17-07-2019, 12:21 AM
“পৃথিবীটা অনেক বিচিত্র মা, কিছু লোকের হাতে উপরওয়ালা অনেক সম্পদ দিয়ে রাখেন, সে সেগুলি নিজে ও ভোগ করার ক্ষমতা রাখে না, আবার অন্যকে বিলিয়ে ও দিতে পারে না...আবার কারো হাতে কিছু নেই, কিন্তু অন্যকে দেয়ার জন্যে মন থাকে...মানুষের জীবনে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ও তেমন, তোমার যদি কোন সম্পর্ককে সম্মান করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে কেন তুমি কাউকে তোমার কাছে আসতে বাধা দিবে তুমি, এই পৃথিবীর তৈরি করা নিয়মের সম্পর্কের চেয়ে ও বড় হচ্ছে আমাদের মনের সম্পর্ক, যাকে তোমার মন ভালবাসতে চাইবে, তাকে কেন তুমি সমাজের নিয়মের জন্যে দূরে ঠেলে রাখবে, এমন ভুল করো না বউমা। যেসব সম্পর্ককে নিজের কাছে টেনে রাখবে, সম্মান দিবে, সম্পর্ককে বেড়ে উঠার সুযোগ দিবে, সেটাই তোমার সাথে ওই লোকের সঠিক সম্পর্ক। এই যে তুমি আমাকে আদর করে নিজের মায়ের স্থানে বসিয়ে সেবা করছো, এটাই তোমার আমার প্রকৃত সম্পর্ক। সমাজের কাছে আমি তোমার শাশুড়ি, কিন্তু তুমি আর আমি দুজনেই জানি যে তুমি আমার মেয়ের চেয়ে কম নও, আমি তোমার মায়ের চেয়ে কম নই। এই পরিবারে তোমার অনেক অবদান...মাত্র এক বছরেই তুমি অনেক কিছু দিয়েছো আমাদের, সামনে আরও অনেক কিছু দিবে...তাই আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, শুধু আমি না তোমার শ্বশুর ও তোমার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ, মুখে বলেননি তোমাকে কোনদিন, কিন্তু আমি জানি উনার মনের কথা।“- এই পর্যন্ত বলে উনি একটু থামলেন।
এর পরে আবার বলতে শুরু করলেন, “এই যে জেরিনের বিয়ে হয়েছে, সেটা তোমার কারনেই সম্ভব হয়েছে আমি জানি...আমি তোমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলে ও আমার মনের সান্তনা, যে এই সংসারের ভার তুমি নিজের কাধে নিয়ে নিয়েছো...এটাই আমার পরম পাওয়া। খুব কম বউকে আমাদের চারপাশের লোকদের সংসারে তুমি পাবে, যেই বউ শ্বশুরবাড়িকে নিজের মনে করে, সেখানে নিজের সব শ্রম উজার করে দেয়। কিন্তু এতো কিছুর পরে ও তোমাকে দেয়ার মত বড় কোন সম্পদ নেই আমার কাছে, থাকলে আমি সেটাই তোমাকে দিতাম...শুধু আমার গয়নার বাক্সে আমার বাবার বাড়ীর আর তোমার শ্বশুরের দেয়া অনেক গয়না আছে, ১০০ ভরির কম হবে না, সেগুলি আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম...তুমি না করো না বউমা। এগুলি তোমার, এগুলি আমি তোমাকেই দিলাম। জেরিনের এখানে কোন প্রাপ্য নেই। ওর বাবা ওকে যা দেবার দিবেন। কিন্তু আমার নিজের বলতে শুধু এই গয়নাগুলিই আছে, এগুলি সব আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম।”-শাশুড়ি আম্মার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো, অনেক কষ্টে থেমে থেমে কথাগুলি বলছিলেন। আমি চুপ করে শুনছিলাম উনাকে কথার মাঝে কোন বাধা না দিয়ে, গয়না দেবার কথা শুনে আমি মানা করতে গেলাম, উনি হাত চেপে ধরে করুন গলায় অনুনয় করলেন, তাই আর কিছু বললাম না।
“আপনার দেয়া সম্পদ আমি মাথায় করে রাখবো মা...”-আমি ছোট করে বললাম উনাকে।
“তোমার শ্বশুর ও যথা সময়ে উনার সমস্ত সম্পদ ৩ ভাগে ভাগ করে দিবেন, আমি উনাকে বলে রেখেছি, এক ভাগ জেরিনের, এক ভাগ সুমনের আর এক ভাগ তোমার...তুমি আমাদের আরেক সন্তান, তাই তোমার শ্বশুরের সম্পদে তোমার ও প্রাপ্য হক আছে, সমান হক।”-উনি আবার ও বললেন।
“তুমি তো আমাদের অনেক দিয়েছ, মা, তাই তোমার কাছে আর কিছু চাইতে লজ্জা করে, তারপর ও চাইছি...জানি তুমি মানা করবে না আমাকে...”-উনি বললেন। আমি সাথে সাথে বললাম, “বলুন মা, কি করতে হবে?”
