03-12-2025, 09:02 PM
(This post was last modified: 03-12-2025, 09:06 PM by ধূমকেতু. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
রাত নটার মধ্যে সব রান্না শেষ করে ফেললো মধুমিতা। পনেরোটার বেশি পদ রেঁধেছে ও। চিংড়ি মাছের মালাই কারি, ইলিশ মাছ ভাজা, সরষে ইলিশ, দই কাতলা, আলু দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল, পাবদা মাছের ঝাল, ডিমের কোরমা, মটন কষা, মুড়গির কারি, ফ্রাইড রাইস আর পোলাও। শশুর মশাই আবার পোলাও খান না তাই ওনার জন্য সাদা ভাত। আরো ছোট খাটো ভাজা-ফ্রাইয়ের কথা উয্য থাক। শুধু শুধু বর্ননা বড় করে লাভ নেই।
মধুমিতা একসাথে দুই উনুনে রান্না করেছে। সাথে সাহায্য করেছেন কমলিনী দেবী, ফলে দ্রুতই ও রান্না শেষ করতে পেরেছে। সব খাবার ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে মধুমিতা রিতমকে ডাকতে গেলো।
রিতম তখন বসার ঘরেই ছিলো। মধুমিতাকে দেখে হেসে বললো, কি রান্না করছো বলতো। পুরো বাড়ি গন্ধে ভরে গেছে। খিদে পেয়ে গেছে এর মধ্যেই।
তাহলে এসো, রান্না হয়ে গেছে।
কি কি রান্না করলে?
খেতে বসলেই দেখতে পাবে। মধুমিতাও মৃদু হেসে বললো।
মধুমিতা খাবার জন্য শশুর মশাইকেও ডেকে এনেছিলো। তিনজনকে খেতে দিয়েছিলো এক সাথে। রিতম সেটা খেয়াল করে বললো, মিতা, তুমিও খেতে বসো।
আমি খেতে বসে গেলে তোমাদের খেতে দেবে কে?
কথায় যুক্তি ঠিক আছে, কিন্তু এমন কাঠখোট্টা ভাবে কে উত্তর দেয়?
এরপর রিমত আরো কয়েক বার অনুরোধ করেছিল, মধুমিতা শোনে নি। রিতমের মনে হলো ওর বউ আর ঠিক আগের মতো নেই। পাল্টে গেছে। কেমন যেন গম্ভীর, প্রাণহীন, আর খুব দূরের মনে হচ্ছে।
রিতমকে দেখে ওর মা বাবা আর মেহুল প্রচন্ড খুশি হয়েছে। মেহুলতো রিতিমত নেচে ফেলে এমন অবস্থা। তারপর কি এনেছে, কেমন আছে আরো কত খুনসুটি। মধুমিতা তো এমন কিছুই করলো না? ওরই তো সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা ছিলো। ওর মধ্যে কেন কোনো প্রাণ চাঞ্চল্য নেই? ওর মধ্যে কোনো কৌতুহল জাগছে না কেন?
অভিমান থেকে কি কেউ এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে?
খেতে খেতে এ কথা গুলোই রিতম আবার ভাবছিল। মনকে বোঝাতে চাইছিলো যে এটা স্বাভাবিক, মধুমিতা তো বেশ কয়েক মাস ধরেই এমন নির্জীব। কিন্তু ওকে আজ সরাসরি দেখে সেটা যেন একটু বেশিই চোখে লাগছে, রিতম স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করতে পারছে না।
ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেছিলো, ওঠে যাবে এমন সময় মধুমিতা আবার ওর প্লেট ভরিয়ে দিল ফ্রাইড রাইস দিয়ে, সাথে মাটন কষা। রিতম বললো, কি করলে এটা? এমনিতেই খাওয়া বেশি হয়ে গেছে।
পারবে, খাও। মধুমিতা বলল। আগে এরচেয়ে বেশি খেতে। তারউপর এতোদিন তো বাঙালি খাবার খাও নি।
রিতমের পেট ভরে গেছিলো, মধুমিতাকে শত বলেও বোঝাতে পারলো না। ওর কথা খেতেই হবে। সুতরাং ওগুলোও খেতে হলো।
এই একটা জিনিস ওর মন ভালো করে দিল, মধুমিতা রিতমকে প্রাণ দিয়ে আপ্পায়ণ করছিলো। কিন্ত কেন যে এমন পরের মতো ব্যবহার করছিলো! কেন যে এমন দূরুত্ব বজায় রাখছিল।
খাওয়ার পর রিতম ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মধুমিতা বাদে সবার খাওয়া শেষ হয়েগেছিলো। এঁটো পরিস্কার করে মধুমিতা প্লেট গুলো উঠিয়ে নিচ্ছিল ধোয়ার জন্য।
রিতম বললো, এবার তুমি খেয়ে নাও, মিতা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মধুমিতা মৃদু হেসে বললো, এগুলো পরিষ্কার করে নিই, তারপরই খাচ্ছি।
মধুমিতার ঠোঁটের এই হাসিটিও কেমন নির্জিব দেখাচ্ছিলো। চোখে লাগছিলো খুব।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। বাড়ির প্রায় সব আলো নিভে গেছে, শুধু রান্নাঘরের ছোট্ট টিউবলাইটটা জ্বলছে। মধুমিতা একা দাঁড়িয়ে আছে সিঙ্কের সামনে। হাতে একটা কাচের থালা, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ও শুধু জলের ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। জল পড়ছে টুপটুপ করে, আর ওর চোখের কোণেও জমে উঠেছে একই রকম বিন্দু, বাষ্পাদ্র হয়ে ওঠেছে ওর আঁখি।
রিতমকে দূরে সরিয়ে রেখে কষ্ট হচ্ছিলো। মধুমিতা ওর কালো মুখটা দেখেছে যখন রিতম এসেছিলো ওকে শোবার জন্য ঢাকতে। রিতমকে ফিরিয়ে দিয়েছে মধুমিতা।
রিতম এসেছিলো একটু আগে। মধুমিতাকে ঘুমোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, মিতা.....ঘুমোবে না?
