01-01-2019, 04:42 PM
অবশেষে পিয়ালের সাথে দেখা করার দিন ঠিক হোলো। তুলি আসবেনা। পিয়াল কে নিয়ে আসবে সেই পার্কে, সঙ্গে থাকবে উকিল, যাতে আমি ঠিক ঠাক জায়গায় সই করি, সেটা দেখভাল করার জন্যে।
সারারাত কাঁদলাম। ভাবলাম ওকে দেখে আর মায়া বাড়াবো কেন? কিন্তু সেটা আক্কেলের কথা, মন তো অপত্য স্নেহে ব্যাকুল।
পিয়ালের জন্যে অনেক চকোলেত আর ক্যান্ডি নিলাম। যেগুলো ও পছন্দ করে। সেই গাড়িটাই ওকে নিয়ে এলো। সঙ্গে ধোপদুরস্ত পোষাক পরা এক ভদ্রলোক নামলেন। বুঝলাম ইনিই উকিল। আমাকে দেখে পিয়ালের খুব একটা ভাবান্তর দেখলাম না। আমি গিয়ে ওর হাত ধরলাম। রক্ত যেন ঝিলিক মেরে উঠলো। গলার কাছে, কান্না আটকে আছে। তুলতুলে নরম হাত নিয়ে আমি আর তুলি কত খেলেছি, ও ঘুমাতো আর আমরা দেখতাম ওর ছোট ছোট হাত আর পা গুলো, খালি বলতাম দেখো কয়টুক কয়টুক আঙ্গুল।
আমি পিয়ালের হাত ধরে ওকে পার্কের ভিতরে নিয়ে গেলাম, পিছন পিছন সেই উকিল ভদ্রলোক আসছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে চিনতে পারছো?
-তুমি বাপি তো। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি।
-চিনতে পেরেছিস...। বাপির কাছে আস্তে ইচ্ছে করছিলো না?
-না তুমি আমার খেলনা দাও নি। আমি খুব রাগ করেছি।
- কে বললো আমি খেলনা দিই নি।
-কেন সুমতি আন্টি।
- ও বলেছে যে আমি তোর খেলনা দিতে চাইনি?
-হ্যাঁ।
-আমি বলেছি যে তুই এসে যেন খেলে যাস, আর ও গিয়ে এই বলল তোকে, দাড়া পাই একবার ব্যাটাকে?
-ব্যাটা কেন? ও তো লেডী।
- ও সরি বাবা ভুল হয়ে গেছে।
-দাদুর কি হয়েছে বাপি?
-কেন কিছু হয়নি তো?
- ঐ যে আন্টি টা বলছিলো দাদুর কি হয়েছে আমি কাছে গেলে নাকি আমাকেও পোকা ধরবে?
-ভুল বলেছে তোমাকে? আন্টি ভুল বলেছে। তুমি দাদুর সাথে কথা বলোনি বলে দাদু খুব কেঁদেছে।
-আমি দাদুকে ফোন করে সরি বলে দেবো?
-কেন তুমি দাদুর সাথে দেখা করবেনা?
-না। তুমি আর দাদু তো চলে যাচ্ছো?
-কোথায়? কে বললো?
-ওই যে আঙ্কেলটা বললো? তুমি নাকি অফিসের কাজে বম্বে যাচ্ছো সাথে দাদুকে নিয়ে যাচ্ছো?
আমি উকিলের দিকে ঘুরে তাকালাম।
সাফাই দেওয়ার সুরে উনি বললেন।
-দোষ নেবেন না, এটা তো আমার পেশা। এসব না বললে ওকে রাখা তো মুস্কিল হবে।
-রাখার কি দরকার। ও বেছে নিক না কার কাছে থাকবে। জোর করে বাচ্চার ওপরে কিছু চাপানো কি ঠিক? এমনও তো হতে পারে যে আমাদের সেপারেশানের পরেও আমরা বন্ধুর মত থাকলাম। পিয়াল যাতায়াত করলো বা মিলিয়ে মিশিয়ে থাকলো।
-দেখুন সে ব্যাপারে আপত্তি আছে। ও তো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর মিঃ গুপ্তা চান না এটা।
- কে মিঃ গুপ্তা?
-কেন আপনি যানেন না? যার সাথে আপনার বর্তমান মিসেস ভবিশ্যতে ঘর বাঁধবে?
