09-01-2019, 07:54 AM
পর্ব সাত – সাহচর্যের হাত (#9)
পরের দিন ফারহানের সাথে কথা বলে বাপ্পা নস্করের বাড়িতে যায়। দানা ঠিক করে, শুরুতেই বাপ্পা নস্করকে এই উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু জানাবে না। কিছু দিন ফারহানের সাথে থেকে বাপ্পা নস্করের চোখের সামনে থেকে ওর হাবভাব বিচার করার পরে উন্নয়নের ব্যাপারে প্রস্তাব দেবে। ফারহান আগে থেকেই দানাকে বাপ্পার চাল চলন সম্বন্ধে দানাকে জানিয়ে দিয়েছিল। নিতাই নামে একজন গুন্ডা বাপ্পার ডান হাত, আর ইন্দ্রনীল নামে একজন উকিল ওর বাম হাত। বাপ্পা নস্করের পেটে কালির বিদ্যে বিশেষ নেই তবে শয়তানি বুদ্ধি প্রচুর আছে আর বাপ্পা নস্কর এই দুইজনের কথায় ওঠে বসা করে। দানা যেন বাপ্পা নস্করের সাথে সমিহ করে কথাবার্তা বলে, বিদ্যে বুদ্ধি যেন ঝাড়তে চেষ্টা না করে। যতই ট্যাক্সি চালক হোক না কেন, পড়াশুনার ইচ্ছে ছিল বলে, মহেন্দ্র বাবুর কাছে থেকে অনেক বই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে আর নিজের জ্ঞানের পরিধি বেশ কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছে।
বাপ্পা নস্কর এককালে চোরাই করা চাল বিক্রি করত তারপরে এক নেতার কাছে গুন্ডার কাজ করত। ওর নামে বেশ কয়েকটা চুরি ডাকাতি এবং খুনের মামলা চলছে, কিন্তু তথ্য প্রমান, সাক্ষী সাবুদের অভাবে বাপ্পাকে পুলিস ধরতে পারেনি। বাপ্পা নস্করের বয়স পঁয়তাল্লিশ, জন সাধারনের টাকা খেয়ে কালো মোটা কোলা ব্যাঙ্গের মতন হয়ে গেছে। এককালে গুন্ডা ছিল সেটা কাঁধের কাছে ছুরির দাগ দেখলেই বোঝা যায়। গলায় মোটা সোনার চেন, এত মোটা যে একটা গরু বেঁধে রাখা যায় তার সাহায্যে, ডান কব্জিতে সোনার ব্রেসলেট, একটা কানে আবার শখের হীরের দুল। মনে মনে হাসে দানা, এদিক নেই ওদিক আছে, পেটে কালির বিদ্যে নেই কিন্তু বাবুর সাজ কেতা দুরস্থ। বাপ্পার বাড়ি দেখেই বোঝা যায় যে লোকটার টাকা থাকলে কি হবে রুচিবোধ বলতে কিছু নেই। বসার ঘর দামী জিনিসপত্রে ঠাসা, যা ভালো লেগেছে তাই কিনে গেছে কিন্তু কি ভাবে সাজাতে হয় সেটা জানে না। বিশাল দুইতলা বাড়ি, সবসময়ে প্রচুর লোকজন ঘিরে থাকে। বসার ঘরের মধ্যে দানার গুমটির মতন দশ খানা গুমটি ঢুকে যাবে। বাড়ির সামনে তিনখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে, ফারহান বাপ্পার খাস গাড়ি, একটা সাদা রঙের স্করপিও চালায়, বাকি দুই গাড়ি ছেলে মেয়ের জন্য আর স্ত্রীর জন্য।
ফারহান দানার সাথে বাপ্পার পরিচয় করিয়ে দেয়, দানাকে একবার দেখে না দেখার ভান করে গাড়িতে উঠে পরে। দানা যেন ওর কাছে মানুষ নয় নিতান্ত একটা মাছি এমন মনভাব দেখায়। ফারহান দানাকে ওর সাথে গাড়িতে উঠতে বলে। দানা অনিচ্ছে সত্তেও ফারহানের পাশে বসে পরে। পেছন পেছন অন্য একটা জিপ গাড়িতে বেশ কয়েকজন লোক উঠে ওদের গাড়ি অনুসরন করে।
গাড়িতে উঠে বাপ্পা ফারহানকে প্রশ্ন করে, “তোর এই নতুন বন্ধুটা কে? নিমাই কোথায় গেল আজকে?”
ফারহান গাড়ি চালাতে চালতে বলে, “বাপ্পাদা, দানা আমার খুব ভালো বন্ধু। আর সব থেকে বড় ব্যাপার যার জন্য আপনার কাছে আনা, দানা পিস্তল রিভলভার চালাতে জানে। দশ জনের মধ্যে খালি হাতে একাই অন্তত চার পাঁচ জনকে মেরে শুইয়ে দেবে।”
বাপ্পা দানার কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর নাম কি?”
পরিচয়ের সময় থেকেই দানার মাথা গরম ছিল তাও ফারহানের চেহারা দেখে কণ্ঠে মিষ্টতা এনে উত্তর দেয়, “দানা।”
বাপ্পা ওকে জিজ্ঞেস করে, “আগে কার কাছে কাজ করতিস?”