সময় লাগবে। বাসন ধোয়া বাকি। বেশি হওয়া খাবার গুলোও ফ্রিজে রাখতে হবে, কালকে সকালের কিছু কাজও করে রাখবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে রাতে তো ঘুম হয় নি, আজকে আবার জার্নি গেছে। তোমার বসে থাকতে হবে না।
রিতমের মুখ কালো হয়ে গেছিলো তখনই। তারপরও আরেক বার অনুরোধের স্বরে বলেছিলো, সমস্যা নেই। কালকে করো। মা আছে.... সাহায্য করবে।
তোমার মাথা খারাপ? মাকে আমি বলবো এগুলো করে দিতে? উনি বয়স্ক মানুষ। আজকে এই যে কাজ করলেন, দু তিন দিন এখন বাতের ব্যথায় ভুগবেন। না..... তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।
রিতম এরপর চলে গেছিলো। রিতম বেহায়া না, কোনো কিছু নিয়েই বেশি ঘ্যানঘ্যান করতে হয় না। অল্পতেই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। শান্ত, খুব বেশি শান্ত ও।
এ দিকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো মধুমিতা। পরক্ষনেই হুঁ হুঁ করে ধেয়ে এল এক রাশ কান্না। বুকের ভেতর নিদারুণ কাঁটা ফুটছিলো। বারবার প্রিয় স্বামীকে দূরে ঠেলে দিয়ে এখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলো।
এরপর অনেক সময় রান্না ঘরে ছিলো। বার কয়েক লুকিয়ে লুকিয়ে শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে দেখে এসেছে, একবার রিতমকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, আরেক বার দেখেছে আধ শোয়া হয়ে ফোন দেখছে, শেষ বার যখন দেখলো ঘুমিয়ে গেছে মধুমিতা তখন চুপিচুপি ঘরে এসে প্রবেশ করলো। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে শরীরে হালকা প্রসাধনী লাগায় মধুমিতা। আজ তা করলো না, শুধু হাত মুখ ধুয়ে আলো নিভিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
পাশেই রিতম। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ আর ওর শরীরের মৃদু গন্ধ ভেসে আসছিলো। আজ অনেক দিন পর রিতমের শরীরের পরিচিত গন্ধটা পাচ্ছে। সেই বছর চার আগে মধুমিতা রিতমের সাথে এক বিছানায় শুয়েছে। এর পর কতগুলো বছর কেটেছে।
সেই দিনের কথা মধুমিতার আজও মনে পড়ে। পরের দিন রিতমের ফ্লাইট। সারা রাত রিতম ঘুমোয় নি মধুমিতার হাত ধরে বসে ছিলো।
এই এখন ঘুমোয়। কাল সারাদিন জার্নি করবে।
রিতম মৃদু হেসে বলেছিলো, একবার চলে গেলে এরপর কতদিন তোমাকে আর কাছে পাবো না কে জানে। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সকাল হয়ে যাবে। তারপর আমায় চলে যেতে হবে। তোমাকে তো আর ছুঁতে পারবো না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এ রাত কাটাতে পারবো না, মিতা। তুমি আমার সাথে থাকো প্লিজ।
সারা রাত ওরা গল্প করেছিলো সে দিন। কত যে স্বপ্ন দেখছিলো এক সাথে। এক সময় রিতম বলেছিলো ও যখন আবার ফিরে আসবে তখন ওরা নতুন করে ফুলশয্যা করবে আবার। মধুমিতা লাল বেনারসি পরে নতুন বউ সাজবে আর রিতম সাজবে বর।
কিন্তু আজ কিছুই হলো না। মধুমিতা নিজের হাতে সব নষ্ট করে ফেললো।
মধুমিতা ঘুমন্ত রিতমকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের বালিশ ছেঁড়ে মাথা এলিয়ে দিলো রিতমের বাহুতে। এতটুকুতেই যেন ওর বুকের সব ভার লাঘব হয়ে গেল।
একটু পরেই রিতমের দুঃখচারিণী দুর্দশাগ্রস্তা স্ত্রী ওর বুকের উপরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোরের দিকে বুকের উপর চাপ অনুভব করে ভেঙে গেল রিতমের। চোখ মেলে দেখলো মধুমিতা ওর উপর শুয়ে শুয়ে আছে, হাত পা তুলে দিয়েছে শরীরে, মুখটা রিতমের মুখের কাছে। মধুমিতার মুখটা যেন এক টুকরো চাঁদ। অন্ধকারেও বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মুখের উপর এসে পড়েছে একগোছা এলোমেলো চুল। ফ্যানের বাতাসে হালকা উড়ছে।
রিতম ধীরে ধীরে চুল গুলো এক পাশে সরিয়ে দিলো। মধুমিতার সুন্দর সুকুমার মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব ভালো লাগলো রিতমের। দু হাত দিয়ে শক্ত করে মধুমিতাকে জড়িয়ে ধরলো।
এরপর রিতমের আর ঘুম এলো না। বাকি রাত জেগে থাকলো।
রাতের বেলা মধুমিতাকে ঘুমোতে ডেকে আসার পরেও রিতম অনেকক্ষণ ধরে জেগে অপেক্ষা করছিলো। পরে এক সময় ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ও ঘুমিয়ে গেছিল তা রিতম জানে না। কিন্তু মধুমিতা অনেক রাতে ঘুমাতে এসেছিল।
রিতমের মন খচখচ করছিল। মধুমিতা ইচ্ছে করে ওর থেকে দূরুত্ব বজায় রাখছিল। কিন্তু কেন রাখছিলো? ওদের মধ্যে এমন কিছুই তো হয়নি, তাহলে?
