12-11-2025, 11:06 PM
নিয়োগ পর্ব ২৩
"ফুল তুই?"
"খাবার নিয়ে এইচিলাম, পড়ে গেল", বলেই পিছন ফিরে ছুট দিল ফুলমণি।
"ফুল দাঁড়া, যাসনে", বলে তড়িঘড়ি নিজের জাঙ্গিয়া আর প্যান্টটা পড়ে দরজা খুলে পিছু নিল মানিক।
মাধবী কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার ব্লাউজের সবকটা হুক ছিঁড়ে দিয়েছিল মানিক। সেফটিপিনও এনে দেয়নি। উল্টে দৌড়োলো মেয়েটির পিছনে। কখন ফিরবে জানা নাই। এর মধ্যে যদি ওর পার্টির ছেলেপিলেরা চলে আসে?
ব্লাউজের দুই দিকটা কোনোমতে হাতে নিয়ে জড়ো করে গিঁট দিয়ে বাঁধলো। তা আঁচল দিয়ে ঢাকলো। যাতে বাইরে থেকে অশোভনীয় কিছু লক্ষণীয় না হয়।
নিজের শাড়িটা ঠিক করে সেও বেরিয়ে পড়লো। মুখটা পুরো কষকষে তিতা লাগছে। সামনে রাস্তার ধারে কোথাও কল পেলে ভালো ভাবে গার্গল করে মুখটা ধুয়ে নিতে হবে। তাও রক্ষে, খালি পেটে আছে বলে বমি পাচ্ছেনা। নাহলে যা তরল সে পান করেছে তা বিষের থেকেও বেশি বিষধর!
মাধবী আপনমনে বিডন স্ট্রিটের ধার ধরে হাঁটতে লাগলো। কোথাও জলের কল সে পাচ্ছিল না। ভবঘুরের মতো খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটা চায়ের দোকানে এসে পৌঁছলো। পচাদার চায়ের দোকান। সেখানে কিছু সদ্য পরিচিত মুখ বসে আড্ডা মারছিল। পরিচয় নাহলেও এদেরকে সে কিছুক্ষণ আগেই দেখেছে পার্টি অফিসের সামনে। মানিকের চ্যালা-চামুন্ডা সব! তাদের মধ্যে কেউ চা খাচ্ছিল, কেউ সিগারেটে টান দিচ্ছিল।
মাধবীকে দেখে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করতে লাগলো। মাধবী তা দেখে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে শাড়ির আঁচলটা ঠিক করলো। ঝন্টু আগ বাড়িয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো, "দাদার সাথে মিটিং হয়েগেছে?"
"হহুঁহ??", থতমত খেয়ে গেল মাধবী।
"ওই যে, পার্টি অফিসে গেছিলেন, আমরা তো সেখানকার লোক, চিনতে পারছেন না?"
"হ্যাঁ", একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল মাধবীকে।
"তা বৌদি চা খাবেন?"
"না, একটু জল চাই.."
"ঠিক আছে, আসুন", বলে পচাদা-কে হাঁক মেরে জলের জগটা পাশ করতে বললো ঝন্টু।
"একটা গ্লাস হলে ভালো হয়", অনুরোধ জানালো মাধবী।
"নিশ্চই, নিশ্চই!.... পচাদা একটা গ্লাস দাও তো"
ঝন্টু পচার কাছ থেকে গ্লাস নিয়ে তাতে জগ থেকে জল ঢালতে লাগলো। মাধবীর দিকে স্টিলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল। মাধবী একটু ইতস্তত করে গ্লাসটা নিল। এত গুলো ছোকরা ছেলেদের মাঝে মাধবীর আড়ষ্টভাব ছিল স্পষ্ট। দোকানে মানিকের ছেলেদের ছাড়াও আরো জনা কয়েক লোক থাকলেও সেখানে সে ব্যতীত আর কোনো মেয়ে ছিলনা। পচার দোকানটা সব লোফার লম্পটদেরই আস্তানা। রাত হলেই চাটাই পেতে চলে তাস পেটানো, সাথে সুরা পান। যোগ দেয় বছর পঁয়তাল্লিশের পচাও।..
"তা দিদিমণি কি এখানে নতুন?", চায়ের ডেকচিতে বড় হাতা দিয়ে চা চিনি দুধে ভালো করে মেশাতে মেশাতে জিজ্ঞেস করলো পচা।
অপ্রত্যাশিতভাবে আসা চা ওয়ালার প্রশ্নে কিছুটা থমকে গিয়ে আবার পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মাধবী উত্তর দিল, "হ্যাঁ, মানে ওই আর কি। .. বক্সার থেকে এসেছি। .."
