরী বাড়ির সবার ছোটো সেইজন্য এই ভিড়ে ওরও খুব একা একা লাগছে।
অভির মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, একটু খানি পরীর ছোঁয়া পাওয়ার জন্য হাত বাড়াল পরীর দিকে। ঠিক সেই সময়ে অভির মা ওদের কে ডাক দিলেন, বললেন যে বাস ছাড়ছে ওরা যেন বাসে উঠে পরে। কপালে করাঘাত করল অভি, "ধুর বাবা, এই সময়ে কি মাকে ডাক দিতে হত, একটু পরে ডাক দিলে হত না।"
পরী বুঝতে পারে অভির মনের কথা, বুঝতে পারে যে অভি ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা এক হাসি দিয়ে বলল, "আমি অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু......"
এই বলে অভিকে ওখানে একা ছেড়ে বাসের দিকে দৌড়ে চলে গেল।
Written By pinuram
Disclaimer : এই কাহিনীর কিছু চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক, কিছু চরিত্র এবং ঘটনা বাস্তব। পুরানো হলুদ কিছু পাতা নিয়ে আবার করে সামনে আসা, এক নতুন ভাবে পরিবেশন করা এই গল্প।
ভুমিকাঃ
এই জীবন ছিল নদীর মতন গতি হারা দিশা হারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
ওগো আমি হয়ে গেছি তারা,
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
আগে ছিল শুধু পরিচয় ,পরে হল মন বিনিময়
আগে ছিল শুধু পরিচয় ,পরে হল মন বিনিময়
শুভ লগ্নে হয়ে গেল শুভ পরিণয়
আমি যখনি ডাকি জানি তুমি দেবে সারা
এই জীবন ছিল নদীর মতন গতি হারা দিশা হারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে আমি হয়ে গেছি তারা।
প্রথম অধ্যায়ঃ প্রথম প্রেম
নিমন্ত্রন
সন ২০০০, শীতকাল ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। নভেম্বর মাসের ঠাণ্ডা শীত তখন ঠিক মতন পড়েনি। । বাইশটা বসন্ত পেরিয়ে, অভিমন্যু তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আবছা কুয়াশা মাখা মিষ্টি রোদ আর ঘাসের ডগায় শিশিরের চিকমিক যেন মন টাকে ব্যাকুল করে তোলে এক অজানা আনন্দের খোঁজে। দিনটা ছিল রবিবার। অভিমন্যু বসার ঘরে বসে আপনমনে খবরের কাগজ’টা পড়ছিল, না ঠিক পড়ছিল নয়, দেখছিল আর গরম চায়ে সুরত সুরুত করে চুমুক দিচ্ছিল। ওর মা রান্না ঘরে রান্না করছিলেন আরে বাবা বাজারে গেছিলেন।
ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। মা বললেন এক বার দেখতে, হয়ত পেপারওয়ালা মাসের টাকা নিতে এসেছে। অভি দৌড়ে নিচে গিয়ে দেখে যে দরজায় একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। অভি তাদের কাউকেই চেনেনা।
ভদ্রলোক অভি কে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মা বাড়িতে আছেন?"
মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয় অভি যে মা বাড়িতে আছেন। ভদ্রলোক নিজের পরিচয়ে বললেন যে তিনি মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই হন। অভি ওদেরকে বাড়ির মধ্যে আসার জন্য বলল এবং বসার ঘরে বসতে বলে মাকে ডাকতে গেল।
মা বসার ঘরে ঢুকে অবাক, "আরে শশাঙ্ক, কি ব্যাপার? অনেক দিন পরে। এটা তোর বউ, মেঘনা? ভাল ভাল, তা অনেক দিন পরে কি মনে করে আসা হল?"