আজ সকাল হলেই মধুমিতা কে জিজ্ঞেস করবে রিতম। যদি ও কোন ভুল করেই থাকে তাহলে তার জন্য ক্ষমাও চাইবে মধুমিতার থেকে।
রিতম এর ভালো লাগছিল না। বুকের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছি। না এরকমটা বেশিক্ষণ চলতে দেওয়া যাবে না। সব কিছু ঠিক করে নিতে হবে।
মানুষের ঘুম বৈচিত্র্যময়। একজন ঘুমন্ত মানুষের কাছে আর একজন জাগ্রত মানুষ বেশিক্ষণ থাকলে বা নড়াচড়া করলে বা শুধু বসে থাকলেও অন্য ঘুমন্ত মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
সেই রূপ মধুমিতারও ঘুম ভেঙ্গে গেল সেই অল্প সময়ের মধ্যে। ও উঠে আবিষ্কার করল রিতমের বুকের উপর শুয়ে আছে ও আর রিতম ওকে মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মধুমিতা এটা চায়নি। ও ভেবেছিল রিতম ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও উঠে চলে যাবে।
মধুমিতাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে রিতম স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল, গুড মর্নিং, ম্যাম। ঘুম কেমন হলো?
মধুমিতা মুখ তুলে চাইলো না। রিতমের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখে ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিলো। গুড মর্নিং। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মধুমিতা বলল। আমার ঘুম ভালোই হয়েছে। হাউ ওয়াজ ইউরস?
ভালো। তবে, তোমার সাথে ঘুমাতে পারলে আরো ভালো হতো।
আমিতো তোমার পাশেই ঘুমিয়েছি। ভ্রু কুঁচকে মধুমিতা বললো।
তুমি যখন এসে ঘুমিয়েছো তখন তো আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। আই স্লেপ্ট উইথ দ্যা ফিলিং অব ডেপ্রিভিয়েশন অব ইউ।
মধুমিতা মৃদুস্বরে বললো, আর আমি যে চার বছর তোমাকে ছাড়া থাকলাম! তুমি একদিনেই ডেপরাইভড ফিল করছ?
কিন্তু সাথে সাথেই মধুমিতা কথা ঘুরিয়ে ফেললো। বললো, এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়েছো যে?
কারণ এসময়ে আমার অভ্যাস জেগে থাকা। আর ঘুমোনোর সময় সকাল থেকে দুপুর। আজ রাতে ঘুম হয়েছে কারণ আগের দুদিন ঘুমাতে পারিনি তাই। নাহলে তো এসময় জেগে থাকি।
মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো, অনেক পরিশ্রম করছো এতো গুলো বছর না?
তুমি জানো না মিতা কত দিন পর আজ রাতে ঘুমালাম। তোমরা জিজ্ঞেস করতে আমি কেমন আছি, বলতাম ভালো, কিন্তু তোমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, আমি খুব একটা ভালো ছিলাম না মিতা।
রিতমের কথায় খারাপ লাগলো মধুমিতার। সত্যিই তো, ছেলেটা কত গুলো বছর সব কিছু ছেড়ে বিদেশে পরে ছিলো। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ কিছুই পায় নি। আর মধুমিতা ওকে মনে করেছে কি সুখেই ছিলো। ও মনে মনে ঠিক করলো এখন যত গুলো দিন রিতম কোলকাতায় থাকবে মধুমিতা প্রাণ ঢেলে ওকে সেবা করে দেবে।
আজ কি খাবে বলো তো? মধুমিতা শুধালো।
তুমি কি আমাকে কত খাবার খাওয়াবে সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছো মিতা?
মধুমিতা হাসলো। মুখ তুলে চাইলোও এবার। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন বলতো?
কালকে এসেছি পর থেকেই শুধু খাওয়ার উপর রেখেছো।
বাড়ে এতদিন পরে এলে একটু ভালো মন্দ খাওয়াবো না?
রিতম হেসে হেসে বলল, তাহলে এ কয়েক মাসে তো মোটা হয়ে যাবো দেখছি।
সেটাই ঠিক হবে। মোটা হওয়া দরকার তোমার। শরীরে তো কিছুই নেই আর। বেশি বেশি খেয়ে ভালো একটা স্বাস্থ্য বানাও।
তোমার স্বাস্থ্য কিন্তু আগের থেকে অনেক ভালো হয়ে গেছে মিতা।
মধুমিতা দুষ্টুমি করে বলল, তুমি কি আমাকে মোটা বললে?