আমি চুপ করে গেলাম।
-না আমি জানতাম না। তবে এটাই তো স্বাভাবিক। নাহলে কেউ আর কাউকে কেন আশ্রয় দেবে।
-এই আমাদের পেশার যন্ত্রনা যানেন। মানবিকতা বোধ থাকলে আপনাকে কষ্টই পেতে হবে। দেখতে তো পাচ্ছি আপনাদের বাপ ছেলের কি রিলেশান। তবুও আমার দায়িত্ব আপনাকে পাহাড়া দেওয়া যাতে আপনি বাচ্চার মন দুর্বল করে না দেন।
-হা হা। যাক ভালো লাগলো আপনার সাথে পরিচয় হয়ে, যদিও আমরা ক্ষনিকের অতিথি।
- আমি আপনাকে চিনি দাদা। আমি ছোটবেলায় আপনাদের পাড়াতেই ভাড়া থাকতাম। পরে ভবানিপুরে চলে আসি।
-ওঃ ভালো। ভালো লাগলো শুনে।
-আপনারা কথা বলুন। আমি বাইরে গিয়ে একটু সিগেরেট ফুঁকে আসি। কিন্তু ওকে বলতে বলবেন যে আমি কাছেই ছিলাম।
-বাচ্চাকে কি ভাবে মিথ্যে বলতে শেখায় বলুন তো। ওরা কি গুছিয়ে বলতে পারে? এই দেখুন এসেই তো গরগর করে সব পেটের কথা বলে যাচ্ছে।
-হা হা। ঠিক আছে আমি মাঝে মাঝে এসে আপনাদের বিরক্ত করবো।
- আপনি বসতেও পারেন, আমি আর ও কি এমন গোপন কথা বলবো?
-বাপি আমার একটা গোপন কথা আছে।
-বাব্বা তোরও গোপন কথা আছে?
-মাথা নিচু করো কানে কানে বলবো।
আমি বললাম দাড়া, তোকে কানের কাছে নিয়ে আসি। ওকে কোলে তুলে একটা বেঞ্চের ওপর দাড় করিয়ে দিলাম। মুখের কাছে কান নিয়ে গেলাম।
ফিস ফিস করে বলার চেষ্টা করলেও বেস জোরেই বলে ফেললো, একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির দাবি।
আমি ফিস ফিস করে বললাম ‘এটা গোপন কথা?’
‘হ্যাঁ, মা বলেছে কিছু না চাইতে তোমার থেকে।’
‘তুই মাকে গিয়ে বলবি, যে তুই আমার থেকে চেয়েছিস, আর বলবি বাবা এত গরিব না যে তোকে কিছু দিতে পারবেনা। কানে কানে বলবি কিন্তু।’
উকিল সাহেব চলে গেলো ফুঁকতে অথবা বাপ ছেলেকে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ করে দিতে।
-কিরে তোর বাপিকে ছেরে থাকতে ভালো লাগে?
-হ্যাঁ।
-ভালো লাগে?
-হ্যাঁ। তুমি বকা দাও।
-তুই দুষ্টুমি করলে বকা দেবোনা। কিন্তু চকোলেট তো আর মা কিনে আনেনা, খেলনাও তো আমিই কিনে আনি।
-তুমি তো বম্বেতে ছিলে। তাই তো আমরা ঘুরতে এসেছি এখানে।
-এখন তো চলে এসেছি, তো চল বাড়িতে থাকবি?
-মা তো বলেছে এখন থেকে আমরা ওখনেই থাকবো।
-বাপি তো ওখানে গিয়ে থাকবে না।
-তুমি বম্বে থেকে ফিরলে ওখানে গিয়ে থাকবে।
-তোর মাতো থাকতে দেবে না। ওটা তো আমার বাড়ি না আমি কিভাবে থাকবো?
-ওটা কার বাড়ি?
-একটা আঙ্কেলের।
-ওই যে আঙ্কেলটা যাকে বললাম শক্তিমানের খেলনা দিতে, দিতে পারলো না?
-হ্যাঁ।
-আঙ্কেলটা ভালো না।
-কেন?
-ভালো না।
-আমি ভালো?
-তুমি খুব ভালো।
-আমি তো তোকে বকা দি। আঙ্কেল তো বকা দেয় না।
-না তাও।
-কি করলো যে তোর এমন না পসন্দ হয়ে গেলো এই কদিনেই?
-দেওয়ালে হাত দিতে বারন করে, কিছু ড্রয়িং করতে পারবোনা, বলে রঙ লেগে যাবে।
- মা কিছু বলে না।
-মা আঙ্কেলটা চলে গেলে কাঁদে।
বসার ঘরের কথা মনে পরে যায়, যতদুর হাত যায় সে একেছে। প্রথম প্রথম তুলি খুব বকতো ওকে। শুঁচিবাই তো। আমি তুলিকে বলেছিলাম, বাচ্চারা এরকমই করে, আর যেন না বকে ওকে। শালা হারামির বাচ্চা, একটা বাচ্চার ওপরেও কত নিয়ম কানুন।
-তাহলে তুই আমার বাড়িতে চলে আয়, এখানে যত খুশি আঁকবি।
-মা তো আসতে চাইছেনা। বাড়ি যাবো বললে বকে।
-এবার গিয়ে বলবি আর বকবেনা।
-তাই। তাহলে চলো তুমি আর আমি চলে যাই, মা পরে আসবে।
-নারে এই আঙ্কেলটা তোকে নিয়ে এসেছে, আবার তোকে নিয়ে যাবে মার কাছে। নাহলে মা তোকে দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট পাবে। তুই বরঞ্চ মাকে নিয়ে চলে আয়, বলবি বাড়িতে থাকবো, আর আমি বম্বে চলে যাবো।
-তুমি থাকবেনা?
