07-11-2025, 06:20 PM
(This post was last modified: 07-11-2025, 06:23 PM by ধূমকেতু. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
তখন রাত। ঠান্ডা পরিবেশ। বাইরের রাস্তায় লোকজন নেই। শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোর হলদে আলোয় ঝিকমিক করছে ফাঁকা ফুটপাথ। নিদ্রা দেবী ধীরে ধীরে ঘুম নামক মায়া বিস্তার করছিলো মানুষের উপর যেন কালো চাদরে আবৃত করছে শহরটাকে। আরেক ঘন্টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাবে পুরো লন্ডন।
রিতম নিজের ঘরে খাটের উপর বসে ব্যাগ প্যাক করছিলো। কেনাকাটা করে তিনটে লাগেজ ভড়িয়ে ফেলেছে। চকোলেট, পারফিউম, শাড়ি, জামাকাপড়, কসমেটিকস , জুয়েলারি এমনকি বাচ্চাদের জন্য খেলনা, সবকিছুতে লাগেজ গুলো ঠাসা হয়ে গেছে।পঞ্চাশ কেজির উপর ওজন হবে। কিন্তু টিকেটে দেখেছে পঁচিশ কেজি নিয়ে প্লেনে যেতে পারবে। অতিরিক্ত ওজনের জন্য এক্সট্রা চার্জ। সেটা ব্যয়বহুল। দেড়শো পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। যাক, তাতে রিতমের কোনো আফসোস নেই। বাড়ির সবার জন্য উপহার নিতে পারছে এতেই ওর খুশি লাগছে।
এমন সময় রিতমের রুমমেট, আদি ট্রে তে করে দুই মগ কফি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। জিজ্ঞেস করলো, তোর হলো?
আদি লম্বা চওড়া পুরুষ। ফর্সা গায়ের রঙ। চটপটে, সুপ্রতিভ যুবক। রিতমের সমবয়সী। তবে ওর পড়াশোনা শেষ। চাকড়ি করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। বেশ ভালো মাইনে পায়।
একটা লাগেজ একটু বেশিই ভরে গেছিলো, রিতম চেইন লাগাতে পারছিলো না। ও বললো, এইতো হয়ে গেছে।
আদি ট্রে টা টেবিলে রেখে বললো, একা পারবি না। আমাকে সাহায্য করতে দে। আদি এসে লাগেজে চাপ দিলো উপর থেকে। এবার রিতম অনায়াসে জিপার টেনে চেইন লাগিয়ে ফেললো।
আদি সোফায় এসে বসলো। একটা মগ হাতে নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, ব্যপারটা কি বলতো, এতো জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিস কেনো? এতো কিছু নিতে দেবে না, জানিস না?
দেবে। মৃদু হেসে বলল রিতম। লাগেজ গুলো এক সাইডে সরিয়ে রেখে সোফায় এসে বসলো। কফির মগ তুলে নিয়ে বললো, এক্সট্রা পে করতে হবে। এই যা।
ম্যাক্সিমাম লিমিট কত?
পঁচিশ কেজি।
তাহলে তো অনেক টাকা খরচা পরবে তোর।
হুম, তা একটু পরবে। রিতমের হাবভাব এমন যেন খরচাটা নিয়ে ভাবছে না ও।
একটু না, রুপির হিসেবে কমসে কম বিশ হাজার টাকার মতো পড়বে।
সমস্যা নেই। যখন আমি এগুলো মা-বাবা, বউয়ের হাতে তুলে দেবো তখন ওরা খুশি হবে। আমার কাছে সেই মুহূর্তটা দামি। ওদের মুখে খুশি দেখতে চাই। আর কত দিন ওদেরকে নিজের হাতে কিছু দেই না জানিস?
বলিস কি রে বেটা, তুইতো কয়েক মাস পরপরই কিছু না কিছু পাঠাতিস। জানা শোনা যে যায় তার সাথেই, এমনকি কুরিয়ার করেও কত কিছু পাঠিয়েছিস। সেই তুলনায় আমি তো কিছুই পাঠাই নি। তার উপর মাত্র বিশ কেজির লাগেজ নিয়ে গেলাম না লাস্ট উইন্টারে?
আদির কথায় রিতম শুধু মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দিলো, কিছুই বললো না।
একটু পর আদি ফিচেল হেঁসে বললো, চার মাসের ছুটি, হাহ? কি করবি এতো দিন? বৌদি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে শুনে? এতো দিন তো তোকে জালিয়ে মেরেছে, এখন খুশি হওয়ারই কথা।
এই যে, তোর বাজে চিন্তা থামা। একটু থেমে বললো, এখনো আমি কাউকে বলিনি যে আমি যাচ্ছি।
কাউকে বলিস নি! কেন?
সারপ্রাইজ দেবো ওদের। হঠাৎ আমাকে দেখে একেবারে চমকে উঠবে। আর তোর মতো বৌয়ের সাথে হানিমুন করতে যাচ্ছি না। এক মাসেই তো কাম শেরে এসেছিস। ব্যাচারি আমার বোনটা এখন প্রেগন্যান্ট।
হো হো করে হেঁসে উঠলো আদি। তুই তো চার মাস পাচ্ছিস, আমি এক মাস থেকে একটা বাচ্চার বাবা হচ্ছি। এটলিস্ট তিনটে ছানার থেকে বাবা ডাক শুনতে পাবি আই একসপেক্ট। চার মাসে চারটে বলতাম, যদিও সেটা রেয়ার। কিন্তু তুই এই সময়ে তিনটে পয়দা করতে পারবি।
চুপ যা সালা। আমি কলকাতায় যাচ্ছি তার প্রধান কারণ সামনে পুজো। পুজোর পর ভাইবার প্রস্তুতি নেবো, শুধু বেরানোটা ফ্রি।
রাতের বেলা যে বউয়ের সার্ভিস সেটা? সেটা গোনায় ধরছিস না, এমন ভাব ধরেছিস, বৌদিকে ছুঁয়েই দেখবি না।
ইডিয়েট। কফির মগে চুমুক দিয়ে রিতম হঠাৎ আনমনা হয়ে উঠলো। ভাবলো, এতো গুলো বছর পর বাড়ি যাচ্ছে, সব কিছু কি আগের মতো আছে? কোলকাতা নিশ্চয়ই পাল্টে গেছে। সেই কোলকাতা কি রিতমের ভালো লাগবে? মানুষগুলো পাল্টে যায় নি তো? ওরা কি রিতমকে আগের মতো ভালোবাসা দেবে?
আদি জিজ্ঞেস করলো, কিরে কি হলো?
আদির দিকে তাকিয়ে রিতম বললো, কোলকাতা আগের মতো আছে তো আদি?
