18-10-2019, 01:42 PM
পরের পর্ব
রিক্সা আমাদের জন্য প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। আসলে আসার পথে দোকান পাট খোলা দেখে আমি এটা ওটা দেখছিলাম আর দর দাম করছিলাম, যদিও আমার কোনও কিছুই কেনার প্ল্যান ছিল না। এটা আমার একটা বদভ্যাস। একটা ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ও আমাকে বলেছিল “ একটা নতুন রেজার কিনে দেব?” আমি খুব লজ্জা পেয়ে ওর কাঁধে একটা ঘুসি মেরে ওকে শান্ত করেছিলাম। ফেরার পথেও রিক্সায় গোটা রাস্তাটা আমি নিজের হাতটা ওর হাতের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। রিক্সায় ও দু তিনবার আমার গালে চুমুও খেয়েছিল, কনুই দিয়ে আমার ডান স্তনের ওপর ঘন ঘন ঘষে চলেছিল গোটা রাস্তা ধরে। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম যেন, অন্য দিকে তাকিয়ে ওর এই অত্যাচার সহ্য করে চললাম। হ্যাঁ, অবশেষে আমি চুটিয়ে প্রেম করছি। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি আমার লেগিন্সের পিছনে ওর বীর্যের ভেজা ছোপ ছারাও অনেকটা জায়গা জুড়ে নোংরা মাটির ময়লা লেগে গিয়েছিল, সেটা ও রাস্তার মাঝেই আমার পিছন থেকে ঝেরে দিয়েছিল। প্রথমে এইভাবে আমার পাছার ওপর সবার সামনে হাত দিয়ে ময়লা ঝারার জন্য ওকে বারণ করেছিলাম, কিন্তু ও শোনেনি, সত্যি বলতে কি আমার বেশ লেগেছিল। অচেনা জায়গায় এইভাবে নষ্টামি করতে। অনেকে তাকিয়ে তাকিয়ে লেগিন্সের উপর দিয়ে আমার পেছন থেকে ওর ময়লা ঝারা দেখেছিল। প্রথমে লজ্জা আর তারপর লজ্জার সাথে মিশে গিয়েছিল একটা ব্যভিচার মাখা স্বাদ। আর যার সাথে এইসব নষ্টামি করছি সে এখন আমার চোখের মণি। একটু ফুর্তি করলাম, তাতে কিসের ক্ষতি। এইগুলো হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেদিন আমি প্রথম ডাইরি লিখেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। সেই ঘটনায় এইবার আসব। যা বলছিলাম বাড়ি ফেরার পর যা দেখলাম আর তারপর যা যা হয়েছিল সেটা সিরিয়স ব্যাপার। চলে আসছি সেই সময়ের কথায়।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সময় অরুণ আমার কানে কানে বলল “একেবারে চেঞ্জ করে নিচে নামিস। তোর লেগিন্সের পিছনটা একটু ময়লা হয়ে আছে। ওরা অনেক প্রশ্ন করতে পারে। “ ভিতরে ঢুকে ভাগ্যি ভালো রাজা বা সন্দীপ কাউকে দেখতে পেলাম না। ও চোখের ইশারায় বোঝাল তাড়াতাড়ি আয় তারপর গল্প হবে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হেঁসে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সিঁড়ির মুখে অরুণ আবার আমার ডান কনুইটা টেনে ধরল, আরও গলা নামিয়ে বলল “ চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি নেমে আসিস কিন্তু। মাঠের ওই ছেলেটার জিনিসটার কথা ভেবে ভেবে আবার নিজে নিজে কিছু করতে শুরু করে দিস না। “ একটা চোখ মেরে নির্লজ্জের মতন চাপা গলায় হেঁসে উঠে বলল “ ভীষণ মোটা ছিল কিন্তু, ভেতরে ভরে লাগালে ভালোই সুখ পেতিস। “ আরেকটা নির্লজ্জের মতন চাপা হাঁসি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগাল। আমি দৌড়ে উপরে চলে এলাম। যত তাড়াতাড়ি পারি পরিষ্কার হয়ে স্নান করে, নোংরা প্যানটিটা কেঁচে, গায়ে একটু দিও মেখে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। রাজার ঘরে ঢুকে দেখি বেশ একটা থমথমে ভাব। তাছাড়া ওর ঘরে ঢুকেই রাজা আর সন্দীপকে দেখে একটু যেন চমকে গেছি। “কি করে হল এটা?” রাজার কপালের বা পাশে বেশ খানিকটা কেটে গেছে, দুই কনুইয়ের কাছেও দেখলাম ভালো ভাবে ছড়ে গেছে। সন্দীপ বারমুডা পরে বসেছিল, ওর ডান হাঁটুতেও দেখলাম অনেকটা ছড়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিল, কিভাবে এসব হল? রক্ত পড়ছে না কারোর ছড়ে যাওয়া বা কাটা জায়গা থেকে আর ওরা ফার্স্ট এইড ও করে নিয়েছে, কিন্তু মন বলছে বড় রকমের কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অরুণ আর আমার অবর্তমানে। অরুণকে দেখে বুঝতে পারছিলাম যে আমার আসার আগেই ওকে ওরা সব কিছু খুলে বলেছে, তবু আমার জন্য আরেকবার রাজাকে রিপিট করতে হল। ব্যাপারটা খানিকটা এইমতন হয়েছে। রাজা আর সন্দীপ ঘরে ফিরে মদ গুছিয়ে রেখে ঠিক করেছিল যে নদীর ধারে ঘুরতে যাবে। অরুণ আর আমি নেই তাই আড্ডা ঠিক মতন জমবে না। কিছুক্ষণ নদীর ধারে হাওয়া খেয়ে আবার ফিরে আসবে। নদীর ধারে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাইরের আলো কমে আসছে দেখে ওরা যখন ফিরছিল তখন মাঝ রাস্তায় তিনজন লোক ওদের ওপর চড়াও হয় হঠাতই। ওদের কে আমরা কেউই আগে কোনও দিন দেখিনি, সম্পূর্ণ অচেনা। রাজারা প্রথমে ভেবেছিল যে একলা পেয়ে টাকা পয়সা নিতে এসেছে, কিন্তু সেই গুঁড়ে বালি, কারণ ওরা নদীতে যাওয়ার সময় ড্রেস চেঞ্জ করে গিয়েছিল আর তাই কারোর সাথে কোনও পার্স ছিল না। কিন্তু পরে অনুধাবন করল ব্যাপারটা পুরো অন্য, আর তাছাড়া এখানে সচরাচর ছিন্তাই করার ঘটনা কানে আসে না। আসল ব্যাপার ওরা যতক্ষণে বুঝেছে ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। কারণ ততক্ষণে ওদের তিনজন এদের দুজনের সাথে হাতাহাতির মধ্যে ঢুকে গেছে। রাজার বক্তব্য ও নাকি নিজেও ওদের কে বেশ করে কয়েক ঘা দিয়েছে আর সন্দীপও যতটা পারে হাত পা ছুঁড়েছে, কিন্তু নিজেরাও কয়েক ঘা খেয়েছে ওদের হাতে। ওদের হাত পা ছড়ে গেছে, মাথা কেটে গেছে। যাওয়ার সময় পরিষ্কার ধমকি দিয়ে গেছে যে বাইরে থেকে এসে এখানকার ব্যাপারে বেশী নাক গলালে ওরা ছেড়ে কথা বলবে না। তার সাথে ওই দালালটার নাম নিয়ে এও বলেছে যে আমরা যদি ওর পেছনে পুলিশ লাগাই তাহলে ওরা পরের বার আরও উচিত শিক্ষা দেবে আমাদের। আমি একটু চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম “তো এখন কি ঠিক করেছিস?” রাজা বলল “এদের একটা উচিত শিক্ষা এইবার আমরা দেব। ছক কষা কাকে বলে তো জানে না। বাপ বাপান্ত করে না ছাড়লে আমার নাম নেই এই বলে দিলাম।“ সন্দীপ উঠতে উঠতে বলল “ আমরা তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আরেকটা রিক্সা আনতে বলে দিয়েছি, আজই আমরা পুলিশে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করব। একটা কিছু হেস্ত নেস্ত না করে ফিরছি না। “ আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি, আসলে আমি রিক্সা থেকে নামার পর অরুণের কথা শুনতে এত মশগুল ছিলাম যে খেয়াল করিনি আমরা ছেড়ে দেওয়ার পরও রিক্সাটা আসলে যায়নি। শ্যামদা বোধহয় ভেতর থেকে হাত দেখিয়ে ওকে আটকে রেখেছেন। বাইরে উঁকি মেরে দেখলাম আমাদের রিক্সাওয়ালাটা রিক্সার সিটে আরাম করে বসে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে। অরুণকে দেখলাম ও আগের জামা কাপড় পরেই বসে আছে, মানে চেঞ্জ করার সুযোগ পায়নি। আমি বললাম “আমাকে পাঁচ মিনিট দে, দৌড় মারলাম উপরে।“ আবার চট করে শালোয়ার কামিজ পরে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। সন্দীপ আর রাজাও পুরো তৈরি। সন্দীপের হাঁটা দেখে মনে হল ও যেন একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। জিজ্ঞেস করায় বলল “কিছু না, হাতাহাতির সময় বা পাটা মচকে গেছে। “ তবে দেখে মনে হল ভালোই খোঁড়াচ্ছে। আমরা রোজকার মতন জোড়ায় জোড়ায় রিক্সায় উঠে পুলিশ চৌকির দিকে রওয়ানা দিয়ে দিলাম।
আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি মারছে। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এমনিতেই এমন ছোট একটা চৌকি। এখন কি আর কোনও কাজের লোক সেখানে থাকবে। রিক্সায় যেতে যেতে রাজাকে সেকথা বলায় রাজা বলল “না থাকুক, কিন্তু কমপ্লেনটা আজই করতে হবে। কাল আর কখন সময় পাব জানি না। “ একটু থেমে বলল “ পরে দরকার হলে কাল হাঁসপাতাল থেকে ফিরতি পথে একবার খোঁজ নিয়ে আসব। আর স্যার যে গতকাল পুলিশকে এত কথা বলেছিলেন, ওরা কি করেছে সেটাও জানা দরকার।“ এখানে একটা কথা বলে রাখি, এই দুটো রিক্সাওয়ালা আমাদের ওপর খুবই খুশি। আমরা প্রত্যেক বারই ভাড়ার থেকে ৫-১০ টাকা বেশী দি, আর তাই আমরা যদি অন্য কোথাও যেতে বলি তাহলে এরা বেশ খুশিই হয়, কারণ আরেকটু বেশী ভাড়া পাবে। পারলে সারাদিন শুধু আমাদের নিয়েই যাতায়াত করলে এরা সবথেকে খুশি হয়। চৌকিতে পৌঁছে ভেতরে ঢুকে দেখলাম যে না আমাদের বরাত আজকে বেশ ভালো। গতকাল স্যার যে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছিলেন ওই লোকটা এখনও আছে। অলসভাবে বসে আরও দু তিনজন দারোগার সাথে গল্প গুজব করছে। আমাদের এই অসময়ে ঢুকতে দেখেই একটু যেন প্রশ্নসুচক মুখ নিয়ে আমাদেরকে একবার ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। রাজার কপালের দিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। রাজাই যা বলার বলল “ তিনজন আমাদের ওপর চড়াও হয়ে বাজে ভাবে মারধর করার চেষ্টা করেছে। আমাদের বলেছে যে বাইরে থেকে এসে ওই দালালটার পেছনে পুলিশ লাগালে আমাদের এখানে থাকতে দেবে না। এও বলেছে যে আপনাদের কাছে নাকি ওই দালালটা মাঝে মাঝে টাকাও পাঠায়। তাই আপনাদের বলে কোনও ফল হবে না, আপনারা ওই দালালটার বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না। আপনারা শুধু লোক দেখানোর জন্য উনিশ বিশ কিছু একটা করবেন আর তারপর ওরা এসে আমাদের দেখে নেবে। এখন আপনি বলুন আমাদের কি করনীয়।“ আমি জানি রাজা অনেকটা কথা নিজে থেকে রঙ চড়িয়ে বলেছে, কিন্তু তাতে ফল হল মারাত্মক। শেষ কয়েকটা কথা যখন ও বলছিল লক্ষ্য করছিলাম শ্রোতাদের চেহারা বেশ জ্বলে উঠেছে। ভালোই তাতিয়ে দিয়েছে এই লোকগুলোকে। ওর কথার সত্যতা যাচাই করার কোনও প্রশ্ন ওঠে না, কারণ কে করবে। বুঝলাম রাজার ছক কষে কেস খাওয়ানোর ব্যাপারটা কি ভয়ানক। রাজা সব কথা শেষ করে একটু থামল। আমাদের সামনের বসা লোকগুলো এখন নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। ভদ্রলোক একটু গলা পরিষ্কার করে বলল “ তোমরা গতকাল তোমাদের স্যারকে দিয়ে আমার কাছে অভিযোগ লিখিয়েছিলে। আমরা গতকালই গেছিলাম খোঁজখবর নিতে। কিন্তু ওই দালালটার দেখা পাইনি। বাড়ি ছিল বাইরে থেকে তালা মারা। আমরা অবশ্য ওর চারপাশে যারা থাকে তাদের ভালো করে বলে এসেছি যে ও ফিরেই যেন থানায় এসে আমাদের সাথে দেখা করে, কিন্তু, হ্যাঁ, এখন অব্দি ওর কোনও পাত্তা নেই। এইজন্যই বোধহয় এইসব করে তোমাদের শাসিয়ে চলেছে। “ খানিকক্ষণ আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন, দিয়ে বলল “ তোমরা এখন একটু বস। চা খাও। মাথা ঠাণ্ডা কর। তারপর দেখছি কি করা যায়।“ আমাদের এখন চা খাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায়ও নেই। তাই বসেই রইলাম। এক দারোগা চার কাপ চা এনে দিল। ভদ্রলোক একজন দারোগাকে ডেকে কোনও একটা গাড়ির উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করল যে সেই গাড়িটা ফিরেছে কিনা। পরে অবশ্য ওর কথাতেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। ছোট চৌকি বলে এখানে মাত্র এখন চারটে গাড়ি আছে। তার মধ্যে দুটো গাড়ি খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে অপরাধ তেমন একটা হয়না বা হলেও চৌকি অব্দি এসে সেই খবর পৌঁছায় না। তাই গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর কোনও তাগিদ না এরা দেখিয়েছে আর না সরকার। আর তাছাড়া এখানে এদের তেমন কোনও দৌড় ঝাঁপ করতে হয় না। একটা গাড়ি বেড়িয়েছে একটা কি কাজে। এতজন লোক একটা গাড়িতে ধরবে না। আরেকটা গাড়ি ফিরলেই আমরা একসাথে রওয়ানা দেব। ওর কথাতেই আমরা রিক্সা গুলোকে ভাড়া মিটিয়ে ছেড়ে দিলাম কারণ ওরা ফিরতি পথে আমাদেরকে আমাদের মেসে নামিয়ে দিয়ে আসবে বলে আশ্বস্ত করল। একটাই ব্যাপারে আমাদের ভালো লাগছিল যে অনেকদিন পর আবার আমরা মোটর চালিত বাহনে চরতে চলেছি। এই লোকগুলো নেহাত খারাপ নয়। আমাদের চা খাওয়া হল। আর তার একটু পরে গারিটাও এসে হাজির হল। পাঁচ জন দারোগা সমেত আমরা ভাগাভাগি করে দুটো গাড়িতে চড়ে বসলাম।
আমরা প্রথমেই ওই দালালটার বাড়িতে না গিয়ে শ্যামদার শালার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। উনি বাড়িতেই ছিলেন। ওকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হল। ও আমাদের সাথে আসতেই চাইছিল না, অনেক গাইগুই করল, কিন্তু ওর কোনও কথাতেই কান দেওয়া হল না, খানিকটা জোড় করেই গাড়িতে তুলে দেওয়া হল। আসে পাশের কয়েকটা বাড়িতে, মানে যাদের মেয়েদের সম্বন্ধ ওই দালালটা করেছিল তাদের ও তিনজনকে তুলে নেওয়া হল। গাড়ির ভেতরে একটু চাপাচাপি করে বসতে হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। এদের সাথেই নাকি আগের দিন এসে এরা কথা বলে গিয়েছিল। এদের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে এরা বেশ উত্তেজিত। অনেক দিনের পোষা রাগ ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে বেশ চেগে উঠেছে সেটা তাদের কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। শ্যামদার শালার বাড়ি থেকে ওই লোকটার বাড়িটা কিছু দূরে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা বলে গাড়ি স্পীড তুলতে পারছিল না আর তাই সময় একটু বেশী লাগল। গোটা রাস্তা ধরে শ্যামদার শালা নানা রকম ভাবে কাকুতি মিনতি করে বলে চলল যে ওর কোনও দোষ নেই, ও কিছুই জানে না, কেন ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ওকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়, ও বাড়ি ফিরে যাবে, বাড়ির লোকজন চিন্তা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে একজন দারোগার প্রচণ্ড ধমকে ওর মুখ বন্ধ হল। আমার তো ওর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কিছু করার নেই, হাতটা শান্ত ভাবে কোলে নিয়েই বসে থাকতে হল। দালালটার বাড়ি পৌঁছালাম।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, বেশ ভালো বাড়ি বানিয়েছে এই লোকটা। তিনতলা রঙ করা পাকা বাড়ি। পয়সার যে ভালো আমদানি আছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। এই রকম জায়গায় এই রকম একটা ঝকঝকে বাড়ি বেশ চোখে পড়ার মতন। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশগুলো আগে এগিয়ে গেল, আমরা চারজন বাকিদের সাথে পেছন পেছন চললাম। আমাদের বরাত যে সত্যি ভালো সেটা বারবার প্রমাণ পাচ্ছি। শয়তানটা আজ বাড়িতেই আছে। একজন দারোগা খুব শব্দ করে বেশ কয়েকবার কড়া নারল। প্রায় আধ মিনিট পরে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। দরজা ফাঁক করে একজন লোক মাথা বের করে দেখছে কে এসেছে। আমাদের দেখেই যেন চমকে গেল লোকটা। আর অন্যদিকে হয়েছে আরেক ব্যাপার। ক্ষুধার্ত বাঘ যে ভাবে নিজের নাগালের মধ্যে একটা হরিণ দেখলে তার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রাজা লোকটাকে দেখে ঠিক সেইভাবেই উত্তেজিত হয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে দরজার উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার মুখে এক ঘুষি মেরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। লোকটা এমনিতেই স্বাভাবিক কারণে পুলিশ আর এতগুলো লোক দেখে ঘাবড়ে গেছে। রাজার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি বুঝলাম এই লোকটা ওই তিনজনের একজন যারা