Thread Rating:
  • 32 Vote(s) - 3.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মহানগরের আলেয়া
#60
পর্ব ছয় – কাগজের সিঁড়ি (#11)



এই ঘটনার কয়েকদিন পরে এক দুপুরে দানার ফোন বেজে ওঠে। ফোন তুলে দেখে ইন্দ্রাণীর হাসি হাসি চেহারা, একচোখ টিপে, ঠোঁট এক মিষ্টি হাসি দিয়ে ওকে ডাকছে। ওই চেহারা দেখে দানার বুক কেঁপে ওঠে, নাকের পাটা ফুলে ওঠে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। বুকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে, না পাখী না, আমাকে ফোন করোনা আর। আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য পাত্র নই আমি তোমার পাপী, পাখী। দানা ফোন উঠায় না, বারেবারে ফোন বেজে যায়। কি বলার জন্য ইন্দ্রাণী ফোন করেছে? কঙ্কনা আর নাস্রিন ওকে সব কিছু এতদিনে বলে দিয়েছে নিশ্চয়। ইন্দ্রাণীর সামনে গেলে ওকে ঘৃণার চোখে দেখবে আর ওকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেবে। হয়ত সেটাই বলার জন্য ফোন করেছে ইন্দ্রাণী, দানা তুমি একি করলে? হ্যাঁ, এটাই হওয়া উচিত দানার সাথে, দানা ভালোবাসার যোগ্য নয়, অন্তত ইন্দ্রাণীর মতন এক নিষ্পাপ নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যোগ্য পুরুষ দানা নয়।


কিছু পরে ইন্দ্রাণী ওর ফোনে সংবাদ পাঠায়, “প্লিস দানা একবার ফোন উঠাও। প্লিস দানা রাগ করে না।”

সেই সংবাদ পড়েই দানার বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসে, সত্যি এই নারী ওকে কত ভালোবাসে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রাণীর ফোন উঠায়।
ফোন উঠিয়েই ইন্দ্রাণী ক্ষমা চেয়ে মিঠে কণ্ঠে বলে, “কেমন আছো দানা? আমি জানি তুমি আমার ওপরে রাগ করে আছ। তুমি যেদিন ফোন করলে সেদিন আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম, বাড়ি ফিরে ফোন করতে একদম ভুলে গেছিলাম, ডারলিং। তাই বলে তুমি এত রাগ করে আমার ফোন উঠান বন্ধ করে দেবে?” 

দানা নির্বাক, কানের কাছে ফোন চেপে শুধু ওর কণ্ঠ স্বর শুনে যায়। ওই মিষ্টি কণ্ঠ স্বর সারা অঙ্গে মাখিয়ে নেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, পারলে এই ফোনের মধ্যে ঢুকে এক দৌড়ে ইন্দ্রাণীর কাছে চলে যায়। কোন উত্তর না পেয়ে ইন্দ্রাণী প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে দানা, আমার ওপরে এত রাগ করে থাকবে যে একটা কথাও বলবে না? আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে, তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি। শোন না, আমি আজ রাতে শহরে ফিরছি, প্লিস প্লিস প্লিস, আমাকে নিতে আসবে। আজ সারা রাত, কাল সারাদিন কাল সারা রাত শুধু তোমার সাথে কাটাব। এই দানা, কিছু বলছ না কেন? প্লিস কিছু বল।”

ভাঙ্গা পাঁজর বুকের সাথে শক্ত করে বেঁধে কম্পিত কণ্ঠে ইন্দ্রাণীকে বলে, “পাখী...”

কম্পিত কন্ঠের “পাখী” ডাক শুনেই ইন্দ্রাণী বুঝে যায় দানার কিছু একটা হয়েছে, তাই আঁতকে উঠে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে তোমার? সত্যি আমার মাথার দিব্যি, বল আমাকে কি হয়েছে তোমার?”

