16-01-2019, 06:47 PM
৪০।।
‘ভাবলাম এবার বোধহয় বর্ষাকালটা শেষ হলো... কিন্তু কোথায় কি, আবার কেমন আকাশটা ভার করে আছে দেখো... গুমোটও পড়েছে বেশ... শেষ হয়েও যেন শেষ হতে চাইছে না বৃষ্টিটা... পুজোও তো এসে গেলো প্রায়... কে জানে বাবা... এবার আবার পূজোয় বৃষ্টি হবে কি না... এত দেরীতে পূজো, তাও যদি বৃষ্টি হয়...’ অফিসের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে পৃথা... সে জানে তারই অপেক্ষায় অর্নব ড্রইংরুমে বসে থাকে... যতক্ষন না সে ফেরে... এটা যে কত বড় পাওনা তার কাছে সেটা সেই বোঝে মনে মনে... এক এক সময় মনে হয় তার, এই যে অর্নব বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ সামলায়, সেটা তো ও বেরুতে পারে না বলেই... কিন্তু যদি ও বেরুতে? তখন কি এই মুহুর্তটা পৃথা উপভোগ করতে পারতো? নাহঃ... হয়তো পারতো না ঠিকই... কিন্তু তাতে যে অখুশি হতো, সেটাও তো জোর দিয়ে বলা যায় না... হয়তো খুশিই হতো, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মত... পৃথা জানে, তার মনের এই কথা যদি কোন ভাবে অর্নব জানতে পারে, তবে কতটা আঘাত পাবে সে... তার জীবনের সাথে এই কারণে জড়াতে চাইনি অর্নব কিছুতেই, সেই প্রথমদিন থেকে... অনেক ভাবে অনেক চেষ্টায় তবে রাজি করাতে পেরেছিল পৃথা... তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকায় নি... দুজনেই... একে অপরে মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে অসীম ভালোবাসায়... অর্নবও নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে পৃথাকে ভর করে... সেটা শুধু সে বোঝে না, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে... আর করে বলেই যখন মনের মধ্যে এই ধরণের ভাবনা উঠে আসে, মরমে মরে যায়... আপন স্বার্থপরতায় অপরাধ বোধে ভোগে... ছি ছি... মানুষটাকে আজ সেই তো এই সম্পর্কে টেনে এনেছে, আর সেই কিনা... জোর করে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয় ভাবনাগুলো মনের ভেতর থেকে... কিন্তু চাইলেই কি যায় দুর্ভাবনা? এবারে অনেক কষ্টে মাকে সামলেছে... এড়িয়েছে অর্নবকে তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া থেকে... মা বার বার করে বলে দিয়েছে পরের বার এলে যেন অর্নবকে সাথে নিয়েই আসে... সেদিন সে যে কি করবে ভাবলেই হা পা ঠান্ডা হয়ে যায় পৃথার... অর্নবকেও খুলে বলতে পারে না কিছুতেই... আঘাত পাবে... হয়তো ফের ওর মনের মধ্যের দ্বিধাটা ফিরে আসবে, যেটা অনেক কষ্ট করে সরিয়ে দিয়েছে পৃথা... কিন্তু নিজেও যে প্রচন্ড অস্বস্থির মধ্যে দিয়ে চলেছে... কি ভাবে ম্যানেজ করবে মা’কে? কি বোঝাবে সে যদি সেই ভাবে চেপে ধরে তাকে? একটা ব্যাপারে সে একটু হলেও নিশ্চিত যে বাপীর শরীর খারাপ হওয়ার ফলে দুম করে ওরা কলকাতায় চলে আসবে না মেয়ের কাছে, কিন্তু যদি না বাপীর এই ঘটনাটা ঘটতো, মাকে বিশ্বাস নেই, হয়তো দেখা যেতো এসে হাজির হতো মেয়ের কাছেই... আলাপ করতে চলে আসতো হবু জামাইয়ের সাথে... ভাবলেই ঘেমে ওঠে পৃথা...
‘হ্যা... আজও মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে... ক’দিন ধরেই তো খবরে জানাচ্ছিল যে একটা নাকি বেশ বড়সড় নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে... তীব্র ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে এদিকেই...’ অর্নবের গলার স্বরে সম্বিত ফেরে পৃথার... তাড়াতাড়ি নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে গুছিয়ে ফেলে... মুখ তুলে একটা হাসি উপহার দেয় অর্নবের গলার স্বর লক্ষ্য করে...
আজও বড্ড সুন্দর লাগছে পৃথাকে... হাল্কা কচি কলাপাতা রঙের চুড়িদার কুর্তিটায় বেশ মানিয়েছে পৃথাকে... এমন ভাবে ঘরের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে যেন দেখে মনে হবে সদ্য গাছ থেকে ঝড়ের হাওয়ায় একটা কচি পাতা ঝরে পড়েছে... হাওয়ার তালে নেচে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে... মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পৃথার পানে সোফায় বসে থাকা অর্নব... তার মনে হয় এই নবীন পাতাটাকে হাতে ধরলেও যেন লজ্জাবতীর মত কুঁকড়ে গুটিয়ে যাবে নিজের ভেতরে... তম্বী দেহটা আঁটো কুর্তির আড়ালে আরো যেন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে... গাঢ় স্বরে ডাকে... ‘তিতির...’
বুকের ওপর থেকে পাতলা ওড়নাটাকে খুলে হাতের মধ্যে নিয়ে সবে পা বাড়িয়েছিল বেডরুমের দিকে, অর্নবের ডাকে থমকে দাঁড়ায়... মুখ তুলে সোফার পানে তাকিয়ে ভ্রু তুলে সাড়া দেয় সে... ‘উউউ...’
ওই ভাবে ঘাড় তুলে সাড়া দেওয়াটা ভিষন ভালো লাগে অর্নবের... বুকের মধ্যেটায় যেন কি একটা ঝড় ওঠে তার... ইচ্ছা করে পৃথার ওই নরম শরীরটাকে টেনে চেপে ধরে বুকের মধ্যে... আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি... ‘বাইরে মনে হচ্ছে বেশ হাওয়া ছেড়েছে... ছাদে যাবে?’
