09-01-2019, 07:48 AM
পর্ব সাত – সাহচর্যের হাত (#2)
ঠিক সেই সময়ে এক গুরু গম্ভির কণ্ঠ স্বর শোনা যায়, “ছেড়ে দে অনেক হয়েছে। শালা আট জনের মধ্যে চারজনকে একাই শুইয়ে দিল। তোদের কতবার বলি রোজ সাঁতার কাট কিন্তু তোরা শুনবি না।”
সবাই ওকে ছেড়ে দিতেই দানা উঠে দাঁড়ায়। মহেন্দ্র বাবু, সৌম্য কান্তি ব্যাক্তি, দেখলেই বোঝা যায় যে ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। পরনে সাদা ধুতি, একটা সাদা গেঞ্জি, কপালে বড় লাল তিলক। ডান হাতের ওপরে বেশ পুরানো গভীর ক্ষত দাগ, দেখেই মনে হয় আইন বিরোধী কর্মের ফল। ফারহান আর শঙ্কর ওর দিকে এগিয়ে আসে, একজন একটা চেয়ার নিয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে। ফারহান ওর দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে ক্ষমা চেয়ে বলে, এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতে হলে একটা পরীক্ষা দিতে হয়, মনে হয় দানা পাশ করে যাবে এই পরীক্ষায়। সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়েন ভদ্রলোক।
ফারহান ওই ভদ্রলোকের সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, “এই হচ্ছেন আমাদের বড়দা।” ফিসফিস করে বলে, “পেন্নাম ঠোক রে।” ফারহানের সাথে সাথে দানাও সেই ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে।
মহেন্দ্র বাবু দানাকে আপাদ মস্তক জরিপ করে জিজ্ঞেস করে, “কি করিস তুই?”
দানা নাকের রক্ত হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে উত্তর দেয়, “আগে ট্যাক্সি চালাতাম কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না তাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম।”
মহেন্দ্র বাবু ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, “মিথ্যে কথা বলছিস আর সেটাও ভালো ভাবে বলতে জানিস না তুই। নিশ্চয় প্রেমে ধাক্কা খেয়েছিস তাই মহানগর ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।” মহেন্দ্র বাবুর কথা শুনে বাকি সবাই হেসে দেয়ে। মহেন্দ্র বাবু শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি রে এর নাক থেকে রক্ত পড়ছে একটু কিছু দে?”
সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন একটা কাপড় আর একটা ওষুধ দেয় ওর হাতে। দানা তাকিয়ে দেখে যার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে মাথা দিয়ে মেরেছিল সেই ব্যাক্তি ওর হাতে কাপড় আর ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে। মহেন্দ্র বাবু সেই ব্যাক্তির সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, রামিজ আন্সারি। ফারহান একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, শক্তি, মনা, কালী, বলাই, আক্রাম, নাসির, সোহেল, পিন্টু, নাড়ু আরো অনেকের সাথে, দানাও সবার সাথে হাত মিলিয়ে সন্ধি পাতিয়ে নেয়। সবাই মহেন্দ্র বাবুর সাথেই থাকে। এই বাড়িতে শঙ্কর আর রামিজ নিজেদের পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকে আর মহেন্দ্র বাবু তাঁর ছেলেদের নিয়ে একতলায় থাকেন।
একজন মহিলা এক থালা খাবার দাবার এনে ছেলেদের হাতে দিয়ে চলে যায়। সবার সাথে খাবার খেতে খেতে দানা এদিক ওদিকে চেয়ে দেখে। বাড়িটা বেশ বড় সর, সব মিলিয়ে মনে হল দশ বারোটা ঘর হবে। অনেকের কোমরে পিস্তল গোঁজা দেখে দানা একটু চমকে যায়। ফারহান জানিয়ে দেয় চমকানোর কিছু নেই, ওই পিস্তল কোনদিন দুর্বল মানুষের ওপরে চালানো হয় না।
মহেন্দ্র বাবু ওর মারামারি করা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর নাম কি?”
দানা উত্তর দেয়, “আমার নাম দানা।”
মহেন্দ্র বাবু হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এটা কি ভালো নাম না ডাক নাম?”
দানা মাথা চুলকায়, কারুর ভালো নাম কি কখন দানা হতে পারে নাকি? তারপরে উত্তর দেয়, “না মানে এটা ডাক নাম, একটা ভালো নাম আছে বিশ্বজিৎ তবে ওই নামে আমাকে কেউ ডাকে না।”
মহেন্দ্র বাবু হেসে ফেলেন, “তোর এই দানা নামের একটা অর্থ আছে সেটা জানিস কি? হিব্রু ভাষায় দানা মানে বিদ্বান। কত পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিস তুই?”
