01-01-2019, 04:41 PM
বাতি জ্বলে উঠছে আর নিভে যাচ্ছে। কি করবো আমি। রাজু কি সত্যি বলছে? তুলি কি স্বেচ্ছায় ওর কাছে গেছে? সজ্ঞানে কি এটা করা সম্ভব। তাহলে রাজুর ওপরে এত বিদ্বেষ কেন ছিলো ওর । তলে তলে কি ফল্গুর কোন ধারা বয়েছিলো।
ইচ্ছে করছে নিজেকে অন্য কোনোদিকে ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু আমার তো সেক্স ছাড়া আর কোন হবি নেই যে সেদিকে মনোনিবেশ করবো।
নিজের বোউকে পান্তা ভাত ভেবে, ম্যাথরের পোঁদটা বিরিয়ানি ভেবেছিলাম। কি পরিনতি হোলো আমার। হয়তো কোনদিন কাউকে বলতে পারবোনা, এই অভিজ্ঞতার কথা। জানিনা শেষে কি আছে। কিন্তু এ এক বড় শিক্ষা হোলো আমার।
জন্ডিসের দোহাই দেওয়া আছে আমার, তাই অফিস নিয়ে চিন্তা নেই। একনিষ্ঠ কর্মচারির জন্ডিস হলে, কোম্পানি তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়, যাতে সে তারাতারি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে। সেরকম অনেক মেল এসেছে, দ্রুত আরোগ্য কামনা করে। কিন্তু আমার রোগের পরিধি তো বিশাল। সেটা কিভাবে সারবে।
দুদিন কেটে গেলো। প্রায় গৃহবন্দি আমি। মাঝে একবার বেরিয়ে দু কার্টন সিগেরেট নিয়ে এলাম। এখন এটাই আমার একাকিত্বের সঙ্গি। ঘর নরকের মত হয়ে আছে। আমি অসহায়, নখ দন্ত বিহিন একদা পুরুষ সিংহ।
সানিও জানিয়ে দিলো সেরকম কিছু ও করে উঠতে পারবেনা।
এখন উপায় কি? কিভাবে তুলির খোঁজ পাবো। আর ওর যদি ডিভোর্সেরই দরকার তো ও সরাসরি যোগাযোগ করছেনা না কেন?
দুএকদিন এইভাবেই কেটে গেলো। রাজুর সাথে কথা বলার পর ভিতরের শক্তিটাই কমে গেছে। পুলিশে গিয়ে যে বলবো সেটার মত মানসিক জোর আমার নেই। আর কিই বা বলবো। আসল কথা তো বেরিয়ে যাবেই।
চিন্তা করতে করতে খেয়ালই ছিলো না যে নিচের কোলাপ্সিবল গেট দিইনি। সেটা খোলার আওয়াজে হুঁস ফিরলো। নিজের বোকামোতে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে আমি খুব শক্ত সমর্থ ভাবতাম। মনের খেয়ালে যে গেট দিইনি সেটাই ভুলে গেছি।
সুমতি দি এসেছে।
মুখ কালো করে দাড়িয়ে আছে।
‘কি ব্যাপার দিদি? টাকাপয়সা তো সব পেয়ে গেছেন।‘
‘আমি সেই জন্যে আসিনি।’
‘ও বলুন তাহলে কি দরকার?’
-কি করে বলি? আর আমাকেই পাঠালো এসব করার জন্যে? সুমতিদির মুখে আষাঢ়ের মেঘ।
-কি হয়েছে? কে পাঠালো আপনাকে?
-দিদিমনি।
-দিদিমনি!!!! মানে তুলি?
-হ্যাঁ।
আমি আকাশ থেকে পরলাম।
-তুলির দেখা কোথায় পেলেন আপনি?
-সেটা বলতে পারবো না, আমাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিলো এক জায়গায়, সেখান দিদি গাড়ির ভিতর থেকে বললো।
-কি বললো? কোথায় ডেকে পাঠিয়েছিলো? কে গাড়ি চালাচ্ছিলো?
-আমি অতসত জানিনা দাদা, তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, কিন্তু দিদি আমার হাতে ধরে বলেছে কয়েকটা খেলনা নিয়ে যেতে বাবুর জন্যে।
আমি গম্ভির হয়ে গেলাম। মনের মধ্যে সব চিন্তা মুহুর্তের মধ্যে জট পেকে গেলো। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, তুলি আমার খোঁজ করতে ওকে পাঠিয়েছে।
-খেলনা তো বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়, এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কি আছে। দরকার হলে ও নিজে আসতো।
-সে আমি তো আর জিজ্ঞেস করিনি। আর আমার মনেও নেই যে কি খেলনা বলেছে। অত নাম কি করে মনে রাখবো?
-তুমি এলে কেন তাহলে?
-বাবু নাকি ওই খেলনা গুলোর কথা খুব বলছে। খুব বায়না করছে।
-বাবু বাবার জন্যে বায়না করছে না? তুমি দেখেছো বাবুকে?
-হ্যাঁ গাড়িতেই তো ছিলো। আমাকে দেখে চিনতেই পারলো না। কত ডাকলাম।
-হুঁ
-বাবুর খেলনা গুলো নিয়ে যাই?
-না।
-তাহলে কি বলবো গিয়ে?
-বলবে এসে নিয়ে যেতে। এভাবে কিছু দেওয়া যায় না। খেলনাই হোক আর যাই হোক। তোমাকে কিভাবে যোগাযোগ করলো তুলি?
-বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলো। চিনে চিনে ঠিক দেশের বাড়িতে পোউছে গেছিলো। বলেছে দিদির ওখানে কাজ দেবে।
-সেটা কোথায়?
-সেতো জানিনা।
-কি জানো তুমি... রাস্তায় ডেকে বললো আর তুমি চলে গেলে?
-কি করবো আমাকে তো উপার্জন করেই খেতে হবে, ছেলে ছেলের বৌ তো আর দেখেনা। কাজের লোভে গেছিলাম। এখানে তো তুমি জবাব দিয়ে দিলে।
-যার জন্যে কাজ সে না থাকলে আর কি হবে কাজের লোক রেখে?
-কিজানি, ছোট মুখে বড় কথা হবে, ওই দিদিটা কিন্তু ভালো না।
-কোন দিদিটা?
-ওই যে যে দিদি এসে দিদিমনির কান ভাঙ্গিয়েছিলো, এমন সুন্দর ছবির মত সংসার, ওর কুনজরে ছারখার হয়ে গেলো। চোখে জল এসে যায়।
-সে আর কি করা যাবে। কেউ যদি অবুঝ হয় তো আমি কি করবো? সে তো নজর দিয়েছে, কিন্তু আমার ঘরের লোক পরের ঝাল খেলো কেন?
-দাদা তুমি দিদিমনির সাথে কথা বলে নিয়ে এসো না। আমরাও তো সন্তানের মা বাবা, সংসার ভাঙ্গতে দেখলে কি ভালো লাগে?
-দিদিমনি তো আমার সাথে কথায় বলতে চায়না। নিজের মর্জিতেই চলে গেলো, যে চলে যাবে বলে ঠিক করেছে, তাকে আটকাবো কি করে।
-জানিনা কি কান ভরলো দিদির, এত কেন রাগ তোমার ওপরে?
-তোমাকে বললো কিছু?
-না আমাকে আর কি বলবে। কিন্তু মেয়েছেলের মুখে হাসি থাকলেও মনের কথা বোঝা যায়। আমি তো কিছু বুঝতে পারলাম না যে দিদির শোক সন্তাপ কিছু আছে।
-তুমি কি করে বুঝলে?
