05-11-2025, 08:00 PM
কিছু সম্পর্কঃ ৯ (খ)
জান্নাত অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক পায়চারি করছে।বারবার জয়ের নম্বরে ফোন দেয়, কিন্তু জয় ধরছেই না।প্রতিবার কল কেটে যাওয়ার সাথে সাথে জান্নাতের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।মনে মনে ভাবে, কেন যে রানীকে ওভাবে বলতে গেলাম! এখন যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়?যেভাবে সামান্য কারণেই রানী অজ্ঞান হয়ে যায়,এটা তো অনেক বড় ব্যাপার।জান্নাতের হাত-পা কাঁপছে হালকা, বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে অজানা ভয়।ফোনের স্ক্রিনে জয়ের নামটার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলে “ প্লিজ ধর , প্লিজ ফোনটা ধর ভাই”
“হ্যাঁ বল।” অবশেষে জয় কল রিসিভ করতেই জান্নাতের মনে একটুখানি স্বস্তি আসে।
কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ টেকে না।রানীর কথা জিজ্ঞাস করতেই জয় অভিযোগের স্বরে যা বলে তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের হাত পা হিম হয়ে যায় । জয়ের গলায় যে বিরক্তি আর ক্ষোভ, সেটা জান্নাত একদম স্পষ্ট বুঝতে পারে।ওর মনে হয়, জয় নিশ্চয়ই রানীর উপর রেগে গেছে, হয়তো বকাঝকা ও করেছে । আর এখন রানী জয়ের সাথে নেই ।এই ভাবনাটা জান্নাতকে আরও ভীত করে তোলে।
জান্নাত ভাবে এই অবস্থায় রানী একা একা কি করবে কে জানে ? প্রশ্নটা করেই জান্নাত উত্তর খুজতে যায় না । কারন উত্তর ওর পছন্দ হবে না । জান্নাত সময় নষ্ট করে না , সরাসরি নিউজ টা দেয় জয় কে আর বলে , জয় যেন দ্রুত রানী কে নিয়ে চলে আসে।
জয় যখন নিউজটা শুনেই কল কেটে দেয় , তখন জান্নাত আবারো পাইচারি করতে থাকে । আর বার বার প্রার্থনা করতে থাকে , জয় যেন রানীকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় চলে আসতে পারে । জান্নাত আর জয় কে কল করে না , কিন্তু অধির হয়ে জয়ের কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ।
মাঝের তিন চার মিনিট জান্নাতের কাছে তিন চার ঘণ্টা মনে হয় । কিন্তু জয় যখন আবার ফোন করে ঠিকানা চায় , তখন আবার শান্ত হয় জান্নাত । মনে মনে ভাবে যাক শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়েছে । জয় কে জিজ্ঞাস করতে যাবে রানীর কি অবস্থা তখন জয় আবার কল কেটে দেয় । জান্নাত পাশের চেয়ারে বসে , একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে । ডান হাতে কলাপ চেপে ধরে ভাবে , দিন দিন ওর কি হয়ে যাচ্ছে ? এমন ইরেস্পন্সিবল আচরণ ও কেন করছে বার বার ।
হ্যাঁ রাজীব কে এভাবে কাঁদতে দেখে , ওর নিজের মনের অবস্থা ভালো নেই । নিজে রাজীবের জন্য কিছু করতে না পাড়ায় নিজের উপর ও কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু এসব তো আর এমন নিরবুদ্ধিতার এস্কিউজ হতে পারে না । দিন দিন নিজের মাঝে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় জান্নাত কিছুটা ভীত হয় ।
আবার রাজীবের চিন্তা ওর মনে ফিরে আসে , ভাবে রাজীব কি করে পারে ? বা এতোদিন কিভাবে পেড়েছে ? আশ্চর্য হয় জান্নাত । সেই সাথে রাজীবের প্রতি স্রদ্ধাও বৃদ্ধি পায় । শত চাপেও কোনদিন রাজীব কে নিজের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হতে দেখেনি ও। জান্নাত আড় চোখে কিছুদুর দাঁড়ানো রাজীব কে দেখে । একেবারে শান্ত দেখাচ্ছে রাজীব কে , এখনো ওর বড় আব্বুর সাথে কথা বলছে । দেখে মনে হচ্ছে জয়নালের আব্বু অসুস্থ আর রাজীব জয়নাল কে সান্তনা দিচ্ছে ।
জান্নাত উঠে দাড়ায় , হেটে হেটে আবার সবাই যেখানে আছে , সেখানে চলে আসে । কিছুটা নির্ভার লাগছে এখন নিজেকে ।
“ জয় কে কল করেছি , ও রানী কে নিয়ে আসছে” কথাটা জান্নাত ওর বাবা মায়ের দিকেই তাকিয়ে বলে । কিছুক্ষন আগে নিজের আচরণের কারনে কিছুটা লজ্জিত লাগে ।
“ আসুক আজকে লাফাঙ্গাটা , ওর লাফাঙ্গা গিরি আমি ছুটিয়ে দেবো” জয়নাল চাপা গর্জন করে ,
“ আব্বু এখানে কি চেঁচামেচি করে কোন লাভ হবে ? আরো অসুবিধা হবে, প্লিজ এখানে কিছু বলো না” জান্নাত এবার খুব ধীরেসুস্থে জয়নাল কে বুঝিয়ে বলে। রেগে বা বিরক্তি নিয়ে নয় ।
জয়নাল ও জান্নাতের কথায় কিছুটা শান্ত হয় । মেয়ের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন দেখে হয়তো জয়নালের আচরনেও পরিবর্তন আসে । একটু নরম দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে ।
রাজীবের সাথে চোখাচোখি হয়ে জান্নাতের রাজীব হালকা ইশারায় যেন বলতে চায় , “হ্যাঁ এবার ঠিক আছে”
উত্তরে জান্নাতও শুষ্ক হাসি হাসে , মনে মনে প্রার্থনা করে , রানী যেন আসতে আসতে স্বাভাবিক হয়্যে যায় , নইলে এই ছেলেটার উপর আরেক বিপদ এসে পরবে । তখন রানীকে সামলাতে হবে । তবে জান্নাতের মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে । এতক্ষণ কি আর রানী এমন অবস্থায় থাকবে ?