-না। তুই আর তোর মা থাকবি।
-তাহলে খেলনা কে দেবে?
-কেন দাদু দেবে।
-ও দাদু!!
-হ্যাঁ।
-মাকে বলবি বাবা বলেছে বেশি নক্কাছক্কা না করতে সোজা বাড়ি চলে আসতে।
-নক্কা ছক্কা।
-তুই বলিস না গিয়ে মা ঠিক বুঝবে। ওটা বড়দের ভাষা।
ধিরে ধিরে সময় হয়ে গেলো।
সেই বেঞ্চেই বসে সই করে দিলাম বিচ্ছেদের। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা যদি ছেলের কথায় মার মন গলে। এখন থেকেই তো চোখের জল বেরোচ্ছে।
সেই উকিল আবার যোগাযোগ করলো আমার সাথে। দাদা একবার তো আসতে হবে কোর্টে। জাজের সামনে বলতে হবে আপনি ও বৌদি স্বেচ্ছায় আলাদা হতে চাইছেন।
-আমিতো চাইছিনা? আপনার বোউদি চাইছে, আর যদি না যাই তাহলে কি হবেনা?
না আজকাল শুধু সই দিয়ে হয় না। জাজ মুখোমুখি কথা বলতে চায়। দরকার হলে ম্যারেজ কাউন্সেলরের কাছে রেফার করে, যদি জাজ বোঝে যে সামান্য ব্যাপার এটা।
- ওঃ। তা কবে যেতে হবে। পরশু দিন আড়াইটের সময়।
- ঠিক আছে চলে আসবো।
দাড়ি কেটে ফ্রেশ হয়ে ভালো একটা জিন্স আর টি শার্ট পরলাম। বহুদিন পরে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। অদ্ভুত ফিলিংস মনের মধ্যে। যাচ্ছি বিচ্ছেদের জন্যে। এসবের কি দরকার ছিলো। এই টি শার্টটা পরলে তুলি খুব রেগে যেত। কালারটা নাকি মেয়েদের আকর্ষন করে। আমি কাকে আকর্ষন করার জন্যে পরলাম।
আবার খুলে ফেললাম, সাদা একটা টি শার্ট গলিয়ে নিলাম। সাদা শান্তির প্রতিক।
আমিই আগে গিয়ে পৌছালাম।
তুলি বেশ কিছুক্ষন পরে এলো। সঙ্গে রাজু, রাজুর বাবা আর মা। আজকেই বিয়ে করিয়ে দেবে নাকিরে। আমাকে এমন ভাবে দেখছে যেন গিলে খেয়ে নেবে। বহুকষ্টে ওদের এতদিনের ইচ্ছে পুরন হতে চলেছে। গাইয়ের সঙ্গে না হয় বাছুরও রইলো।
আমাদের নিয়ে একটা ঘরে গেলো। তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। জাজের সামনে শুধু আমি আর তুলি বসবো। এখনো পর্যন্ত আমার এই অধিকার আছে তাহলে। রাজু তুলিকে নিচু গলায় কিছু বলে চলেছে। হাল্কা যা শুনতে পাচ্ছি তাতে ও বলছে, যা সত্যি তাই বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি সিগেরেট বের করে ধরিয়ে হাটতে শুরু করলাম, সবার আগে। রাজুর মাকে দেখে মনে হোলো সিগেরেটের ধোয়ায় হার্টফেল করে যাবে। ওর বাবা ফোনে কাকে বলছে যে ওরা পৌছে গেছে। ওর বাবার কোন বাবা হবে। কি বালের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আমার, ফেউয়ার মত কোর্টের চক্কর মারছে। লজ্জা সরম বলে কিছু নেই। আমার ভাগ্য খারাপ তাই ওরা সুস্থ আছে।
আমার হাড়ানোর কিছু নেই। এর পরের স্টেপ ভেবে নিয়েছি। আরে নাঃ আর সুইসাইড না। ওটা একবার ট্রাই করেছি। সফল যখন হইনি, তখন ওতে হাত পাকানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার।
জাজের সামনে ভালো ছেলের মত গিয়ে বসলাম। মহিলা জাজ। মুখটা দেখে মনে হয় খুব দয়ালু, ধার্মিক প্রকৃতির।
আমাদের নাম ধরে জিজ্ঞেস করলো কে কোন জন।
-সেপারেশান চাইছেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। তুলিও।
-কারো কোন অভিযোগ নেই? তাহলে এসব করার কি দরকার?