-বোঝা যায় গো দাদা। তোমাকে দেখে কি আমি বুঝতে পারছিনা, তোমার মনের কথা। আর দিদিকে দেখে...।
সুমতি চলে গেলো। আমার মনের মধ্যে ঘুরছে যে তুলি ভালোই আছে আমাকে ছাড়া। আমার ছেলেও আমার কথা বলছেনা। তাহলে আমার আর কি দরকার এই পৃথিবিতে। এতদিন যাদের নিজের মনে করেছি, আজ তারাই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। থাক ভালো থাক ওরা।
কদিন ঘুমিয়েছি জানিনা। একগাদা ঘুমের ওষূধ খেয়েছিলাম, কিন্তু মৃত্যুও আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যমেরও অরুচি আমাকে নিয়ে। হয়তো এত ভালো মৃত্যু আমার জন্যে না।
দুপায়ে বিন্দুমাত্র জোর নেই যে উঠে দারাবো। প্রকৃতির নিয়মে শরিরের বর্জ্য আপনে আপ বেরিয়ে ঘরময় দুর্গন্ধ ছরিয়েছে। সেখান থেকেও সরে যাবো সেই শক্তি আমার নেই। দিনক্ষন, তারিখ, বার সব মুছে গেছে জীবন থেকে। দুর্বল শরির আরো দুর্বল হয়ে পরছে, পর পর বমি করে চলেছি, আর তার মধ্যেই শুয়ে রয়েছি। আমি কেন মরে গেলাম না। বেচে থাকাও তো এখন কষ্টকর। এই শরির নিয়ে আর কি আমি স্বাভাবিক হতে পারবো? আদৌ বিছানা থেকে উঠতে পারবো?
জানিনা বাবা কবে বাড়িতে এসেছে। সেই আমাকে উদ্ধার করে নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়েছে।
জখন চোখ খুললাম তখন সামনে একমাত্র সে বসে আছে। নিদ্রাহীন ক্লান্ত শ্রান্ত। আমি তো ওর একমাত্র সন্তান।
কয়েকদিন পরে বাড়িতে ফিরলাম। এই কদিন আমি নিজের শারিরিক অসহায়তার সাথে লরেছি। তুলির কথা মনে পরেনি। মনে মনে আনন্দ হচ্ছিলো যে যাক কিছু করে হলেও ওকে ভুলে থাকতে পেরেছি। কিন্তু বাবা কি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে?
বাড়িতেও দুদিন প্রায় ঘুমিয়েই কাটালাম। ঘুম ভাঙ্গলো বাবার হাতের ছোয়ায়। কত অসহায় লাগছে ওকে। আমি উঠে বসলাম। বাবা উঠে দাড়ালো।
আমি বাবার হাত চেপে ধরলাম, আমার চোখে ক্ষমার ভিক্ষা, শুধু শুধু উনাকে বিব্রত করার জন্যে। আমার পাশে বিছানায় বসে আমার মাথায় হাত দিলো।
-কেমন লাগছে এখন?
আমি চুপ করে রইলাম। চোখের কোনে জল এসে চোখ ভারি করে দিয়েছে।
উদাস ভাবে বাবা বললেন “তোর হয়তো অগ্নিপরীক্ষা চলছে...”
বাবা হয়তো সব জেনে গেছে। সজত্নে লুকিয়ে রাখা নিজের কুকির্তির ভান্ডার নিজের লোকের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে যে কিরকম অনুভুতি হয় সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব না। জিবনে কোন কিছুর জন্যেই মা বাবার কাছে বকুনি খাইনি। অন্যায় করার বয়েসে অন্যায় করিনি। আমার জন্যে মা বাবার মাথা কোনদিনই ঝোকেনি। আর আজকে, আমার বিকৃত কামবাইয়ের প্রভাব আমার বাবার ওপরেও এসে পরেছে। এটা আমার কাছে অগ্নিপরীক্ষা নয়, পাতাল প্রবেশ করে নিজেকে লুকোনোর পরিক্ষা।
-আমাকে কেন ফিরিয়ে আনলে?
-চলে যাওয়া কি এতই সোজা রে। তাহলে তো আমি কবেই চলে যেতাম। এটাই তো জীবন। এক সময় যে তোকে ভরিয়ে দেবে, আবার সময় আসলে সেগুলো একে একে কেড়ে নেবে। সেটা চাক্ষুষ উপলব্ধি করার জন্যেই তো মানুষের এই দির্ঘ্য আয়ু। সব তোকে দেখে যেতে হবে। আমি নাহয় উপলক্ষ্য, হঠাত চলে এলাম। না এলেও তুই থেকে থাকতিস।
-বাবা তুলি...।
-আমি সব জানি। আমি ওর সাথে দেখাও করেছি।
আমি চমকে উঠলাম। কোনোরকমে উঠে বসলাম।
-কোথায় দেখা করেছো?
-ও এখন যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে?
-কি বললো ও?
-থাক তুই সুস্থ হয়ে নে তারপর কথা হবে।
-বাবা আমার দোষ গুলো বাদ দিলে আমি কিন্তু এখনো সেই তোমারই ছেলে। আমার সব কিছু হজম করার মত ক্ষমতা আছে। আর তুমি চুপ করে থাকলে আমার শরিরের পক্ষে সেটা ভালো হবেনা। তুমি সেটা ভালো করেই জানো।
-তোর শুনে ভালো লাগবে না রে।
-ভালো কিছু হলে তো তুমি নিজে থেকেই আমাকে জানাতে। বাবা প্লিজ...।
-কি আর বলবো বল। এরপর তোর জন্যে আরো অনেক ঝরঝঞ্ঝাট অপেক্ষা করছে। তুলি আর এমুখো হবেনা।
-ঝরঝঞ্ঝাট বলতে।
-তুলি ডিভোর্স চায়।
-পিয়াল...। পিয়ালের সাথে দেখা হয়নি? তোমাকে দেখতে দেয়নি?
-বহুকষ্টে রে, বহু অনুরোধের পরে। বাবার গলা ধরে এলো, মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
-চিনতে পারেনি তোমাকে?
-হ্যাঁ চিনেছে। কিন্তু ওকে আমাদের সন্মন্ধে অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে, শিশু মন তাই গ্রহন করেছে। এক মহিলা ওকে নিয়ে এলো আমার কাছে। আমাকে দেখে চুপ করে রইলো ও। আমি অনেক ডাকলাম একবার ওকে আদর করবো বলে, তুলিও বাঁধা দিলো, ঐ মহিলাও। চলে যাওয়ার সময় পিয়াল বলছিলো, তুমি যে বলছিলে এটা পঁচা দাদু, এই দাদুই তো আমাকে ক্যাডবেরি কিনে দেয়...। আমি হাসছিলাম তুলির অপ্রস্তুত ভাব দেখে। ওকে বললাম শিশুমন বিষাক্ত কোরো না। ভালো মন্দ ও ঠিক বুঝতে পারে। আর তুমি যেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো, সেখানে আমাকে দেখে বা কোনকিছুই তো সেটা বদলাতে পারবেনা।
তুলি উত্তর দিয়েছিলো- আমার তো কোন দোষ নেই, আমি তো বিশ্বাসভঙ্গ করিনি, করেছে আপনার ছেলে। কারন তো এত কথার পরে তো আর নতুন করে কিছু বলতে হবেনা আপনাকে নিশ্চয়। আমি অনেক অনুরোধ করেছি ওকে, কিন্তু আমি জানিনা ও এতো মানসিক দৃঢ়তা কোথা থেকে পেলো।
-ওকি কোন চাপে রয়েছে। ও তো সেই গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিজের কোন গেস্ট হাউসে রয়েছে? তুমি কি জানতে পারলে কেন ও ওখানে গিয়ে উঠলো?
-নারে বাবা, আমাকেও ওর সাথে দেখা করার জন্যে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে। খুব সহজে হয়ে ওঠেনি। রিতিমত ধমকি দিতে হয়েছে বাপ ছেলেকে।
-কেন?
