07-01-2019, 05:26 PM
৩২।।
‘এখন কি রকম আছিস পৃথা?’ অফিসে ঢোকার মুখেই অভিজিতদার সাথে দেখা... অভিজিত হালদার, ওদের ব্রাঞ্চএর হেড ক্যাশিয়র... প্রশ্ন শুনে হাসি মুখে তাকায় পৃথা... ‘ভালো আছি অভিজিতদা... ওই একটু ঠান্ডা লেগে জ্বর মত হয়েছিলো আর কি...’ বলতে বলতে এগিয়ে যায় বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেন্ডেন্সএর মেশিনটা দিকে।
আঙুল ছুইয়ে ঘুরে দাড়াতে অপর্নার সাথে মুখোমুখি... অপর্না, সুশান্তের সাথেই মার্কেটিং ডিপার্টেমেন্টএ রয়েছে, ওকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘এই সুশান্ত এসেছে রে অফিসে?’
‘হ্যা, এই খানিক আগেই দেখলাম তো সুশান্তকে... ওই দিকেই আছে বোধহয়... আরে জানিস, কে জানে কি করে ও মুখটুখ একেবারে ফাটিয়ে এসেছে... বেশ ফুলে আছে... তুই তো ছিলিস না কাল, থাকলে হয়তো জানতে পারতিস... তোর সাথে তো ভালো বন্ধুত্ব ওর...’ খবর দেয় অপর্না।
‘হ্যা... সেটাই... দেখি জিজ্ঞাসা করে... তুই জানতে চাস নি?’ তৈরী হয়ে নিতে চায় পৃথা, সুশান্তের মুখোমুখি হবার আগেই।
‘জিজ্ঞাসা করেছিলাম তো... বললো যে কোথায় পড়ে গিয়েছিল... কে জানে বাবা... দেখ অফিসের পর কার পেছনে লাগতে গিয়েছিল, দিয়েছে কেলিয়ে...’ বলেই শরীর দুলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, পরক্ষনের সাবধান হয়ে যায়, যতই হোক, অফিস তো... মুখ চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে নিজের কাজে চলে যায় অপর্না। ওর ‘কেলিয়ে দিয়েছে’ কথাটা শুনেই অর্নবের সাথে ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেন... তাড়াতাড়ি করে সামলে নেয় নিজেকে... এগিয়ে যায় নিজের টেবিলের দিকে।
টেবিলে দাঁড়িয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতে গিয়ে চোখে পড়ে দূরের কিউবিকিল্এর মধ্যে বসে সুশান্ত মাথা নিচু করে কিছু লিখছে... সম্ভবত কোন রিপোর্ট বা ওই ধরনের কিছু হবে... পৃথার খুব ইচ্ছা করে গিয়ে সুশান্তর সামনে দাঁড়ায়... প্রতিদিনকার মত হাই বলে আসে... কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে... মনে মনে ভাবে, ‘না... এখন নয়...’ কারণ সে জানে না তাকে দেখে সুশান্তর কি রিঅ্যাকশন হবে... তার থেকে আর একটু সময় নেওয়া উচিত বলে মনে করে পৃথা... চেয়ারে বসে জলের বোতল খুলে গলা ভেজায়।
‘এখন কেমন বোধ করছেন, মিস মুখার্জি?’ ঘাড়ের কাছে ম্যানেজারের গলার আওয়াজে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় পৃথা... ‘এই তো স্যর... এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো... সরি... কাল হটাৎ করে জ্বর এসে যাওয়াতে আসতে পারলাম না...’ সাওয়াল করে পৃথা স্বপক্ষে।
‘না, না, ইটস্ ওকে, শরীর খারাপ হলে আসবেন কি করে... আমি রতনের হাত দিয়ে কিছু ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি, কয়এক’টা ক্লায়েন্টের লোন অ্যাপ্রুভ করে দিয়েছি আমি, সে গুলো একটু দেখে নিয়ে প্রসেসএ ফেলে দিবেন...’ অবাঙালী ম্যানেজার সহায় পৃথাকে বলে আর দাঁড়ান না... এগিয়ে যান নিজের কেবিনের দিকে... সেই দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিয়ে হাঁফ ছাড়ে পৃথা... ‘যাক... ম্যানেজার খচে যায় নি তার এই রকম ভাবে হটাৎ কামাই করাতে...’ মনে মনে ভাবে সে।
প্রথম হাফটা কোথা দিয়ে উড়ে গেলো, সেটার আর খেয়াল থাকে না পৃথার... একটা পর একটা লোন এগ্রিমেন্ট চেক করে সেটাকে প্রসেসএ ফেলতেই কখন লাঞ্চএর সময় হয়ে গেছে জানতেই পারে নি সে... সম্বিত হয় কাকলির ডাকে... ‘কি রে পৃথা, লাঞ্চ করবি না? নাকি কাজ খাবি আজ?’
হেসে মুখ তুলে তাকায় সহকর্মীনির পানে... ‘না রে, এই তো... তুই কি লাঞ্চ এনেছিস?’
আরো বেশ কয়একজন জুটে যায় তাদের সাথে... এক সাথে বেরিয়ে যায় ব্রাঞ্চ থেকে যেখান থেকে ওরা সাধারণতঃ লাঞ্চ করে থাকে সেই দিকে... অন্য দিন ওদের সাথে সুশান্তও থাকে, কিন্তু আজ সে আর সঙ্গ নেই নি তাদের... দেখতো পায় নি সে... কখন কাজের অজুহাতে বেরিয়ে গিয়েছে অফিস থেকে কে জানে।
সুশান্তের সাথে অবশেষে দেখা হয় পৃথার একেবারে শেষ বেলায়, অফিস ছুটির সময় বেরিয়ে এসে... বিল্ডিংএর পোটিকোর থেকে তখন সবে গাড়িতে উঠতে যাবে, দেখে লিফটের থেকে সুশান্ত বেরিয়ে আসছে... মুখ নীচু করে ড্রাইভার ছেলেটিকে গাড়িটাকে একটু সাইড করে রাখতে বলে সে এগিয়ে যায় সুশান্তের দিকে... একেবারে সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় সে... ‘তুমি আজ সারাদিন আমাকে এ্যাভোয়েড করে চলছো কেন বলো তো?’ চোখে পড়ে বাঁ চোখের নীচে কালশিটের দাগটা... ঠোটের কোনাতেও খানিকটা কেটে গিয়েছে...
‘নাঃ... কোথায় এ্যাভোয়েড করলাম, কাজ ছিল তাই হয়তো কথা হয় নি... ক্লায়েন্ট ভিজিট ছিল, তাই বেরোতে হয়েছিল...’ না চাইলেও সুশান্তের চোখ ঘুরে যায় পৃথার বুকের ওপর দিয়ে... কামিজের আড়াল থেকে দুটো গোলাকৃত মুঠিভর স্তনের আভাস স্পষ্ট সেখানে... আর সেই সাথে দিব্বি ফুটে রয়েছে কাপড় ভেদ করে স্তনবৃন্তের ইষৎ আভাস... তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়... চোখের নীচের কালশিটের জায়গাটা কেমন টনটন করে ওঠে তার... তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যায় সে...
খপ করে হাত বাড়িয়ে সুশান্তের সার্টের স্লীভটা ধরে টান দেয় পৃথা... ‘এই ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছ যে?’ প্রায় জোর করেই সুশান্তকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়... ঘাড় তুলে তাকায় তার মুখের দিকে... ‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে...’
পৃথার ওই কটা চোখের মণির মধ্যে কেমন সন্মোহন আছে যেন... মুহুর্তের জন্য সুশান্ত কেমন বিহবল হয়ে পড়ে... বুকের মধ্যেটায় দুলে ওঠে তার... জোর করে নিজের চোখদুটোকে সরিয়ে নেয় পৃথার ওই রকম সন্মোহীনি চোখের নজর থেকে... মুখটাকে অন্য দিকে ফিরিয়ে বলে, ‘আমার সাথে আবার কি কথা... আমি তো...’
