06-08-2019, 07:16 AM
পবন মনিকার ব্যাপারটা ভাবে কিন্তু বলতে সাহস হয় না। নির্ঘাত সবাই ভুল বুঝবে। অনেক প্রবাদ নেমে আসবে ওর কানে; বামন হয়ে চাঁদে হাত, বানরের গলায় মুক্তোর মালা অথবা চাঁদের সঙ্গে পোঁদের তুলনা। তার চেয়ে নিজেই কয়েকদিন লক্ষ্য রাখুক। তিলের নারু না ফিক হাসি কোনটা আসলে ওর জুটেছে। পুজোতে আরও কয়েকদিন কাছে থেকে দেখতে পারবে। ছেলেরা ঠাকুর দেখতে বেরবে, মেয়েরাও ঠাকুর দেখতে বেরবে। পবন ভাবে কি যে রোজ রোজ ঠাকুর দেখা বোঝা যায় না। একা একা ঠাকুরের সামনে বসিয়ে দিলে কি কেউ বার বার ঠাকুর দেখবে? বাল দেখবে। যায় তো সব মেয়ে দেখতে অথবা মেয়েরা যায় নিজেদের দেখাতে অথবা মেয়েরা যায় ছেলে দেখতে। শেষের ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নয়। ওদের ঢং দেখে কিছু বোঝা যায় না! অকারন বুকের ওড়না টানা বা শাড়ির আঁচল ঠিক করার মানে নিজেকে পুরুষের নজর থেকে বাঁচান না পুরুষের চোখ দৃষ্টি আকর্ষণ করা সেটা নিয়ে ওর ধোঁয়াশা আছে।
পবনের হটাৎ গোলাপি বউদির কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল আর প্রসঙ্গ সবার সামনে ফেলাও সারা।
পবন বলল, ‘আমরা গোলাপি বউদির জন্যে কিছু করতে পারি না?’
সবাই ভাবল। সেই দুর্ঘটনা ছয় মাসের বেশি আগে ঘটে গেছে। কিন্তু সেটার রেশ হয়ত চিরকাল থেকে যাবে। কিছু করতে পারলে ভাল হত।
ধীমান বলল, ‘ঠিক আছে, সবাই ভাব। কিছু করতে পারলে ভালই লাগবে। কি করা যায় দেখ। এখন কিছুটা সময় আছে। আর চল বাড়ি যাই। অন্ধকার হয়ে এলো।’
ওরা গঙ্গার পাড় থেকে উঠে গেল।
ঈদের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠল সফিকুল। ভোরের নামাজ পড়ল। আগের রাতে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। সেই খবর নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে সফিকুলের ঘুমাতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠবার জন্যে ও কোন আলস্যকে পাত্তা দেয় নি। নামাজ পড়া শেষ হলে পায়ে পায়ে রাহাত ভাবির বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। হাতে একটা প্যাকেট। শহর থেকে নিজে পছন্দ করে শাড়িটা কিনে এনেছে। সবুজ রঙের ওপর। ভাবির সবুজ রঙ খুব পছন্দের। সফিকুল ভাবির সাথে কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল দিন কয়েক আগেই। আরে একটা ছোট বক্সে মানানসই রঙের কাঁচের চুড়ি। এই হল ভাবিকে দেবার মত তোফা।
রাহাতের বাড়ি পৌঁছে দেখল রাহাত ঘুম থেকে ওঠেনি। গিয়াস থাকে না বলে রাহাতের কাছে সব পরব বিবর্ণ, রঙ চটা। আল্লার কাছে ও প্রত্যেকদিন দোয়া চায়। তাই বিশেষ দিনে আর বিশেষ করে কিছু চায় না। সারাজীবন ধরে একটাই চাওয়া আল্লার কাছে। একটা সন্তান। কিন্তুর উপরওয়ালার কোন রেহমত পায়নি রাহাত। উৎসবের দিনে বাচ্চাদের আনন্দ দেখতে রাহাতের সব চেয়ে ভাল লাগে। তাই মসজিদ যায়। সবাইকে নতুন পোশাকে দেখে ওর গিয়াসের কথা মনে পড়ে যায়। বর পাশে থাকলে ওর ভাল লাগে, নাইবা থাকল কোন সন্তান।
দরজায় খটখট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাহাতের। চোখ খুলে ঠাহর করতে পারল এটা কোন সময়। কাল বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে। আনারপুর থেকে রমনগড়ের রাস্তা খুব কম না। শরীর ক্লান্ত ছিল। মরার মত ঘুমিয়েছে।
ভোর হয়ে গেছে খেয়াল পরতেই রাহাত বিশ্রী গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে?’
সফিকুল বাইরে থেকে উত্তর দিল, ‘ভাবি আমি।’
রাহাত উঠে বসে কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এতো সকালে কি চাইছিস?’
কাল সন্ধ্যাবেলায় সফিকুল কথা বলে গেছে রাহাতের সাথে। বাপের বাড়ি কেমন কাটাল, শরীর ঠিক আছে কিনা, মসজিদে যাবে কিনা ইত্যাদি।
সফিকুল উত্তর দিল না। রাহাত দরজা খুলে দিল। সফিকুল ঘরে ঢুকে পড়ল।
সফিকুল রাহাতকে বলল, ‘ঈদ মোবারক ভাবি।’
রাহাতের মন ভাল হয়ে গেল। এতো সকালে ঈদের শুভেচ্ছা দিতে এসেছে বলে। রাহাত বলল, ‘ঈদ মোবারক।’
রাহাত লক্ষ্য করল সফিকুলের হাতে একটা প্যাকেট। কিসের প্যাকেট?