দানা মাথা নাড়িয়ে জানায় এতদিন ওর ডাকনামের অর্থ জানত না তারপরে উত্তর দেয়, “বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম তারপরে মা মারা যাওয়াতে আর পড়াশুনা করে ওঠা হয়নি।”
মহেন্দ্র বাবু দানাকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তোর এই বিস্বজিতের মানে কি সেটা জানিস?”
দানা কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলে, “হ্যাঁ জানি, যে বিশ্ব জয় করে তার নাম বিশ্বজিৎ।” তারপরে হেসে দুই আঙ্গুল দিয়ে বন্দুক ইশারা করে বলে, “এই দিয়ে এখন বিশ্ব জয় করা যায়।”
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, “অরে মূর্খ, ওই পিস্তল বন্দুক দিয়ে যদি সত্যি সত্যি বিশ্ব জয় করা যেত তাহলে সারা বিশ্বে মারামারি কাটাকাটি লেগে যেত, জলের পরিবর্তে রক্তের নদী বইত। বিশ্ব জয় করতে গেলে মানুষের মন জয় করতে হয়। স্বদেশে পুজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে।”
দানা মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বড়দা এটা কোন ভাষা? কিছু বুঝলাম না যে?”
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, “এটা সংস্কৃত ভাষা। আমি যা বললাম তার মানে, যে বিদ্বান, যে অন্য মানুষের দুঃখ বোঝে সেই বিশ্ব জয় করে, নিজের দেশে শুধু মাত্র রাজার পুজো করা হয় কিন্তু ভালো মানুষের পুজো সব জায়গাতেই হয়। বিদ্বান মানে শুধু বই পুঁথি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘিলুর শ্রাদ্ধ করলাম সেটা নয় রে দানা। একজন মহান সন্ন্যাসী বলে গেছেন, এজুকেশান ইজ দা মানিফেস্টেসান অফ দা পারফেক্সান আল্রেডি উইদিন ম্যান। এর মানেও নিশ্চয় কিছু বুঝিস নি তাই না?” দানার মাথা এই কথা কিছুই ঢোকে না তাই মাথা নাড়িয়ে জানায় যে কিছুই ঢোকেনি। মহেন্দ্র বাবু ওকে পাশে বসিয়ে বলেন, “একজন মানুষের শিক্ষা দীক্ষার পরিপূর্ণতা সবসময়ে সেই মানুষের হৃদয়ে অভ্যন্তরে থাকে, সেইখান থেকেই আসে শিক্ষার আসল অর্থ।”
দানা মহেন্দ্র বাবুকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা বড়দা আপনি এত তত্ত কথা জানলেন কি করে?”
মহেন্দ্র বাবু ওকে বলে, “আমি প্রায় সব ধর্ম গ্রন্থ পড়েছি এই শিক্ষার খোঁজে। অবাক হচ্ছিস না আমাকে দেখে?” দানার সাথে সাথে বাকি ছেলেরা অবাক হয়ে মহেন্দ্র বাবুর দিকে তাকায়। মহেন্দ্র বাবু হেসে ওদের বলে, “তোদের মানুষ করব বলে এইখানে এসেছি, বুঝেছিস। আমি অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেই এক বানী, মানুষকে ভালবাসতে শিখতে হয়।” বলেই হেসে ফেলেন, “যা এবারে ওঠ, অনেক হল আজকে। তারপরে বলবি বুড়ো ভাম বসিয়ে বসিয়ে জ্ঞান দিয়ে গেল।”
ফারহান প্রশ্ন করে, “তাহলে বড়দা এই কাজে কেন নেমেছেন?”