আগের মতোই আছে। ক্রাউডেট, পলিউটেড আর ভেরি হট। তোর গিয়ে ভালো লাগবে নারে। আমারো ভালো লাগে নি। এক্সেপ্ট না নাইটস।
আমার কিন্তু এক্সাইটেড লাগছে।
অনেক দিন পর যাচ্ছিস তো তাই হয়তো তোর এক্সাইটেড লাগছে। আসলে ব্যাপারটা এমন, যখন কেউ অনেক দিন বাড়ির বাইরে থাকে তখন নিজের বাড়িকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। বাট লাইফ ইজ মাচ ডিফারেন্ট দেয়ার। এবার গেলে তোর মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। তারপর হেঁসে বলল, বাট আই বিলিভ বৌদি তোর সব সমস্যা মিটিয়ে দেবে।
রিতম আদির কথায় হাসলো। কিন্তু ওরা দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না, আদির শেষের এই কথাটা কতটা উল্টো হতে যাচ্ছে।
তবে যাই বলিস আদি, আমি ঐ ক্রাউড, ঐ নয়েজ, এন্ড দ্যা মোস্ট, কোলকাতার সেই পরিচিত গন্ধটা, সেটাকে খুব মিস করছিলাম। জানিস কোলকাতার নিজস্ব একটা গন্ধ আছে? তুই বুঝবি না, সম্পূর্ণ আলাদা একটা গন্ধ। এটা শুধু পুরোনো কোলকাতায়ই আছে, বিশ্বের আর কোনো শহরেই তা নেই। ফিরে গিয়ে আমি পুরো কোলকাতা চষে বেড়াবো ঠিক করেছি।
তুই কবি মানুষ তোর ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তারপর বললো, কাল কয়টায় ফ্লাইট যেন?
সন্ধ্যায়। ছটার পর। দিল্লিতে পৌঁছতে সকাল হয়ে যাবে। তারপর দিল্লি থেকে আবার কোলকাতায়। বাড়ি পৌঁছতে বিকেল।
তাইতো বলছি, ইয়ু নিড স্লিপ। ইট উইল বি এ লঙ জার্নি।
আরো খানিকটা কথা বলে শুতে গেছিলো ওরা। রিতমের থিসিস, ভাইবার প্রস্তুতি, পিএইচডির পর ক্যারিয়ার চিন্তা, আদির অফিস এই গুলো নিয়ে কথা হয়েছিলো।
রিতম আর আদি রুম শেয়ার করে এক সাথে থাকে। এমন করে খরচা কম পরে দুজনের। ইংল্যান্ডে রিতম আগে এসেছিলো, আদি ওর একবছর পর। রিতম তখন লন্ডনের প্রায় সব কিছু জেনে গেছে, প্রবাসী সার্কেলের অনেকের সাথেও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিলো। আদি এসে খুব স্ট্রাগল করছিলো প্রথমে। পার্ট টাইম জব খুঁজে পাচ্ছিলো না, থাকছিলো ব্যয়বহুল এক বাড়িতে। পরে একদিন রিতমের সাথে পরিচয় হয় আদির। রিতম ওর জানাশোনা লিঙ্ক থেকে আদিকে কেএফসি তে জব পাইয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে আদিকে নিজের ফ্লাটেও নিয়ে এসেছিলো। সেই থেকে ওদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক।
বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না। মধুমিতা হঠাৎ ওকে দেখে কি করবে, নিশ্চয়ই বাক রুদ্ধ হয়ে যাবে, নাকি আনন্দে ফেটে পরবে? এগুলো ভেবে খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিলো রিতমের মনে। চোখ বুজে শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করছিলো।
মধুমিতা কি অনুভব করতে পারে রিতম ওর কথা কত ভাবে? কতটা ব্যাকুল ও? রিতম যে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অপেক্ষা করছে মধুমিতাকে সামনের থেকে দেখতে মধুমিতা কি বুঝতে পারে এটা?
রিতমের বুক শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ওর মন ফিসফিস করে বলে ওঠে, মধুমিতা কিছুই বুঝতে পারে না।
রিতম একসময় বিছানার থেকে উঠে পড়লো। চলে এলো ব্যালকনিতে। এখন চারপাশ নিঃশব্দ। লন্ডন শহর জুড়ে গাঢ় নিশুতি। দূরে কোনো ডিস্কো ক্লাব থেকে মৃদু শব্দের দ্রিপ দ্রিপ গানের বিট ভেসে আসছিলো শুধু। আটতলার দক্ষিণমুখী এই বারান্দা থেকে বেশ ভালো দেখা যায় চারপাশ। রাস্তা গুলোতে লোক নেই। তাও লাইটের আলোয় ঝলমল করছিলো পুরো শহর। অন্য দিন হলে রিতম হয়তো একমনে শহরটাকেই দেখতো। কিন্তু আজ ওর মনে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চাপা উত্তেজনা। মধুমিতার কথাই মনে পরছিলো শুধু। সেই কবে রিতম ওকে শেষ বারের মতো সামনে থেকে দেখছে, হাতে হাত রেখেছে, ওর শরীরের চাঁপা ফুলের গন্ধ পেয়েছে। সে অনেক দিন আগে। যতোই ভিডিও কল করুক, সেগুলো কৃত্রিম, বিপরীত পাশে থাকা রিতমের হৃদয়ের তৃষ্ণা কখনো মেটে নি।
কলকাতায় এখন কটা বাজে? ভোর ঘনিয়ে আসছে হয়তো। মধুমিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রুপকথার গল্পের রাজকন্যার মতো সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে। কোনো রাক্ষস ওকে আটকে রাখে নি, রিতম নিজেই ওকে ফেলে রেখে এসেছে। কত কেঁদেছে প্রেয়সী বউ ওর। শত অনুরোধ করেছে ওকে একবারের জন্য যেতে। রিতম যায় নি। নানান ভাবে প্রবোধ দিয়েছে। কিন্তু তা করতে বুক ফেটে যেতো ওর, যখন রিতম আসতে পারবে না জেনে মধুমিতার কালো মুখটা দেখতে পেতো।
শেষ কয়েক দিন রিতমের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে, শপিং করা, প্লেনের টিকিট কাটা, ভাইবার প্রস্তুতির জন্য কি কি বই লাগবে তার চেক লিস্ট করা, অন্যান্য ডকুমেন্টস রেডি করা, এগুলো করতে করতে মধুমিতার সাথে খুব একটা কথা বলা হয়নি। রিতম খেয়াল করে নি কিন্তু মধুমিতাও খুব আগ্রহী ছিল না কথা বলতে। আজকে পাঁচবারের মতো ফোন দিয়েছিলো রিতম, মধুমিতা ফোন ধরে নি একবারও। ব্যাস্ত আছে ভেবে রিতমও বেশি মাথা ঘামায় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই অভিমান হয়েছে ওর। থাক আর একটা দিনই তো। একেবারে সরাসরি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। মধুমিতা নিশ্চয়ই তখন আর রাগ করে থাকবে না। দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে রিতমকে। এই আশাতেই ছটফট করতে থাকে ও। মধুমিতার কোমল স্পর্শ পাওয়ার জন্য বুক শুকিয়ে মরুভূমির মতো খাঁখাঁ করছে।
কিরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ঘুম আসছে না যে। হেসে বলল রিতম।
বৌদির কথা মনে পরছে?
রোজই পরে।
আদি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো রিতমের পাশে। বলল, কালকেই তো চলে যাচ্ছিস। তাহলে এখন আবার বউয়ের কথা ভেবে ছটফট করছিস কেন?
