08-01-2019, 02:52 PM
পর্ব চার – বলাকার ডানা মেলে (#6)
পার্টি খুব বড় একটা বাগান বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল। বাগান বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই উর্দি পরা একজন লোক এসে ওদের দরজা খুলে দিল। দানা এইসবে একদম অভস্ত্য নয়, একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকায়। ইন্দ্রাণী ওর হাত চেপে অভয় দিয়ে বলে সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু দানাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। দানা যেন এমন কিছু আচরন না করে যাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। আশেপাশে যা কিছু হচ্ছে, সেটা শুধু যেন চুপচাপ দেখে যায় আর বাকি সব যেন ইন্দ্রাণীর ওপরে ছেড়ে দেয়।
ইন্দ্রাণী ওকে পাখী পড়ার মতন শিখিয়ে দেয়, “শোনো দানা, মেয়েদের সাথে দেখা হলে, ওর ডান হাত আলতো করে নিজের হাতে নেবে আর নিজের ডান গাল দিয়ে আলতো করে ওর ডান গাল ছুঁইয়ে দেবে। ছেলেদের সাথে মেশার সময়ে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে একটা হ্যান্ডশেক করবে আর মনে থাকে যেন, তোমার হাত ওপরে দিকে রাখতে চেষ্টা করবে, এটা নিজের শক্তির পরিচয়। মেয়েদের সাথে কথা বলার সময়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, না হয় ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে, কখন বুকের দিকে তাকাবে না।”
দানা বাধ্য ছাত্রের মতন হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “যে আজ্ঞে মহারানী, আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”
মাথার ওপরে খোলা আকাশের সামিয়ানা, অজস্র তারা মিটিমিটি করে ঘন কালো আকাশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দুইজনে পাশাপাশি হেঁটে বাগান বাড়িতে ঢুকে পড়ে। চারপাশে ছোট ছোট আলোর সম্ভার, এক কোনায় নাচের জায়গা। সেখানে মানুষের ভিড় তখন জমে ওঠেনি। মৃদু কোন বাদ্য যন্ত্রের সঙ্গীত এক টানা বেজে চলেছে। ইতস্তত লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মশগুল। বেশ বড়সড় বাগানের একপাশে, লম্বা টেবিলে সাজানো খাবারের প্লেট আর ছোট ছোট উনুনে হাঁড়ির মতন কিছু চড়ানো। এক কোনায় মদের বার, সেইখানে ছেলেদের জটলা অন্যদিকের তুলনায় বেশি। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষ, কোথাও পুরুষের জটলা বেশি, কোথাও নারীর জটলা বেশি, কোথাও জোড়ায় জোড়ায় নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে সবার হাতেই মদের গ্লাস, দুই আঙ্গুলের মাঝে সিগারেট। অনেক মেয়েরাও সিগারেট টানছে, এই দৃশ্য বহুবার সিনেমা টিভিতে দেখেছে দানা কিন্তু নিজের চোখে দেখা এই প্রথম। মেয়েদের অনেকেই শাড়ি পড়ে এসেছে, বেশির ভাগ মেয়েদের শাড়ি অতি ফিনফিনে মাছের জালের মতন। বেশির ভাগ মেয়েদের পরনে হাতা বিহীন ব্লাউজ, অনেকে মনে হয় অন্তর্বাস পরেই চলে এসেছে, কারুর কারুর বুকের খাঁজের নিচের দিকে গিঁট বাঁধা যার ফলে সেই নারীর অর্ধেকের বেশি বক্ষ বিভাজন বেড়িয়ে এসেছে সামনের দিকে, অনেকের পিঠ সম্পূর্ণ খালি। অনেক মেয়েদের পরনে হাতা বিহীন কাঁধ বিহীন ছোট পার্টি পোশাক ঠিক পাছার নিচে এসে থেমে গেছে। পুরুষেরা এইসব কম পোশাক পরিহিত মেয়েদের আশেপাশে মাছির মতন ভনভন করছে।
ইন্দ্রাণীর পেছন পেছন ছোট ছোট পায়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়ায় আর এইসব দেখে। এই সব বিত্তশালী প্রতিপত্তি শালী লোকজনের মাঝে খুব বিবৃত বোধ করে। কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ঘামে পরনের গেঞ্জি ভিজে ত্বকের সাথে লেপটে যায়। একটা ওয়েটার এসে ওদের হাতে মদের গ্লাস ধরিয়ে দিল আর সেই সাথে অন্য এক ওয়েটাররে ট্রে থেকে মাংসের কাবাব উঠিয়ে নিল একটা প্লেটে। এই সমাগমে ইন্দ্রাণী বিশেষ কাউকে চেনে না, তবে অনেক পুরুষের চোখ ওর দিকে। এহেন সমাগমে পুরুষেরা আড়ালে আবডালে নারীর ছোঁয়া পেতে