-ওরা দেখা করতে দেবেনা বলেছিলো। এখনো তো আইনত তুলি আমাদের ঘরের বৌ, ওর কি সাধ্য রে আমাকে আটকায়। মন্ত্রি সান্ত্রি দেখাচ্ছিলো আমাকে। আমিও দেখালাম। শুধু তুই পা পিছলে পরেছিস বলে রে। নাহলে ...।
নাহলে তো কারো ক্ষমতা ছিলো না সেটা আমি জানি। সৎ লোককে দুনিয়া ভয় খায়। তারওপর নকশাল আমলের তরুন তুর্কি। মন্ত্রি সান্ত্রি হওয়ার ওনেক সুজোগ ছিলো। কিন্তু আমি তো কুলাঙ্গার। আমার হয়ে কি করে কেউ গলা ফাটাবে।
-মনে মনে নিজেকে তৈরি কর, বিচ্ছেদের জন্যে। মন শক্ত কর যে তোর স্ত্রী সন্তানের ওপর তোর আর কোন অধিকার থাকবেনা।
-হ্যাঁ বাবা তুমি ঠিক বলেছো। কিন্তু আমি একবার তুলির সাথে সামনা সামনি কথা বলতে চায়। শেষ বারের মতন আমি পিয়ালের জন্মদিন পালন করতে চাই এই বাড়িতে। পরের দিন আমি ওদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। তুমি একবার ব্যাবস্থা করে দেবে? তুলির সাথে একবার দেখা হওয়ার খুব দরকার আমার। দোষ আমার অনেক আছে। কিন্তু আমার অনেক কাছের লোকও আমার পিছনে ছুরি মেরেছে।
-আমি বলবো তুই জাস না। তুই সহ্য করতে পারবি না। তুলি আর আমাদের কেউ না এখন। তোর মনের মধ্যে যদি ক্ষীণ আশা থাকে যে তুলি তোকে দেখে মত বদল করতে পারে তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। এর থেকে চুপচাপ কাগজ পত্রে সই করে দে। নাহলে কোর্টে ডেকে নিদারুন অপমান করবে ওরা।
-আমি তুলির এই রুপটা একবার দেখতে চাই। তুমি একবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি বললে হিতে বিপরিত হবে।
-জেদ করছিস বাবা। তাও বলছি আজকের দিনটা ভেবে দেখ। বাবা তো তোকে কোনদিন কোনো কাজে বাধা দেয়নি।
অবশেষে বাবার দৌত্যে, বাবার প্রভাবে তুলির সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। হ্যাঁ দুজনে একা, লবন হ্রদের একটা পার্কে।
গাল ভর্তি দাড়ি আমার, অজত্নে লালিত।
পার্কে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছি, এক মিনিট যেন এক ঘন্টা।
অবশেষে তুলি এলো, সাদা পোষাক পরা ধোপ দুরস্ত সোফার এসে দরজা খুলে দিলো গাড়ির, মহারানি মাটিতে পা রাখলো। আমার বুকে অদ্ভুত অনুভুতি। সুবেশা তুলির শরিরে মুখে কোন বিরহের ছাপ নেই। হয়তো এই জার্মান গাড়ীটার সাথে ওর জীবন মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু রঙ্গিন সেই দিন গুলো কি তুলি ভুলে গেছে। মেয়েরা কি এতই নিষ্ঠুর হতে পারে?
শারিরিক দুর্বলতা আমার আছেই। তাই জোরে হাটতে পারছিনা। তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাটছে। দু একটা গাছের পাতায় হাত বোলাচ্ছে নিজের মনে। দুজনেই চুপচাপ হেটে চলেছি, নিরবিলিতে কিছুক্ষন সময় কাটানোর জন্যে।
আমার মন গলে যাচ্ছে। তুলির সান্নিধ্যে। মন বলছে, আমি খালি হাতে ফিরবো না। তুলির গায়ের দামি পারফিউম মন মাতোয়ারা করে তুলেছে। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। আমি দেখিনি আগে এটা। আর ওতো কিছু নিয়ে যায়নি।
-পিয়াল কে নিয়ে এলে না?
-ও এসে কি করবে?
-না আসলে তো ক্ষতি কিছু হোতো না?
-লাভ ক্ষতি কে চিন্তা করছে।
আমি চুপ করে গেলাম তুলির রুক্ষ জবাবে।
গিয়ে একটা পুকুরের গায়ে শান বাধানো বেঞ্চে বসলাম।
একটা সিগেরেট ধরিয়ে চুপ করে রইলাম। গায়ে একটা খিমচিতে সম্বিত ফিরলো।
-চুপ করে থাকার জন্যে ডেকে এনেছো নাকি?
-আমি তো চুপ করেই থাকি, তুমিই তো বকবক করো?
-হ্যাঁ সেই জন্যে তো আমাকে মনে ধরেনি আমি এত বকবক করি বলে।
-আমাকে লজ্জা দিয়ো না তুলি। তুমি তো সব জানো। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ছিলো ফুর্তি করার ইচ্ছা। তোমাকে ঠকানোর কোন ইচ্ছে নয়। তুমি কি দেখেছো আমি কাউকে মনের কথা বলেছি তুমি ছাড়া। আর এসবের পিছনে কে তুমি জানো? দোষ তো আমার আছেই, কিন্তু আমাকে ফাঁদে ফেলেছে কে জানো?
-নিজের খোড়া গর্তে তুমি নিজে পরেছো, এর ওর দোষ দিচ্ছো কেন? কিন্তু কে ছিলো সে জার কথা বলছো?
-বিজয়া। আমার সাথে ভালো বন্ধুত্বের ভান করে তলে তলে ও তোমার আর আমার মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর নিরলস চেষ্টা করে গেছে। এমন কি ওই লোকটা যার সাথে আমার ঝামেলা হোলো, সেই অসিত না অসিম কি যেন নাম, সেও বিজয়ার ফিট করা লোক। লোকটা এইসব প্রেম বিবাহ সঙ্ক্রান্ত ব্যাপারে খবর টবর নেওয়া এসব কাজ করে। মানে গোয়েন্দা বলে নিজেকে। আর এতই যখন যানো তখন তোমাকে এটা কেন বললো না বিজয়া তোমাকে যে ওর মাও আমার সজ্জা সঙ্গিনি ছিলো।
-ইস্*। তুমি কি গো, কাজের মেয়ে, বুড়ি ছুরি কিছুই বাদ দাও নি তো। বিজয়ার মাও...।
-আমি কি বলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো তুলি। আমি অপরাধ করেছি, কিন্তু তোমার থেকে সেই শাস্তিও পাচ্ছি। আর পারছিনা আমি তোমাকে ছেরে থাকতে। আর কিছুদিন থাকলে আমি সত্যি মরে যাবো। এবার আর ঘুমের ওষুধ খাবো না। গায়ে আগুন লাগিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরবো।
-তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলে?
আমি চুপ করে রইলাম?
-আমাকে কেউ বলেনি তো, বাবা এল বললো তোমার শরির খারাপ। তুমি আত্মহত্যা...
-আমি মরে গেলে ভালো হোতো। তোমরা সবাই ভালো থাকতে পারতে, মাঝখান থেকে কোথা থেকে বাবা এসে হসপিটালে নিয়ে গেলো।
-ভালো করেছে, খুব সখ না, নিজে দোষ করবে আর টুক করে পালিয়ে যাবে, তাই না। ভালো হয়েছে, আরো শাস্তি পাওনা তোমার আছে, আরো পস্তাও। দাঁত থাকলে তার মর্জাদা দাও না...। তুলির গলায় কান্না আটকে গেলো, ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
আমি ওর হাত চেপে ধরে আমার কাছে টেনে নিলাম। আমার বুকের মধ্যে মুখ গুজে দিলো ও। আমিও পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ফেললাম ওকে আমার বুকের মাঝখানে ফিরে পেয়ে। গাল বেয়ে জল গরিয়ে পরছে আমার।
- এভাবে সিন ক্রিয়েট করে কোন লাভ নেই। তুলির রুক্ষ গলায় আমার হুঁশ ফিরলো। বুঝলাম জেগে জেগে অনেক চিন্তা করে ফেলেছি। মিষ্টি স্বপ্ন।
- এখন চোখের জল ফেলে শুধু শুধু চোখের জলের অপমান করা। আর আমি সারাদিন সময় নিয়ে আসিনি।
আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম।
- হ্যাঁ সরি।
- তারাতারি বলো কি বলবে?
- বলার তো অনেক কিছুই আছে, কিন্তু তোমার কি শোনার মত ধৈর্য্য আছে? ফাঁসির আসামিরাও তো নিজেদের পক্ষে বলার সুযোগ পায়।
- আমি বিচারক না যে আসামির কথা শুনবো। সেটা বলার অনেক যায়গা আছে। এই তুলিকে তো আমি চিনিনা। এত রুক্ষ, এত বাস্তব সন্মত কথা তুলি বলছে?
- বিচারও তুমি করলে, শাস্তিও তুমি ঠিক করলে আর বলছো তুমি কিছু না...।
- দ্যাখো কাজের কথায় আসো। কি বলতে চাও তুমি?