ঝটপট ছটফট নয় রে। রিতম হাসলো। এক্সাইটমেন্ট। সুইট একটা অনুভূতি। কতদিন পর বউকে দেখবো, জানিস? মনে মনে বললো, আজকেই যে কেন এমন এমন হচ্ছে, কেন ওর কথা মনে পড়ছে বার বার?
হাউ রোমান্টিক!
এখানে রোমান্টিকের কি দেখলি? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল রিতম।
রোমান্টিক নয়? ভেবে দেখ, এক বিরহী প্রেমিক গভীর রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওর প্রিয়তমার কথা ভাবছে। যার কথা ভাবছে সে হয়তো ঘুমিয়ে আছে, আর ভাবতেই পারছে না যে কেউ ওর কথা এত করে মনে করছে। একেবারে সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্য। হাহা.....।
রিতমও হাসলো বললো, তোর মত করে ভাবি নি। কিন্তু এখন ভেবে ভালই লাগছে।
এত ভাবিস না, চল ঘুমিয়ে পড়। আদি রিতমের কাধ টিপে বললো, কালকে সারাদিন সারারাত ট্রাভেল করবি শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
আরে শালা চল, কালকে বউকে তো দেখতেই পারবি। এখন ঘুম খুব জরুরী। কালকে রাতে জেগে থাকতে হবে। তাই আজকে আর কালকে জেগে থাকলে পরশু এনার্জি পাবি না, আর এনার্জি না থাকলে বেস্ট ফর্মেও থাকতে পারবি না। শেষে বৌদি বেচারী অসুখী হবে।
তোর যত বাজে কথা। আমি বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। দেখ বাইরেটা কি সুন্দর আর শান্ত। তাকিয়ে থাকলে মনও প্রশান্ত হয়ে যায়। তুই যা আমি আসছি পাঁচ মিনিট পর।
আদি হেঁসে ঘুমাতো চলে গেছিলো। যেতে যেতে বলেছিলো, আমরাও এই সময় পার করেছি বন্ধু। ধোঁকা দিতে পারবি না।
লন্ডন থেকে কলকাতার সরাসরি কোন ফ্লাইট নেই। সাধারণত দিল্লিতে ট্রানজিট থাকে। প্রথমে লন্ডন থেকে দিল্লি তারপর সেখানে প্লেন পরিবর্তন করে কলকাতায় আসতে হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে আসতে আসতে রিতমের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তার আগে, আগের দিন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে সন্ধ্যা আটটায় ওর ফ্লাইট দিল্লির উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করে। এটা ছিলো ব্রিটিশ এয়ারোয়েজের একটা বিমান। দশ ঘণ্টা একটানা উড়ে দিল্লি পৌঁছতে ভোর হয়ে গেছিলো।
তখন সূর্যদেবের আবির্ভাব হচ্ছিল সবে। পূর্ব আকাশে অরুণোদয়ের লাল আভা, যেন সিঁদুর লেপা দিগন্ত রেখায়। এইচ রোতে বসে জানালা দিয়ে সকাল হওয়া দেখছিল রিতম। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছিল চরাচরে। রাতের থেকে দিন হওয়ার দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত, মন্থর আর শব্দহীন। যেন নিজের আগমনের বার্তা কাউকে জানান দিতে চায় না। একেক সময় একেক রকম রঙের বাহার দেখা যায় এই সময়। রাতের শেষ মুহূর্তে আলো ফোটার ঠিক আগে আকাশটা নীল হয়ে যায়, তারপর বেগুনি থেকে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে বর্ণে ছেয়ে যায় পুরো আকাশ। আর তখনই পূর্ব আকাশে লালচে হতে শুরু করে। সেটাও হয় অনেক ধীরে ধীরে।
ব্রিটিশ এয়ারোয়েজের বিএ টুফাইভসেভেন বিমানটি তখন দিল্লির আকাশে দশ হাজার ফুটেরো নিচ দিয়ে উড়ছিল। উপর থেকে শহরটাকে বেশ গোছানো আর সুন্দর দেখায়। দিল্লি তখনও ঘুমন্ত, সড়ক বাতির আলোয় ঝকঝক করছিল পথঘাট। রিতমের মনে হচ্ছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতের রাজধানীও কম উন্নত, কম তিলোত্তমা নয়।
বিমানটি যখন ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে অবতরণ করল তখন সবে সূর্য উঠছে। সূর্যের নরম আলোয় আলোকময় সবকিছু। প্লেন থেকে নামতেই রিতমের খুব খিদে পেয়ে গেল। সেই রাতের বেলা ডিনার করেছিল প্লেনে থাকতে।
কলকাতার প্লেনে উঠতে আরো তিন ঘন্টার মতো অপেক্ষা করতে হবে। তাই এখন কিছু খেতেই হবে। এয়ারপোর্টের ভেতরে এখন তেমন লোকজন নেই। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ফ্লোর পরিষ্কার করছিলো। রেস্টুরেন্টগুলোতে অল্প কিছু বিদেশী লোক বশে আড্ডা দিচ্ছে।
রিতম কফি আর বার্গার নিয়ে ওয়েটিং জোনে এসে বসলো। ফোনে এয়ার পোর্টের ফ্রি ওয়াইফাই কানেক্ট করে আগেই যেটা করল তা হলো হোয়াটসঅ্যাপ চেক করা। কিন্তু মধুমিতা একটাও ফোন করেনি কাল রাতে। এই নিয়ে দুদিন হল মধুমিতা রিতমকে ফোন করছে না। কালকে প্লেনে ওঠার আগে রিতম ফোন করেছিল একবার, সেটাও ধরেনি। মধুমিতা হয়তো এবার প্রচন্ড অভিমান করেছে। এটা নিয়ে রিতমের কিন্তু তেমন কোনো চিন্তা হলো না। উল্টো পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো। এছাড়া আর তো কিছুই করার নেই। ফোন দেখে সময় কাটাতে লাগলো।
রিতমের দিল্লি থেকে কলকাতা যাওয়ার ফ্লাইট ছিল সকাল আটটায়। দুঘন্টা ধরে প্লেন উড়ে কলকাতায় নামল দুপুরের দিকে। রিতম এয়ার পোর্টে চেক আউট করে নিজের নির্দিষ্ট লাগেজ গুলো সংগ্রহ করে বাইরে এসে দাঁড়ালো। খটখটে রোদ, লোকজনের ভিড়, হলদে ট্যাক্সির আর গাড়ির দীর্ঘ লাইন– ভ্যাবশা গরমে মুহূর্তের মধ্যেই ঘেমে নেয়ে উঠলো ও। পরনে থাকা কালো কোর্ট খুলে হাতে নিলো। ইন করা সাদা শার্ট ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে।
রিতম এয়ারপোর্টের ভেতরে থাকতেই উবার বুক করে নিয়েছিল, সেটা আসতে আরেকটু সময় লাগবে।
এত গরমেও রিতমের কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছিল না। উল্টো কেমন যেন নিজেকে হালকা আর মুক্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল অনেকদিন পর নিজের পরিচিত কোথাও আসলো। বুক ভরে কয়েক বার শ্বাস নিল। বোধ হল এত সজীব বাতাস হয়তো লন্ডনেও নেই।
এইযে এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষারত স্বজনেরা–হলদে, শ্যামলা, মাঝারি সাইজের লোক গুলো, এদের দেখে চোখে আরাম অনুভব হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো ওরই আপনার মানুষ। রিতম অনেকদিন এই হইচই দেখেনি।
রিতমের খুব ভালো লাগছিলো। বাড়ি ফেরার আগেই খুশিতে ভরে উঠল ওর মন।
গাড়ি এলো পনেরো মিনিটের অপেক্ষার পর। তখন বারোটা বাজে সবে। গাড়িতে উঠে রিতম আরাম করে বসলো। সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল, ডেস্টিনেশন চেঞ্জ, পুরো কলকাতা ঘুরবো দাদা। বিকেলের দিকে আহিরীটোলা যাব। কোন সমস্যা হবে না তো?