সুশান্তের কথা শেষ করতে দেয় না পৃথা... ওই ভাবেই তার সার্টের শ্লিভটা ধরে রাখে হাতে মুঠোয়... টান দিয়ে বলে, ‘এখানে, এই ভাবে পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে কথা হয় না, চলো, ওই দিকটায় যাই...’ বলে শার্টের শ্লিভ ছেড়ে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে গাড়ির দিকে।
দু-পা হেঁটেই ঘাড় ফেরায় সে... দেখে সুশান্ত তখনও সেই জায়গাতেই দাড়িয়ে রয়েছে... দেখে ফের তাড়া দেয়, ‘কোই... এসো... ওই দিকটায় যাবো...’ বলে ফিরে আবার হাঁটা লাগায় পৃথা।
অনিচ্ছা সত্তেও আর কথা বাড়ায় না সুশান্ত... ধীর পদক্ষেপে পা বাড়ায় পৃথাকে অনুসরণ করে... যেতে গিয়ে চোখ আটকে যায় সামনে হেঁটে চলা পৃথার দুলদলিয়মান পাছার দাবনা দুটোর ওপরে... বুকটা ধড়াস করে ওঠে তার... দেহের সাথে চেপে বসা গাঢ় রঙের কামিজটা যেন পৃথার পাছার দাবনাদুটোকে আরো বেশি করে প্রস্ফুটিত করে তুলেছে... তার প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে পাছার দাবনা দুটো গভীর এক বিভাজিকায় ভাগ হয়ে গিয়ে তলতলে নরম দুটো চর্বির তাল নিজস্ব ছন্দে ছলকে ছলকে উঠছে... কি অপূর্ব তাদের গঠন... সাদা লেগিংসে মোড়া দুটো পুরুষ্টু থাইয়ের সাথে একেবারে সামাঞ্জস্য ভাবে দুটো বর্তুল নিতম্ব... প্যাসেজ ওয়ের এলিডি আলো পড়ে লেগিংস কুর্তির ওপর দিয়েও সুস্পষ্ট প্যান্টি লাইনটা, ওই দুই নরম চর্বির পিন্ডের ওপরে যেন নক্সা কেটে সাজিয়ে তুলেছে।
পৃথা চলতে চলতেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয় সুশান্তকে... তার নজর যে কোন খানে সেটাও বুঝে যায় ওই এক লহমাতেই... মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে ফেলে সে... নাঃ মেন উইল বি অলওয়েজ মেন... মনে মনে ভাবে সে... তারপর খানিক ইচ্ছা করেই আরো একটু নিজের পাছাটা দুলিয়ে হাঁটতে থাকে... হাঁটার তালে তালে ঝটকা দেয় নিজের পাছার দাবনায়... মাথার মধ্যে দুষ্টুমীর পোকাটা কিলবিলিয়ে ওঠে যেন...
একেবারের গাড়ির সামনে এসে ঘুরে দাঁড়ায় পৃথা, ‘নাও... ওঠো... আমরা বরং একটা কফি শপে গিয়ে বসি... কি বলো? একটু নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে...’
‘উঠবো মানে? এ... এটা কার গাড়ি? তোমার?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘হুমমমম... বলতে পারো... আমি যখন তোমায় উঠতে বলছি... তখন ধরেই নাও না আমারই গাড়ি... নাও... ওঠো...’ বলে নিজে ঘুরে গাড়ির বাঁদিকের দরজা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়... ইসমাইল ছেলেটি দৌড়ে এগিয়ে এসে পৃথার দিকের দরজা খুলে ধরে... পৃথা ভেতরে ঢুকে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে ‘থ্যাঙ্কস্’ তারপর খেয়াল করে সুশান্ত তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে এদিকেই... গলা তুলে তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ‘কি হোলো, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, না কি উঠবে?’
সম্বিৎ ফেরে সুশান্তের, ধীর পায়ে এগিয়ে এসে গাড়ির ওপর দিকের দরজা খুলে উঠে বসে ভেতরে... ইসমাইল নিজের সিটে ফিরে গিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ম্যাডাম, কোথায় যাবেন? বাড়ি?’
‘না, এক্ষুনি বাড়ি যাবো না... তুমি বরং এই কাছেই একটা সিসিডি আছে, ওখানেই চলো আগে...’ বলতে বলতে ব্যাগ খুলে মোবাইলটা বের করে নেয় হাতে... ডায়াল প্যাডে নাম্বার টিপে কল লাগায়... অপেক্ষা কর খানিক, তারপর বলে ওঠে... ‘হ্যা... আমি বলছি... আমার ফিরতে একটু দেরী হবে... হ্যা হ্যা... গাড়ি আছে সঙ্গে... চিন্তা করো না... না, না... খুব দেরী হবে না... ওই একটু কাছেই একটা সিসিডি আছে, সেখানেই যাচ্ছি... ফেরার সময় তোমার কিছু আনতে হবে?... আচ্ছা... ঠিক আছে... বাই... রাখছি...’ বলে ফোনটা কেটে ফের নিজের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে সে।
পুরো ফোনালাপটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সুশান্ত... ফোনের ওপারের কথা শুনতে না পেলেও, স্বরের খানিকটা কানে এসে পৌছানোর ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ওপারের কন্ঠটি কোন পুরুষের... এবং যথেষ্টই ভরাট সে স্বর... মানে কোন পরিণত বয়সের পুরুষই হওয়া সম্ভব... পৃথার কথা শেষ হতে দেখে মুখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকায় সে... গাড়ি ততক্ষনে চলতে শুরু করে দিয়েছে... সন্ধ্যের অন্ধকার সরিয়ে রাস্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে আশপাশের দোকানের থেকে উপচে পড়া নানা রঙের বৈদ্যুতিক আলোয়...
গাড়ির এসির ঠান্ডা পরিবেশে বসে হাজারটা প্রশ্ন ভীড় করে আসে সুশান্তের মনের মধ্যে... কার গাড়ি?... কার সাথে কথা বললো পৃথা?... কথার ধরণ শুনে মনে হয় ফোনের ওই পারে যে রয়েছে, সে পৃথার খুবই কাছের... তবে কি?... কিন্তু?... পৃথাই বা কি বলতে চায় তাকে? গতকাল সন্ধ্যেবেলায় যে ঘটনা সে ঘটিয়েছে, তারপর সত্যিই বলতে মুখ নেই পৃথার সামনে দাঁড়াবার... পৃথা যদি নিজের থেকে এগিয়ে এসে ওর সাথে কথা বলতো, ওর সাহস হতো না আর কোনদিন পৃথার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবার... আবার অন্য দিকে দেখতে গেলে গতকাল ওর সাথেও যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার ব্যাখ্যাও কিছুতেই খুঁজে পায় নি সে, সারাটা রাত হাজার ভেবেও... কে তাকে আঘাত করল?... নাঃ... সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে... নিশব্দে মাথা নাড়ে সুশান্ত।
পৃথা কোন কথা বলে না... সেও উল্টোদিকের জানলার ভেতর দিয়ে বাইরের পানে চেয়ে থাকে চুপ করে... নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় কথা শুরুর আগে... সুশান্তকে সামনে দেখে দুম করে বলে ফেলেছে সে ঠিকই, যে সে ওর সাথে কথা বলতে চায়, কিন্ত আসলে কি বলবে সেটাই তো জানা নেই তার... তাই কি ভাবে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না... গতকাল সন্ধ্যেবেলায় যেটা ঘটেছে, তারপর অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো আর কোনদিন সুশান্তকে তার চোখে চোখ তুলে তাকানো দূর অস্ত, হয়তো তার পরিধীর মধ্যেই আসতে দিতো না কোনমতেই... কিন্তু সে সেই ধরণের মেয়ে নয়... আবেগপ্রবণতায় সে বাস্তব পরিস্থিতি ভোলে না, সে জানে, আজকে তার পাশে যতই অর্নব থাকুক না কেন, অর্নবের গন্ডীটা সীমিত... তার শারীরিক অক্ষমতায় হুট করে লোক সমাজে বেরিয়ে এসে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়, তাই সেখানে তার কর্মক্ষেত্রে একটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়ে থাকুক, সেটা সে কোন মতেই চায় না... বরং সুশান্তের সাথে ব্যাপারটাকে মিটিয়ে নিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে অটুট রাখতেই হবে...