কথাবার্তায় জানা গেল যে, শশাঙ্ক অভির মায়ের খুব দূর সম্পর্কের ভাই হন। তাঁরা তিন ভাই, তিন বোন। ছোটো ভাই সুব্রতর বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রন করতে এসেছে। কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে, শশাঙ্কর ছোটো বোন তখন অবিবাহিতা আর তাঁরা এক উপযুক্ত পাত্রের খোঁজে করছেন। তাঁরা সবাই গ্রামের বাড়িতে এক যৌথ পরিবারে থাকে, গ্রামের নাম বসিরহাট। অভি’র মা একজন শিক্ষিকা, মায়ের কলেজও বসিরহাটে। মা যখন কলেজের চাকরি শুরু করেন তখন তিনি ওদের বাড়িতে থাকতেন। অভির জন্মের বছর দুই আগে, মায়ের ছোটো মাসি, শশাঙ্কের মা, এক কন্যে সন্তানের জন্ম দেন। মায়ের ছোট্ট কুট্টী বোন, শুচিস্মিতা। মায়ের মুখে অভি তার কথা অনেক শুনেছে, কেমন করে অভি কে নিয়ে সারাদিন খেলে বেড়াত শুচিস্মিতা।
অভিমন্যুর যখন দুষ্টুমি করার বয়স হল এবং কলেজ যেতে শুরু করল তখন অভির বাবা মা, কলকাতা চলে আসেন। অভির মনে সেই ছোটো বেলার কোন কথাই মনে নেই। সব তাই যেন এক স্বপ্ন ধোঁয়াটে।
অভির মা অভিকে বললেন যে, শুচিস্মিতা বাড়ির ছোটো মেয়ে সেই জন্য সব থেকে দুষ্টু ছিল। ওর চেয়ে শুধু অভি ছোটো ছিল তাই অভিকে নিয়ে ওর যত খেলাধুলা চলত। টানতে টানতে নিয়ে যেত আমের বাগানে, পুকুর পাড়ে, ধানের ক্ষেতে। অভি ছিল তার জলজ্যান্ত খেলার পুতুল, যাকে নিয়ে ওর সারাদিন কেটে যেত শুধু খেলায়।
গ্রামে সবারই বড় এবং যৌথ পরিবার হয়ে থাকে। শশাঙ্কের দেরও যৌথ পরিবার এবং ওদের এক ছেলে, নাম নীলাঞ্জন, ক্লাস ফোরে পড়ে।
মা শশাঙ্কের নিমন্ত্রন স্বীকার করলেন আর জানালেন যে তাঁরা সবাই সুব্রতর বিয়েতে যাবেন।
প্রথম দেখা
বিয়ের দিন ছিল দিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এক সুন্দর সকালে ওরা বেড়িয়ে পড়ল মায়ের মাসির বাড়ি, বসিরহাটের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কোলকাতা ছেড়ে, ধান খেতের মাঝ দিয়ে ছুটে চলতে লাগল। অভি জানাল্র পাশে বসে পুরান স্মৃতি রোমন্থন করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে গেল। কেমন দেখতে হবে সেই শুচিস্মিতা যে ওকে কোলে নিয়ে ছোটো বেলায় অনেক খেলা করেছে, শীতের রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচিয়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতে অভি একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অভি’র ঘুম ভাঙ্গল মায়ের ডাকে, "এই ওঠ। বসিরহাট এসে গেছে প্রায়। এর পরের স্টপেজে আমাদের নামতে হবে।"
বাস থেকে নামার পরে মা জানালেন যে শশাঙ্কর বাড়ি বড় রাস্তা থেকে প্রায় মাইল দুই তিন ভেতরে, এতটা রাস্তা হাটতে হবে তবে গিয়ে গ্রামে পৌঁছান যাবে। অভি জিজ্ঞেস করল যে কোন রিক্সা পাওয়া যায় কিনা।
প্রতিউত্তর অভির বাবা বললেন যে, "ব্যাটা, গ্রামের হাওয়া বাতাসে অনেক অক্সিজেন। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নে, এই সুদ্ধ হাওয়া বাতাস কোলকাতায় পাবি না। এখানে তুই মাটির অনেক কাছে আছিস, হেঁটে চল।"
বাবার কথা তো আর অমান্য করা যায় না, অগত্যা অভি হাঁটতে শুরু করে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মা ওকে শুচিস্মিতার গল্প শুনালেন। সেই শুনে অভির মনে শুচিস্মিতাকে দেখার এক প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠল।
