05-11-2025, 08:03 PM
কিছু সম্পর্কঃ ৯ (খ) এর বাকি অংশ.........
ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পথে জান্নাত নরম স্বরে বার বার রানীকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে , ওর Intuition ওকে বলছে , রানীকে এখন আশ্বস্ত করা খুব জরুরি , জয় না বুঝেই ওর সাথে হয়তো কঠোর হয়েছিলো , তাই রানী জয়ের সামনে ভীত হয়ে উঠছে । যদিও জান্নাত বুঝতে পারছে ওর আশ্বাস বানীতে রানী সম্পূর্ণ রুপে নির্ভার হচ্ছে না , এখনো ওর চোখে অনিশ্চয়তা , ভয় আর দ্বিধা , এমনকি জান্নাতের মনে হচ্ছে রানী ওকে সম্পূর্ণ ভাবে চিনতেও পারেনি । তবে জান্নাত অনুভব করছে রানীর হাতের কম্পন কিছুটা কমে এসেছে । মনে মনে জান্নাত সান্তনা খোঁজে , অন্তত একটা কিছু তো ঠিক হচ্ছে ।
“ এইতো আর অল্প একটু , তারপর আমরা ছোট আব্বুর কাছে চলে আসবো” লিফটের বদ্ধ পরিবেশে, লোকজনের মাঝে রানীকে আবারো কিছুটা অস্থির হয়ে উঠতে দেখে , জান্নাত আর একবার রানীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে । আলতো করে রানীর হাতটা ধরেই রেখছে জান্নাত । কিছুক্ষনের মাঝেই নির্দিষ্ট ফ্লোরে লিফট এর দরজা খুলে যায় । জান্নাত রানীর দিকে তাকিয়ে ম্রিধু স্বরে বলে , “ এই তো চলে এসেছি “ কথাটা বলার সময় জান্নাত ঠোঁটে মৃদু একটা উষ্ণ হাসি ধরে রাখে , রানীর বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য । আসলে ভেতরে ভেতরে ও বেশ চিন্তিত , লজ্জিতও । রানীর এই অবস্থার জন্য ওর ভুমিকাটা বেশ বড় ।
হসপিটালের লম্বা করিডোর ধরে হেটে আসছে জান্নাত আর রানী , জান্নাত আগে আগে , রানী ওর পেছন পেছন । রানী বার বার এদিন সেদিক তাকাচ্ছে ভীত দৃষ্টিতে , আর জান্নাত মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছে । এইতো কিছুক্ষন আগে , রাজীবের জন্য সহানুভুতি দেখাতে গিয়ে সবার উপর বিরক্ত হয়েছিলো । আর এখন সেই বিরক্তির ফসল নিজের হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে , রাজীবের ঘারে চাপিয়ে দেয়ার জন্য । রাজীবের জন্য ওর সেই অবুঝ মমতার কি লাভ হলো ? মনে মনে ভাবে জান্নাত । উল্টো ক্ষতিই হলো , এখন আরো একটা বাড়তি দায়িত্ব রাজীব কে পালন করতে হবে । আরো একটু বাড়তি চাপ ।
প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে জান্নাতের পা দুটো ভারি হয়ে আসছে । রাজীবের যতটা কাছাকাছি যাচ্ছে ততই অনুশোচনাটা ওর মনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে । কিছুদুর এগিয়ে যেতেই জান্নাত রাজীব কে দেখতে পায় । রাজীব জয়নালের সাথে কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে । শান্ত নির্লিপ্ত চেহারা , কিন্তু জান্নাত তো জানে ভেতরে কতটা ভেঙ্গে পরা , জানাত যদি পারতো তাহলে এখন রানীকে কোথাও লুকিয়ে রাখতো । কিন্তু সেটা সম্ভব নয় , জান্নাত নিজেও তাই জানে । তাইতো ধির লজ্জিত পদক্ষেপে রানীকে নিয়ে এগিয়ে যায় ।
রানীর দিকে তাকিয়ে বলে “ এইতো চলে এসেছি ঐ যে দেখ রাজীব দাড়িয়ে আছে” জান্নাত রাজীবের দিকে হাত তুলে দেখায় ।
রাজীবের নামটা শুনতেই রানীর মাঝে চাঞ্চল্য দেখা দেয় , দ্রুত পা চালায় রানী , তাল মেলানোর জন্য জান্নাত কেও দ্রুত পা ফেলতে হয় ।
রাজীব ঠিক তখন জয়নালের সঙ্গে এই কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারের বলা কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করছিল। ডাক্তার জানিয়েছে—আপাতত তেমন ভয় নেই, তবে আরও কিছু টেস্ট করা হবে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য। রহিমকে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণে। দু’দিন সেখানে থাকতে হবে।
এই সময় রাজীবের চোখ পড়ে জান্নাত আর রানীর দিকে। ওরা তখন মাত্র দশ ফুট দূরে। প্রথমে রাজীবের দৃষ্টি পড়ে জান্নাতের উপর—খেয়াল করে, জান্নাত খুব যত্ন করে রানীর হাত ধরে নিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখে রাজীবের মনের ভেতর হালকা একটা প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়। এই দুঃসময়েও মেয়েটা নিঃস্বার্থভাবে পাশে আছে—এই ভেবে ওর মনে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। রাজীব মৃদু হেসে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে নড করে , কিন্তু জান্নাতের ঠোঁটে হাসির বদলে , চেহারায় একটা দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পায় । আর তখনি রাজীব রানীর দিকে ভালো করে তাকায় ,
এক মুহূর্তেই রাজীবের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, “কিছু একটা ঠিক নেই”