মোটেও না। বলেছি আগে শুকনো ছিলে এখন পারফেক্ট হয়েছো।
হুম....কত দিন থাকবে এবার? মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো।
অনেক দিন।
তুমি ঐ রকমই বলো। শেষে দেখা যাবে এক মাসও থাকবে না।
নাগো মিতা, এবার অনেক দিন থাকবো।
কত দিন?
চার মাস।
কথাটা মধুমিতার বিশ্বাস হলো না। রিতম মরে গেলেও চার থাকতে পারবে না। কিন্তু কথাটায় তো মধুমিতার খুশি হওয়ার কথা। রিতম ওর কাছে চার মাস থাকবে, এর থেকে বড় পাওয়া আর আছে নাকি?
কয়েক মাস আগে এ কথাটা শুনলে মধুমিতা প্রকৃতই খুশি হতো। এখন সময় পাল্টেছে। নিজের কামনা পরিতৃপ্ত করার জন্য এখন ও আরেকটা সম্পর্কে আবদ্ধ। গোপন আর অবৈধ সম্পর্ক সেটা। তাই অনেক কিছু ভেবে চিন্তে চলতে হয় ওকে।
তাই রিতমের হঠাৎ আগমন ওকে অনেকটা অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় পায় নি। আর এখন যখন শুনলো রিতম অনেকদিন থাকবে সেটা যেন ওর সংকট আরো বাড়িয়ে দিলো।
দিহানকে এখনো সব কিছু বলা হয়নি, এখন ওরা কি করবে তা ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে, না হলে কোনো একটা অঘটন ঘটে যাবে।
মধুমিতা ঠিক করেছে যত দিন রিতম থাকে ততদিন আর দিহান কে ওর কাছে ঘেঁষতে দেবে না। কিন্তু বড় চিন্তা দিহান কি এতো দিন নিজেকে সামলে রাখবে?
বেপরোয়া হয়ে ওঠবে না?
রিতমের কাছে মধুমিতার মুখের ভাব এবারও ধরা পড়ে গেল। ও বুঝতে পারল মধুমিতা এ সংবাদেও খুশি হতে পারে নি। কিন্তু কেন? সংঙ্কায় আকুল হয়ে উঠলো রিতম।
সকালে খাওয়া দাওয়ার পর রিতম ইংল্যান্ড থেকে আনা লাগেজ গুলো খুললো। মা বাবা, মেহুর আর বউয়ের জন্য আনা উপহার গুলো দিতে লাগলো এক এক করে। মা বাবা খুব খুশি। রিতম একবার মধুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেই আগের মতো নিরাসক্ত ওর মুখ।
মধুমিতার আসলে কি হয়েছে এটা জানার জন্য মধুমিতার মুখোমুখি হতে হবে রিতমকে। তারজন্য রিতম মনে মনে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তার আগে আরেকবার মধুমিতাকে পরিক্ষা করতে হবে।
অনেকক্ষণ পর বাবা মা চলে গেলে রিতম ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী মধুমিতার দিকে এগিয়ে গেলো। মধুমিতা তখন মেহুলের জন্য আনা উপহার গুলো উঠিয়ে রাখছিলো। রিতম পেছন থেকে জাপটে ধরেছিল মধুমিতাকে। ইচ্ছে করে ছুঁতে চেষ্টা করছিলো।
কিন্তু মধুমিতা বিদ্যুৎ গতিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলো। রিতমের থেকে একটু দূরে সরে এসে বললো, কি করছো রিতম?
রিতম মধুমিতার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, আমি আসায় তুমি কি খুশি হওনি, মিতা?
প্রশ্নটা যেন মধুমিতার বুকে শুলের মতো বিঁধলো। কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারলো না কি উত্তর দেবে। ঠোঁট কেঁপে উঠলো মধুমিতার। তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, এ কথার মানে কি, রিতম? তোমার কেন এমন মনে হলো যে আমি খুশি না?
তার কারণ হলো দূরুত্ব, কেন তুমি এমন দূরে দূরে থাকছো আমার থেকে? কেন এই অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছো? যখনই তোমার কাছে যেতে চাইছি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো কেন, মিতা? বলো কেন?
সেটা তুমি বুঝতে পারবে না রিতম। সত্যি বলতে আমি একটু অপ্রস্তুত। তাই শারীরিক ভাবে তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারছি না। কয়েক দিন সময় লাগবে।
তুমি কি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না মিতা?
তোমার এমনটা মনে হচ্ছে কেন? প্রায় কেঁদে ফেলল মধুমিতা। একদিন মাত্র তোমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, তার জন্য তুমি এমনটা ভাবতে পারছো? এটা আমার সাথে ঠিক বিচার করছো তুমি?
তুমি তো আমাকে কিছুই বলো নি, মিতা। আমি বুঝবো কি করে?
তার জন্য আমার ভালোবাসা আমার অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন করবে?
স্যরি মিতা। কিন্তু তুমি সত্যি পাল্টে গেছো।
আমি পাল্টাই নি রিতম। আমি আগের মতই আছি, কিন্তু তুমি আমাকে অনেক দিন পর দেখছো। তাই তোমার হয়তো এমন মনে হচ্ছে।
কিন্তু তুমি এতো দূরে থাকছো কেন মিতা?
কোথায়?
তাহলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছো যে?
মধুমিতা এবার হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো রিতমের উপর। তীব্র চুমু খেলো।
এটাই এক মাত্র পথ ছিলো রিতমের প্রশ্ন বন্ধ করার।
দীর্ঘ সময় পর মুখ তুলে হাঁফাতে হাঁফাতে মধুমিতা বললো, এখনো মনে হচ্ছে যে আমি দূরের, তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখছি?