অনেকক্ষণ হাঁটার পরে ওরা সবাই মায়ের মাসির বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়িটা বিশাল। মায়ের মেসোমশাই বেশ বড় চাষা ছিলেন, অনেক জমি জমা ছিল এককালে। অনেকদিন আগেই তিনি দেহরক্ষা করেছেন। মেসোমশাই মারা যাবার পরে, বড় ভাই সুমন্ত পরিবারের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। সংসারের জোয়াল কাঁধে পরাতে তিনি আর বেশি পড়াশুনা করতে পারলেন না, তিনি চাষ বাস করে বাকি ভাই বোনেদের পড়াশুনা করিয়েছেন এবং বোনেদের বিয়েথা দিয়েছেন।
বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মনে হল যেন এক জন সমুদ্রের মাঝে এসে পড়েছে অভি। চারদিকে লোকজনের হইহুল্লর, চেঁচামেচি, দৌড়া দউরি লেগে আছে। অভি সেই পরিবেশে একদম নতুন, কাউকেই সে চেনে না। মায়ের মাসিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মা। ঝুঁকে প্রনাম করল অভি। দিদু পরিবারের সবাইকে ডেকে অভির পরিবারের সাথে সবার আলাপ করিয়ে দিল। অভির চোখ থেকে থেকে শুচিস্মিতাকে খোঁজে, তার কোন দেখা নেই। অভির বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, জিজ্ঞেস করবে কি করবেনা যে শুচিস্মিতা কোথায়, জিজ্ঞেস করাটা বাতুলতা হতে পারে সেই ভয়ে জিজ্ঞেস করল না অভি। মা মেঘনা কে শুচিস্মিতার কথা জিজ্ঞেস করলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অভি। মেঘনা উত্তর দিলেন যে যেহেতু শুচিস্মিতা বাড়ির সব থেকে ছোটো মেয়ে তাই ছোটবেলা থেকেই অনেক চঞ্চল। ওর বাড়ির বিয়ে হয়ত কোথাও ওর বান্ধবীদের সাথে ঘুরছে বা আড্ডা মারছে।
ঠিক সেইসময়ে ওদের পাশ দিয়ে একদল মেয়ে গল্প করতে করতে আর ফুল হাতে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। মেঘনা ওদের মধ্যে একজন কে ডাক দিল, "পরী এই দিকে শোনো। উলুপি দি ডাকছে তোমাকে।"
মেয়েদের দলের মাঝ থেকে একটি সুন্দরী তরুণী এগিয়ে এল। লাল ঠোঁটে লেগে আছে মনমোহক হাসি। মেয়েটি ঝুঁকে মায়ের পায়ে প্রনাম করল। অভির মা, দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। তারপর মেয়েটির চিবুক ছুঁয়ে আদর করে কপালে একটা চুমু খেলেন।
মাতৃ সুলভ স্বরে বললেন, "পরী! আমার ছোট্ট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক দিন তোকে দেখিনি রে।"
অভি নিস্পলক চোখে মেয়েটির সৌন্দর্য সুধা পান করে চলেছে। মেয়েটির গায়ের রঙ বেশ ফর্সা যেন একটু আলতা ছোঁয়ান। পরনে একটি ছোটো হাতার হালকা গোলাপি রঙের জমকালো সালোয়ার কামিজ পড়েছে। মাথার লম্বা ঘন কালো চুল একটা হাত খোঁপা করে ঘাড়ের কাছে আলত করে বাঁধা। খোঁপায় জুঁই ফুল গোঁজা, আর সেই জুঁই ফুলের গন্ধে চারপাশ মাতোয়ারা করে তুলেছে। শীতের মিষ্টি রদ্দুর যেন ওর ত্বকের ওপরে পেছল খাচ্ছে। ডিম্বাকৃতি মুখাবয়াব, হাসলে দু’গালে টোল পরে, আর তাতে যেন হাসিটার সৌন্দর্য আরও শত গুন বেড়ে যায়। মেয়েটির রুপে মোহিত হয়ে যায় অভিমন্যু, হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর দিকে।
পরী একবার অভির হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে, মাকে প্রশ্ন করল, "এটি তোমার পুত্র অভিমন্যু, তাই না?"
