10-12-2025, 10:25 PM
বাকী রইলো টুসি। গ্রামের যুবতী মেয়ে। শরীরের চাহিদায় ছটফট করছে। রতন দেখতে শুনতে খারাপ না, সহজেই তার সাথে ভাব জমিয়ে নিলো। হয়তো চুরির পর দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাতার লোভও দেখিয়ে থাকবে তাকে। ব্যাস পেয়ে গেলো সহকারিণী।
রতন বুঝেছিলো কন্সট্রাকশন সাইট এবং গ্রিলের দোকানে কাজ করতে করতে এই অভিনয় করা সম্ভব নয়। তাই সে কাজটা ছেড়ে দিলো। কিন্তু বাড়ির কাউকে জানালো না সেকথা। আগের মতোই সে রাত দশটার ফেরে এটাই দেখালো সবাইকে। এটা তারজন্য একটা পারফেক্ট অ্যালিবাই। অন্তত লনের টিউব লাইট না জ্বলার জন্য কেউ তাকে দায়ী করতে পারলো না। সবার চোখে সে তো এই সময় বাড়িতেই থাকে না!
সব প্ল্যান প্রোগ্রাম ঠিক হলে শুভ দিনক্ষণ দেখে আবির্ভূত হলো ভয়ঙ্কর দর্শন ভূত মহাশয়। পালা করে রতন আর টুসি ভূতের ভুমিকায় অভিনয় করতে লাগলো।
তাদের প্ল্যানটা খুব ভালোভাবেই কাজ করছিলো। বাড়ির সবাই, বিশেষ করে কুহেলি ভূতের ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলো। রাতে জানালা খোলা বন্ধ করে দিলো। কিন্তু এমন সময় আমি এসে পৌঁছালাম এখানে। তাদের সাধের প্ল্যান বানচাল হতে বসলো। তখন প্রথমে আমাকেও ভূতের খেলা দেখানো হলো। আমি ঘাবড়ালাম না দেখে অন্য পথ নিলো রতন। সেও ভান করলো যে সে ভূতে বিশ্বাস করেনা। সবগুলো কান্ডের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে আমার আস্থাভাজন হবার চেষ্টা করলো যাতে আমার সন্দেহ তার উপর পড়ার আগেই দানা খেয়ে পাখি উড়ে যেতে পারে।
আমি বিশ্বাস না করলেও বাকীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। এভাবেই ভৌতিক বাতাবরণের আড়ালে রতন আর টুসি মিলে গয়নার দোকানে চুরিটা করেই ফেললো। আর চোরাই মাল নিয়ে সরে পড়ারও চেষ্টা করলো। যদিও আমি পৌঁছাবার জন্য তাদের বেশ তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে। সেই জন্য অনেকগুলো ভুলও করে ফেলে তারা। তবে বলতেই হয়, দুজনের দল হিসাবে এই দুঃসাহসিক চুরি প্রশংসার দাবী রাখে। অবশ্য সঙ্গে আরও কেউ থাকতে পারে। সেটা পুলিশই বের করে নিতে পারবে।
এবার কথা বললেন ইন্সপেক্টর বোস। গম গমে গলায় বললেন, কিন্তু তমালবাবু, চুরির মালগুলো কোথায়? হিসেব মতো তিরিশ লাখটাকার সোনার গয়না আর পঞ্চাশ লাখ টাকার রত্ন পাথর। সেগুলো গেল কোথায় ?
তমাল বললো, কাল রাতে রতনের সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল না? সার্চ করেছিলেন?
ইন্সপেক্টর বোস বললো, হ্যাঁ ছিল কিন্তু শুধুই জামা কাপড়।
তমালের ভুরু কুঁচকে গেল। বললো, চলুন তো কয়েকটা জায়গা একটু খুঁজে দেখি।
ইন্সপেক্টর বোস লাফিয়ে উঠলেন। তারপর হুঙ্কার দিয়ে দু'জন কনস্টেবলকে ডাকলেন। তাদের জিম্মায় রতনকে রেখে তমাল, ইন্সপেক্টর আর শালিনী প্রথমেই গেল রতনদের বাথরুমে। সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না। তারপর স্টোর রুমে এসে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল মুখোশটা। ঠিক যেমন তমাল বর্ণনা দিয়েছিলো তেমনই।
তমাল বললো, পোর্টেবল oxy-acetylene টর্চটাও পাওয়া যাবে খুঁজলে। আর সত্যিই ভালো করে খুঁজতেই সেটাও পাওয়া গেল জঞ্জাল এর ভিতরে লুকানো। কিন্তু গয়না আর জেমস্ পাওয়া গেল না।
ফিরে আসার পর ইন্সপেক্টর বোস বললেন, তমাল বাবু মাল পাচার হয়ে যায়নি তো?
তমাল দু' পাশে ঘাড় নাড়লো। বললো, নাহ্! সে সুযোগ পায়নি রতন।
মিঃ বোস বললেন, তাহলে গেল কই? অতো গুলো টাকার জেম স্টোন!