‘যাবে ছাদে? কিন্তু যদি বৃষ্টি নামে?’ বৃষ্টিতে ভিজতে বরাবরই পৃথার খুব ভালো লাগে... আগেও কত যে এই রকম বৃষ্টিতে তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজেছে, তার ইয়ত্তা নেই... মায়ের চোখ লুকিয়ে বৃষ্টি নামলেই পালাতো ছাদে... তারপর বৃষ্টি দাঁড়িয়ে নাচতো, গাইতো গলা ছেড়ে... পরে মা এসে বকা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যেত... কি অদ্ভুত, আজও অফিস থেকে ফেরার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা করছিল আগের মত ভেজে, কিন্তু সে ইচ্ছা আজকাল আর প্রকাশ করে না সে, কারণ সে জানে, ওই ঘটনার পর থেকে অর্নব বাজ পড়াকে খুব ভয় পায়... একটা কেমন ট্রমা গড়ে উঠেছে মনের মধ্যে অর্নবের, তাই সেও কখনও উল্লেখ করে না ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার... অর্নবের মুখে শুনে আনন্দে চোখদুটো চকচক করে ওঠে তার... কিন্তু পরক্ষনেই ভাবে, সত্যি যদি বৃষ্টি নামে, তখন? যদি বাজ পড়ে... কিন্তু অর্নব যখন নিজের থেকেই চাইছে...
‘চলো না... যাই... আজ কেন জানি না, ভিষন ইচ্ছা করছে তোমার সাথে ছাদে গিয়ে দাঁড়াতে... ঝড়ের হাওয়ার মুখে... গায়ে মাখতে প্রকৃতির খোলা হাওয়াটাকে...’ ঘাড়ের একেবারে কাছে অর্নবের গলার স্বরে ঘুরে দাড়ায় পৃথা... কখন সোফা থেকে উঠে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করে নি... অর্নবের বুকের ওপরে হাত রেখে উত্তর দেয় সে, ‘বেশ... চলো... তোমার যখন ইচ্ছা করছে...’
‘কেন তোমার ইচ্ছা করছে না?’ জিজ্ঞাসা করে অর্নব...
হাসে পৃথা... চোখের কটা মণিতে ঝিলিক খেলে যায়... ‘করছে তো... জানো... আমার না এই ভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিষন ভালো লাগে... আগে তো...’ বলতে বলতে থমকে যায় সে... ভাবে যদি অর্নবের কষ্ট হয় শুনে... এতদিন মনের মধ্যে তার এই ইচ্ছাটাকে চেপে রেখেছে জানলে পৃথা সুনিশ্চিত, খারাপ লাগবে অর্নবের, শুধু এই ইচ্ছাটাই বা কেন? সে দেখেছে, তার মুখ থেকে কোন কথা খসার সাথে সাথেই সেটা পূরণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে কিভাবে অর্নব... সেখানে যেটা ভয় পায় মানুষটা, কি ভাবে তাকে বলতো সে?
‘আগে কখনো বলো নি তো?’ প্রশ্ন করে অর্নব... ‘কেন?’
‘এমনি... তাই...’ কথা এড়ায় পৃথা... ‘যাবে?’... তারপর একটু ভেবে বলে, ‘কিন্তু যদি বাজ পড়ে? তুমি...’
‘পড়ুক না... ক্ষতি কি? তুমি তো আমার সাথে থাকবে... তুমি আমার পাশে থাকলে যে কোন ভয়কে আমি জিতে নিতে পারি... এখনও বোঝনি?’ গাঢ় স্বরে বলে ওঠে অর্নব... হাত রাখে পৃথার কাঁধে...
মাথা নাড়ে পৃথা... ‘হু... জানি তো...’
.
.
.
.
ছাদে এসে দাঁড়ায় দুজনে... আকাশে তখন ঘন ধূসর মেঘের আনাগোনা... সন্ধ্যের অন্ধকারে আকাশটা একটা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে যেন... ঝোড়ো হাওয়া বইছে বেশ জোরে জোরে... ছাদের তারে ক্লিপে আটকানো ফ্ল্যাটের কারুর জামা কাপড় তখনও তোলা হয় নি, ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেই গুলো... পৎপৎ করে আওয়াজ তুলছে...
ছাদের আলসের ধারে এসে দাঁড়ায় ওরা... বেশ উঁচু ওদের ফ্ল্যাটটা... ছাদের ওপর থেকে অনেকটা দূর অবধি চোখে পড়ে... আশপাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ঘরের আলো বেরিয়ে চতুর্দিকটা কেমন মায়াবী দৃশ্য এঁকে রেখেছে যেন... কোমর অবধি থাকা ছাদের পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় পৃথাকে অর্নব... পৃথা অর্নবের কোমরটা জড়িয়ে ধরে মাথা নামায় লোমশ বুকের ওপরে... পৃথার অগোছালো ঝাকড়া চুল উড়ে বেড়ায় হাওয়া ভেসে... ঢেকে দিতে চায় অর্নবের অদেখা মুখ চোখগুলো... চুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে অর্নবের ভেতরটা...
‘এই তিতির... একটা গান শোনাবে?’ আবদার করে অর্নব...
অর্নবের বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকায় পৃথা, হাসে... ‘কি গান শুনবে?’ প্রশ্ন করে সে।
‘যে কোন একটা... আনন্দের... ভালোবাসার...’ উত্তর দেয় অর্নব...