এয়ারপোর্টের ভেতরে থাকতে রিতমের মা রিতম কে ফোন করেছিল। তখন জেনেছে মধুমিতা বাড়ি নেই। বান্ধবীর সাথে শপিংয়ে গেছে। দুপুরের পর ফিরবে। তাই রিতম ঠিক করেছে এখন বাড়ি যাবে না, বিকেলে ফিরবে। তার আগে বরং কলকাতা ঘুরে নিক কতক্ষণ।
কোনো সমস্যা নেই, স্যার। কস্ট বেশি পড়বে।
কস্ট নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আপনি স্লো ড্রাইভ করুন।
সিওর স্যার। বলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। ধীরে ধীরে ছুটে চলেছিল সাদা রঙের গাড়িটি। রিতম বাইরে তাকিয়ে পথ-ঘাট, বিল্ডিং, আর রাস্তার পথিকদের দেখছিল। এখানে আসার আগে মনে করেছিল সবকিছু হয়তো পাল্টে গেছে। কিন্তু কলকাতা যেন চির যৌবনা। সেই আগের মতই আছে সব কিছু। চার বছরে কিছুই পাল্টায়নি।
সারা দুপুর ঘুরিয়ে বেরিয়ে বিকেলের দিকে আহিরীটোলা স্ট্রিটের কাছে এসে থামলো রিতমের গাড়িটি। সূর্য তখন ঢলে গেছে গঙ্গার ওপারে। রোদের হলদে আলোয় নদীর জল চিকচিক করছিল। নদীবক্ষ থেকে ভেসে আসা হালকা ঠান্ডা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছিল রিতমকে।
গাড়ি থেকে নেমে রিতম আর দেরি করলো না। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে এলো নিজের বাড়িতে। লিফ্টে চড়ে বুক ধুকপুক করছিল। চারতলায় উঠে রিতম ধীরে ধীরে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। কলিং বিল বাজিয়ে দরজা খোলার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে লাগলো। প্রবল রোমাঞ্চ ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এখনই ও সেই কাঙ্খিত মুখটা দেখতে পাবে।
মধুমিতা তখন সবে স্নান করে বেরিয়েছে। বাড়িতে ফিরেছে একটু আগে। তার আগে দিহানের সাথে হোটেলে ঘন্টা দুয়েকের মত কাটিয়ে এসেছে। মেতে ছিলো রগরগে যৌনতায়। দুই দফা দীর্ঘ মৈথুনের পর ক্লান্ত হয়ে পরেছিলো। শাওয়ার নিয়ে এখন সতেজ লাগছে।
কলিংবেলের শব্দে মধুমিতা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শ্বশুর-শাশুড়ি হাটতে গেছেন। বাড়িতে কেউ নেই।
কে এলো আবার এই সময়? ভাবতে ভাবতে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক-বিহ্বল হয়ে পড়লো। ওর সামনে কালো সুট-বুট-কোট পরা রিতম দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি। পাশে বড় সাইজের তিনটি লাগেজ।
মধুমিতা প্রতিক্রিয়া করতে ভুলে গেছে, ও ভুল দেখছে না তো? বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে।
রিতম দেখলো ওকে দেখে মধুমিতা অবাক হয়ে গেছে। মুখে বিস্মিত ভাব। যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে রিতম ওর সামনে। মধুমিতা হয়তো এখন স্নান করে বেরিয়েছে। ছেড়ে রাখা চুলগুলো ভেজা। ফর্সা মুখ বৃষ্টি ভেজা জুঁই ফুলের মত সাদা দেখাচ্ছিলো। পাতলা ঠোট দুটি নিলচে।
রিতম অপেক্ষা করলো মধুমিতার জন্য, মধুমিতার কোমল স্পর্শের জন্য, মধুমিতার রিতমের বুকে আঁছড়ে পড়ার জন্য। কিন্তু মধুমিতা কিছুই করল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো। ব্যাপারটা খেয়াল করে রিতম নিজেই এক পা এগিয়ে এলো, দুহাত বাড়িয়ে মধুমিতার নরম হাত দুটো ধরলো। রিতমের ঠোঁটের মৃদু হাসি প্রশস্ত হলো আরেকটু। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রিতম বলল, কেমন আছো মিতা?
মধুমিতা উত্তর করতে পারলো না। শুধু কেঁপে উঠলো একটু।
কিছু বলবেনা? ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো রিতম।
এবার ধীরে ধীরে ভিজলো উঠলো মধুমিতার চোখ। দুটো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায় জল কণা। কাঁপা গলায় ও জিজ্ঞেস করলো, তুমি? এটা কি সত্যিই তুমি, রিতম?
রিতম মধুমিতার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নিজের দুহাত রাখল ওর কাঁধে। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, হ্যাঁ, মিতা। আমি।
মধুমিতা ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। রিতম ওকে বুঝতে পারলো না। একটু দূরে সরে এসে বললো, কেন এসেছ তুমি? না এলেই তো পারতে। ওর কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান।
তা হয়তো পারতাম। কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে মন চাইছিল না।
মিথ্যে, তুমি মিথ্যে বলছো। আবার কেঁদে ফেলল মধুমিতা।
আমি মিথ্যে বলছি না, মিতা। মধুমিতা ভেজা চোখে রিতমের দিকে তাকালো। রিতম কি কষ্ট পাচ্ছে ওর আচরণে? ওর হঠাৎ এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ওরতো খুশি হওয়ার কথা। মধুমিতা নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে রিতমের দিকে এগিয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল রিতমকে যতটা সম্ভব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তবে যদি বুকের জ্বালা মেটে।
এমন সময় শশুর শাশুড়ির আগমন ঘটলো নাট্যমঞ্চে। মধুমিতার আর এগোলো না, না রিতমকে জড়িয়ে ধরতে পারলো। এই মুহূর্তে রিতমকে জড়িয়ে ধরাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা
হয়তো মধুমিতা এখন ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু এই ঘটনার জন্য এমন এক বিষ বৃক্ষের বীর রিতমের হৃদয়ে রোপিত হয়ে গেল যে ভবিষ্যতে সেটা মধুমিতাকে নিদারুণ কাঁটা ফোটাবে।
রিতম নিজের ঘরে খাটের উপর বসে ব্যাগ প্যাক করছিলো। কেনাকাটা করে তিনটে লাগেজ ভড়িয়ে ফেলেছে। চকোলেট, পারফিউম, শাড়ি, জামাকাপড়, কসমেটিকস , জুয়েলারি এমনকি বাচ্চাদের জন্য খেলনা, সবকিছুতে লাগেজ গুলো ঠাসা হয়ে গেছে।পঞ্চাশ কেজির উপর ওজন হবে। কিন্তু টিকেটে দেখেছে পঁচিশ কেজি নিয়ে প্লেনে যেতে পারবে। অতিরিক্ত ওজনের জন্য এক্সট্রা চার্জ। সেটা ব্যয়বহুল। দেড়শো পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। যাক, তাতে রিতমের কোনো আফসোস নেই। বাড়ির সবার জন্য উপহার নিতে পারছে এতেই ওর খুশি লাগছে।
এমন সময় রিতমের রুমমেট, আদি ট্রে তে করে দুই মগ কফি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। জিজ্ঞেস করলো, তোর হলো?