ফারহান এইবারে ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আগে অধির বাবুর ট্যাক্সি চালত, ব্যাস। কিন্তু বুঝতেই পারছেন ট্যাক্সিতে কতদিন। তাই আমি ওকে এই পিস্তল রিভলভার চালানো শিখিয়ে দিলাম যাতে আপনার কাছে একটা কাজ করতে পারে।”
বাপ্পা দানাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই পড়াশুনা করেছিস? কি ধরনের কাজ করতে চাস তুই?”
এবারেও দানার হয়ে ফারহান উত্তর দেয়, “হ্যাঁ বাপ্পাদা তা একটু আধটু করেছে। আপনার অনেক চেনাজানা, তাই বলছিলাম যদি কারুর কাছে ড্রাইভারির চাকরি পাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়।”
বাপ্পা খানিকক্ষন চিন্তা করে ফারহানকে বলে, “দেখি কি করতে পারি। আচ্ছা এখন সোজা লালগঞ্জ চল।”
লালগঞ্জ, টিভি সিনেমার শুটিং হয়, সেইখানে বাপ্পার কি কাজ? লালগঞ্জ ঢোকার আগেই পেছনের গাড়ি অন্যদিকে চলে যায়। দানা চুপ করে ওদের কথাবার্তা শুনে যায়, ফারহান আড় চোখে দানার কঠিন চোয়াল লক্ষ্য করে ওকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। দানার একবার মনে হয় এই গাড়ির মধ্যে বাপ্পা নস্করকে এক থাবরে শেষ করে দেয়, শালা সরকারী টাকায় দুইতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে, তিনখানা গাড়ি করে নিয়েছে আর ওই বস্তির লোকেরা পচা নোংরা পুতিময় গলির পাশে থাকে, স্নানের জন্য আলাদা কল নেই, খাওয়ার জলের কোল আর স্নানের জায়গা এক জায়গায়, বর্ষা হলে বস্তির অর্ধেক গুমটি জলের তলায় চলে যায়। সব টাকা আত্মসাৎ করে আবার বড় বড় বুলি ঝাড়ছে, ইতর রাজনৈতিক পিচাশ।
লালগঞ্জে চোদ্দ নাম্বার স্টুডিওর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় ফারহান। এই লালগঞ্জ থেকেই বাংলা চলচিত্র সিরিয়ালের ইত্যাদির শুটিং হয়, এদিকে গাড়ি ওদিকে গাড়ি, লোকে লোকারণ্য, কোথাও বেশ কয়েকটা বড় বড় বাস কিন্তু তাতে কোন জানালা নেই। ফারহান জানায় ওই গুলো নাকি ভ্যানিটি ভ্যান, ওর ভেতরটা নাকি পাঁচতারা হোটেলের সুসজ্জিত কামরার মতন সাজানো। নায়ক নায়িকাদের জন্য ওই সব ভ্যানের ব্যাবস্থা, পাঁচ মিনিট শুটিং করে আর পাঁচ ঘন্টা ওই ভ্যানের মধ্যে কাটায়। বাপ্পার গাড়ি মনে হয় এই স্টুডিওর লোকেরা চেনে। গাড়ি দাঁড়াতেই একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে সেলাম ঠোকে। তারপরে গলা নামিয়ে বাপ্পার সাথে কিছু বাক্য বিনিময় হয়।
বাপ্পা আবার ফারহানকে গাড়ি নিয়ে সোজা বেলডাঙ্গা যেতে নির্দেশ দেয়। এইভাবে সারাদিন বাপ্পার সাথে ঘুরে ঘুরে কাটায়, কখন কাজলহাটি, কখন বেলডাঙ্গা। কখন কোন বিল্ডারের অফিসে যাওয়া কখন কোন বড় ব্যাবসায়ির অফিসে ঢোকা এইভাবে সারাদিন কেটে যায়। দানার একটাই প্রশ্ন এই লোক অফিসে কখন যায় মানে ওই লালবাড়িতে কখন যায়? সারাদিন শুধু পান চেবান আর সিগারেট খাওয়া। কোন অফিস থেকে বের হলেই শরীর থেকে মদের গন্ধ বের হয়। সন্ধ্যে বেলায় বাপ্পা বাড়ি ফেরার পরেই দানা আর ফারহান নিজেদের মধ্যে কথা বলার অবকাশ পায়। বাড়িতে ঢোকার আগে দানার সাথে বাকিদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে।
দানা ফারহানকে লালগঞ্জের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ফারহান নিচু কণ্ঠে ওকে জানায়, “চুপ একদম মাথা ঘামাবি না ওই সব ব্যাপারে বুঝলি। যে যা করছে করতে দে, যে মরছে মরতে দে, যে যাকে পারছে চুদতে দে।” দানা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে কি ব্যাপার, ফারহান উত্তর দেয়, “মাদারজাতের সাথে ওই নয়না বোসের চক্কর আছে। দুইদিন অন্তর চোদাচুদি চলে ওই নায়িকার সাথে। এইকথা অবশ্য অনেকের অজানা। শুধু আমি ওর গাড়ি চালাই বলে জানি আর এই তুই জানলি। দ্যাখ দানা, বাপ্পার নেক নজরে না পড়লে তুই যে উন্নয়নের কাজ করতে চাস সেটা করতে পারবি না।”
শুধু ওই প্রথম দিন ছাড়া নিতাই আর বাকিরা দানাকে বাপ্পার গাড়িতে উঠতে দেয়নি। নিরুপায় ফারহান চেষ্টা করলেও নিতাইয়ের সামনে মুখ খোলার সাহস পায়নি। দানাকে পেছনের গাড়িতে বাকি ছেলেদের সাথে বসতে হত। এই কয়দিন ফারহানের পাশে পাশে ছিল বটে কিন্তু বাপ্পার কাছে দানা আর পাঁচখানা গুন্ডা ছেলদের চেয়ে বেশি নয়। দানা সেটা কখনই চায়নি। দানার ইচ্ছে পুজোর আগেই বস্তি উন্নয়নের কাজ শুরু করতে, তাহলে অনেকের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে। তাই একদিন বস্তির সবার সাথে আলোচনা করার পরে ঠিক করে যে সোজা বাপ্পা নস্করের কাছে গিয়ে উন্নয়নের প্রস্তাব দেবে। পরিকল্পনা মাফিক দানা, কেষ্ট মদনা বলাই আরও বেশ কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে যায় সরাসরি বাপ্পা নস্করের কাছে যায়। একটা সামান্য ট্যাক্সি চালকের পেছনে এত লোক দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় বাপ্পা নস্কর, তবে তুখোড় নেতার মতন নিজেকে সামলে নেয়।
বাপ্পা দানাকে প্রশ্ন করে, “হটাত বস্তি উন্নয়নের কথা মাথায় এলো, কি ব্যাপার।” বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে, “তুই নতুন কোন রাজনৈতিক দল গঠন করছিস নাকি রে?”