দানা কি বলবে ভেবে পায় না, ওর কথা শুনে মনে হল, কঙ্কনার সাথে এখন ইন্দ্রাণীর কোন কথাবার্তা হয়নি। একবার তাহলে লুকিয়ে ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করে সব জানিয়ে দিতে হবে, ওকে সাবধান করে দিতে হবে। কিন্তু দিনের আলোতে দেখা করা সম্ভব নয়, কঙ্কনা নাস্রিন নিশ্চয় ইন্দ্রাণীর ওপরে নজর রাখার জন্য লোক লাগিয়েছে। ওদের অনেক টাকা ওরা অনেক শক্তিশালী, এই মহানগরের অনেক প্রতিপত্তিশালী ব্যাক্তি ওদের চেনা। 

দানা চাপা কণ্ঠে বলে, “পাখী, আমি তোমার সাথে দেখা করতে পারছি না।”

ইন্দ্রাণী অভিমান করে বলে, “এত রাগ, যাও আর তোমার সাথে কথা বলব না কিন্তু।”

দানা সেটাই চায়, ইন্দ্রাণী, শুচিস্মিতা দেবাদিত্যের ভালর জন্য মনে প্রানে চায় যাতে ইন্দ্রাণী ওর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দানা নিচু কণ্ঠে বলে, “আমি শহরে নেই পাখী, আমি দুঃখিত তোমাকে আনতে যেতে পারছি না।”

কিছুতেই ওর কথা বিশ্বাস করতে পারে না ইন্দ্রাণী তাই ওকে বলে, “হতেই পারে না। আমি কিন্তু কিছু জানি না, আমি প্লেন থেকে নেমে তোমার জন্য অপেক্ষা করব, ব্যাস।” অভিমানিনী ফোন রেখে দেয়। 

কি করবে দানা, বিমান বন্দরে কি ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করতে যাবে। যদি সেখানে কঙ্কনার লোক থাকে আর ওকে দেখে ফেলে তাহলে মুশকিলে পরে যাবে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যের পরে বিমান বন্দরে পৌঁছে যায়। ভিড় থেকে অনেকদুরে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণীর অপেক্ষা করে। প্লেন থেকে নেমেই ইন্দ্রাণী ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছানর ব্যাপারে। দানা মিথ্যে কথা বলে, না শহর থেকে দূরে আছে বলে আসতে পারেনি। বিমান বন্দরের কাঁচের দরজা ঠেলে ইন্দ্রাণী বেড়িয়ে এসে এপাশ ওপাশ দেখে, ওর চোখ জোড়া বারেবারে এই ভিড়ের মধ্যে দানাকে খুঁজে বেড়ায় কিন্তু দানা অনেকদুর থেকে ইন্দ্রাণীকে দেখতে পেয়ে লুকিয়ে যায়। ইন্দ্রাণী ব্যাকুল হয়ে দানাকে খোঁজে ওই ভিড়ের মধ্যে, শেষে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি দিকে পথ ধরে। দানা অন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে ইন্দ্রাণীর ট্যাক্সি অনুসরন করে। ইন্দ্রাণীর বাড়ি আসার আগেই দানা ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ইন্দ্রাণীকে নিস্পলক নয়নে দেখে যায়। ধিরে ধিরে রাত বেড়ে ওঠে, দানা একটা চায়ের দোকানে বসে থাকে গভীর রাতের অপেক্ষায়। অন্ধকার রাতের সাহায্য নিয়ে ওর সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইতে চায়, না হলে ওর পাপের শরীর ওকে কোনোদিন শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না। 

রাত প্রায় বারোটা বাজে, রাস্তা ঘাট নির্জন হয়ে গেছে অনেক আগেই। গ্রীষ্ম কেটে আকাশে মাঝে মাঝেই কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যায় তবে সেইদিন আকাশে তারারা ওর দিকে তাকিয়ে ধিক্কার জানায়। এপাশ ওপাশ ভালো করে দেখে নেয় দানা, কেউ কোথা থেকে উঁকি মেরে ওকে অনুসরন করছে না তো? না কেউ কোথাও নেই, গোল বাগানের বড় বড় বাড়ির আলো একে এঁকে নিভতে শুরু করে কিন্তু তখন ইন্দ্রাণীর বসার ঘরে আলো জ্বলছে। কি করছে ইন্দ্রাণী এত রাত পর্যন্ত জেগে? এমন সময়ে ওর ফোন বেজে ওঠে, ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইন্দ্রাণী ওকে ফোন করেছে।

আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এই দানা কি করছ? সত্যি বল না, তুমি আমার ওপরে খুব রেগে আছো তাই না?”