মহেন্দ্র বাবু ওর মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি দুষ্টের নিধন করি তাই বন্দুক তুলে নিয়েছি হাতে। এদেশের যে রাজা সেই চোর তাই বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে। আমি ডাকাতি করি, সোনা চোরাই করি, বিদেশী মাল চোরাই করি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছি। তবে টাকার জন্যে আমি কোনোদিন কাউকে খুন করিনি, ড্রাগসের ব্যাবসা কোনোদিন করিনি। আমার হৃদয় যাদের বলেছিল যে এই মানুষকে খুন করে দাও, নর নারী নির্বিশেষে তাদের খুন করেছি। পুরুষ হোক কি মহিলা, যদি তোর হৃদয় বলে যে এই মানুষ সমাজের জন্য পূতিময় রোগ তাহলে তাকে সরিয়ে দিতে পিছপা হবি না কখন। কোনোদিন কোন অবলা নারীর গায়ে হাত তুলিনি, কোন নারীর শ্লীলতা হনন করিনি, কোন দরিদ্র মানুষের রুটি কেড়ে খাইনি। তোদের কেও সেই এক কথা বলি।”
বেশ কিছুক্ষণ ওইখানে বসে থাকার পরে ফারহান ওকে জানায় ওকে ফিরে যেতে হবে। দানা ব্যাগ উঠিয়ে নিতেই ফারহান বলে এইখানে থাকতে। ওকে জানায় যে শঙ্কর আর রামিজ মহেন্দ্র বাবুর দুই হাত। ওদের দুইজনের যেন কোনোদিন বিরাগ ভাজন না হয়। তারপরে কানেকানে জানায় ওর মতন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করুক, ভালো কারুর গাড়ি চালাবার চাকরি পেলে দানাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। কেষ্টর পরে ফারহানকে দেখে দানার মনে হয় সত্যি এক বন্ধু পেয়েছে এই মহানগরের বুকে। ফারহান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
শঙ্কর বাকি ছেলেদের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়। নিচের একটা বড় ঘরে আরো তিনজনের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা। ওই ঘরে চারখানা খাট পাতা, বলাই, নাসির আর শক্তি যারা বয়সে একটু ছোট তারা এই ঘরে থাকে। বাকিদের জন্য পাশের অন্য ঘর। রাতে ওই উঠানে লম্বা সার বেঁধে খাওয়া দাওয়ার পাত পরে। শঙ্করের স্ত্রী, মহিমা আর রামিজের স্ত্রী আবিদার ওপরে রান্না করার ভার, দুই নারীকে দেখে মনে হয় দুই বোন। রাতের বেলায় বাকিদের সাথে মদ খেতে খেতে আরো জানতে পারে যে, শঙ্কর আর রামিজের ছেলে মেয়েরা দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। সব খরচ এই বড়দা দেন। এই এলাকার অনেক ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ মহেন্দ্র বাবু বহন করেন।
পরের দিন সকাল থেকেই দানার অনুশীলন শুরু হয়ে যায়, ভোরবেলা সূর্য উঁকি মারার সময় থেকেই সবাই উঠে পরে। সকাল সকাল নদীর তীরে গিয়ে সাঁতার কাটতে হয়, সাঁতরে নদী পেরিয়ে ওইপাশে যেতে হবে। বাপরে এই গঙ্গা পার হওয়া, বিশাল ব্যাপার। দানা ছোট বেলায় কালী পাড়ার বস্তির পেছনের দিকের পুকুরে সাঁতার শিখেছিল কিন্তু এযে বিশাল চওড়া নদী। প্রথম দিনে বেশি দুর যেতে পারল না, বাকিরা পারাপার করে দিল এক বারেই। এই নদী পারাপার করা যেন ওদের কাছে ছেলে খেলা। দুপুরের পরে বলাই, নাসিরের সাথে মাছ ধরার প্রশিক্ষণ চলে। বলাইকে জিজ্ঞেস করলে জানায় যে এই বিদ্যে একদিন ওর কাজে লাগবে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা ধৈর্যের পরীক্ষা করায়, ছিপ ধরে বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা, ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকো একভাবে কখন মাছে চারা খাবে, ফাতনায় টান ধরলেই ঢিল দিয়ে আগে মাছ খেলাও তারপরে টেনে উঠাও। তারপরে বিকেলে আবার পিস্তল বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ। কোনটা সাইলেন্সার, কোনটা ট্রিগার, কোনটা সেফটি ক্লাচ, কি ভাবে রিভলভারে গুলি ভরতে হয়, কি ভাবে পিস্তলে ম্যাগাজিন ভরতে হয় ইত্যাদি, কোন গুলি কত বোরের, কোন গুলিতে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবি, পিস্তল রিভলভার খুলে কি ভাবে পরিস্কার করে আবার জোড়া লাগাতে হয় ইত্যাদি।