দানাও চোয়াল শক্ত করে প্রত্তুতরে হেসে জবাব দেয়, “না বাপ্পা দা, বস্তির হাল ফেরাতে চাই এই ব্যাস।”
বাপ্পা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে, “আমি কি করতে পারি, এর জন্য। গত বার তোদের ওই বস্তির সামনের রাস্তা ঠিক করতেই এত টাকা বেড়িয়ে গেল যে বস্তির ভেতরে আর হাত দিতে পারলাম না।”
সেই হাসি শুনে দানার গা জ্বলে ওঠে তাও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বাপ্পাকে উত্তর দেয়, “না না, আপনাকে কিছু করতে হবে না। বস্তি উন্নয়নের টাকা আমি যোগাড় করে নেব। আপনাকে শুধু জানিয়ে রাখলাম কারন আপনি এই এলাকার বিধায়ক।”
বাপ্পা নস্কর, ইন্দ্রনীলের সাথে শলা পরামর্শ করে জানাল উন্নয়নের জন্য সরকার তরফ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দেবে। দানার যদিও ওই টাকার কোন দরকার ছিল না তাও বাপ্পা নস্করকে হাতে রাখার জন্য ওই টাকা নেওয়ার সম্মতি জানায়।
পুজোর আগেই অরুনকান্তি বাবুর ত্বত্তাবধনে কালী পাড়ার বস্তি উন্নয়নের কাজে শুরু হয়। মহেন্দ্র বাবু দানাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। কেষ্ট মদনের সাথে শঙ্কর, রামিজ, বলাই, নাসির সবাই কাজে লেগে পরে। সেই সাথে আশেপাশের বেশ কিছু বস্তির উন্নয়নের জন্য লোকেরা এগিয়ে আসে। দানা আর অরুনকান্তি বাবুর সাহায্যে শুধু কালী পাড়া নয়, কবিঝিলের বস্তি, নদেরঘাট, মোহনপুরা, পাল বাগান এই সব জায়গার রাস্তা ঘাট মেরামতি, ড্রেন তৈরি ইত্যাদি শুরু হয়। দানা ওই পাপের আয় করা টাকা দিয়ে বুড়ো দুলালের ঘর, বরুনের ঘর, কেষ্ট, মদনার গুমটি এমন আরো অনেকের ঘর পাকা করে দেয়। টালির জায়গায় টিন আর এসবেস্টিসের ছাউনি দেওয়া হয়, বেশ কয়েকজনার ছাদ পাকা করে দেয়। পাঁচখানা পায়খানা নতুন করে তৈরি করে, মেয়েদের স্নানের জন্য তিনটে বাথরুম তৈরি করে দেয়। অচিরে দানা কালী পাড়া বস্তি আর আশেপাশের লোকদের কাছে মুকুট হীন রাজা হয়ে ওঠে।
মাঝে মাঝেই ফারহানের সাথে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় যায় মহেন্দ্র বাবুর সাথে দেখা করার জন্য। হিঙ্গল গঞ্জে গেলেই ফারহান ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। রাতের গভীর অন্ধকারে নাফিসার সাথে দানা মেতে ওঠে নিজের কাম পিপাসা চরিতার্থ করতে। কখন জারিনা থাকলে চারজনে মিলে নিজেদের তৃষ্ণার্ত শরীর কাম রসে ভিজিয়ে নেয়।
একদিন বেশ রাতে বাপ্পা নস্কর দানা এবং ফারহানকে একাকী ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে দানা, কয়েক দিনের মধ্যে মনে হচ্ছে তুই নতুন রাজনৈতিক দল বানিয়ে নিবি?”