‘ম্যাডাম... সিসিডি এসে গেছে...’ ইসমাইলের গলার স্বরে সম্বিৎ ফেরে পৃথার... ‘ও, ঠিক আছে, তুমি পার্কিং দেখে গাড়ি রাখো, আমরা একটু আসছি...’ বলে সুশান্তর দিকে ফেরে... ‘চলো... গিয়ে বসি একটু...’
‘হু... চলো...’ ছোট্ট উত্তর দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় সুশান্ত।
ইসমাইল তাড়াতাড়ি ঘুরে এসে পৃথার দিকের দরজা খুলে ধরে, পৃথা নেমে গেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফের ফিরে যায় নিজের সিটের দিকে... গাড়ি চালিয়ে চলে যায় পার্কিং লটের পানে, পৃথা আর সুশান্ত ঢোকে সিসিডির মধ্যে।
সামনের একটা ফাঁকা টেবিল দেখে দুজনে গিয়ে বসে, শপের ছেলেটি এগিয়ে এসে মেনু কার্ড বাড়িয়ে দেয়... পৃথা মেনু কার্ডটা সুশান্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘কি খাবে?’
‘যা হোক একটা কিছু বলে দাও না...’ দায়সারা উত্তর দেয় সুশান্ত... রুমাল দিয়ে নিজের চোখের নিচের কালশিটেটাকে আড়াল করে শপের ছেলেটির সামনে... এই ভাবে খুলে রাখতে অস্বস্থি হয় তার।
‘তাও... কিছু তো বলো...’ বলে নিজে ঝুঁকে পড়ে মেনু কার্ডের ওপরে... ভালো করে দেখে নিয়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে, ‘আই’ল টেক আ ট্রপিকাল আইসবার্গ...’
ছেলেটি শুনে ঘাড় হেলায়... তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুশান্তের দিকে তাকায় সে...
সুশান্ত একবার মেনু কার্ডের ওপরে চোখ রেখেই বলে ওঠে, ‘আই’ল হ্যাভ ওয়ান ক্যাপুচিনো... লার্জ...’
‘ওকে স্যর... এনিথিং এলস্ ইয়ু ওয়ান্ট টু অর্ডার?’ প্রশ্ন করে ছেলেটি...
মাথা নাড়ে দুজনেই এক সাথে প্রায়... ‘নো নো... দ্যটস্ অল...’
ছেলেটি চলে যেতে পৃথা চুপচাপ মেনু কার্ডের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে... সুশান্তও কোন কথা বলে না আগ বাড়িয়ে।
নাঃ... এই ভাবে চলবে না... একটা কিছু বলতেই হবে... শুরুটা আমাকেই করতে হবে বুঝতে পারছি... ভাবে পৃথা মনে মনে... তারপর মুখ তুলে তাকায় সুশান্তের দিকে... সবে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সুশান্তই কথা শুরু করে... ‘সরি... আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর ইয়েস্টার্ডেজস ইন্সিডেন্স...’ বলে চুপ করে।
পৃথা নিজের হাতটা তুলে আলতো করে টেবিলের ওপরে রাখা সুশান্তের হাতের ওপরে রাখে... রেখে মৃদু চাপ দেয় সেই হাতে... ‘ইটস্ ওকে... আই আন্ডার্স্ট্যান্ড... ওটা নিয়ে ভেবো না... ওটা আমিও জানি যে হটাৎ করেই আবেগের বশে ঘটে গিয়েছে... আই ক্যান ফিল ইট...’
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটনাটা পৃথা দেখবে, সেটা আশা করেনি সুশান্ত... ‘তুমি... তুমি আমাকে খুব খারাপ ভেবেছ... না?’
‘উ... হু... খারাপ?... হ্যা... অস্বীকার করবো না... কালকে তুমি চলে যাবার পর সত্যিই আমি ভিষন ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম... আসলে জানো সুশান্ত... এই শহরে আসার পর থেকে তোমাকে ভিষন ভাবে একজন ভালো বন্ধু বলে মেনে এসেছিলাম... তাই সেখানটায় আঘাত পড়তে, খারাপ তো লাগবেই? তাই না?’
‘এখন আর আমাকে বন্ধু ভাবতে পারছো না... তাই না?’ ধরা গলায় মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘ভাবছি সুশান্ত... তোমাকে এখনও আমার বন্ধুই ভাবছি... আর ভাবছি বলেই না তোমায় ধরে নিয়ে এলাম...’ সুশান্তের হাতের পীঠে নখ দিয়ে আকিবুকি কাটে পৃথা... ‘আসলে...’
‘আমি আর কক্ষনও এই ধরণের ব্যবহার করবো না কোনদিন... ঠিক...’ পৃথা কথা থামিয়ে বলে ওঠে সুশান্ত... ‘আমিও তোমাকে হারাতে চাই না... হারাতে চাই না তোমার বন্ধুত্ব...’
সুশান্তের হাতটাকে নিজের মুঠোয় ধরে চাপ দেয় পৃথা... ‘থ্যাঙ্কস্... আমিও তোমাকে চাই... বন্ধু হিসাবে... আমার পাশে...’
সুশান্তের বুক থেকে একটা যেন বিরাট বোঝা নেবে যায় পৃথার আশ্বাসে... মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোটের কোনে... ‘থাকবো পৃথা... তবে আজ থেকে আর তুমি নয়... তুই করে বলতে হবে দুজন দুজনকে... বন্ধুরা কি তুমি করে বলে?’
সুশান্তের কথায় পৃথাও এবার হেসে ফেলে... ‘বেশ তো... তাহলে তুই করে বললেই হয়... যাই বলো... তুইটা কিন্তু আরো আপন শোনায়... তাই না?’
‘আবার বলো?’ শুধরে দেয় সুশান্ত... তাতে দুজনেই হেসে ওঠে এক সাথে।
এর মাঝেই ওদের কফি সার্ভ করে দিয়ে যায় ছেলেটি... দুজনেই খানিক চুপ করে থাকে সেই সময়টায়... তারপর ছেলেটি চলে গেলে সুশান্ত বলে ওঠে, ‘আসলে কি হয়েছে জানিস তো...’ বলতে গিয়ে থমকায় সে।
পৃথা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
‘না... হটাৎ করে তুই করে বলছি তো... তাই কেমন খট করে লাগলো কানে...’ হেসে বলে সুশান্ত।
পৃথা হাসে, কিন্তু কিছু বলে না উত্তরে।
‘যাক... যেটা বলছিলাম... আসলে কি হয়েছে জানিস তো... এই বাংলা মিডিয়ামে পড়েই এই অবস্থাটা হয়েছে... আগে তো কখনও কোন মেয়ের এতটা সান্নিধ্যে আসিনি... তাই তোর এতটা খোলামেলা ব্যবহার দেখে গুলিয়ে ফেলেছিলাম, কোনটা প্রেম আর কোনটা বন্ধুত্ব... সরি রে... প্লিজ ক্ষমা করে দিস আমায়...’ বলে সুশান্ত... এবার নিসংকোচে পৃথার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে।
‘আর এতো বার সরি সরি বলতে হবে না... ছাড় তো...’ কাঁছ শ্রাগ করে বলে ওঠে পৃথা।
‘একটা প্রশ্ন করবো... যদি কিছু মনে না করিস...’ ইতস্থত করে সুশান্ত।
‘বন্ধুত্বের মধ্যে আবার কিন্তু কিন্তু হয় নাকি? বল না?’ সহজ গলায় জানতে চায় পৃথা।
‘তুই হটাৎ করে গাড়ি পেলি কোথা থেকে? মানে এটা কার গাড়ি?’ সসঙ্কোচে প্রশ্ন করে সুশান্ত।
ওর প্রশ্নের ধরনে ফিক করে হেসে ফেলে পৃথা, সে ইতিমধ্যেই অপেক্ষায় ছিল এই প্রশ্নটা আসবে জেনে... তাই শুনে মুখ তুলে তাকায় সুশান্তের দিকে, তারপর, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ওটা... ওটা আমার বরের গাড়ি...’