‘উউউমমমম...’ খানিক ভাবে পৃথা, কুর্তির পকেট থেকে ফ্ল্যাটের চাবিটা বের করে রাখে ছাদের পাঁচিলের ওপরে, একটু দূরের দিক করে, যাতে তাদের হাতে লেগে পড়ে না যায় নীচে... তারপর সরে যায় খানিকটা ছাদের ভেতর দিক করে... গায়ের ওড়নাটাকে ভালো করে পেঁচিয়ে নেয় নরম সুগোল বুকগুলোর ওপর দিয়ে... বেঁধে দেয় কোমরের একপাশটায়... তারপর শরীরটাকে বেঁকিয়ে ধরে নাচের ভঙ্গিমায়... ‘আজ শুধু তোমায় গান নয়... নাচও দেখাবো আমি... এটা শুধু আমার সোনার জন্য...’ বলে শুরু করে নাচের তালে তালে গান গাইতে...
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার তিতিরের দিকে... এত ভালো নাচে মেয়েটা? কি অপূর্ব ছন্দে গানের তালে হিল্লোল তুলছে দেহে... হাতের মুদ্রায় তৈরী করে চলেছে গানের ছন্দ... ঘুরে ফিরে মনের সমস্ত আনন্দ ঢেলে দিয়ে সে নেচে চলেছে আপন খেয়ালে...
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।
সুন্দর এসে ফিরে যায়, তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥
মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক বহ্নি।
ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ক্রন্দন তন্বী!
মাল্য যে দংশিছে হায়, তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা
মিলনসমুদ্রবেলায় চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা॥
পেছন থেকে হাততালির আওয়াজে চমকে ঘুরে তাকায় পৃথা... দেখে ছাদের দরজা ঠেলে এগিয়ে আসছেন অলোকবাবু... মুখে গাল এঁটো করা হাসি লেগে রয়েছে ওনার... সন্ধ্যের আবছায়া অন্ধকারেও পৃথার বুঝতে অসুবিধা হয় না ভদ্রলোকের লোলুপ চোখের চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার শরীরের ওপর থেকে নীচ অবধি... অপ্রস্তুত হাসি হেসে তাড়াতাড়ি টেনে বেঁধে রাখা ওড়নার বাঁধনটা খুলে দেয় সে... ঠিক করে সেটাকে ভাজ করে বুকের ওপরে ফেলে রাখে... প্রশ্ন করে... ‘এই ঝড়ে আপনি ওপরে, ছাদে এলেন?’
কথায় কথায় বেশ অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন ততক্ষনে ভদ্রলোক... ওই আধো-অন্ধকারের মধ্যেও পৃথার নজর এড়ায় ভদ্রলোকের চোখের মনিতে লালসার ঝিলিক... তাকে একা এই ভাবে ছাদে দেখতে পাবেন, এটা যেন ওনার কাছে পরম প্রাপ্তি... নির্জন ছাদে একটা একাকী পৃথার মত তম্বী দেহের মেয়েকে পেয়ে কামনার আগুনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে অলোকবাবুর সারা দেহটা... ঠোঁটা চেটে নিয়ে বলে ওঠেন, ‘ছাদে না এলে তোমাকে এই ভাবে তো দেখতে পেতাম না... বাহ! তুমি তো বেশ ভালো নাচো... অবস্য তোমার শরীরটাই এত সুন্দর, এত লোভনীয়, ভালো তো নাচবেই...’ বলতে বলতে নজর বোলান পৃথার শরীরের প্রতিটা খাঁজে...
‘না, মানে ওই আর কি... এমনই... মনে হলো তাই...’ কুন্ঠিত গলায় উত্তর দেয় পৃথা... কেমন যেন অর্নবের সামনে একজন অনাহুত ব্যক্তি তার দিকে এই ভাবে মন্তব্য করাটা সে ঠিক নিতে পারে না... ভালো লাগে না... অস্বস্থি হয় ভেতর ভেতর... সে জানে, যদি ভদ্রলোক তাকে একা ভেবে কিছু খারাপ মতলবে তার দিকে হাত বাড়াতে যান, অর্নব সেটা হতে দেবে না, কিন্তু তবুও... সুশান্তর ঘটনাটার পর থেকে তার সেই আত্মবিশ্বাসএর জায়গাটাতেই কেমন নড়ে গিয়েছে, ভুলে গিয়েছে মানুষের লোলুপতা প্রত্যাহত করার শক্তিটাই... অথচ এই পৃথাই এক সময় কি অবলীলায় না ঘুরে বেরিয়েছে পাহাড়ে পর্বতে, বনে জঙ্গলে... আসলে জন্তুদের মুখোমুখি হওয়া আর ভদ্রমুখোশের আড়ালে থাকা প্রকৃত জন্তুদের সাথে সংঘাত যে কতটা আলাদা, সেই দিন থেকেই তার সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে... আগে হলে এই অলোকবাবুকে নিয়েই কতই না মজা করেছে, প্রলুব্ধ করেছে সে... কিন্তু আজ কেন জানে না সে, এই খোলা ছাদে অন্ধকার আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একটা অস্বস্থি হয় তার...
‘তুমি কি ঘরেও এই ভাবেই নাচো? বাহ! খুব ভালো... নাচের তালে তালে তোমার সারা শরীরটা কেমন কি সুন্দর করে দুলে দুলে উঠছিল... তোমার অবস্য চেহারাটা বেশ ভালো... হেঁ হেঁ...’ বলতে বলত দেঁতো হাসেন ভদ্রলোক... আরো খানিকটা এগিয়ে আসেন পৃথার দিকে...
পৃথা স্পর্শ পায়ে কাঁধের ওপরে অর্নবের হাতের... সাথে সাথেই যেন তার কিছুক্ষন আগের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা ফিরে আসে... আগের পৃথা হয়ে ওঠে সে... ঠোঁটের কোনে খেলে যায় একরাশ দুষ্টুমীর হাসি... ‘ভালো লেগেছে আপনার আমার নাচ?’ প্রশ্ন করে সে...
গদগদ গলায় বলে ওঠেন অলোকবাবু, ‘উফফফ ভালো লেগেছে মানে... কি সুন্দর করে নাচছিলে তুমি... আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি এতো ভালো নাচতে পারো... বাহ! খুব ভালো লাগছিল... আসলে...’
অলোকবাবুর মুখের কথাটা প্রায় কেড়ে নেয় পৃথা, ‘হ্যা... ঠিক বলেছেন... ও’ও মনে হয় পছন্দ করে...’