মা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ। তোর মনে আছে, ছোটো বেলায় তুই এর সাথে খেলতিস। তুই যেখানে যেতিস, তোর সাথে একেও টেনে নিয়ে যেতিস।"
পরী অভির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, "বাঃবা, অভিমন্যু তো অনেক বড় হয়ে গেছে।"
অভির দিকে তাকিয়ে এক মিষ্টি হাসল পরী। সেই হাসি দেখে অভির বুকের ভেতরের রক্ত ছলকে উঠল। আওয়াজ শুনে মনে হল যেন ওর কানে কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে।
মাকে জড়িয়ে ধরে পরী বলল, "উলুপিদি, আমার না খুব তাড়া আছে। আমি এখন যাচ্ছি, পরে তোমাদের সাথে কথা বলব।" তারপরে অভির দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি আমাকে পরী বলে ডাকতে পার। আমাকে বাড়ির সবাই পরী বলেই ডাকে। আমার এখন খুব তাড়া আছে, আমি তোমার সাথে পরে দেখা করব।"
মেঘনা পরীকে বলল, "তোমার কোন তাড়া নেই, পরী। তুমি শুধু আড্ডা মেরে বেড়াবে আর কিছু না।"
পরী মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "অঃ বৌদি, এইত সময় আমার আড্ডা মারার আর মজা করার।"
তারপরে পরী ওর বান্ধবীদের সাথে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। অভি নিস্পলক চোখে পরীর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। নাসারন্ধ্রে তখন শুধু জুঁইয়ের গন্ধ মম-মম করছে।
অভির মা অভিকে বললেন যে ঘুরে ফিরে সবার সাথে আলাপ পরিচয় করে নিত। নিজেরা চলে গেলেন ভেতরে। অভি একা একা কি করবে ঠিক ভেবে পেল না। একেবারে নতুন পরিবেশ নতুন মানুষজন, কাউকেই ও চেনেনা।
এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে উঠে গেল অভি। পড়ন্ত দুপুরের রোদে ছাদের ওপরে একা একা ঘুরতে ঘুরতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে গ্রামের শোভা দেখতে লাগল।হটাত করে চোখ গেল নিচে উঠানে। সেই মেয়েদের দল উঠানে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। পরী কে দেখতে ঠিক এক রাজকুমারীর যেন সখী পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে সেই রকম লাগছে। অভির চোখ আবার যেন পরীর শরীরের আঁকিবুঁকি মাপার জন্যে আনচান করছে। পরীর গঠন যেন প্রাচিন এক বালি-ঘড়ির মতন। তিন তলার ছাদ থেকে অভি পরীর রুপ ব্যাস এইটুকুই দেখে মন শান্তি করতে হল।
পরীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে প্রেমে পরে গেছে অভি। এক অদৃশ্য চুম্বকীয় শক্তি বাঁ ভাললাগা যেন ওকে পরীর দিকে টানছে। কিছু পরে মেয়েদের দলটি উঠান ছেড়ে অন্য দিকে চলে গেল।
বিমোহিত সৌন্দর্য
অভি পুনরায় পরীর চিন্তায় হারিয়ে গেল, যদি পরী ওর সাথে দেখা করতে না আসে? কিন্তু না আসার ত কোন কারন খুঁজে পাচ্ছে না। অভি’ত পরীর আত্মীয় হয় মাত্র, দেখা করতে আসা বা কথা বলা দৃষ্টিকটু নয়।
সূর্যি পশ্চিম আকাশের দিকে ঢলে চলেছে। বাড়ির সকলে নিজেদের সাজসজ্জা নিয়ে ব্যাস্ত। বিয়ে বলে কথা তাই সবাই নিজেদের কে নিখুত করে তুলতে তৎপর। অভি বরযাত্রী। অভি জানতে পারল যে কনের বাড়ি বসিরহাট থেকে অনেক দূর, রানাঘাট নামক এক জায়গায়, বাসে প্রায় ঘন্টা চারেক লাগবে যেতে। বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে।
বাঙ্গালীর প্রিয় পোশাক ধুতি পাঞ্জাবী। সাধারনত অভি ধুতি পাঞ্জাবী পরেনা, কিন্তু খুব কাছের কারুর বিয়ে হলে ধুতি পাঞ্জাবী পরে। অভি একটি ধাক্কা পাড়ের ধুতি আর তসরের পাঞ্জাবী পরে। গায়ে জড়িয়ে নেয় ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরি শাল। এই জন সমুদ্রে অভিকে একদম আলাদা লাগছে ওর পোশাকের জন্য। এককোনে দাঁড়িয়ে থাকে অভি, চারদিকে সাজ সাজ কোলাহল।
সূর্যি পশ্চিম দিগন্তে পাটে চলে গেছে। বিয়ে বাড়ি সহস্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। বিয়ের ভিড়ে অভি আবার একা সাথে শুধু পরীর মুখাবয়াব চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে হটাত করে কেউ অভির পাঞ্জাবির হাতা ধরে টান মারে। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছ।
অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি হল?"
ছেলেটি উত্তর দিল, "আমি নীলাঞ্জন। সবাই আমাকে দুষ্টু নামে ডাকে, আমি তোমার শশাঙ্ক মামার পুত্র।"
অভি হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় দুষ্টুর সাথে, "তোমার সাথে দেখা করে বেশ ভাল লাগল।"
দুষ্টু উত্তর দিল, "আমার ছোটো পিসি, পরী, তোমাকে উঠানে ডাকছে।"
অভি ওকে জিজ্ঞেস করে, "কেন ডাকছে?"