রাজীব তাড়াতাড়ি লম্বা পা ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে আসে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, রানীর চোখে ভয়, যা এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভয়ের ভেতরেও একটা দিশেহারা ভাব, এমন এক শূন্য দৃষ্টি যা রাজীবকে অস্বস্তি দেয়। ভয় আর দিশেহারার বাইরেও কিছু আছে, যা রাজীব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না , একবার চকিতে জানাতের দিকে তাকায় রাজীব , চোখে জিজ্ঞাসা । কিন্তু জান্নাতের কাছ থেকেও কোন উত্তর আসে না ।
“ রানী , কি হয়েছে , ভয় পেয়েছিস? এই যে দ্যাখ, এইতো আমি , আমরা সবাই আছি” খুব শান্ত কণ্ঠে বলে রাজীব, ধীরে ধীরে দু’হাত রাখে রানীর কাঁধে, এমন সতর্কভাবে, যেন হঠাৎ নড়াচড়ায় রানী চমকে না ওঠে ।
যার উপর ছোটবেলা থেকে নির্ভর করে এসেছে, সেই নির্ভর যোগ্য বিশ্বস্ত মানুষটির স্নেহময় কণ্ঠস্বর, পরিচিত ছোঁয়া, আর উষ্ণ উপস্থিতি যেন জাদুর মতো কাজ করে। রানীর চোখের ভয় আস্তে আস্তে ম্লান হয়, শরীরের কম্পন কমে আসে। আশপাশের পরিবেশ ও নিজের অবস্থান সম্পর্কে সে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে ওঠে। রানীর চোখে সেই দিশেহারা ভয় , ধিরে ধিরে কমতে থাকে, সেই শূন্য স্থান দখল করে নেয় , নোনা পানি ।
প্রথমে রানীর ঠোঁট দুটো ফুলে ওঠে , তারপর চাপা স্বরে “ভাইয়া …… আব্বু……” বলে রাজীব কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে ।
রানীর এই অবস্থা দেখে , জয়নাল আর আয়শা এগিয়ে আসে , ওদের দুজনের চোখে মুখেই উৎকণ্ঠা , আর সহানুভুতি। আয়শা রানী কে ধরতে যায় , আর জয়নাল কিছু বলতে যায় । কিন্তু রাজীব ওদের ইশারা করে , দুজন কেই থেমে যেতে অনুরধ করে । জান্নাত , আয়শা আর জয়নাল তাকিয়ে থাকে । জান্নাত মনে মনে একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে , রানী কে কাঁদতে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় । জান্নাতের অসস্তির কারন ছিলো , গাড়ি থেকে এ পর্যন্ত আসার সময় রানী একটা কথাও বলেনি । জান্নাতের কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি । উল্টো রানী চিৎকার করে কাঁদলেই সেটা স্বাভাবিক বলে মনে হতো জান্নাতের কাছে।
রানীর কান্নার শব্দে করিডোরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, তবু সেই কান্নার মধ্যেই যেন রানী কে কল করার পর , এই প্রথমবার একটু শান্তির ছোঁয়া পায় জান্নাত। এতক্ষণ বেশ চাপের মাঝে ছিলো ।
“ শশশ…… কিচ্ছু হয় নি……… আব্বু একদম ঠিক আছে ……… কোন ভয় নেই……… এই তো আমরা সবাই আছি ……… কিচ্ছু হবে না ……সব ঠিক হয়ে যাবে …” রাজীব স্নেহভরে যত্নের সাথে রানীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রায় ফিসফিস করে কথা গুলো বার বার রানীর কানের কাছে বলতে থাকে ।
এরই মধ্যে দর্শকের সংখ্যা তিন থেকে চার হয়। জয় এসে দাঁড়িয়েছে সবার কাছ থেকে একটু দূরে। ভগ্ন হৃদয়ে তাকিয়ে আছে রানীর ক্রন্দনরত শরীরের দিকে। নীরব করিডোরে সেই কান্নার শব্দ বারবার ধাক্কা দিচ্ছে ওর বুকের ভেতরে। একবারের জন্য জয় ও জান্নাতের চোখাচোখি হয়। জান্নাত হাত তুলে ইশারায় জানায়, সব ঠিক আছে।জয় নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। সামান্য স্বস্তি আসে বটে, কিন্তু সেই স্বস্তির ভেতরও লেগে থাকে এক অদ্ভুত ভার।রানীর এই অবস্থায়, এতক্ষণ ধরে জয় নিজের ভেতরে অসংখ্য অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করেছে, ভয়, অপরাধবোধ, অস্থিরতা, আর একটুকরো অসহায় ভালোবাসা।
কিছুক্ষণ পর রাজীব খুব নরম হাতে রানীকে নিজের বুক থেকে আলাদা করে । “তুই একটু বস,” —রাজীবের কণ্ঠে অনুরোধের সুর। কিন্তু রানী মাথা নাড়ে, বসতে চাচ্ছে না জানিয়ে দেয়। আশেপাশের অপরিচিত চোখগুলো তাকে এখনো অস্বস্তিতে রেখেছে।
রাজীব ধৈর্য ধরে বলে, “অনেক দূর থেকে এসেছিস… একটু বিশ্রাম নে, তারপর তোকে আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো।” রানী এবার রাজীবের কথায় সাড়া দেয়। রাজীবের দেখানো চেয়ারে ধীরে ধীরে বসে পড়ে।
চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে চায়, কিন্তু রাজীব সেটা হতে দেয় না , সম্পূর্ণ মনোযোগ ওর নিজের দিকে আকর্ষণ করে । নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রানীর সামনে, নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে— “একটু পানি খাবি? গলাটা শুকিয়ে গেছে, তাই না?”