ওকে বেশি ভাবার অবকাশ না দিয়ে সফিকুল হাত বাড়িয়ে প্যাকেট রাহাতের মুখের সামনে ধরল, ‘ভাবি, এটা তোমাকে ঈদের উপহার।’
এরকম ধাপ্পা (surprise) রাহাতকে আগে কেউ কোনদিন দেয় নি। বাবাজান বা গিয়াস পর্যন্ত না। বাবার কাছে বা গিয়াসের কাছে একটা দাবি মত থাকত ঈদের উপহারের জন্যে। মুখ ফুটে না বললেও। সফিকুলের কাছে এমন উপহার কোন দিন পাবে স্বপ্নেও ভাবে নি। এমন সুখের, আনন্দের ধাপ্পা রাহাতকে বেসামাল করে ফেলল। হাত বাড়িয়ে উপহার স্বীকার করল। বিছানায় প্যাকেটটা রেখে সফিকুলকে জড়িয়ে ধরল রাহাত। সকালের আলোয় সফিকুলকে বুকের মধ্যে পেয়ে রাহাত এক রেশমের পেলবতা অনুভব করল। ভোরের শিশির ওর মনকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। প্রভাতের সূর্যের নরম কিরণ সফিকুলের ভালবাসা। গায়ে মেখে নিল। রাহাত ভাবল কেন ওর ভাগ্য এতো ভাল হল না যে গিয়াস সফিকের মত হল না। গিয়াসের কথা না ভেবে সফিকুলকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। লম্বা সফিকুলের বুক পর্যন্ত রাহাত মাথা। আলতো করে সফিকুলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে রাহাত। অন্তরের সুখের ফল্গু বয়ে চলেছে। সফিক যে আল্লার বড়দান। ওর ভালবাসা সব থেকে বড় ঈদের উপহার। কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে রাহাত বুঝতে পারে নি। গাল বেয়ে নেমেছে। হুঁশ ফিরল সফিকুলের কথায়।
‘ভাবি কাঁদছ কেন? গিয়াস ভাই তো কাজে গেছে। এরপর একেবারে চলে এলে আর কোন কষ্ট থাকবে না তোমার।’ সফিকুল রাহাতকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল। রাহাত সফিকুলকে বোঝাতে চাইছে না কিসের দুঃখে বা সুখে রাহাতের চোখে জল। এমনও ভালবাসা ওর জীবনে আসতে পারে ভাবে নি রাহাত।
এক সময় রাহাত ছেড়ে দেয় সফিকুলকে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি শাড়িটা পরবে কিন্তু। এখন চলি।’
রাহাতের সফিকুলকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। মন চায় আজ উৎসবের সারাটা দিন একসাথে কাটায়। মন চাইলেও হবে না। ওদের সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত নয়, কোন দিন হবেও না।
রাহাত বলল, ‘সন্ধ্যাবেলা আসিস।’
সফিকুল মাথা নেড়ে বেরিয়ে পড়ে। সুন্দর একটা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। সকালের রবিরশ্মি ওর শরীরে পড়ছে। রাহাত দেখল সফিকুল বাঁধের ওপরে উঠল, ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। রাহাত আর বিছানায় দ্বিতীয়বার ঘুমাবার জন্যে শুয়ে পড়ল না। ঈদের বিশেষ দিন সুন্দর করে কাটাতে চায়। মন চেয়েছে ঈদের দিনটা ভাল কাটুক। গিয়াস পাশে না থাকার দুঃখ ভুলে উৎসবে মেতে উঠবে রাহাত।
গোটা রমনগড় জুড়েই খুশি বাতাবরণ। ছোট ছোট . বাচ্চারা মেতে উঠেছে ঈদের আনন্দে। দুর্গা পূজা ষষ্ঠীর দিনে ভাল করে শুরু হয় না। কিন্তু বাচ্চাদের বোঝায় কার সাধ্যি! কত ক্ষণে ঠাকুর প্যান্ডেলে আসবে আর ওরা নতুন নতুন জামা প্যান্ট পরে বেরবে সেই শুভ সময়ের প্রতীক্ষায় থাকে। ঠাকুর এলেই ঠাকুমা, বাবা, দাদা বা দিদি যে কারোর হাত ধরে চলে আসে।
কলেজের সামনে মাঠ আছে। কলেজের একটা ঘরে পূজা হয়। সামনের মাঠে নানা রকমের স্টল বসে। বাজি, খেলনা বন্দুক, রঙ বেরঙের বেলুন, তেলে ভাঁজা, অন্যান্য খাবার মানে চিনে খাবার, মোঘলাই খাবার আরও কত কি! কিছু লোক পূজার এই সময় দুই পয়সা রোজগার করে নেবার সুযোগ হারাতে পারে না। ছোটদের ওপর খবরদারি নেই। বেশ একটা আলগা আলগা ভাব। মাইকে গান বাজছে, কালিপটকা, দদমা, চকলেট বোম ইত্যাদি বাজির শব্দ, বাতাসে বাজির গন্ধ সব মিলিয়ে একেবারে অচেনা রমনগড়। সন্ধ্যাবেলা দেবী প্রতিমার সামনে বক্সে গান বাজবে। বাচ্চা, কিশোরেরা নাচবে।
সারাদিন রাহাত সফিকুলের চিন্তা করে গেছে। প্রত্যূষে ভালবাসার যে সুর সফিকুল রাহাতের মনের ভিতরে বাজিয়ে দিয়ে গেছে সেটার রেশ রাহাতের মনের মধ্যে থেকে গেছে। রিনরিন করে বেজে যাচ্ছে সারাদিন। মন খুঁজে বেরিয়েছে সফিকুলকে। সফিকুলের দেখা মেলে নি। সারাটা দিন ছেলেটা কোথায় থাকে কে জানে! দুচোখে সফিকুলের জন্যে তৃষ্ণা। তৃষ্ণা মেটে নি। রাহাত ভাবল কেন যে সন্ধ্যাবেলা আসতে বলেছিল, দুপুরে বললে তো দুপুরেই আসত সফিকুল। যা হবার হয়ে গেছে। রাহাত বেরিয়ে গ্রামের অনেকের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছে। অনেকের সাথে কথা বলেছে। ঝাঁঝালো স্বর রাহাত ব্যবহার করে নি। খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে।