রিতম ঠোঁট মুছে বললো, না।
*******
ছোট আপডেট।
স্যরি।
এতো টুকু লিখতেই অনেক সময় লেগেছে।
তবে, এখন থেকে রেগুলার আপডেট দিতে চেষ্টা করব।
Take love ❤️
মধুমিতা একসাথে দুই উনুনে রান্না করেছে। সাথে সাহায্য করেছেন কমলিনী দেবী, ফলে দ্রুতই ও রান্না শেষ করতে পেরেছে। সব খাবার ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে মধুমিতা রিতমকে ডাকতে গেলো।
রিতম তখন বসার ঘরেই ছিলো। মধুমিতাকে দেখে হেসে বললো, কি রান্না করছো বলতো। পুরো বাড়ি গন্ধে ভরে গেছে। খিদে পেয়ে গেছে এর মধ্যেই।
তাহলে এসো, রান্না হয়ে গেছে।
কি কি রান্না করলে?
খেতে বসলেই দেখতে পাবে। মধুমিতাও মৃদু হেসে বললো।
মধুমিতা খাবার জন্য শশুর মশাইকেও ডেকে এনেছিলো। তিনজনকে খেতে দিয়েছিলো এক সাথে। রিতম সেটা খেয়াল করে বললো, মিতা, তুমিও খেতে বসো।
আমি খেতে বসে গেলে তোমাদের খেতে দেবে কে?
কথায় যুক্তি ঠিক আছে, কিন্তু এমন কাঠখোট্টা ভাবে কে উত্তর দেয়?
এরপর রিমত আরো কয়েক বার অনুরোধ করেছিল, মধুমিতা শোনে নি। রিতমের মনে হলো ওর বউ আর ঠিক আগের মতো নেই। পাল্টে গেছে। কেমন যেন গম্ভীর, প্রাণহীন, আর খুব দূরের মনে হচ্ছে।
রিতমকে দেখে ওর মা বাবা আর মেহুল প্রচন্ড খুশি হয়েছে। মেহুলতো রিতিমত নেচে ফেলে এমন অবস্থা। তারপর কি এনেছে, কেমন আছে আরো কত খুনসুটি। মধুমিতা তো এমন কিছুই করলো না? ওরই তো সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা ছিলো। ওর মধ্যে কেন কোনো প্রাণ চাঞ্চল্য নেই? ওর মধ্যে কোনো কৌতুহল জাগছে না কেন?
অভিমান থেকে কি কেউ এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে?
খেতে খেতে এ কথা গুলোই রিতম আবার ভাবছিল। মনকে বোঝাতে চাইছিলো যে এটা স্বাভাবিক, মধুমিতা তো বেশ কয়েক মাস ধরেই এমন নির্জীব। কিন্তু ওকে আজ সরাসরি দেখে সেটা যেন একটু বেশিই চোখে লাগছে, রিতম স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করতে পারছে না।
ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেছিলো, ওঠে যাবে এমন সময় মধুমিতা আবার ওর প্লেট ভরিয়ে দিল ফ্রাইড রাইস দিয়ে, সাথে মাটন কষা। রিতম বললো, কি করলে এটা? এমনিতেই খাওয়া বেশি হয়ে গেছে।
পারবে, খাও। মধুমিতা বলল। আগে এরচেয়ে বেশি খেতে। তারউপর এতোদিন তো বাঙালি খাবার খাও নি।
রিতমের পেট ভরে গেছিলো, মধুমিতাকে শত বলেও বোঝাতে পারলো না। ওর কথা খেতেই হবে। সুতরাং ওগুলোও খেতে হলো।
এই একটা জিনিস ওর মন ভালো করে দিল, মধুমিতা রিতমকে প্রাণ দিয়ে আপ্পায়ণ করছিলো। কিন্ত কেন যে এমন পরের মতো ব্যবহার করছিলো! কেন যে এমন দূরুত্ব বজায় রাখছিল।
খাওয়ার পর রিতম ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মধুমিতা বাদে সবার খাওয়া শেষ হয়েগেছিলো। এঁটো পরিস্কার করে মধুমিতা প্লেট গুলো উঠিয়ে নিচ্ছিল ধোয়ার জন্য।
রিতম বললো, এবার তুমি খেয়ে নাও, মিতা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মধুমিতা মৃদু হেসে বললো, এগুলো পরিষ্কার করে নিই, তারপরই খাচ্ছি।
মধুমিতার ঠোঁটের এই হাসিটিও কেমন নির্জিব দেখাচ্ছিলো। চোখে লাগছিলো খুব।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। বাড়ির প্রায় সব আলো নিভে গেছে, শুধু রান্নাঘরের ছোট্ট টিউবলাইটটা জ্বলছে। মধুমিতা একা দাঁড়িয়ে আছে সিঙ্কের সামনে। হাতে একটা কাচের থালা, কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ও শুধু জলের ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে আছে। জল পড়ছে টুপটুপ করে, আর ওর চোখের কোণেও জমে উঠেছে একই রকম বিন্দু, বাষ্পাদ্র হয়ে ওঠেছে ওর আঁখি।
রিতমকে দূরে সরিয়ে রেখে কষ্ট হচ্ছিলো। মধুমিতা ওর কালো মুখটা দেখেছে যখন রিতম এসেছিলো ওকে শোবার জন্য ঢাকতে। রিতমকে ফিরিয়ে দিয়েছে মধুমিতা।
রিতম এসেছিলো একটু আগে। মধুমিতাকে ঘুমোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, মিতা.....ঘুমোবে না?