তমাল বললো, চোর যখন ধরেছি তখন মালও পাওয়া যাবে। তার আগে রতন কে একটা প্রশ্ন করি? আচ্ছা রতন কনডমের এতো বিবিধ ব্যবহার তুমি কোথায় শিখলে? আমরা তো একটা ব্যবহারই জানতাম? তারপর ইন্সপেক্টর বোসের দিকে ফিরে বললো, আপনার সঙ্গে লেডি কনস্টেবল আছেন? থাকলে ডাকুন।
মিঃ বোস মহিলা পুলিশ ডাকার পর তমাল বললো, টুসির ঘরটা সার্চ করুন তো? একটা কনডমে মোড়া বড়সড় পোটলা পাবেন, নিয়ে আসুন। কনস্টেবল টুসির ঘরে ঢুকে দশ মিনিটের ভিতরেই পেয়ে গেল পোটলাটা। বেশ বড়। একটা কনডম এর ভিতরে আর একটা কনডম ঢুকিয়ে তার ভিতরে কিছু রাখা হয়েছে।
তমাল বললো, এই নিন আপনার সোনার গয়না মিঃ বোস।
ইন্সপেক্টর বোস বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পরে কনডম ছিঁড়ে ফেললেন। তার ভিতরে থেকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের মোড়ক বের হলো। ইন্সপেক্টর বোস খুব আস্তে আস্তে যত্ন নিয়ে সেটা খুলতে লাগলেন। যেন তার প্রাণ ভোমরা মোড়কটার ভিতরে রয়েছে।
মোড়কটা খুলেই ইন্সপেক্টর বোস ধপাস্ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। এ কী মিস্টার মজুমদার? কোথায় সোনা? এ তো ভাঙাচোরা লোহার টুকরো?
তমাল হাসতে লাগল হো হো করে। বললো, জানি। আমিই তো রেখেছি। কিন্তু চোরেরা জানে না ভিতরে কী আছে। তারা সোনার গয়নাই রেখেছিলো। আর গয়না আছে ভেবেই সরিয়েও এনেছিলো। সব জেনেও নাটক করে সার্চ করিয়ে ওটা আনতে বললাম এই কারণে যাতে প্রমাণ হয় যে তারা ওটা নিজেদের কাছেই রেখেছিলো চোরাই মাল ভেবে।
রতন আর টুসি চুরির পরে দু'টো কনডমের ভিতরে ভরে ওটা লুকিয়ে রেখেছিলো রতনদের বাথরুমের চৌবাচ্চার জলের নিচে। অস্বচ্ছ নোংরা জল জমে ছিলো বলে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যেতো না। কালই আমি ওটার হদিস পাই। রাতের বেলা আমি আর শালিনী গিয়ে বদলে দিয়ে এসেছি পোটলাটা।
ইন্সপেক্টর বললেন, কিন্তু গয়না? সেগুলো কোথায়?
তমাল বললো, আমার কাছেই আছে। শালিনী একটু উপরে যাও তো। আমার বেডের নিচে স্যুটকেসটার পিছনে ঠিক ওই রকমই একটা কনডমে মোড়া প্যাকেট পাবে। নিয়ে এসো প্লিজ। সরি সমরবাবু আপনার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে আপনার স্টক থেকে কয়েকটা কনডম চুরি করেছিলাম কাল, মাফ করবেন।
শালিনী উপরে গিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে এলো। সেটা খুলতেই কাঁচা হলুদ রঙের সোনার গয়না বেরিয়ে ঘর আলো করে দিলো। ইন্সপেক্টর বোস আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, সাবাস! তমাল বাবু সাবাস ! ঘরে অন্য যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল। শুধু রতন আর টুসির মুখে কেউ যেন কালি ঢেলে দিল।
এতক্ষণে কথা বলার সাহস খুঁজে পেল রতন। সে চেঁচিয়ে বললো, ধুর! শুধু শুধু নাটক করে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাদের আটকে রেখেছেন। এ সবই তমালবাবুর বানানো গল্প। উনিই চুরিটা করেছেন। চোরাই মাল তো পাওয়া গেছে ওনার কাছেই। উনি কলকাতা থেকে এসেছেন চুরি করার জন্যই। আর এই সব আজগুবি গল্প ফেঁদে আমাদের বিপদে ফেলছেন নিজে বাঁচার জন্য। ছেড়ে দিন আমাদের! তারপর সে কনস্টেবল দু'জনের হাত থেকে মুক্তি পেতে জোরাজুরি করতে লাগল।