রানীর কান্না তখন অনেকটা কমে এসেছে, এখন সুধু কিছুক্ষন পর পর নাক টানছে। মাথা নেড়ে জানায়, ও পানি খাবে।
জয়নাল এগিয়ে দেয় বোতলটা, রাজীব সেটা নিয়ে রানীর হাতে তুলে দেয়। রানী কয়েক চুমুক খায়, তারপর রাজীব বোতলটা নিয়ে পাশে রাখে।
এরপর খুব আলতো করে রানীর দুই হাত নিজের হাতে নেয়। “আমার সাথে সাথে শ্বাস নে তো…” —কথাটা বলেই রাজীব গভীর শ্বাস নেয়। রানীও ওর মতো করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। প্রথমে তাল মেলাতে পারে না, তারপর ধীরে ধীরে দু’জনের শ্বাসপ্রশ্বাস এক হয়ে যায়। চোখে মুখে শান্তি নামে, শরীরের কম্পন মিলিয়ে যায়, রানী আস্তে আস্তে নিজের ভেতর ফিরে আসে।
জান্নাত, জয়, আয়শা আর জয়নাল , চারজনেই নীরবে দেখছে এই দৃশ্য।
কেউ কিছু বলে না, তবু তাদের মুখে ফুটে ওঠে ভেতরের কথাগুলো, বিস্ময়, মায়া, স্বস্তি, অপরাধবোধ।
বিশেষ করে জয় , ওর মুখে জমে থাকা অনুতাপ যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। ওর চোখের সামনের দৃশ্যটা এই মুহূর্তে যেন ওর অক্ষমতা ওর চোখের সামনে তুলে ধরেছে , নিষ্ঠুর এক আয়নার মতো। রানীর প্রতি নিজের ভালোবাসা থাকলেও, আজ সে কিছুই করতে পারেনি। বরং নিজের অজান্তেই পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। অথচ রাজীব কি সুন্দর আর যত্নের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ।
জীবনে এই প্রথমবার জয় নিজেকে এত হালকা মনে করে। যে ছেলেটা ভাবতো , মুখে যা বলে তা করে দেখানোর ক্ষমতা ওর আছে, আজ বুঝতে পারছে, কিছু জিনিস আছে যা ইচ্ছাশক্তিরও বাইরে।
রানীর অবস্থা একটু ভালো হতে দেখে ওর বুকটা হালকা লাগে, কিন্তু সেই হালকা হওয়ার ভেতরেই যেন সূক্ষ্ম একটা সূচ ফোঁটে একটা অদৃশ্য ঈর্ষা। মনে হয়, রাজীবের জায়গায় কেন ও নিজে নেই? কেন রানীর চোখের নিরাপত্তা অন্যের উপস্থিতিতে জেগে ওঠে, ওর নিজের উপস্থিতিতে নয়? যে রানীকে ও একান্ত নিজের করে পেতে চায় , যে রানীর হৃদয়ে সুধু ওর নিজের ছাপ ছাড়া আর কেউকে চায় না , কেন ও সেই রানীর দায়িত্ব সম্পূর্ণ রুপে নিতে ব্যারথ হচ্ছে ।
এসব অনুভুতির মাঝেও জয় রাজীবের প্রতি অল্প হলেও কৃতজ্ঞতা বোধ করে ।
জান্নাতের মনের অবস্থা জয়ের ঠিক উল্টো। রাজীবকে এতটা শান্ত ও দক্ষভাবে পরিস্থিতি সামলাতে দেখে তার মনে এক অদ্ভুত স্বস্তি নামে। সেই স্বস্তির ভেতর মিশে আছে একরাশ গর্বও। যেন নিজের মানুষকে নতুন করে চিনে ফেলেছে ও।
হঠাৎই জান্নাতের মনে উপলব্ধি জাগে, যদি সত্যিই রাজীবের সহমর্মী হতে চায়, তবে রাজীবের কাছের মানুষগুলোর প্রতিও ওকে সমান সহানুভূতিশীল হতে হবে। রাজীবের কাঁধে বোঝা বাড়ছে, তাই ওর প্রিয় মানুষদের প্রতি বিরক্তি দেখানো মানে, আসলে রাজীবকেই কষ্ট দেওয়া, এই সত্যটা যেন আজ প্রথমবার গভীরভাবে টের পায় জান্নাত।
রাজীব কাউকেই বোঝা ভাবে না, সেটা তো চোখের সামনেই প্রমাণ হয়ে আছে। রানীর অবস্থার উন্নতি দেখে রাজীবের মুখে যে স্বস্তি, যে নিঃশব্দ পরিতৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠেছে, সেটাই বলে দিচ্ছে, এই মানুষগুলোই রাজীবের পৃথিবী, রাজীবের প্রাণের মানুষ। জান্নাত ভাবে রাজিব কে আপন করে পেতে চাইলে এদের কেও আপন করে নিতে হবে , যেমন করে রাজীব নিয়েছে ।
সময়ের সাথে সাথে রানীর অবস্থার আরও উন্নতি হতে থাকে। রাজীব পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে, ওর হাত আলতো করে চেপে ধরে হাসিমুখে বলে, “ভয় পেয়েছিলি খুব?”