“ তোমারা সবাই চা খাবে?” জান্নাত সবার উদ্দেশ্যে বলে , কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না । ঠিক আছে , আমি নিয়ে আসছি , এই বলে জান্নাত আবার চলে যায় চা আনতে । আসল উদ্দেশ্য জয় কে আর একবার কল করবে। রানীর কি অবস্থা সেটা জানার চেষ্টা করবে ।
****
জয় সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসেছে , আর রানী পেছনে , জয়ের সাথে বসতে চাচ্ছিলো না । জয় যখন নরম স্বরে বলল “ তোর আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো” তখন রাজি হয়েছে । জয় সামনে বসলেও তাকিয়ে আছে পেছনে , রানীর প্রতিটা মুভমেন্ট লক্ষ্য করছে। সময়ের সাথে সাথে জয়ের উদ্বেগ বেড়েই চলছে । কারন রানীর হাত কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে । চোখে ভয় , চোখের মনি স্থির নয় , এদিক সেদিক দেখছে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঠিক কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না ।
জয় দুই একবার কথা বলার চেষ্টা করেছে , কিন্তু এতে কাজ তো হয়ই নি উল্টো আরো ভয় পেয়ে গেছে । তাই সেই চেষ্টা বাদ দিয়েছে । ঠিক সেই মুহূর্তে জান্নাতের কল আসে , জয় রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে জান্নাত প্রশ্ন করে “ রানীর অবস্থা এখন কেমন ? তোদের আসতে আর কত সময় লাগবে?”
“ রাস্তা ফ্রি আছে , হয়তো আর পনেরো মিনিট, কিন্তু আমি রানীর অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছি না , মনে হচ্ছে আমাকে ভয় পাচ্ছে , আমি একটু রাগ হয়েছিলাম , কি করবো বল , একটা রেস্টুরেন্টে ছিলাম , ওয়াশ রুমে গেলো ভালো , ফিরে এসে যেন আমাকে চেনেই না , রাগ উঠে গিয়েছিলো” জয় কথা গুলো খুব নিচু স্বরে বলে ,
“ আমিও যে কোন আক্কেলে ওকে বলতে গেলাম…… উফ…”
“ আচ্ছা চিন্তা করিস না , হস্পিটালেই তো আসছি , যা হবে দেখা যাবে” জয় জান্নাত কে আশ্বস্ত করার জন্য বলে ।
“ ঠিক আছে আমি গেটে দাঁড়াচ্ছি” এই বলে জান্নাত কল কেটে দেয়
জয় আবার রানীর দিকে তাকায় , দেখে রানী আড় চোখে ওকে দেখছে , কিন্তু সরাসরি চাইছে না । জয় রানীর দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি হাসে , চেষ্টা করে রানীকে আশ্বস্ত করতে । কিন্তু কোন কাজ হয় বলে মনে হয় না । উল্টো রানী আরো কুঁচকে যায় , নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় জয়ের । নিজেকে বড্ড অপ্রয়োজনীয় মনে হয় । ওর সবচেয়ে পছন্দের মানুষটি এমন কষ্ট পাচ্ছে , ও কিছু তো করতেই পারেনি , উল্টো আরো সমস্যা তৈরি করেছে ।
রানীর এমন ভয়ার্ত অসহায় মুখের দিকে তাকাতে পারছে না , বুকের ভেতরটা বার বার মোচড় দিচ্ছে । নিজেকে এতো ছোট কোনদিন মনে হয়নি । জয় আর পেছনে তাকিয়ে থাকতে পারে না , সামনের দিকে তাকায় । রাস্তা ফাঁকা , দুপুরে লাঞ্চের সময় ঘণ্টা খানেকের জন্য রাস্তা ফাঁকা থাকে । আর সেই সময়টাই ওরা পেয়েছে । জয় ড্রাইভার কে ইংগিত করে একটু দ্রুত চালানোর জন্য
****
জান্নাত গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছিল জয়ের বাইক খুঁজে।তাই ওদের গাড়িটা যখন এসে সামনে থামল, প্রথমে বুঝতেই পারেনি।জয় যখন গেট খুলে নেমে জান্নাতের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল তখন জান্নাত ওদের দেখতে পেলো। বাইক না দেখে জান্নাতের মুখে হালকা বিস্ময় ফুটল, চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল “বাইক বাদ দিয়ে গাড়ি কেন?”