সময় লাগবে। বাসন ধোয়া বাকি। বেশি হওয়া খাবার গুলোও ফ্রিজে রাখতে হবে, কালকে সকালের কিছু কাজও করে রাখবো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে রাতে তো ঘুম হয় নি, আজকে আবার জার্নি গেছে। তোমার বসে থাকতে হবে না।
রিতমের মুখ কালো হয়ে গেছিলো তখনই। তারপরও আরেক বার অনুরোধের স্বরে বলেছিলো, সমস্যা নেই। কালকে করো। মা আছে.... সাহায্য করবে।
তোমার মাথা খারাপ? মাকে আমি বলবো এগুলো করে দিতে? উনি বয়স্ক মানুষ। আজকে এই যে কাজ করলেন, দু তিন দিন এখন বাতের ব্যথায় ভুগবেন। না..... তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।
রিতম এরপর চলে গেছিলো। রিতম বেহায়া না, কোনো কিছু নিয়েই বেশি ঘ্যানঘ্যান করতে হয় না। অল্পতেই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। শান্ত, খুব বেশি শান্ত ও।
এ দিকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো মধুমিতা। পরক্ষনেই হুঁ হুঁ করে ধেয়ে এল এক রাশ কান্না। বুকের ভেতর নিদারুণ কাঁটা ফুটছিলো। বারবার প্রিয় স্বামীকে দূরে ঠেলে দিয়ে এখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিলো।
এরপর অনেক সময় রান্না ঘরে ছিলো। বার কয়েক লুকিয়ে লুকিয়ে শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে দেখে এসেছে, একবার রিতমকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, আরেক বার দেখেছে আধ শোয়া হয়ে ফোন দেখছে, শেষ বার যখন দেখলো ঘুমিয়ে গেছে মধুমিতা তখন চুপিচুপি ঘরে এসে প্রবেশ করলো। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে শরীরে হালকা প্রসাধনী লাগায় মধুমিতা। আজ তা করলো না, শুধু হাত মুখ ধুয়ে আলো নিভিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
পাশেই রিতম। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ আর ওর শরীরের মৃদু গন্ধ ভেসে আসছিলো। আজ অনেক দিন পর রিতমের শরীরের পরিচিত গন্ধটা পাচ্ছে। সেই বছর চার আগে মধুমিতা রিতমের সাথে এক বিছানায় শুয়েছে। এর পর কতগুলো বছর কেটেছে।
সেই দিনের কথা মধুমিতার আজও মনে পড়ে। পরের দিন রিতমের ফ্লাইট। সারা রাত রিতম ঘুমোয় নি মধুমিতার হাত ধরে বসে ছিলো।
এই এখন ঘুমোয়। কাল সারাদিন জার্নি করবে।
রিতম মৃদু হেসে বলেছিলো, একবার চলে গেলে এরপর কতদিন তোমাকে আর কাছে পাবো না কে জানে। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সকাল হয়ে যাবে। তারপর আমায় চলে যেতে হবে। তোমাকে তো আর ছুঁতে পারবো না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এ রাত কাটাতে পারবো না, মিতা। তুমি আমার সাথে থাকো প্লিজ।
সারা রাত ওরা গল্প করেছিলো সে দিন। কত যে স্বপ্ন দেখছিলো এক সাথে। এক সময় রিতম বলেছিলো ও যখন আবার ফিরে আসবে তখন ওরা নতুন করে ফুলশয্যা করবে আবার। মধুমিতা লাল বেনারসি পরে নতুন বউ সাজবে আর রিতম সাজবে বর।
কিন্তু আজ কিছুই হলো না। মধুমিতা নিজের হাতে সব নষ্ট করে ফেললো।
মধুমিতা ঘুমন্ত রিতমকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের বালিশ ছেঁড়ে মাথা এলিয়ে দিলো রিতমের বাহুতে। এতটুকুতেই যেন ওর বুকের সব ভার লাঘব হয়ে গেল।
একটু পরেই রিতমের দুঃখচারিণী দুর্দশাগ্রস্তা স্ত্রী ওর বুকের উপরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
ভোরের দিকে বুকের উপর চাপ অনুভব করে ভেঙে গেল রিতমের। চোখ মেলে দেখলো মধুমিতা ওর উপর শুয়ে শুয়ে আছে, হাত পা তুলে দিয়েছে শরীরে, মুখটা রিতমের মুখের কাছে। মধুমিতার মুখটা যেন এক টুকরো চাঁদ। অন্ধকারেও বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মুখের উপর এসে পড়েছে একগোছা এলোমেলো চুল। ফ্যানের বাতাসে হালকা উড়ছে।
রিতম ধীরে ধীরে চুল গুলো এক পাশে সরিয়ে দিলো। মধুমিতার সুন্দর সুকুমার মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব ভালো লাগলো রিতমের। দু হাত দিয়ে শক্ত করে মধুমিতাকে জড়িয়ে ধরলো।
এরপর রিতমের আর ঘুম এলো না। বাকি রাত জেগে থাকলো।
রাতের বেলা মধুমিতাকে ঘুমোতে ডেকে আসার পরেও রিতম অনেকক্ষণ ধরে জেগে অপেক্ষা করছিলো। পরে এক সময় ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ও ঘুমিয়ে গেছিল তা রিতম জানে না। কিন্তু মধুমিতা অনেক রাতে ঘুমাতে এসেছিল।
রিতমের মন খচখচ করছিল। মধুমিতা ইচ্ছে করে ওর থেকে দূরুত্ব বজায় রাখছিল। কিন্তু কেন রাখছিলো? ওদের মধ্যে এমন কিছুই তো হয়নি, তাহলে?