দানাও হেসে জবাব দেয়, “কি যে বলেন না আপনি। আমি কেন রাজনীতিতে যোগ দিতে যাবো? রাজনীতি করা আমার ধাতে সয় না। আমি ট্যাক্সি চালক বড় জোর আপনার কৃপায় কারুর গাড়ি চালানোর কাজ পেলেই যথেষ্ট।”
ফারহান পাশেই ছিল স্বমস্বরে বলল, “না না বাপ্পা দা, দানাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম কারন আপনার অনেক চেনা জানা তাই।”
বাপ্পা নস্কর দানাকে বলে, “শোন, তুই ভালো গাড়ি চালাতে পারিস। তাই ত?” দানা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” বাপ্পা নস্কর গলা নামিয়ে বলে, “আমার একটা কাজ তোকে করতে হবে।” দানা আর ফারহান দুইজনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বাপ্পা নস্করের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাপ্পা নস্কর বলে, “তুই অভিনেত্রী নয়না বোসকে, চিনিস? ওর সাথে আমার আলোচনা হয়ে গেছে। অনেকদিন থেকে নয়না একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার খুঁজছে। তুই ছেলে ভালো, দরকার পড়লে গুলি গোলাও চালাতে জানিস, তাই তোকে এই কাজে নিযুক্ত করতে চাই।”
দানা আর ফারহান মুখ চাওয়াচায়ি করে। এমনিতে এই বস্তি উন্নয়নে ব্যাঙ্কে যা জমানো টাকা ছিল সব প্রায় শেষের মুখে। বাপ্পা নস্করের ওই গুন্ডাদের সাথে কাজ করার তেমন ইচ্ছে ছিল না দানার। দানার ইচ্ছে ছিল আবার নিজের পুরাতন জীবনে ফিরে যাওয়ার, অধীর বাবুর ট্যাক্সি চালানোর। কিন্তু ফারহান ওকে নয়নার গাড়ি চালানোর পরামর্শ দেয়, ওকে বুঝিয়ে বলে এই কাজে খাটনি কম। জীবনে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম দানা করেছে তাই খাটুনি কম বেশি তাতে ওর কিছু আসে যায় না। দানা চিন্তা ভাবনা করে দেখে, এই কাজে টাকা বেশি আয় হবে, তাই শেষ পর্যন্ত নয়নার গাড়ি চালানোর কাজে সম্মতি জানায়।
বাপ্পা ওদের বলে, “এই বার্তালাপ শুধু যেন আমাদের তিন জনের মধ্যে সীমিত থাকে। তুই নয়নার ড্রাইভার আর রক্ষক, সেই সাথে তোকে নয়নার ওপরে নজর রাখতে হবে। মানে ও কোথায় যায় কখন যায় কার সাথে যায় ইত্যাদি সব খবরাখবর আমাকে জানাবি। এক কথায় গুপ্তচর।” বাপ্পা মিচকি হেসে জবাব দেয়, “মাইনের ব্যাপারে চিন্তা করিস না একদম, নয়না তোকে আট হাজার দেবে। আর উপরি পাওনা আমি তোকে মাসে পাঁচ হাজার দেব।”
ফারহান দানার হয়ে জবাব দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ বাপ্পাদা আপনি একদম চিন্তা করবেন না। দানাকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেব। দানা আমার সব থেকে ভালো বন্ধু। ওর ওপরে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন।”
দানা মিচকি হেসে মাথা নাড়ায়। এতদিন সুন্দরী অভিনেত্রী নয়না বোসকে শুধু মাত্র ওই টিভি আর সিনেমাতে দেখে এসেছে। এইবারে ড্রাইভারির সুবাদে নয়নার কাছাকাছি থাকতে পারবে তার চেয়ে বড় কথা টাকার অঙ্ক কম নয় এই কাজে। ট্যাক্সি চালিয়ে একমাসে এত টাকা রোজগার করা সম্ভব নয়।
দানার সাথে হাত মিলিয়ে বাপ্পা বলে, “তাহলে নভেম্বরের প্রথম থেকে কাজ শুরু করে দিস। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা পরের ইলেকশানে তোর এলাকার সব ভোট যেন আমি পাই।”
দানাও বাপ্পা নস্করের হাতে হাত মিলিয়ে হেসে জানিয়ে দেয় এলাকার সব মানুষ বাপ্পা নস্করকেই ভোট দেবে।
পুজোর আগেই কালী পাড়া বস্তি নতুন সাজে সেজে ওঠে, পুজোয় নতুন জামা নতুন কাপড় চোপড়ের সাথে নতুন ঘর বাড়ির খুশিতে সবাই উৎফুল্ল। কেউ দানার জন্য নতুন জামা উপহার দেয়, কেউ নতুন জুতো। প্রত্যকে সন্ধেয় মদনার দোকানে আড্ডার আসর জমে ওঠে, দানার মতন উদার লোকের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরে।