চেয়ার থেকে উঠলো তমাল। এগিয়ে গেল রতনের কাছে। তারপর কোনো কথা না বলে ডান হাত তুলে সপাটে চড় কষালো রতনের গালে। চড়টা এত জোরে মারলো, যে তার প্রতিধ্বনি ঘরের সমস্ত শব্দকে থামিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ করে দিল।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ভাঙা হাতটা চেপে ধরে কাতরাতে লাগল রতন। তমাল হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, ন্যাকামো রাখো রতন। যথেষ্ট নাটক হয়েছে, আর না। কিচ্ছু হয়নি তোমার হাতে। আমি তোমার ডক্টর সেনের সাথেও দেখা করেছিলাম। তিনি বললেন তোমার হাতে কিছুই হয়নি। এমন কি একটা ব্যান্ড-এইড লাগানোরও দরকার ছিলো না তোমার।
আর থাপ্পড়টা তোমাকে আমাকে চোর বলার জন্য মারিনি। মনে আছে আমি তোমার কাছে প্রমিস করেছিলাম, যে তোমার এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ছাড়বো না। শাস্তি দেবোই? তুমিই তোমার এই অবস্থা করেছো, তাই শাস্তি তোমারই প্রাপ্য। এ ছাড়াও সেদিন রাতে কুহেলিকেও কথা দিয়েছিলাম যারা তার বদনাম করছে, যারা ভয় দেখিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, তাদের শাস্তি দেবো। সেই প্রমিসটাও আজ রাখলাম।
ঘরে যেন বাজ পড়লো এবার এমন ভাবে কথা বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর বোস। ধুর ধুর! এটা কোনো শাস্তি হলো! এতো জামাই আদর। আসল খাতির তো হবে থানায় গিয়ে। তুমি যদি বুনো ভূত হও আমিও বাঘা ওঝা! তা ছাড়া দলে আর কে কে আছে, রত্ন পাথর গুলো কোথায় রেখেছো, সেটাও তো বের করতে হবে আমাকে? চলো চলো আমার আর দেরি সইছে না যে! হাতটা নিসপিস করছে সোনা মানিক !
তমাল বললো, শুধু মানিক নয় ইন্সপেক্টর বোস মানিকজোড় বলুন।
ইন্সপেক্টর বোস টুসির দিকে তাকালো। বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন মানিকজোড়ই বটে। এক জোড়াই তো আছে। ওর খাতির করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমাদের মহিলা কনস্টেবল সরমা!
তমাল বললো, নাহ্! ও তো সোনার টুকরো মেয়ে। ও মানিক না।
মিঃ বোস বললেন, তাহলে? জোড়া মানিক এর আর একজন কই?
তমাল মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। বললো, বলছি। তার আগে রতনকে তার বোকামির আরও দু'টো উদাহরণ দেই? যাতে জীবনে আর নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান না ভাবে। রতন, এটা মনে রেখো ভালো অভিনেতা হতে গেলে সব সময় ক্যারেক্টারে ঢুকে থাকতে হয়। হাত ভাঙ্গা মানুষের অভিনয় যখন করবে, সব সময় মনে করবে তোমার হাতটা সত্যিই ভাঙ্গা। এমন কি রাতের বেলা যদি খুব জোর পটিও পায়, তাহলেও। ওই ভাঙ্গা হাতে জলের বালতি ঝুলিয়ে হাঁটবে না। কাল রাতে সেটাই করেছিলে তুমি।
তোমার আর একটা বোকামির কথা বলি? তোমার সঙ্গে গ্রিল কারখানায় কাজ করত একটা ছেলে,নাম রাজু। যার একটা মুরগির দোকানও রয়েছে। তার কাছ থেকে রক্ত আনছিলে, এটা বেশ বুদ্ধিমানের মতোই কাজ হচ্ছিলো। কিন্তু চুরিটা সাফল্যের সাথে করে ফেলার পরে অতি গর্বে আমাকে নিয়ে মস্করা করার লোভটা বোধহয় সামলাতে পারোনি, তাইনা?
তাই সেদিন জ্যান্ত মুরগি এনে নিজেই গলা কেটে সেটার বুকে হাতে বানানো ছুরি গেঁথে ছুঁড়ে মারলে কুহেলির ঘরে। কিন্তু খেয়ালই করলে না যে তোমার কনুই এর কাছে ব্যান্ডেজে মুরগির রক্তের ছিটা লেগে গেছিলো। রাতেই টুসিকে যখন মুরগীটা দেবার পরে তোমার ঘরে গেছিলাম, তখনি খেয়াল করেছি।
পরদিন দেখলাম রক্তের দাগটা নেই। অথচ বললো, ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করোনি। ইসসসস তোমার কতো বড় একটা প্ল্যান একটা তুচ্ছ মুরগি ভেস্তে দিলো রতন ! চুরি করার আগেই দামি মাল লুকিয়ে রাখার জন্য হাত ভাঙ্গার নাটক করে এতো বড় ব্যান্ডেজটা বাঁধলে হাতে, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না! ইন্সপেক্টর বোস, রতনের হাতের ব্যান্ডেজটা খোলান তো কাউকে দিয়ে?