আমি তুলিকে বললাম ‘তুমি বলো, তোমার তো বলার কথা, সব সত্যি কথায় বলো।’
জাজ হেঁসে বললো ‘তাহলে আপনি দোষী’ তুলির দিকে তাকিয়ে বললো ‘কই বলুন, আপনি যা বলবেন সেটা সত্যি বলেই ধরা হবে। আদালতে কেউ মিথ্যে বলেনা। আর আমরা তিনজন ছাড়া কেউ জানতে পারবেনা এই কথা।
তুলি তাও চুপ করে রইলো। রাজুর উকিল হঠাত করে এসে ঢুকলো। জাজ মনে হোলো একটু বিরক্তই হোলো।
-মিঃ বকশি, প্লিজ পরের বার নক করবেন। এমনিতে চারপাশে কেমন আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন তো।
-সরি ম্যাডাম, আসলে আমি ম্যাডামের এপয়ন্টেড এডভোকেট।
-আপনি ইচ্ছে করলে থাকতে পারেন, কিন্তু মার মনে হয়না আমি এমন কিছু জিজ্ঞেস করেছি যেটা উনি না বলে আপনি বলতে পারবেন।
সে নির্লজ্জের মতন রয়ে গেলো সেখানে।
-হ্যাঁ সুচন্দ্রা দেবি বলুন। নামটা দেখলাম কাগজ থেকে দেখে নিলেন।
তুলি তাও চুপ করেই রইলো।
আমি মুখ খুললাম, ‘অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে পারি?’
চোখের ইশারায় আমাকে অনুমতি দিলেন উনি।
-আমার বিরুদ্ধে ওর অনেক অভিযোগ আছে। সেটা হয়তো ও বলতে লজ্জা পাচ্ছে, আর কারো সামনে বলা সম্ভবও না। আমি সব অভিযোগ সত্যি বলে মেনে নিচ্ছি। এরপর কি ওকে কিছু বলতে হবে? ওর পক্ষে আমার সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব না। ওর দোষ নেই কোণ আমারই দোষ। তুলি মাথা তুলে আমাকে অবাক হয়ে দেখছে। আমি ওকে দেখছিনা, আমি বলে চলেছি। আমার যতটুকু ধারনা আছে এ ব্যাপারে তাতে যদি ব্যাপারটা এইরকম হয় যে দুজনের সন্মতিক্রমে আলাদা থাকতে চাইছি, তাহলে কি এত প্রশ্ন আসবে?
-আপনি? অভিষেক মুখার্জি। (আবার কাগজ দেখে বললেন), দেখুন বিয়ে যখন করেছিলেন তখন তো বোঝেনই এর গুরুত্ব কি? ভাঙ্গতে তো এক মুহুর্ত। কিন্তু আপনারা কি চান আরেকবার দুজনকেই সুযোগ দিতে।
উকিল বলে উঠলো ‘ম্যাডাম এরা দুজনে নিভৃতে আলোচনা করেছে, এখানে আসার আগে, সুতরাং আর মনে হয় না এসবের দরকার আছে।’
-ও আপনারা কথা বলেছেন তাহলে নিজেদের মধ্যে। ঠিক আছে তাহলে এই কয়েকটা কাগজে সই করে দিন।
-একটা কথা ছিলো ম্যাডাম।
-একটা কেন অনেক কথা বলতে পারেন কিন্তু সেটা সই করার আগে, পরে আর নয়।
-আমাদের ছেলের কি হবে?
-ছেলের কথা কোথায় বলেন নি তো? কি ব্যাপার মিঃ বকশি। বিচ্ছেদের আইন নতুন করে পরতে হবে নাকি আপনার? সে নিশ্চয় নাবালক?
-হ্যাঁ ম্যাডাম।
-তো এখানে চালানে লেখেন নি কেন?
আগে কাগজ ঠিক করে আনুন তারপর আবার ডেট দেবো। অযথা কোর্টের সময় নষ্ট করাবেন না। এতবড় ইস্যু চেপে রেখে দিলেন।
বাইরেই সব দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, উকিল বলছেন, উনার স্বামি ছেলের কথা তুলবে যে আমি কি করে বুঝবো?