চায়, নারীরাও পিছিয়ে থাকে না। অনেক পুরুষ পাশের নারীর কোমরে হাত দিয়ে, কারুর খালি পিঠের ওপরে হাত দিয়ে, কেউ আবার পাশের নারীর পাছায় আলতো আদর করে দিচ্ছে। সিনেমা টিভিতে এইসব দেখেছে কিন্তু চাক্ষুষ এইসব কোনোদিন দেখেনি অথবা ভাবতে পারেনি যে কোনোদিন এমন একটা পার্টিতে আসতে পারবে। একটা গাছের আড়ালে এক পুরুষ তার নারী সঙ্গীর সাথে কাম লীলায় মত্ত। মেয়েটার স্কারটের নিচে পুরুষের হাত, সাদা রঙের প্যান্টি দেখা যায়। প্যান্টির ওপর দিয়েই মেয়েটার পাছা খামচে ধরে নিজের ঊরুসন্ধি ওই মেয়েটার ঊরুসন্ধির ওপরে ঘষে চলেছে। ঠোঁট ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বনে হারিয়ে গেছে দুইজনে। কোথাও হাসির ছলে এক নারী তার পুরুষসঙ্গীর লিঙ্গ প্যান্টের ওপর দিয়েই আলতো করে বুলিয়ে হয়ত দেখে নিচ্ছে রাতের সুখ কি রকম হবে।
দানাকে পাশে দেখে হয়ত অনেকেই ইন্দ্রাণীর দিকে এগিয়ে আসছে না। ইন্দ্রাণী মাঝে মাঝে দানার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বলে, “পাশেই থেকো না হলে কখন কোন কুকুর কেঁউকেঁউ করে পাশে চলে আসবে।” দানাও মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেলে ওর কথা শুনে। তাও মাঝে মাঝে এই মানুষের সমাগমে কিছু চেনা মানুষ বেড়িয়ে যায়। ইন্দ্রাণী ওদের দেখে শুধু মাত্র মাথা হেলিয়ে কুশল আদান প্রদান করে। কেউ কেউ দানার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ইন্দ্রাণী বলে, “মিস্টার বিশ্বজিৎ মন্ডল, আমার অনেক পুরনো বন্ধু।”
এমন সময়ে এক মহিলা হাসতে হাসতে হাতে ওদের দিকে এগিয়ে এলো। মহিলা সাধারন বাঙালি মহিলাদের মতন গোলগাল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের, গলায় কানে বেশ ভারী গয়না। পরনে বেশ দামী সালোয়ার কামিজ, গলা বেশ গভীর কাটা যার ফলে বক্ষ বিভাজনের অনেকটা অনাবৃত। দুই চোখের নিচে মোটা করে কাজল, কপাল জুড়ে একটা বিশাল হলদে টিপ। এইখানে মনে হয় সবাই শরীর ঢাকার চেয়ে শরীর দেখাতে এসেছে। ইন্দ্রাণী সঙ্গে সঙ্গে দানাকে ফিসফিস করে সেই মহিলার পরিচয় দিল, রমলা বিশ্বাস। রমলা ওকে দেখেই একদম হেসে গলে পড়ে দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।
ইন্দ্রাণীর হাত ধরে রমলা জিজ্ঞেস করে, “কি রে কি ব্যাপার, তুই একদম ঈদের চাঁদ হয়ে গেছিস? ছেলে মেয়ে কেমন আছে?” দানার দিকে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “হাই, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”
ইন্দ্রাণী ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আমার বন্ধু মিস্টার বিশ্বজিৎ মন্ডল, ভাবলাম তোর পার্টিতে নিয়ে আসি। তুই কেমন আছিস সেটা বল।” গলা নামিয়ে চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলত, হটাত এই পার্টির মানে কি?”
রমলা ওর কানে কানে আসল ঘটনা খুলে বলে, “এই তোকে বলছি, আসলে কি জানিস গত মাসে আমি একটা পত্রিকা বের করেছি আর তার সম্পাদক আমি তাই এই পার্টি। তবে এই পার্টির আয়োজন করার পেছনে আরও একটা কারন আছে। তুই, অভিনেত্রী নয়না বোস কে চিনিস ত?” ইন্দ্রাণী মাথা নাড়িয়ে জানায় যে চেনে। রমলা বলে, “এই পার্টি ওর কারনেও রাখা। কিছু পরে বাপ্পা নস্কর, দুলাল মিত্র, বিমান চন্দ এই সব রাজনৈতিক নেতারা আসবে।”
বাপ্পা নস্করের নাম শুনতেই দানা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন নিয়ে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকায়। বাপ্পা নস্কর আসা মানে ফারহান হয়ত সাথে আসবে। এই সমাগমে যদি ফারহান ওকে দেখে ফেলে তাহলে ওর আসল পরিচয় সবাই জেনে যাবে। আশঙ্কায় দানার বুক কেঁপে ওঠে, ইন্দ্রাণী চোখের ইশারায় ওকে স্বাভাবিক হয়ে থাকতে অনুরোধ করে।
ইন্দ্রাণী ভুরু কুঁচকে রমলাকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু বাপ্পা নস্কর, দুলাল মিত্র, বিমান চন্দ; এরা সবাই যে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, এরা একসঙ্গে কেন আসবে?”