শক্তি বলাই নাসিরের তালিমে কয়েকদিনের মধ্যে দানা পিস্তল চালানো, ছিপ আর জাল নিয়ে মাছ ধরা আর সাঁতরে নদী পার হওয়া রপ্ত করে নেয়। নিত্যদিন ওর কাজ, সকালে নদীতে নেমে সাঁতার কেটে স্নান সেরে বাড়ি ফেরা, তারপরে খেয়ে দেয়ে মাছ ধরা, তারপরে এক ঘুম লাগানো, বিকেলে সবাই মিলে বসে জমিয়ে আড্ডা। কেউ দানাকে ওর প্রেমিকার বিষয়ে চেপে ধরলে দানা চেষ্টা করে এড়িয়ে যেতে, নিতান্ত যদি বলতেই হয় তখন ময়নার ঘটনা বলে। কি ভাবে পাশের গুমটির বিষ্টুর বউয়ের সাথে সহবাস করেছিল আর একদিন ময়না ফুরুত করে উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুখ ফুটে কারুর কাছে ওর ভালোবাসা, ইন্দ্রাণীর কথা বলতে পারে না। ইন্দ্রাণীর কাছে যে ও পাপী। রোজ রাতে ফাঁক পেলেই মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর হাসি হাসি চেহারা দেখে আর ভাবে কি করছে ইন্দ্রাণী, ওর কথা কি মনে করে? নিশ্চয় নয়, অথবা হয়ত হ্যাঁ। খুব ইচ্ছে করে একবার গোল বাগান যেতে, কিন্তু কি মুখ নিয়ে যাবে, আর যদি কোনভাবে নাস্রিন অথবা কঙ্কনার চোখে পরে যায় তাহলে ওরা ইন্দ্রাণীকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে বাঁধবে না। ইন্দ্রাণী সত্যি ওকে ভালবেসেছিল।
মহেন্দ্র বাবু কোনোদিন কোন গল্প ফেঁদে বসেন, দুর কোন প্রদেশের জঙ্গলে হাতির পিঠে চড়ে বাঘ, গন্ডার দেখেছিলেন তার গল্প, ভিন্ন প্রদেশের এক জঙ্গলে সিংহ দেখেছিলেন সেই গল্প। দানা ভাবে এদের কি কোন কাজ নেই। বলাই জানায় সময় হলেই কাজের জন্য ওকে নিয়ে বের হবে। ধিরে ধিরে সবার সাথে ভালো বন্ধুত্ত হয়ে যায়। দানা ওদের মধ্যে সব থেকে বেশি শিক্ষিত, বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে আবার ইংরেজি পড়তে পারে আর বলতেও পারে ভালো করে। ওর খাতির একটু বেড়ে যায় সবার চোখে, যতই হোক বিদ্যের দাম আলাদা। শঙ্কর আর রামিজের বিশ্বাসের লোক হয়ে উঠতে সময় লাগে না ওর। এই কয়দিনে ফারহান অবশ্য ওর সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখে। প্রায় দিনেই ফোনে ওকে আশ্বাস দেয়, সময় হলে আর ওর মতন কাজ পেলে ওকে এইখান থেকে নিয়ে যাবে। এই কয়দিনে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকা ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতেও পারেনি, সব সময়ে ওর পাশে বলাই না হয় শক্তি না হয় নাসির কেউ না কেউ থাকত।
ফারহানের বিষয়ে একদিন নাসিরের কাছ থেকে জানতে পারে, ফারহানের বাড়ি এই হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায়, বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর বৌদি নাফিসা ছাড়া আর কেউ নেই। ফারহান আগে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতেন পরে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে বাপ্পা নস্করের ড্রাইভারির কাজ করতে শুরু করে।
একদিন সকালে মহেন্দ্র বাবু ওদের সবাইকে ডেকে বলেন সমুদ্র পথে “ব্লু কুইন” নামক জাহাজে ওদের জন্য চোরাই করা সোনা আসছে। ওই সোনা এই দেশের জলে সীমানায় ঢোকার আগেই মাঝ সমুদ্র থেকে নৌকা করে নিয়ে আসতে হবে। সাগর পাড়ি দেবে দানা, জিজ্ঞাসু চোখে বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলাই ওকে বুঝিয়ে দেয় যে এইবারে আসল কাজে নামবে। প্রায় দিন দশেকের মতন নৌকায় থাকতে হবে, নৌকা বেয়ে মাঝ সমুদ্রে ওরা মাছ ধরার আছিলায় যাবে আর ওই জাহাজে ওদের লোক ঠিক করা আছে যারা ওদের দেখে সোনা ভরা বাক্স সমুদ্রের জলে ফেলে দেবে। সেই সোনা ভরা বাক্স নৌকার নিচে বেঁধে, মাছ ভর্তি নৌকা নিয়ে আবার এইখানে ফিরে আসতে হবে।
ঠিক সেই সময়ে এক গুরু গম্ভির কণ্ঠ স্বর শোনা যায়, “ছেড়ে দে অনেক হয়েছে। শালা আট জনের মধ্যে চারজনকে একাই শুইয়ে দিল। তোদের কতবার বলি রোজ সাঁতার কাট কিন্তু তোরা শুনবি না।”
সবাই ওকে ছেড়ে দিতেই দানা উঠে দাঁড়ায়। মহেন্দ্র বাবু, সৌম্য কান্তি ব্যাক্তি, দেখলেই বোঝা যায় যে ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। পরনে সাদা ধুতি, একটা সাদা গেঞ্জি, কপালে বড় লাল তিলক। ডান হাতের ওপরে বেশ পুরানো গভীর ক্ষত দাগ, দেখেই মনে হয় আইন বিরোধী কর্মের ফল। ফারহান আর শঙ্কর ওর দিকে এগিয়ে আসে, একজন একটা চেয়ার নিয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে। ফারহান ওর দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে ক্ষমা চেয়ে বলে, এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতে হলে একটা পরীক্ষা দিতে হয়, মনে হয় দানা পাশ করে যাবে এই পরীক্ষায়। সাদা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়েন ভদ্রলোক।
ফারহান ওই ভদ্রলোকের সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, “এই হচ্ছেন আমাদের বড়দা।” ফিসফিস করে বলে, “পেন্নাম ঠোক রে।” ফারহানের সাথে সাথে দানাও সেই ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে।
মহেন্দ্র বাবু দানাকে আপাদ মস্তক জরিপ করে জিজ্ঞেস করে, “কি করিস তুই?”