"বক্সার?? সে তো বিহার।.. আপনি কি বিহারি?", মানিকের দলের আর এক বৃষ পকাই উপযাজক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। পকাইয়ের সবকিছুতে আগ্রহ একটু বেশিই। তাই প্রয়োজনের থেকে মাত্রাতিরিক্ত কথা, এবং অধিকার-উর্দ্ধ বিষয়ে নাক গলাতে সে দু'বার ভাবেনা। তার জন্য মানিকের কাছে প্রায়শই বকা খায় সে।
"আরে থামো তো! বৌদিকে আগে বসতে দাও। তোমরা সবাই প্রশ্ন করে করে বেচারিকে অতিষ্ঠ করে তুলছো। বৌদি বিহারি হোক বা বাঙালি, তাতে আমাদের কি??.. আপনি এখানে আসুন", বলে নিজের জায়গা ছেড়ে দিল শ্যামল, দলের রোমিও।
"বাবাহঃ শ্যামা, তোর তো দেখছি খুব চিন্তা বৌদি-কে নিয়ে!.. হা হা হা হা", হাসতে হাসতে টিস্ করলো ঠোঁটকাটা দিলীপ। যেমন নাম, তেমনই চরিত্র। কোনো কিছুই মুখে আটকায় না। স্থান কাল পাত্র, সেসব আবার কি? দিলীপ যেখানে যে সময় যার সাথে কথা বলে সেটাকেই সে নিজের মনে করে যা ইচ্ছে তাই বলে দেবে। এই জগৎ সংসারে তার লাগাম টানতে পারে শুধু একজন, মানিক চাঁদ মিত্তির। তাকে ছাড়া সে আর কাউকে ভয় পায়না।
"আরে না না!! আসলে বৌদি আমাদের দাদার খাস লোক! তাই আর কি...." , দলের মধ্যে শ্যামলটাই একটু গোবেচারা মার্কা। তার উপর মেয়ে দেখলে মন গ্লিসারিন মেখে পিছলে যায়। সধবা, বিধবা, কিশোরী, যুবতী কোনো বাদ বিচার সে রাখেনা। সবার উপরই মন পড়ে যায় তার।
"তা খাস মানুষটার দেখাশোনার দায়িত্ব কি দাদা তোকে দিয়েছে?", পাশ থেকে দলবদলু মঙ্গল বলে উঠলো। আগে বিরোধী শিবিরে ছিল। সরকারি সুবিধা পেতে ও ক্ষমতার অলিন্দে থাকতে দলবদল করে মানিকের আস্তানায় এসেছে। তাই জন্য দলের মধ্যে এখনো সেভাবে খাপ খাওয়াতে পারেনি।
হাসির ছলে হলেও সবাই মঙ্গলকে দলবদলু বলে ডাকে। পাল্টা সেও বলে যে এটাই নাকি সমাজের দস্তুর, সময়ের সাথে সাথে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়া। নিজেকে উইনস্টন চার্চিলের সাথে তুলনা করে। বলে নাকি তিনিও ওর মতোই দলবদলু ছিলেন! কনসারভেটিভ পার্টি থেকে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তারপর লিবারেল পার্টিতে যোগ। ফের কনসারভেটিভ দলে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন, বিরোধী দলনেতাও ছিলেন! মঙ্গলের মতে, পশ্চিমবঙ্গেও একদিন তার মতো সুবিধাবাদী দলবদলুদের বাড়বাড়ন্ত হবে। আগামীদিনে তারাই নাকি রাজ্যের রূপরেখা ও দিশা নির্ধারণ করবে।...
"এই চুপ কর তো তোরা সবাই! তোদের জন্য বৌদি আমার আরো ঘাবড়ে যাচ্ছে।.. বৌদি কিছু মাইন্ড করবেন না। এরা এরকমই। আপনি প্লিজ বসুন এখানে", বলে একটা মোড়া এগিয়ে দিল মানিকের ডান হাত তথা সেনাপতি ঝন্টু। তাকে নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। সত্তর--আশির দশকে মানিক যখন প্রথম প্রথম লোহা লক্কড়ের অবৈধ কারবারিতে হাত পাকাচ্ছিল তখন থেকেই ঝন্টু তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। দলের প্রথম এবং সবচেয়ে পুরোনো ষণ্ড। মানিকের পরেই তার স্থান।
এছাড়াও আরো একজন রয়েছে, বুঁদো। ফুলমণির দাদা। বাড়িতে বোনটা ছাড়াও এক অন্ধ বিধবা মা রয়েছে। চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে, কানে শোনে বেশি। মানিকের আজ্ঞাবহ। তাই মানিক তার পরিবারের সবাইকে খুব স্নেহ করে।
সেনাপতি ঝন্টু, এঁচোড়েপক্ক পকাই, রোমিও শ্যামল, ঠোঁটকাটা দিলীপ, দলবদলু মঙ্গল, আর ফুলমণির দাদা বুঁদো, এই হল মানিকের গোষ্ঠী, মানিকের দল ও সর্বক্ষণের সাথী। দাদার জন্য জান দিতে প্রস্তুত। এছাড়া দাদার কথায় পার্টির জন্য বুথ ক্যাপচার, ছাপ্পা ভোট এসব তো করেই। পার্টির জন্য এরাই এক একটা মানিক রত্ন।