আজ ওদের ওপর চড়াও হয়েছিল। দারোগারা ভেতরে ঢুকে রাজাকে ধরে কোনও মতে ঠাণ্ডা করল। গত রাতের দেখা দালালটাকে দেখতে পেলাম এইবার, ঘরের এককোনে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যাদের মেয়েদের সম্বন্ধ এই লোকটা করেছিল তারা এখন সবাই মিলে সমবেত স্বরে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল অনেক দিন পর পাওয়া এই সুযোগ তারা কিছুতেই হাতছাড়া করতে নারাজ, ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এই মারে কি সেই মারে। একসাথে এতগুলো লোক চেঁচিয়ে কথা বললে যা হয় সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে! ঠিক যেমন পার্লামেন্টের ভাষণ শুনতে বসলে চিৎকারের চোটে কারোর কোনও কথা বোঝা যায় না, এখানেও ঠিক একই অবস্থা। আমি এদের অর্ধেক কথাই বুঝতে পারছি না। শেষে সবাইকে ধমকে ঠাণ্ডা করল সেই বড় বাবু। পুলিশগুলো এখানে আজ না থাকলে এত গুলো লোকের এত দিনের জমা রাগের সামনে এদের দুজনের কি হাল হত সেটা বলা শক্ত। হয়ত যমের দক্ষিণ দুয়ারে গিয়ে রেখে দিয়ে আসত এদের দুজনকে। লোকটা যে ভয় পেয়ে গুটিয়ে গেছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষে লোকটা মুখ খুলল। “আমাকে এখান থেকে চৌকিতে নিয়ে চলুন। সেখানে গিয়ে আমি সব কথা খুলে বলব।“ কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল “সে সব পরে হবে, আগে বল আমার মেয়ে কোথায়?” বাকিরা আবার হই হই করা শুরু করে দিল। বেচারারা এখনও নিজেদের মেয়েদের ফেরত পাওয়ার আশা রাখে দেখে খুব খারাপ লাগলো। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে এই দালালটার সাথে পুলিশ আর আইন যাই করুক না কেন, ওদের মেয়েরা আর ফিরে আসবে না। এই সত্যিটা এদের বলা মুশকিল, কিন্তু এরা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয় ততই ভালো। ওখান থেকে বেড়িয়ে আসার আগে আরেকটা লোক মানে যার উপর রাজা আক্রোশে লাফিয়ে পড়েছিল, তাকে খুব কঠোর ভাবে জিজ্ঞেস করা হল যে তার দুই সাকরেদ কোথায়? লোকটা মোটামুটি মেনে নিয়েছে যে ও আজ রাজাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিল, কিন্তু সেটা পরে হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়। কে আগে মেরেছে আর কে পরে এখন সেই প্রশ্ন অবান্তর। লোকটা বাকি দুজনের নাম আর তাদের বাড়ি কোথায় এককথায় বলে দিল। বাকি দুজন একদম কাছেই থাকে, তাই ঠিক হল একেবারে তাদের উঠিয়ে নিয়ে চৌকিতে ফেরা হবে।
কিন্তু ওদের বাড়িতে গিয়ে ওদের দেখা পাওয়া গেল না। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে দুটো বাড়িতেই। কিন্তু আজ যেন সবাই একটা এসপার কি অসপার করতেই এসেছে। এখানেও সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলল তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে দেখা হক। কিন্তু শেষমেশ পুলিশের বাঁধায় তেমন কিছু হল না। ওই ভদ্রলোক সবাইকে শান্ত করে বলল যে এইভাবে বাড়ির তালা ভাঙা ঠিক হবে না। ওদের তিনচারজন প্রতিবেশির সাথে পুলিশরা গিয়ে কথা বলল। ওদের প্রতিবেশিদের পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হল যে ওরা ফিরলেই যেন বলে দেওয়া হয় চৌকিতে হাজিরা দিতে, নইলে ওদের বাড়ি ফেরার সব পথ পুলিশরা বন্ধ করে দেবে আর ওদের এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা থাকবে না। এখানে আইন আদালতের থেকে বেশী এই গায়ের জোড় মার্কা ধমকি বা ধমকানই গুলোই কাজ করে বেশী। রাস্তায় দেখলেই ওদের পিটিয়ে চৌকিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, আগামিকাল বিকেলের মধ্যে চৌকিতে না গেলে এখানে এসে বাড়ির তালা ভেঙে সব জিনিসের উপর কবজা করে সব জিনিস উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, আর তাছাড়া এখানকার লোক ওদের বাড়ি চিনে গেছে আর তাই ওরা চৌকিতে গিয়ে ধরা না দিলে পুলিশ এই লোক গুলোর হাত থেকে ওদের বাচানর কোনও চেস্টাই করবে না, এদের মুখোমুখি হলে এরা ওদের দুজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি যত প্রকারের ভয় দেখানো সম্ভব সব রকম ভয় দেখিয়ে পুলিশদের সাথে আমরা ওই দালালটা, তার ওই বন্দী সাকরেদ আর শ্যামদার শালাকে সঙ্গে করে প্রস্থান করলাম। অবশেষে আমাদের ঘাড় থেকে ব্যাপারটা নামল মনে হয়। পরের দিন সেই বড় বাবু হাঁসপাতালে এসে বেশ কয়েকটা জিনিস জানিয়ে গিয়েছিল। এখানেই সেটা লিখে দিচ্ছি নইলে পরে ভুলে যাব বলতে। দালাল লোকটা শিকার করেছে যে শহরের একজনের সাথে একজোট হয়ে ও এখানকার গরীব মেয়েগুলর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনে ওদের শহরে পাচার করে দিত। অবশ্য এর পর তাদের কি হয়, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, বা বাজে ভাষায় বলতে গেলে কোথায় বেচে দেওয়া হয় সে বিষয়ে ও কিছু মাত্র আলোকপাত করতে পারেনি কারণ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে কি হয় সেটা ও নিজেই জানে না। পুলিশের ধারণা লোকটা এই কথাটা সত্যি বলছে। শ্যামদার শালা শিকার করেছে যে এই দালালটার কাছ থেকে ও বেশ কিছু টাকা নিয়েছিল শ্যামদার মেয়েকে ওর ঠিক করা পাত্রের সাথে বিয়ের নাটক করে শহরে পাঠিয়ে দেবার জন্য। এই লোকটার বদনাম তার আগে থেকেই জানা ছিল, শ্যামদার মেয়ের ব্যাপারে ও যা করেছে সব জেনে বুঝে করেছে। তাছাড়া এই দালালটা শ্যামদার শালাকে শহরে একটা চাকরির বন্দবস্ত করে দেবে বলেও নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইসব মিথ্যা প্রলোভন আর টাকার লোভে পড়ে ও এইসব করেছে। সেদিন রাত্রেই বাকি দুজন এসে চৌকিতে ধরা দিয়েছে। এরা চারজনেই এখন হাজতে। পুলিশ ভেবে দেখছে এদের নিয়ে কি করা যায়। আমাদের অবশ্য আর এই ব্যাপারে পরে কোনও খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। শ্যামদার মেয়ে বেচে গেছে, না বলা ভালো বেচারির উপর অন্যায় যারা করতে চেয়েছে তাদের একটা ব্যবস্থা করা গেছে, আমাদের প্রতিশোধ নেওয়া সম্পূর্ণ, এখন আর এই ব্যাপারে আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। শুধু শ্যামদাকে দেখে আমরা বুঝতে পারছিলাম যে এইসব কথা শুনে ওনার মনটা পুরো ভেঙে গেছে। কিন্তু জীবনে এরকম ঘটনা কতই না হয়ে থাকে, কিছুই করার নেই। যাকগে। তবে উনি নিজে আর ওনার মেয়ে আমাদের উপর ভীষণ কৃতজ্ঞ আর সেটা ওদের আমাদের প্রতি খাতির আর যত্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আগেই ওনার খাতির যত্নের কমতি ছিল না আমাদের ব্যাপারে, এই ঘটনার পর সেটা যেন বেড়ে দশ গুণ হয়ে গেছে, আর তাই আমরা মাঝে মাঝেই ওদের এই দুর্নিবার আর ভয়ানক খাতির আপ্যায়নের সামনে ভীষণ রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তাম। এই অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি।