- আমি বলতে চাই যে ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো, সেই ভুল তো তুমি নিজেও করেছো, আমি তো সেটা তোমার অতিত ভেবে সেটা নিয়ে ভাবিই নি আর। তুমি আমাকে চিঠি লিখে তোমার মার সাথে আমার শারিরিক সম্পর্কের কথা বলেছো, তুমি ঠিকই ধরেছো? কিন্তু তুমি কি জানো কি পরিস্থিতিতে সেটা করতে হয়েছে, ওই যে তোমার রনি দাদা ছিলো, সে কি মাল ছিলো যানো? মেয়ের ব্যাবসা, তোমার মা তোমাকে ওর হাতে তুলে দিচ্ছিলো, আমি না থাকলে আজকে হয় তুমি বিষ খেয়ে মরে যেতে, নাহলে রোজ রোজ নতুন নতুন পুরুষের সাথে শুতে হোতো। তোমার মার সাথে শারিরিক সম্পর্ক না করলে তোমার মা সংসারে ফিরে আসতো না।
- এসব কথা এখন বলে লাভ কি? মাও নেই আমিও বেশ্যাবৃত্তি করছি না।
- আমি তোমাকে বলতে চাইছিনা যে আমি তোমাকে দয়া করেছি। আমি শুধু বলতে চাইছি, যে আমার চরিত্রের স্খলন কোথা থেকে শুরু।
- হ্যাঁ সেই জন্যে তো ছেলে হওয়ার আনন্দে ম্যাথরানি কে ডেকে বৌয়ের বদলে ফুর্তি করছিলে, আর কতটা নোংরা হলে মানুষ তার বর কেও সঙ্গ দেওয়ার জন্যে ডাকতে পারে।
- এরকম অনেক ঘটনায় আছে যার কোন উত্তর নেই, বিনা প্ররোচনায় হয়েছিলো। কিন্তু আমি একটাই কথা বলতে চাই, মনের দিক থেকে আমি পরিষ্কার ছিলাম আছি। ওগুলো আমার ক্ষনিকের পাঁপ। আমার মনের মধ্যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, ছিলো না আর থাকবে না।
- সেটা তো আমি আর জানিনা। জানার ইচ্ছেও নেই। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। কেউ আমাকে জোর করেনি এই সিদ্ধান্ত নিতে, তুম যদি সেটা ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভাবছো।
- ও। তাহলে এটা তোমার ফাইনাল কথা। পিয়ালের কি হবে।
- সেটা সময় হলে ভাবা যাবে। আপাতত ওর কোন সমস্যা হচ্ছেনা।
- সমস্যা হচ্ছেনা? এটা মেনে নিতে হবে, কিছু খেলনা দিয়ে বাচ্চাকে সাময়িক ভুলিয়ে রাখা যায় কিন্তু পিতৃস্নেহ কি কেউ দিতে পারে। ওর গলা তুমি বা তোমরা দাবিয়ে রেখেছো, যাতে ও মুখ দিয়ে বাবা শব্দটা না বের করতে পারে। দাদু যদি পঁচা হয় তাহলে বাবার সন্মন্ধে কি না বলছো কি জানি।
- সেটা প্রয়োজনের খাতিরে। মন থেকে কাউকেই ছোট করা হয়নি ওর সামনে। ওকে তো মানিয়ে নিতে হবে এখানে।
- এখানে মানে? ও কি এখানেই থাকবে নাকি?
- হ্যাঁ এখানেই থাকবে?
- তুমি?
- সেসব জেনে কি হবে? আর এত কথার জবাব আমি দেবো কেন?
- জবাব দিতে তুমি বাধ্য।
- মোটেও না।
- মানে? তুমি কি গায়েরজোরি করে আমার ছেলেকে আটকে রাখবে নাকি?
- ছেলে তোমার কথা ভুলে গেছে। সুতরাং ওকে ওর মত থাকতে দাও।
- এই কদিনে ভুলিয়ে দিলে? সত্যি তুমি তো ম্যাজিশিয়ান।
- জিবনে তো খারাপটা বাদ দিয়ে ভালোর সাথেই এগিয়ে যেতে হবে।
- তাই আমি খারাপ আর রাজু ভালো হয়ে গেলো।
- হ্যাঁ অন্তত ধোকা দেবে না।
- সেই হাতি গাড্ডায় পরলে চামচিকিতেও হাঁসে।
- এসব কথা আমার ভালো লাগে না।
- তোমার কি ভালো লাগে?
- সেটা বলার মত ইচ্ছে নেই আমার, সেটা শোনার যোগ্যতা থাকা দরকার।
- তাহলে আমি অযোগ্য? এতদিন পরে বুঝলে। ছেলে হওয়ার আগে বুঝলে ভালো হোতো।
- সেটা তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। আর আমার দুর্ভাগ্য যে আমি এত পরে বুঝেছি।
আমি উঠে দাড়ালাম।
- ঠিক আছে। সময় দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। চলো যাওয়া যাক। আমি চলে যাওয়ার জন্যে পা বারিয়েও বাড়াতে পারছিনা, কারন তুলি বসে আছে, ভাবলেশহীন ওর মুখ।
- কি হোলো যাবে না? সরি যাবেন না। তুলি একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। দুর্বল মন আমার মনে হোলো যেন কোথাও কিছু বলার ছিলো। চোখের কোনে কি চিকচিক করছে?
- আমি চলে যাবো, তুমি যাও।
- না এভাবে তো আপনাকে একা রেখে আমি যেতে পারিনা। যতই হোক আপনি তো অন্যের সম্পত্তি। আমি একটা সিগেরেট ধরাতে ধরাতে বললাম। সিগেরেটই কেমন যেন আমার সঙ্গি হয়ে পরেছে। একটা সিগেরেট যে কত বড় সঙ্গি সেটা আমার এ কদিনে ভালো জানা হয়ে গেছে।
তুলি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে আপনি আপনি করছি বলে। কি বলতে চায় ও?
আমি আরো বললাম ‘দেখুন, আমার আর সেই মনের জোর নেই আর শারিরিক ক্ষমতাও নেই যে আপনাকে সুরক্ষা দেবো, আর আপনি যখন অন্য কারু বাড়িতে রয়েছেন, সেখান পর্যন্ত ঠিক ঠাক পোউছে দিতে না পারলে, আমার চিন্তা থাকবে, পরবর্তিকালে কোন দোষ এলে আমি সামলাতে পারবোনা। সেই শক্তি আমার আর অবশিষ্ট নেই। সবই তো শুনেছেন। বাবা তো সব বলেছে আপনাকে। হয় আপনি কাউকে ডেকে নিন এখানে, নাহলে আমি আপনাকে ছেরে দিয়ে আসবো। তবে ট্যাক্সি করে। দামি গাড়ি আমার নেই।’
তুলি চুপ করে রইলো।
-তুমি ডিভোর্সের পেপারে সাইন করে দেবে তো?
আমি অবাক হয়ে গেলাম শুনে। এটাই কি বলতে চাইছিলো? বলা হোলো না দেখে মন খারাপ হচ্ছিলো?
আমি চুপ করে গেলাম।
-আমাকে একবার যদি পিয়ালের সাথে দেখা করতে দিতেন। এ জন্মে আর আমি দেখতে চাইতাম না। নাহলে আফশোষ থেকে যাবে।
-তাহলে কি সই করে দেবে?