রাজুর মার গলা পেলাম ‘এসব কিছুই না বাহানা, আমাদের হ্যারাস করার। এখানে ভদ্রলোক আসে নাকি? ছেলের দরদ উথলে উঠেছে...।’
আমি থেমে গেলাম ঘুরে তাকালাম ওদের দিকে। জোঁকের মুখে নুন পরেছে যেন। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে রাজুর গালে সপাটে এক থাপ্পর মারলাম। চারিপাশে লোকজন থমকে দারালো। মুহুর্তের জন্যে সব চুপ।
রাজুর মা বাবা হাউমাউ করে উঠলো।
আমি বললাম “ছেলের জন্যে পিরিত উথলে ওঠে কিভাবে দেখলেন? তাও এই ছেলে যে মেয়েছেলের অধম, অন্যের বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে পুরুষত্বের প্রমান দিচ্ছে যে, আসল যায়গায় নপুংশক’
‘আমি তোকে লকাপে ঢুকিয়ে দেবো জানোয়ার কোথাকার...।’ রাজুর বাবা চিৎকার করে উঠলো।
‘তুমি আমার বাল ছিরবে? লকাপে আমি তোমাকে ঢুকিয়ে দেবো। ভাবছো আমি কিছু খোঁজ রাখিনা তাইনা? এক জমি দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে কবার লোন নিয়েছো? আর এইযে নট্য কোমাপ্নির মাসিমা, ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্যে লাফালাফি করছেন, বিয়ের পর তা টিকবে তো? আসল জায়গায় তো জোর নেই। ভদ্র ভাবে আছি, তাই নাহলে সব কিছু নিয়ে এমন টান দেবো বুঝতে পারবেন’
সারারাত কাঁদলাম। ভাবলাম ওকে দেখে আর মায়া বাড়াবো কেন? কিন্তু সেটা আক্কেলের কথা, মন তো অপত্য স্নেহে ব্যাকুল।
পিয়ালের জন্যে অনেক চকোলেত আর ক্যান্ডি নিলাম। যেগুলো ও পছন্দ করে। সেই গাড়িটাই ওকে নিয়ে এলো। সঙ্গে ধোপদুরস্ত পোষাক পরা এক ভদ্রলোক নামলেন। বুঝলাম ইনিই উকিল। আমাকে দেখে পিয়ালের খুব একটা ভাবান্তর দেখলাম না। আমি গিয়ে ওর হাত ধরলাম। রক্ত যেন ঝিলিক মেরে উঠলো। গলার কাছে, কান্না আটকে আছে। তুলতুলে নরম হাত নিয়ে আমি আর তুলি কত খেলেছি, ও ঘুমাতো আর আমরা দেখতাম ওর ছোট ছোট হাত আর পা গুলো, খালি বলতাম দেখো কয়টুক কয়টুক আঙ্গুল।
আমি পিয়ালের হাত ধরে ওকে পার্কের ভিতরে নিয়ে গেলাম, পিছন পিছন সেই উকিল ভদ্রলোক আসছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে চিনতে পারছো?
-তুমি বাপি তো। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি।
-চিনতে পেরেছিস...। বাপির কাছে আস্তে ইচ্ছে করছিলো না?
-না তুমি আমার খেলনা দাও নি। আমি খুব রাগ করেছি।
- কে বললো আমি খেলনা দিই নি।
-কেন সুমতি আন্টি।
- ও বলেছে যে আমি তোর খেলনা দিতে চাইনি?
-হ্যাঁ।
-আমি বলেছি যে তুই এসে যেন খেলে যাস, আর ও গিয়ে এই বলল তোকে, দাড়া পাই একবার ব্যাটাকে?
-ব্যাটা কেন? ও তো লেডী।
- ও সরি বাবা ভুল হয়ে গেছে।
-দাদুর কি হয়েছে বাপি?
-কেন কিছু হয়নি তো?
- ঐ যে আন্টি টা বলছিলো দাদুর কি হয়েছে আমি কাছে গেলে নাকি আমাকেও পোকা ধরবে?
-ভুল বলেছে তোমাকে? আন্টি ভুল বলেছে। তুমি দাদুর সাথে কথা বলোনি বলে দাদু খুব কেঁদেছে।
-আমি দাদুকে ফোন করে সরি বলে দেবো?
-কেন তুমি দাদুর সাথে দেখা করবেনা?
-না। তুমি আর দাদু তো চলে যাচ্ছো?
-কোথায়? কে বললো?
-ওই যে আঙ্কেলটা বললো? তুমি নাকি অফিসের কাজে বম্বে যাচ্ছো সাথে দাদুকে নিয়ে যাচ্ছো?
আমি উকিলের দিকে ঘুরে তাকালাম।
সাফাই দেওয়ার সুরে উনি বললেন।
-দোষ নেবেন না, এটা তো আমার পেশা। এসব না বললে ওকে রাখা তো মুস্কিল হবে।
-রাখার কি দরকার। ও বেছে নিক না কার কাছে থাকবে। জোর করে বাচ্চার ওপরে কিছু চাপানো কি ঠিক? এমনও তো হতে পারে যে আমাদের সেপারেশানের পরেও আমরা বন্ধুর মত থাকলাম। পিয়াল যাতায়াত করলো বা মিলিয়ে মিশিয়ে থাকলো।
-দেখুন সে ব্যাপারে আপত্তি আছে। ও তো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর মিঃ গুপ্তা চান না এটা।
- কে মিঃ গুপ্তা?
-কেন আপনি যানেন না? যার সাথে আপনার বর্তমান মিসেস ভবিশ্যতে ঘর বাঁধবে?
আমি চুপ করে গেলাম।
-না আমি জানতাম না। তবে এটাই তো স্বাভাবিক। নাহলে কেউ আর কাউকে কেন আশ্রয় দেবে।
-এই আমাদের পেশার যন্ত্রনা যানেন। মানবিকতা বোধ থাকলে আপনাকে কষ্টই পেতে হবে। দেখতে তো পাচ্ছি আপনাদের বাপ ছেলের কি রিলেশান। তবুও আমার দায়িত্ব আপনাকে পাহাড়া দেওয়া যাতে আপনি বাচ্চার মন দুর্বল করে না দেন।
-হা হা। যাক ভালো লাগলো আপনার সাথে পরিচয় হয়ে, যদিও আমরা ক্ষনিকের অতিথি।
- আমি আপনাকে চিনি দাদা। আমি ছোটবেলায় আপনাদের পাড়াতেই ভাড়া থাকতাম। পরে ভবানিপুরে চলে আসি।
-ওঃ ভালো। ভালো লাগলো শুনে।
-আপনারা কথা বলুন। আমি বাইরে গিয়ে একটু সিগেরেট ফুঁকে আসি। কিন্তু ওকে বলতে বলবেন যে আমি কাছেই ছিলাম।
-বাচ্চাকে কি ভাবে মিথ্যে বলতে শেখায় বলুন তো। ওরা কি গুছিয়ে বলতে পারে? এই দেখুন এসেই তো গরগর করে সব পেটের কথা বলে যাচ্ছে।
-হা হা। ঠিক আছে আমি মাঝে মাঝে এসে আপনাদের বিরক্ত করবো।
- আপনি বসতেও পারেন, আমি আর ও কি এমন গোপন কথা বলবো?