রমলা চোখ টিপে ঠোঁট বাঁকিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আসলে কি জানিস নয়নার সাথে এদের কোন আলোচনা আছে। নয়না আসলে বাপ্পার কিপ মানে রক্ষিতা, বুঝতেই পারছিস সুন্দরী নায়িকার টানে রাজনেতা কেন মহর্ষি বাল্মীকিরও আসন টলেছিল। এই পার্টির আড়ালে ওদের দেখা সাক্ষাৎ হবে, এদের মধ্যে কিছু একটা বোঝাপড়া হবে। পার্টির আয়োজনে নয়নার অনুদান বেশি।”
ইন্দ্রাণী চোখ মেরে ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করে, “তোর সাথে নয়নার এত গলায় গলায় সম্পর্ক কি করে হল।”
রমলা ফিসফিস করে ইন্দ্রাণীর কানে কানে বলে, “এক বছর আগে আমার এক জুনিয়ার সাংবাদিক, সঙ্গীতা রায়, ওই মাঝেরহাটির জমি বন্টন কেনা বেচা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বাপ্পার বিরুদ্ধে বিশাল অঙ্কের টাকা নয়ছয় করার প্রমান পায়। সেই সময়ে সঙ্গীতা জেনে ফেলে নয়না আর বাপ্পার এই গোপন মেলামেশা। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেড়িয়ে যায়, প্রোমটারের কালো কারবারির পেছনের খবর আরো অনেক গোপন খবর আমাকে জানিয়েছিল। আমি দেখলাম যে এই ভাঙ্গিয়ে অনেক টাকা কামানো যাবে। আমি সেই খবর আর ছাপালাম না, আমি সব তথ্য প্রমান নিয়ে নয়নাকে দিলাম আর নয়না আমার পত্রিকার জন্য এক কোটি টাকা দিল। সেই থেকে আমাদের পরিচয় বেড়ে যায়।” তারপরে চুকচুক করে হেসে বলে, “বেচারি সঙ্গীতা, ওইরকম বোলতার চাকে কি ঢিল ছুঁড়তে আছে? নয়না আমাকে অনেক বার সাংবাদিকের নাম জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু সঙ্গীতার নাম আমি বলিনি, যতই হোক মেয়েটা খুব ভালো। যাই হোক ছাড় ওইসব কথা, বল তোর এত দেরি কেন হল?”
দানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুই নারীর গল্প শোনা ছাড়া কিছু করার থাকে না। নয়না আর বাকি রাজনৈতিক দলের নেতারা একটু গভীর রাতে আসবে। তাড়াতাড়ি এসে গেলে আবার ফটোগ্রাফাদের ভিড়, সাংবাদিকের ভিড় জমে যাবে, এমনিতেই এই সমাগমে কম সাংবাদিক, সম্পাদক আসেনি। দুই নারী গল্প করতে করতে একটু তফাতে চলে যায়। ইন্দ্রাণী ওর দিকে এক নিরুপায় হাসি দেয়, কিছু করার নেই।
দানা চুপচাপ মদের বারের পাশে বসে মদের গেলাসে চুমুক দেয় আর এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে। রাত বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নাচের জায়গায় আলো ধিরে ধিরে কমে আসে আর সেই সাথে আলোর চমকানি শুরু হয়ে যায়। জোড়ায় জোড়ায়, ধিরে ধিরে নারী পুরুষ এগিয়ে যায় নাচের জায়গায়। কেউ কেউ পাশে দাঁড়িয়ে পা নাচায়, এমন ভাব দেখায় যেন একটু বললেই নাচতে শুরু করবে। বেশ কয়েকটা কম বয়সী ছেলে মেয়ে উদ্দাম তালে একদিকে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। সেই দেখে কয়েকজন বয়স্ক নর নারী নেশার তালে জড়াজড়ি করে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। দানা এইরকম কোন বড়লোক পার্টিতে কোনোদিন যায়নি। ওর দৌড় ওই কালী পাড়ার বস্তির কারুর বিয়ে, ওইখানেও প্রচুর হইহুল্লড়, হাসা হাসি গায়ে ঢলাঢলি সব চলে, ওইখানেও মদ খেয়ে মাতলামো করে ছেলেরা, ওইখানেও খুব জোরে গান বাজে, লোকে নাচে। বিশেষ কিছু তফাৎ নেই ওই কালী পাড়ার বস্তির সমাগমে আর এই বড়লোক পার্টিতে, এইখানে কমদামী মদের জায়গায় দামী মদ, কমদামী খাবারের জায়গায় দামী সুস্বাদু খাবার, এইখানে মেয়েদের পরনে জামাকাপড় একটু কম, এই যা। রাতে হয়ত এর স্ত্রী ওর বাহুতে ধরা দেবে, অথবা ওর ছেলে কোন বড়লোক নারীকে কোলে তুলে বাড়ি যাবে।