ইনস্পেক্টর বোস বললেন, আমিই খুলছি।
তমাল বললো, সাবধানে খুলবেন মিঃ বোস। ওটা পৃথিবীর সব চাইতে দামী ব্যান্ডেজ। পঞ্চাশ লাখ টাকা দাম।
ইন্সপেক্টর রতনের হাতটা ডাইনিং টেবিলের উপর চেপে ধরে আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলেন। ঘরের ভিতরে তখন পিন-পতন নিস্তব্ধতা। সবার হৃদপিণ্ড বোধহয় বিট করতেও ভুলে গেছে। কয়েক পরত ব্যান্ডেজ খোলার পরই টেবিলের উপর রত্ন বৃষ্টি শুরু হলো। হীরা, পান্না, চুনি, গোমেদ, পোখরাজ, বৃষ্টির মতো টুপ্টাপ্ ঝরে পড়ছে। তাদের বিচিত্র বর্ণ-চ্ছটায় সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।
পুরো ব্যান্ডেজটা খোলা হয়ে যেতেই তমাল রত্ন গুলো এক জায়গায় জড়ো করে একটা রুমালে জড়িয়ে ইন্সপেক্টরের হাতে তুলে দিলো। বললো, রতন মানে রত্ন, মানে মানিক। এক মানিক এর সঙ্গে ছিল আরও অনেক মানিক। তাই মানিক-জোড় বলেছিলাম।
ইনস্পেক্টর বোস উঠে তমালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আপনাকে কিভাবে যে ধন্যবাদ দেবো মিঃ মজুমদার! আপনি জানেন না, এই চুরিটার কিনারা করার জন্য উপর মহল থেকে কি পরিমাণ চাপ আসছিলো! থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি ভেরি মাচ্ তমাল বাবু! তমালের হাতটা ধরে জোরে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিলেন ইনস্পেক্টর বোস।
যখন তারা কথা বলছিল, ঠিক তখনই লেডি কনস্টেবলের হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল টুসি। কনস্টেবলও দৌড়ে গিয়ে তার চুলের মুঠি টেনে ধরে গালে এক বিরাশি-সিক্কার থাপ্পড় কষালো। ছিটকে মাটিতে পড়ে গোঙাতে লাগলো সে।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন ইন্সপেক্টর বোস। বললেন, এ যে দেখছি নতুন একটা মুহাবরা পেয়ে গেলাম.. " রতন এ রতন চেনে টুসি চেনে ঘুষি "। নিজের রসিকতায় নিজেই দুলে দুলে হাসতে লাগলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরে চুরির মাল, রতন আর টুসি কে নিয়ে পুলিশ জীপ বেরিয়ে যেতেই ভূপেনবাবু এগিয়ে এলেন তমালের কাছে। বললেন, এ বাড়িতে আমার আর থাকার মতো মুখ নেই বাবু। আমি কোন মুখে আর ইন্দ্রর সামনে দাঁড়াবো? তারপর কুন্তলার দিকে ফিরে বললেন, আমাকে মাফ্ করে দিন মা! আমিও এবার বিদেয় হই। এমন ছেলে জন্ম দেওয়াও তো একটা পাপ!
তমাল তার কাঁধে হাত রাখলো। বললো, আপনি কোথাও যাবেন না। একমাত্র আপনার উপরই ভরসা করে এই মেয়েদের রেখে যাচ্ছি আমি। সমরবাবু তার বিশ্বাস যোগ্যতা হারিয়েছেন। আপনিই এখন থেকে এদের অভিভাবক। ইন্দ্র না ফেরা পর্যন্ত আপনাকেই এদের রক্ষা করতে হবে।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ভূপেনবাবু বললেন, আমার জীবন থাকতে এদের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে, না কথা দিলাম। তমাল তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললো, জানি।
তমালকে আরও দু'একদিন থেকে যাবার অনেক অনুরোধ করলো কুন্তলা, কুহেলি আর শিপ্রা। তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনেক কষ্টে ছুটি পেলো তমাল। স্টেশনে সবাই এসেছে তমাল আর শালিনীকে ছাড়তে। এমন কি সমরবাবু ও। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে শালিনী তার ব্যাগ খুলে দু'টো প্যাকেট বের করলো। সুন্দর করে রঙিন কাগজে মোড়া। তারপর একটা শিপ্রা আর অন্যটা কুন্তলার হাতে দিয়ে বললো, বসের তরফ থেকে সামান্য উপহার আপনাদের জন্য। শিপ্রা আর কুন্তলা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো প্যাকেট দু'টোর দিকে। তমালও অবাক হয়েছে ভারি।
সময় হয়ে গেলো, হুইসেল বাজলো, আস্তে আস্তে ট্রেন গড়াতে লাগলো। গাড়ি প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসার পর তমাল বললো, কি দিলে বলতো এদের? কই তুমি আমাকে তো বলোনি উপহারের কথা? শালিনী বললো, ওদের দু'জনের ভিতরে ঝগড়া হোক, চাইনি আমি। সেদিন বেনাচিতি থেকে ছ'টা নতুন জাঙ্গিয়া কিনে এনেছি আপনার জন্য। তাই পুরনো ছ'টা সমান ভাগে ভাগ করে ওদের উপহার দিলাম।
তমাল হা হয়ে গেল কথাটা শুনে। তারপর বললো, ফাজিল মেয়ে! শালিনী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে খিক্ খিক্ করে হাসতে লাগলো। !!!