থমকে যান ভদ্রলোক, পৃথার কথাটা শুনে... ‘ও’ও... মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করেন উনি...
‘হ্যা... ওই তো... আমার ঘরে যে থাকে... কেন? শোনেন নি আগে?’ প্রশ্ন করে ফিরিয়ে পৃথা।
‘তোমার ঘরে?’ আরো অবাক হন ভদ্রলোক... ‘তুমি তো একাই থাকো... তাই তো জানতাম...’
‘একাই তো... কিন্তু আবার ও’ও থাকে আমার সাথে...’ রহস্য করে উত্তর দেয় পৃথা...
‘ঠিক বুঝলাম না... অন্য কেউও থাকে নাকি তোমার সাথে?’ কৌতুহলী হয়ে ওঠে অলোকবাবুর স্বর... রসের সূত্র খুজতে চেষ্টা করেন পৃথার কথার মধ্যে দিয়ে... ‘কে? কে আসে? রাতে আসে?’
‘না, না... রাতে আসবে কেন... সব সময়ই তো আমি উপলব্ধি করি ওকে... আমার আশে পাশে... কেন আপনি শোনেন নি ব্যাপারটা...’
একটু কেমন ধাঁধায় পড়ে যান ভদ্রলোক... আগে শুনেছিলেন ঠিকই ব্যাপারটা... কিন্তু অতটা গুরুত্ব দেন নি কখনই... ভেবেছিলেন যে হয়তো ওটা বাজে লোকের রটনা... নিজে তো তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পান নি, তাই... ‘মানে কে থাকে বলো তো?’ চোখের ওপর থেকে ততক্ষনে লোলুপতা সরে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে অদম্য কৌতুহলে...
‘সেটা ঠিক বলতে পারবো না, বুঝলেন, কথা তো হয় নি, তবে ভিষন ভাবে বুঝতে পারি... প্রায় সব সময়ই আমাকে ঘিরে থাকে ও... কেমন যেন আমায় সর্বদা বডিগার্ডের মত রক্ষা করে চলে...’ মিচকি হেসে উত্তর দেয় পৃথা...
‘ওহ! তাই? আমিও শুনেছিলাম আগে ঠিকই, কিন্তু আসলে বিশ্বাস করি নি... নিজে তো কখনও কিছু বুঝতে পারি নি... তা তুমি যখন বলছ, কারন যতই হোক তুমি থাকো ঘরে...’ বলতে বলতে হাতটা কপালের ওপরে একবার বুলিয়ে নেন... বোঝা যায় ঝোড়ো হাওয়াতেও কপালের ওপরে বোধহয় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা দেখা দিয়েছে...
‘আরে ঘর কি বলছেন... আমি যেখানে যাই, সেখানেই তো ওর উপস্থিতি উপলব্ধি করি... সব জায়গায়... আমাকে যেন ঘিরে থাকে সবসময়...’ মুখটাকে যতটা সম্ভব সিরিয়াস করে বলে ওঠে পৃথা...
‘মা... মানে... এখানেও কি উপলব্ধি করছ নাকি?’ চকিতে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেন পৃথাকে...
‘হ্যা তো... এখানেও তো বুঝতে পারছি... তা না হলে এত নিশ্চিন্তে এই সন্ধ্যের অন্ধকারে ছাদে চলে আসবো, বলুন, মনের সুখের নাচতে পারতাম নাকি?’ বলতে বলত ইচ্ছা করেই দুটো হাত মাথার ওপরে সোজা সুজি তুলে দেয় সে... বুকটাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙে হাতের টানে...
অলোকবাবু পৃথার বুকের ওপরে দৃষ্টি দিয়েই চট করে সরিয়ে নেন কি মনে করে... ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করেন... ‘তুমি এখানেও ওই ওকে অনুভব করছো?’ ফের জিজ্ঞাসা করে ওঠেন তিনি।
‘হ্যা তো... আচ্ছা দেখবেন... ওই যে দেখছেন দড়িতে কাপড়খানা হাওয়ায় উড়ছে... দেখতে পাচ্ছেন তো...’ ছাদের দড়িতে ঝুলতে থাকা সাদা কাপড়টার দিকে ইশারা করে পৃথা... সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকান ভদ্রলোক...
‘হ্যা... তো?’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রশ্ন করেন তিনি।
‘এবার দেখুন... কেমন এত হাওয়াতেও কাপড়টা চুপ করে দাঁড়িয়ে যাবে...’ বলে ওঠে পৃথা।
বিস্ফারিত চোখে অলোকবাবু দেখেন সত্যিই উড়তে থাকা কাপড়টা হটাৎ করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়ে... এত হাওয়ার মধ্যেও এতটুকুও নড়ে না সেটা... যেন কেউ ওটাকে হাত দিয়ে টেনে ধরে রেখেছে...
ধড়াস করে ওঠে ভদ্রলোকের বুকের ভেতরটা... শুকিয়ে যায় গলা... মুখ তুলে একবার তাকায় পৃথার পানে... সে চোখে আর বিশ্ময় বা লোভ নেই... আছে একরাশ ভয়... তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠেন তিনি... ‘আআআ...আমি যাই... কে...কেমন... তোমার কাকিমা আবার এ...একা আছেন তো...’ বলে আর এতটুকুও দাঁড়ান না... দ্রুত নেমে যান সিড়ি দিয়ে নিচের দিকে... একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাবার চেষ্টা করেন না উনি কোনমতেই...
ভদ্রলোককে এই ভাবে দৌড়ে পালিয়ে যেতে খিলখিল করে হেসে ওঠে পৃথা, হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয় তার... অর্নব এগিয়ে এসে টেনে নেয় পৃথাকে নিজের বুকের মধ্যে... তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়... দুটো আলিঙ্গনবদ্ধ প্রেমিকযুগলকে শীতল বারিতে জিজিয়ে দিয়ে...
ক্রমশ...