এত চেনা লোকের সমাগমেও দানার বুক বড় ফাঁকা, লোকের ভিড়ে দানা বড় একা। ওর শুন্য চোখ আজও খুঁজে বেড়ায় কাউকে নিজের পাশে পাওয়ার জন্য। শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা দানাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় ইন্দ্রাণীর কাছে। বুক ভরে শ্বাস নিলে যেন ইন্দ্রাণীর গায়ের গন্ধ ভেসে আসে হাওয়ায়।
********** পর্ব সাত সমাপ্ত। **********
পরের দিন ফারহানের সাথে কথা বলে বাপ্পা নস্করের বাড়িতে যায়। দানা ঠিক করে, শুরুতেই বাপ্পা নস্করকে এই উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু জানাবে না। কিছু দিন ফারহানের সাথে থেকে বাপ্পা নস্করের চোখের সামনে থেকে ওর হাবভাব বিচার করার পরে উন্নয়নের ব্যাপারে প্রস্তাব দেবে। ফারহান আগে থেকেই দানাকে বাপ্পার চাল চলন সম্বন্ধে দানাকে জানিয়ে দিয়েছিল। নিতাই নামে একজন গুন্ডা বাপ্পার ডান হাত, আর ইন্দ্রনীল নামে একজন উকিল ওর বাম হাত। বাপ্পা নস্করের পেটে কালির বিদ্যে বিশেষ নেই তবে শয়তানি বুদ্ধি প্রচুর আছে আর বাপ্পা নস্কর এই দুইজনের কথায় ওঠে বসা করে। দানা যেন বাপ্পা নস্করের সাথে সমিহ করে কথাবার্তা বলে, বিদ্যে বুদ্ধি যেন ঝাড়তে চেষ্টা না করে। যতই ট্যাক্সি চালক হোক না কেন, পড়াশুনার ইচ্ছে ছিল বলে, মহেন্দ্র বাবুর কাছে থেকে অনেক বই ঘাঁটাঘাঁটি করেছে আর নিজের জ্ঞানের পরিধি বেশ কিছুটা বাড়িয়ে নিয়েছে।
বাপ্পা নস্কর এককালে চোরাই করা চাল বিক্রি করত তারপরে এক নেতার কাছে গুন্ডার কাজ করত। ওর নামে বেশ কয়েকটা চুরি ডাকাতি এবং খুনের মামলা চলছে, কিন্তু তথ্য প্রমান, সাক্ষী সাবুদের অভাবে বাপ্পাকে পুলিস ধরতে পারেনি। বাপ্পা নস্করের বয়স পঁয়তাল্লিশ, জন সাধারনের টাকা খেয়ে কালো মোটা কোলা ব্যাঙ্গের মতন হয়ে গেছে। এককালে গুন্ডা ছিল সেটা কাঁধের কাছে ছুরির দাগ দেখলেই বোঝা যায়। গলায় মোটা সোনার চেন, এত মোটা যে একটা গরু বেঁধে রাখা যায় তার সাহায্যে, ডান কব্জিতে সোনার ব্রেসলেট, একটা কানে আবার শখের হীরের দুল। মনে মনে হাসে দানা, এদিক নেই ওদিক আছে, পেটে কালির বিদ্যে নেই কিন্তু বাবুর সাজ কেতা দুরস্থ। বাপ্পার বাড়ি দেখেই বোঝা যায় যে লোকটার টাকা থাকলে কি হবে রুচিবোধ বলতে কিছু নেই। বসার ঘর দামী জিনিসপত্রে ঠাসা, যা ভালো লেগেছে তাই কিনে গেছে কিন্তু কি ভাবে সাজাতে হয় সেটা জানে না। বিশাল দুইতলা বাড়ি, সবসময়ে প্রচুর লোকজন ঘিরে থাকে। বসার ঘরের মধ্যে দানার গুমটির মতন দশ খানা গুমটি ঢুকে যাবে। বাড়ির সামনে তিনখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে, ফারহান বাপ্পার খাস গাড়ি, একটা সাদা রঙের স্করপিও চালায়, বাকি দুই গাড়ি ছেলে মেয়ের জন্য আর স্ত্রীর জন্য।
ফারহান দানার সাথে বাপ্পার পরিচয় করিয়ে দেয়, দানাকে একবার দেখে না দেখার ভান করে গাড়িতে উঠে পরে। দানা যেন ওর কাছে মানুষ নয় নিতান্ত একটা মাছি এমন মনভাব দেখায়। ফারহান দানাকে ওর সাথে গাড়িতে উঠতে বলে। দানা অনিচ্ছে সত্তেও ফারহানের পাশে বসে পরে। পেছন পেছন অন্য একটা জিপ গাড়িতে বেশ কয়েকজন লোক উঠে ওদের গাড়ি অনুসরন করে।
গাড়িতে উঠে বাপ্পা ফারহানকে প্রশ্ন করে, “তোর এই নতুন বন্ধুটা কে? নিমাই কোথায় গেল আজকে?”
ফারহান গাড়ি চালাতে চালতে বলে, “বাপ্পাদা, দানা আমার খুব ভালো বন্ধু। আর সব থেকে বড় ব্যাপার যার জন্য আপনার কাছে আনা, দানা পিস্তল রিভলভার চালাতে জানে। দশ জনের মধ্যে খালি হাতে একাই অন্তত চার পাঁচ জনকে মেরে শুইয়ে দেবে।”
বাপ্পা দানার কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর নাম কি?”
পরিচয়ের সময় থেকেই দানার মাথা গরম ছিল তাও ফারহানের চেহারা দেখে কণ্ঠে মিষ্টতা এনে উত্তর দেয়, “দানা।”
বাপ্পা ওকে জিজ্ঞেস করে, “আগে কার কাছে কাজ করতিস?”