( সমাপ্ত )
রতন বুঝেছিলো কন্সট্রাকশন সাইট এবং গ্রিলের দোকানে কাজ করতে করতে এই অভিনয় করা সম্ভব নয়। তাই সে কাজটা ছেড়ে দিলো। কিন্তু বাড়ির কাউকে জানালো না সেকথা। আগের মতোই সে রাত দশটার ফেরে এটাই দেখালো সবাইকে। এটা তারজন্য একটা পারফেক্ট অ্যালিবাই। অন্তত লনের টিউব লাইট না জ্বলার জন্য কেউ তাকে দায়ী করতে পারলো না। সবার চোখে সে তো এই সময় বাড়িতেই থাকে না!
সব প্ল্যান প্রোগ্রাম ঠিক হলে শুভ দিনক্ষণ দেখে আবির্ভূত হলো ভয়ঙ্কর দর্শন ভূত মহাশয়। পালা করে রতন আর টুসি ভূতের ভুমিকায় অভিনয় করতে লাগলো।
তাদের প্ল্যানটা খুব ভালোভাবেই কাজ করছিলো। বাড়ির সবাই, বিশেষ করে কুহেলি ভূতের ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলো। রাতে জানালা খোলা বন্ধ করে দিলো। কিন্তু এমন সময় আমি এসে পৌঁছালাম এখানে। তাদের সাধের প্ল্যান বানচাল হতে বসলো। তখন প্রথমে আমাকেও ভূতের খেলা দেখানো হলো। আমি ঘাবড়ালাম না দেখে অন্য পথ নিলো রতন। সেও ভান করলো যে সে ভূতে বিশ্বাস করেনা। সবগুলো কান্ডের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে আমার আস্থাভাজন হবার চেষ্টা করলো যাতে আমার সন্দেহ তার উপর পড়ার আগেই দানা খেয়ে পাখি উড়ে যেতে পারে।
আমি বিশ্বাস না করলেও বাকীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। এভাবেই ভৌতিক বাতাবরণের আড়ালে রতন আর টুসি মিলে গয়নার দোকানে চুরিটা করেই ফেললো। আর চোরাই মাল নিয়ে সরে পড়ারও চেষ্টা করলো। যদিও আমি পৌঁছাবার জন্য তাদের বেশ তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে। সেই জন্য অনেকগুলো ভুলও করে ফেলে তারা। তবে বলতেই হয়, দুজনের দল হিসাবে এই দুঃসাহসিক চুরি প্রশংসার দাবী রাখে। অবশ্য সঙ্গে আরও কেউ থাকতে পারে। সেটা পুলিশই বের করে নিতে পারবে।
এবার কথা বললেন ইন্সপেক্টর বোস। গম গমে গলায় বললেন, কিন্তু তমালবাবু, চুরির মালগুলো কোথায়? হিসেব মতো তিরিশ লাখটাকার সোনার গয়না আর পঞ্চাশ লাখ টাকার রত্ন পাথর। সেগুলো গেল কোথায় ?
তমাল বললো, কাল রাতে রতনের সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল না? সার্চ করেছিলেন?
ইন্সপেক্টর বোস বললো, হ্যাঁ ছিল কিন্তু শুধুই জামা কাপড়।
তমালের ভুরু কুঁচকে গেল। বললো, চলুন তো কয়েকটা জায়গা একটু খুঁজে দেখি।
ইন্সপেক্টর বোস লাফিয়ে উঠলেন। তারপর হুঙ্কার দিয়ে দু'জন কনস্টেবলকে ডাকলেন। তাদের জিম্মায় রতনকে রেখে তমাল, ইন্সপেক্টর আর শালিনী প্রথমেই গেল রতনদের বাথরুমে। সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না। তারপর স্টোর রুমে এসে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল মুখোশটা। ঠিক যেমন তমাল বর্ণনা দিয়েছিলো তেমনই।
তমাল বললো, পোর্টেবল oxy-acetylene টর্চটাও পাওয়া যাবে খুঁজলে। আর সত্যিই ভালো করে খুঁজতেই সেটাও পাওয়া গেল জঞ্জাল এর ভিতরে লুকানো। কিন্তু গয়না আর জেমস্ পাওয়া গেল না।
ফিরে আসার পর ইন্সপেক্টর বোস বললেন, তমাল বাবু মাল পাচার হয়ে যায়নি তো?
তমাল দু' পাশে ঘাড় নাড়লো। বললো, নাহ্! সে সুযোগ পায়নি রতন।
মিঃ বোস বললেন, তাহলে গেল কই? অতো গুলো টাকার জেম স্টোন!