দেখতে দেখতে রাত সাড়ে দশটা বেজে যায় আর কিছু পরেই নায়িকা নয়না বোসের আবির্ভাব হয়। পেছন পেছন মাছির মতন ক্যামেরা আর সাংবাদিকের ভিড়। লোকজন সব হুমড়ি খেয়ে পরে নায়িকার সাথে ফটো উঠানোর জন্য, অনেকে বিত্তশালী প্রতিপত্তি শালী ব্যাক্তি আবার নায়িকার কানে কানে কিছু বলে। নয়না ঢুকতেই ভিড়টা যেন বেড়ে ওঠে। ওর চোখ বারেবারে ইন্দ্রাণীকে এই জনসমুদ্র মাঝে খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায় না। দানার মন বিচলিত হয়ে ওঠে, ওকে ভুলে আবার কাউকে ধরে ফেলল না ত? না সেটা আজ রাতে অন্তত নয়।
পিঠের ওপরে চাঁটি খেয়ে সম্বিত ফেরে, পেছনে হাসিহাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী, “কি গো, ভয় পেয়ে গেছিলে নাকি যে তোমার পাখী পালিয়ে গেল?”
সেটা ঠিক, দানা ভয় পায়নি তবে বুক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছিল ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু ইন্দ্রাণীর বড় বড় কাজল কালো চোখের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দিয়ে বলল, “এবারে চল পাখী, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
ইন্দ্রাণী ওকে জিজ্ঞেস করে, “একটু দাঁড়াও একটু পরে যাচ্ছি।” মত্ত তালে নাচতে থাকা মানুষ, নায়িকা নয়নার পাশে মাছির মতন ভনভন করা লোকজন দেখে ওকে বলে, “দানা, এইসব খুব মেকি বলে মনে হচ্ছে তাই না?” দানা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
ইন্দ্রাণী, দানার বাজু শক্ত করে ধরে অন্যদিকে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে ওই কিলবিল করা মানুষ দেখে আর হাসে। ঠিক সেই সময়ে কঙ্কনা যেন মাটি ফুঁড়ে হাসতে হাসতে ওদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। ওর পেছনে আর একজন মহিলা, মনে হয় কঙ্কনার বান্ধবী।
কঙ্কনা মিচকি হেসে ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করে, “কি গো ইন্দ্রাণীদি, কখন এলে?”
ওর উত্তরে ইন্দ্রাণী বলে, “বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল এবারে ফিরবো।”
কঙ্কনা ঘড়ি দেখে বড় বড় চোখ করে বলে, “এই যাঃ ইন্দ্রাণীদি, সবে মাত্র এগারটা বাজে এখুনি কি যাবে? এই ত রাত শুরু হল গো।” দানার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি না হয় নাই বা নাচলে, মিস্টার বিস্বজিতের সাথে আমি নাচতেই পারি। তাই না মিস্টার বিশ্বজিৎ?” এইবলে দানার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “তোমার পার্স পরে গেছিল বিশ্বজিৎ।” বলে এক অধভুত হাসি দিয়ে ওর পার্স ওকে দেয়।
দানা আকাশ থেকে পড়ল, কখন ওর পকেট থেকে পার্স পরেছে সেটা টের পায়নি, পার্স নিয়ে ধন্যবাদ জানায়। কঙ্কনা পেছনের মহিলার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়, মিসেস নাস্রিন আখতার, ওর বান্ধবী। কঙ্কনা আর নাস্রিন দুইজনেই শাড়ি পরে এসেছে, সবার মতন বিশেষ রাখঢাক ছাড়া পোশাকের বাহার। কঙ্কনা দানার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ওকে নাচার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করে কিন্তু দানার মন বলে যে এই নারীর উদ্দেশ্য সুবিধের নয়।
ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে কঠোর এক হাসি ফুটে ওঠে, “নারে ভাই কঙ্কনা, আজকে নয়, এখন আমাদের ফিরতেই হবে। কাল খুব ভোরবেলা ও বেড়িয়ে যাবে রে। পরে একদিন সময় করে আমার বাড়িতে আসিস, অনেক গল্প করা যাবে।”
কঙ্কনা ওর হাত ছেড়ে চুকচুক করে বলে, “মিস্টার বিশ্বজিৎ, আমাদের দেখা একদিন হবেই হবে।”