মাধবী গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বললো, "আমার গলাটা একটু ব্যথা করছে। আমি একটু গার্গল করবো"
"আগে বলবেন তো, পচাদা ছোট এক পাত্রে জল চাপাও তো স্টোভে.. বৌদির ঈষৎ উষ্ণ জল লাগবে", অর্ডার দিল ঝন্টু।
পচা মুখ বেঁকিয়ে মনে মনে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, "যত্তসব আদিক্ষেতা! মেয়ে দেখলো কিনা হামলে পড়লো সব। বাবুরা সব ফুর্তি করার জন্য মেয়ে পটাবে, আর তার রসদ যোগান দেবে এই পচা। ওই নায়িকা মার্কা মেয়ে থুড়ি তোদের পাত্তা দেবে! পোঁদেও মুছবে না।"
"কিছু বললে পচা দা? অসুবিধা থাকলে বলো, আমরাই বৌদির জন্য জল গরম করে নিচ্ছি", পকাই ফোড়ন কাটলো।
"নাহঃ, থাক! ওই কাজটি করে আমাকে উদ্ধার করতে হবেনা! পচার হাত এখনো জগন্নাথ-কে দিয়ে আসিনি", ঝাঁঝিয়ে উঠলো পচা।
ঝন্টু কটমটিয়ে তাকাতেই সেই ঝাঁঝ আবার উবে গেল। পচা স্টোভে জল বসালো।
ওদিকে সান্যাল বাড়িতে সমরেশের যেন পাগল পাগল অবস্থা। কোথাও নেই তার মাধবী! ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি চষে ফেলেছে। ক্লান্ত মনে ছাদে উঠে দেখে সেখানে মাধবীর কাপড়চোপড় মেলা আছে। মাধবীই কেচে তা মেলে দিয়ে গ্যাছে। কিন্তু গ্যাছেটা কোথায়? সেইসময়ে করবী আবার ছাদে উঠেছিল। এবার সে একা। তাদের ছাদে মেলা কাপড় গুলো তুলতে। চোখাচোখি হল সমরেশের সাথে। তাকে দেখেই চওড়া হাসি খেলে উঠলো করবীর মুখে, "আরে সমরেশ দা, তুমি! কতদিন পর ছাদে এলে। তুমি তো ডুমুরের ফুল হয়েগেছো।"
সমরেশের তখন ইচ্ছা করছিলনা করবীর সাথে খোশগল্প জুড়তে। করবী মনে মনে সমরেশকে যতটা চায়, তার ছিটেফোঁটাও সমরেশের মনে অনুভূতি নেই করবীর প্রতি।
"হ্যাঁ, ওই আর কি। আসা হয়না", কোনোমতে দায়সারা উত্তর দিয়ে গা ছাড়লো।
"আচ্ছা, ওই মেয়েটা কে গো?"
"কোন মেয়েটা?", এবার সমরেশ মনোযোগ দিল করবীর কথায়।
"ওই যে, কালো শাড়ি পড়ে এসছে। বলছিল তোমার শালী হয়, কিন্তু বোন নয়, বন্ধু, কিসব যেন...."
"মাধবী...."
"কিই.. কি নাম বললে ওর?", করবী ঠিকমতো শুনতে পেলনা।
"আগে বলো, সে আর কি কি বলেছে তোমায়? কোথাও যাবে কিছু বলে গ্যাছে??", মাধবীর চিন্তায় সমরেশকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছিল।
"নাহঃ, মানে.. বললো সে মানিক মিত্তিরের লোক। বক্সার থেকে এসছে, মানিকের কাছে এসে উঠেছে। তোমার বাড়ির ব্যাপারে দালালি করতে।.."
-- বক্সার, দালাল, মানিক মিত্তির, সব কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছিল সমরেশের। নিজের পরিচয় গোপন রাখতে নাহয় ঠিকানাটা মিথ্যে বলেছে, কিন্তু মানিক আর বাড়ির ব্যাপারে কথা বললো কেন সে? বললো মানিকের কাছে উঠেছে, তার মানে কি সে মানিকের সাথে দেখা করতে গ্যাছে? বাড়ির ব্যাপার নিয়ে? কি একটা ডিল নিয়ে যেন কথা হয়েছিল! তাছাড়া সমরেশ মনে করে দেখলো বাড়ির দলিলটাও বসার ঘরে নেই। সেটা কি তবে মাধবী সাথে নিয়ে গেছে? কিন্তু কেন? মাধবী কি চায়? --
"সমরেশ.. দা.... সমুদা??"
"হহু?"
"কি ভাবছো?"
"না কিছুনা, আমি একটু আসছি হ্যা! পরে কথা হবে", বলেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে সিঁড়ি ঘর ধরলো। করবী চেয়ে রইলো তার স্বপ্নের মানুষটার দিকে। মানুষটা তাকে চায়না তো কি হয়েছে, সে তো মনে ধরে।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)