ওদিকে মনে তখন ওর নাচন ধরেছে!
দুষ্টু একটি শয়তানি হাসি হেসে বলে, "দেখা করে নিজেই জিজ্ঞেস করে নিও কেন ডাকছে।"
এই বলে দুষ্টু পালিয়ে গেল।
অভি উঠানের দিকে পা বাড়াল। প্রত্যেক পদে ওর বুকের ধুকপুকানি শতগুন বেড়ে গেছে, হৃদয়টা যেন পাঁজর ফেটে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে। সেই শীতের রাতে অধির ব্যাকুলতায় অভির ঘাম দিয়ে দিল।
উঠানে পা রাখতেই অভি দেখতে পেল যে পরী আর কিছু মহিলাদের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সেই মহিলাদের মাঝে অভির মা ও বর্তমান। মাকে দেখে অভির বুকটা বেলুনের থেকে হাওয়া বেড়িয়ে যাওয়ার মতন চুপসে গেল।
মা ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল, "এদিকে আয়। সারা দিন কোথায় ছিলিস তুই?"
পরী ওর দিকে দুষ্টুমি মাখা হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "হ্যাঁ অভিমন্যু, সারাদিন কোথায় ছিলে?"
ওই হাসি দেখে, অভির মনে হল বলে ফেলে, "তোমার খেয়ালে ডুবে ছিলাম সারাদিন।"
মা ওকে জানিয়ে দিলেন যে বাস বিকেল ছ’টার মধ্যে ছেড়ে যাবে, যেখানেই থাকুক না কেন অভি যেন ঠিক সময়ে বাসে উপস্থিত থাকে।
পরী অভির পাশে এসে ওর মাকে বলল, "কোন চিন্তা করোনা উলুপিদি। ছোটো বেলায় ওকে যেমন দেখতাম ঠিক তেমনি করে দেখব আমি।"
পরীর দিকে তাকাল অভি। পরীর পরনে কালো রঙের জমকালো শাড়ি তাতে সোনালি সুতোর ভারী কাজ। রুপ দেখে মনে হল যেন আকাশ থেকে একটুকরো তারা মাটিতে নেমে এসেছে। পাশে দাঁড়িয়ে অভির বাজুতে হাত ছোঁয়াল পরী। হাতের ছোঁয়ায় অভির সারা অঙ্গে যেন বিদুত্য খেলে গেল। অভির নাকে পরীর সেই মনমাতান জুঁইয়ের গন্ধে ভরে উঠল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখল ওর মুখ। টিয়ে পাখীর মতন নাক, টানা টানা কাজল কালো দুই চোখ, দুই ভুরু যেন কালো দুই চাবুক। ঠোঁট জোড়া যেন রসাল কোন ফল।
অভির দিকে তাকিয়ে পরী ইশারা করল ওর সাথে হাঁটতে। নির্বাক হয়ে এতক্ষণ অভি শুধু পরীকে দেখে যাচ্ছিল, ওর কথা শুনে হতবাকের ন্যায় ওর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।
পরী ওকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার কি ছোটবেলার কোন কথাই মনে নেই?"
নির্বাক অভি মাথা নাড়ল, "না নেই।"
পরী, "তুমি নাকি পড়াশুনায় বেশ ভাল।"
অভি আবার মাথা নাড়ল, "হুম।"
পরী, "তোমাকে না এই ধুতি পাঞ্জাবিতে দারুন হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। তুমি কি সবসময়ে ধুতি পাঞ্জাবী পর?"
নির্বাক অভি আবার মাথা নাড়ল, "না"।
কথা কি বলবে অভি ওত বাক শক্তি হারিয়ে শুধু পরীর কথা শুনে যাচ্ছে।
পরী, "আমি গ্রাজুয়েসান ফিসিক্সে করেছি। শুনলাম তুমিও নাকি ফিসিক্সে গ্রাজুয়েসান করছ?"