-তুমি কি এখানে কাগজ এনেছো? আমি আবার তুমিতে ফিরে এলাম। যেটা অভ্যেস সেটাই তো হবে।
- না তাহলে পিয়ালের সাথে দেখা করার সময় তৈরি করে রাখবো।
-এখন থাকলে এখনই করে দিতাম। কিন্তু সরি সেটা নেই যেহেতু, তো মাকে এখনো কিছুদিন আমার অফিসিয়াল স্ত্রী হয়ে থাকতে হবে? কিন্তু পিয়াল কি আমার কাছে থাকতে পারেনা? তুমি তো নিশ্চয় নতুন জীবন শুরু করবে।
-সেটা আমি কিছু ঠিক করিনি। আমাকে কেউ কোনকিছুর জন্যে জোর করছেনা। তুমি যা ভাবছো তা নয়।
-আমি ভাবছি, তুমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলে, আর রাজুর কাছে এসে উঠলে কি করে। আমার মতে দুপায়ে দাড়ালেই তো কেউ মানুষ হয় না। ওর চরিত্র কেমন মেয়েলি সেটা তো আমি জানি। যাই হোক তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার আমি আর নাক গলাবো না। আর পিয়ালের সাথে দেখা করাটা আমার শর্ত না যে নাহলে আমি সই করবো না। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। যদি এতে তুমি ভালো থাকো তো আমার ভালো লাগবে। কি আর হবে কোর্টে গিয়ে কেস কামারি করে। সেখানে তোমার যেমন কিছু বলার আছে আমারও কিছু বলার আছে। থাক না এসব।
তুলি মাথা নিচু করে নিলো।
ইচ্ছে করছে নিজেকে অন্য কোনোদিকে ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু আমার তো সেক্স ছাড়া আর কোন হবি নেই যে সেদিকে মনোনিবেশ করবো।
নিজের বোউকে পান্তা ভাত ভেবে, ম্যাথরের পোঁদটা বিরিয়ানি ভেবেছিলাম। কি পরিনতি হোলো আমার। হয়তো কোনদিন কাউকে বলতে পারবোনা, এই অভিজ্ঞতার কথা। জানিনা শেষে কি আছে। কিন্তু এ এক বড় শিক্ষা হোলো আমার।
জন্ডিসের দোহাই দেওয়া আছে আমার, তাই অফিস নিয়ে চিন্তা নেই। একনিষ্ঠ কর্মচারির জন্ডিস হলে, কোম্পানি তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়, যাতে সে তারাতারি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে। সেরকম অনেক মেল এসেছে, দ্রুত আরোগ্য কামনা করে। কিন্তু আমার রোগের পরিধি তো বিশাল। সেটা কিভাবে সারবে।
দুদিন কেটে গেলো। প্রায় গৃহবন্দি আমি। মাঝে একবার বেরিয়ে দু কার্টন সিগেরেট নিয়ে এলাম। এখন এটাই আমার একাকিত্বের সঙ্গি। ঘর নরকের মত হয়ে আছে। আমি অসহায়, নখ দন্ত বিহিন একদা পুরুষ সিংহ।
সানিও জানিয়ে দিলো সেরকম কিছু ও করে উঠতে পারবেনা।
এখন উপায় কি? কিভাবে তুলির খোঁজ পাবো। আর ওর যদি ডিভোর্সেরই দরকার তো ও সরাসরি যোগাযোগ করছেনা না কেন?
দুএকদিন এইভাবেই কেটে গেলো। রাজুর সাথে কথা বলার পর ভিতরের শক্তিটাই কমে গেছে। পুলিশে গিয়ে যে বলবো সেটার মত মানসিক জোর আমার নেই। আর কিই বা বলবো। আসল কথা তো বেরিয়ে যাবেই।
চিন্তা করতে করতে খেয়ালই ছিলো না যে নিচের কোলাপ্সিবল গেট দিইনি। সেটা খোলার আওয়াজে হুঁস ফিরলো। নিজের বোকামোতে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে আমি খুব শক্ত সমর্থ ভাবতাম। মনের খেয়ালে যে গেট দিইনি সেটাই ভুলে গেছি।
সুমতি দি এসেছে।
মুখ কালো করে দাড়িয়ে আছে।
‘কি ব্যাপার দিদি? টাকাপয়সা তো সব পেয়ে গেছেন।‘
‘আমি সেই জন্যে আসিনি।’
‘ও বলুন তাহলে কি দরকার?’
-কি করে বলি? আর আমাকেই পাঠালো এসব করার জন্যে? সুমতিদির মুখে আষাঢ়ের মেঘ।
-কি হয়েছে? কে পাঠালো আপনাকে?
-দিদিমনি।
-দিদিমনি!!!! মানে তুলি?
-হ্যাঁ।
আমি আকাশ থেকে পরলাম।
-তুলির দেখা কোথায় পেলেন আপনি?
-সেটা বলতে পারবো না, আমাকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিলো এক জায়গায়, সেখান দিদি গাড়ির ভিতর থেকে বললো।
-কি বললো? কোথায় ডেকে পাঠিয়েছিলো? কে গাড়ি চালাচ্ছিলো?
-আমি অতসত জানিনা দাদা, তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে, কিন্তু দিদি আমার হাতে ধরে বলেছে কয়েকটা খেলনা নিয়ে যেতে বাবুর জন্যে।
আমি গম্ভির হয়ে গেলাম। মনের মধ্যে সব চিন্তা মুহুর্তের মধ্যে জট পেকে গেলো। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, তুলি আমার খোঁজ করতে ওকে পাঠিয়েছে।
-খেলনা তো বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়, এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার কি আছে। দরকার হলে ও নিজে আসতো।
-সে আমি তো আর জিজ্ঞেস করিনি। আর আমার মনেও নেই যে কি খেলনা বলেছে। অত নাম কি করে মনে রাখবো?
-তুমি এলে কেন তাহলে?
-বাবু নাকি ওই খেলনা গুলোর কথা খুব বলছে। খুব বায়না করছে।
-বাবু বাবার জন্যে বায়না করছে না? তুমি দেখেছো বাবুকে?
-হ্যাঁ গাড়িতেই তো ছিলো। আমাকে দেখে চিনতেই পারলো না। কত ডাকলাম।
-হুঁ
-বাবুর খেলনা গুলো নিয়ে যাই?
-না।
-তাহলে কি বলবো গিয়ে?
-বলবে এসে নিয়ে যেতে। এভাবে কিছু দেওয়া যায় না। খেলনাই হোক আর যাই হোক। তোমাকে কিভাবে যোগাযোগ করলো তুলি?
-বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলো। চিনে চিনে ঠিক দেশের বাড়িতে পোউছে গেছিলো। বলেছে দিদির ওখানে কাজ দেবে।
-সেটা কোথায়?
-সেতো জানিনা।
-কি জানো তুমি... রাস্তায় ডেকে বললো আর তুমি চলে গেলে?
-কি করবো আমাকে তো উপার্জন করেই খেতে হবে, ছেলে ছেলের বৌ তো আর দেখেনা। কাজের লোভে গেছিলাম। এখানে তো তুমি জবাব দিয়ে দিলে।
-যার জন্যে কাজ সে না থাকলে আর কি হবে কাজের লোক রেখে?
-কিজানি, ছোট মুখে বড় কথা হবে, ওই দিদিটা কিন্তু ভালো না।
-কোন দিদিটা?
-ওই যে যে দিদি এসে দিদিমনির কান ভাঙ্গিয়েছিলো, এমন সুন্দর ছবির মত সংসার, ওর কুনজরে ছারখার হয়ে গেলো। চোখে জল এসে যায়।
-সে আর কি করা যাবে। কেউ যদি অবুঝ হয় তো আমি কি করবো? সে তো নজর দিয়েছে, কিন্তু আমার ঘরের লোক পরের ঝাল খেলো কেন?
-দাদা তুমি দিদিমনির সাথে কথা বলে নিয়ে এসো না। আমরাও তো সন্তানের মা বাবা, সংসার ভাঙ্গতে দেখলে কি ভালো লাগে?
-দিদিমনি তো আমার সাথে কথায় বলতে চায়না। নিজের মর্জিতেই চলে গেলো, যে চলে যাবে বলে ঠিক করেছে, তাকে আটকাবো কি করে।
-জানিনা কি কান ভরলো দিদির, এত কেন রাগ তোমার ওপরে?
-তোমাকে বললো কিছু?
-না আমাকে আর কি বলবে। কিন্তু মেয়েছেলের মুখে হাসি থাকলেও মনের কথা বোঝা যায়। আমি তো কিছু বুঝতে পারলাম না যে দিদির শোক সন্তাপ কিছু আছে।
-তুমি কি করে বুঝলে?
-বোঝা যায় গো দাদা। তোমাকে দেখে কি আমি বুঝতে পারছিনা, তোমার মনের কথা। আর দিদিকে দেখে...।
সুমতি চলে গেলো। আমার মনের মধ্যে ঘুরছে যে তুলি ভালোই আছে আমাকে ছাড়া। আমার ছেলেও আমার কথা বলছেনা। তাহলে আমার আর কি দরকার এই পৃথিবিতে। এতদিন যাদের নিজের মনে করেছি, আজ তারাই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। থাক ভালো থাক ওরা।
কদিন ঘুমিয়েছি জানিনা। একগাদা ঘুমের ওষূধ খেয়েছিলাম, কিন্তু মৃত্যুও আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যমেরও অরুচি আমাকে নিয়ে। হয়তো এত ভালো মৃত্যু আমার জন্যে না।
দুপায়ে বিন্দুমাত্র জোর নেই যে উঠে দারাবো। প্রকৃতির নিয়মে শরিরের বর্জ্য আপনে আপ বেরিয়ে ঘরময় দুর্গন্ধ ছরিয়েছে। সেখান থেকেও সরে যাবো সেই শক্তি আমার নেই। দিনক্ষন, তারিখ, বার সব মুছে গেছে জীবন থেকে। দুর্বল শরির আরো দুর্বল হয়ে পরছে, পর পর বমি করে চলেছি, আর তার মধ্যেই শুয়ে রয়েছি। আমি কেন মরে গেলাম না। বেচে থাকাও তো এখন কষ্টকর। এই শরির নিয়ে আর কি আমি স্বাভাবিক হতে পারবো? আদৌ বিছানা থেকে উঠতে পারবো?