রানীর চোখে তখনো বিভ্রান্তি। যেন কয়েক মিনিট আগের কিছুই স্পষ্ট মনে নেই।
“ঠিক বুঝতে পারছি না… তবে মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়েছিলাম। একটা দরজা খুলছিল না, কেউ খুব রেগে গিয়েছিল… কী যেন…”
রাজীব রানীকে আর আগে বাড়তে দেয় না। মৃদু হাসে, বলে “হয়েছে, ওসব কিছু না। আর ভয় পেয়েছিলি কেন? আমি আছি না? আমি থাকতে তোর ভয় কিসের?” বলতে বলতেই রাজীবের গলা হালকা কেঁপে ওঠে, কিন্তু মুখে হাসিটা লেগেই থাকে।
রানীও হেসে ফেলে নির্ভার, শান্ত হাসি। “আমি জানি…” বলে থেমে যায়, তারপর হঠাৎই কিছু মনে পড়ে যায় ওর, চিন্তিত স্বরে বলে “ভাইয়া, আব্বু কেমন আছে?”
রাজীব সান্ত্বনার স্বরে বলে, “আব্বুর তেমন কিছু হয়নি। উনি এখন ডাক্তারদের কেয়ারে আছেন, অবজারভেশনে রেখেছে।”
“তুই মিথ্যা বলছিস না তো ভাইয়া?”
রাজীব হালকা মুচকি হাসে, “তুই কি বোকা মেয়ে, যে আমি তোকে মিথ্যে বলে ভুলিয়ে রাখবো? তুই আমার বুদ্ধিমতী বোন। আমি জানি তুই সব পরিস্থিতি সামাল দিতে জানিস। এখন চল এমারজেন্সিতে , তোকে একটু চেকআপ করিয়ে নিই।”
“আমাকে কেন? আমার কী হয়েছে? আমি তো…” রানী অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে ।
পেছন থেকে আয়েশা সাবধানে বলে ওঠে “যা না, একবার দেখিয়ে আয় না।” এখন কথা বলা ঠিক হবে কিনা আয়শা বুঝতে পারে না, তাই আয়েশার কণ্ঠে দ্বিধা মেশানো ভয়ও স্পষ্ট।
জয়নালও সায় দেয়, “হ, একটু দেখিয়ে আয় মা, সাবধানতার জন্য।”
এতক্ষনে রানী অন্যদের উপস্থিতি টের পায় , বুঝতে পারে না এতক্ষণ ওর সাথে কি হচ্ছিলো । ও বুঝতে পারে বেশ কিছুক্ষন আগেই ও এসেছে । তাহলে বড় আম্মু , বড় আব্বু , জান্নাত , জয় এদের এতক্ষণ খেয়াল করেনি কেনো ? রানী মাথায় একটা ভোঁতা ব্যাথা টের পায় ।
বেশ দুর্বল বোধ করছে রানী। বসা থেকে উঠতেই মাথাটা হালকা ঘোরে। রাজীবের হাত ধরেই জরুরি বিভাগের দিকে হাঁটে সে, পাশে জান্নাত।
জয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকায় রানী। জয়ের চোখে অনুতাপ, আর রানীর চোখে……আশ্চর্যভাব……আর কোনো ভয় নেই। উল্টো, তাতে আছে একটুখানি নির্ভরতার ছোঁয়া। যেন জয়ের উপস্থিতি ওকে এই দুঃসময়ে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
প্রথমে একটু অবাক হলেও জয় বুঝে ফেলে, রেস্তোরার ঘটনার কিছুই রানীর স্পষ্ট মনে নেই। শুধু ভাঙা ভাঙা কিছু টুকরো আছে । দরজা বন্ধ, ভয়, আর কারও রাগ। কিন্তু সেই ‘কেউ’ যে জয়, সেটা ওর মনে নেই।
আর তখনই জয়ের বুকের ভেতর আবার অপরাধবোধের ভার নেমে আসে, এক নিঃশব্দ অনুশোচনার মতো।
*****
ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পথে জান্নাত নরম স্বরে বার বার রানীকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে , ওর Intuition ওকে বলছে , রানীকে এখন আশ্বস্ত করা খুব জরুরি , জয় না বুঝেই ওর সাথে হয়তো কঠোর হয়েছিলো , তাই রানী জয়ের সামনে ভীত হয়ে উঠছে । যদিও জান্নাত বুঝতে পারছে ওর আশ্বাস বানীতে রানী সম্পূর্ণ রুপে নির্ভার হচ্ছে না , এখনো ওর চোখে অনিশ্চয়তা , ভয় আর দ্বিধা , এমনকি জান্নাতের মনে হচ্ছে রানী ওকে সম্পূর্ণ ভাবে চিনতেও পারেনি । তবে জান্নাত অনুভব করছে রানীর হাতের কম্পন কিছুটা কমে এসেছে । মনে মনে জান্নাত সান্তনা খোঁজে , অন্তত একটা কিছু তো ঠিক হচ্ছে ।
“ এইতো আর অল্প একটু , তারপর আমরা ছোট আব্বুর কাছে চলে আসবো” লিফটের বদ্ধ পরিবেশে, লোকজনের মাঝে রানীকে আবারো কিছুটা অস্থির হয়ে উঠতে দেখে , জান্নাত আর একবার রানীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে । আলতো করে রানীর হাতটা ধরেই রেখছে জান্নাত । কিছুক্ষনের মাঝেই নির্দিষ্ট ফ্লোরে লিফট এর দরজা খুলে যায় । জান্নাত রানীর দিকে তাকিয়ে ম্রিধু স্বরে বলে , “ এই তো চলে এসেছি “ কথাটা বলার সময় জান্নাত ঠোঁটে মৃদু একটা উষ্ণ হাসি ধরে রাখে , রানীর বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য । আসলে ভেতরে ভেতরে ও বেশ চিন্তিত , লজ্জিতও । রানীর এই অবস্থার জন্য ওর ভুমিকাটা বেশ বড় ।