ফারহান এইবারে ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আগে অধির বাবুর ট্যাক্সি চালত, ব্যাস। কিন্তু বুঝতেই পারছেন ট্যাক্সিতে কতদিন। তাই আমি ওকে এই পিস্তল রিভলভার চালানো শিখিয়ে দিলাম যাতে আপনার কাছে একটা কাজ করতে পারে।”
বাপ্পা দানাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই পড়াশুনা করেছিস? কি ধরনের কাজ করতে চাস তুই?”
এবারেও দানার হয়ে ফারহান উত্তর দেয়, “হ্যাঁ বাপ্পাদা তা একটু আধটু করেছে। আপনার অনেক চেনাজানা, তাই বলছিলাম যদি কারুর কাছে ড্রাইভারির চাকরি পাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়।”
বাপ্পা খানিকক্ষন চিন্তা করে ফারহানকে বলে, “দেখি কি করতে পারি। আচ্ছা এখন সোজা লালগঞ্জ চল।”
লালগঞ্জ, টিভি সিনেমার শুটিং হয়, সেইখানে বাপ্পার কি কাজ? লালগঞ্জ ঢোকার আগেই পেছনের গাড়ি অন্যদিকে চলে যায়। দানা চুপ করে ওদের কথাবার্তা শুনে যায়, ফারহান আড় চোখে দানার কঠিন চোয়াল লক্ষ্য করে ওকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করে। দানার একবার মনে হয় এই গাড়ির মধ্যে বাপ্পা নস্করকে এক থাবরে শেষ করে দেয়, শালা সরকারী টাকায় দুইতলা বাড়ি হাঁকিয়েছে, তিনখানা গাড়ি করে নিয়েছে আর ওই বস্তির লোকেরা পচা নোংরা পুতিময় গলির পাশে থাকে, স্নানের জন্য আলাদা কল নেই, খাওয়ার জলের কোল আর স্নানের জায়গা এক জায়গায়, বর্ষা হলে বস্তির অর্ধেক গুমটি জলের তলায় চলে যায়। সব টাকা আত্মসাৎ করে আবার বড় বড় বুলি ঝাড়ছে, ইতর রাজনৈতিক পিচাশ।
লালগঞ্জে চোদ্দ নাম্বার স্টুডিওর সামনে গাড়ি দাঁড় করায় ফারহান। এই লালগঞ্জ থেকেই বাংলা চলচিত্র সিরিয়ালের ইত্যাদির শুটিং হয়, এদিকে গাড়ি ওদিকে গাড়ি, লোকে লোকারণ্য, কোথাও বেশ কয়েকটা বড় বড় বাস কিন্তু তাতে কোন জানালা নেই। ফারহান জানায় ওই গুলো নাকি ভ্যানিটি ভ্যান, ওর ভেতরটা নাকি পাঁচতারা হোটেলের সুসজ্জিত কামরার মতন সাজানো। নায়ক নায়িকাদের জন্য ওই সব ভ্যানের ব্যাবস্থা, পাঁচ মিনিট শুটিং করে আর পাঁচ ঘন্টা ওই ভ্যানের মধ্যে কাটায়। বাপ্পার গাড়ি মনে হয় এই স্টুডিওর লোকেরা চেনে। গাড়ি দাঁড়াতেই একটা লোক হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে সেলাম ঠোকে। তারপরে গলা নামিয়ে বাপ্পার সাথে কিছু বাক্য বিনিময় হয়।
বাপ্পা আবার ফারহানকে গাড়ি নিয়ে সোজা বেলডাঙ্গা যেতে নির্দেশ দেয়। এইভাবে সারাদিন বাপ্পার সাথে ঘুরে ঘুরে কাটায়, কখন কাজলহাটি, কখন বেলডাঙ্গা। কখন কোন বিল্ডারের অফিসে যাওয়া কখন কোন বড় ব্যাবসায়ির অফিসে ঢোকা এইভাবে সারাদিন কেটে যায়। দানার একটাই প্রশ্ন এই লোক অফিসে কখন যায় মানে ওই লালবাড়িতে কখন যায়? সারাদিন শুধু পান চেবান আর সিগারেট খাওয়া। কোন অফিস থেকে বের হলেই শরীর থেকে মদের গন্ধ বের হয়। সন্ধ্যে বেলায় বাপ্পা বাড়ি ফেরার পরেই দানা আর ফারহান নিজেদের মধ্যে কথা বলার অবকাশ পায়। বাড়িতে ঢোকার আগে দানার সাথে বাকিদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে।
দানা ফারহানকে লালগঞ্জের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ফারহান নিচু কণ্ঠে ওকে জানায়, “চুপ একদম মাথা ঘামাবি না ওই সব ব্যাপারে বুঝলি। যে যা করছে করতে দে, যে মরছে মরতে দে, যে যাকে পারছে চুদতে দে।” দানা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে কি ব্যাপার, ফারহান উত্তর দেয়, “মাদারজাতের সাথে ওই নয়না বোসের চক্কর আছে। দুইদিন অন্তর চোদাচুদি চলে ওই নায়িকার সাথে। এইকথা অবশ্য অনেকের অজানা। শুধু আমি ওর গাড়ি চালাই বলে জানি আর এই তুই জানলি। দ্যাখ দানা, বাপ্পার নেক নজরে না পড়লে তুই যে উন্নয়নের কাজ করতে চাস সেটা করতে পারবি না।”