পার্টি খুব বড় একটা বাগান বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল। বাগান বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই উর্দি পরা একজন লোক এসে ওদের দরজা খুলে দিল। দানা এইসবে একদম অভস্ত্য নয়, একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকায়। ইন্দ্রাণী ওর হাত চেপে অভয় দিয়ে বলে সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু দানাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে। দানা যেন এমন কিছু আচরন না করে যাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। আশেপাশে যা কিছু হচ্ছে, সেটা শুধু যেন চুপচাপ দেখে যায় আর বাকি সব যেন ইন্দ্রাণীর ওপরে ছেড়ে দেয়।
ইন্দ্রাণী ওকে পাখী পড়ার মতন শিখিয়ে দেয়, “শোনো দানা, মেয়েদের সাথে দেখা হলে, ওর ডান হাত আলতো করে নিজের হাতে নেবে আর নিজের ডান গাল দিয়ে আলতো করে ওর ডান গাল ছুঁইয়ে দেবে। ছেলেদের সাথে মেশার সময়ে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে একটা হ্যান্ডশেক করবে আর মনে থাকে যেন, তোমার হাত ওপরে দিকে রাখতে চেষ্টা করবে, এটা নিজের শক্তির পরিচয়। মেয়েদের সাথে কথা বলার সময়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে, না হয় ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে, কখন বুকের দিকে তাকাবে না।”
দানা বাধ্য ছাত্রের মতন হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, “যে আজ্ঞে মহারানী, আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।”
মাথার ওপরে খোলা আকাশের সামিয়ানা, অজস্র তারা মিটিমিটি করে ঘন কালো আকাশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দুইজনে পাশাপাশি হেঁটে বাগান বাড়িতে ঢুকে পড়ে। চারপাশে ছোট ছোট আলোর সম্ভার, এক কোনায় নাচের জায়গা। সেখানে মানুষের ভিড় তখন জমে ওঠেনি। মৃদু কোন বাদ্য যন্ত্রের সঙ্গীত এক টানা বেজে চলেছে। ইতস্তত লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মশগুল। বেশ বড়সড় বাগানের একপাশে, লম্বা টেবিলে সাজানো খাবারের প্লেট আর ছোট ছোট উনুনে হাঁড়ির মতন কিছু চড়ানো। এক কোনায় মদের বার, সেইখানে ছেলেদের জটলা অন্যদিকের তুলনায় বেশি। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষ, কোথাও পুরুষের জটলা বেশি, কোথাও নারীর জটলা বেশি, কোথাও জোড়ায় জোড়ায় নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে সবার হাতেই মদের গ্লাস, দুই আঙ্গুলের মাঝে সিগারেট। অনেক মেয়েরাও সিগারেট টানছে, এই দৃশ্য বহুবার সিনেমা টিভিতে দেখেছে দানা কিন্তু নিজের চোখে দেখা এই প্রথম। মেয়েদের অনেকেই শাড়ি পড়ে এসেছে, বেশির ভাগ মেয়েদের শাড়ি অতি ফিনফিনে মাছের জালের মতন। বেশির ভাগ মেয়েদের পরনে হাতা বিহীন ব্লাউজ, অনেকে মনে হয় অন্তর্বাস পরেই চলে এসেছে, কারুর কারুর বুকের খাঁজের নিচের দিকে গিঁট বাঁধা যার ফলে সেই নারীর অর্ধেকের বেশি বক্ষ বিভাজন বেড়িয়ে এসেছে সামনের দিকে, অনেকের পিঠ সম্পূর্ণ খালি। অনেক মেয়েদের পরনে হাতা বিহীন কাঁধ বিহীন ছোট পার্টি পোশাক ঠিক পাছার নিচে এসে থেমে গেছে। পুরুষেরা এইসব কম পোশাক পরিহিত মেয়েদের আশেপাশে মাছির মতন ভনভন করছে।
ইন্দ্রাণীর পেছন পেছন ছোট ছোট পায়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়ায় আর এইসব দেখে। এই সব বিত্তশালী প্রতিপত্তি শালী লোকজনের মাঝে খুব বিবৃত বোধ করে। কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ঘামে পরনের গেঞ্জি ভিজে ত্বকের সাথে লেপটে যায়। একটা ওয়েটার এসে ওদের হাতে মদের গ্লাস ধরিয়ে দিল আর সেই সাথে অন্য এক ওয়েটাররে ট্রে থেকে মাংসের কাবাব উঠিয়ে নিল একটা প্লেটে। এই সমাগমে ইন্দ্রাণী বিশেষ কাউকে চেনে না, তবে অনেক পুরুষের চোখ ওর দিকে। এহেন সমাগমে পুরুষেরা আড়ালে আবডালে নারীর ছোঁয়া পেতে চায়, নারীরাও পিছিয়ে থাকে না। অনেক পুরুষ পাশের নারীর কোমরে হাত দিয়ে, কারুর খালি পিঠের ওপরে হাত দিয়ে, কেউ আবার পাশের নারীর