‘ভাবলাম এবার বোধহয় বর্ষাকালটা শেষ হলো... কিন্তু কোথায় কি, আবার কেমন আকাশটা ভার করে আছে দেখো... গুমোটও পড়েছে বেশ... শেষ হয়েও যেন শেষ হতে চাইছে না বৃষ্টিটা... পুজোও তো এসে গেলো প্রায়... কে জানে বাবা... এবার আবার পূজোয় বৃষ্টি হবে কি না... এত দেরীতে পূজো, তাও যদি বৃষ্টি হয়...’ অফিসের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে পৃথা... সে জানে তারই অপেক্ষায় অর্নব ড্রইংরুমে বসে থাকে... যতক্ষন না সে ফেরে... এটা যে কত বড় পাওনা তার কাছে সেটা সেই বোঝে মনে মনে... এক এক সময় মনে হয় তার, এই যে অর্নব বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ সামলায়, সেটা তো ও বেরুতে পারে না বলেই... কিন্তু যদি ও বেরুতে? তখন কি এই মুহুর্তটা পৃথা উপভোগ করতে পারতো? নাহঃ... হয়তো পারতো না ঠিকই... কিন্তু তাতে যে অখুশি হতো, সেটাও তো জোর দিয়ে বলা যায় না... হয়তো খুশিই হতো, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মত... পৃথা জানে, তার মনের এই কথা যদি কোন ভাবে অর্নব জানতে পারে, তবে কতটা আঘাত পাবে সে... তার জীবনের সাথে এই কারণে জড়াতে চাইনি অর্নব কিছুতেই, সেই প্রথমদিন থেকে... অনেক ভাবে অনেক চেষ্টায় তবে রাজি করাতে পেরেছিল পৃথা... তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকায় নি... দুজনেই... একে অপরে মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে অসীম ভালোবাসায়... অর্নবও নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছে পৃথাকে ভর করে... সেটা শুধু সে বোঝে না, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে... আর করে বলেই যখন মনের মধ্যে এই ধরণের ভাবনা উঠে আসে, মরমে মরে যায়... আপন স্বার্থপরতায় অপরাধ বোধে ভোগে... ছি ছি... মানুষটাকে আজ সেই তো এই সম্পর্কে টেনে এনেছে, আর সেই কিনা... জোর করে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয় ভাবনাগুলো মনের ভেতর থেকে... কিন্তু চাইলেই কি যায় দুর্ভাবনা? এবারে অনেক কষ্টে মাকে সামলেছে... এড়িয়েছে অর্নবকে তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া থেকে... মা বার বার করে বলে দিয়েছে পরের বার এলে যেন অর্নবকে সাথে নিয়েই আসে... সেদিন সে যে কি করবে ভাবলেই হা পা ঠান্ডা হয়ে যায় পৃথার... অর্নবকেও খুলে বলতে পারে না কিছুতেই... আঘাত পাবে... হয়তো ফের ওর মনের মধ্যের দ্বিধাটা ফিরে আসবে, যেটা অনেক কষ্ট করে সরিয়ে দিয়েছে পৃথা... কিন্তু নিজেও যে প্রচন্ড অস্বস্থির মধ্যে দিয়ে চলেছে... কি ভাবে ম্যানেজ করবে মা’কে? কি বোঝাবে সে যদি সেই ভাবে চেপে ধরে তাকে? একটা ব্যাপারে সে একটু হলেও নিশ্চিত যে বাপীর শরীর খারাপ হওয়ার ফলে দুম করে ওরা কলকাতায় চলে আসবে না মেয়ের কাছে, কিন্তু যদি না বাপীর এই ঘটনাটা ঘটতো, মাকে বিশ্বাস নেই, হয়তো দেখা যেতো এসে হাজির হতো মেয়ের কাছেই... আলাপ করতে চলে আসতো হবু জামাইয়ের সাথে... ভাবলেই ঘেমে ওঠে পৃথা...
‘হ্যা... আজও মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে... ক’দিন ধরেই তো খবরে জানাচ্ছিল যে একটা নাকি বেশ বড়সড় নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে... তীব্র ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে এদিকেই...’ অর্নবের গলার স্বরে সম্বিত ফেরে পৃথার... তাড়াতাড়ি নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে গুছিয়ে ফেলে... মুখ তুলে একটা হাসি উপহার দেয় অর্নবের গলার স্বর লক্ষ্য করে...
আজও বড্ড সুন্দর লাগছে পৃথাকে... হাল্কা কচি কলাপাতা রঙের চুড়িদার কুর্তিটায় বেশ মানিয়েছে পৃথাকে... এমন ভাবে ঘরের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে যেন দেখে মনে হবে সদ্য গাছ থেকে ঝড়ের হাওয়ায় একটা কচি পাতা ঝরে পড়েছে... হাওয়ার তালে নেচে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে... মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পৃথার পানে সোফায় বসে থাকা অর্নব... তার মনে হয় এই নবীন পাতাটাকে হাতে ধরলেও যেন লজ্জাবতীর মত কুঁকড়ে গুটিয়ে যাবে নিজের ভেতরে... তম্বী দেহটা আঁটো কুর্তির আড়ালে আরো যেন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে... গাঢ় স্বরে ডাকে... ‘তিতির...’
বুকের ওপর থেকে পাতলা ওড়নাটাকে খুলে হাতের মধ্যে নিয়ে সবে পা বাড়িয়েছিল বেডরুমের দিকে, অর্নবের ডাকে থমকে দাঁড়ায়... মুখ তুলে সোফার পানে তাকিয়ে ভ্রু তুলে সাড়া দেয় সে... ‘উউউ...’
ওই ভাবে ঘাড় তুলে সাড়া দেওয়াটা ভিষন ভালো লাগে অর্নবের... বুকের মধ্যেটায় যেন কি একটা ঝড় ওঠে তার... ইচ্ছা করে পৃথার ওই নরম শরীরটাকে টেনে চেপে ধরে বুকের মধ্যে... আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি... ‘বাইরে মনে হচ্ছে বেশ হাওয়া ছেড়েছে... ছাদে যাবে?’