তমাল বললো, চোর যখন ধরেছি তখন মালও পাওয়া যাবে। তার আগে রতন কে একটা প্রশ্ন করি? আচ্ছা রতন কনডমের এতো বিবিধ ব্যবহার তুমি কোথায় শিখলে? আমরা তো একটা ব্যবহারই জানতাম? তারপর ইন্সপেক্টর বোসের দিকে ফিরে বললো, আপনার সঙ্গে লেডি কনস্টেবল আছেন? থাকলে ডাকুন।
মিঃ বোস মহিলা পুলিশ ডাকার পর তমাল বললো, টুসির ঘরটা সার্চ করুন তো? একটা কনডমে মোড়া বড়সড় পোটলা পাবেন, নিয়ে আসুন। কনস্টেবল টুসির ঘরে ঢুকে দশ মিনিটের ভিতরেই পেয়ে গেল পোটলাটা। বেশ বড়। একটা কনডম এর ভিতরে আর একটা কনডম ঢুকিয়ে তার ভিতরে কিছু রাখা হয়েছে।
তমাল বললো, এই নিন আপনার সোনার গয়না মিঃ বোস।
ইন্সপেক্টর বোস বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পরে কনডম ছিঁড়ে ফেললেন। তার ভিতরে থেকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের মোড়ক বের হলো। ইন্সপেক্টর বোস খুব আস্তে আস্তে যত্ন নিয়ে সেটা খুলতে লাগলেন। যেন তার প্রাণ ভোমরা মোড়কটার ভিতরে রয়েছে।
মোড়কটা খুলেই ইন্সপেক্টর বোস ধপাস্ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। এ কী মিস্টার মজুমদার? কোথায় সোনা? এ তো ভাঙাচোরা লোহার টুকরো?
তমাল হাসতে লাগল হো হো করে। বললো, জানি। আমিই তো রেখেছি। কিন্তু চোরেরা জানে না ভিতরে কী আছে। তারা সোনার গয়নাই রেখেছিলো। আর গয়না আছে ভেবেই সরিয়েও এনেছিলো। সব জেনেও নাটক করে সার্চ করিয়ে ওটা আনতে বললাম এই কারণে যাতে প্রমাণ হয় যে তারা ওটা নিজেদের কাছেই রেখেছিলো চোরাই মাল ভেবে।
রতন আর টুসি চুরির পরে দু'টো কনডমের ভিতরে ভরে ওটা লুকিয়ে রেখেছিলো রতনদের বাথরুমের চৌবাচ্চার জলের নিচে। অস্বচ্ছ নোংরা জল জমে ছিলো বলে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যেতো না। কালই আমি ওটার হদিস পাই। রাতের বেলা আমি আর শালিনী গিয়ে বদলে দিয়ে এসেছি পোটলাটা।
ইন্সপেক্টর বললেন, কিন্তু গয়না? সেগুলো কোথায়?
তমাল বললো, আমার কাছেই আছে। শালিনী একটু উপরে যাও তো। আমার বেডের নিচে স্যুটকেসটার পিছনে ঠিক ওই রকমই একটা কনডমে মোড়া প্যাকেট পাবে। নিয়ে এসো প্লিজ। সরি সমরবাবু আপনার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে আপনার স্টক থেকে কয়েকটা কনডম চুরি করেছিলাম কাল, মাফ করবেন।
শালিনী উপরে গিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে এলো। সেটা খুলতেই কাঁচা হলুদ রঙের সোনার গয়না বেরিয়ে ঘর আলো করে দিলো। ইন্সপেক্টর বোস আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, সাবাস! তমাল বাবু সাবাস ! ঘরে অন্য যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইল। শুধু রতন আর টুসির মুখে কেউ যেন কালি ঢেলে দিল।
এতক্ষণে কথা বলার সাহস খুঁজে পেল রতন। সে চেঁচিয়ে বললো, ধুর! শুধু শুধু নাটক করে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাদের আটকে রেখেছেন। এ সবই তমালবাবুর বানানো গল্প। উনিই চুরিটা করেছেন। চোরাই মাল তো পাওয়া গেছে ওনার কাছেই। উনি কলকাতা থেকে এসেছেন চুরি করার জন্যই। আর এই সব আজগুবি গল্প ফেঁদে আমাদের বিপদে ফেলছেন নিজে বাঁচার জন্য। ছেড়ে দিন আমাদের! তারপর সে কনস্টেবল দু'জনের হাত থেকে মুক্তি পেতে জোরাজুরি করতে লাগল।
চেয়ার থেকে উঠলো তমাল। এগিয়ে গেল রতনের কাছে। তারপর কোনো কথা না বলে ডান হাত তুলে সপাটে চড় কষালো রতনের গালে। চড়টা এত জোরে মারলো, যে তার প্রতিধ্বনি ঘরের সমস্ত শব্দকে থামিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ করে দিল।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ভাঙা হাতটা চেপে ধরে কাতরাতে লাগল রতন। তমাল হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, ন্যাকামো রাখো রতন। যথেষ্ট নাটক হয়েছে, আর না। কিচ্ছু হয়নি তোমার হাতে। আমি তোমার ডক্টর সেনের সাথেও দেখা করেছিলাম। তিনি বললেন তোমার হাতে কিছুই হয়নি। এমন কি একটা ব্যান্ড-এইড লাগানোরও দরকার ছিলো না তোমার।
আর থাপ্পড়টা তোমাকে আমাকে চোর বলার জন্য মারিনি। মনে আছে আমি তোমার কাছে প্রমিস করেছিলাম, যে তোমার এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ছাড়বো না। শাস্তি দেবোই? তুমিই তোমার এই অবস্থা করেছো, তাই শাস্তি তোমারই প্রাপ্য। এ ছাড়াও সেদিন রাতে কুহেলিকেও কথা দিয়েছিলাম যারা তার বদনাম করছে, যারা ভয় দেখিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে, তাদের শাস্তি দেবো। সেই প্রমিসটাও আজ রাখলাম।
ঘরে যেন বাজ পড়লো এবার এমন ভাবে কথা বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর বোস। ধুর ধুর! এটা কোনো শাস্তি হলো! এতো জামাই আদর। আসল খাতির তো হবে থানায় গিয়ে। তুমি যদি বুনো ভূত হও আমিও বাঘা ওঝা! তা ছাড়া দলে আর কে কে আছে, রত্ন পাথর গুলো কোথায় রেখেছো, সেটাও তো বের করতে হবে আমাকে? চলো চলো আমার আর দেরি সইছে না যে! হাতটা নিসপিস করছে সোনা মানিক !