শুধু ওই প্রথম দিন ছাড়া নিতাই আর বাকিরা দানাকে বাপ্পার গাড়িতে উঠতে দেয়নি। নিরুপায় ফারহান চেষ্টা করলেও নিতাইয়ের সামনে মুখ খোলার সাহস পায়নি। দানাকে পেছনের গাড়িতে বাকি ছেলেদের সাথে বসতে হত। এই কয়দিন ফারহানের পাশে পাশে ছিল বটে কিন্তু বাপ্পার কাছে দানা আর পাঁচখানা গুন্ডা ছেলদের চেয়ে বেশি নয়। দানা সেটা কখনই চায়নি। দানার ইচ্ছে পুজোর আগেই বস্তি উন্নয়নের কাজ শুরু করতে, তাহলে অনেকের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে। তাই একদিন বস্তির সবার সাথে আলোচনা করার পরে ঠিক করে যে সোজা বাপ্পা নস্করের কাছে গিয়ে উন্নয়নের প্রস্তাব দেবে। পরিকল্পনা মাফিক দানা, কেষ্ট মদনা বলাই আরও বেশ কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে যায় সরাসরি বাপ্পা নস্করের কাছে যায়। একটা সামান্য ট্যাক্সি চালকের পেছনে এত লোক দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় বাপ্পা নস্কর, তবে তুখোড় নেতার মতন নিজেকে সামলে নেয়।
বাপ্পা দানাকে প্রশ্ন করে, “হটাত বস্তি উন্নয়নের কথা মাথায় এলো, কি ব্যাপার।” বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে, “তুই নতুন কোন রাজনৈতিক দল গঠন করছিস নাকি রে?”
দানাও চোয়াল শক্ত করে প্রত্তুতরে হেসে জবাব দেয়, “না বাপ্পা দা, বস্তির হাল ফেরাতে চাই এই ব্যাস।”
বাপ্পা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলে, “আমি কি করতে পারি, এর জন্য। গত বার তোদের ওই বস্তির সামনের রাস্তা ঠিক করতেই এত টাকা বেড়িয়ে গেল যে বস্তির ভেতরে আর হাত দিতে পারলাম না।”
সেই হাসি শুনে দানার গা জ্বলে ওঠে তাও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বাপ্পাকে উত্তর দেয়, “না না, আপনাকে কিছু করতে হবে না। বস্তি উন্নয়নের টাকা আমি যোগাড় করে নেব। আপনাকে শুধু জানিয়ে রাখলাম কারন আপনি এই এলাকার বিধায়ক।”
বাপ্পা নস্কর, ইন্দ্রনীলের সাথে শলা পরামর্শ করে জানাল উন্নয়নের জন্য সরকার তরফ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দেবে। দানার যদিও ওই টাকার কোন দরকার ছিল না তাও বাপ্পা নস্করকে হাতে রাখার জন্য ওই টাকা নেওয়ার সম্মতি জানায়।
পুজোর আগেই অরুনকান্তি বাবুর ত্বত্তাবধনে কালী পাড়ার বস্তি উন্নয়নের কাজে শুরু হয়। মহেন্দ্র বাবু দানাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। কেষ্ট মদনের সাথে শঙ্কর, রামিজ, বলাই, নাসির সবাই কাজে লেগে পরে। সেই সাথে আশেপাশের বেশ কিছু বস্তির উন্নয়নের জন্য লোকেরা এগিয়ে আসে। দানা আর অরুনকান্তি বাবুর সাহায্যে শুধু কালী পাড়া নয়, কবিঝিলের বস্তি, নদেরঘাট, মোহনপুরা, পাল বাগান এই সব জায়গার রাস্তা ঘাট মেরামতি, ড্রেন তৈরি ইত্যাদি শুরু হয়। দানা ওই পাপের আয় করা টাকা দিয়ে বুড়ো দুলালের ঘর, বরুনের ঘর, কেষ্ট, মদনার গুমটি এমন আরো অনেকের ঘর পাকা করে দেয়। টালির জায়গায় টিন আর এসবেস্টিসের ছাউনি দেওয়া হয়, বেশ কয়েকজনার ছাদ পাকা করে দেয়। পাঁচখানা পায়খানা নতুন করে তৈরি করে, মেয়েদের স্নানের জন্য তিনটে বাথরুম তৈরি করে দেয়। অচিরে দানা কালী পাড়া বস্তি আর আশেপাশের লোকদের কাছে মুকুট হীন রাজা হয়ে ওঠে।
মাঝে মাঝেই ফারহানের সাথে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় যায় মহেন্দ্র বাবুর সাথে দেখা করার জন্য। হিঙ্গল গঞ্জে গেলেই ফারহান ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। রাতের গভীর অন্ধকারে নাফিসার সাথে দানা মেতে ওঠে নিজের কাম পিপাসা চরিতার্থ করতে। কখন জারিনা থাকলে চারজনে মিলে নিজেদের তৃষ্ণার্ত শরীর কাম রসে ভিজিয়ে নেয়।
একদিন বেশ রাতে বাপ্পা নস্কর দানা এবং ফারহানকে একাকী ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে দানা, কয়েক দিনের মধ্যে মনে হচ্ছে তুই নতুন রাজনৈতিক দল বানিয়ে নিবি?”