‘যাবে ছাদে? কিন্তু যদি বৃষ্টি নামে?’ বৃষ্টিতে ভিজতে বরাবরই পৃথার খুব ভালো লাগে... আগেও কত যে এই রকম বৃষ্টিতে তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজেছে, তার ইয়ত্তা নেই... মায়ের চোখ লুকিয়ে বৃষ্টি নামলেই পালাতো ছাদে... তারপর বৃষ্টি দাঁড়িয়ে নাচতো, গাইতো গলা ছেড়ে... পরে মা এসে বকা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যেত... কি অদ্ভুত, আজও অফিস থেকে ফেরার পথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা করছিল আগের মত ভেজে, কিন্তু সে ইচ্ছা আজকাল আর প্রকাশ করে না সে, কারণ সে জানে, ওই ঘটনার পর থেকে অর্নব বাজ পড়াকে খুব ভয় পায়... একটা কেমন ট্রমা গড়ে উঠেছে মনের মধ্যে অর্নবের, তাই সেও কখনও উল্লেখ করে না ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার... অর্নবের মুখে শুনে আনন্দে চোখদুটো চকচক করে ওঠে তার... কিন্তু পরক্ষনেই ভাবে, সত্যি যদি বৃষ্টি নামে, তখন? যদি বাজ পড়ে... কিন্তু অর্নব যখন নিজের থেকেই চাইছে...
‘চলো না... যাই... আজ কেন জানি না, ভিষন ইচ্ছা করছে তোমার সাথে ছাদে গিয়ে দাঁড়াতে... ঝড়ের হাওয়ার মুখে... গায়ে মাখতে প্রকৃতির খোলা হাওয়াটাকে...’ ঘাড়ের একেবারে কাছে অর্নবের গলার স্বরে ঘুরে দাড়ায় পৃথা... কখন সোফা থেকে উঠে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করে নি... অর্নবের বুকের ওপরে হাত রেখে উত্তর দেয় সে, ‘বেশ... চলো... তোমার যখন ইচ্ছা করছে...’
‘কেন তোমার ইচ্ছা করছে না?’ জিজ্ঞাসা করে অর্নব...
হাসে পৃথা... চোখের কটা মণিতে ঝিলিক খেলে যায়... ‘করছে তো... জানো... আমার না এই ভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিষন ভালো লাগে... আগে তো...’ বলতে বলতে থমকে যায় সে... ভাবে যদি অর্নবের কষ্ট হয় শুনে... এতদিন মনের মধ্যে তার এই ইচ্ছাটাকে চেপে রেখেছে জানলে পৃথা সুনিশ্চিত, খারাপ লাগবে অর্নবের, শুধু এই ইচ্ছাটাই বা কেন? সে দেখেছে, তার মুখ থেকে কোন কথা খসার সাথে সাথেই সেটা পূরণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে কিভাবে অর্নব... সেখানে যেটা ভয় পায় মানুষটা, কি ভাবে তাকে বলতো সে?
‘আগে কখনো বলো নি তো?’ প্রশ্ন করে অর্নব... ‘কেন?’
‘এমনি... তাই...’ কথা এড়ায় পৃথা... ‘যাবে?’... তারপর একটু ভেবে বলে, ‘কিন্তু যদি বাজ পড়ে? তুমি...’
‘পড়ুক না... ক্ষতি কি? তুমি তো আমার সাথে থাকবে... তুমি আমার পাশে থাকলে যে কোন ভয়কে আমি জিতে নিতে পারি... এখনও বোঝনি?’ গাঢ় স্বরে বলে ওঠে অর্নব... হাত রাখে পৃথার কাঁধে...
মাথা নাড়ে পৃথা... ‘হু... জানি তো...’
.
.
.
.
ছাদে এসে দাঁড়ায় দুজনে... আকাশে তখন ঘন ধূসর মেঘের আনাগোনা... সন্ধ্যের অন্ধকারে আকাশটা একটা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে যেন... ঝোড়ো হাওয়া বইছে বেশ জোরে জোরে... ছাদের তারে ক্লিপে আটকানো ফ্ল্যাটের কারুর জামা কাপড় তখনও তোলা হয় নি, ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেই গুলো... পৎপৎ করে আওয়াজ তুলছে...
ছাদের আলসের ধারে এসে দাঁড়ায় ওরা... বেশ উঁচু ওদের ফ্ল্যাটটা... ছাদের ওপর থেকে অনেকটা দূর অবধি চোখে পড়ে... আশপাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ঘরের আলো বেরিয়ে চতুর্দিকটা কেমন মায়াবী দৃশ্য এঁকে রেখেছে যেন... কোমর অবধি থাকা ছাদের পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নেয় পৃথাকে অর্নব... পৃথা অর্নবের কোমরটা জড়িয়ে ধরে মাথা নামায় লোমশ বুকের ওপরে... পৃথার অগোছালো ঝাকড়া চুল উড়ে বেড়ায় হাওয়া ভেসে... ঢেকে দিতে চায় অর্নবের অদেখা মুখ চোখগুলো... চুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে অর্নবের ভেতরটা...
‘এই তিতির... একটা গান শোনাবে?’ আবদার করে অর্নব...
অর্নবের বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকায় পৃথা, হাসে... ‘কি গান শুনবে?’ প্রশ্ন করে সে।
‘যে কোন একটা... আনন্দের... ভালোবাসার...’ উত্তর দেয় অর্নব...
‘উউউমমমম...’ খানিক ভাবে পৃথা, কুর্তির পকেট থেকে ফ্ল্যাটের চাবিটা বের করে রাখে ছাদের পাঁচিলের ওপরে, একটু দূরের দিক করে, যাতে তাদের হাতে লেগে পড়ে না যায় নীচে... তারপর সরে যায় খানিকটা ছাদের ভেতর দিক করে... গায়ের ওড়নাটাকে ভালো করে পেঁচিয়ে নেয় নরম সুগোল বুকগুলোর ওপর দিয়ে... বেঁধে দেয় কোমরের একপাশটায়... তারপর শরীরটাকে বেঁকিয়ে ধরে নাচের ভঙ্গিমায়... ‘আজ শুধু তোমায় গান নয়... নাচও দেখাবো আমি... এটা শুধু আমার সোনার জন্য...’ বলে শুরু করে নাচের তালে তালে গান গাইতে...