জানিনা বাবা কবে বাড়িতে এসেছে। সেই আমাকে উদ্ধার করে নার্সিং হোমে ভর্তি করিয়েছে।
জখন চোখ খুললাম তখন সামনে একমাত্র সে বসে আছে। নিদ্রাহীন ক্লান্ত শ্রান্ত। আমি তো ওর একমাত্র সন্তান।
কয়েকদিন পরে বাড়িতে ফিরলাম। এই কদিন আমি নিজের শারিরিক অসহায়তার সাথে লরেছি। তুলির কথা মনে পরেনি। মনে মনে আনন্দ হচ্ছিলো যে যাক কিছু করে হলেও ওকে ভুলে থাকতে পেরেছি। কিন্তু বাবা কি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে?
বাড়িতেও দুদিন প্রায় ঘুমিয়েই কাটালাম। ঘুম ভাঙ্গলো বাবার হাতের ছোয়ায়। কত অসহায় লাগছে ওকে। আমি উঠে বসলাম। বাবা উঠে দাড়ালো।
আমি বাবার হাত চেপে ধরলাম, আমার চোখে ক্ষমার ভিক্ষা, শুধু শুধু উনাকে বিব্রত করার জন্যে। আমার পাশে বিছানায় বসে আমার মাথায় হাত দিলো।
-কেমন লাগছে এখন?
আমি চুপ করে রইলাম। চোখের কোনে জল এসে চোখ ভারি করে দিয়েছে।
উদাস ভাবে বাবা বললেন “তোর হয়তো অগ্নিপরীক্ষা চলছে...”
বাবা হয়তো সব জেনে গেছে। সজত্নে লুকিয়ে রাখা নিজের কুকির্তির ভান্ডার নিজের লোকের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে যে কিরকম অনুভুতি হয় সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব না। জিবনে কোন কিছুর জন্যেই মা বাবার কাছে বকুনি খাইনি। অন্যায় করার বয়েসে অন্যায় করিনি। আমার জন্যে মা বাবার মাথা কোনদিনই ঝোকেনি। আর আজকে, আমার বিকৃত কামবাইয়ের প্রভাব আমার বাবার ওপরেও এসে পরেছে। এটা আমার কাছে অগ্নিপরীক্ষা নয়, পাতাল প্রবেশ করে নিজেকে লুকোনোর পরিক্ষা।
-আমাকে কেন ফিরিয়ে আনলে?
-চলে যাওয়া কি এতই সোজা রে। তাহলে তো আমি কবেই চলে যেতাম। এটাই তো জীবন। এক সময় যে তোকে ভরিয়ে দেবে, আবার সময় আসলে সেগুলো একে একে কেড়ে নেবে। সেটা চাক্ষুষ উপলব্ধি করার জন্যেই তো মানুষের এই দির্ঘ্য আয়ু। সব তোকে দেখে যেতে হবে। আমি নাহয় উপলক্ষ্য, হঠাত চলে এলাম। না এলেও তুই থেকে থাকতিস।
-বাবা তুলি...।
-আমি সব জানি। আমি ওর সাথে দেখাও করেছি।
আমি চমকে উঠলাম। কোনোরকমে উঠে বসলাম।
-কোথায় দেখা করেছো?
-ও এখন যেখানে আছে, সেখানে গিয়ে?
-কি বললো ও?
-থাক তুই সুস্থ হয়ে নে তারপর কথা হবে।
-বাবা আমার দোষ গুলো বাদ দিলে আমি কিন্তু এখনো সেই তোমারই ছেলে। আমার সব কিছু হজম করার মত ক্ষমতা আছে। আর তুমি চুপ করে থাকলে আমার শরিরের পক্ষে সেটা ভালো হবেনা। তুমি সেটা ভালো করেই জানো।
-তোর শুনে ভালো লাগবে না রে।
-ভালো কিছু হলে তো তুমি নিজে থেকেই আমাকে জানাতে। বাবা প্লিজ...।
-কি আর বলবো বল। এরপর তোর জন্যে আরো অনেক ঝরঝঞ্ঝাট অপেক্ষা করছে। তুলি আর এমুখো হবেনা।
-ঝরঝঞ্ঝাট বলতে।
-তুলি ডিভোর্স চায়।
-পিয়াল...। পিয়ালের সাথে দেখা হয়নি? তোমাকে দেখতে দেয়নি?
-বহুকষ্টে রে, বহু অনুরোধের পরে। বাবার গলা ধরে এলো, মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
-চিনতে পারেনি তোমাকে?
-হ্যাঁ চিনেছে। কিন্তু ওকে আমাদের সন্মন্ধে অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে, শিশু মন তাই গ্রহন করেছে। এক মহিলা ওকে নিয়ে এলো আমার কাছে। আমাকে দেখে চুপ করে রইলো ও। আমি অনেক ডাকলাম একবার ওকে আদর করবো বলে, তুলিও বাঁধা দিলো, ঐ মহিলাও। চলে যাওয়ার সময় পিয়াল বলছিলো, তুমি যে বলছিলে এটা পঁচা দাদু, এই দাদুই তো আমাকে ক্যাডবেরি কিনে দেয়...। আমি হাসছিলাম তুলির অপ্রস্তুত ভাব দেখে। ওকে বললাম শিশুমন বিষাক্ত কোরো না। ভালো মন্দ ও ঠিক বুঝতে পারে। আর তুমি যেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো, সেখানে আমাকে দেখে বা কোনকিছুই তো সেটা বদলাতে পারবেনা।
তুলি উত্তর দিয়েছিলো- আমার তো কোন দোষ নেই, আমি তো বিশ্বাসভঙ্গ করিনি, করেছে আপনার ছেলে। কারন তো এত কথার পরে তো আর নতুন করে কিছু বলতে হবেনা আপনাকে নিশ্চয়। আমি অনেক অনুরোধ করেছি ওকে, কিন্তু আমি জানিনা ও এতো মানসিক দৃঢ়তা কোথা থেকে পেলো।
-ওকি কোন চাপে রয়েছে। ও তো সেই গুপ্তা ইন্ডাস্ট্রিজের কোন গেস্ট হাউসে রয়েছে? তুমি কি জানতে পারলে কেন ও ওখানে গিয়ে উঠলো?
-নারে বাবা, আমাকেও ওর সাথে দেখা করার জন্যে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে। খুব সহজে হয়ে ওঠেনি। রিতিমত ধমকি দিতে হয়েছে বাপ ছেলেকে।
-কেন?