বাজার থেকে মাংস কিনে এনেছে রাহাত। সফিকুলের জন্যে রান্না করবে আজ। তেল, মশলা কিনেছে। বাড়ি ফিরে এসে মাংস তেল ও নানা মশলা মেখে কচু পাতায় রেখে দিল। বেলা পরে এলে রান্না করতে শুরু করল রাহাত। দুপুরে ভাত খেয়েছে। সাধারণ ডাল ভাত। মাংস রান্না করলে দুপুরে খেতে পারত। কিন্তু একা একা খেতে ইচ্ছা করে নি। সন্ধ্যাবেলা সফিকুল আসবে জানে। সফিকুল ওর কথা শুনতে ভালবাসে, মান্য করতে ভালবাসে। তাই সন্ধ্যাবেলার প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে রাহাত। মাংস রান্না সেরে ফেলল। ভাত সফিকুল এলে করবে। নিজের অভ্যাস মত সন্ধ্যা নামলে মাঠে গিয়ে নিত্যদিনের প্রাকৃতিক কর্ম সেরে স্নান করে নিজেকে পরিস্কার করে নিল। মনে মনে খুশির গান বাজছে রাহাতের। স্পষ্ট করে না হলেও গুনগুন করছে রাহাত। কানটা রাহাতের মুখের সামনে নিয়ে গেলে শোনা যাবে।
সন্ধ্যাবেলা সফিকুল এলো রাহাতের ঘরে। টিভি দেখছিল রাহাত। একটা বাংলা সিনেমা চলছিল। সফিকুল ঢুকলে বন্ধ করে দিল টিভি। দেখল সফিকুলকে একটা পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে। পাজামা পাঞ্জাবী পরেছিল। সকালে যেটা ছিল এটা অন্য। সাদা নয়। হালকা রঙিন। রাহাত ভাবল সফিকুলদের নানা রকমের পোশাক কেনার ক্ষমতা আছে। সফিকুলের চোখের দৃষ্টি নরম। রাহাতের ভাল লাগল।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি সিমাইয়ের পায়েস এনেছি। খাবে?’
রাহাত বাস্তবে ফিরে এলো, ‘খাব। তোর জন্যে গোস্ত রান্না করেছি। এখন রান্না ঘরে চল। ভাত বসাবো। গরম গরম খেয়ে নিবি আমার সাথে।’
রাহাত সফিকুলের কাছে থেকে পায়েস নিল। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল। পিছন পিছন সফিকুল গেল রান্না ঘরের মধ্যে। দেখতে সুন্দর লাগছে ভাবিকে। রাহাত চাল মাপল। জল দিয়ে ধুয়ে নিল। হাঁড়িতে চাল ফেলে উনুনে আগুন জ্বেলে দিল। পাটকাঠি পুড়িয়ে রান্নাবান্না করে রমনগড়ের মহিলারা। রাহাত ব্যতিক্রম নয়। পাটকাঠি উনুনে ফেলে ভাত রান্না করতে শুরু করে দিল। সফিকুল কথা না বলে রাহাতকে দেখতে লাগল। রাহাত নীরবে রান্না করতে লাগল। ওর জন্যে রান্না করছে ভেবে ভাল লাগল। ভাবি ওর বউ হলে নিত্যদিন ওর জন্যে রান্না করত। সফিকুল ভাবতে লাগল ভাবি কত পাল্টে গেছে। আজ একেবারে নতুন বউ লাগছে। মুখে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। চুরি করে সফিকুলকে মাঝে মাঝে দেখছে। যেন কিশোরী তার নতুনকে প্রেমিককে দেখছে। ভাত হয়ে গেছে। রাহাত ফ্যান ঝরাতে দিল। খানিক সময় পরে ভাতের হাড়ি তুলে নিল রাহাত। একটা থালায় ভাত বেরে দিল। ধোঁয়া উড়ছে। রাহাত অনেক রান্না করেছে। পটল ভাঁজা, ডাল, ঝিঙ্গে পোস্ত, গোস্ত, চাটনি। সফিকুল দেখল একটা থালায় ভাত বেরেছে। মানে ওকে আগে খেতে দেবে। কিন্তু সফিকুল একসাথে খেতে চায়।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি একলা খাব না, তুমিও বেরে নাও। একসাথে খাব।’
রাহাত বলল, ‘না না তা হয় না। তুই আগে খা, তারপর আমি খাবো।’
সফিকুল বলল, ‘একসাথে খেলে কি হবে? খাওয়া হলে ঘরে গিয়ে একটু ফ্যানের নিচে বসতে পারি।’
রাহাত ওর কথা কিছুটা অনুমান করে নিল, বলল, ‘খেতে খেতে তোর যদি কিছু লাগে? তুই আগে খাইয়ে দিলে আমি সেইমত খেয়ে নিতাম।’
সফিকুল বলল, ‘কিছু লাগবে না। যদি কিছু লাগে তাহলে খেতে খেতে দিও।’
সফিকুল জোর করলে বলে রাহাত নিজের জন্যে খাবার থালায় বেড়ে নিল। দুজনে খেতে শুরু করল। রাহাত অনেকদিন পর মাংস খাচ্ছে। গিয়াস থাকে না বলে ওর ইচ্ছাগুলো মরে যাচ্ছিল। সফিকুলের জন্যে রান্না করেছিল বলে নিজেও খাচ্ছে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি মাংস দারুন রেঁধেছ। আমার আম্মাও এমন পারে না।’
রাহাত নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে খুশি হল, কিন্তু মুখে বলল, ‘সফিক তুই কি যে বলিস না! তোর কথা শুনে আমার ছাগলও হাসবে। তোর আম্মা রমনগড়ের সব চেয়ে বড় রাঁধুনি।’
সফিকুল আর একটা গ্রাস মুখে ফেলে বলল, ‘সে হতে পারে। কিন্তু খেয়ে আমার যা মনে হল তাই বললাম।’
রাহাত বলল, ‘আর একটু নিবি?’