দানা নাকের রক্ত হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে উত্তর দেয়, “আগে ট্যাক্সি চালাতাম কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না তাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম।”
মহেন্দ্র বাবু ওর কথা শুনে হেসে ফেলে, “মিথ্যে কথা বলছিস আর সেটাও ভালো ভাবে বলতে জানিস না তুই। নিশ্চয় প্রেমে ধাক্কা খেয়েছিস তাই মহানগর ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।” মহেন্দ্র বাবুর কথা শুনে বাকি সবাই হেসে দেয়ে। মহেন্দ্র বাবু শঙ্করের দিকে তাকিয়ে বলে, “কি রে এর নাক থেকে রক্ত পড়ছে একটু কিছু দে?”
সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন একটা কাপড় আর একটা ওষুধ দেয় ওর হাতে। দানা তাকিয়ে দেখে যার ঊরুসন্ধি লক্ষ্য করে মাথা দিয়ে মেরেছিল সেই ব্যাক্তি ওর হাতে কাপড় আর ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে। মহেন্দ্র বাবু সেই ব্যাক্তির সাথে দানার পরিচয় করিয়ে দেয়, রামিজ আন্সারি। ফারহান একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, শক্তি, মনা, কালী, বলাই, আক্রাম, নাসির, সোহেল, পিন্টু, নাড়ু আরো অনেকের সাথে, দানাও সবার সাথে হাত মিলিয়ে সন্ধি পাতিয়ে নেয়। সবাই মহেন্দ্র বাবুর সাথেই থাকে। এই বাড়িতে শঙ্কর আর রামিজ নিজেদের পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকে আর মহেন্দ্র বাবু তাঁর ছেলেদের নিয়ে একতলায় থাকেন।
একজন মহিলা এক থালা খাবার দাবার এনে ছেলেদের হাতে দিয়ে চলে যায়। সবার সাথে খাবার খেতে খেতে দানা এদিক ওদিকে চেয়ে দেখে। বাড়িটা বেশ বড় সর, সব মিলিয়ে মনে হল দশ বারোটা ঘর হবে। অনেকের কোমরে পিস্তল গোঁজা দেখে দানা একটু চমকে যায়। ফারহান জানিয়ে দেয় চমকানোর কিছু নেই, ওই পিস্তল কোনদিন দুর্বল মানুষের ওপরে চালানো হয় না।
মহেন্দ্র বাবু ওর মারামারি করা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর নাম কি?”
দানা উত্তর দেয়, “আমার নাম দানা।”
মহেন্দ্র বাবু হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এটা কি ভালো নাম না ডাক নাম?”
দানা মাথা চুলকায়, কারুর ভালো নাম কি কখন দানা হতে পারে নাকি? তারপরে উত্তর দেয়, “না মানে এটা ডাক নাম, একটা ভালো নাম আছে বিশ্বজিৎ তবে ওই নামে আমাকে কেউ ডাকে না।”
মহেন্দ্র বাবু হেসে ফেলেন, “তোর এই দানা নামের একটা অর্থ আছে সেটা জানিস কি? হিব্রু ভাষায় দানা মানে বিদ্বান। কত পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিস তুই?”