হসপিটালের লম্বা করিডোর ধরে হেটে আসছে জান্নাত আর রানী , জান্নাত আগে আগে , রানী ওর পেছন পেছন । রানী বার বার এদিন সেদিক তাকাচ্ছে ভীত দৃষ্টিতে , আর জান্নাত মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছে । এইতো কিছুক্ষন আগে , রাজীবের জন্য সহানুভুতি দেখাতে গিয়ে সবার উপর বিরক্ত হয়েছিলো । আর এখন সেই বিরক্তির ফসল নিজের হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে , রাজীবের ঘারে চাপিয়ে দেয়ার জন্য । রাজীবের জন্য ওর সেই অবুঝ মমতার কি লাভ হলো ? মনে মনে ভাবে জান্নাত । উল্টো ক্ষতিই হলো , এখন আরো একটা বাড়তি দায়িত্ব রাজীব কে পালন করতে হবে । আরো একটু বাড়তি চাপ ।
প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে জান্নাতের পা দুটো ভারি হয়ে আসছে । রাজীবের যতটা কাছাকাছি যাচ্ছে ততই অনুশোচনাটা ওর মনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে । কিছুদুর এগিয়ে যেতেই জান্নাত রাজীব কে দেখতে পায় । রাজীব জয়নালের সাথে কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে । শান্ত নির্লিপ্ত চেহারা , কিন্তু জান্নাত তো জানে ভেতরে কতটা ভেঙ্গে পরা , জানাত যদি পারতো তাহলে এখন রানীকে কোথাও লুকিয়ে রাখতো । কিন্তু সেটা সম্ভব নয় , জান্নাত নিজেও তাই জানে । তাইতো ধির লজ্জিত পদক্ষেপে রানীকে নিয়ে এগিয়ে যায় ।
রানীর দিকে তাকিয়ে বলে “ এইতো চলে এসেছি ঐ যে দেখ রাজীব দাড়িয়ে আছে” জান্নাত রাজীবের দিকে হাত তুলে দেখায় ।
রাজীবের নামটা শুনতেই রানীর মাঝে চাঞ্চল্য দেখা দেয় , দ্রুত পা চালায় রানী , তাল মেলানোর জন্য জান্নাত কেও দ্রুত পা ফেলতে হয় ।
রাজীব ঠিক তখন জয়নালের সঙ্গে এই কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারের বলা কথাগুলো নিয়ে আলোচনা করছিল। ডাক্তার জানিয়েছে—আপাতত তেমন ভয় নেই, তবে আরও কিছু টেস্ট করা হবে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি বোঝার জন্য। রহিমকে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণে। দু’দিন সেখানে থাকতে হবে।
এই সময় রাজীবের চোখ পড়ে জান্নাত আর রানীর দিকে। ওরা তখন মাত্র দশ ফুট দূরে। প্রথমে রাজীবের দৃষ্টি পড়ে জান্নাতের উপর—খেয়াল করে, জান্নাত খুব যত্ন করে রানীর হাত ধরে নিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখে রাজীবের মনের ভেতর হালকা একটা প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়। এই দুঃসময়েও মেয়েটা নিঃস্বার্থভাবে পাশে আছে—এই ভেবে ওর মনে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। রাজীব মৃদু হেসে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে নড করে , কিন্তু জান্নাতের ঠোঁটে হাসির বদলে , চেহারায় একটা দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পায় । আর তখনি রাজীব রানীর দিকে ভালো করে তাকায় ,
এক মুহূর্তেই রাজীবের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, “কিছু একটা ঠিক নেই”
রাজীব তাড়াতাড়ি লম্বা পা ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে আসে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, রানীর চোখে ভয়, যা এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভয়ের ভেতরেও একটা দিশেহারা ভাব, এমন এক শূন্য দৃষ্টি যা রাজীবকে অস্বস্তি দেয়। ভয় আর দিশেহারার বাইরেও কিছু আছে, যা রাজীব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না , একবার চকিতে জানাতের দিকে তাকায় রাজীব , চোখে জিজ্ঞাসা । কিন্তু জান্নাতের কাছ থেকেও কোন উত্তর আসে না ।