সফিকুল বলল, ‘তোমার কম পড়বে না তো?’
রাহাত বলল, ‘না না, তুই পেট ভরে খা।’ রাহাত সফিকুলকে মাংস দিল। বঙ্গদেশে নারীরা কবে আবার রান্না করা খাবারের প্রতি নিজের অংশিদারিত্ব ফলিয়েছে? রাহাতরা নিজেদের কথা ভেবে পুরুষদের খেতে দেয় না। পুরুষদের ভুরিভোজ হলে তারপর যা থাকে সেটা খেয়ে সুখি থাকে।
ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। সফিকুলকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রাহাত বাসন ধুয়ে ফেলল। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
রাহাত বলল, ‘তোর শাড়ি আর চুড়ি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’ রাহাতের চোখে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
সফিকুল জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে শাড়ি পরে কেমন দেখাচ্ছিল?’
রাহাত বলল, ‘তোকে সারা দুপুর দেখলাম না। কোথায় ছিলি? আমি তো সারাদিন তোর শাড়ি গায়ে জড়িয়েছিলাম।’
ফিকুল মনে মনে ভাবল শাড়ির থেকে ওকে জড়ালে সফিকুল বেশি খুশি হত।
সফিকুল বলল, ‘মসজিদ গেছিলাম, তারপর ধীমানের সাথে ছিলাম। আরেকবার পরবে?’
রাহাত চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এখন?’
সফিকুল মৃদু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ।’
রাহাত বলল, ‘কি যে করিস না! যখন পরেছিলাম তখন বাবুর পাত্তা নেই। এখন আবার হুকুম করা হচ্ছে। যা ঘরের বাইরে যা, আমি পরছি।’
সফিকুল অবাক করা গলায় বলল, ‘আমাকে বাইরে যেতে হবে?’
রাহাত বলল, ‘হ্যাঁ, আমার লজ্জা করবে না?’
সফিকুল ভেবে পায় ভাবির আবার ওর সামনে কিসের লজ্জা করবে। শ্রীমনি পর্যন্ত সফিকুলের মুখে চুম্বন করেছে, তারপরেও এতো লজ্জা ভাবি কোথা থেকে পায় কে জানে!
সফিকুল বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে?’
রাহাত বলল, ‘মিনিট দশেক।’
সফিকুল বাইরে চলে গেল। দশ মিনিট ভাবির কিসের জন্যে লাগবে কে জানে। নিজের বাড়ি গেল। দুটো পান নিল। বাঁধের ওপর হাঁটছিল। মাইকে গান শোনা যাচ্ছে। এখন সব নাচের গান শুরু হয়ে গেছে। ছেলেপিলেরা নাচানাচি শুরু করেছে। ওর যেতে ইচ্ছা করছে প্যান্ডেলে। কিন্তু আজ ভাবির সাথে ডিউটি করাটা জরুরি। দলের মত তাই। ওদের সবাইকে সিমাই খাইয়ে চলে এসেছে।
সফিকুল বাঁধ থেকে ভাবির বাড়ি নেমে গেল। দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমার হয়েছে ভাবি? ঢুকব?’
রাহাত জবাব দিল, ‘আয়।’
সফিকুল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাহাতের দিকে নজর পড়তেই ওর চক্ষু ছানাবড়া। রাহাত ভাবি সত্যি এতো সুন্দর দেখতে। মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সাধারণ চুল বাঁধা। ওর দেওয়া শাড়িটা পরেছে, সঙ্গের সবুজ রঙের কাঁচের চুড়িগুলো। কপালে একটা সবজে টিপ পরেছে। ওই বিন্দিটাই চিরপরিচিত ভাবিকে অন্যরকম করে ফেলেছে। সফিকুলের ভাল লাগছে ভাবিকে দেখতে। চোখ লজ্জা লজ্জা করে নামানো। চৌকির ওপর বসে আছে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি পান খাও।’
রাহাত ভেবেছিল ওর সাজসজ্জা সম্পর্কে কিছু বলবে। বলল না দেখে হতাশ হল। হাত বাড়িয়ে পান নিল। মুখের মধ্যে পুরে চিবাতে শুরু করল। সফিকুল নিজের পান খেতে শুরু করেছে। রাহাতের সামনে বসেছে সফিকুল। রাহাতের দিকে মুখ করে। দেখছে। চোখে মুগ্ধতা। সত্যি রাহাত ওকে মুগ্ধ করেছে। পান খেতে খেতে রাহাতের জিভ লাল হয়ে গেছে। বাংলা পান ছিল, খয়ের দেওয়া। খেলে রঙ হওয়া অনিবার্য। সফিকুল নিজেরটা দেখতে পাচ্ছে না। তাই বুঝছে না নিজের জিভও লালচে হয়েছে। মুখ থুথুতে ভরে যায়। রাহাত নিজের জিভ একবার ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নিল। রাঙা ঠোঁট। দুজনেই বাইরে গিয়ে থুথু ফেলল। মুখ পরিস্কার করল। আবার ঘরে এসে গেল।
পবনের হটাৎ গোলাপি বউদির কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল আর প্রসঙ্গ সবার সামনে ফেলাও সারা।
পবন বলল, ‘আমরা গোলাপি বউদির জন্যে কিছু করতে পারি না?’