তমাল বললো, শুধু মানিক নয় ইন্সপেক্টর বোস মানিকজোড় বলুন।
ইন্সপেক্টর বোস টুসির দিকে তাকালো। বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন মানিকজোড়ই বটে। এক জোড়াই তো আছে। ওর খাতির করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমাদের মহিলা কনস্টেবল সরমা!
তমাল বললো, নাহ্! ও তো সোনার টুকরো মেয়ে। ও মানিক না।
মিঃ বোস বললেন, তাহলে? জোড়া মানিক এর আর একজন কই?
তমাল মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। বললো, বলছি। তার আগে রতনকে তার বোকামির আরও দু'টো উদাহরণ দেই? যাতে জীবনে আর নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান না ভাবে। রতন, এটা মনে রেখো ভালো অভিনেতা হতে গেলে সব সময় ক্যারেক্টারে ঢুকে থাকতে হয়। হাত ভাঙ্গা মানুষের অভিনয় যখন করবে, সব সময় মনে করবে তোমার হাতটা সত্যিই ভাঙ্গা। এমন কি রাতের বেলা যদি খুব জোর পটিও পায়, তাহলেও। ওই ভাঙ্গা হাতে জলের বালতি ঝুলিয়ে হাঁটবে না। কাল রাতে সেটাই করেছিলে তুমি।
তোমার আর একটা বোকামির কথা বলি? তোমার সঙ্গে গ্রিল কারখানায় কাজ করত একটা ছেলে,নাম রাজু। যার একটা মুরগির দোকানও রয়েছে। তার কাছ থেকে রক্ত আনছিলে, এটা বেশ বুদ্ধিমানের মতোই কাজ হচ্ছিলো। কিন্তু চুরিটা সাফল্যের সাথে করে ফেলার পরে অতি গর্বে আমাকে নিয়ে মস্করা করার লোভটা বোধহয় সামলাতে পারোনি, তাইনা?
তাই সেদিন জ্যান্ত মুরগি এনে নিজেই গলা কেটে সেটার বুকে হাতে বানানো ছুরি গেঁথে ছুঁড়ে মারলে কুহেলির ঘরে। কিন্তু খেয়ালই করলে না যে তোমার কনুই এর কাছে ব্যান্ডেজে মুরগির রক্তের ছিটা লেগে গেছিলো। রাতেই টুসিকে যখন মুরগীটা দেবার পরে তোমার ঘরে গেছিলাম, তখনি খেয়াল করেছি।
পরদিন দেখলাম রক্তের দাগটা নেই। অথচ বললো, ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করোনি। ইসসসস তোমার কতো বড় একটা প্ল্যান একটা তুচ্ছ মুরগি ভেস্তে দিলো রতন ! চুরি করার আগেই দামি মাল লুকিয়ে রাখার জন্য হাত ভাঙ্গার নাটক করে এতো বড় ব্যান্ডেজটা বাঁধলে হাতে, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না! ইন্সপেক্টর বোস, রতনের হাতের ব্যান্ডেজটা খোলান তো কাউকে দিয়ে?