পরের দিন থেকে আবার যেই কে সেই রুটিন শুরু হয়ে গেল। পর পর দুদিন ওদের মদের ঠেক অনেক বেশী রাত অব্দি চলেছিল। রাজা আর সন্দীপ অনেক দেরী করে শুতে গেছিল বলে অরুণ আর আমার ঘরে আসতে পারেনি। আমি অবশ্য এই দুদিনই খাবার খেয়ে উপরে উঠে ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে ওর জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে থাকতাম। মন বলত এই এল বলে আমার সোনা, এই হয়ত দরজায় টোকা পড়ল, কিন্তু না এল না। কিন্তু শেষে একসময় দুচোখের পাতায় ঘুম নেমে আসত। অরুণকে জড়িয়ে ধরছি মনে করে নিজের বালিশটাতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তবে নতুন প্রেম বা বিয়েতে যেরকম হয়, আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি হচ্ছিল। আমাদের দুজনের মধ্যেই সারাদিন ধরে একটা চাপা লুকানো দুষ্টুমি কাজ করত। ব্রেকফাস্টের আগে ও আমাকে একা পেলেই প্রথম প্রশ্ন করত কাল আমি ওর জন্য অপেক্ষা করেছি কিনা, আমি লাজুক ভাবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে ওর সামনে থেকে চলে যেতাম। আমরা হয়ত কোনও একটা কাজে দুজনে একসাথে হাঁসপাতালের কোনও একটা জায়গায় যাচ্ছি, সবার অলখ্যে ও প্রায়ই আমার হাত চেপে ধরত। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও অনেক সময় ছারত না। কখনও বা দুজনে হাত ধরেই হেঁটে চলেছি নিজেদের কাজে। যেটুকু সময় ওকে কাছে পাওয়া যায় সেটাই আমার কাছে অনেক, এক কথায় অমৃত। এটা আমারও অজানা নয় যে রোজ রাতে এইভাবে চোরের মতন আমার ঘরে আসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই যদি দু মিনিট বেশী ওর হাতের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাই বা মন্দ কি। হাঁসপাতালে দু একবার আমাকে একলা পেয়ে আর চারপাশে কেউ নেই দেখে আমাকে দুএকবার চুমুও খেয়েছিল, আমার ভীষণ ভালো লাগলেও, ভয় আর লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সবার নজরের থেকে বাঁচিয়ে একে ওপরের দিকে মিষ্টি করে তাকানো, দুষ্টুমি ভরা ইশারা করা, চোখে চোখে কথা, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আর সেই থেকে উৎপন্ন হওয়া দুজন দুজনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, এই সব নিয়ে দুদিন খুব ভালো কাটলো। ওকে খুব কাছে না পেলেও, এইগুলো ভালোবাসার গভীরতা আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মধ্যে। আমরা দুজন দুজনকে সবসময় একলা নিজেদের করে পেতে চাইছি, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছি না, এর থেকে ভালো মিষ্টি জিনিস আর কি হতে পারে। বিরহ,অপেক্ষা, এত কাছে থেকেও না পাওয়ার দুঃখ আর হতাশা, এই সবই তো ভালোবাসা আর আকর্ষণ বাড়ায় একজনের আরেকজনের প্রতি। এই হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যে শুধু এই দুষ্টু মিষ্টি নিষিদ্ধ প্রেমের ব্যাপারটাই ছিল যেটা আমাকে খুশি রাখত, সারাদিন সতেজ করে রাখত। কথায় বলে কোথাও আগুন লাগলে যতই ঢাকার চেষ্টা কর না কেন ধোয়া ঠিক উঠবে, আর লোকে ঠিক তা জানতে পারবে। রাজা আর সন্দীপও আমাদের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল নিশ্চই। অরুণ যদিও বা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করত, কিন্তু ওর সামনে আমার লাজুক ভাবটা ছিল ভীষণ চোখে পড়ার মতন। আর এটা আমি নিজেও বুঝতাম। তাছাড়া ওদের সামনে আমি ওর সামনে প্রায় কথাই বলতাম না, বা বলতে পারতাম না, পাছে যদি “তুমি” করে বলছি শুনে সব বুঝে ফেলে, ও যদিও আমাকে একান্তেও তুই বলেই ডাকে। অথচ রাজারা বুঝেছে যে আমাদের মধ্যে কোনও রকম মন মালিন্য বা ঝগড়া হয় নি। জানি না , কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দুজনের দুজনের প্রতি গদগদ ভাবটাও ওদের নজর এড়ায় নি। তৃতীয় দিন লাঞ্চের সময় সন্দীপ আমাকে অরুণের সামনেই সরাসরি পরিবর্তনের কারণটা জিজ্ঞেস করে ফেলল। “ কি রে কি ব্যাপার বলত, কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি যে তুই অরুণের সাথে তেমন ভাবে কোনও কথাই বলছিস না। ও সামনে এলেই তুই কেমন যেন ঘেঁটে যাচ্ছিস, গুটিয়ে নিচ্ছিস নিজেকে। ব্যাপারটা কি খুলেই বল তো। “ অরুণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম, শয়তানটা নিশ্চিন্তে রুটি দিয়ে সবজি খেয়ে চলেছে। কি উত্তর দেব এই প্রশ্নের। মন দিয়ে ফেলেছি, এই কথাটা বলতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আর লজ্জাও হচ্ছে। আমি আরেকবার সন্দীপের দিকে তাকিয়ে আর তারপরই অরুণের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলাম আমার থালার দিকে। ইচ্ছে হচ্ছিল এখান থেকে উঠে ছুটে কোথাও দৌড়ে পালিয়ে যাই, কিন্তু সেটা আর কি করে সম্ভব। লজ্জায় কানগুলো লাল হয়ে গরম হয়ে উঠেছে, ঘেমে গেলাম যেন এক নিমেষে। কিছু বলতে পারলাম না। আমার এই হঠাত পরিবর্তন রাজা আর সন্দীপ দুজনেই লক্ষ্য করেছে। আমি কিছু না বলে মুখ নিচু করে বসে আছি দেখে রাজা এইবার অরুণের পিছনে পড়ল। অরুণ কে গুঁতিয়ে জিজ্ঞেস করল “ কি রে ভাই , ডুবে ডুবে কি জল খাচ্ছিস একটু খুলেই বল না। আমরা কি তোদের শ্ত্রু নাকি?” আমি ভয় ভয় চোখে অরুণের দিকে তাকালাম, অরুণ সোজা আমার মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল “ এই যে, ডুবে ডুবে এই জল খাচ্ছি।“ সন্দীপ যেন বিষম খেল, এক ঢোকে পুরো গ্লাসের জলটা গলায় ঢেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল “প্রেম? কি বলছিস?” রাজা যেন ভীষণ অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলল “সত্যি প্রেমে পড়ে গেছিস তোরা?” আমি লজ্জায় নিজের খালি থালাটার দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে থালাটার ওপর আঁকিবুকি এঁকে চলেছি। অরুণ বোধহয় গলা নামিয়ে কিছু একটা বলল যাতে পাশের কেউ না শুনতে পায়, কিন্তু আমিও সেই কথা শুনতে পেলাম না। রাজা অরুণের কাঁধে একটা জোড়ে গুঁতো মেরে বলল “শালা তোর মতন গান্ডু দেখিনি। শালা প্রেম করছিস তো এত লুকানর কি আছে? শালা আমি তোর জায়গায় থাকলে এতদিনে সবাইকে জানিয়ে দিতাম যে এই শুঁটকি মালটাকে ভালোবাসি। প্রেমে পড়েছি এই মালটার। কিন্তু সত্যি বলছি ভেরি গুড চয়েস।“ সন্দীপ টেবিলে বসেই গুণ গুণ করে গান ধরেছে “দোস্ত দোস্ত না রাহা, পেয়ার পেয়ার না রাহা। “ একটু থেমে নাটক করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “ শালা আমাকে ল্যাং মেরে শেষমেশ এই মালটাকে পছন্দ হল তোর? ঠিক আছে ডিয়ার, কুছ পরোয়া নেই। এইটুকু মনে রাখিস আমার হৃদয়ের দরজা তোর জন্য সব সময় খোলা জানেমন। “ ওরা যত এইসব মজা করছে আমার লজ্জা আর অস্বস্তি ততই বেড়ে চলেছে, আর পারলাম না থালা নিয়ে উঠতে গেলাম, সন্দীপ আমার হাত ধরে আমাকে টেনে বসিয়ে দিল। ভাষণ দেওয়ার মতন করে আমাদের দুজনকে বলল “ শোন, আমরা তোদেরকে অবাধ মেলা মেশা করার সম্পূর্ণ ছাড়পত্র দিলাম। তোরা আমাদের সামনে বা পিছনে যা খুশি করতে পারিস, আমরা কিছু মনে করব না, কোনও বাঁধা দেব না, আর কাউকে কিছু বলবও না। “ অরুণকে একটা ঘুসি মেরে বলল “শালা কি লাকি রে ভাই তুই যে এমন একটা কচি বউ ফাঁকায় ফাঁকায় বিনা পরিশ্রমে পেয়ে গেলি। “ রাজা বলল “ভাই সন্দীপ, সারা দিন এইভাবে দূরে দূরে, ছাড়া ছাড়া থাকার পর, রাত্রে বেচারারা আমাদের জন্য এক হতে পারে না।“ অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল “ভাই আমাদের সামনে রাখা ঢাকা করার দরকার নেই। যখন দরকার পড়বে তখনই তোমরা মিলিত হতে পার এবং অবাধ ভাবেই মিলিত হতে পার, আমরা বাঁধা দেব না। শুধু বেশী শব্দ কর না যাতে শ্যামদা বা ওনার মেয়ে এইসব ব্যাপার টের পেয়ে যায়। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন তো, আপনার কচি বর বউয়ের মতন হয়ে গেছেন, কিন্তু এখনও ঠিক আপনারা বর বউ নন। তাই যা করবেন গোপনে করবেন, নিঃশব্দে করবেন। কথাটা মাথায় ঢুকল? “ রাজা আর সন্দীপ দুজনেই অশ্লীল ভাবে হেঁসে উঠল। আমার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরবে এইবার। সন্দীপও অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলল “ভাই নিঃসন্দেহে গুড চয়েস।“ আমি আর বসে থাকতে পারলাম না, হন্তদন্ত হয়ে ওখান থেকে উঠে বাসন রাখার জায়গার দিকে প্রস্থান করলাম। মাঝ পথে স্যারের সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলাম, স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কি হয়েছে, আমি কোনও মতে মাথা নাড়িয়ে কিছু হয়নি এইটুকু শুধু বুঝিয়ে কেটে পড়লাম।