“ রানী , কি হয়েছে , ভয় পেয়েছিস? এই যে দ্যাখ, এইতো আমি , আমরা সবাই আছি” খুব শান্ত কণ্ঠে বলে রাজীব, ধীরে ধীরে দু’হাত রাখে রানীর কাঁধে, এমন সতর্কভাবে, যেন হঠাৎ নড়াচড়ায় রানী চমকে না ওঠে ।
যার উপর ছোটবেলা থেকে নির্ভর করে এসেছে, সেই নির্ভর যোগ্য বিশ্বস্ত মানুষটির স্নেহময় কণ্ঠস্বর, পরিচিত ছোঁয়া, আর উষ্ণ উপস্থিতি যেন জাদুর মতো কাজ করে। রানীর চোখের ভয় আস্তে আস্তে ম্লান হয়, শরীরের কম্পন কমে আসে। আশপাশের পরিবেশ ও নিজের অবস্থান সম্পর্কে সে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে ওঠে। রানীর চোখে সেই দিশেহারা ভয় , ধিরে ধিরে কমতে থাকে, সেই শূন্য স্থান দখল করে নেয় , নোনা পানি ।
প্রথমে রানীর ঠোঁট দুটো ফুলে ওঠে , তারপর চাপা স্বরে “ভাইয়া …… আব্বু……” বলে রাজীব কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে ।
রানীর এই অবস্থা দেখে , জয়নাল আর আয়শা এগিয়ে আসে , ওদের দুজনের চোখে মুখেই উৎকণ্ঠা , আর সহানুভুতি। আয়শা রানী কে ধরতে যায় , আর জয়নাল কিছু বলতে যায় । কিন্তু রাজীব ওদের ইশারা করে , দুজন কেই থেমে যেতে অনুরধ করে । জান্নাত , আয়শা আর জয়নাল তাকিয়ে থাকে । জান্নাত মনে মনে একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে , রানী কে কাঁদতে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় । জান্নাতের অসস্তির কারন ছিলো , গাড়ি থেকে এ পর্যন্ত আসার সময় রানী একটা কথাও বলেনি । জান্নাতের কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি । উল্টো রানী চিৎকার করে কাঁদলেই সেটা স্বাভাবিক বলে মনে হতো জান্নাতের কাছে।
রানীর কান্নার শব্দে করিডোরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, তবু সেই কান্নার মধ্যেই যেন রানী কে কল করার পর , এই প্রথমবার একটু শান্তির ছোঁয়া পায় জান্নাত। এতক্ষণ বেশ চাপের মাঝে ছিলো ।
“ শশশ…… কিচ্ছু হয় নি……… আব্বু একদম ঠিক আছে ……… কোন ভয় নেই……… এই তো আমরা সবাই আছি ……… কিচ্ছু হবে না ……সব ঠিক হয়ে যাবে …” রাজীব স্নেহভরে যত্নের সাথে রানীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রায় ফিসফিস করে কথা গুলো বার বার রানীর কানের কাছে বলতে থাকে ।
এরই মধ্যে দর্শকের সংখ্যা তিন থেকে চার হয়। জয় এসে দাঁড়িয়েছে সবার কাছ থেকে একটু দূরে। ভগ্ন হৃদয়ে তাকিয়ে আছে রানীর ক্রন্দনরত শরীরের দিকে। নীরব করিডোরে সেই কান্নার শব্দ বারবার ধাক্কা দিচ্ছে ওর বুকের ভেতরে। একবারের জন্য জয় ও জান্নাতের চোখাচোখি হয়। জান্নাত হাত তুলে ইশারায় জানায়, সব ঠিক আছে।জয় নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। সামান্য স্বস্তি আসে বটে, কিন্তু সেই স্বস্তির ভেতরও লেগে থাকে এক অদ্ভুত ভার।রানীর এই অবস্থায়, এতক্ষণ ধরে জয় নিজের ভেতরে অসংখ্য অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করেছে, ভয়, অপরাধবোধ, অস্থিরতা, আর একটুকরো অসহায় ভালোবাসা।
কিছুক্ষণ পর রাজীব খুব নরম হাতে রানীকে নিজের বুক থেকে আলাদা করে । “তুই একটু বস,” —রাজীবের কণ্ঠে অনুরোধের সুর। কিন্তু রানী মাথা নাড়ে, বসতে চাচ্ছে না জানিয়ে দেয়। আশেপাশের অপরিচিত চোখগুলো তাকে এখনো অস্বস্তিতে রেখেছে।
রাজীব ধৈর্য ধরে বলে, “অনেক দূর থেকে এসেছিস… একটু বিশ্রাম নে, তারপর তোকে আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো।” রানী এবার রাজীবের কথায় সাড়া দেয়। রাজীবের দেখানো চেয়ারে ধীরে ধীরে বসে পড়ে।
চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে চায়, কিন্তু রাজীব সেটা হতে দেয় না , সম্পূর্ণ মনোযোগ ওর নিজের দিকে আকর্ষণ করে । নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রানীর সামনে, নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে— “একটু পানি খাবি? গলাটা শুকিয়ে গেছে, তাই না?”