কি উত্তর দেবে দানা, এহেন নিষ্পাপ ভালোবাসার উত্তর দেওয়ার মতন শক্তি ওর কাছে নেই। দানার গলা শুকিয়ে যায় ওর কণ্ঠ স্বর শুনে, কোনরকমে ওকে বলে, “পাখী তুমি একটু দরজা খুলতে পারো, মানে আমি...”

কথাটা শেষ করতে দেয় না, উচ্ছল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “সত্যি তুমি আসবে? কোথায় তুমি নিচে, দাঁড়িয়ে নাকি?”

দানা দেখে ইন্দ্রাণী বারান্দায় এসে এদিক ওদিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে দানাকে খুঁজছে, কিন্তু দানার সাহস হয়না ছায়া থেকে বেড়িয়ে এসে ইন্দ্রাণীর সামনে দাঁড়াতে। ইন্দ্রাণী ব্যাকুল হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই দানা, প্লিস সোনা আমার সাথে এই ভাবে মজা কোরো না। বল না কোথায় তুমি?”

দানা নিচু কণ্ঠে ওকে বলে, “তুমি ভেতরে যাও আমি একটু পরে আসছি।”

ইন্দ্রাণী কচি মেয়ের মতন আনন্দে লাফিয়ে উঠে উচ্ছল কণ্ঠে বলে, “তাড়াতাড়ি আসো।”

ইন্দ্রাণী ভেতরে ঢুকে যেতেই, দানা ত্রস্ত পায়ে ইন্দ্রাণীর ফ্লাটের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সিঁড়ি চড়ার সময়ে বুকের মাঝের কুণ্ঠাবোধ ওকে মাটির সাথে টেনে ধরে। শরীরের সব শক্তি একত্র করে সিঁড়ি চড়ে ইন্দ্রাণীর দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাহকার পরে কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে। বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দ্রাণী দরজা খুলে ওকে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে। 

কোনোকিছু বলার আগেই দানাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ওর বাহুপাশে সঁপে আদুরে কণ্ঠে বলে, “প্লিস দানা আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিস এইরকম ভাবে রাগতে নেই সোনা। এই দেখ আমি ফিরে এসেছি। একটু বুঝতে চেষ্টা কর দানা, আমি ছেলে মেয়ের সাথে ছিলাম...”

দানা চোখ বুজে দুই হাতে ইন্দ্রাণীকে আস্টেপিস্টে শেষ বারের মতন জড়িয়ে ওর মাথার মধ্যে ঠোঁট চেপে ধরে। মনে প্রানে জানে ওর কথা একবার শোনার পরে ইন্দ্রাণী ওকে তাড়িয়ে দেবে তাই আগেভাগে ইন্দ্রাণীর ভালোবাসার শেষ কণা টুকু নিজের দেহের সাথে মিলিয়ে নিতে আপ্রান চেষ্টা করে। ইন্দ্রাণীর কোমল দেহ পল্লব ওর বুকের ওপরে মিশে ওকে ভাসিয়ে দেয়। ইন্দ্রাণী বুঝতে পারে যে দানার বুকের মধ্যে কোন ঝঞ্ঝা ওকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে চলেছে। ইন্দ্রাণী ওর মুখ খানি আঁজলা করে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে দেখতে পায় যে দানার দুই চোখ ছলছল করছে। 

সেই চোখ দেখে ইন্দ্রাণী থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তোমার।” বলেই ওর হাত নিজের মাথার ওপরে চেপে ধরে বলে, “সত্যি বল না হলে আমার...” 