সবাই ভাবল। সেই দুর্ঘটনা ছয় মাসের বেশি আগে ঘটে গেছে। কিন্তু সেটার রেশ হয়ত চিরকাল থেকে যাবে। কিছু করতে পারলে ভাল হত।
ধীমান বলল, ‘ঠিক আছে, সবাই ভাব। কিছু করতে পারলে ভালই লাগবে। কি করা যায় দেখ। এখন কিছুটা সময় আছে। আর চল বাড়ি যাই। অন্ধকার হয়ে এলো।’
ওরা গঙ্গার পাড় থেকে উঠে গেল।
ঈদের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠল সফিকুল। ভোরের নামাজ পড়ল। আগের রাতে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। সেই খবর নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে সফিকুলের ঘুমাতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠবার জন্যে ও কোন আলস্যকে পাত্তা দেয় নি। নামাজ পড়া শেষ হলে পায়ে পায়ে রাহাত ভাবির বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। হাতে একটা প্যাকেট। শহর থেকে নিজে পছন্দ করে শাড়িটা কিনে এনেছে। সবুজ রঙের ওপর। ভাবির সবুজ রঙ খুব পছন্দের। সফিকুল ভাবির সাথে কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল দিন কয়েক আগেই। আরে একটা ছোট বক্সে মানানসই রঙের কাঁচের চুড়ি। এই হল ভাবিকে দেবার মত তোফা।
রাহাতের বাড়ি পৌঁছে দেখল রাহাত ঘুম থেকে ওঠেনি। গিয়াস থাকে না বলে রাহাতের কাছে সব পরব বিবর্ণ, রঙ চটা। আল্লার কাছে ও প্রত্যেকদিন দোয়া চায়। তাই বিশেষ দিনে আর বিশেষ করে কিছু চায় না। সারাজীবন ধরে একটাই চাওয়া আল্লার কাছে। একটা সন্তান। কিন্তুর উপরওয়ালার কোন রেহমত পায়নি রাহাত। উৎসবের দিনে বাচ্চাদের আনন্দ দেখতে রাহাতের সব চেয়ে ভাল লাগে। তাই মসজিদ যায়। সবাইকে নতুন পোশাকে দেখে ওর গিয়াসের কথা মনে পড়ে যায়। বর পাশে থাকলে ওর ভাল লাগে, নাইবা থাকল কোন সন্তান।
দরজায় খটখট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাহাতের। চোখ খুলে ঠাহর করতে পারল এটা কোন সময়। কাল বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে। আনারপুর থেকে রমনগড়ের রাস্তা খুব কম না। শরীর ক্লান্ত ছিল। মরার মত ঘুমিয়েছে।
ভোর হয়ে গেছে খেয়াল পরতেই রাহাত বিশ্রী গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে?’
সফিকুল বাইরে থেকে উত্তর দিল, ‘ভাবি আমি।’
রাহাত উঠে বসে কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এতো সকালে কি চাইছিস?’
কাল সন্ধ্যাবেলায় সফিকুল কথা বলে গেছে রাহাতের সাথে। বাপের বাড়ি কেমন কাটাল, শরীর ঠিক আছে কিনা, মসজিদে যাবে কিনা ইত্যাদি।
সফিকুল উত্তর দিল না। রাহাত দরজা খুলে দিল। সফিকুল ঘরে ঢুকে পড়ল।
সফিকুল রাহাতকে বলল, ‘ঈদ মোবারক ভাবি।’
রাহাতের মন ভাল হয়ে গেল। এতো সকালে ঈদের শুভেচ্ছা দিতে এসেছে বলে। রাহাত বলল, ‘ঈদ মোবারক।’
রাহাত লক্ষ্য করল সফিকুলের হাতে একটা প্যাকেট। কিসের প্যাকেট?