‘বরের...’ কথাটায় হোঁচট খায় যেন সুশান্ত... জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় পৃথার পানে।
‘হুম... বরের... ঠিকই শুনেছো... সরি শুনেছিস...’ নিজের ভুলেই হেসে ফেলে পৃথা।
কিন্তু পৃথার ভুলের ধার দিয়ে যায় না সুশান্ত... ‘কিন্তু...’ ফের প্রশ্ন করে সে।
‘আর কোন কিন্তু নয়... ছাড় এসব কথা... এখন বল তুই কি বাড়ি ফিরবি?’ কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘হ্যা, বাড়িই ফিরবো... তবে... তার মানে তুই যে বলেছিলিস যে তুই কমিটেড...’ ফের প্রশ্ন করে সুশান্ত... ব্যাপারটা কিছুতেই ওর মাথা থেকে যায় না... মনের মধ্যে আরো অনেক ধরনের প্রশ্ন ভীড় করে থাকে।
নিজের গ্লাসের শেষ আইসক্রীমটুকু খেয়ে চেয়ারের ব্যাকরেস্টএ গা এলিয়ে দেয় পৃথা... ‘হু... ঠিকই শুনেছিস... আমি যার সাথে কমিটেড... তারই গাড়ি এটা... আর সেই আমার বর... আমি তো তোকে আগেই তাই বলে রেখেছিলাম... তুই’ই তো বিশ্বাস করতে চাইছিলিস না...’
‘ওহ!...’ বলে একটু থামে সুশান্ত... তারপর সসঙ্কোচে প্রশ্ন করে, ‘তুই তোর ফ্ল্যাটে কি সেফ? না, মানে বলছিলাম যে...’ কথা বলতে বলতে নিজের ডান হাতটা টেবিলের ওপর থেকে উঠে এসে ছোয় চোখের নীচে পড়া কালশিটেটায়... ব্যথাটা এখনও রয়েছে ওখানটায়... হয়তো সময়ের সাথে দাগ মুছে যাবে ঠিকই... কিন্তু বুকের মধ্যের দাগটা? সেটা কি কখনও মুছবে? সম্পর্কের ডাকটা তুমি থেকে তুইতে বদলে গেলেও... আর কালকের ঘটনাটা? সেটারই বা কি ব্যাখ্যা? কে ছিল ওখানে? পৃথাকি জানে সেটা? নাকি জানে না? সব গুলিয়ে যায় সুশান্তের মাথার মধ্যে... কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না সে হাজার ভেবেও... গতকাল থেকে ক্রমাগত সে ভেবেই চলেছে এটাকে নিয়ে, কিন্তু এখন অবধি তার কোন সদুত্তর সে বের করতে পারে নি...
সুশান্তের কথা শেষ করতে দেয় না পৃথা, ফ্ল্যাটের কথা উঠতেই তার মুখের রঙ কেমন যেন বদলে যায়... সেখানে যেন হাজারটা রামধনূ খেলা করতে শুরু করে... উজ্জল হয়ে ওঠে পুরো মুখটা... হাসি মুখে বলে সে... ‘দুশো শতাংশ সেফ... তুই এ নিয়ে কিছু ভাবিস না...’ বলেই তাকায় সুশান্তের কাপের দিকে, ততক্ষনে কথায় কথায় সুশান্তেরও কফি খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই ঝট করে উঠে দাঁড়ায় পৃথা... আর বেশি ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে ময়না তদন্ত করতে দেওয়া উচিত হবে মনে মনে করে না সে... ব্যাগ খুলে টাকা বের করে টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে বলে, ‘নে... আর বসে থাকতে হবে না, এবার চল, যাওয়া যাক... আমাকেও ফিরতে হবে...’ ইচ্ছা করেই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চায় সে... নতুন করে আর অপ্রস্তুত হতে রাজি নয় পৃথা।
পৃথাকে টাকা দিতে দেখে হাঁ হাঁ করে ওঠে সে, ‘আরে তুই পেমেন্ট করছিস কেন?’
‘তো? আমি তোকে ডেকে এনেছি, তুই নস... তাই আমি পেমেন্ট করবো, যেদিন তুই আমাকে নিয়ে আসবি সেদিন তুই দিবি... সিম্পল্...’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে পৃথা।
আর কথা বাড়ায় না সুশান্ত... এতদিনে বুঝে গিয়েছে, এই মেয়ের সাথে তার পেরে ওঠা সাধ্য নয়... তাই হাল ছেড়ে দেয়... ওরা দুজনেই বেরিয়ে আসে সিসিডি থেকে... পৃথা এদিক ওদিক মুখ তুলতেই রাস্তার উল্টো দিক থেকে ইসমাইল চেঁচিয়ে বলে, ‘এই যে ম্যাডাম, এখানে, আপনি দাঁড়ান, আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আসছি...’
পৃথা, সুশান্তের সাথে ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়... সুশান্ত বলে, ‘আমি বরং এখান থেকে চলে যাবো, তোকে আর আমার সাথে যেতে হবে না, তোর রাস্তাটা তো একেবারে উল্টোদিকে... তুই বরং চলে যা...’
‘ঠিক... আমার পথ তোর উল্টো দিকেই বটে’, অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে পৃথা... যাতে সুশান্তর কানে না পৌছায়, সেই ভাবে...
গাড়িটা ঘুরিয়ে ওর কাছে আসতে সুশান্তই এগিয়ে গিয়ে পৃথার জন্য দরজাটা খুলে ধরে... পৃথা গাড়ির মধ্যে উঠে বসলে, দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে জানলা কাছে মুখটা এনে নীচু স্বরে বলে সে, ‘একটা অনুরোধ করবো... রাখবি?’
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় পৃথা সুশান্তের দিকে...
একটু ইতস্থত করে কথাটা বলার আগে, তারপর গলা নামিয়ে বলে সে, ‘মৌসুমীকে গতকালকের ব্যাপারে কিছু বলিস না...’
তাড়াতাড়ি হাত তুলে সুশান্তের হাতটা ধরে নেয় পৃথা... ‘ছি ছি... তুই ভাবলি কি করে যে এসব আমি মৌসুমীকে বলবো... ডোন্ট ওয়োরি... কেউই জানবে না... আই প্রমিস...’
ম্লান হাসে সুশান্ত... ‘থ্যাঙ্কস্’... বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়... ইসমাইল হুস করে গাড়ি চালিয়ে ওর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়... যতক্ষন গাড়িটা দেখা যায়, সেই দিকেই চুপ করে তাকিয়ে থাকে সে, মনের মধ্যে লক্ষ প্রশ্ন নিয়ে।
ক্রমশ...