দানা ওর মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ভালোবাসার আগুনে ওর শরীর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। কম্পিত কণ্ঠে ইন্দ্রাণীকে বলে, “পাখী আমি পাপী, আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই।”

ইন্দ্রাণী চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে, বুক বেঁধে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কেন দানা, তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?” একটু থেমে ওর গালে হাত রেখে ম্লান হেসে বলে, “আমার পেছনে ঘুরঘুর না করে নিজের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া, এত ভালো কথা, দানা।”

দানার শরীর অবশ হয়ে আসে, হাঁটু ভেঙ্গে যায়, ইন্দ্রাণীর সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে পরে। কি ভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ভেবে পায় না। দানাকে নিজের সামনে ওই ভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে ইন্দ্রাণীর বুক কেঁপে ওঠে। 

ইন্দ্রাণী উৎকণ্ঠায় কাঁপতে কাঁপতে সোফার ওপরে বসে দানাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি করেছ? তুমি কাউকে খুন করেছ নাকি?”

দানা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “না, তার চেয়েও অনেক নিচ কাজ করেছি পাখী।”

ইন্দ্রাণী আঁতকে ওঠে, “কি করেছ দানা, সত্যি করে বল।”

দানা চোখ বুজে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজের পাপের কথা ব্যাক্ত করতে শুরু করে, “তুমি চলে যাবার পরে একদিন কঙ্কনা আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকেছিল। ও আমাকে তোমার বিরুদ্ধে অনেক কিছু উল্টোপাল্টা কথা শুনালো। আমি কিছুতেই ওর কথা বিশ্বাস করিনি প্রথমে, কিন্তু ও আমাকে আমার নাম, ধাম কোথায় থাকি কি করি ইত্যাদি বলার পরে বিশ্বাস করে নিলাম যে তুমি ওকে আমার নামে আমাদের এই সম্পর্কের ব্যাপারে সব কিছু বলে দিয়েছ। আমি তোমাকে ফোন করলাম কিন্তু তুমি ফোন উঠালে না। আমাকে কঙ্কনা বলল তুমি নাকি আমাকে নিজের শারীরিক চাহিদার জন্য ব্যাবহার করেছ। আমি রাগে দুঃখে ওদের কথা মেনে নিলাম। কঙ্কনা আর নাস্রিন আমাকে পুরুষ বেশ্যা বানিয়ে দিল।” 

ইন্দ্রাণীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় দানার মুখে ওই কাহিনী শুনে। ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় ইন্দ্রাণী, থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমার কথা একবারের জন্য তোমার মনে পড়ল না? আমার ওপরে এত অবিশ্বাস তোমার? ভালোবাসা এতই ঠুনকো ছিল, দানা? তোমাকে ওই কঙ্কনার সম্বন্ধে সব কিছু জানিয়েছিলাম, তাও তুমি ওর ছলনায় ভুলে গেলে? তারপরে আর কি করেছ ওর সাথে?”

দানা বলে চলে ওর পাপের কথা, একমাত্র এর কাছে এই পাপের ক্ষমা আছে, “আমাকে ক্ষমা করে দাও পাখী। আমি পাপী, তোমার ভালোবাসার যোগ্য নই পাখী। কঙ্কনা আর নাস্রিন আমাকে শাসিয়েছে যদি আমি তোমার সাথে সম্পর্ক করতে চেষ্টা করি তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবে। পাখী আমি পাপী পাখী, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

“পাখী” নাম শুনেই ইন্দ্রাণী চিৎকার করে ওঠে, “একদম ওই নাম তোমার মুখে আনবে না, দানা। তোমার পাখী মরে গেছে। ওই ধূর্ত নিচ কামুকী নারীর কথা মেনে তুমি আমার জীবন নরক বানিয়ে দিলে? কেন দানা, আমি তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম?” ইন্দ্রাণী কাঁদতে কাঁদতে সোফা ছেড়ে উঠে ভেতরের ঘরে চলে যায়। কিছু পরে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে, ওর দিকে ব্যাঙ্কের বই খাতা ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে, দানা। তুমি সত্যি নিচ মানুষ। না না, তুমি মানুষ নও দানা, তুমি কাম পিশাচ দানব। তোমার বুকে হৃদপিণ্ড বলে কিছু নেই। এইবারে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। তুমি আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিলে দানা। আমি ভেবেছিলাম এই রাতে বেরাতে বের হওয়া ছেড়ে দেব, বাড়িতে টিউশানি করব, ছেলে মেয়ে পড়াব। কিন্তু তুমি... আমার ভালোবাসার দাম দিলে না দানা।”