রিক্সা আমাদের জন্য প্রায় দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। আসলে আসার পথে দোকান পাট খোলা দেখে আমি এটা ওটা দেখছিলাম আর দর দাম করছিলাম, যদিও আমার কোনও কিছুই কেনার প্ল্যান ছিল না। এটা আমার একটা বদভ্যাস। একটা ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ও আমাকে বলেছিল “ একটা নতুন রেজার কিনে দেব?” আমি খুব লজ্জা পেয়ে ওর কাঁধে একটা ঘুসি মেরে ওকে শান্ত করেছিলাম। ফেরার পথেও রিক্সায় গোটা রাস্তাটা আমি নিজের হাতটা ওর হাতের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। রিক্সায় ও দু তিনবার আমার গালে চুমুও খেয়েছিল, কনুই দিয়ে আমার ডান স্তনের ওপর ঘন ঘন ঘষে চলেছিল গোটা রাস্তা ধরে। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম যেন, অন্য দিকে তাকিয়ে ওর এই অত্যাচার সহ্য করে চললাম। হ্যাঁ, অবশেষে আমি চুটিয়ে প্রেম করছি। ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি আমার লেগিন্সের পিছনে ওর বীর্যের ভেজা ছোপ ছারাও অনেকটা জায়গা জুড়ে নোংরা মাটির ময়লা লেগে গিয়েছিল, সেটা ও রাস্তার মাঝেই আমার পিছন থেকে ঝেরে দিয়েছিল। প্রথমে এইভাবে আমার পাছার ওপর সবার সামনে হাত দিয়ে ময়লা ঝারার জন্য ওকে বারণ করেছিলাম, কিন্তু ও শোনেনি, সত্যি বলতে কি আমার বেশ লেগেছিল। অচেনা জায়গায় এইভাবে নষ্টামি করতে। অনেকে তাকিয়ে তাকিয়ে লেগিন্সের উপর দিয়ে আমার পেছন থেকে ওর ময়লা ঝারা দেখেছিল। প্রথমে লজ্জা আর তারপর লজ্জার সাথে মিশে গিয়েছিল একটা ব্যভিচার মাখা স্বাদ। আর যার সাথে এইসব নষ্টামি করছি সে এখন আমার চোখের মণি। একটু ফুর্তি করলাম, তাতে কিসের ক্ষতি। এইগুলো হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেদিন আমি প্রথম ডাইরি লিখেছিলাম ওখানে যাওয়ার পর। সেই ঘটনায় এইবার আসব। যা বলছিলাম বাড়ি ফেরার পর যা দেখলাম আর তারপর যা যা হয়েছিল সেটা সিরিয়স ব্যাপার। চলে আসছি সেই সময়ের কথায়।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সময় অরুণ আমার কানে কানে বলল “একেবারে চেঞ্জ করে নিচে নামিস। তোর লেগিন্সের পিছনটা একটু ময়লা হয়ে আছে। ওরা অনেক প্রশ্ন করতে পারে। “ ভিতরে ঢুকে ভাগ্যি ভালো রাজা বা সন্দীপ কাউকে দেখতে পেলাম না। ও চোখের ইশারায় বোঝাল তাড়াতাড়ি আয় তারপর গল্প হবে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হেঁসে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সিঁড়ির মুখে অরুণ আবার আমার ডান কনুইটা টেনে ধরল, আরও গলা নামিয়ে বলল “ চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি নেমে আসিস কিন্তু। মাঠের ওই ছেলেটার জিনিসটার কথা ভেবে ভেবে আবার নিজে নিজে কিছু করতে শুরু করে দিস না। “ একটা চোখ মেরে নির্লজ্জের মতন চাপা গলায় হেঁসে উঠে বলল “ ভীষণ মোটা ছিল কিন্তু, ভেতরে ভরে লাগালে ভালোই সুখ পেতিস। “ আরেকটা নির্লজ্জের মতন চাপা হাঁসি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগাল। আমি দৌড়ে উপরে চলে এলাম। যত তাড়াতাড়ি পারি পরিষ্কার হয়ে স্নান করে, নোংরা প্যানটিটা কেঁচে, গায়ে একটু দিও মেখে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। রাজার ঘরে ঢুকে দেখি বেশ একটা থমথমে ভাব। তাছাড়া ওর ঘরে ঢুকেই রাজা আর সন্দীপকে দেখে একটু যেন চমকে গেছি। “কি করে হল এটা?” রাজার কপালের বা পাশে বেশ খানিকটা কেটে গেছে, দুই কনুইয়ের কাছেও দেখলাম ভালো ভাবে ছড়ে গেছে। সন্দীপ বারমুডা পরে বসেছিল, ওর ডান হাঁটুতেও দেখলাম অনেকটা ছড়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিল, কিভাবে এসব হল? রক্ত পড়ছে না কারোর ছড়ে যাওয়া বা কাটা জায়গা থেকে আর ওরা ফার্স্ট এইড ও করে নিয়েছে, কিন্তু মন বলছে বড় রকমের কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অরুণ আর আমার অবর্তমানে। অরুণকে দেখে বুঝতে পারছিলাম যে আমার আসার আগেই ওকে ওরা সব কিছু খুলে বলেছে, তবু আমার জন্য আরেকবার রাজাকে রিপিট করতে হল। ব্যাপারটা খানিকটা এইমতন হয়েছে। রাজা আর সন্দীপ ঘরে ফিরে মদ গুছিয়ে রেখে ঠিক করেছিল যে নদীর ধারে ঘুরতে যাবে। অরুণ আর আমি নেই তাই আড্ডা ঠিক মতন জমবে না। কিছুক্ষণ নদীর ধারে হাওয়া খেয়ে আবার ফিরে আসবে। নদীর ধারে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাইরের আলো কমে আসছে দেখে ওরা যখন ফিরছিল তখন মাঝ রাস্তায় তিনজন লোক ওদের ওপর চড়াও হয় হঠাতই। ওদের কে আমরা কেউই আগে কোনও দিন দেখিনি, সম্পূর্ণ অচেনা। রাজারা প্রথমে ভেবেছিল যে একলা পেয়ে টাকা পয়সা নিতে এসেছে, কিন্তু সেই গুঁড়ে বালি, কারণ ওরা নদীতে যাওয়ার সময় ড্রেস চেঞ্জ করে গিয়েছিল আর তাই কারোর সাথে কোনও পার্স ছিল না। কিন্তু পরে অনুধাবন করল ব্যাপারটা পুরো অন্য, আর তাছাড়া এখানে সচরাচর ছিন্তাই করার ঘটনা কানে আসে না। আসল ব্যাপার ওরা যতক্ষণে বুঝেছে ততক্ষণে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। কারণ ততক্ষণে ওদের তিনজন এদের দুজনের সাথে হাতাহাতির মধ্যে ঢুকে গেছে। রাজার বক্তব্য ও নাকি নিজেও ওদের কে বেশ করে কয়েক ঘা দিয়েছে আর সন্দীপও যতটা পারে হাত পা ছুঁড়েছে, কিন্তু নিজেরাও কয়েক ঘা খেয়েছে ওদের হাতে। ওদের হাত পা ছড়ে গেছে, মাথা কেটে গেছে। যাওয়ার সময় পরিষ্কার ধমকি দিয়ে গেছে যে বাইরে থেকে এসে এখানকার ব্যাপারে বেশী নাক গলালে ওরা ছেড়ে কথা বলবে না। তার সাথে ওই দালালটার নাম নিয়ে এও বলেছে যে আমরা যদি ওর পেছনে পুলিশ লাগাই তাহলে ওরা পরের বার আরও উচিত শিক্ষা দেবে আমাদের। আমি একটু চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম “তো এখন কি ঠিক করেছিস?” রাজা বলল “এদের একটা উচিত শিক্ষা এইবার আমরা দেব। ছক কষা কাকে বলে তো জানে না। বাপ বাপান্ত করে না ছাড়লে আমার নাম নেই এই বলে দিলাম।“ সন্দীপ উঠতে উঠতে বলল “ আমরা তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আরেকটা রিক্সা আনতে বলে দিয়েছি, আজই আমরা পুলিশে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করব। একটা কিছু হেস্ত নেস্ত না করে ফিরছি না। “ আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি, আসলে আমি রিক্সা থেকে নামার পর অরুণের কথা শুনতে এত মশগুল ছিলাম যে খেয়াল করিনি আমরা ছেড়ে দেওয়ার পরও রিক্সাটা আসলে যায়নি। শ্যামদা বোধহয় ভেতর থেকে হাত দেখিয়ে ওকে আটকে রেখেছেন। বাইরে উঁকি মেরে দেখলাম আমাদের রিক্সাওয়ালাটা রিক্সার সিটে আরাম করে বসে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে। অরুণকে দেখলাম ও আগের জামা কাপড় পরেই বসে আছে, মানে চেঞ্জ করার সুযোগ পায়নি। আমি বললাম “আমাকে পাঁচ মিনিট দে, দৌড় মারলাম উপরে।“ আবার চট করে শালোয়ার কামিজ পরে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। সন্দীপ আর রাজাও পুরো তৈরি। সন্দীপের হাঁটা দেখে মনে হল ও যেন একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। জিজ্ঞেস করায় বলল “কিছু না, হাতাহাতির সময় বা পাটা মচকে গেছে। “ তবে দেখে মনে হল ভালোই খোঁড়াচ্ছে। আমরা রোজকার মতন জোড়ায় জোড়ায় রিক্সায় উঠে পুলিশ চৌকির দিকে রওয়ানা দিয়ে দিলাম।
আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি মারছে। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এমনিতেই এমন ছোট একটা চৌকি। এখন কি আর কোনও কাজের লোক সেখানে থাকবে। রিক্সায় যেতে যেতে রাজাকে সেকথা বলায় রাজা বলল “না থাকুক, কিন্তু কমপ্লেনটা আজই করতে হবে। কাল আর কখন সময় পাব জানি না। “ একটু থেমে বলল “ পরে দরকার হলে কাল হাঁসপাতাল থেকে ফিরতি পথে একবার খোঁজ নিয়ে আসব। আর স্যার যে গতকাল পুলিশকে এত কথা বলেছিলেন, ওরা কি করেছে সেটাও জানা দরকার।“ এখানে একটা কথা বলে রাখি, এই দুটো রিক্সাওয়ালা আমাদের ওপর খুবই খুশি। আমরা প্রত্যেক বারই ভাড়ার থেকে ৫-১০ টাকা বেশী দি, আর তাই আমরা যদি অন্য কোথাও যেতে বলি তাহলে এরা বেশ খুশিই হয়, কারণ আরেকটু বেশী ভাড়া পাবে। পারলে সারাদিন শুধু আমাদের নিয়েই যাতায়াত করলে এরা সবথেকে খুশি হয়। চৌকিতে পৌঁছে ভেতরে ঢুকে দেখলাম যে না আমাদের বরাত আজকে বেশ ভালো। গতকাল স্যার যে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলেছিলেন ওই লোকটা এখনও আছে। অলসভাবে বসে আরও দু তিনজন দারোগার সাথে গল্প গুজব করছে। আমাদের এই অসময়ে ঢুকতে দেখেই একটু যেন প্রশ্নসুচক মুখ নিয়ে আমাদেরকে একবার ভালভাবে তাকিয়ে দেখল। রাজার কপালের দিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। রাজাই যা বলার বলল “ তিনজন আমাদের ওপর চড়াও হয়ে বাজে ভাবে মারধর করার চেষ্টা করেছে। আমাদের বলেছে যে বাইরে থেকে এসে ওই দালালটার পেছনে পুলিশ লাগালে আমাদের এখানে থাকতে দেবে না। এও বলেছে যে আপনাদের কাছে নাকি ওই দালালটা মাঝে মাঝে টাকাও পাঠায়। তাই আপনাদের বলে কোনও ফল হবে না, আপনারা ওই দালালটার বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না। আপনারা শুধু লোক দেখানোর জন্য উনিশ বিশ কিছু একটা করবেন আর তারপর ওরা এসে আমাদের দেখে নেবে। এখন আপনি বলুন আমাদের কি করনীয়।“ আমি জানি রাজা অনেকটা কথা নিজে থেকে রঙ চড়িয়ে বলেছে, কিন্তু তাতে ফল হল মারাত্মক। শেষ কয়েকটা কথা যখন ও বলছিল লক্ষ্য করছিলাম শ্রোতাদের চেহারা বেশ জ্বলে উঠেছে। ভালোই তাতিয়ে দিয়েছে এই লোকগুলোকে। ওর কথার সত্যতা যাচাই করার কোনও প্রশ্ন ওঠে না, কারণ কে করবে। বুঝলাম রাজার ছক কষে কেস খাওয়ানোর ব্যাপারটা কি ভয়ানক। রাজা সব কথা শেষ করে একটু থামল। আমাদের সামনের বসা লোকগুলো এখন নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। ভদ্রলোক একটু গলা পরিষ্কার করে বলল “ তোমরা গতকাল তোমাদের স্যারকে দিয়ে আমার কাছে অভিযোগ লিখিয়েছিলে। আমরা গতকালই গেছিলাম খোঁজখবর নিতে। কিন্তু ওই দালালটার দেখা পাইনি। বাড়ি ছিল বাইরে থেকে তালা মারা। আমরা অবশ্য ওর চারপাশে যারা থাকে তাদের ভালো করে বলে এসেছি যে ও ফিরেই যেন থানায় এসে আমাদের সাথে দেখা করে, কিন্তু, হ্যাঁ, এখন অব্দি ওর কোনও পাত্তা নেই। এইজন্যই বোধহয় এইসব করে তোমাদের শাসিয়ে চলেছে। “ খানিকক্ষণ আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলেন, দিয়ে বলল “ তোমরা এখন একটু বস। চা খাও। মাথা ঠাণ্ডা কর। তারপর দেখছি কি করা যায়।“ আমাদের এখন চা খাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায়ও নেই। তাই বসেই রইলাম। এক দারোগা চার কাপ চা এনে দিল। ভদ্রলোক একজন দারোগাকে ডেকে কোনও একটা গাড়ির উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করল যে সেই গাড়িটা ফিরেছে কিনা। পরে অবশ্য ওর কথাতেই পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। ছোট চৌকি বলে এখানে মাত্র এখন চারটে গাড়ি আছে। তার মধ্যে দুটো গাড়ি খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। এখানে অপরাধ তেমন একটা হয়না বা হলেও চৌকি অব্দি এসে সেই খবর পৌঁছায় না। তাই গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর কোনও তাগিদ না এরা দেখিয়েছে আর না সরকার। আর তাছাড়া এখানে এদের তেমন কোনও দৌড় ঝাঁপ করতে হয় না। একটা গাড়ি বেড়িয়েছে একটা কি কাজে। এতজন লোক একটা গাড়িতে ধরবে না। আরেকটা গাড়ি ফিরলেই আমরা একসাথে রওয়ানা দেব। ওর কথাতেই আমরা রিক্সা গুলোকে ভাড়া মিটিয়ে ছেড়ে দিলাম কারণ ওরা ফিরতি পথে আমাদেরকে আমাদের মেসে নামিয়ে দিয়ে আসবে বলে আশ্বস্ত করল। একটাই ব্যাপারে আমাদের ভালো লাগছিল যে অনেকদিন পর আবার আমরা মোটর চালিত বাহনে চরতে চলেছি। এই লোকগুলো নেহাত খারাপ নয়। আমাদের চা খাওয়া হল। আর তার একটু পরে গারিটাও এসে হাজির হল। পাঁচ জন দারোগা সমেত আমরা ভাগাভাগি করে দুটো গাড়িতে চড়ে বসলাম।
আমরা প্রথমেই ওই দালালটার বাড়িতে না গিয়ে শ্যামদার শালার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। উনি বাড়িতেই ছিলেন। ওকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হল। ও আমাদের সাথে আসতেই চাইছিল না, অনেক গাইগুই করল, কিন্তু ওর কোনও কথাতেই কান দেওয়া হল না, খানিকটা জোড় করেই গাড়িতে তুলে দেওয়া হল। আসে পাশের কয়েকটা বাড়িতে, মানে যাদের মেয়েদের সম্বন্ধ ওই দালালটা করেছিল তাদের ও তিনজনকে তুলে নেওয়া হল। গাড়ির ভেতরে একটু চাপাচাপি করে বসতে হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। এদের সাথেই নাকি আগের দিন এসে এরা কথা বলে গিয়েছিল। এদের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে এরা বেশ উত্তেজিত। অনেক দিনের পোষা রাগ ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে বেশ চেগে উঠেছে সেটা তাদের কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। শ্যামদার শালার বাড়ি থেকে ওই লোকটার বাড়িটা কিছু দূরে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা বলে গাড়ি স্পীড তুলতে পারছিল না আর তাই সময় একটু বেশী লাগল। গোটা রাস্তা ধরে শ্যামদার শালা নানা রকম ভাবে কাকুতি মিনতি করে বলে চলল যে ওর কোনও দোষ নেই, ও কিছুই জানে না, কেন ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ওকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়, ও বাড়ি ফিরে যাবে, বাড়ির লোকজন চিন্তা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে একজন দারোগার প্রচণ্ড ধমকে ওর মুখ বন্ধ হল। আমার তো ওর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কিছু করার নেই, হাতটা শান্ত ভাবে কোলে নিয়েই বসে থাকতে হল। দালালটার বাড়ি পৌঁছালাম।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, বেশ ভালো বাড়ি বানিয়েছে এই লোকটা। তিনতলা রঙ করা পাকা বাড়ি। পয়সার যে ভালো আমদানি আছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। এই রকম জায়গায় এই রকম একটা ঝকঝকে বাড়ি বেশ চোখে পড়ার মতন। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশগুলো আগে এগিয়ে গেল, আমরা চারজন বাকিদের সাথে পেছন পেছন চললাম। আমাদের বরাত যে সত্যি ভালো সেটা বারবার প্রমাণ পাচ্ছি। শয়তানটা আজ বাড়িতেই আছে। একজন দারোগা খুব শব্দ করে বেশ কয়েকবার কড়া নারল। প্রায় আধ মিনিট পরে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। দরজা ফাঁক করে একজন লোক মাথা বের করে দেখছে কে এসেছে। আমাদের দেখেই যেন চমকে গেল লোকটা। আর অন্যদিকে হয়েছে আরেক ব্যাপার। ক্ষুধার্ত বাঘ যে ভাবে নিজের নাগালের মধ্যে একটা হরিণ দেখলে তার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রাজা লোকটাকে দেখে ঠিক সেইভাবেই উত্তেজিত হয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে দরজার উপরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার মুখে এক ঘুষি মেরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। লোকটা এমনিতেই স্বাভাবিক কারণে পুলিশ আর এতগুলো লোক দেখে ঘাবড়ে গেছে। রাজার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি বুঝলাম এই লোকটা ওই তিনজনের একজন যারা আজ ওদের ওপর চড়াও হয়েছিল। দারোগারা ভেতরে ঢুকে রাজাকে ধরে কোনও মতে ঠাণ্ডা করল। গত রাতের দেখা দালালটাকে দেখতে পেলাম এইবার, ঘরের এককোনে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যাদের মেয়েদের সম্বন্ধ এই লোকটা করেছিল তারা এখন সবাই মিলে সমবেত স্বরে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল অনেক দিন পর পাওয়া এই সুযোগ তারা কিছুতেই হাতছাড়া করতে নারাজ, ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এই মারে কি সেই মারে। একসাথে এতগুলো লোক চেঁচিয়ে কথা বললে যা হয় সেটা কি বুঝিয়ে বলতে হবে! ঠিক যেমন পার্লামেন্টের ভাষণ শুনতে বসলে চিৎকারের চোটে কারোর কোনও কথা বোঝা যায় না, এখানেও ঠিক একই অবস্থা। আমি এদের অর্ধেক কথাই বুঝতে পারছি না। শেষে সবাইকে ধমকে ঠাণ্ডা করল সেই বড় বাবু। পুলিশগুলো এখানে আজ না থাকলে এত গুলো লোকের এত দিনের জমা রাগের সামনে এদের দুজনের কি হাল হত সেটা বলা শক্ত। হয়ত যমের দক্ষিণ দুয়ারে গিয়ে রেখে দিয়ে আসত এদের দুজনকে। লোকটা যে ভয় পেয়ে গুটিয়ে গেছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষে লোকটা মুখ খুলল। “আমাকে এখান থেকে চৌকিতে নিয়ে চলুন। সেখানে গিয়ে আমি সব কথা খুলে বলব।“ কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল “সে সব পরে হবে, আগে বল আমার মেয়ে কোথায়?” বাকিরা আবার হই হই করা শুরু করে দিল। বেচারারা এখনও নিজেদের মেয়েদের ফেরত পাওয়ার আশা রাখে দেখে খুব খারাপ লাগলো। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে এই দালালটার সাথে পুলিশ আর আইন যাই করুক না কেন, ওদের মেয়েরা আর ফিরে আসবে না। এই সত্যিটা এদের বলা মুশকিল, কিন্তু এরা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয় ততই ভালো। ওখান থেকে বেড়িয়ে আসার আগে আরেকটা লোক মানে যার উপর রাজা আক্রোশে লাফিয়ে পড়েছিল, তাকে খুব কঠোর ভাবে জিজ্ঞেস করা হল যে তার দুই সাকরেদ কোথায়? লোকটা মোটামুটি মেনে নিয়েছে যে ও আজ রাজাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিল, কিন্তু সেটা পরে হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়। কে আগে মেরেছে আর কে পরে এখন সেই প্রশ্ন অবান্তর। লোকটা বাকি দুজনের নাম আর তাদের বাড়ি কোথায় এককথায় বলে দিল। বাকি দুজন একদম কাছেই থাকে, তাই ঠিক হল একেবারে তাদের উঠিয়ে নিয়ে চৌকিতে ফেরা হবে।
কিন্তু ওদের বাড়িতে গিয়ে ওদের দেখা পাওয়া গেল না। বাইরে থেকে তালা ঝুলছে দুটো বাড়িতেই। কিন্তু আজ যেন সবাই একটা এসপার কি অসপার করতেই এসেছে। এখানেও সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলল তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে দেখা হক। কিন্তু শেষমেশ পুলিশের বাঁধায় তেমন কিছু হল না। ওই ভদ্রলোক সবাইকে শান্ত করে বলল যে এইভাবে বাড়ির তালা ভাঙা ঠিক হবে না। ওদের তিনচারজন প্রতিবেশির সাথে পুলিশরা গিয়ে কথা বলল। ওদের প্রতিবেশিদের পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হল যে ওরা ফিরলেই যেন বলে দেওয়া হয় চৌকিতে হাজিরা দিতে, নইলে ওদের বাড়ি ফেরার সব পথ পুলিশরা বন্ধ করে দেবে আর ওদের এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা থাকবে না। এখানে আইন আদালতের থেকে বেশী এই গায়ের জোড় মার্কা ধমকি বা ধমকানই গুলোই কাজ করে বেশী। রাস্তায় দেখলেই ওদের পিটিয়ে চৌকিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, আগামিকাল বিকেলের মধ্যে চৌকিতে না গেলে এখানে এসে বাড়ির তালা ভেঙে সব জিনিসের উপর কবজা করে সব জিনিস উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, আর তাছাড়া এখানকার লোক ওদের বাড়ি চিনে গেছে আর তাই ওরা চৌকিতে গিয়ে ধরা না দিলে পুলিশ এই লোক গুলোর হাত থেকে ওদের বাচানর কোনও চেস্টাই করবে না, এদের মুখোমুখি হলে এরা ওদের দুজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি যত প্রকারের ভয় দেখানো সম্ভব সব রকম ভয় দেখিয়ে পুলিশদের সাথে আমরা ওই দালালটা, তার ওই বন্দী সাকরেদ আর শ্যামদার শালাকে সঙ্গে করে প্রস্থান করলাম। অবশেষে আমাদের ঘাড় থেকে ব্যাপারটা নামল মনে হয়। পরের দিন সেই বড় বাবু হাঁসপাতালে এসে বেশ কয়েকটা জিনিস জানিয়ে গিয়েছিল। এখানেই সেটা লিখে দিচ্ছি নইলে পরে ভুলে যাব বলতে। দালাল লোকটা শিকার করেছে যে শহরের একজনের সাথে একজোট হয়ে ও এখানকার গরীব মেয়েগুলর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনে ওদের শহরে পাচার করে দিত। অবশ্য এর পর তাদের কি হয়, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, বা বাজে ভাষায় বলতে গেলে কোথায় বেচে দেওয়া হয় সে বিষয়ে ও কিছু মাত্র আলোকপাত করতে পারেনি কারণ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে কি হয় সেটা ও নিজেই জানে না। পুলিশের ধারণা লোকটা এই কথাটা সত্যি বলছে। শ্যামদার শালা শিকার করেছে যে এই দালালটার কাছ থেকে ও বেশ কিছু টাকা নিয়েছিল শ্যামদার মেয়েকে ওর ঠিক করা পাত্রের সাথে বিয়ের নাটক করে শহরে পাঠিয়ে দেবার জন্য। এই লোকটার বদনাম তার আগে থেকেই জানা ছিল, শ্যামদার মেয়ের ব্যাপারে ও যা করেছে সব জেনে বুঝে করেছে। তাছাড়া এই দালালটা শ্যামদার শালাকে শহরে একটা চাকরির বন্দবস্ত করে দেবে বলেও নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইসব মিথ্যা প্রলোভন আর টাকার লোভে পড়ে ও এইসব করেছে। সেদিন রাত্রেই বাকি দুজন এসে চৌকিতে ধরা দিয়েছে। এরা চারজনেই এখন হাজতে। পুলিশ ভেবে দেখছে এদের নিয়ে কি করা যায়। আমাদের অবশ্য আর এই ব্যাপারে পরে কোনও খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। শ্যামদার মেয়ে বেচে গেছে, না বলা ভালো বেচারির উপর অন্যায় যারা করতে চেয়েছে তাদের একটা ব্যবস্থা করা গেছে, আমাদের প্রতিশোধ নেওয়া সম্পূর্ণ, এখন আর এই ব্যাপারে আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। শুধু শ্যামদাকে দেখে আমরা বুঝতে পারছিলাম যে এইসব কথা শুনে ওনার মনটা পুরো ভেঙে গেছে। কিন্তু জীবনে এরকম ঘটনা কতই না হয়ে থাকে, কিছুই করার নেই। যাকগে। তবে উনি নিজে আর ওনার মেয়ে আমাদের উপর ভীষণ কৃতজ্ঞ আর সেটা ওদের আমাদের প্রতি খাতির আর যত্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আগেই ওনার খাতির যত্নের কমতি ছিল না আমাদের ব্যাপারে, এই ঘটনার পর সেটা যেন বেড়ে দশ গুণ হয়ে গেছে, আর তাই আমরা মাঝে মাঝেই ওদের এই দুর্নিবার আর ভয়ানক খাতির আপ্যায়নের সামনে ভীষণ রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তাম। এই অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি।