‘এখন কি রকম আছিস পৃথা?’ অফিসে ঢোকার মুখেই অভিজিতদার সাথে দেখা... অভিজিত হালদার, ওদের ব্রাঞ্চএর হেড ক্যাশিয়র... প্রশ্ন শুনে হাসি মুখে তাকায় পৃথা... ‘ভালো আছি অভিজিতদা... ওই একটু ঠান্ডা লেগে জ্বর মত হয়েছিলো আর কি...’ বলতে বলতে এগিয়ে যায় বায়োম্যাট্রিক অ্যাটেন্ডেন্সএর মেশিনটা দিকে।
আঙুল ছুইয়ে ঘুরে দাড়াতে অপর্নার সাথে মুখোমুখি... অপর্না, সুশান্তের সাথেই মার্কেটিং ডিপার্টেমেন্টএ রয়েছে, ওকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘এই সুশান্ত এসেছে রে অফিসে?’
‘হ্যা, এই খানিক আগেই দেখলাম তো সুশান্তকে... ওই দিকেই আছে বোধহয়... আরে জানিস, কে জানে কি করে ও মুখটুখ একেবারে ফাটিয়ে এসেছে... বেশ ফুলে আছে... তুই তো ছিলিস না কাল, থাকলে হয়তো জানতে পারতিস... তোর সাথে তো ভালো বন্ধুত্ব ওর...’ খবর দেয় অপর্না।
‘হ্যা... সেটাই... দেখি জিজ্ঞাসা করে... তুই জানতে চাস নি?’ তৈরী হয়ে নিতে চায় পৃথা, সুশান্তের মুখোমুখি হবার আগেই।
‘জিজ্ঞাসা করেছিলাম তো... বললো যে কোথায় পড়ে গিয়েছিল... কে জানে বাবা... দেখ অফিসের পর কার পেছনে লাগতে গিয়েছিল, দিয়েছে কেলিয়ে...’ বলেই শরীর দুলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, পরক্ষনের সাবধান হয়ে যায়, যতই হোক, অফিস তো... মুখ চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে নিজের কাজে চলে যায় অপর্না। ওর ‘কেলিয়ে দিয়েছে’ কথাটা শুনেই অর্নবের সাথে ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেন... তাড়াতাড়ি করে সামলে নেয় নিজেকে... এগিয়ে যায় নিজের টেবিলের দিকে।
টেবিলে দাঁড়িয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামাতে গিয়ে চোখে পড়ে দূরের কিউবিকিল্এর মধ্যে বসে সুশান্ত মাথা নিচু করে কিছু লিখছে... সম্ভবত কোন রিপোর্ট বা ওই ধরনের কিছু হবে... পৃথার খুব ইচ্ছা করে গিয়ে সুশান্তর সামনে দাঁড়ায়... প্রতিদিনকার মত হাই বলে আসে... কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে... মনে মনে ভাবে, ‘না... এখন নয়...’ কারণ সে জানে না তাকে দেখে সুশান্তর কি রিঅ্যাকশন হবে... তার থেকে আর একটু সময় নেওয়া উচিত বলে মনে করে পৃথা... চেয়ারে বসে জলের বোতল খুলে গলা ভেজায়।
‘এখন কেমন বোধ করছেন, মিস মুখার্জি?’ ঘাড়ের কাছে ম্যানেজারের গলার আওয়াজে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় পৃথা... ‘এই তো স্যর... এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো... সরি... কাল হটাৎ করে জ্বর এসে যাওয়াতে আসতে পারলাম না...’ সাওয়াল করে পৃথা স্বপক্ষে।
‘না, না, ইটস্ ওকে, শরীর খারাপ হলে আসবেন কি করে... আমি রতনের হাত দিয়ে কিছু ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি, কয়এক’টা ক্লায়েন্টের লোন অ্যাপ্রুভ করে দিয়েছি আমি, সে গুলো একটু দেখে নিয়ে প্রসেসএ ফেলে দিবেন...’ অবাঙালী ম্যানেজার সহায় পৃথাকে বলে আর দাঁড়ান না... এগিয়ে যান নিজের কেবিনের দিকে... সেই দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিয়ে হাঁফ ছাড়ে পৃথা... ‘যাক... ম্যানেজার খচে যায় নি তার এই রকম ভাবে হটাৎ কামাই করাতে...’ মনে মনে ভাবে সে।
প্রথম হাফটা কোথা দিয়ে উড়ে গেলো, সেটার আর খেয়াল থাকে না পৃথার... একটা পর একটা লোন এগ্রিমেন্ট চেক করে সেটাকে প্রসেসএ ফেলতেই কখন লাঞ্চএর সময় হয়ে গেছে জানতেই পারে নি সে... সম্বিত হয় কাকলির ডাকে... ‘কি রে পৃথা, লাঞ্চ করবি না? নাকি কাজ খাবি আজ?’
হেসে মুখ তুলে তাকায় সহকর্মীনির পানে... ‘না রে, এই তো... তুই কি লাঞ্চ এনেছিস?’
আরো বেশ কয়একজন জুটে যায় তাদের সাথে... এক সাথে বেরিয়ে যায় ব্রাঞ্চ থেকে যেখান থেকে ওরা সাধারণতঃ লাঞ্চ করে থাকে সেই দিকে... অন্য দিন ওদের সাথে সুশান্তও থাকে, কিন্তু আজ সে আর সঙ্গ নেই নি তাদের... দেখতো পায় নি সে... কখন কাজের অজুহাতে বেরিয়ে গিয়েছে অফিস থেকে কে জানে।
সুশান্তের সাথে অবশেষে দেখা হয় পৃথার একেবারে শেষ বেলায়, অফিস ছুটির সময় বেরিয়ে এসে... বিল্ডিংএর পোটিকোর থেকে তখন সবে গাড়িতে উঠতে যাবে, দেখে লিফটের থেকে সুশান্ত বেরিয়ে আসছে... মুখ নীচু করে ড্রাইভার ছেলেটিকে গাড়িটাকে একটু সাইড করে রাখতে বলে সে এগিয়ে যায় সুশান্তের দিকে... একেবারে সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায় সে... ‘তুমি আজ সারাদিন আমাকে এ্যাভোয়েড করে চলছো কেন বলো তো?’ চোখে পড়ে বাঁ চোখের নীচে কালশিটের দাগটা... ঠোটের কোনাতেও খানিকটা কেটে গিয়েছে...
‘নাঃ... কোথায় এ্যাভোয়েড করলাম, কাজ ছিল তাই হয়তো কথা হয় নি... ক্লায়েন্ট ভিজিট ছিল, তাই বেরোতে হয়েছিল...’ না চাইলেও সুশান্তের চোখ ঘুরে যায় পৃথার বুকের ওপর দিয়ে... কামিজের আড়াল থেকে দুটো গোলাকৃত মুঠিভর স্তনের আভাস স্পষ্ট সেখানে... আর সেই সাথে দিব্বি ফুটে রয়েছে কাপড় ভেদ করে স্তনবৃন্তের ইষৎ আভাস... তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়... চোখের নীচের কালশিটের জায়গাটা কেমন টনটন করে ওঠে তার... তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যায় সে...
খপ করে হাত বাড়িয়ে সুশান্তের সার্টের স্লীভটা ধরে টান দেয় পৃথা... ‘এই ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছ যে?’ প্রায় জোর করেই সুশান্তকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়... ঘাড় তুলে তাকায় তার মুখের দিকে... ‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে...’
পৃথার ওই কটা চোখের মণির মধ্যে কেমন সন্মোহন আছে যেন... মুহুর্তের জন্য সুশান্ত কেমন বিহবল হয়ে পড়ে... বুকের মধ্যেটায় দুলে ওঠে তার... জোর করে নিজের চোখদুটোকে সরিয়ে নেয় পৃথার ওই রকম সন্মোহীনি চোখের নজর থেকে... মুখটাকে অন্য দিকে ফিরিয়ে বলে, ‘আমার সাথে আবার কি কথা... আমি তো...’