ওকে বেশি ভাবার অবকাশ না দিয়ে সফিকুল হাত বাড়িয়ে প্যাকেট রাহাতের মুখের সামনে ধরল, ‘ভাবি, এটা তোমাকে ঈদের উপহার।’
এরকম ধাপ্পা (surprise) রাহাতকে আগে কেউ কোনদিন দেয় নি। বাবাজান বা গিয়াস পর্যন্ত না। বাবার কাছে বা গিয়াসের কাছে একটা দাবি মত থাকত ঈদের উপহারের জন্যে। মুখ ফুটে না বললেও। সফিকুলের কাছে এমন উপহার কোন দিন পাবে স্বপ্নেও ভাবে নি। এমন সুখের, আনন্দের ধাপ্পা রাহাতকে বেসামাল করে ফেলল। হাত বাড়িয়ে উপহার স্বীকার করল। বিছানায় প্যাকেটটা রেখে সফিকুলকে জড়িয়ে ধরল রাহাত। সকালের আলোয় সফিকুলকে বুকের মধ্যে পেয়ে রাহাত এক রেশমের পেলবতা অনুভব করল। ভোরের শিশির ওর মনকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। প্রভাতের সূর্যের নরম কিরণ সফিকুলের ভালবাসা। গায়ে মেখে নিল। রাহাত ভাবল কেন ওর ভাগ্য এতো ভাল হল না যে গিয়াস সফিকের মত হল না। গিয়াসের কথা না ভেবে সফিকুলকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে। লম্বা সফিকুলের বুক পর্যন্ত রাহাত মাথা। আলতো করে সফিকুলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে রাহাত। অন্তরের সুখের ফল্গু বয়ে চলেছে। সফিক যে আল্লার বড়দান। ওর ভালবাসা সব থেকে বড় ঈদের উপহার। কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে রাহাত বুঝতে পারে নি। গাল বেয়ে নেমেছে। হুঁশ ফিরল সফিকুলের কথায়।
‘ভাবি কাঁদছ কেন? গিয়াস ভাই তো কাজে গেছে। এরপর একেবারে চলে এলে আর কোন কষ্ট থাকবে না তোমার।’ সফিকুল রাহাতকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল। রাহাত সফিকুলকে বোঝাতে চাইছে না কিসের দুঃখে বা সুখে রাহাতের চোখে জল। এমনও ভালবাসা ওর জীবনে আসতে পারে ভাবে নি রাহাত।
এক সময় রাহাত ছেড়ে দেয় সফিকুলকে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি শাড়িটা পরবে কিন্তু। এখন চলি।’
রাহাতের সফিকুলকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। মন চায় আজ উৎসবের সারাটা দিন একসাথে কাটায়। মন চাইলেও হবে না। ওদের সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত নয়, কোন দিন হবেও না।
রাহাত বলল, ‘সন্ধ্যাবেলা আসিস।’
সফিকুল মাথা নেড়ে বেরিয়ে পড়ে। সুন্দর একটা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে। সকালের রবিরশ্মি ওর শরীরে পড়ছে। রাহাত দেখল সফিকুল বাঁধের ওপরে উঠল, ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। রাহাত আর বিছানায় দ্বিতীয়বার ঘুমাবার জন্যে শুয়ে পড়ল না। ঈদের বিশেষ দিন সুন্দর করে কাটাতে চায়। মন চেয়েছে ঈদের দিনটা ভাল কাটুক। গিয়াস পাশে না থাকার দুঃখ ভুলে উৎসবে মেতে উঠবে রাহাত।
গোটা রমনগড় জুড়েই খুশি বাতাবরণ। ছোট ছোট . বাচ্চারা মেতে উঠেছে ঈদের আনন্দে। দুর্গা পূজা ষষ্ঠীর দিনে ভাল করে শুরু হয় না। কিন্তু বাচ্চাদের বোঝায় কার সাধ্যি! কত ক্ষণে ঠাকুর প্যান্ডেলে আসবে আর ওরা নতুন নতুন জামা প্যান্ট পরে বেরবে সেই শুভ সময়ের প্রতীক্ষায় থাকে। ঠাকুর এলেই ঠাকুমা, বাবা, দাদা বা দিদি যে কারোর হাত ধরে চলে আসে।
কলেজের সামনে মাঠ আছে। কলেজের একটা ঘরে পূজা হয়। সামনের মাঠে নানা রকমের স্টল বসে। বাজি, খেলনা বন্দুক, রঙ বেরঙের বেলুন, তেলে ভাঁজা, অন্যান্য খাবার মানে চিনে খাবার, মোঘলাই খাবার আরও কত কি! কিছু লোক পূজার এই সময় দুই পয়সা রোজগার করে নেবার সুযোগ হারাতে পারে না। ছোটদের ওপর খবরদারি নেই। বেশ একটা আলগা আলগা ভাব। মাইকে গান বাজছে, কালিপটকা, দদমা, চকলেট বোম ইত্যাদি বাজির শব্দ, বাতাসে বাজির গন্ধ সব মিলিয়ে একেবারে অচেনা রমনগড়। সন্ধ্যাবেলা দেবী প্রতিমার সামনে বক্সে গান বাজবে। বাচ্চা, কিশোরেরা নাচবে।
সারাদিন রাহাত সফিকুলের চিন্তা করে গেছে। প্রত্যূষে ভালবাসার যে সুর সফিকুল রাহাতের মনের ভিতরে বাজিয়ে দিয়ে গেছে সেটার রেশ রাহাতের মনের মধ্যে থেকে গেছে। রিনরিন করে বেজে যাচ্ছে সারাদিন। মন খুঁজে বেরিয়েছে সফিকুলকে। সফিকুলের দেখা মেলে নি। সারাটা দিন ছেলেটা কোথায় থাকে কে জানে! দুচোখে সফিকুলের জন্যে তৃষ্ণা। তৃষ্ণা মেটে নি। রাহাত ভাবল কেন যে সন্ধ্যাবেলা আসতে বলেছিল, দুপুরে বললে তো দুপুরেই আসত সফিকুল। যা হবার হয়ে গেছে। রাহাত বেরিয়ে গ্রামের অনেকের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছে। অনেকের সাথে কথা বলেছে। ঝাঁঝালো স্বর রাহাত ব্যবহার করে নি। খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে।