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার তিতিরের দিকে... এত ভালো নাচে মেয়েটা? কি অপূর্ব ছন্দে গানের তালে হিল্লোল তুলছে দেহে... হাতের মুদ্রায় তৈরী করে চলেছে গানের ছন্দ... ঘুরে ফিরে মনের সমস্ত আনন্দ ঢেলে দিয়ে সে নেচে চলেছে আপন খেয়ালে...
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।
সুন্দর এসে ফিরে যায়, তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা॥
মুখে নাহি নিঃসরে ভাষ, দহে অন্তরে নির্বাক বহ্নি।
ওষ্ঠে কী নিষ্ঠুর হাস, তব মর্মে যে ক্রন্দন তন্বী!
মাল্য যে দংশিছে হায়, তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা
মিলনসমুদ্রবেলায় চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা॥
পেছন থেকে হাততালির আওয়াজে চমকে ঘুরে তাকায় পৃথা... দেখে ছাদের দরজা ঠেলে এগিয়ে আসছেন অলোকবাবু... মুখে গাল এঁটো করা হাসি লেগে রয়েছে ওনার... সন্ধ্যের আবছায়া অন্ধকারেও পৃথার বুঝতে অসুবিধা হয় না ভদ্রলোকের লোলুপ চোখের চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার শরীরের ওপর থেকে নীচ অবধি... অপ্রস্তুত হাসি হেসে তাড়াতাড়ি টেনে বেঁধে রাখা ওড়নার বাঁধনটা খুলে দেয় সে... ঠিক করে সেটাকে ভাজ করে বুকের ওপরে ফেলে রাখে... প্রশ্ন করে... ‘এই ঝড়ে আপনি ওপরে, ছাদে এলেন?’
কথায় কথায় বেশ অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন ততক্ষনে ভদ্রলোক... ওই আধো-অন্ধকারের মধ্যেও পৃথার নজর এড়ায় ভদ্রলোকের চোখের মনিতে লালসার ঝিলিক... তাকে একা এই ভাবে ছাদে দেখতে পাবেন, এটা যেন ওনার কাছে পরম প্রাপ্তি... নির্জন ছাদে একটা একাকী পৃথার মত তম্বী দেহের মেয়েকে পেয়ে কামনার আগুনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে অলোকবাবুর সারা দেহটা... ঠোঁটা চেটে নিয়ে বলে ওঠেন, ‘ছাদে না এলে তোমাকে এই ভাবে তো দেখতে পেতাম না... বাহ! তুমি তো বেশ ভালো নাচো... অবস্য তোমার শরীরটাই এত সুন্দর, এত লোভনীয়, ভালো তো নাচবেই...’ বলতে বলতে নজর বোলান পৃথার শরীরের প্রতিটা খাঁজে...
‘না, মানে ওই আর কি... এমনই... মনে হলো তাই...’ কুন্ঠিত গলায় উত্তর দেয় পৃথা... কেমন যেন অর্নবের সামনে একজন অনাহুত ব্যক্তি তার দিকে এই ভাবে মন্তব্য করাটা সে ঠিক নিতে পারে না... ভালো লাগে না... অস্বস্থি হয় ভেতর ভেতর... সে জানে, যদি ভদ্রলোক তাকে একা ভেবে কিছু খারাপ মতলবে তার দিকে হাত বাড়াতে যান, অর্নব সেটা হতে দেবে না, কিন্তু তবুও... সুশান্তর ঘটনাটার পর থেকে তার সেই আত্মবিশ্বাসএর জায়গাটাতেই কেমন নড়ে গিয়েছে, ভুলে গিয়েছে মানুষের লোলুপতা প্রত্যাহত করার শক্তিটাই... অথচ এই পৃথাই এক সময় কি অবলীলায় না ঘুরে বেরিয়েছে পাহাড়ে পর্বতে, বনে জঙ্গলে... আসলে জন্তুদের মুখোমুখি হওয়া আর ভদ্রমুখোশের আড়ালে থাকা প্রকৃত জন্তুদের সাথে সংঘাত যে কতটা আলাদা, সেই দিন থেকেই তার সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে... আগে হলে এই অলোকবাবুকে নিয়েই কতই না মজা করেছে, প্রলুব্ধ করেছে সে... কিন্তু আজ কেন জানে না সে, এই খোলা ছাদে অন্ধকার আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একটা অস্বস্থি হয় তার...
‘তুমি কি ঘরেও এই ভাবেই নাচো? বাহ! খুব ভালো... নাচের তালে তালে তোমার সারা শরীরটা কেমন কি সুন্দর করে দুলে দুলে উঠছিল... তোমার অবস্য চেহারাটা বেশ ভালো... হেঁ হেঁ...’ বলতে বলত দেঁতো হাসেন ভদ্রলোক... আরো খানিকটা এগিয়ে আসেন পৃথার দিকে...
পৃথা স্পর্শ পায়ে কাঁধের ওপরে অর্নবের হাতের... সাথে সাথেই যেন তার কিছুক্ষন আগের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা ফিরে আসে... আগের পৃথা হয়ে ওঠে সে... ঠোঁটের কোনে খেলে যায় একরাশ দুষ্টুমীর হাসি... ‘ভালো লেগেছে আপনার আমার নাচ?’ প্রশ্ন করে সে...
গদগদ গলায় বলে ওঠেন অলোকবাবু, ‘উফফফ ভালো লেগেছে মানে... কি সুন্দর করে নাচছিলে তুমি... আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি এতো ভালো নাচতে পারো... বাহ! খুব ভালো লাগছিল... আসলে...’