রানীর কান্না তখন অনেকটা কমে এসেছে, এখন সুধু কিছুক্ষন পর পর নাক টানছে। মাথা নেড়ে জানায়, ও পানি খাবে।
জয়নাল এগিয়ে দেয় বোতলটা, রাজীব সেটা নিয়ে রানীর হাতে তুলে দেয়। রানী কয়েক চুমুক খায়, তারপর রাজীব বোতলটা নিয়ে পাশে রাখে।
এরপর খুব আলতো করে রানীর দুই হাত নিজের হাতে নেয়। “আমার সাথে সাথে শ্বাস নে তো…” —কথাটা বলেই রাজীব গভীর শ্বাস নেয়। রানীও ওর মতো করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। প্রথমে তাল মেলাতে পারে না, তারপর ধীরে ধীরে দু’জনের শ্বাসপ্রশ্বাস এক হয়ে যায়। চোখে মুখে শান্তি নামে, শরীরের কম্পন মিলিয়ে যায়, রানী আস্তে আস্তে নিজের ভেতর ফিরে আসে।
জান্নাত, জয়, আয়শা আর জয়নাল , চারজনেই নীরবে দেখছে এই দৃশ্য।
কেউ কিছু বলে না, তবু তাদের মুখে ফুটে ওঠে ভেতরের কথাগুলো, বিস্ময়, মায়া, স্বস্তি, অপরাধবোধ।
বিশেষ করে জয় , ওর মুখে জমে থাকা অনুতাপ যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। ওর চোখের সামনের দৃশ্যটা এই মুহূর্তে যেন ওর অক্ষমতা ওর চোখের সামনে তুলে ধরেছে , নিষ্ঠুর এক আয়নার মতো। রানীর প্রতি নিজের ভালোবাসা থাকলেও, আজ সে কিছুই করতে পারেনি। বরং নিজের অজান্তেই পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। অথচ রাজীব কি সুন্দর আর যত্নের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ।
জীবনে এই প্রথমবার জয় নিজেকে এত হালকা মনে করে। যে ছেলেটা ভাবতো , মুখে যা বলে তা করে দেখানোর ক্ষমতা ওর আছে, আজ বুঝতে পারছে, কিছু জিনিস আছে যা ইচ্ছাশক্তিরও বাইরে।
রানীর অবস্থা একটু ভালো হতে দেখে ওর বুকটা হালকা লাগে, কিন্তু সেই হালকা হওয়ার ভেতরেই যেন সূক্ষ্ম একটা সূচ ফোঁটে একটা অদৃশ্য ঈর্ষা। মনে হয়, রাজীবের জায়গায় কেন ও নিজে নেই? কেন রানীর চোখের নিরাপত্তা অন্যের উপস্থিতিতে জেগে ওঠে, ওর নিজের উপস্থিতিতে নয়? যে রানীকে ও একান্ত নিজের করে পেতে চায় , যে রানীর হৃদয়ে সুধু ওর নিজের ছাপ ছাড়া আর কেউকে চায় না , কেন ও সেই রানীর দায়িত্ব সম্পূর্ণ রুপে নিতে ব্যারথ হচ্ছে ।
এসব অনুভুতির মাঝেও জয় রাজীবের প্রতি অল্প হলেও কৃতজ্ঞতা বোধ করে ।
জান্নাতের মনের অবস্থা জয়ের ঠিক উল্টো। রাজীবকে এতটা শান্ত ও দক্ষভাবে পরিস্থিতি সামলাতে দেখে তার মনে এক অদ্ভুত স্বস্তি নামে। সেই স্বস্তির ভেতর মিশে আছে একরাশ গর্বও। যেন নিজের মানুষকে নতুন করে চিনে ফেলেছে ও।
হঠাৎই জান্নাতের মনে উপলব্ধি জাগে, যদি সত্যিই রাজীবের সহমর্মী হতে চায়, তবে রাজীবের কাছের মানুষগুলোর প্রতিও ওকে সমান সহানুভূতিশীল হতে হবে। রাজীবের কাঁধে বোঝা বাড়ছে, তাই ওর প্রিয় মানুষদের প্রতি বিরক্তি দেখানো মানে, আসলে রাজীবকেই কষ্ট দেওয়া, এই সত্যটা যেন আজ প্রথমবার গভীরভাবে টের পায় জান্নাত।
রাজীব কাউকেই বোঝা ভাবে না, সেটা তো চোখের সামনেই প্রমাণ হয়ে আছে। রানীর অবস্থার উন্নতি দেখে রাজীবের মুখে যে স্বস্তি, যে নিঃশব্দ পরিতৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠেছে, সেটাই বলে দিচ্ছে, এই মানুষগুলোই রাজীবের পৃথিবী, রাজীবের প্রাণের মানুষ। জান্নাত ভাবে রাজিব কে আপন করে পেতে চাইলে এদের কেও আপন করে নিতে হবে , যেমন করে রাজীব নিয়েছে ।
সময়ের সাথে সাথে রানীর অবস্থার আরও উন্নতি হতে থাকে। রাজীব পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলে, ওর হাত আলতো করে চেপে ধরে হাসিমুখে বলে, “ভয় পেয়েছিলি খুব?”