দানার দুই চোখের কোল বেয়ে অবিশ্রাম অশ্রু ধারা বয়ে চলে। ওর চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে মাথা উঠিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর মুখের ওপরে টাকার তোড়া ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “হ্যাঁ দানা, তুমি আমাকে অনেক শারীরিক সুখ দিয়েছ। তুমি টাকা চাও, তাই না? কত টাকা চাই তোমার, বল? এক লাখ, দুই লাখ, কত চাই? কাগজের সিঁড়ি বল পলকা। এই সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে গেলে একদিন না একদিন মানুষকে নিচে পড়তেই হয়।” দানা তাও ওর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। ইন্দ্রাণী ওকে ওই ভাবে বসে থাকতে দেখে বুক ভাঙ্গা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, “তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও দানা। কোনোদিন আমার সামনে আসবে না। আমি ভুলে যাবো কাউকে মন থেকে চেয়েছিলাম।” ইন্দ্রাণী কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

দানা কোনোদিন মাটিতে পরা চোখের জলের আওয়াজ শোনেনি কিন্তু সেদিন ইন্দ্রাণীর অঝোর ধারায় ঝরে যাওয়া অশ্রুর আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। ওই বন্ধ দরজার পেছনে ইন্দ্রাণীর অশ্রু অঝোর ধারায় মেঝতে গড়িয়ে পড়েছিল, দানার মনে হয়েছিল এক পাহাড়ি ঝর্না ওকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ বসার ঘরের মেঝের ওপরে স্থানুর মতন মাথা নিচু করে বসে থাকে। ওর ঋজু দেহ ইন্দ্রাণীর তীব্র ধিক্কারের ভারে নুইয়ে পরে। নিজের পাপের বোঝা ঘাড়ের ওপরে এত কঠিন চেপে থাকে যে ওঠার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। এটাই ওর পাপের শাস্তি, ইন্দ্রাণীর ভাঙ্গা বুক আর কোনোদিন জোড়া লাগাতে পারবে না। দানা মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ স্থানুবত বসে থাকার পরে ব্যাঙ্কের কাগজ পত্র নিজের কাগজ পত্র উঠিয়ে নেয়। ভগ্ন হৃদয় আর পাপের বোঝা ঘাড়ে করে এই কল্লোলিনী মহানগরের অন্ধকার পথ ধরে উন্মাদের মতন এলোমেলো হাঁটতে শুরু করে। 

এই বিশাল মহানগরের ঝকমকে আলেয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে এই ভাবে সবকিছু হারিয়ে যাবে, সেটা দানা আগে ভাবেনি। আলেয়া সব কিছু মিছে আলেয়া, ময়না আলেয়া, কঙ্কনা নাস্রিন আলেয়া, সিমোনে সাগরিকা নিলাঞ্জনা দীপা সবাই শুধু মাত্র নিজেদের একঘেয়ে জীবন থেকে উদ্ধার পেতে ওর সান্নিধ্য চেয়েছিল, কাজের পরে সবাই ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কেন কঙ্কনা আর নাস্রিন ওকে মারতে চেয়েছিল সেই উত্তর ওর জানা নেই। এই আলেয়ার মাঝে এক ক্ষীণ আলোর রেখা যাও দেখা দিয়েছিল, নিজের হাতে সেই প্রদিপ শিখা অনেক আগেই নিভিয়ে দিয়েছে। 
(পর্ব ছয় সমাপ্ত)
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মহানগরের আলেয়া - by Nilpori - 09-01-2019, 07:30 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)