দানা মাথা নাড়িয়ে জানায় এতদিন ওর ডাকনামের অর্থ জানত না তারপরে উত্তর দেয়, “বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম তারপরে মা মারা যাওয়াতে আর পড়াশুনা করে ওঠা হয়নি।”
মহেন্দ্র বাবু দানাকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তোর এই বিস্বজিতের মানে কি সেটা জানিস?”
দানা কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলে, “হ্যাঁ জানি, যে বিশ্ব জয় করে তার নাম বিশ্বজিৎ।” তারপরে হেসে দুই আঙ্গুল দিয়ে বন্দুক ইশারা করে বলে, “এই দিয়ে এখন বিশ্ব জয় করা যায়।”
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, “অরে মূর্খ, ওই পিস্তল বন্দুক দিয়ে যদি সত্যি সত্যি বিশ্ব জয় করা যেত তাহলে সারা বিশ্বে মারামারি কাটাকাটি লেগে যেত, জলের পরিবর্তে রক্তের নদী বইত। বিশ্ব জয় করতে গেলে মানুষের মন জয় করতে হয়। স্বদেশে পুজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে।”
দানা মাথা চুলকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বড়দা এটা কোন ভাষা? কিছু বুঝলাম না যে?”
মহেন্দ্র বাবু ওকে হেসে বলে, “এটা সংস্কৃত ভাষা। আমি যা বললাম তার মানে, যে বিদ্বান, যে অন্য মানুষের দুঃখ বোঝে সেই বিশ্ব জয় করে, নিজের দেশে শুধু মাত্র রাজার পুজো করা হয় কিন্তু ভালো মানুষের পুজো সব জায়গাতেই হয়। বিদ্বান মানে শুধু বই পুঁথি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘিলুর শ্রাদ্ধ করলাম সেটা নয় রে দানা। একজন মহান সন্ন্যাসী বলে গেছেন, এজুকেশান ইজ দা মানিফেস্টেসান অফ দা পারফেক্সান আল্রেডি উইদিন ম্যান। এর মানেও নিশ্চয় কিছু বুঝিস নি তাই না?” দানার মাথা এই কথা কিছুই ঢোকে না তাই মাথা নাড়িয়ে জানায় যে কিছুই ঢোকেনি। মহেন্দ্র বাবু ওকে পাশে বসিয়ে বলেন, “একজন মানুষের শিক্ষা দীক্ষার পরিপূর্ণতা সবসময়ে সেই মানুষের হৃদয়ে অভ্যন্তরে থাকে, সেইখান থেকেই আসে শিক্ষার আসল অর্থ।”
দানা মহেন্দ্র বাবুকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা বড়দা আপনি এত তত্ত কথা জানলেন কি করে?”
মহেন্দ্র বাবু ওকে বলে, “আমি প্রায় সব ধর্ম গ্রন্থ পড়েছি এই শিক্ষার খোঁজে। অবাক হচ্ছিস না আমাকে দেখে?” দানার সাথে সাথে বাকি ছেলেরা অবাক হয়ে মহেন্দ্র বাবুর দিকে তাকায়। মহেন্দ্র বাবু হেসে ওদের বলে, “তোদের মানুষ করব বলে এইখানে এসেছি, বুঝেছিস। আমি অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম সেই এক বানী, মানুষকে ভালবাসতে শিখতে হয়।” বলেই হেসে ফেলেন, “যা এবারে ওঠ, অনেক হল আজকে। তারপরে বলবি বুড়ো ভাম বসিয়ে বসিয়ে জ্ঞান দিয়ে গেল।”
ফারহান প্রশ্ন করে, “তাহলে বড়দা এই কাজে কেন নেমেছেন?”