আজ সকাল হলেই মধুমিতা কে জিজ্ঞেস করবে রিতম। যদি ও কোন ভুল করেই থাকে তাহলে তার জন্য ক্ষমাও চাইবে মধুমিতার থেকে।
রিতম এর ভালো লাগছিল না। বুকের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছি। না এরকমটা বেশিক্ষণ চলতে দেওয়া যাবে না। সব কিছু ঠিক করে নিতে হবে।
মানুষের ঘুম বৈচিত্র্যময়। একজন ঘুমন্ত মানুষের কাছে আর একজন জাগ্রত মানুষ বেশিক্ষণ থাকলে বা নড়াচড়া করলে বা শুধু বসে থাকলেও অন্য ঘুমন্ত মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে দেয়।
সেই রূপ মধুমিতারও ঘুম ভেঙ্গে গেল সেই অল্প সময়ের মধ্যে। ও উঠে আবিষ্কার করল রিতমের বুকের উপর শুয়ে আছে ও আর রিতম ওকে মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মধুমিতা এটা চায়নি। ও ভেবেছিল রিতম ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও উঠে চলে যাবে।
মধুমিতাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে রিতম স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল, গুড মর্নিং, ম্যাম। ঘুম কেমন হলো?
মধুমিতা মুখ তুলে চাইলো না। রিতমের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখে ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিলো। গুড মর্নিং। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মধুমিতা বলল। আমার ঘুম ভালোই হয়েছে। হাউ ওয়াজ ইউরস?
ভালো। তবে, তোমার সাথে ঘুমাতে পারলে আরো ভালো হতো।
আমিতো তোমার পাশেই ঘুমিয়েছি। ভ্রু কুঁচকে মধুমিতা বললো।
তুমি যখন এসে ঘুমিয়েছো তখন তো আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। আই স্লেপ্ট উইথ দ্যা ফিলিং অব ডেপ্রিভিয়েশন অব ইউ।
মধুমিতা মৃদুস্বরে বললো, আর আমি যে চার বছর তোমাকে ছাড়া থাকলাম! তুমি একদিনেই ডেপরাইভড ফিল করছ?
কিন্তু সাথে সাথেই মধুমিতা কথা ঘুরিয়ে ফেললো। বললো, এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়েছো যে?
কারণ এসময়ে আমার অভ্যাস জেগে থাকা। আর ঘুমোনোর সময় সকাল থেকে দুপুর। আজ রাতে ঘুম হয়েছে কারণ আগের দুদিন ঘুমাতে পারিনি তাই। নাহলে তো এসময় জেগে থাকি।
মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো, অনেক পরিশ্রম করছো এতো গুলো বছর না?
তুমি জানো না মিতা কত দিন পর আজ রাতে ঘুমালাম। তোমরা জিজ্ঞেস করতে আমি কেমন আছি, বলতাম ভালো, কিন্তু তোমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, আমি খুব একটা ভালো ছিলাম না মিতা।
রিতমের কথায় খারাপ লাগলো মধুমিতার। সত্যিই তো, ছেলেটা কত গুলো বছর সব কিছু ছেড়ে বিদেশে পরে ছিলো। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ কিছুই পায় নি। আর মধুমিতা ওকে মনে করেছে কি সুখেই ছিলো। ও মনে মনে ঠিক করলো এখন যত গুলো দিন রিতম কোলকাতায় থাকবে মধুমিতা প্রাণ ঢেলে ওকে সেবা করে দেবে।
আজ কি খাবে বলো তো? মধুমিতা শুধালো।
তুমি কি আমাকে কত খাবার খাওয়াবে সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছো মিতা?
মধুমিতা হাসলো। মুখ তুলে চাইলোও এবার। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন বলতো?
কালকে এসেছি পর থেকেই শুধু খাওয়ার উপর রেখেছো।
বাড়ে এতদিন পরে এলে একটু ভালো মন্দ খাওয়াবো না?
রিতম হেসে হেসে বলল, তাহলে এ কয়েক মাসে তো মোটা হয়ে যাবো দেখছি।
সেটাই ঠিক হবে। মোটা হওয়া দরকার তোমার। শরীরে তো কিছুই নেই আর। বেশি বেশি খেয়ে ভালো একটা স্বাস্থ্য বানাও।
তোমার স্বাস্থ্য কিন্তু আগের থেকে অনেক ভালো হয়ে গেছে মিতা।
মধুমিতা দুষ্টুমি করে বলল, তুমি কি আমাকে মোটা বললে?
মোটেও না। বলেছি আগে শুকনো ছিলে এখন পারফেক্ট হয়েছো।
হুম....কত দিন থাকবে এবার? মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো।
অনেক দিন।
তুমি ঐ রকমই বলো। শেষে দেখা যাবে এক মাসও থাকবে না।
নাগো মিতা, এবার অনেক দিন থাকবো।
কত দিন?
চার মাস।
কথাটা মধুমিতার বিশ্বাস হলো না। রিতম মরে গেলেও চার থাকতে পারবে না। কিন্তু কথাটায় তো মধুমিতার খুশি হওয়ার কথা। রিতম ওর কাছে চার মাস থাকবে, এর থেকে বড় পাওয়া আর আছে নাকি?