দানাও হেসে জবাব দেয়, “কি যে বলেন না আপনি। আমি কেন রাজনীতিতে যোগ দিতে যাবো? রাজনীতি করা আমার ধাতে সয় না। আমি ট্যাক্সি চালক বড় জোর আপনার কৃপায় কারুর গাড়ি চালানোর কাজ পেলেই যথেষ্ট।”
ফারহান পাশেই ছিল স্বমস্বরে বলল, “না না বাপ্পা দা, দানাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম কারন আপনার অনেক চেনা জানা তাই।”
বাপ্পা নস্কর দানাকে বলে, “শোন, তুই ভালো গাড়ি চালাতে পারিস। তাই ত?” দানা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।” বাপ্পা নস্কর গলা নামিয়ে বলে, “আমার একটা কাজ তোকে করতে হবে।” দানা আর ফারহান দুইজনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বাপ্পা নস্করের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাপ্পা নস্কর বলে, “তুই অভিনেত্রী নয়না বোসকে, চিনিস? ওর সাথে আমার আলোচনা হয়ে গেছে। অনেকদিন থেকে নয়না একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার খুঁজছে। তুই ছেলে ভালো, দরকার পড়লে গুলি গোলাও চালাতে জানিস, তাই তোকে এই কাজে নিযুক্ত করতে চাই।”
দানা আর ফারহান মুখ চাওয়াচায়ি করে। এমনিতে এই বস্তি উন্নয়নে ব্যাঙ্কে যা জমানো টাকা ছিল সব প্রায় শেষের মুখে। বাপ্পা নস্করের ওই গুন্ডাদের সাথে কাজ করার তেমন ইচ্ছে ছিল না দানার। দানার ইচ্ছে ছিল আবার নিজের পুরাতন জীবনে ফিরে যাওয়ার, অধীর বাবুর ট্যাক্সি চালানোর। কিন্তু ফারহান ওকে নয়নার গাড়ি চালানোর পরামর্শ দেয়, ওকে বুঝিয়ে বলে এই কাজে খাটনি কম। জীবনে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম দানা করেছে তাই খাটুনি কম বেশি তাতে ওর কিছু আসে যায় না। দানা চিন্তা ভাবনা করে দেখে, এই কাজে টাকা বেশি আয় হবে, তাই শেষ পর্যন্ত নয়নার গাড়ি চালানোর কাজে সম্মতি জানায়।
বাপ্পা ওদের বলে, “এই বার্তালাপ শুধু যেন আমাদের তিন জনের মধ্যে সীমিত থাকে। তুই নয়নার ড্রাইভার আর রক্ষক, সেই সাথে তোকে নয়নার ওপরে নজর রাখতে হবে। মানে ও কোথায় যায় কখন যায় কার সাথে যায় ইত্যাদি সব খবরাখবর আমাকে জানাবি। এক কথায় গুপ্তচর।” বাপ্পা মিচকি হেসে জবাব দেয়, “মাইনের ব্যাপারে চিন্তা করিস না একদম, নয়না তোকে আট হাজার দেবে। আর উপরি পাওনা আমি তোকে মাসে পাঁচ হাজার দেব।”
ফারহান দানার হয়ে জবাব দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ বাপ্পাদা আপনি একদম চিন্তা করবেন না। দানাকে আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেব। দানা আমার সব থেকে ভালো বন্ধু। ওর ওপরে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন।”
দানা মিচকি হেসে মাথা নাড়ায়। এতদিন সুন্দরী অভিনেত্রী নয়না বোসকে শুধু মাত্র ওই টিভি আর সিনেমাতে দেখে এসেছে। এইবারে ড্রাইভারির সুবাদে নয়নার কাছাকাছি থাকতে পারবে তার চেয়ে বড় কথা টাকার অঙ্ক কম নয় এই কাজে। ট্যাক্সি চালিয়ে একমাসে এত টাকা রোজগার করা সম্ভব নয়।
দানার সাথে হাত মিলিয়ে বাপ্পা বলে, “তাহলে নভেম্বরের প্রথম থেকে কাজ শুরু করে দিস। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা পরের ইলেকশানে তোর এলাকার সব ভোট যেন আমি পাই।”
দানাও বাপ্পা নস্করের হাতে হাত মিলিয়ে হেসে জানিয়ে দেয় এলাকার সব মানুষ বাপ্পা নস্করকেই ভোট দেবে।
পুজোর আগেই কালী পাড়া বস্তি নতুন সাজে সেজে ওঠে, পুজোয় নতুন জামা নতুন কাপড় চোপড়ের সাথে নতুন ঘর বাড়ির খুশিতে সবাই উৎফুল্ল। কেউ দানার জন্য নতুন জামা উপহার দেয়, কেউ নতুন জুতো। প্রত্যকে সন্ধেয় মদনার দোকানে আড্ডার আসর জমে ওঠে, দানার মতন উদার লোকের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরে।
এত চেনা লোকের সমাগমেও দানার বুক বড় ফাঁকা, লোকের ভিড়ে দানা বড় একা। ওর শুন্য চোখ আজও খুঁজে বেড়ায় কাউকে নিজের পাশে পাওয়ার জন্য। শরতের নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা দানাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় ইন্দ্রাণীর কাছে। বুক ভরে শ্বাস নিলে যেন ইন্দ্রাণীর গায়ের গন্ধ ভেসে আসে হাওয়ায়।
********** পর্ব সাত সমাপ্ত। **********