মহেন্দ্র বাবু ওর মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি দুষ্টের নিধন করি তাই বন্দুক তুলে নিয়েছি হাতে। এদেশের যে রাজা সেই চোর তাই বন্দুক হাতে তুলে নিতে হয়েছে। আমি ডাকাতি করি, সোনা চোরাই করি, বিদেশী মাল চোরাই করি এমন কি খুন পর্যন্ত করেছি। তবে টাকার জন্যে আমি কোনোদিন কাউকে খুন করিনি, ড্রাগসের ব্যাবসা কোনোদিন করিনি। আমার হৃদয় যাদের বলেছিল যে এই মানুষকে খুন করে দাও, নর নারী নির্বিশেষে তাদের খুন করেছি। পুরুষ হোক কি মহিলা, যদি তোর হৃদয় বলে যে এই মানুষ সমাজের জন্য পূতিময় রোগ তাহলে তাকে সরিয়ে দিতে পিছপা হবি না কখন। কোনোদিন কোন অবলা নারীর গায়ে হাত তুলিনি, কোন নারীর শ্লীলতা হনন করিনি, কোন দরিদ্র মানুষের রুটি কেড়ে খাইনি। তোদের কেও সেই এক কথা বলি।”
বেশ কিছুক্ষণ ওইখানে বসে থাকার পরে ফারহান ওকে জানায় ওকে ফিরে যেতে হবে। দানা ব্যাগ উঠিয়ে নিতেই ফারহান বলে এইখানে থাকতে। ওকে জানায় যে শঙ্কর আর রামিজ মহেন্দ্র বাবুর দুই হাত। ওদের দুইজনের যেন কোনোদিন বিরাগ ভাজন না হয়। তারপরে কানেকানে জানায় ওর মতন কাজ না পাওয়া পর্যন্ত এই মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করুক, ভালো কারুর গাড়ি চালাবার চাকরি পেলে দানাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। কেষ্টর পরে ফারহানকে দেখে দানার মনে হয় সত্যি এক বন্ধু পেয়েছে এই মহানগরের বুকে। ফারহান সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
শঙ্কর বাকি ছেলেদের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়। নিচের একটা বড় ঘরে আরো তিনজনের সাথে ওর থাকার ব্যাবস্থা। ওই ঘরে চারখানা খাট পাতা, বলাই, নাসির আর শক্তি যারা বয়সে একটু ছোট তারা এই ঘরে থাকে। বাকিদের জন্য পাশের অন্য ঘর। রাতে ওই উঠানে লম্বা সার বেঁধে খাওয়া দাওয়ার পাত পরে। শঙ্করের স্ত্রী, মহিমা আর রামিজের স্ত্রী আবিদার ওপরে রান্না করার ভার, দুই নারীকে দেখে মনে হয় দুই বোন। রাতের বেলায় বাকিদের সাথে মদ খেতে খেতে আরো জানতে পারে যে, শঙ্কর আর রামিজের ছেলে মেয়েরা দূরে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। সব খরচ এই বড়দা দেন। এই এলাকার অনেক ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ মহেন্দ্র বাবু বহন করেন।
পরের দিন সকাল থেকেই দানার অনুশীলন শুরু হয়ে যায়, ভোরবেলা সূর্য উঁকি মারার সময় থেকেই সবাই উঠে পরে। সকাল সকাল নদীর তীরে গিয়ে সাঁতার কাটতে হয়, সাঁতরে নদী পেরিয়ে ওইপাশে যেতে হবে। বাপরে এই গঙ্গা পার হওয়া, বিশাল ব্যাপার। দানা ছোট বেলায় কালী পাড়ার বস্তির পেছনের দিকের পুকুরে সাঁতার শিখেছিল কিন্তু এযে বিশাল চওড়া নদী। প্রথম দিনে বেশি দুর যেতে পারল না, বাকিরা পারাপার করে দিল এক বারেই। এই নদী পারাপার করা যেন ওদের কাছে ছেলে খেলা। দুপুরের পরে বলাই, নাসিরের সাথে মাছ ধরার প্রশিক্ষণ চলে। বলাইকে জিজ্ঞেস করলে জানায় যে এই বিদ্যে একদিন ওর কাজে লাগবে। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা ধৈর্যের পরীক্ষা করায়, ছিপ ধরে বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা, ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকো একভাবে কখন মাছে চারা খাবে, ফাতনায় টান ধরলেই ঢিল দিয়ে আগে মাছ খেলাও তারপরে টেনে উঠাও। তারপরে বিকেলে আবার পিস্তল বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ। কোনটা সাইলেন্সার, কোনটা ট্রিগার, কোনটা সেফটি ক্লাচ, কি ভাবে রিভলভারে গুলি ভরতে হয়, কি ভাবে পিস্তলে ম্যাগাজিন ভরতে হয় ইত্যাদি, কোন গুলি কত বোরের, কোন গুলিতে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবি, পিস্তল রিভলভার খুলে কি ভাবে পরিস্কার করে আবার জোড়া লাগাতে হয় ইত্যাদি।