সুশান্তের কথা শেষ করতে দেয় না পৃথা... ওই ভাবেই তার সার্টের শ্লিভটা ধরে রাখে হাতে মুঠোয়... টান দিয়ে বলে, ‘এখানে, এই ভাবে পোর্টিকোয় দাঁড়িয়ে কথা হয় না, চলো, ওই দিকটায় যাই...’ বলে শার্টের শ্লিভ ছেড়ে ঘুরে হাঁটতে শুরু করে গাড়ির দিকে।
দু-পা হেঁটেই ঘাড় ফেরায় সে... দেখে সুশান্ত তখনও সেই জায়গাতেই দাড়িয়ে রয়েছে... দেখে ফের তাড়া দেয়, ‘কোই... এসো... ওই দিকটায় যাবো...’ বলে ফিরে আবার হাঁটা লাগায় পৃথা।
অনিচ্ছা সত্তেও আর কথা বাড়ায় না সুশান্ত... ধীর পদক্ষেপে পা বাড়ায় পৃথাকে অনুসরণ করে... যেতে গিয়ে চোখ আটকে যায় সামনে হেঁটে চলা পৃথার দুলদলিয়মান পাছার দাবনা দুটোর ওপরে... বুকটা ধড়াস করে ওঠে তার... দেহের সাথে চেপে বসা গাঢ় রঙের কামিজটা যেন পৃথার পাছার দাবনাদুটোকে আরো বেশি করে প্রস্ফুটিত করে তুলেছে... তার প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে পাছার দাবনা দুটো গভীর এক বিভাজিকায় ভাগ হয়ে গিয়ে তলতলে নরম দুটো চর্বির তাল নিজস্ব ছন্দে ছলকে ছলকে উঠছে... কি অপূর্ব তাদের গঠন... সাদা লেগিংসে মোড়া দুটো পুরুষ্টু থাইয়ের সাথে একেবারে সামাঞ্জস্য ভাবে দুটো বর্তুল নিতম্ব... প্যাসেজ ওয়ের এলিডি আলো পড়ে লেগিংস কুর্তির ওপর দিয়েও সুস্পষ্ট প্যান্টি লাইনটা, ওই দুই নরম চর্বির পিন্ডের ওপরে যেন নক্সা কেটে সাজিয়ে তুলেছে।
পৃথা চলতে চলতেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয় সুশান্তকে... তার নজর যে কোন খানে সেটাও বুঝে যায় ওই এক লহমাতেই... মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে ফেলে সে... নাঃ মেন উইল বি অলওয়েজ মেন... মনে মনে ভাবে সে... তারপর খানিক ইচ্ছা করেই আরো একটু নিজের পাছাটা দুলিয়ে হাঁটতে থাকে... হাঁটার তালে তালে ঝটকা দেয় নিজের পাছার দাবনায়... মাথার মধ্যে দুষ্টুমীর পোকাটা কিলবিলিয়ে ওঠে যেন...
একেবারের গাড়ির সামনে এসে ঘুরে দাঁড়ায় পৃথা, ‘নাও... ওঠো... আমরা বরং একটা কফি শপে গিয়ে বসি... কি বলো? একটু নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে...’
‘উঠবো মানে? এ... এটা কার গাড়ি? তোমার?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘হুমমমম... বলতে পারো... আমি যখন তোমায় উঠতে বলছি... তখন ধরেই নাও না আমারই গাড়ি... নাও... ওঠো...’ বলে নিজে ঘুরে গাড়ির বাঁদিকের দরজা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়... ইসমাইল ছেলেটি দৌড়ে এগিয়ে এসে পৃথার দিকের দরজা খুলে ধরে... পৃথা ভেতরে ঢুকে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে ‘থ্যাঙ্কস্’ তারপর খেয়াল করে সুশান্ত তখনও অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে এদিকেই... গলা তুলে তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ‘কি হোলো, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, না কি উঠবে?’
সম্বিৎ ফেরে সুশান্তের, ধীর পায়ে এগিয়ে এসে গাড়ির ওপর দিকের দরজা খুলে উঠে বসে ভেতরে... ইসমাইল নিজের সিটে ফিরে গিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ম্যাডাম, কোথায় যাবেন? বাড়ি?’
‘না, এক্ষুনি বাড়ি যাবো না... তুমি বরং এই কাছেই একটা সিসিডি আছে, ওখানেই চলো আগে...’ বলতে বলতে ব্যাগ খুলে মোবাইলটা বের করে নেয় হাতে... ডায়াল প্যাডে নাম্বার টিপে কল লাগায়... অপেক্ষা কর খানিক, তারপর বলে ওঠে... ‘হ্যা... আমি বলছি... আমার ফিরতে একটু দেরী হবে... হ্যা হ্যা... গাড়ি আছে সঙ্গে... চিন্তা করো না... না, না... খুব দেরী হবে না... ওই একটু কাছেই একটা সিসিডি আছে, সেখানেই যাচ্ছি... ফেরার সময় তোমার কিছু আনতে হবে?... আচ্ছা... ঠিক আছে... বাই... রাখছি...’ বলে ফোনটা কেটে ফের নিজের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে সে।
পুরো ফোনালাপটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সুশান্ত... ফোনের ওপারের কথা শুনতে না পেলেও, স্বরের খানিকটা কানে এসে পৌছানোর ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ওপারের কন্ঠটি কোন পুরুষের... এবং যথেষ্টই ভরাট সে স্বর... মানে কোন পরিণত বয়সের পুরুষই হওয়া সম্ভব... পৃথার কথা শেষ হতে দেখে মুখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকায় সে... গাড়ি ততক্ষনে চলতে শুরু করে দিয়েছে... সন্ধ্যের অন্ধকার সরিয়ে রাস্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে আশপাশের দোকানের থেকে উপচে পড়া নানা রঙের বৈদ্যুতিক আলোয়...
গাড়ির এসির ঠান্ডা পরিবেশে বসে হাজারটা প্রশ্ন ভীড় করে আসে সুশান্তের মনের মধ্যে... কার গাড়ি?... কার সাথে কথা বললো পৃথা?... কথার ধরণ শুনে মনে হয় ফোনের ওই পারে যে রয়েছে, সে পৃথার খুবই কাছের... তবে কি?... কিন্তু?... পৃথাই বা কি বলতে চায় তাকে? গতকাল সন্ধ্যেবেলায় যে ঘটনা সে ঘটিয়েছে, তারপর সত্যিই বলতে মুখ নেই পৃথার সামনে দাঁড়াবার... পৃথা যদি নিজের থেকে এগিয়ে এসে ওর সাথে কথা বলতো, ওর সাহস হতো না আর কোনদিন পৃথার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবার... আবার অন্য দিকে দেখতে গেলে গতকাল ওর সাথেও যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার ব্যাখ্যাও কিছুতেই খুঁজে পায় নি সে, সারাটা রাত হাজার ভেবেও... কে তাকে আঘাত করল?... নাঃ... সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে... নিশব্দে মাথা নাড়ে সুশান্ত।
পৃথা কোন কথা বলে না... সেও উল্টোদিকের জানলার ভেতর দিয়ে বাইরের পানে চেয়ে থাকে চুপ করে... নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় কথা শুরুর আগে... সুশান্তকে সামনে দেখে দুম করে বলে ফেলেছে সে ঠিকই, যে সে ওর সাথে কথা বলতে চায়, কিন্ত আসলে কি বলবে সেটাই তো জানা নেই তার... তাই কি ভাবে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না... গতকাল সন্ধ্যেবেলায় যেটা ঘটেছে, তারপর অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো আর কোনদিন সুশান্তকে তার চোখে চোখ তুলে তাকানো দূর অস্ত, হয়তো তার পরিধীর মধ্যেই আসতে দিতো না কোনমতেই... কিন্তু সে সেই ধরণের মেয়ে নয়... আবেগপ্রবণতায় সে বাস্তব পরিস্থিতি ভোলে না, সে জানে, আজকে তার পাশে যতই অর্নব থাকুক না কেন, অর্নবের গন্ডীটা সীমিত... তার শারীরিক অক্ষমতায় হুট করে লোক সমাজে বেরিয়ে এসে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়, তাই সেখানে তার কর্মক্ষেত্রে একটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতি তৈরী হয়ে থাকুক, সেটা সে কোন মতেই চায় না... বরং সুশান্তের সাথে ব্যাপারটাকে মিটিয়ে নিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে অটুট রাখতেই হবে...