ইনস্পেক্টর বোস বললেন, আমিই খুলছি।
তমাল বললো, সাবধানে খুলবেন মিঃ বোস। ওটা পৃথিবীর সব চাইতে দামী ব্যান্ডেজ। পঞ্চাশ লাখ টাকা দাম।
ইন্সপেক্টর রতনের হাতটা ডাইনিং টেবিলের উপর চেপে ধরে আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলেন। ঘরের ভিতরে তখন পিন-পতন নিস্তব্ধতা। সবার হৃদপিণ্ড বোধহয় বিট করতেও ভুলে গেছে। কয়েক পরত ব্যান্ডেজ খোলার পরই টেবিলের উপর রত্ন বৃষ্টি শুরু হলো। হীরা, পান্না, চুনি, গোমেদ, পোখরাজ, বৃষ্টির মতো টুপ্টাপ্ ঝরে পড়ছে। তাদের বিচিত্র বর্ণ-চ্ছটায় সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।
পুরো ব্যান্ডেজটা খোলা হয়ে যেতেই তমাল রত্ন গুলো এক জায়গায় জড়ো করে একটা রুমালে জড়িয়ে ইন্সপেক্টরের হাতে তুলে দিলো। বললো, রতন মানে রত্ন, মানে মানিক। এক মানিক এর সঙ্গে ছিল আরও অনেক মানিক। তাই মানিক-জোড় বলেছিলাম।
ইনস্পেক্টর বোস উঠে তমালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আপনাকে কিভাবে যে ধন্যবাদ দেবো মিঃ মজুমদার! আপনি জানেন না, এই চুরিটার কিনারা করার জন্য উপর মহল থেকে কি পরিমাণ চাপ আসছিলো! থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি ভেরি মাচ্ তমাল বাবু! তমালের হাতটা ধরে জোরে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে দিলেন ইনস্পেক্টর বোস।
যখন তারা কথা বলছিল, ঠিক তখনই লেডি কনস্টেবলের হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল টুসি। কনস্টেবলও দৌড়ে গিয়ে তার চুলের মুঠি টেনে ধরে গালে এক বিরাশি-সিক্কার থাপ্পড় কষালো। ছিটকে মাটিতে পড়ে গোঙাতে লাগলো সে।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন ইন্সপেক্টর বোস। বললেন, এ যে দেখছি নতুন একটা মুহাবরা পেয়ে গেলাম.. " রতন এ রতন চেনে টুসি চেনে ঘুষি "। নিজের রসিকতায় নিজেই দুলে দুলে হাসতে লাগলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরে চুরির মাল, রতন আর টুসি কে নিয়ে পুলিশ জীপ বেরিয়ে যেতেই ভূপেনবাবু এগিয়ে এলেন তমালের কাছে। বললেন, এ বাড়িতে আমার আর থাকার মতো মুখ নেই বাবু। আমি কোন মুখে আর ইন্দ্রর সামনে দাঁড়াবো? তারপর কুন্তলার দিকে ফিরে বললেন, আমাকে মাফ্ করে দিন মা! আমিও এবার বিদেয় হই। এমন ছেলে জন্ম দেওয়াও তো একটা পাপ!
তমাল তার কাঁধে হাত রাখলো। বললো, আপনি কোথাও যাবেন না। একমাত্র আপনার উপরই ভরসা করে এই মেয়েদের রেখে যাচ্ছি আমি। সমরবাবু তার বিশ্বাস যোগ্যতা হারিয়েছেন। আপনিই এখন থেকে এদের অভিভাবক। ইন্দ্র না ফেরা পর্যন্ত আপনাকেই এদের রক্ষা করতে হবে।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ভূপেনবাবু বললেন, আমার জীবন থাকতে এদের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে, না কথা দিলাম। তমাল তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললো, জানি।
তমালকে আরও দু'একদিন থেকে যাবার অনেক অনুরোধ করলো কুন্তলা, কুহেলি আর শিপ্রা। তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনেক কষ্টে ছুটি পেলো তমাল। স্টেশনে সবাই এসেছে তমাল আর শালিনীকে ছাড়তে। এমন কি সমরবাবু ও। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে শালিনী তার ব্যাগ খুলে দু'টো প্যাকেট বের করলো। সুন্দর করে রঙিন কাগজে মোড়া। তারপর একটা শিপ্রা আর অন্যটা কুন্তলার হাতে দিয়ে বললো, বসের তরফ থেকে সামান্য উপহার আপনাদের জন্য। শিপ্রা আর কুন্তলা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো প্যাকেট দু'টোর দিকে। তমালও অবাক হয়েছে ভারি।
সময় হয়ে গেলো, হুইসেল বাজলো, আস্তে আস্তে ট্রেন গড়াতে লাগলো। গাড়ি প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসার পর তমাল বললো, কি দিলে বলতো এদের? কই তুমি আমাকে তো বলোনি উপহারের কথা? শালিনী বললো, ওদের দু'জনের ভিতরে ঝগড়া হোক, চাইনি আমি। সেদিন বেনাচিতি থেকে ছ'টা নতুন জাঙ্গিয়া কিনে এনেছি আপনার জন্য। তাই পুরনো ছ'টা সমান ভাগে ভাগ করে ওদের উপহার দিলাম।
তমাল হা হয়ে গেল কথাটা শুনে। তারপর বললো, ফাজিল মেয়ে! শালিনী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে খিক্ খিক্ করে হাসতে লাগলো। !!!
( সমাপ্ত )

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)