পরের দিন থেকে আবার যেই কে সেই রুটিন শুরু হয়ে গেল। পর পর দুদিন ওদের মদের ঠেক অনেক বেশী রাত অব্দি চলেছিল। রাজা আর সন্দীপ অনেক দেরী করে শুতে গেছিল বলে অরুণ আর আমার ঘরে আসতে পারেনি। আমি অবশ্য এই দুদিনই খাবার খেয়ে উপরে উঠে ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে ওর জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে থাকতাম। মন বলত এই এল বলে আমার সোনা, এই হয়ত দরজায় টোকা পড়ল, কিন্তু না এল না। কিন্তু শেষে একসময় দুচোখের পাতায় ঘুম নেমে আসত। অরুণকে জড়িয়ে ধরছি মনে করে নিজের বালিশটাতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তবে নতুন প্রেম বা বিয়েতে যেরকম হয়, আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি হচ্ছিল। আমাদের দুজনের মধ্যেই সারাদিন ধরে একটা চাপা লুকানো দুষ্টুমি কাজ করত। ব্রেকফাস্টের আগে ও আমাকে একা পেলেই প্রথম প্রশ্ন করত কাল আমি ওর জন্য অপেক্ষা করেছি কিনা, আমি লাজুক ভাবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে ওর সামনে থেকে চলে যেতাম। আমরা হয়ত কোনও একটা কাজে দুজনে একসাথে হাঁসপাতালের কোনও একটা জায়গায় যাচ্ছি, সবার অলখ্যে ও প্রায়ই আমার হাত চেপে ধরত। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও অনেক সময় ছারত না। কখনও বা দুজনে হাত ধরেই হেঁটে চলেছি নিজেদের কাজে। যেটুকু সময় ওকে কাছে পাওয়া যায় সেটাই আমার কাছে অনেক, এক কথায় অমৃত। এটা আমারও অজানা নয় যে রোজ রাতে এইভাবে চোরের মতন আমার ঘরে আসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই যদি দু মিনিট বেশী ওর হাতের ছোঁয়া পাওয়া যায় তাই বা মন্দ কি। হাঁসপাতালে দু একবার আমাকে একলা পেয়ে আর চারপাশে কেউ নেই দেখে আমাকে দুএকবার চুমুও খেয়েছিল, আমার ভীষণ ভালো লাগলেও, ভয় আর লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সবার নজরের থেকে বাঁচিয়ে একে ওপরের দিকে মিষ্টি করে তাকানো, দুষ্টুমি ভরা ইশারা করা, চোখে চোখে কথা, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আর সেই থেকে উৎপন্ন হওয়া দুজন দুজনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, এই সব নিয়ে দুদিন খুব ভালো কাটলো। ওকে খুব কাছে না পেলেও, এইগুলো ভালোবাসার গভীরতা আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মধ্যে। আমরা দুজন দুজনকে সবসময় একলা নিজেদের করে পেতে চাইছি, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছি না, এর থেকে ভালো মিষ্টি জিনিস আর কি হতে পারে। বিরহ,অপেক্ষা, এত কাছে থেকেও না পাওয়ার দুঃখ আর হতাশা, এই সবই তো ভালোবাসা আর আকর্ষণ বাড়ায় একজনের আরেকজনের প্রতি। এই হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যে শুধু এই দুষ্টু মিষ্টি নিষিদ্ধ প্রেমের ব্যাপারটাই ছিল যেটা আমাকে খুশি রাখত, সারাদিন সতেজ করে রাখত। কথায় বলে কোথাও আগুন লাগলে যতই ঢাকার চেষ্টা কর না কেন ধোয়া ঠিক উঠবে, আর লোকে ঠিক তা জানতে পারবে। রাজা আর সন্দীপও আমাদের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল নিশ্চই। অরুণ যদিও বা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করত, কিন্তু ওর সামনে আমার লাজুক ভাবটা ছিল ভীষণ চোখে পড়ার মতন। আর এটা আমি নিজেও বুঝতাম। তাছাড়া ওদের সামনে আমি ওর সামনে প্রায় কথাই বলতাম না, বা বলতে পারতাম না, পাছে যদি “তুমি” করে বলছি শুনে সব বুঝে ফেলে, ও যদিও আমাকে একান্তেও তুই বলেই ডাকে। অথচ রাজারা বুঝেছে যে আমাদের মধ্যে কোনও রকম মন মালিন্য বা ঝগড়া হয় নি। জানি না , কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দুজনের দুজনের প্রতি গদগদ ভাবটাও ওদের নজর এড়ায় নি। তৃতীয় দিন লাঞ্চের সময় সন্দীপ আমাকে অরুণের সামনেই সরাসরি পরিবর্তনের কারণটা জিজ্ঞেস করে ফেলল। “ কি রে কি ব্যাপার বলত, কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি যে তুই অরুণের সাথে তেমন ভাবে কোনও কথাই বলছিস না। ও সামনে এলেই তুই কেমন যেন ঘেঁটে যাচ্ছিস, গুটিয়ে নিচ্ছিস নিজেকে। ব্যাপারটা কি খুলেই বল তো। “ অরুণের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম, শয়তানটা নিশ্চিন্তে রুটি দিয়ে সবজি খেয়ে চলেছে। কি উত্তর দেব এই প্রশ্নের। মন দিয়ে ফেলেছি, এই কথাটা বলতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আর লজ্জাও হচ্ছে। আমি আরেকবার সন্দীপের দিকে তাকিয়ে আর তারপরই অরুণের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলাম আমার থালার দিকে। ইচ্ছে হচ্ছিল এখান থেকে উঠে ছুটে কোথাও দৌড়ে পালিয়ে যাই, কিন্তু সেটা আর কি করে সম্ভব। লজ্জায় কানগুলো লাল হয়ে গরম হয়ে উঠেছে, ঘেমে গেলাম যেন এক নিমেষে। কিছু বলতে পারলাম না। আমার এই হঠাত পরিবর্তন রাজা আর সন্দীপ দুজনেই লক্ষ্য করেছে। আমি কিছু না বলে মুখ নিচু করে বসে আছি দেখে রাজা এইবার অরুণের পিছনে পড়ল। অরুণ কে গুঁতিয়ে জিজ্ঞেস করল “ কি রে ভাই , ডুবে ডুবে কি জল খাচ্ছিস একটু খুলেই বল না। আমরা কি তোদের শ্ত্রু নাকি?” আমি ভয় ভয় চোখে অরুণের দিকে তাকালাম, অরুণ সোজা আমার মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল “ এই যে, ডুবে ডুবে এই জল খাচ্ছি।“ সন্দীপ যেন বিষম খেল, এক ঢোকে পুরো গ্লাসের জলটা গলায় ঢেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল “প্রেম? কি বলছিস?” রাজা যেন ভীষণ অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলল “সত্যি প্রেমে পড়ে গেছিস তোরা?” আমি লজ্জায় নিজের খালি থালাটার দিকে তাকিয়ে নখ দিয়ে থালাটার ওপর আঁকিবুকি এঁকে চলেছি। অরুণ বোধহয় গলা নামিয়ে কিছু একটা বলল যাতে পাশের কেউ না শুনতে পায়, কিন্তু আমিও সেই কথা শুনতে পেলাম না। রাজা অরুণের কাঁধে একটা জোড়ে গুঁতো মেরে বলল “শালা তোর মতন গান্ডু দেখিনি। শালা প্রেম করছিস তো এত লুকানর কি আছে? শালা আমি তোর জায়গায় থাকলে এতদিনে সবাইকে জানিয়ে দিতাম যে এই শুঁটকি মালটাকে ভালোবাসি। প্রেমে পড়েছি এই মালটার। কিন্তু সত্যি বলছি ভেরি গুড চয়েস।“ সন্দীপ টেবিলে বসেই গুণ গুণ করে গান ধরেছে “দোস্ত দোস্ত না রাহা, পেয়ার পেয়ার না রাহা। “ একটু থেমে নাটক করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “ শালা আমাকে ল্যাং মেরে শেষমেশ এই মালটাকে পছন্দ হল তোর? ঠিক আছে ডিয়ার, কুছ পরোয়া নেই। এইটুকু মনে রাখিস আমার হৃদয়ের দরজা তোর জন্য সব সময় খোলা জানেমন। “ ওরা যত এইসব মজা করছে আমার লজ্জা আর অস্বস্তি ততই বেড়ে চলেছে, আর পারলাম না থালা নিয়ে উঠতে গেলাম, সন্দীপ আমার হাত ধরে আমাকে টেনে বসিয়ে দিল। ভাষণ দেওয়ার মতন করে আমাদের দুজনকে বলল “ শোন, আমরা তোদেরকে অবাধ মেলা মেশা করার সম্পূর্ণ ছাড়পত্র দিলাম। তোরা আমাদের সামনে বা পিছনে যা খুশি করতে পারিস, আমরা কিছু মনে করব না, কোনও বাঁধা দেব না, আর কাউকে কিছু বলবও না। “ অরুণকে একটা ঘুসি মেরে বলল “শালা কি লাকি রে ভাই তুই যে এমন একটা কচি বউ ফাঁকায় ফাঁকায় বিনা পরিশ্রমে পেয়ে গেলি। “ রাজা বলল “ভাই সন্দীপ, সারা দিন এইভাবে দূরে দূরে, ছাড়া ছাড়া থাকার পর, রাত্রে বেচারারা আমাদের জন্য এক হতে পারে না।“ অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল “ভাই আমাদের সামনে রাখা ঢাকা করার দরকার নেই। যখন দরকার পড়বে তখনই তোমরা মিলিত হতে পার এবং অবাধ ভাবেই মিলিত হতে পার, আমরা বাঁধা দেব না। শুধু বেশী শব্দ কর না যাতে শ্যামদা বা ওনার মেয়ে এইসব ব্যাপার টের পেয়ে যায়। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন তো, আপনার কচি বর বউয়ের মতন হয়ে গেছেন, কিন্তু এখনও ঠিক আপনারা বর বউ নন। তাই যা করবেন গোপনে করবেন, নিঃশব্দে করবেন। কথাটা মাথায় ঢুকল? “ রাজা আর সন্দীপ দুজনেই অশ্লীল ভাবে হেঁসে উঠল। আমার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরবে এইবার। সন্দীপও অরুণের কাঁধে হাত রেখে বলল “ভাই নিঃসন্দেহে গুড চয়েস।“ আমি আর বসে থাকতে পারলাম না, হন্তদন্ত হয়ে ওখান থেকে উঠে বাসন রাখার জায়গার দিকে প্রস্থান করলাম। মাঝ পথে স্যারের সাথে প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলাম, স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কি হয়েছে, আমি কোনও মতে মাথা নাড়িয়ে কিছু হয়নি এইটুকু শুধু বুঝিয়ে কেটে পড়লাম।