-ওরা দেখা করতে দেবেনা বলেছিলো। এখনো তো আইনত তুলি আমাদের ঘরের বৌ, ওর কি সাধ্য রে আমাকে আটকায়। মন্ত্রি সান্ত্রি দেখাচ্ছিলো আমাকে। আমিও দেখালাম। শুধু তুই পা পিছলে পরেছিস বলে রে। নাহলে ...।
নাহলে তো কারো ক্ষমতা ছিলো না সেটা আমি জানি। সৎ লোককে দুনিয়া ভয় খায়। তারওপর নকশাল আমলের তরুন তুর্কি। মন্ত্রি সান্ত্রি হওয়ার ওনেক সুজোগ ছিলো। কিন্তু আমি তো কুলাঙ্গার। আমার হয়ে কি করে কেউ গলা ফাটাবে।
-মনে মনে নিজেকে তৈরি কর, বিচ্ছেদের জন্যে। মন শক্ত কর যে তোর স্ত্রী সন্তানের ওপর তোর আর কোন অধিকার থাকবেনা।
-হ্যাঁ বাবা তুমি ঠিক বলেছো। কিন্তু আমি একবার তুলির সাথে সামনা সামনি কথা বলতে চায়। শেষ বারের মতন আমি পিয়ালের জন্মদিন পালন করতে চাই এই বাড়িতে। পরের দিন আমি ওদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। তুমি একবার ব্যাবস্থা করে দেবে? তুলির সাথে একবার দেখা হওয়ার খুব দরকার আমার। দোষ আমার অনেক আছে। কিন্তু আমার অনেক কাছের লোকও আমার পিছনে ছুরি মেরেছে।
-আমি বলবো তুই জাস না। তুই সহ্য করতে পারবি না। তুলি আর আমাদের কেউ না এখন। তোর মনের মধ্যে যদি ক্ষীণ আশা থাকে যে তুলি তোকে দেখে মত বদল করতে পারে তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। এর থেকে চুপচাপ কাগজ পত্রে সই করে দে। নাহলে কোর্টে ডেকে নিদারুন অপমান করবে ওরা।
-আমি তুলির এই রুপটা একবার দেখতে চাই। তুমি একবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি বললে হিতে বিপরিত হবে।
-জেদ করছিস বাবা। তাও বলছি আজকের দিনটা ভেবে দেখ। বাবা তো তোকে কোনদিন কোনো কাজে বাধা দেয়নি।
অবশেষে বাবার দৌত্যে, বাবার প্রভাবে তুলির সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। হ্যাঁ দুজনে একা, লবন হ্রদের একটা পার্কে।
গাল ভর্তি দাড়ি আমার, অজত্নে লালিত।
পার্কে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছি, এক মিনিট যেন এক ঘন্টা।
অবশেষে তুলি এলো, সাদা পোষাক পরা ধোপ দুরস্ত সোফার এসে দরজা খুলে দিলো গাড়ির, মহারানি মাটিতে পা রাখলো। আমার বুকে অদ্ভুত অনুভুতি। সুবেশা তুলির শরিরে মুখে কোন বিরহের ছাপ নেই। হয়তো এই জার্মান গাড়ীটার সাথে ওর জীবন মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু রঙ্গিন সেই দিন গুলো কি তুলি ভুলে গেছে। মেয়েরা কি এতই নিষ্ঠুর হতে পারে?
শারিরিক দুর্বলতা আমার আছেই। তাই জোরে হাটতে পারছিনা। তুলি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাটছে। দু একটা গাছের পাতায় হাত বোলাচ্ছে নিজের মনে। দুজনেই চুপচাপ হেটে চলেছি, নিরবিলিতে কিছুক্ষন সময় কাটানোর জন্যে।
আমার মন গলে যাচ্ছে। তুলির সান্নিধ্যে। মন বলছে, আমি খালি হাতে ফিরবো না। তুলির গায়ের দামি পারফিউম মন মাতোয়ারা করে তুলেছে। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। আমি দেখিনি আগে এটা। আর ওতো কিছু নিয়ে যায়নি।
-পিয়াল কে নিয়ে এলে না?
-ও এসে কি করবে?
-না আসলে তো ক্ষতি কিছু হোতো না?
-লাভ ক্ষতি কে চিন্তা করছে।
আমি চুপ করে গেলাম তুলির রুক্ষ জবাবে।
গিয়ে একটা পুকুরের গায়ে শান বাধানো বেঞ্চে বসলাম।
একটা সিগেরেট ধরিয়ে চুপ করে রইলাম। গায়ে একটা খিমচিতে সম্বিত ফিরলো।
-চুপ করে থাকার জন্যে ডেকে এনেছো নাকি?
-আমি তো চুপ করেই থাকি, তুমিই তো বকবক করো?
-হ্যাঁ সেই জন্যে তো আমাকে মনে ধরেনি আমি এত বকবক করি বলে।
-আমাকে লজ্জা দিয়ো না তুলি। তুমি তো সব জানো। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ছিলো ফুর্তি করার ইচ্ছা। তোমাকে ঠকানোর কোন ইচ্ছে নয়। তুমি কি দেখেছো আমি কাউকে মনের কথা বলেছি তুমি ছাড়া। আর এসবের পিছনে কে তুমি জানো? দোষ তো আমার আছেই, কিন্তু আমাকে ফাঁদে ফেলেছে কে জানো?
-নিজের খোড়া গর্তে তুমি নিজে পরেছো, এর ওর দোষ দিচ্ছো কেন? কিন্তু কে ছিলো সে জার কথা বলছো?
-বিজয়া। আমার সাথে ভালো বন্ধুত্বের ভান করে তলে তলে ও তোমার আর আমার মধ্যে ভাঙ্গন ধরানোর নিরলস চেষ্টা করে গেছে। এমন কি ওই লোকটা যার সাথে আমার ঝামেলা হোলো, সেই অসিত না অসিম কি যেন নাম, সেও বিজয়ার ফিট করা লোক। লোকটা এইসব প্রেম বিবাহ সঙ্ক্রান্ত ব্যাপারে খবর টবর নেওয়া এসব কাজ করে। মানে গোয়েন্দা বলে নিজেকে। আর এতই যখন যানো তখন তোমাকে এটা কেন বললো না বিজয়া তোমাকে যে ওর মাও আমার সজ্জা সঙ্গিনি ছিলো।
-ইস্*। তুমি কি গো, কাজের মেয়ে, বুড়ি ছুরি কিছুই বাদ দাও নি তো। বিজয়ার মাও...।
-আমি কি বলে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো তুলি। আমি অপরাধ করেছি, কিন্তু তোমার থেকে সেই শাস্তিও পাচ্ছি। আর পারছিনা আমি তোমাকে ছেরে থাকতে। আর কিছুদিন থাকলে আমি সত্যি মরে যাবো। এবার আর ঘুমের ওষুধ খাবো না। গায়ে আগুন লাগিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরবো।
-তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলে?
আমি চুপ করে রইলাম?
-আমাকে কেউ বলেনি তো, বাবা এল বললো তোমার শরির খারাপ। তুমি আত্মহত্যা...
-আমি মরে গেলে ভালো হোতো। তোমরা সবাই ভালো থাকতে পারতে, মাঝখান থেকে কোথা থেকে বাবা এসে হসপিটালে নিয়ে গেলো।
-ভালো করেছে, খুব সখ না, নিজে দোষ করবে আর টুক করে পালিয়ে যাবে, তাই না। ভালো হয়েছে, আরো শাস্তি পাওনা তোমার আছে, আরো পস্তাও। দাঁত থাকলে তার মর্জাদা দাও না...। তুলির গলায় কান্না আটকে গেলো, ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
আমি ওর হাত চেপে ধরে আমার কাছে টেনে নিলাম। আমার বুকের মধ্যে মুখ গুজে দিলো ও। আমিও পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ফেললাম ওকে আমার বুকের মাঝখানে ফিরে পেয়ে। গাল বেয়ে জল গরিয়ে পরছে আমার।
- এভাবে সিন ক্রিয়েট করে কোন লাভ নেই। তুলির রুক্ষ গলায় আমার হুঁশ ফিরলো। বুঝলাম জেগে জেগে অনেক চিন্তা করে ফেলেছি। মিষ্টি স্বপ্ন।
- এখন চোখের জল ফেলে শুধু শুধু চোখের জলের অপমান করা। আর আমি সারাদিন সময় নিয়ে আসিনি।
আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম।
- হ্যাঁ সরি।
- তারাতারি বলো কি বলবে?
- বলার তো অনেক কিছুই আছে, কিন্তু তোমার কি শোনার মত ধৈর্য্য আছে? ফাঁসির আসামিরাও তো নিজেদের পক্ষে বলার সুযোগ পায়।
- আমি বিচারক না যে আসামির কথা শুনবো। সেটা বলার অনেক যায়গা আছে। এই তুলিকে তো আমি চিনিনা। এত রুক্ষ, এত বাস্তব সন্মত কথা তুলি বলছে?
- বিচারও তুমি করলে, শাস্তিও তুমি ঠিক করলে আর বলছো তুমি কিছু না...।
- দ্যাখো কাজের কথায় আসো। কি বলতে চাও তুমি?