‘ম্যাডাম... সিসিডি এসে গেছে...’ ইসমাইলের গলার স্বরে সম্বিৎ ফেরে পৃথার... ‘ও, ঠিক আছে, তুমি পার্কিং দেখে গাড়ি রাখো, আমরা একটু আসছি...’ বলে সুশান্তর দিকে ফেরে... ‘চলো... গিয়ে বসি একটু...’
‘হু... চলো...’ ছোট্ট উত্তর দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় সুশান্ত।
ইসমাইল তাড়াতাড়ি ঘুরে এসে পৃথার দিকের দরজা খুলে ধরে, পৃথা নেমে গেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফের ফিরে যায় নিজের সিটের দিকে... গাড়ি চালিয়ে চলে যায় পার্কিং লটের পানে, পৃথা আর সুশান্ত ঢোকে সিসিডির মধ্যে।
সামনের একটা ফাঁকা টেবিল দেখে দুজনে গিয়ে বসে, শপের ছেলেটি এগিয়ে এসে মেনু কার্ড বাড়িয়ে দেয়... পৃথা মেনু কার্ডটা সুশান্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘কি খাবে?’
‘যা হোক একটা কিছু বলে দাও না...’ দায়সারা উত্তর দেয় সুশান্ত... রুমাল দিয়ে নিজের চোখের নিচের কালশিটেটাকে আড়াল করে শপের ছেলেটির সামনে... এই ভাবে খুলে রাখতে অস্বস্থি হয় তার।
‘তাও... কিছু তো বলো...’ বলে নিজে ঝুঁকে পড়ে মেনু কার্ডের ওপরে... ভালো করে দেখে নিয়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে, ‘আই’ল টেক আ ট্রপিকাল আইসবার্গ...’
ছেলেটি শুনে ঘাড় হেলায়... তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুশান্তের দিকে তাকায় সে...
সুশান্ত একবার মেনু কার্ডের ওপরে চোখ রেখেই বলে ওঠে, ‘আই’ল হ্যাভ ওয়ান ক্যাপুচিনো... লার্জ...’
‘ওকে স্যর... এনিথিং এলস্ ইয়ু ওয়ান্ট টু অর্ডার?’ প্রশ্ন করে ছেলেটি...
মাথা নাড়ে দুজনেই এক সাথে প্রায়... ‘নো নো... দ্যটস্ অল...’
ছেলেটি চলে যেতে পৃথা চুপচাপ মেনু কার্ডের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে... সুশান্তও কোন কথা বলে না আগ বাড়িয়ে।
নাঃ... এই ভাবে চলবে না... একটা কিছু বলতেই হবে... শুরুটা আমাকেই করতে হবে বুঝতে পারছি... ভাবে পৃথা মনে মনে... তারপর মুখ তুলে তাকায় সুশান্তের দিকে... সবে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই সুশান্তই কথা শুরু করে... ‘সরি... আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর ইয়েস্টার্ডেজস ইন্সিডেন্স...’ বলে চুপ করে।
পৃথা নিজের হাতটা তুলে আলতো করে টেবিলের ওপরে রাখা সুশান্তের হাতের ওপরে রাখে... রেখে মৃদু চাপ দেয় সেই হাতে... ‘ইটস্ ওকে... আই আন্ডার্স্ট্যান্ড... ওটা নিয়ে ভেবো না... ওটা আমিও জানি যে হটাৎ করেই আবেগের বশে ঘটে গিয়েছে... আই ক্যান ফিল ইট...’
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটনাটা পৃথা দেখবে, সেটা আশা করেনি সুশান্ত... ‘তুমি... তুমি আমাকে খুব খারাপ ভেবেছ... না?’
‘উ... হু... খারাপ?... হ্যা... অস্বীকার করবো না... কালকে তুমি চলে যাবার পর সত্যিই আমি ভিষন ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম... আসলে জানো সুশান্ত... এই শহরে আসার পর থেকে তোমাকে ভিষন ভাবে একজন ভালো বন্ধু বলে মেনে এসেছিলাম... তাই সেখানটায় আঘাত পড়তে, খারাপ তো লাগবেই? তাই না?’
‘এখন আর আমাকে বন্ধু ভাবতে পারছো না... তাই না?’ ধরা গলায় মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘ভাবছি সুশান্ত... তোমাকে এখনও আমার বন্ধুই ভাবছি... আর ভাবছি বলেই না তোমায় ধরে নিয়ে এলাম...’ সুশান্তের হাতের পীঠে নখ দিয়ে আকিবুকি কাটে পৃথা... ‘আসলে...’
‘আমি আর কক্ষনও এই ধরণের ব্যবহার করবো না কোনদিন... ঠিক...’ পৃথা কথা থামিয়ে বলে ওঠে সুশান্ত... ‘আমিও তোমাকে হারাতে চাই না... হারাতে চাই না তোমার বন্ধুত্ব...’
সুশান্তের হাতটাকে নিজের মুঠোয় ধরে চাপ দেয় পৃথা... ‘থ্যাঙ্কস্... আমিও তোমাকে চাই... বন্ধু হিসাবে... আমার পাশে...’
সুশান্তের বুক থেকে একটা যেন বিরাট বোঝা নেবে যায় পৃথার আশ্বাসে... মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোটের কোনে... ‘থাকবো পৃথা... তবে আজ থেকে আর তুমি নয়... তুই করে বলতে হবে দুজন দুজনকে... বন্ধুরা কি তুমি করে বলে?’
সুশান্তের কথায় পৃথাও এবার হেসে ফেলে... ‘বেশ তো... তাহলে তুই করে বললেই হয়... যাই বলো... তুইটা কিন্তু আরো আপন শোনায়... তাই না?’
‘আবার বলো?’ শুধরে দেয় সুশান্ত... তাতে দুজনেই হেসে ওঠে এক সাথে।
এর মাঝেই ওদের কফি সার্ভ করে দিয়ে যায় ছেলেটি... দুজনেই খানিক চুপ করে থাকে সেই সময়টায়... তারপর ছেলেটি চলে গেলে সুশান্ত বলে ওঠে, ‘আসলে কি হয়েছে জানিস তো...’ বলতে গিয়ে থমকায় সে।
পৃথা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
‘না... হটাৎ করে তুই করে বলছি তো... তাই কেমন খট করে লাগলো কানে...’ হেসে বলে সুশান্ত।
পৃথা হাসে, কিন্তু কিছু বলে না উত্তরে।
‘যাক... যেটা বলছিলাম... আসলে কি হয়েছে জানিস তো... এই বাংলা মিডিয়ামে পড়েই এই অবস্থাটা হয়েছে... আগে তো কখনও কোন মেয়ের এতটা সান্নিধ্যে আসিনি... তাই তোর এতটা খোলামেলা ব্যবহার দেখে গুলিয়ে ফেলেছিলাম, কোনটা প্রেম আর কোনটা বন্ধুত্ব... সরি রে... প্লিজ ক্ষমা করে দিস আমায়...’ বলে সুশান্ত... এবার নিসংকোচে পৃথার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে।
‘আর এতো বার সরি সরি বলতে হবে না... ছাড় তো...’ কাঁছ শ্রাগ করে বলে ওঠে পৃথা।
‘একটা প্রশ্ন করবো... যদি কিছু মনে না করিস...’ ইতস্থত করে সুশান্ত।
‘বন্ধুত্বের মধ্যে আবার কিন্তু কিন্তু হয় নাকি? বল না?’ সহজ গলায় জানতে চায় পৃথা।
‘তুই হটাৎ করে গাড়ি পেলি কোথা থেকে? মানে এটা কার গাড়ি?’ সসঙ্কোচে প্রশ্ন করে সুশান্ত।
ওর প্রশ্নের ধরনে ফিক করে হেসে ফেলে পৃথা, সে ইতিমধ্যেই অপেক্ষায় ছিল এই প্রশ্নটা আসবে জেনে... তাই শুনে মুখ তুলে তাকায় সুশান্তের দিকে, তারপর, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ওটা... ওটা আমার বরের গাড়ি...’