-বাপি আমার একটা গোপন কথা আছে।
-বাব্বা তোরও গোপন কথা আছে?
-মাথা নিচু করো কানে কানে বলবো।
আমি বললাম দাড়া, তোকে কানের কাছে নিয়ে আসি। ওকে কোলে তুলে একটা বেঞ্চের ওপর দাড় করিয়ে দিলাম। মুখের কাছে কান নিয়ে গেলাম।
ফিস ফিস করে বলার চেষ্টা করলেও বেস জোরেই বলে ফেললো, একটা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির দাবি।
আমি ফিস ফিস করে বললাম ‘এটা গোপন কথা?’
‘হ্যাঁ, মা বলেছে কিছু না চাইতে তোমার থেকে।’
‘তুই মাকে গিয়ে বলবি, যে তুই আমার থেকে চেয়েছিস, আর বলবি বাবা এত গরিব না যে তোকে কিছু দিতে পারবেনা। কানে কানে বলবি কিন্তু।’
উকিল সাহেব চলে গেলো ফুঁকতে অথবা বাপ ছেলেকে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ করে দিতে।
-কিরে তোর বাপিকে ছেরে থাকতে ভালো লাগে?
-হ্যাঁ।
-ভালো লাগে?
-হ্যাঁ। তুমি বকা দাও।
-তুই দুষ্টুমি করলে বকা দেবোনা। কিন্তু চকোলেট তো আর মা কিনে আনেনা, খেলনাও তো আমিই কিনে আনি।
-তুমি তো বম্বেতে ছিলে। তাই তো আমরা ঘুরতে এসেছি এখানে।
-এখন তো চলে এসেছি, তো চল বাড়িতে থাকবি?
-মা তো বলেছে এখন থেকে আমরা ওখনেই থাকবো।
-বাপি তো ওখানে গিয়ে থাকবে না।
-তুমি বম্বে থেকে ফিরলে ওখানে গিয়ে থাকবে।
-তোর মাতো থাকতে দেবে না। ওটা তো আমার বাড়ি না আমি কিভাবে থাকবো?
-ওটা কার বাড়ি?
-একটা আঙ্কেলের।
-ওই যে আঙ্কেলটা যাকে বললাম শক্তিমানের খেলনা দিতে, দিতে পারলো না?
-হ্যাঁ।
-আঙ্কেলটা ভালো না।
-কেন?
-ভালো না।
-আমি ভালো?
-তুমি খুব ভালো।
-আমি তো তোকে বকা দি। আঙ্কেল তো বকা দেয় না।
-না তাও।
-কি করলো যে তোর এমন না পসন্দ হয়ে গেলো এই কদিনেই?
-দেওয়ালে হাত দিতে বারন করে, কিছু ড্রয়িং করতে পারবোনা, বলে রঙ লেগে যাবে।
- মা কিছু বলে না।
-মা আঙ্কেলটা চলে গেলে কাঁদে।
বসার ঘরের কথা মনে পরে যায়, যতদুর হাত যায় সে একেছে। প্রথম প্রথম তুলি খুব বকতো ওকে। শুঁচিবাই তো। আমি তুলিকে বলেছিলাম, বাচ্চারা এরকমই করে, আর যেন না বকে ওকে। শালা হারামির বাচ্চা, একটা বাচ্চার ওপরেও কত নিয়ম কানুন।
-তাহলে তুই আমার বাড়িতে চলে আয়, এখানে যত খুশি আঁকবি।
-মা তো আসতে চাইছেনা। বাড়ি যাবো বললে বকে।
-এবার গিয়ে বলবি আর বকবেনা।
-তাই। তাহলে চলো তুমি আর আমি চলে যাই, মা পরে আসবে।
-নারে এই আঙ্কেলটা তোকে নিয়ে এসেছে, আবার তোকে নিয়ে যাবে মার কাছে। নাহলে মা তোকে দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট পাবে। তুই বরঞ্চ মাকে নিয়ে চলে আয়, বলবি বাড়িতে থাকবো, আর আমি বম্বে চলে যাবো।
-তুমি থাকবেনা?
-না। তুই আর তোর মা থাকবি।
-তাহলে খেলনা কে দেবে?
-কেন দাদু দেবে।
-ও দাদু!!