- আমি বলতে চাই যে ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো, সেই ভুল তো তুমি নিজেও করেছো, আমি তো সেটা তোমার অতিত ভেবে সেটা নিয়ে ভাবিই নি আর। তুমি আমাকে চিঠি লিখে তোমার মার সাথে আমার শারিরিক সম্পর্কের কথা বলেছো, তুমি ঠিকই ধরেছো? কিন্তু তুমি কি জানো কি পরিস্থিতিতে সেটা করতে হয়েছে, ওই যে তোমার রনি দাদা ছিলো, সে কি মাল ছিলো যানো? মেয়ের ব্যাবসা, তোমার মা তোমাকে ওর হাতে তুলে দিচ্ছিলো, আমি না থাকলে আজকে হয় তুমি বিষ খেয়ে মরে যেতে, নাহলে রোজ রোজ নতুন নতুন পুরুষের সাথে শুতে হোতো। তোমার মার সাথে শারিরিক সম্পর্ক না করলে তোমার মা সংসারে ফিরে আসতো না।
- এসব কথা এখন বলে লাভ কি? মাও নেই আমিও বেশ্যাবৃত্তি করছি না।
- আমি তোমাকে বলতে চাইছিনা যে আমি তোমাকে দয়া করেছি। আমি শুধু বলতে চাইছি, যে আমার চরিত্রের স্খলন কোথা থেকে শুরু।
- হ্যাঁ সেই জন্যে তো ছেলে হওয়ার আনন্দে ম্যাথরানি কে ডেকে বৌয়ের বদলে ফুর্তি করছিলে, আর কতটা নোংরা হলে মানুষ তার বর কেও সঙ্গ দেওয়ার জন্যে ডাকতে পারে।
- এরকম অনেক ঘটনায় আছে যার কোন উত্তর নেই, বিনা প্ররোচনায় হয়েছিলো। কিন্তু আমি একটাই কথা বলতে চাই, মনের দিক থেকে আমি পরিষ্কার ছিলাম আছি। ওগুলো আমার ক্ষনিকের পাঁপ। আমার মনের মধ্যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, ছিলো না আর থাকবে না।
- সেটা তো আমি আর জানিনা। জানার ইচ্ছেও নেই। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। কেউ আমাকে জোর করেনি এই সিদ্ধান্ত নিতে, তুম যদি সেটা ভেবে থাকো তাহলে ভুল ভাবছো।
- ও। তাহলে এটা তোমার ফাইনাল কথা। পিয়ালের কি হবে।
- সেটা সময় হলে ভাবা যাবে। আপাতত ওর কোন সমস্যা হচ্ছেনা।
- সমস্যা হচ্ছেনা? এটা মেনে নিতে হবে, কিছু খেলনা দিয়ে বাচ্চাকে সাময়িক ভুলিয়ে রাখা যায় কিন্তু পিতৃস্নেহ কি কেউ দিতে পারে। ওর গলা তুমি বা তোমরা দাবিয়ে রেখেছো, যাতে ও মুখ দিয়ে বাবা শব্দটা না বের করতে পারে। দাদু যদি পঁচা হয় তাহলে বাবার সন্মন্ধে কি না বলছো কি জানি।
- সেটা প্রয়োজনের খাতিরে। মন থেকে কাউকেই ছোট করা হয়নি ওর সামনে। ওকে তো মানিয়ে নিতে হবে এখানে।
- এখানে মানে? ও কি এখানেই থাকবে নাকি?
- হ্যাঁ এখানেই থাকবে?
- তুমি?
- সেসব জেনে কি হবে? আর এত কথার জবাব আমি দেবো কেন?
- জবাব দিতে তুমি বাধ্য।
- মোটেও না।
- মানে? তুমি কি গায়েরজোরি করে আমার ছেলেকে আটকে রাখবে নাকি?
- ছেলে তোমার কথা ভুলে গেছে। সুতরাং ওকে ওর মত থাকতে দাও।
- এই কদিনে ভুলিয়ে দিলে? সত্যি তুমি তো ম্যাজিশিয়ান।
- জিবনে তো খারাপটা বাদ দিয়ে ভালোর সাথেই এগিয়ে যেতে হবে।
- তাই আমি খারাপ আর রাজু ভালো হয়ে গেলো।
- হ্যাঁ অন্তত ধোকা দেবে না।
- সেই হাতি গাড্ডায় পরলে চামচিকিতেও হাঁসে।
- এসব কথা আমার ভালো লাগে না।
- তোমার কি ভালো লাগে?
- সেটা বলার মত ইচ্ছে নেই আমার, সেটা শোনার যোগ্যতা থাকা দরকার।
- তাহলে আমি অযোগ্য? এতদিন পরে বুঝলে। ছেলে হওয়ার আগে বুঝলে ভালো হোতো।
- সেটা তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। আর আমার দুর্ভাগ্য যে আমি এত পরে বুঝেছি।
আমি উঠে দাড়ালাম।
- ঠিক আছে। সময় দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। চলো যাওয়া যাক। আমি চলে যাওয়ার জন্যে পা বারিয়েও বাড়াতে পারছিনা, কারন তুলি বসে আছে, ভাবলেশহীন ওর মুখ।
- কি হোলো যাবে না? সরি যাবেন না। তুলি একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। দুর্বল মন আমার মনে হোলো যেন কোথাও কিছু বলার ছিলো। চোখের কোনে কি চিকচিক করছে?
- আমি চলে যাবো, তুমি যাও।
- না এভাবে তো আপনাকে একা রেখে আমি যেতে পারিনা। যতই হোক আপনি তো অন্যের সম্পত্তি। আমি একটা সিগেরেট ধরাতে ধরাতে বললাম। সিগেরেটই কেমন যেন আমার সঙ্গি হয়ে পরেছে। একটা সিগেরেট যে কত বড় সঙ্গি সেটা আমার এ কদিনে ভালো জানা হয়ে গেছে।
তুলি আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে আপনি আপনি করছি বলে। কি বলতে চায় ও?
আমি আরো বললাম ‘দেখুন, আমার আর সেই মনের জোর নেই আর শারিরিক ক্ষমতাও নেই যে আপনাকে সুরক্ষা দেবো, আর আপনি যখন অন্য কারু বাড়িতে রয়েছেন, সেখান পর্যন্ত ঠিক ঠাক পোউছে দিতে না পারলে, আমার চিন্তা থাকবে, পরবর্তিকালে কোন দোষ এলে আমি সামলাতে পারবোনা। সেই শক্তি আমার আর অবশিষ্ট নেই। সবই তো শুনেছেন। বাবা তো সব বলেছে আপনাকে। হয় আপনি কাউকে ডেকে নিন এখানে, নাহলে আমি আপনাকে ছেরে দিয়ে আসবো। তবে ট্যাক্সি করে। দামি গাড়ি আমার নেই।’
তুলি চুপ করে রইলো।
-তুমি ডিভোর্সের পেপারে সাইন করে দেবে তো?
আমি অবাক হয়ে গেলাম শুনে। এটাই কি বলতে চাইছিলো? বলা হোলো না দেখে মন খারাপ হচ্ছিলো?
আমি চুপ করে গেলাম।
-আমাকে একবার যদি পিয়ালের সাথে দেখা করতে দিতেন। এ জন্মে আর আমি দেখতে চাইতাম না। নাহলে আফশোষ থেকে যাবে।
-তাহলে কি সই করে দেবে?
-তুমি কি এখানে কাগজ এনেছো? আমি আবার তুমিতে ফিরে এলাম। যেটা অভ্যেস সেটাই তো হবে।
- না তাহলে পিয়ালের সাথে দেখা করার সময় তৈরি করে রাখবো।
-এখন থাকলে এখনই করে দিতাম। কিন্তু সরি সেটা নেই যেহেতু, তো মাকে এখনো কিছুদিন আমার অফিসিয়াল স্ত্রী হয়ে থাকতে হবে? কিন্তু পিয়াল কি আমার কাছে থাকতে পারেনা? তুমি তো নিশ্চয় নতুন জীবন শুরু করবে।
-সেটা আমি কিছু ঠিক করিনি। আমাকে কেউ কোনকিছুর জন্যে জোর করছেনা। তুমি যা ভাবছো তা নয়।
-আমি ভাবছি, তুমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলে, আর রাজুর কাছে এসে উঠলে কি করে। আমার মতে দুপায়ে দাড়ালেই তো কেউ মানুষ হয় না। ওর চরিত্র কেমন মেয়েলি সেটা তো আমি জানি। যাই হোক তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার আমি আর নাক গলাবো না। আর পিয়ালের সাথে দেখা করাটা আমার শর্ত না যে নাহলে আমি সই করবো না। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। যদি এতে তুমি ভালো থাকো তো আমার ভালো লাগবে। কি আর হবে কোর্টে গিয়ে কেস কামারি করে। সেখানে তোমার যেমন কিছু বলার আছে আমারও কিছু বলার আছে। থাক না এসব।
তুলি মাথা নিচু করে নিলো।