“তোমার শ্বশুর মশাই, খুব ভালো মানুষ, সাড়া জীবনে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবেসে গেছেন...আমার যাওয়ার পরে তুমি উনাকে দেখে রেখো...উনার যত্ন নিয়ো...আমি চলে গেলে উনার কথা বলার মানুষ ও চলে যাবে, তাই তুমি একটু উনাকে সময় না দিলে, বেচারা একাকিত্তের কষ্টে নুয়ে যাবে...উনার ভার আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম...বলো মা, তুমি এই ভার টা নিবে তো?”-উনি বললেন, উনার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।
“মা, আপনি বাবাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমি বাবাকে কোন রকম কষ্ট পেতে দিবো না। উনাকে ও আমি নিজের বাবার চেয়ে কম মনে করি না, তাই মেয়ে হয়ে বাবার জন্যে যা করা যায় সবই করবো...”-আমি কথা দিলাম।
“খুশি হলাম মা, শুনে খুব খুশি হলাম...আমি অনেক বছর যাবত অসুস্থ, তাই কোনদিন একটু ভালো করে উনার সেবা ও করতে পারি নাই...তুমি উনার সেবা করবে জেনে খুশি লাগলো...শুধু বলবো যে উনাকে তুমি পর মনে করো না কোনদিন...বাবা মা বুড়ো হয়ে ছেলে আর মেয়েদের উপরেই নির্ভর হয়ে যায়...আমাদের ছেলে বলো আর মেয়ে বলো, সে তুমিই...তাই তোমার শ্বশুরের সেবা করতে কোন কার্পণ্য করো না বউমা, উনার সব চাওয়া তুমি পুরন করবে আমি জানি, তবে কি বউমা? তোমার শ্বশুর একটু লাজুক নিরিহ গোবেচারা টাইপের মানুষ, তাই নিজের চাওয়াটা ও সব সময় মুখ ফুটে বলতে পারে না। তোমার শ্বশুর খুশি থাকলে আমি ও খুশি থাকবো...মনে রেখো...”-উনি কি বুঝাতে চাইছেন বার বার সেবা বলতে জানি না, কিন্তু যেমন করুন চোখে উনি আমার কাছে ভিক্ষা চাইছেন, সেটা আমার বুকটা ভেঙ্গে দিলো, আমি নিজে ও কেঁদে উনাকে জড়িয়ে ধরে কথা দিলাম, “একবারই বললাম তো মা, আমি উনাকে কোন কষ্ট পেতে দিবো না...উনাকে খুশি রাখার সব রকম চেষ্টা করবো মা...আপনি আমাকে দোয়া করেন...”।
“দোয়া করি বউমা, অনেক অনেক দোয়া করি...স্বামীর মন পাও সাড়া জীবন, অনেকগুলি সন্তান এই আঙ্গিনায় খেলা করবে, তুমি ওদের মা হবে...এই দোয়া করি আমি সব সময়...স্বামীর কোলে মাথা দিয়ে যেন মরতে পারো, সেই দোয়া ও করি...”-উনি আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। আমার খুব ভালো লাগছিলো, উনাকে যেন আমার নিজের মায়ের চেয়ে ও বেশি আপন বলেই মনে হতে লাগলো। দুই অসম বয়সী নারী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। এর কিছু পরে আমার শ্বশুর রুমে ঢুকলো, তাই আমি উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোতলায় নিজের রুমে গেলাম, আমার হাতে মায়ের দেয়া সেই গয়নার বাক্স।