আদি লম্বা চওড়া পুরুষ। ফর্সা গায়ের রঙ। চটপটে, সুপ্রতিভ যুবক। রিতমের সমবয়সী। তবে ওর পড়াশোনা শেষ। চাকড়ি করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। বেশ ভালো মাইনে পায়।
একটা লাগেজ একটু বেশিই ভরে গেছিলো, রিতম চেইন লাগাতে পারছিলো না। ও বললো, এইতো হয়ে গেছে।
আদি ট্রে টা টেবিলে রেখে বললো, একা পারবি না। আমাকে সাহায্য করতে দে। আদি এসে লাগেজে চাপ দিলো উপর থেকে। এবার রিতম অনায়াসে জিপার টেনে চেইন লাগিয়ে ফেললো।
আদি সোফায় এসে বসলো। একটা মগ হাতে নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, ব্যপারটা কি বলতো, এতো জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিস কেনো? এতো কিছু নিতে দেবে না, জানিস না?
দেবে। মৃদু হেসে বলল রিতম। লাগেজ গুলো এক সাইডে সরিয়ে রেখে সোফায় এসে বসলো। কফির মগ তুলে নিয়ে বললো, এক্সট্রা পে করতে হবে। এই যা।
ম্যাক্সিমাম লিমিট কত?
পঁচিশ কেজি।
তাহলে তো অনেক টাকা খরচা পরবে তোর।
হুম, তা একটু পরবে। রিতমের হাবভাব এমন যেন খরচাটা নিয়ে ভাবছে না ও।
একটু না, রুপির হিসেবে কমসে কম বিশ হাজার টাকার মতো পড়বে।
সমস্যা নেই। যখন আমি এগুলো মা-বাবা, বউয়ের হাতে তুলে দেবো তখন ওরা খুশি হবে। আমার কাছে সেই মুহূর্তটা দামি। ওদের মুখে খুশি দেখতে চাই। আর কত দিন ওদেরকে নিজের হাতে কিছু দেই না জানিস?
বলিস কি রে বেটা, তুইতো কয়েক মাস পরপরই কিছু না কিছু পাঠাতিস। জানা শোনা যে যায় তার সাথেই, এমনকি কুরিয়ার করেও কত কিছু পাঠিয়েছিস। সেই তুলনায় আমি তো কিছুই পাঠাই নি। তার উপর মাত্র বিশ কেজির লাগেজ নিয়ে গেলাম না লাস্ট উইন্টারে?
আদির কথায় রিতম শুধু মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দিলো, কিছুই বললো না।
একটু পর আদি ফিচেল হেঁসে বললো, চার মাসের ছুটি, হাহ? কি করবি এতো দিন? বৌদি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে শুনে? এতো দিন তো তোকে জালিয়ে মেরেছে, এখন খুশি হওয়ারই কথা।
এই যে, তোর বাজে চিন্তা থামা। একটু থেমে বললো, এখনো আমি কাউকে বলিনি যে আমি যাচ্ছি।
কাউকে বলিস নি! কেন?
সারপ্রাইজ দেবো ওদের। হঠাৎ আমাকে দেখে একেবারে চমকে উঠবে। আর তোর মতো বৌয়ের সাথে হানিমুন করতে যাচ্ছি না। এক মাসেই তো কাম শেরে এসেছিস। ব্যাচারি আমার বোনটা এখন প্রেগন্যান্ট।
হো হো করে হেঁসে উঠলো আদি। তুই তো চার মাস পাচ্ছিস, আমি এক মাস থেকে একটা বাচ্চার বাবা হচ্ছি। এটলিস্ট তিনটে ছানার থেকে বাবা ডাক শুনতে পাবি আই একসপেক্ট। চার মাসে চারটে বলতাম, যদিও সেটা রেয়ার। কিন্তু তুই এই সময়ে তিনটে পয়দা করতে পারবি।
চুপ যা সালা। আমি কলকাতায় যাচ্ছি তার প্রধান কারণ সামনে পুজো। পুজোর পর ভাইবার প্রস্তুতি নেবো, শুধু বেরানোটা ফ্রি।
রাতের বেলা যে বউয়ের সার্ভিস সেটা? সেটা গোনায় ধরছিস না, এমন ভাব ধরেছিস, বৌদিকে ছুঁয়েই দেখবি না।
ইডিয়েট। কফির মগে চুমুক দিয়ে রিতম হঠাৎ আনমনা হয়ে উঠলো। ভাবলো, এতো গুলো বছর পর বাড়ি যাচ্ছে, সব কিছু কি আগের মতো আছে? কোলকাতা নিশ্চয়ই পাল্টে গেছে। সেই কোলকাতা কি রিতমের ভালো লাগবে? মানুষগুলো পাল্টে যায় নি তো? ওরা কি রিতমকে আগের মতো ভালোবাসা দেবে?
আদি জিজ্ঞেস করলো, কিরে কি হলো?
আদির দিকে তাকিয়ে রিতম বললো, কোলকাতা আগের মতো আছে তো আদি?