পাছায় আলতো আদর করে দিচ্ছে। সিনেমা টিভিতে এইসব দেখেছে কিন্তু চাক্ষুষ এইসব কোনোদিন দেখেনি অথবা ভাবতে পারেনি যে কোনোদিন এমন একটা পার্টিতে আসতে পারবে। একটা গাছের আড়ালে এক পুরুষ তার নারী সঙ্গীর সাথে কাম লীলায় মত্ত। মেয়েটার স্কারটের নিচে পুরুষের হাত, সাদা রঙের প্যান্টি দেখা যায়। প্যান্টির ওপর দিয়েই মেয়েটার পাছা খামচে ধরে নিজের ঊরুসন্ধি ওই মেয়েটার ঊরুসন্ধির ওপরে ঘষে চলেছে। ঠোঁট ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বনে হারিয়ে গেছে দুইজনে। কোথাও হাসির ছলে এক নারী তার পুরুষসঙ্গীর লিঙ্গ প্যান্টের ওপর দিয়েই আলতো করে বুলিয়ে হয়ত দেখে নিচ্ছে রাতের সুখ কি রকম হবে।
দানাকে পাশে দেখে হয়ত অনেকেই ইন্দ্রাণীর দিকে এগিয়ে আসছে না। ইন্দ্রাণী মাঝে মাঝে দানার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বলে, “পাশেই থেকো না হলে কখন কোন কুকুর কেঁউকেঁউ করে পাশে চলে আসবে।” দানাও মাথা নাড়িয়ে হেসে ফেলে ওর কথা শুনে। তাও মাঝে মাঝে এই মানুষের সমাগমে কিছু চেনা মানুষ বেড়িয়ে যায়। ইন্দ্রাণী ওদের দেখে শুধু মাত্র মাথা হেলিয়ে কুশল আদান প্রদান করে। কেউ কেউ দানার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে ইন্দ্রাণী বলে, “মিস্টার বিশ্বজিৎ মন্ডল, আমার অনেক পুরনো বন্ধু।”
এমন সময়ে এক মহিলা হাসতে হাসতে হাতে ওদের দিকে এগিয়ে এলো। মহিলা সাধারন বাঙালি মহিলাদের মতন গোলগাল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের, গলায় কানে বেশ ভারী গয়না। পরনে বেশ দামী সালোয়ার কামিজ, গলা বেশ গভীর কাটা যার ফলে বক্ষ বিভাজনের অনেকটা অনাবৃত। দুই চোখের নিচে মোটা করে কাজল, কপাল জুড়ে একটা বিশাল হলদে টিপ। এইখানে মনে হয় সবাই শরীর ঢাকার চেয়ে শরীর দেখাতে এসেছে। ইন্দ্রাণী সঙ্গে সঙ্গে দানাকে ফিসফিস করে সেই মহিলার পরিচয় দিল, রমলা বিশ্বাস। রমলা ওকে দেখেই একদম হেসে গলে পড়ে দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।
ইন্দ্রাণীর হাত ধরে রমলা জিজ্ঞেস করে, “কি রে কি ব্যাপার, তুই একদম ঈদের চাঁদ হয়ে গেছিস? ছেলে মেয়ে কেমন আছে?” দানার দিকে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “হাই, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”
ইন্দ্রাণী ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আমার বন্ধু মিস্টার বিশ্বজিৎ মন্ডল, ভাবলাম তোর পার্টিতে নিয়ে আসি। তুই কেমন আছিস সেটা বল।” গলা নামিয়ে চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলত, হটাত এই পার্টির মানে কি?”
রমলা ওর কানে কানে আসল ঘটনা খুলে বলে, “এই তোকে বলছি, আসলে কি জানিস গত মাসে আমি একটা পত্রিকা বের করেছি আর তার সম্পাদক আমি তাই এই পার্টি। তবে এই পার্টির আয়োজন করার পেছনে আরও একটা কারন আছে। তুই, অভিনেত্রী নয়না বোস কে চিনিস ত?” ইন্দ্রাণী মাথা নাড়িয়ে জানায় যে চেনে। রমলা বলে, “এই পার্টি ওর কারনেও রাখা। কিছু পরে বাপ্পা নস্কর, দুলাল মিত্র, বিমান চন্দ এই সব রাজনৈতিক নেতারা আসবে।”
বাপ্পা নস্করের নাম শুনতেই দানা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন নিয়ে ইন্দ্রাণীর দিকে তাকায়। বাপ্পা নস্কর আসা মানে ফারহান হয়ত সাথে আসবে। এই সমাগমে যদি ফারহান ওকে দেখে ফেলে তাহলে ওর আসল পরিচয় সবাই জেনে যাবে। আশঙ্কায় দানার বুক কেঁপে ওঠে, ইন্দ্রাণী চোখের ইশারায় ওকে স্বাভাবিক হয়ে থাকতে অনুরোধ করে।
ইন্দ্রাণী ভুরু কুঁচকে রমলাকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু বাপ্পা নস্কর, দুলাল মিত্র, বিমান চন্দ; এরা সবাই যে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, এরা একসঙ্গে কেন আসবে?”