অভি আবার মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ।"
পরী, "আমি আরও পড়তে চাই। আমার মা আমার বিয়ের জন্যে ছেলে দেখছে। আমি অনেক বলে কয়ে উলুপিদিকে ডাকিয়েছি। উলুপিদি হাইয়ার পড়াশুনা করে এখন কলেজে চাকরি করেন। উনি যে কলেজে চাকরি করেন সেই কলেজে আমি ছোটো বেলায় পড়তাম। আমি আশা করে আছি যে তোমার মা আমার মাকে বলে বুঝাবে যাতে আমি আগেও পড়াশুনা করতে পারি আর উলুপিদির মতন আমিও কলেজে টিচার হতে চাই।"
অভি চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি হাঁটার ফলে মাঝে মাঝে পরীর হাত অভির হাতের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝ আঙ্গুল গুলির একে ওপরকে ছঁচ্ছে। আঙ্গুলের সেই কোমল স্পর্শে অভির শিরদাঁড়ায় যেন বিদ্যতু খেলে যায়। বারে বারে অভির নজর পরীর মুখের দিকে চলে যায়।
পরী, "তোমার মাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। উলুপিদি বলেছেন যে ঠিক সময়ে আমার মাকে সব বুঝিয়ে বলবে যাতে আমার মা আমাকে আগেও পরাশুনার জন্য বারন না করে। আমি জানি যে আমার মা তোমার মায়ের কথা উপেক্ষা করতে পারবে না। আমি মায়ের মুখে শুনেছি যে তোমার মা নাকি আমাকে নিজের মেয়ের মতন ভালবাসত আর আমার মা তোমার মায়ের সব কথা শুনত। সেইসব দিন চলে গেছে, আর আমাদের মাঝের ব্যাবধান অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন আগে তোমার মায়ের কথা উঠতে আমার মায়ের চোখে জল চলে আসে। আজও আমার মা উলুপিদির কথা মনে করে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। সেইসব শুনে আমার মনে হল যে আমি যদি উলুপিদিকে আমার মনের কথা খুলে বলি আর উলুপিদি যদি আমার মাকে বলে তাহলে আমার মা তোমার মায়ের কথা ফেলতে পারবে না।"
অভির দিকে তাকিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে, "তোমার কি মনে হয় অভিমন্যু? মা আমাকে পড়াশুনা করতে দেবে?"
নির্বাক অভি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে চেষ্টা করল, কি উত্তর দেবে, ওর কানে ত একবর্ণ ও কথা ঢোকেনি।
পরী একটু রাগত ভাবে বলল, "কি হল অভিমন্যু? তখন থেকে শুধু আমিই কথা বলে যাচ্ছি। তোমার কি জিব নেই নাকি না বোবা তুমি। তখন থেকে শুধু গরুর মতন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছ যে। কিছু’ত উত্তর দেবে নাকি?"
আকাশের দিকে তাকিয়ে অভি বুক ভরে এক নিঃশ্বাস নিল। বুকের মধ্যে সাহস জুগিয়ে দুম করে বললে ফেলল, "পরী তুমি ভারী সুন্দরী।" কথাটা বলে ফেলেই চোখ বন্ধ করে নেই অভি, এই বুঝি পরী ওর গালে সপাটে এক চড় কসিয়ে দেয়।
পরী ওর কথা শুনে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। অভির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তুমি তার মানে আমার কোন কথাই শোনোনি, তাইত। তুমি একদম শয়তান ছেলে, মনে মনে আবার আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে?"
অভির হাতে সজোরে একটা থাপ্পর মেরে বলল, "তুমি না খুব শয়তান।"
অভি মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, "না সেই কথা নয়। আমি তোমার কথা সব শুনেছি কিন্তু তুমি ভারী সুন্দরী দেখতে, পরী।"
পরী লাজুক হেসে উত্তর দিল, "দুষ্টু ছেলে, যাই হক, থ্যাঙ্কস ফর দা কমপ্লিমেন্টস।"
অভি জিজ্ঞেস করল, "তোমার বান্ধবীরা কোথায়, তুমি তাদের সাথে কেন নয়?"
পরী উত্তরে জানাল যে, ওর বান্ধবীদের বউভাতে নিমন্ত্রন করা হয়েছে। যেহেতু পরী বাড়ির সবার ছোটো সেইজন্য এই ভিড়ে ওরও খুব একা একা লাগছে।
অভির মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, একটু খানি পরীর ছোঁয়া পাওয়ার জন্য হাত বাড়াল পরীর দিকে। ঠিক সেই সময়ে অভির মা ওদের কে ডাক দিলেন, বললেন যে বাস ছাড়ছে ওরা যেন বাসে উঠে পরে। কপালে করাঘাত করল অভি, "ধুর বাবা, এই সময়ে কি মাকে ডাক দিতে হত, একটু পরে ডাক দিলে হত না।"
পরী বুঝতে পারে অভির মনের কথা, বুঝতে পারে যে অভি ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা এক হাসি দিয়ে বলল, "আমি অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু......"
এই বলে অভিকে ওখানে একা ছেড়ে বাসের দিকে দৌড়ে চলে গেল।