আগের মতোই আছে। ক্রাউডেট, পলিউটেড আর ভেরি হট। তোর গিয়ে ভালো লাগবে নারে। আমারো ভালো লাগে নি। এক্সেপ্ট না নাইটস।
আমার কিন্তু এক্সাইটেড লাগছে।
অনেক দিন পর যাচ্ছিস তো তাই হয়তো তোর এক্সাইটেড লাগছে। আসলে ব্যাপারটা এমন, যখন কেউ অনেক দিন বাড়ির বাইরে থাকে তখন নিজের বাড়িকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। বাট লাইফ ইজ মাচ ডিফারেন্ট দেয়ার। এবার গেলে তোর মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। তারপর হেঁসে বলল, বাট আই বিলিভ বৌদি তোর সব সমস্যা মিটিয়ে দেবে।
রিতম আদির কথায় হাসলো। কিন্তু ওরা দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না, আদির শেষের এই কথাটা কতটা উল্টো হতে যাচ্ছে।
তবে যাই বলিস আদি, আমি ঐ ক্রাউড, ঐ নয়েজ, এন্ড দ্যা মোস্ট, কোলকাতার সেই পরিচিত গন্ধটা, সেটাকে খুব মিস করছিলাম। জানিস কোলকাতার নিজস্ব একটা গন্ধ আছে? তুই বুঝবি না, সম্পূর্ণ আলাদা একটা গন্ধ। এটা শুধু পুরোনো কোলকাতায়ই আছে, বিশ্বের আর কোনো শহরেই তা নেই। ফিরে গিয়ে আমি পুরো কোলকাতা চষে বেড়াবো ঠিক করেছি।
তুই কবি মানুষ তোর ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তারপর বললো, কাল কয়টায় ফ্লাইট যেন?
সন্ধ্যায়। ছটার পর। দিল্লিতে পৌঁছতে সকাল হয়ে যাবে। তারপর দিল্লি থেকে আবার কোলকাতায়। বাড়ি পৌঁছতে বিকেল।
তাইতো বলছি, ইয়ু নিড স্লিপ। ইট উইল বি এ লঙ জার্নি।
আরো খানিকটা কথা বলে শুতে গেছিলো ওরা। রিতমের থিসিস, ভাইবার প্রস্তুতি, পিএইচডির পর ক্যারিয়ার চিন্তা, আদির অফিস এই গুলো নিয়ে কথা হয়েছিলো।
রিতম আর আদি রুম শেয়ার করে এক সাথে থাকে। এমন করে খরচা কম পরে দুজনের। ইংল্যান্ডে রিতম আগে এসেছিলো, আদি ওর একবছর পর। রিতম তখন লন্ডনের প্রায় সব কিছু জেনে গেছে, প্রবাসী সার্কেলের অনেকের সাথেও ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিলো। আদি এসে খুব স্ট্রাগল করছিলো প্রথমে। পার্ট টাইম জব খুঁজে পাচ্ছিলো না, থাকছিলো ব্যয়বহুল এক বাড়িতে। পরে একদিন রিতমের সাথে পরিচয় হয় আদির। রিতম ওর জানাশোনা লিঙ্ক থেকে আদিকে কেএফসি তে জব পাইয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে আদিকে নিজের ফ্লাটেও নিয়ে এসেছিলো। সেই থেকে ওদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক।
বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না। মধুমিতা হঠাৎ ওকে দেখে কি করবে, নিশ্চয়ই বাক রুদ্ধ হয়ে যাবে, নাকি আনন্দে ফেটে পরবে? এগুলো ভেবে খুব রোমাঞ্চ হচ্ছিলো রিতমের মনে। চোখ বুজে শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করছিলো।
মধুমিতা কি অনুভব করতে পারে রিতম ওর কথা কত ভাবে? কতটা ব্যাকুল ও? রিতম যে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অপেক্ষা করছে মধুমিতাকে সামনের থেকে দেখতে মধুমিতা কি বুঝতে পারে এটা?
রিতমের বুক শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। ওর মন ফিসফিস করে বলে ওঠে, মধুমিতা কিছুই বুঝতে পারে না।
রিতম একসময় বিছানার থেকে উঠে পড়লো। চলে এলো ব্যালকনিতে। এখন চারপাশ নিঃশব্দ। লন্ডন শহর জুড়ে গাঢ় নিশুতি। দূরে কোনো ডিস্কো ক্লাব থেকে মৃদু শব্দের দ্রিপ দ্রিপ গানের বিট ভেসে আসছিলো শুধু। আটতলার দক্ষিণমুখী এই বারান্দা থেকে বেশ ভালো দেখা যায় চারপাশ। রাস্তা গুলোতে লোক নেই। তাও লাইটের আলোয় ঝলমল করছিলো পুরো শহর। অন্য দিন হলে রিতম হয়তো একমনে শহরটাকেই দেখতো। কিন্তু আজ ওর মনে বাড়ি ফিরে যাওয়ার চাপা উত্তেজনা। মধুমিতার কথাই মনে পরছিলো শুধু। সেই কবে রিতম ওকে শেষ বারের মতো সামনে থেকে দেখছে, হাতে হাত রেখেছে, ওর শরীরের চাঁপা ফুলের গন্ধ পেয়েছে। সে অনেক দিন আগে। যতোই ভিডিও কল করুক, সেগুলো কৃত্রিম, বিপরীত পাশে থাকা রিতমের হৃদয়ের তৃষ্ণা কখনো মেটে নি।
কলকাতায় এখন কটা বাজে? ভোর ঘনিয়ে আসছে হয়তো। মধুমিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রুপকথার গল্পের রাজকন্যার মতো সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে। কোনো রাক্ষস ওকে আটকে রাখে নি, রিতম নিজেই ওকে ফেলে রেখে এসেছে। কত কেঁদেছে প্রেয়সী বউ ওর। শত অনুরোধ করেছে ওকে একবারের জন্য যেতে। রিতম যায় নি। নানান ভাবে প্রবোধ দিয়েছে। কিন্তু তা করতে বুক ফেটে যেতো ওর, যখন রিতম আসতে পারবে না জেনে মধুমিতার কালো মুখটা দেখতে পেতো।
শেষ কয়েক দিন রিতমের ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে গেছে, শপিং করা, প্লেনের টিকিট কাটা, ভাইবার প্রস্তুতির জন্য কি কি বই লাগবে তার চেক লিস্ট করা, অন্যান্য ডকুমেন্টস রেডি করা, এগুলো করতে করতে মধুমিতার সাথে খুব একটা কথা বলা হয়নি। রিতম খেয়াল করে নি কিন্তু মধুমিতাও খুব আগ্রহী ছিল না কথা বলতে। আজকে পাঁচবারের মতো ফোন দিয়েছিলো রিতম, মধুমিতা ফোন ধরে নি একবারও। ব্যাস্ত আছে ভেবে রিতমও বেশি মাথা ঘামায় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই অভিমান হয়েছে ওর। থাক আর একটা দিনই তো। একেবারে সরাসরি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। মধুমিতা নিশ্চয়ই তখন আর রাগ করে থাকবে না। দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করবে রিতমকে। এই আশাতেই ছটফট করতে থাকে ও। মধুমিতার কোমল স্পর্শ পাওয়ার জন্য বুক শুকিয়ে মরুভূমির মতো খাঁখাঁ করছে।
কিরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ঘুম আসছে না যে। হেসে বলল রিতম।
বৌদির কথা মনে পরছে?
রোজই পরে।
আদি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো রিতমের পাশে। বলল, কালকেই তো চলে যাচ্ছিস। তাহলে এখন আবার বউয়ের কথা ভেবে ছটফট করছিস কেন?
ঝটপট ছটফট নয় রে। রিতম হাসলো। এক্সাইটমেন্ট। সুইট একটা অনুভূতি। কতদিন পর বউকে দেখবো, জানিস? মনে মনে বললো, আজকেই যে কেন এমন এমন হচ্ছে, কেন ওর কথা মনে পড়ছে বার বার?