রানীর চোখে তখনো বিভ্রান্তি। যেন কয়েক মিনিট আগের কিছুই স্পষ্ট মনে নেই।
“ঠিক বুঝতে পারছি না… তবে মনে হচ্ছে খুব ভয় পেয়েছিলাম। একটা দরজা খুলছিল না, কেউ খুব রেগে গিয়েছিল… কী যেন…”
রাজীব রানীকে আর আগে বাড়তে দেয় না। মৃদু হাসে, বলে “হয়েছে, ওসব কিছু না। আর ভয় পেয়েছিলি কেন? আমি আছি না? আমি থাকতে তোর ভয় কিসের?” বলতে বলতেই রাজীবের গলা হালকা কেঁপে ওঠে, কিন্তু মুখে হাসিটা লেগেই থাকে।
রানীও হেসে ফেলে নির্ভার, শান্ত হাসি। “আমি জানি…” বলে থেমে যায়, তারপর হঠাৎই কিছু মনে পড়ে যায় ওর, চিন্তিত স্বরে বলে “ভাইয়া, আব্বু কেমন আছে?”
রাজীব সান্ত্বনার স্বরে বলে, “আব্বুর তেমন কিছু হয়নি। উনি এখন ডাক্তারদের কেয়ারে আছেন, অবজারভেশনে রেখেছে।”
“তুই মিথ্যা বলছিস না তো ভাইয়া?”
রাজীব হালকা মুচকি হাসে, “তুই কি বোকা মেয়ে, যে আমি তোকে মিথ্যে বলে ভুলিয়ে রাখবো? তুই আমার বুদ্ধিমতী বোন। আমি জানি তুই সব পরিস্থিতি সামাল দিতে জানিস। এখন চল এমারজেন্সিতে , তোকে একটু চেকআপ করিয়ে নিই।”
“আমাকে কেন? আমার কী হয়েছে? আমি তো…” রানী অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে ।
পেছন থেকে আয়েশা সাবধানে বলে ওঠে “যা না, একবার দেখিয়ে আয় না।” এখন কথা বলা ঠিক হবে কিনা আয়শা বুঝতে পারে না, তাই আয়েশার কণ্ঠে দ্বিধা মেশানো ভয়ও স্পষ্ট।
জয়নালও সায় দেয়, “হ, একটু দেখিয়ে আয় মা, সাবধানতার জন্য।”
এতক্ষনে রানী অন্যদের উপস্থিতি টের পায় , বুঝতে পারে না এতক্ষণ ওর সাথে কি হচ্ছিলো । ও বুঝতে পারে বেশ কিছুক্ষন আগেই ও এসেছে । তাহলে বড় আম্মু , বড় আব্বু , জান্নাত , জয় এদের এতক্ষণ খেয়াল করেনি কেনো ? রানী মাথায় একটা ভোঁতা ব্যাথা টের পায় ।
বেশ দুর্বল বোধ করছে রানী। বসা থেকে উঠতেই মাথাটা হালকা ঘোরে। রাজীবের হাত ধরেই জরুরি বিভাগের দিকে হাঁটে সে, পাশে জান্নাত।
জয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকায় রানী। জয়ের চোখে অনুতাপ, আর রানীর চোখে……আশ্চর্যভাব……আর কোনো ভয় নেই। উল্টো, তাতে আছে একটুখানি নির্ভরতার ছোঁয়া। যেন জয়ের উপস্থিতি ওকে এই দুঃসময়ে কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
প্রথমে একটু অবাক হলেও জয় বুঝে ফেলে, রেস্তোরার ঘটনার কিছুই রানীর স্পষ্ট মনে নেই। শুধু ভাঙা ভাঙা কিছু টুকরো আছে । দরজা বন্ধ, ভয়, আর কারও রাগ। কিন্তু সেই ‘কেউ’ যে জয়, সেটা ওর মনে নেই।
আর তখনই জয়ের বুকের ভেতর আবার অপরাধবোধের ভার নেমে আসে, এক নিঃশব্দ অনুশোচনার মতো।
*****
কিছু প্রশ্নের উত্তর নেই,
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)