-হ্যাঁ।
-মাকে বলবি বাবা বলেছে বেশি নক্কাছক্কা না করতে সোজা বাড়ি চলে আসতে।
-নক্কা ছক্কা।
-তুই বলিস না গিয়ে মা ঠিক বুঝবে। ওটা বড়দের ভাষা।
ধিরে ধিরে সময় হয়ে গেলো।
সেই বেঞ্চেই বসে সই করে দিলাম বিচ্ছেদের। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা যদি ছেলের কথায় মার মন গলে। এখন থেকেই তো চোখের জল বেরোচ্ছে।
সেই উকিল আবার যোগাযোগ করলো আমার সাথে। দাদা একবার তো আসতে হবে কোর্টে। জাজের সামনে বলতে হবে আপনি ও বৌদি স্বেচ্ছায় আলাদা হতে চাইছেন।
-আমিতো চাইছিনা? আপনার বোউদি চাইছে, আর যদি না যাই তাহলে কি হবেনা?
না আজকাল শুধু সই দিয়ে হয় না। জাজ মুখোমুখি কথা বলতে চায়। দরকার হলে ম্যারেজ কাউন্সেলরের কাছে রেফার করে, যদি জাজ বোঝে যে সামান্য ব্যাপার এটা।
- ওঃ। তা কবে যেতে হবে। পরশু দিন আড়াইটের সময়।
- ঠিক আছে চলে আসবো।
দাড়ি কেটে ফ্রেশ হয়ে ভালো একটা জিন্স আর টি শার্ট পরলাম। বহুদিন পরে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। অদ্ভুত ফিলিংস মনের মধ্যে। যাচ্ছি বিচ্ছেদের জন্যে। এসবের কি দরকার ছিলো। এই টি শার্টটা পরলে তুলি খুব রেগে যেত। কালারটা নাকি মেয়েদের আকর্ষন করে। আমি কাকে আকর্ষন করার জন্যে পরলাম।
আবার খুলে ফেললাম, সাদা একটা টি শার্ট গলিয়ে নিলাম। সাদা শান্তির প্রতিক।
আমিই আগে গিয়ে পৌছালাম।
তুলি বেশ কিছুক্ষন পরে এলো। সঙ্গে রাজু, রাজুর বাবা আর মা। আজকেই বিয়ে করিয়ে দেবে নাকিরে। আমাকে এমন ভাবে দেখছে যেন গিলে খেয়ে নেবে। বহুকষ্টে ওদের এতদিনের ইচ্ছে পুরন হতে চলেছে। গাইয়ের সঙ্গে না হয় বাছুরও রইলো।
আমাদের নিয়ে একটা ঘরে গেলো। তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। জাজের সামনে শুধু আমি আর তুলি বসবো। এখনো পর্যন্ত আমার এই অধিকার আছে তাহলে। রাজু তুলিকে নিচু গলায় কিছু বলে চলেছে। হাল্কা যা শুনতে পাচ্ছি তাতে ও বলছে, যা সত্যি তাই বলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি সিগেরেট বের করে ধরিয়ে হাটতে শুরু করলাম, সবার আগে। রাজুর মাকে দেখে মনে হোলো সিগেরেটের ধোয়ায় হার্টফেল করে যাবে। ওর বাবা ফোনে কাকে বলছে যে ওরা পৌছে গেছে। ওর বাবার কোন বাবা হবে। কি বালের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আমার, ফেউয়ার মত কোর্টের চক্কর মারছে। লজ্জা সরম বলে কিছু নেই। আমার ভাগ্য খারাপ তাই ওরা সুস্থ আছে।
আমার হাড়ানোর কিছু নেই। এর পরের স্টেপ ভেবে নিয়েছি। আরে নাঃ আর সুইসাইড না। ওটা একবার ট্রাই করেছি। সফল যখন হইনি, তখন ওতে হাত পাকানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার।
জাজের সামনে ভালো ছেলের মত গিয়ে বসলাম। মহিলা জাজ। মুখটা দেখে মনে হয় খুব দয়ালু, ধার্মিক প্রকৃতির।
আমাদের নাম ধরে জিজ্ঞেস করলো কে কোন জন।
-সেপারেশান চাইছেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম। তুলিও।
-কারো কোন অভিযোগ নেই? তাহলে এসব করার কি দরকার?
আমি তুলিকে বললাম ‘তুমি বলো, তোমার তো বলার কথা, সব সত্যি কথায় বলো।’
জাজ হেঁসে বললো ‘তাহলে আপনি দোষী’ তুলির দিকে তাকিয়ে বললো ‘কই বলুন, আপনি যা বলবেন সেটা সত্যি বলেই ধরা হবে। আদালতে কেউ মিথ্যে বলেনা। আর আমরা তিনজন ছাড়া কেউ জানতে পারবেনা এই কথা।
তুলি তাও চুপ করে রইলো। রাজুর উকিল হঠাত করে এসে ঢুকলো। জাজ মনে হোলো একটু বিরক্তই হোলো।
-মিঃ বকশি, প্লিজ পরের বার নক করবেন। এমনিতে চারপাশে কেমন আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন তো।
-সরি ম্যাডাম, আসলে আমি ম্যাডামের এপয়ন্টেড এডভোকেট।
-আপনি ইচ্ছে করলে থাকতে পারেন, কিন্তু মার মনে হয়না আমি এমন কিছু জিজ্ঞেস করেছি যেটা উনি না বলে আপনি বলতে পারবেন।
সে নির্লজ্জের মতন রয়ে গেলো সেখানে।
-হ্যাঁ সুচন্দ্রা দেবি বলুন। নামটা দেখলাম কাগজ থেকে দেখে নিলেন।
তুলি তাও চুপ করেই রইলো।
আমি মুখ খুললাম, ‘অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে পারি?’