হাউ রোমান্টিক!
এখানে রোমান্টিকের কি দেখলি? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল রিতম।
রোমান্টিক নয়? ভেবে দেখ, এক বিরহী প্রেমিক গভীর রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওর প্রিয়তমার কথা ভাবছে। যার কথা ভাবছে সে হয়তো ঘুমিয়ে আছে, আর ভাবতেই পারছে না যে কেউ ওর কথা এত করে মনে করছে। একেবারে সিনেমার রোমান্টিক দৃশ্য। হাহা.....।
রিতমও হাসলো বললো, তোর মত করে ভাবি নি। কিন্তু এখন ভেবে ভালই লাগছে।
এত ভাবিস না, চল ঘুমিয়ে পড়। আদি রিতমের কাধ টিপে বললো, কালকে সারাদিন সারারাত ট্রাভেল করবি শরীরের উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
আরে শালা চল, কালকে বউকে তো দেখতেই পারবি। এখন ঘুম খুব জরুরী। কালকে রাতে জেগে থাকতে হবে। তাই আজকে আর কালকে জেগে থাকলে পরশু এনার্জি পাবি না, আর এনার্জি না থাকলে বেস্ট ফর্মেও থাকতে পারবি না। শেষে বৌদি বেচারী অসুখী হবে।
তোর যত বাজে কথা। আমি বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। দেখ বাইরেটা কি সুন্দর আর শান্ত। তাকিয়ে থাকলে মনও প্রশান্ত হয়ে যায়। তুই যা আমি আসছি পাঁচ মিনিট পর।
আদি হেঁসে ঘুমাতো চলে গেছিলো। যেতে যেতে বলেছিলো, আমরাও এই সময় পার করেছি বন্ধু। ধোঁকা দিতে পারবি না।
লন্ডন থেকে কলকাতার সরাসরি কোন ফ্লাইট নেই। সাধারণত দিল্লিতে ট্রানজিট থাকে। প্রথমে লন্ডন থেকে দিল্লি তারপর সেখানে প্লেন পরিবর্তন করে কলকাতায় আসতে হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে আসতে আসতে রিতমের দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তার আগে, আগের দিন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে সন্ধ্যা আটটায় ওর ফ্লাইট দিল্লির উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করে। এটা ছিলো ব্রিটিশ এয়ারোয়েজের একটা বিমান। দশ ঘণ্টা একটানা উড়ে দিল্লি পৌঁছতে ভোর হয়ে গেছিলো।
তখন সূর্যদেবের আবির্ভাব হচ্ছিল সবে। পূর্ব আকাশে অরুণোদয়ের লাল আভা, যেন সিঁদুর লেপা দিগন্ত রেখায়। এইচ রোতে বসে জানালা দিয়ে সকাল হওয়া দেখছিল রিতম। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছিল চরাচরে। রাতের থেকে দিন হওয়ার দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত, মন্থর আর শব্দহীন। যেন নিজের আগমনের বার্তা কাউকে জানান দিতে চায় না। একেক সময় একেক রকম রঙের বাহার দেখা যায় এই সময়। রাতের শেষ মুহূর্তে আলো ফোটার ঠিক আগে আকাশটা নীল হয়ে যায়, তারপর বেগুনি থেকে ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে বর্ণে ছেয়ে যায় পুরো আকাশ। আর তখনই পূর্ব আকাশে লালচে হতে শুরু করে। সেটাও হয় অনেক ধীরে ধীরে।
ব্রিটিশ এয়ারোয়েজের বিএ টুফাইভসেভেন বিমানটি তখন দিল্লির আকাশে দশ হাজার ফুটেরো নিচ দিয়ে উড়ছিল। উপর থেকে শহরটাকে বেশ গোছানো আর সুন্দর দেখায়। দিল্লি তখনও ঘুমন্ত, সড়ক বাতির আলোয় ঝকঝক করছিল পথঘাট। রিতমের মনে হচ্ছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতের রাজধানীও কম উন্নত, কম তিলোত্তমা নয়।
বিমানটি যখন ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে অবতরণ করল তখন সবে সূর্য উঠছে। সূর্যের নরম আলোয় আলোকময় সবকিছু। প্লেন থেকে নামতেই রিতমের খুব খিদে পেয়ে গেল। সেই রাতের বেলা ডিনার করেছিল প্লেনে থাকতে।
কলকাতার প্লেনে উঠতে আরো তিন ঘন্টার মতো অপেক্ষা করতে হবে। তাই এখন কিছু খেতেই হবে। এয়ারপোর্টের ভেতরে এখন তেমন লোকজন নেই। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ফ্লোর পরিষ্কার করছিলো। রেস্টুরেন্টগুলোতে অল্প কিছু বিদেশী লোক বশে আড্ডা দিচ্ছে।
রিতম কফি আর বার্গার নিয়ে ওয়েটিং জোনে এসে বসলো। ফোনে এয়ার পোর্টের ফ্রি ওয়াইফাই কানেক্ট করে আগেই যেটা করল তা হলো হোয়াটসঅ্যাপ চেক করা। কিন্তু মধুমিতা একটাও ফোন করেনি কাল রাতে। এই নিয়ে দুদিন হল মধুমিতা রিতমকে ফোন করছে না। কালকে প্লেনে ওঠার আগে রিতম ফোন করেছিল একবার, সেটাও ধরেনি। মধুমিতা হয়তো এবার প্রচন্ড অভিমান করেছে। এটা নিয়ে রিতমের কিন্তু তেমন কোনো চিন্তা হলো না। উল্টো পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসলো। এছাড়া আর তো কিছুই করার নেই। ফোন দেখে সময় কাটাতে লাগলো।
রিতমের দিল্লি থেকে কলকাতা যাওয়ার ফ্লাইট ছিল সকাল আটটায়। দুঘন্টা ধরে প্লেন উড়ে কলকাতায় নামল দুপুরের দিকে। রিতম এয়ার পোর্টে চেক আউট করে নিজের নির্দিষ্ট লাগেজ গুলো সংগ্রহ করে বাইরে এসে দাঁড়ালো। খটখটে রোদ, লোকজনের ভিড়, হলদে ট্যাক্সির আর গাড়ির দীর্ঘ লাইন– ভ্যাবশা গরমে মুহূর্তের মধ্যেই ঘেমে নেয়ে উঠলো ও। পরনে থাকা কালো কোর্ট খুলে হাতে নিলো। ইন করা সাদা শার্ট ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে।
রিতম এয়ারপোর্টের ভেতরে থাকতেই উবার বুক করে নিয়েছিল, সেটা আসতে আরেকটু সময় লাগবে।
এত গরমেও রিতমের কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছিল না। উল্টো কেমন যেন নিজেকে হালকা আর মুক্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল অনেকদিন পর নিজের পরিচিত কোথাও আসলো। বুক ভরে কয়েক বার শ্বাস নিল। বোধ হল এত সজীব বাতাস হয়তো লন্ডনেও নেই।
এইযে এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষারত স্বজনেরা–হলদে, শ্যামলা, মাঝারি সাইজের লোক গুলো, এদের দেখে চোখে আরাম অনুভব হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো ওরই আপনার মানুষ। রিতম অনেকদিন এই হইচই দেখেনি।
রিতমের খুব ভালো লাগছিলো। বাড়ি ফেরার আগেই খুশিতে ভরে উঠল ওর মন।
গাড়ি এলো পনেরো মিনিটের অপেক্ষার পর। তখন বারোটা বাজে সবে। গাড়িতে উঠে রিতম আরাম করে বসলো। সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল, ডেস্টিনেশন চেঞ্জ, পুরো কলকাতা ঘুরবো দাদা। বিকেলের দিকে আহিরীটোলা যাব। কোন সমস্যা হবে না তো?