বাজার থেকে মাংস কিনে এনেছে রাহাত। সফিকুলের জন্যে রান্না করবে আজ। তেল, মশলা কিনেছে। বাড়ি ফিরে এসে মাংস তেল ও নানা মশলা মেখে কচু পাতায় রেখে দিল। বেলা পরে এলে রান্না করতে শুরু করল রাহাত। দুপুরে ভাত খেয়েছে। সাধারণ ডাল ভাত। মাংস রান্না করলে দুপুরে খেতে পারত। কিন্তু একা একা খেতে ইচ্ছা করে নি। সন্ধ্যাবেলা সফিকুল আসবে জানে। সফিকুল ওর কথা শুনতে ভালবাসে, মান্য করতে ভালবাসে। তাই সন্ধ্যাবেলার প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে রাহাত। মাংস রান্না সেরে ফেলল। ভাত সফিকুল এলে করবে। নিজের অভ্যাস মত সন্ধ্যা নামলে মাঠে গিয়ে নিত্যদিনের প্রাকৃতিক কর্ম সেরে স্নান করে নিজেকে পরিস্কার করে নিল। মনে মনে খুশির গান বাজছে রাহাতের। স্পষ্ট করে না হলেও গুনগুন করছে রাহাত। কানটা রাহাতের মুখের সামনে নিয়ে গেলে শোনা যাবে।
সন্ধ্যাবেলা সফিকুল এলো রাহাতের ঘরে। টিভি দেখছিল রাহাত। একটা বাংলা সিনেমা চলছিল। সফিকুল ঢুকলে বন্ধ করে দিল টিভি। দেখল সফিকুলকে একটা পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে। পাজামা পাঞ্জাবী পরেছিল। সকালে যেটা ছিল এটা অন্য। সাদা নয়। হালকা রঙিন। রাহাত ভাবল সফিকুলদের নানা রকমের পোশাক কেনার ক্ষমতা আছে। সফিকুলের চোখের দৃষ্টি নরম। রাহাতের ভাল লাগল।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি সিমাইয়ের পায়েস এনেছি। খাবে?’
রাহাত বাস্তবে ফিরে এলো, ‘খাব। তোর জন্যে গোস্ত রান্না করেছি। এখন রান্না ঘরে চল। ভাত বসাবো। গরম গরম খেয়ে নিবি আমার সাথে।’
রাহাত সফিকুলের কাছে থেকে পায়েস নিল। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল। পিছন পিছন সফিকুল গেল রান্না ঘরের মধ্যে। দেখতে সুন্দর লাগছে ভাবিকে। রাহাত চাল মাপল। জল দিয়ে ধুয়ে নিল। হাঁড়িতে চাল ফেলে উনুনে আগুন জ্বেলে দিল। পাটকাঠি পুড়িয়ে রান্নাবান্না করে রমনগড়ের মহিলারা। রাহাত ব্যতিক্রম নয়। পাটকাঠি উনুনে ফেলে ভাত রান্না করতে শুরু করে দিল। সফিকুল কথা না বলে রাহাতকে দেখতে লাগল। রাহাত নীরবে রান্না করতে লাগল। ওর জন্যে রান্না করছে ভেবে ভাল লাগল। ভাবি ওর বউ হলে নিত্যদিন ওর জন্যে রান্না করত। সফিকুল ভাবতে লাগল ভাবি কত পাল্টে গেছে। আজ একেবারে নতুন বউ লাগছে। মুখে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। চুরি করে সফিকুলকে মাঝে মাঝে দেখছে। যেন কিশোরী তার নতুনকে প্রেমিককে দেখছে। ভাত হয়ে গেছে। রাহাত ফ্যান ঝরাতে দিল। খানিক সময় পরে ভাতের হাড়ি তুলে নিল রাহাত। একটা থালায় ভাত বেরে দিল। ধোঁয়া উড়ছে। রাহাত অনেক রান্না করেছে। পটল ভাঁজা, ডাল, ঝিঙ্গে পোস্ত, গোস্ত, চাটনি। সফিকুল দেখল একটা থালায় ভাত বেরেছে। মানে ওকে আগে খেতে দেবে। কিন্তু সফিকুল একসাথে খেতে চায়।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি একলা খাব না, তুমিও বেরে নাও। একসাথে খাব।’
রাহাত বলল, ‘না না তা হয় না। তুই আগে খা, তারপর আমি খাবো।’
সফিকুল বলল, ‘একসাথে খেলে কি হবে? খাওয়া হলে ঘরে গিয়ে একটু ফ্যানের নিচে বসতে পারি।’
রাহাত ওর কথা কিছুটা অনুমান করে নিল, বলল, ‘খেতে খেতে তোর যদি কিছু লাগে? তুই আগে খাইয়ে দিলে আমি সেইমত খেয়ে নিতাম।’
সফিকুল বলল, ‘কিছু লাগবে না। যদি কিছু লাগে তাহলে খেতে খেতে দিও।’
সফিকুল জোর করলে বলে রাহাত নিজের জন্যে খাবার থালায় বেড়ে নিল। দুজনে খেতে শুরু করল। রাহাত অনেকদিন পর মাংস খাচ্ছে। গিয়াস থাকে না বলে ওর ইচ্ছাগুলো মরে যাচ্ছিল। সফিকুলের জন্যে রান্না করেছিল বলে নিজেও খাচ্ছে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি মাংস দারুন রেঁধেছ। আমার আম্মাও এমন পারে না।’
রাহাত নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে খুশি হল, কিন্তু মুখে বলল, ‘সফিক তুই কি যে বলিস না! তোর কথা শুনে আমার ছাগলও হাসবে। তোর আম্মা রমনগড়ের সব চেয়ে বড় রাঁধুনি।’
সফিকুল আর একটা গ্রাস মুখে ফেলে বলল, ‘সে হতে পারে। কিন্তু খেয়ে আমার যা মনে হল তাই বললাম।’
রাহাত বলল, ‘আর একটু নিবি?’