রমলা চোখ টিপে ঠোঁট বাঁকিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আসলে কি জানিস নয়নার সাথে এদের কোন আলোচনা আছে। নয়না আসলে বাপ্পার কিপ মানে রক্ষিতা, বুঝতেই পারছিস সুন্দরী নায়িকার টানে রাজনেতা কেন মহর্ষি বাল্মীকিরও আসন টলেছিল। এই পার্টির আড়ালে ওদের দেখা সাক্ষাৎ হবে, এদের মধ্যে কিছু একটা বোঝাপড়া হবে। পার্টির আয়োজনে নয়নার অনুদান বেশি।”
ইন্দ্রাণী চোখ মেরে ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করে, “তোর সাথে নয়নার এত গলায় গলায় সম্পর্ক কি করে হল।”
রমলা ফিসফিস করে ইন্দ্রাণীর কানে কানে বলে, “এক বছর আগে আমার এক জুনিয়ার সাংবাদিক, সঙ্গীতা রায়, ওই মাঝেরহাটির জমি বন্টন কেনা বেচা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বাপ্পার বিরুদ্ধে বিশাল অঙ্কের টাকা নয়ছয় করার প্রমান পায়। সেই সময়ে সঙ্গীতা জেনে ফেলে নয়না আর বাপ্পার এই গোপন মেলামেশা। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেড়িয়ে যায়, প্রোমটারের কালো কারবারির পেছনের খবর আরো অনেক গোপন খবর আমাকে জানিয়েছিল। আমি দেখলাম যে এই ভাঙ্গিয়ে অনেক টাকা কামানো যাবে। আমি সেই খবর আর ছাপালাম না, আমি সব তথ্য প্রমান নিয়ে নয়নাকে দিলাম আর নয়না আমার পত্রিকার জন্য এক কোটি টাকা দিল। সেই থেকে আমাদের পরিচয় বেড়ে যায়।” তারপরে চুকচুক করে হেসে বলে, “বেচারি সঙ্গীতা, ওইরকম বোলতার চাকে কি ঢিল ছুঁড়তে আছে? নয়না আমাকে অনেক বার সাংবাদিকের নাম জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু সঙ্গীতার নাম আমি বলিনি, যতই হোক মেয়েটা খুব ভালো। যাই হোক ছাড় ওইসব কথা, বল তোর এত দেরি কেন হল?”
দানা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুই নারীর গল্প শোনা ছাড়া কিছু করার থাকে না। নয়না আর বাকি রাজনৈতিক দলের নেতারা একটু গভীর রাতে আসবে। তাড়াতাড়ি এসে গেলে আবার ফটোগ্রাফাদের ভিড়, সাংবাদিকের ভিড় জমে যাবে, এমনিতেই এই সমাগমে কম সাংবাদিক, সম্পাদক আসেনি। দুই নারী গল্প করতে করতে একটু তফাতে চলে যায়। ইন্দ্রাণী ওর দিকে এক নিরুপায় হাসি দেয়, কিছু করার নেই।
দানা চুপচাপ মদের বারের পাশে বসে মদের গেলাসে চুমুক দেয় আর এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে। রাত বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নাচের জায়গায় আলো ধিরে ধিরে কমে আসে আর সেই সাথে আলোর চমকানি শুরু হয়ে যায়। জোড়ায় জোড়ায়, ধিরে ধিরে নারী পুরুষ এগিয়ে যায় নাচের জায়গায়। কেউ কেউ পাশে দাঁড়িয়ে পা নাচায়, এমন ভাব দেখায় যেন একটু বললেই নাচতে শুরু করবে। বেশ কয়েকটা কম বয়সী ছেলে মেয়ে উদ্দাম তালে একদিকে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। সেই দেখে কয়েকজন বয়স্ক নর নারী নেশার তালে জড়াজড়ি করে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। দানা এইরকম কোন বড়লোক পার্টিতে কোনোদিন যায়নি। ওর দৌড় ওই কালী পাড়ার বস্তির কারুর বিয়ে, ওইখানেও প্রচুর হইহুল্লড়, হাসা হাসি গায়ে ঢলাঢলি সব চলে, ওইখানেও মদ খেয়ে মাতলামো করে ছেলেরা, ওইখানেও খুব জোরে গান বাজে, লোকে নাচে। বিশেষ কিছু তফাৎ নেই ওই কালী পাড়ার বস্তির সমাগমে আর এই বড়লোক পার্টিতে, এইখানে কমদামী মদের জায়গায় দামী মদ, কমদামী খাবারের জায়গায় দামী সুস্বাদু খাবার, এইখানে মেয়েদের পরনে জামাকাপড় একটু কম, এই যা। রাতে হয়ত এর স্ত্রী ওর বাহুতে ধরা দেবে, অথবা ওর ছেলে কোন বড়লোক নারীকে কোলে তুলে বাড়ি যাবে।