কয়েক মাস আগে এ কথাটা শুনলে মধুমিতা প্রকৃতই খুশি হতো। এখন সময় পাল্টেছে। নিজের কামনা পরিতৃপ্ত করার জন্য এখন ও আরেকটা সম্পর্কে আবদ্ধ। গোপন আর অবৈধ সম্পর্ক সেটা। তাই অনেক কিছু ভেবে চিন্তে চলতে হয় ওকে।
তাই রিতমের হঠাৎ আগমন ওকে অনেকটা অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় পায় নি। আর এখন যখন শুনলো রিতম অনেকদিন থাকবে সেটা যেন ওর সংকট আরো বাড়িয়ে দিলো।
দিহানকে এখনো সব কিছু বলা হয়নি, এখন ওরা কি করবে তা ওকে বুঝিয়ে দিতে হবে, না হলে কোনো একটা অঘটন ঘটে যাবে।
মধুমিতা ঠিক করেছে যত দিন রিতম থাকে ততদিন আর দিহান কে ওর কাছে ঘেঁষতে দেবে না। কিন্তু বড় চিন্তা দিহান কি এতো দিন নিজেকে সামলে রাখবে?
বেপরোয়া হয়ে ওঠবে না?
রিতমের কাছে মধুমিতার মুখের ভাব এবারও ধরা পড়ে গেল। ও বুঝতে পারল মধুমিতা এ সংবাদেও খুশি হতে পারে নি। কিন্তু কেন? সংঙ্কায় আকুল হয়ে উঠলো রিতম।
সকালে খাওয়া দাওয়ার পর রিতম ইংল্যান্ড থেকে আনা লাগেজ গুলো খুললো। মা বাবা, মেহুর আর বউয়ের জন্য আনা উপহার গুলো দিতে লাগলো এক এক করে। মা বাবা খুব খুশি। রিতম একবার মধুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেই আগের মতো নিরাসক্ত ওর মুখ।
মধুমিতার আসলে কি হয়েছে এটা জানার জন্য মধুমিতার মুখোমুখি হতে হবে রিতমকে। তারজন্য রিতম মনে মনে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তার আগে আরেকবার মধুমিতাকে পরিক্ষা করতে হবে।
অনেকক্ষণ পর বাবা মা চলে গেলে রিতম ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী মধুমিতার দিকে এগিয়ে গেলো। মধুমিতা তখন মেহুলের জন্য আনা উপহার গুলো উঠিয়ে রাখছিলো। রিতম পেছন থেকে জাপটে ধরেছিল মধুমিতাকে। ইচ্ছে করে ছুঁতে চেষ্টা করছিলো।
কিন্তু মধুমিতা বিদ্যুৎ গতিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলো। রিতমের থেকে একটু দূরে সরে এসে বললো, কি করছো রিতম?
রিতম মধুমিতার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, আমি আসায় তুমি কি খুশি হওনি, মিতা?
প্রশ্নটা যেন মধুমিতার বুকে শুলের মতো বিঁধলো। কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারলো না কি উত্তর দেবে। ঠোঁট কেঁপে উঠলো মধুমিতার। তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, এ কথার মানে কি, রিতম? তোমার কেন এমন মনে হলো যে আমি খুশি না?
তার কারণ হলো দূরুত্ব, কেন তুমি এমন দূরে দূরে থাকছো আমার থেকে? কেন এই অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছো? যখনই তোমার কাছে যেতে চাইছি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো কেন, মিতা? বলো কেন?
সেটা তুমি বুঝতে পারবে না রিতম। সত্যি বলতে আমি একটু অপ্রস্তুত। তাই শারীরিক ভাবে তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারছি না। কয়েক দিন সময় লাগবে।
তুমি কি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না মিতা?
তোমার এমনটা মনে হচ্ছে কেন? প্রায় কেঁদে ফেলল মধুমিতা। একদিন মাত্র তোমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, তার জন্য তুমি এমনটা ভাবতে পারছো? এটা আমার সাথে ঠিক বিচার করছো তুমি?
তুমি তো আমাকে কিছুই বলো নি, মিতা। আমি বুঝবো কি করে?
তার জন্য আমার ভালোবাসা আমার অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন করবে?
স্যরি মিতা। কিন্তু তুমি সত্যি পাল্টে গেছো।
আমি পাল্টাই নি রিতম। আমি আগের মতই আছি, কিন্তু তুমি আমাকে অনেক দিন পর দেখছো। তাই তোমার হয়তো এমন মনে হচ্ছে।
কিন্তু তুমি এতো দূরে থাকছো কেন মিতা?
কোথায়?
তাহলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছো যে?
মধুমিতা এবার হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো রিতমের উপর। তীব্র চুমু খেলো।
এটাই এক মাত্র পথ ছিলো রিতমের প্রশ্ন বন্ধ করার।
দীর্ঘ সময় পর মুখ তুলে হাঁফাতে হাঁফাতে মধুমিতা বললো, এখনো মনে হচ্ছে যে আমি দূরের, তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখছি?
রিতম ঠোঁট মুছে বললো, না।
*******
ছোট আপডেট।
স্যরি।
এতো টুকু লিখতেই অনেক সময় লেগেছে।
তবে, এখন থেকে রেগুলার আপডেট দিতে চেষ্টা করব।
Take love ❤️


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)