চোখের ইশারায় আমাকে অনুমতি দিলেন উনি।
-আমার বিরুদ্ধে ওর অনেক অভিযোগ আছে। সেটা হয়তো ও বলতে লজ্জা পাচ্ছে, আর কারো সামনে বলা সম্ভবও না। আমি সব অভিযোগ সত্যি বলে মেনে নিচ্ছি। এরপর কি ওকে কিছু বলতে হবে? ওর পক্ষে আমার সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব না। ওর দোষ নেই কোণ আমারই দোষ। তুলি মাথা তুলে আমাকে অবাক হয়ে দেখছে। আমি ওকে দেখছিনা, আমি বলে চলেছি। আমার যতটুকু ধারনা আছে এ ব্যাপারে তাতে যদি ব্যাপারটা এইরকম হয় যে দুজনের সন্মতিক্রমে আলাদা থাকতে চাইছি, তাহলে কি এত প্রশ্ন আসবে?
-আপনি? অভিষেক মুখার্জি। (আবার কাগজ দেখে বললেন), দেখুন বিয়ে যখন করেছিলেন তখন তো বোঝেনই এর গুরুত্ব কি? ভাঙ্গতে তো এক মুহুর্ত। কিন্তু আপনারা কি চান আরেকবার দুজনকেই সুযোগ দিতে।
উকিল বলে উঠলো ‘ম্যাডাম এরা দুজনে নিভৃতে আলোচনা করেছে, এখানে আসার আগে, সুতরাং আর মনে হয় না এসবের দরকার আছে।’
-ও আপনারা কথা বলেছেন তাহলে নিজেদের মধ্যে। ঠিক আছে তাহলে এই কয়েকটা কাগজে সই করে দিন।
-একটা কথা ছিলো ম্যাডাম।
-একটা কেন অনেক কথা বলতে পারেন কিন্তু সেটা সই করার আগে, পরে আর নয়।
-আমাদের ছেলের কি হবে?
-ছেলের কথা কোথায় বলেন নি তো? কি ব্যাপার মিঃ বকশি। বিচ্ছেদের আইন নতুন করে পরতে হবে নাকি আপনার? সে নিশ্চয় নাবালক?
-হ্যাঁ ম্যাডাম।
-তো এখানে চালানে লেখেন নি কেন?
আগে কাগজ ঠিক করে আনুন তারপর আবার ডেট দেবো। অযথা কোর্টের সময় নষ্ট করাবেন না। এতবড় ইস্যু চেপে রেখে দিলেন।
বাইরেই সব দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, উকিল বলছেন, উনার স্বামি ছেলের কথা তুলবে যে আমি কি করে বুঝবো?
রাজুর মার গলা পেলাম ‘এসব কিছুই না বাহানা, আমাদের হ্যারাস করার। এখানে ভদ্রলোক আসে নাকি? ছেলের দরদ উথলে উঠেছে...।’
আমি থেমে গেলাম ঘুরে তাকালাম ওদের দিকে। জোঁকের মুখে নুন পরেছে যেন। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে রাজুর গালে সপাটে এক থাপ্পর মারলাম। চারিপাশে লোকজন থমকে দারালো। মুহুর্তের জন্যে সব চুপ।
রাজুর মা বাবা হাউমাউ করে উঠলো।
আমি বললাম “ছেলের জন্যে পিরিত উথলে ওঠে কিভাবে দেখলেন? তাও এই ছেলে যে মেয়েছেলের অধম, অন্যের বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে পুরুষত্বের প্রমান দিচ্ছে যে, আসল যায়গায় নপুংশক’
‘আমি তোকে লকাপে ঢুকিয়ে দেবো জানোয়ার কোথাকার...।’ রাজুর বাবা চিৎকার করে উঠলো।
‘তুমি আমার বাল ছিরবে? লকাপে আমি তোমাকে ঢুকিয়ে দেবো। ভাবছো আমি কিছু খোঁজ রাখিনা তাইনা? এক জমি দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে কবার লোন নিয়েছো? আর এইযে নট্য কোমাপ্নির মাসিমা, ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্যে লাফালাফি করছেন, বিয়ের পর তা টিকবে তো? আসল জায়গায় তো জোর নেই। ভদ্র ভাবে আছি, তাই নাহলে সব কিছু নিয়ে এমন টান দেবো বুঝতে পারবেন’