দেখতে দেখতে রাত সাড়ে দশটা বেজে যায় আর কিছু পরেই নায়িকা নয়না বোসের আবির্ভাব হয়। পেছন পেছন মাছির মতন ক্যামেরা আর সাংবাদিকের ভিড়। লোকজন সব হুমড়ি খেয়ে পরে নায়িকার সাথে ফটো উঠানোর জন্য, অনেকে বিত্তশালী প্রতিপত্তি শালী ব্যাক্তি আবার নায়িকার কানে কানে কিছু বলে। নয়না ঢুকতেই ভিড়টা যেন বেড়ে ওঠে। ওর চোখ বারেবারে ইন্দ্রাণীকে এই জনসমুদ্র মাঝে খুঁজে বেড়ায় কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায় না। দানার মন বিচলিত হয়ে ওঠে, ওকে ভুলে আবার কাউকে ধরে ফেলল না ত? না সেটা আজ রাতে অন্তত নয়।
পিঠের ওপরে চাঁটি খেয়ে সম্বিত ফেরে, পেছনে হাসিহাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী, “কি গো, ভয় পেয়ে গেছিলে নাকি যে তোমার পাখী পালিয়ে গেল?”
সেটা ঠিক, দানা ভয় পায়নি তবে বুক কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেছিল ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু ইন্দ্রাণীর বড় বড় কাজল কালো চোখের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দিয়ে বলল, “এবারে চল পাখী, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
ইন্দ্রাণী ওকে জিজ্ঞেস করে, “একটু দাঁড়াও একটু পরে যাচ্ছি।” মত্ত তালে নাচতে থাকা মানুষ, নায়িকা নয়নার পাশে মাছির মতন ভনভন করা লোকজন দেখে ওকে বলে, “দানা, এইসব খুব মেকি বলে মনে হচ্ছে তাই না?” দানা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ।”
ইন্দ্রাণী, দানার বাজু শক্ত করে ধরে অন্যদিকে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে ওই কিলবিল করা মানুষ দেখে আর হাসে। ঠিক সেই সময়ে কঙ্কনা যেন মাটি ফুঁড়ে হাসতে হাসতে ওদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। ওর পেছনে আর একজন মহিলা, মনে হয় কঙ্কনার বান্ধবী।
কঙ্কনা মিচকি হেসে ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করে, “কি গো ইন্দ্রাণীদি, কখন এলে?”
ওর উত্তরে ইন্দ্রাণী বলে, “বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল এবারে ফিরবো।”
কঙ্কনা ঘড়ি দেখে বড় বড় চোখ করে বলে, “এই যাঃ ইন্দ্রাণীদি, সবে মাত্র এগারটা বাজে এখুনি কি যাবে? এই ত রাত শুরু হল গো।” দানার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি না হয় নাই বা নাচলে, মিস্টার বিস্বজিতের সাথে আমি নাচতেই পারি। তাই না মিস্টার বিশ্বজিৎ?” এইবলে দানার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “তোমার পার্স পরে গেছিল বিশ্বজিৎ।” বলে এক অধভুত হাসি দিয়ে ওর পার্স ওকে দেয়।
দানা আকাশ থেকে পড়ল, কখন ওর পকেট থেকে পার্স পরেছে সেটা টের পায়নি, পার্স নিয়ে ধন্যবাদ জানায়। কঙ্কনা পেছনের মহিলার সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেয়, মিসেস নাস্রিন আখতার, ওর বান্ধবী। কঙ্কনা আর নাস্রিন দুইজনেই শাড়ি পরে এসেছে, সবার মতন বিশেষ রাখঢাক ছাড়া পোশাকের বাহার। কঙ্কনা দানার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ওকে নাচার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করে কিন্তু দানার মন বলে যে এই নারীর উদ্দেশ্য সুবিধের নয়।
ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে কঠোর এক হাসি ফুটে ওঠে, “নারে ভাই কঙ্কনা, আজকে নয়, এখন আমাদের ফিরতেই হবে। কাল খুব ভোরবেলা ও বেড়িয়ে যাবে রে। পরে একদিন সময় করে আমার বাড়িতে আসিস, অনেক গল্প করা যাবে।”
কঙ্কনা ওর হাত ছেড়ে চুকচুক করে বলে, “মিস্টার বিশ্বজিৎ, আমাদের দেখা একদিন হবেই হবে।”