শক্তি বলাই নাসিরের তালিমে কয়েকদিনের মধ্যে দানা পিস্তল চালানো, ছিপ আর জাল নিয়ে মাছ ধরা আর সাঁতরে নদী পার হওয়া রপ্ত করে নেয়। নিত্যদিন ওর কাজ, সকালে নদীতে নেমে সাঁতার কেটে স্নান সেরে বাড়ি ফেরা, তারপরে খেয়ে দেয়ে মাছ ধরা, তারপরে এক ঘুম লাগানো, বিকেলে সবাই মিলে বসে জমিয়ে আড্ডা। কেউ দানাকে ওর প্রেমিকার বিষয়ে চেপে ধরলে দানা চেষ্টা করে এড়িয়ে যেতে, নিতান্ত যদি বলতেই হয় তখন ময়নার ঘটনা বলে। কি ভাবে পাশের গুমটির বিষ্টুর বউয়ের সাথে সহবাস করেছিল আর একদিন ময়না ফুরুত করে উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মুখ ফুটে কারুর কাছে ওর ভালোবাসা, ইন্দ্রাণীর কথা বলতে পারে না। ইন্দ্রাণীর কাছে যে ও পাপী। রোজ রাতে ফাঁক পেলেই মোবাইল খুলে ইন্দ্রাণীর হাসি হাসি চেহারা দেখে আর ভাবে কি করছে ইন্দ্রাণী, ওর কথা কি মনে করে? নিশ্চয় নয়, অথবা হয়ত হ্যাঁ। খুব ইচ্ছে করে একবার গোল বাগান যেতে, কিন্তু কি মুখ নিয়ে যাবে, আর যদি কোনভাবে নাস্রিন অথবা কঙ্কনার চোখে পরে যায় তাহলে ওরা ইন্দ্রাণীকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে বাঁধবে না। ইন্দ্রাণী সত্যি ওকে ভালবেসেছিল।
মহেন্দ্র বাবু কোনোদিন কোন গল্প ফেঁদে বসেন, দুর কোন প্রদেশের জঙ্গলে হাতির পিঠে চড়ে বাঘ, গন্ডার দেখেছিলেন তার গল্প, ভিন্ন প্রদেশের এক জঙ্গলে সিংহ দেখেছিলেন সেই গল্প। দানা ভাবে এদের কি কোন কাজ নেই। বলাই জানায় সময় হলেই কাজের জন্য ওকে নিয়ে বের হবে। ধিরে ধিরে সবার সাথে ভালো বন্ধুত্ত হয়ে যায়। দানা ওদের মধ্যে সব থেকে বেশি শিক্ষিত, বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে আবার ইংরেজি পড়তে পারে আর বলতেও পারে ভালো করে। ওর খাতির একটু বেড়ে যায় সবার চোখে, যতই হোক বিদ্যের দাম আলাদা। শঙ্কর আর রামিজের বিশ্বাসের লোক হয়ে উঠতে সময় লাগে না ওর। এই কয়দিনে ফারহান অবশ্য ওর সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখে। প্রায় দিনেই ফোনে ওকে আশ্বাস দেয়, সময় হলে আর ওর মতন কাজ পেলে ওকে এইখান থেকে নিয়ে যাবে। এই কয়দিনে হিঙ্গলগঞ্জ এলাকা ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতেও পারেনি, সব সময়ে ওর পাশে বলাই না হয় শক্তি না হয় নাসির কেউ না কেউ থাকত।
ফারহানের বিষয়ে একদিন নাসিরের কাছ থেকে জানতে পারে, ফারহানের বাড়ি এই হিঙ্গল গঞ্জ এলাকায়, বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর বৌদি নাফিসা ছাড়া আর কেউ নেই। ফারহান আগে মহেন্দ্র বাবুর কাছে কাজ করতেন পরে এই কাজ ছেড়ে দিয়ে বাপ্পা নস্করের ড্রাইভারির কাজ করতে শুরু করে।
একদিন সকালে মহেন্দ্র বাবু ওদের সবাইকে ডেকে বলেন সমুদ্র পথে “ব্লু কুইন” নামক জাহাজে ওদের জন্য চোরাই করা সোনা আসছে। ওই সোনা এই দেশের জলে সীমানায় ঢোকার আগেই মাঝ সমুদ্র থেকে নৌকা করে নিয়ে আসতে হবে। সাগর পাড়ি দেবে দানা, জিজ্ঞাসু চোখে বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলাই ওকে বুঝিয়ে দেয় যে এইবারে আসল কাজে নামবে। প্রায় দিন দশেকের মতন নৌকায় থাকতে হবে, নৌকা বেয়ে মাঝ সমুদ্রে ওরা মাছ ধরার আছিলায় যাবে আর ওই জাহাজে ওদের লোক ঠিক করা আছে যারা ওদের দেখে সোনা ভরা বাক্স সমুদ্রের জলে ফেলে দেবে। সেই সোনা ভরা বাক্স নৌকার নিচে বেঁধে, মাছ ভর্তি নৌকা নিয়ে আবার এইখানে ফিরে আসতে হবে।