অলোকবাবুর মুখের কথাটা প্রায় কেড়ে নেয় পৃথা, ‘হ্যা... ঠিক বলেছেন... ও’ও মনে হয় পছন্দ করে...’
থমকে যান ভদ্রলোক, পৃথার কথাটা শুনে... ‘ও’ও... মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করেন উনি...
‘হ্যা... ওই তো... আমার ঘরে যে থাকে... কেন? শোনেন নি আগে?’ প্রশ্ন করে ফিরিয়ে পৃথা।
‘তোমার ঘরে?’ আরো অবাক হন ভদ্রলোক... ‘তুমি তো একাই থাকো... তাই তো জানতাম...’
‘একাই তো... কিন্তু আবার ও’ও থাকে আমার সাথে...’ রহস্য করে উত্তর দেয় পৃথা...
‘ঠিক বুঝলাম না... অন্য কেউও থাকে নাকি তোমার সাথে?’ কৌতুহলী হয়ে ওঠে অলোকবাবুর স্বর... রসের সূত্র খুজতে চেষ্টা করেন পৃথার কথার মধ্যে দিয়ে... ‘কে? কে আসে? রাতে আসে?’
‘না, না... রাতে আসবে কেন... সব সময়ই তো আমি উপলব্ধি করি ওকে... আমার আশে পাশে... কেন আপনি শোনেন নি ব্যাপারটা...’
একটু কেমন ধাঁধায় পড়ে যান ভদ্রলোক... আগে শুনেছিলেন ঠিকই ব্যাপারটা... কিন্তু অতটা গুরুত্ব দেন নি কখনই... ভেবেছিলেন যে হয়তো ওটা বাজে লোকের রটনা... নিজে তো তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পান নি, তাই... ‘মানে কে থাকে বলো তো?’ চোখের ওপর থেকে ততক্ষনে লোলুপতা সরে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে অদম্য কৌতুহলে...
‘সেটা ঠিক বলতে পারবো না, বুঝলেন, কথা তো হয় নি, তবে ভিষন ভাবে বুঝতে পারি... প্রায় সব সময়ই আমাকে ঘিরে থাকে ও... কেমন যেন আমায় সর্বদা বডিগার্ডের মত রক্ষা করে চলে...’ মিচকি হেসে উত্তর দেয় পৃথা...
‘ওহ! তাই? আমিও শুনেছিলাম আগে ঠিকই, কিন্তু আসলে বিশ্বাস করি নি... নিজে তো কখনও কিছু বুঝতে পারি নি... তা তুমি যখন বলছ, কারন যতই হোক তুমি থাকো ঘরে...’ বলতে বলতে হাতটা কপালের ওপরে একবার বুলিয়ে নেন... বোঝা যায় ঝোড়ো হাওয়াতেও কপালের ওপরে বোধহয় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা দেখা দিয়েছে...
‘আরে ঘর কি বলছেন... আমি যেখানে যাই, সেখানেই তো ওর উপস্থিতি উপলব্ধি করি... সব জায়গায়... আমাকে যেন ঘিরে থাকে সবসময়...’ মুখটাকে যতটা সম্ভব সিরিয়াস করে বলে ওঠে পৃথা...
‘মা... মানে... এখানেও কি উপলব্ধি করছ নাকি?’ চকিতে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেন পৃথাকে...
‘হ্যা তো... এখানেও তো বুঝতে পারছি... তা না হলে এত নিশ্চিন্তে এই সন্ধ্যের অন্ধকারে ছাদে চলে আসবো, বলুন, মনের সুখের নাচতে পারতাম নাকি?’ বলতে বলত ইচ্ছা করেই দুটো হাত মাথার ওপরে সোজা সুজি তুলে দেয় সে... বুকটাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙে হাতের টানে...
অলোকবাবু পৃথার বুকের ওপরে দৃষ্টি দিয়েই চট করে সরিয়ে নেন কি মনে করে... ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করেন... ‘তুমি এখানেও ওই ওকে অনুভব করছো?’ ফের জিজ্ঞাসা করে ওঠেন তিনি।
‘হ্যা তো... আচ্ছা দেখবেন... ওই যে দেখছেন দড়িতে কাপড়খানা হাওয়ায় উড়ছে... দেখতে পাচ্ছেন তো...’ ছাদের দড়িতে ঝুলতে থাকা সাদা কাপড়টার দিকে ইশারা করে পৃথা... সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকান ভদ্রলোক...
‘হ্যা... তো?’ ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রশ্ন করেন তিনি।
‘এবার দেখুন... কেমন এত হাওয়াতেও কাপড়টা চুপ করে দাঁড়িয়ে যাবে...’ বলে ওঠে পৃথা।
বিস্ফারিত চোখে অলোকবাবু দেখেন সত্যিই উড়তে থাকা কাপড়টা হটাৎ করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়ে... এত হাওয়ার মধ্যেও এতটুকুও নড়ে না সেটা... যেন কেউ ওটাকে হাত দিয়ে টেনে ধরে রেখেছে...
ধড়াস করে ওঠে ভদ্রলোকের বুকের ভেতরটা... শুকিয়ে যায় গলা... মুখ তুলে একবার তাকায় পৃথার পানে... সে চোখে আর বিশ্ময় বা লোভ নেই... আছে একরাশ ভয়... তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠেন তিনি... ‘আআআ...আমি যাই... কে...কেমন... তোমার কাকিমা আবার এ...একা আছেন তো...’ বলে আর এতটুকুও দাঁড়ান না... দ্রুত নেমে যান সিড়ি দিয়ে নিচের দিকে... একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাবার চেষ্টা করেন না উনি কোনমতেই...
ভদ্রলোককে এই ভাবে দৌড়ে পালিয়ে যেতে খিলখিল করে হেসে ওঠে পৃথা, হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয় তার... অর্নব এগিয়ে এসে টেনে নেয় পৃথাকে নিজের বুকের মধ্যে... তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়... দুটো আলিঙ্গনবদ্ধ প্রেমিকযুগলকে শীতল বারিতে জিজিয়ে দিয়ে...
ক্রমশ...