সফিকুল বলল, ‘তোমার কম পড়বে না তো?’
রাহাত বলল, ‘না না, তুই পেট ভরে খা।’ রাহাত সফিকুলকে মাংস দিল। বঙ্গদেশে নারীরা কবে আবার রান্না করা খাবারের প্রতি নিজের অংশিদারিত্ব ফলিয়েছে? রাহাতরা নিজেদের কথা ভেবে পুরুষদের খেতে দেয় না। পুরুষদের ভুরিভোজ হলে তারপর যা থাকে সেটা খেয়ে সুখি থাকে।
ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। সফিকুলকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রাহাত বাসন ধুয়ে ফেলল। তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
রাহাত বলল, ‘তোর শাড়ি আর চুড়ি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’ রাহাতের চোখে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
সফিকুল জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে শাড়ি পরে কেমন দেখাচ্ছিল?’
রাহাত বলল, ‘তোকে সারা দুপুর দেখলাম না। কোথায় ছিলি? আমি তো সারাদিন তোর শাড়ি গায়ে জড়িয়েছিলাম।’
ফিকুল মনে মনে ভাবল শাড়ির থেকে ওকে জড়ালে সফিকুল বেশি খুশি হত।
সফিকুল বলল, ‘মসজিদ গেছিলাম, তারপর ধীমানের সাথে ছিলাম। আরেকবার পরবে?’
রাহাত চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এখন?’
সফিকুল মৃদু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ।’
রাহাত বলল, ‘কি যে করিস না! যখন পরেছিলাম তখন বাবুর পাত্তা নেই। এখন আবার হুকুম করা হচ্ছে। যা ঘরের বাইরে যা, আমি পরছি।’
সফিকুল অবাক করা গলায় বলল, ‘আমাকে বাইরে যেতে হবে?’
রাহাত বলল, ‘হ্যাঁ, আমার লজ্জা করবে না?’
সফিকুল ভেবে পায় ভাবির আবার ওর সামনে কিসের লজ্জা করবে। শ্রীমনি পর্যন্ত সফিকুলের মুখে চুম্বন করেছে, তারপরেও এতো লজ্জা ভাবি কোথা থেকে পায় কে জানে!
সফিকুল বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে?’
রাহাত বলল, ‘মিনিট দশেক।’
সফিকুল বাইরে চলে গেল। দশ মিনিট ভাবির কিসের জন্যে লাগবে কে জানে। নিজের বাড়ি গেল। দুটো পান নিল। বাঁধের ওপর হাঁটছিল। মাইকে গান শোনা যাচ্ছে। এখন সব নাচের গান শুরু হয়ে গেছে। ছেলেপিলেরা নাচানাচি শুরু করেছে। ওর যেতে ইচ্ছা করছে প্যান্ডেলে। কিন্তু আজ ভাবির সাথে ডিউটি করাটা জরুরি। দলের মত তাই। ওদের সবাইকে সিমাই খাইয়ে চলে এসেছে।
সফিকুল বাঁধ থেকে ভাবির বাড়ি নেমে গেল। দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমার হয়েছে ভাবি? ঢুকব?’
রাহাত জবাব দিল, ‘আয়।’
সফিকুল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাহাতের দিকে নজর পড়তেই ওর চক্ষু ছানাবড়া। রাহাত ভাবি সত্যি এতো সুন্দর দেখতে। মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সাধারণ চুল বাঁধা। ওর দেওয়া শাড়িটা পরেছে, সঙ্গের সবুজ রঙের কাঁচের চুড়িগুলো। কপালে একটা সবজে টিপ পরেছে। ওই বিন্দিটাই চিরপরিচিত ভাবিকে অন্যরকম করে ফেলেছে। সফিকুলের ভাল লাগছে ভাবিকে দেখতে। চোখ লজ্জা লজ্জা করে নামানো। চৌকির ওপর বসে আছে।
সফিকুল বলল, ‘ভাবি পান খাও।’
রাহাত ভেবেছিল ওর সাজসজ্জা সম্পর্কে কিছু বলবে। বলল না দেখে হতাশ হল। হাত বাড়িয়ে পান নিল। মুখের মধ্যে পুরে চিবাতে শুরু করল। সফিকুল নিজের পান খেতে শুরু করেছে। রাহাতের সামনে বসেছে সফিকুল। রাহাতের দিকে মুখ করে। দেখছে। চোখে মুগ্ধতা। সত্যি রাহাত ওকে মুগ্ধ করেছে। পান খেতে খেতে রাহাতের জিভ লাল হয়ে গেছে। বাংলা পান ছিল, খয়ের দেওয়া। খেলে রঙ হওয়া অনিবার্য। সফিকুল নিজেরটা দেখতে পাচ্ছে না। তাই বুঝছে না নিজের জিভও লালচে হয়েছে। মুখ থুথুতে ভরে যায়। রাহাত নিজের জিভ একবার ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নিল। রাঙা ঠোঁট। দুজনেই বাইরে গিয়ে থুথু ফেলল। মুখ পরিস্কার করল। আবার ঘরে এসে গেল।
All the contents posted by me have been downloaded from the internet. Credit goes to the original uploaders. Anyone having any issues with pictures posted, please message for removal.