এয়ারপোর্টের ভেতরে থাকতে রিতমের মা রিতম কে ফোন করেছিল। তখন জেনেছে মধুমিতা বাড়ি নেই। বান্ধবীর সাথে শপিংয়ে গেছে। দুপুরের পর ফিরবে। তাই রিতম ঠিক করেছে এখন বাড়ি যাবে না, বিকেলে ফিরবে। তার আগে বরং কলকাতা ঘুরে নিক কতক্ষণ।
কোনো সমস্যা নেই, স্যার। কস্ট বেশি পড়বে।
কস্ট নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আপনি স্লো ড্রাইভ করুন।
সিওর স্যার। বলে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। ধীরে ধীরে ছুটে চলেছিল সাদা রঙের গাড়িটি। রিতম বাইরে তাকিয়ে পথ-ঘাট, বিল্ডিং, আর রাস্তার পথিকদের দেখছিল। এখানে আসার আগে মনে করেছিল সবকিছু হয়তো পাল্টে গেছে। কিন্তু কলকাতা যেন চির যৌবনা। সেই আগের মতই আছে সব কিছু। চার বছরে কিছুই পাল্টায়নি।
সারা দুপুর ঘুরিয়ে বেরিয়ে বিকেলের দিকে আহিরীটোলা স্ট্রিটের কাছে এসে থামলো রিতমের গাড়িটি। সূর্য তখন ঢলে গেছে গঙ্গার ওপারে। রোদের হলদে আলোয় নদীর জল চিকচিক করছিল। নদীবক্ষ থেকে ভেসে আসা হালকা ঠান্ডা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছিল রিতমকে।
গাড়ি থেকে নেমে রিতম আর দেরি করলো না। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে এলো নিজের বাড়িতে। লিফ্টে চড়ে বুক ধুকপুক করছিল। চারতলায় উঠে রিতম ধীরে ধীরে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। কলিং বিল বাজিয়ে দরজা খোলার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে লাগলো। প্রবল রোমাঞ্চ ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এখনই ও সেই কাঙ্খিত মুখটা দেখতে পাবে।
মধুমিতা তখন সবে স্নান করে বেরিয়েছে। বাড়িতে ফিরেছে একটু আগে। তার আগে দিহানের সাথে হোটেলে ঘন্টা দুয়েকের মত কাটিয়ে এসেছে। মেতে ছিলো রগরগে যৌনতায়। দুই দফা দীর্ঘ মৈথুনের পর ক্লান্ত হয়ে পরেছিলো। শাওয়ার নিয়ে এখন সতেজ লাগছে।
কলিংবেলের শব্দে মধুমিতা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শ্বশুর-শাশুড়ি হাটতে গেছেন। বাড়িতে কেউ নেই।
কে এলো আবার এই সময়? ভাবতে ভাবতে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক-বিহ্বল হয়ে পড়লো। ওর সামনে কালো সুট-বুট-কোট পরা রিতম দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি। পাশে বড় সাইজের তিনটি লাগেজ।
মধুমিতা প্রতিক্রিয়া করতে ভুলে গেছে, ও ভুল দেখছে না তো? বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছে।
রিতম দেখলো ওকে দেখে মধুমিতা অবাক হয়ে গেছে। মুখে বিস্মিত ভাব। যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে রিতম ওর সামনে। মধুমিতা হয়তো এখন স্নান করে বেরিয়েছে। ছেড়ে রাখা চুলগুলো ভেজা। ফর্সা মুখ বৃষ্টি ভেজা জুঁই ফুলের মত সাদা দেখাচ্ছিলো। পাতলা ঠোট দুটি নিলচে।
রিতম অপেক্ষা করলো মধুমিতার জন্য, মধুমিতার কোমল স্পর্শের জন্য, মধুমিতার রিতমের বুকে আঁছড়ে পড়ার জন্য। কিন্তু মধুমিতা কিছুই করল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো। ব্যাপারটা খেয়াল করে রিতম নিজেই এক পা এগিয়ে এলো, দুহাত বাড়িয়ে মধুমিতার নরম হাত দুটো ধরলো। রিতমের ঠোঁটের মৃদু হাসি প্রশস্ত হলো আরেকটু। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রিতম বলল, কেমন আছো মিতা?
মধুমিতা উত্তর করতে পারলো না। শুধু কেঁপে উঠলো একটু।
কিছু বলবেনা? ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো রিতম।
এবার ধীরে ধীরে ভিজলো উঠলো মধুমিতার চোখ। দুটো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায় জল কণা। কাঁপা গলায় ও জিজ্ঞেস করলো, তুমি? এটা কি সত্যিই তুমি, রিতম?
রিতম মধুমিতার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নিজের দুহাত রাখল ওর কাঁধে। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, হ্যাঁ, মিতা। আমি।
মধুমিতা ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। রিতম ওকে বুঝতে পারলো না। একটু দূরে সরে এসে বললো, কেন এসেছ তুমি? না এলেই তো পারতে। ওর কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান।
তা হয়তো পারতাম। কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে মন চাইছিল না।
মিথ্যে, তুমি মিথ্যে বলছো। আবার কেঁদে ফেলল মধুমিতা।
আমি মিথ্যে বলছি না, মিতা। মধুমিতা ভেজা চোখে রিতমের দিকে তাকালো। রিতম কি কষ্ট পাচ্ছে ওর আচরণে? ওর হঠাৎ এত কষ্ট হচ্ছে কেন? ওরতো খুশি হওয়ার কথা। মধুমিতা নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে রিতমের দিকে এগিয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল রিতমকে যতটা সম্ভব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তবে যদি বুকের জ্বালা মেটে।
এমন সময় শশুর শাশুড়ির আগমন ঘটলো নাট্যমঞ্চে। মধুমিতার আর এগোলো না, না রিতমকে জড়িয়ে ধরতে পারলো। এই মুহূর্তে রিতমকে জড়িয়ে ধরাটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা
হয়তো মধুমিতা এখন ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু এই ঘটনার জন্য এমন এক বিষ বৃক্ষের বীর রিতমের হৃদয়ে রোপিত হয়ে গেল যে ভবিষ্যতে সেটা মধুমিতাকে নিদারুণ কাঁটা ফোটাবে।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)