‘বরের...’ কথাটায় হোঁচট খায় যেন সুশান্ত... জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় পৃথার পানে।
‘হুম... বরের... ঠিকই শুনেছো... সরি শুনেছিস...’ নিজের ভুলেই হেসে ফেলে পৃথা।
কিন্তু পৃথার ভুলের ধার দিয়ে যায় না সুশান্ত... ‘কিন্তু...’ ফের প্রশ্ন করে সে।
‘আর কোন কিন্তু নয়... ছাড় এসব কথা... এখন বল তুই কি বাড়ি ফিরবি?’ কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘হ্যা, বাড়িই ফিরবো... তবে... তার মানে তুই যে বলেছিলিস যে তুই কমিটেড...’ ফের প্রশ্ন করে সুশান্ত... ব্যাপারটা কিছুতেই ওর মাথা থেকে যায় না... মনের মধ্যে আরো অনেক ধরনের প্রশ্ন ভীড় করে থাকে।
নিজের গ্লাসের শেষ আইসক্রীমটুকু খেয়ে চেয়ারের ব্যাকরেস্টএ গা এলিয়ে দেয় পৃথা... ‘হু... ঠিকই শুনেছিস... আমি যার সাথে কমিটেড... তারই গাড়ি এটা... আর সেই আমার বর... আমি তো তোকে আগেই তাই বলে রেখেছিলাম... তুই’ই তো বিশ্বাস করতে চাইছিলিস না...’
‘ওহ!...’ বলে একটু থামে সুশান্ত... তারপর সসঙ্কোচে প্রশ্ন করে, ‘তুই তোর ফ্ল্যাটে কি সেফ? না, মানে বলছিলাম যে...’ কথা বলতে বলতে নিজের ডান হাতটা টেবিলের ওপর থেকে উঠে এসে ছোয় চোখের নীচে পড়া কালশিটেটায়... ব্যথাটা এখনও রয়েছে ওখানটায়... হয়তো সময়ের সাথে দাগ মুছে যাবে ঠিকই... কিন্তু বুকের মধ্যের দাগটা? সেটা কি কখনও মুছবে? সম্পর্কের ডাকটা তুমি থেকে তুইতে বদলে গেলেও... আর কালকের ঘটনাটা? সেটারই বা কি ব্যাখ্যা? কে ছিল ওখানে? পৃথাকি জানে সেটা? নাকি জানে না? সব গুলিয়ে যায় সুশান্তের মাথার মধ্যে... কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না সে হাজার ভেবেও... গতকাল থেকে ক্রমাগত সে ভেবেই চলেছে এটাকে নিয়ে, কিন্তু এখন অবধি তার কোন সদুত্তর সে বের করতে পারে নি...
সুশান্তের কথা শেষ করতে দেয় না পৃথা, ফ্ল্যাটের কথা উঠতেই তার মুখের রঙ কেমন যেন বদলে যায়... সেখানে যেন হাজারটা রামধনূ খেলা করতে শুরু করে... উজ্জল হয়ে ওঠে পুরো মুখটা... হাসি মুখে বলে সে... ‘দুশো শতাংশ সেফ... তুই এ নিয়ে কিছু ভাবিস না...’ বলেই তাকায় সুশান্তের কাপের দিকে, ততক্ষনে কথায় কথায় সুশান্তেরও কফি খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই ঝট করে উঠে দাঁড়ায় পৃথা... আর বেশি ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে ময়না তদন্ত করতে দেওয়া উচিত হবে মনে মনে করে না সে... ব্যাগ খুলে টাকা বের করে টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে বলে, ‘নে... আর বসে থাকতে হবে না, এবার চল, যাওয়া যাক... আমাকেও ফিরতে হবে...’ ইচ্ছা করেই প্রসঙ্গের ইতি টানতে চায় সে... নতুন করে আর অপ্রস্তুত হতে রাজি নয় পৃথা।
পৃথাকে টাকা দিতে দেখে হাঁ হাঁ করে ওঠে সে, ‘আরে তুই পেমেন্ট করছিস কেন?’
‘তো? আমি তোকে ডেকে এনেছি, তুই নস... তাই আমি পেমেন্ট করবো, যেদিন তুই আমাকে নিয়ে আসবি সেদিন তুই দিবি... সিম্পল্...’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে পৃথা।
আর কথা বাড়ায় না সুশান্ত... এতদিনে বুঝে গিয়েছে, এই মেয়ের সাথে তার পেরে ওঠা সাধ্য নয়... তাই হাল ছেড়ে দেয়... ওরা দুজনেই বেরিয়ে আসে সিসিডি থেকে... পৃথা এদিক ওদিক মুখ তুলতেই রাস্তার উল্টো দিক থেকে ইসমাইল চেঁচিয়ে বলে, ‘এই যে ম্যাডাম, এখানে, আপনি দাঁড়ান, আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আসছি...’
পৃথা, সুশান্তের সাথে ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়... সুশান্ত বলে, ‘আমি বরং এখান থেকে চলে যাবো, তোকে আর আমার সাথে যেতে হবে না, তোর রাস্তাটা তো একেবারে উল্টোদিকে... তুই বরং চলে যা...’
‘ঠিক... আমার পথ তোর উল্টো দিকেই বটে’, অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে পৃথা... যাতে সুশান্তর কানে না পৌছায়, সেই ভাবে...
গাড়িটা ঘুরিয়ে ওর কাছে আসতে সুশান্তই এগিয়ে গিয়ে পৃথার জন্য দরজাটা খুলে ধরে... পৃথা গাড়ির মধ্যে উঠে বসলে, দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে জানলা কাছে মুখটা এনে নীচু স্বরে বলে সে, ‘একটা অনুরোধ করবো... রাখবি?’
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় পৃথা সুশান্তের দিকে...
একটু ইতস্থত করে কথাটা বলার আগে, তারপর গলা নামিয়ে বলে সে, ‘মৌসুমীকে গতকালকের ব্যাপারে কিছু বলিস না...’
তাড়াতাড়ি হাত তুলে সুশান্তের হাতটা ধরে নেয় পৃথা... ‘ছি ছি... তুই ভাবলি কি করে যে এসব আমি মৌসুমীকে বলবো... ডোন্ট ওয়োরি... কেউই জানবে না... আই প্রমিস...’
ম্লান হাসে সুশান্ত... ‘থ্যাঙ্কস্’... বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়... ইসমাইল হুস করে গাড়ি চালিয়ে ওর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়... যতক্ষন গাড়িটা দেখা যায়, সেই দিকেই চুপ করে তাকিয়ে থাকে সে, মনের মধ্যে লক্ষ প্রশ্ন নিয়ে।
ক্রমশ...