জয় কোনো কথা না বলে শুধু চোখের ইশারায় রানীর দিকে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের গম্ভীর ভাব, আর বাইকের বদলে গাড়ি, সব মিলিয়ে জান্নাতের বুঝতে বাকি রইল না, রানীর অবস্থা ও যা ভেবেছিল, তার চেয়েও খারাপ।হাত নাড়িয়ে জান্নাত রানীর কথা জানতে চাইল।জয় মৃদু স্বরে বলল, “গাড়ির ভেতর দেখ, বের করতে পারিস কিনা।”
জান্নাত দরজা খুলতে গেল, কিন্তু লক করা। ড্রাইভারকে বলতেই সে লক খুলে দিল। দরজা খুলে জান্নাত রানীর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। রানীর চোখের দৃষ্টি যেন অচেনা, অস্বাভাবিক, শূন্য। একটু ভয়ও পেল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিল।
হাসি মুখে নরম স্বরে বলল, “তুই এসেছিস, চল, তোকে ছোট আব্বুর কাছে নিয়ে যাই।”
জান্নাত নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়।দেখে, রানী কিছুটা ইতস্তত করছে।এমন সময় সামনে থেকে ড্রাইভার বলে ওঠে, “ম্যাডাম, উনার কি মাথায় সমস্যা?”
জান্নাত এক মুহূর্তে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ড্রাইভারের দিকে।ওর সেই দৃষ্টিতে ড্রাইভারের সব দাঁত যেন মুহূর্তেই আবার মুখের ভেতর ঢুকে যায়।তারপর জান্নাত আবার রানীর দিকে ঘুরে তাকায়, হাসি মুখে বলে,“ছোট আব্বু কতক্ষণ যাবত তোর জন্য অপেক্ষা করছে জানিস? আয়, আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।”
“আব্বু” শব্দটা শুনতেই রানীর ভেতর হালকা চাঞ্চল্য আসে।একবার ভালো করে জান্নাতের দিকে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে নিজের কম্পিত হাত বাড়িয়ে দেয়।জান্নাত খুব আলতো করে সেই হাত ধরে, যেন স্পর্শে নিশ্চয়তা দেয়ার চেষ্টা করছে , বলার চেষ্টা করছে, ভয় পাস না, আমি আছি।
রানী ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। নেমেই রানীর চোখে জয়ের দিকে যায় , জয় ও রানীর দিকে তাকায় । দুজনার চোখ এক হতেই রানী দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে রানী , যেন জয়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় ।
জয় আর জান্নাত দুজনেই বিষয়টা টের পায়। জান্নাত হাত তুলে ইশারা করে, “এখন আসিস না।” প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও জয় মেনে নেয়, শুধু রানীর জন্য। রানী আর জান্নাত ভেতরে চলে যায় ।
এই মুহূর্তে রানীর ওর প্রয়োজন নেই, এই ভাবনাটা জয়ের বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিঁধে যায়। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে জয় কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরায়, লম্বা একটা টনে ধোয়া গুলো সব বুকের ভেতর নিয়ে নেয়। আগুনে তামাক পোড়ার পট পট মৃদু শব্দ শুনতে পায় , সেই সাথে জয় টের পায়, ওর ভেতরেও কিছু একটা জ্বলছে।না আছে ধোঁয়া, না আছে শব্দ, তবু সেই আগুনের জ্বলন টের পায় জয় ।
****
জান্নাত অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক পায়চারি করছে।বারবার জয়ের নম্বরে ফোন দেয়, কিন্তু জয় ধরছেই না।প্রতিবার কল কেটে যাওয়ার সাথে সাথে জান্নাতের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়।মনে মনে ভাবে, কেন যে রানীকে ওভাবে বলতে গেলাম! এখন যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়?যেভাবে সামান্য কারণেই রানী অজ্ঞান হয়ে যায়,এটা তো অনেক বড় ব্যাপার।জান্নাতের হাত-পা কাঁপছে হালকা, বুকের ভেতর ভার হয়ে আছে অজানা ভয়।ফোনের স্ক্রিনে জয়ের নামটার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলে “ প্লিজ ধর , প্লিজ ফোনটা ধর ভাই”
“হ্যাঁ বল।” অবশেষে জয় কল রিসিভ করতেই জান্নাতের মনে একটুখানি স্বস্তি আসে।
কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ টেকে না।রানীর কথা জিজ্ঞাস করতেই জয় অভিযোগের স্বরে যা বলে তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের হাত পা হিম হয়ে যায় । জয়ের গলায় যে বিরক্তি আর ক্ষোভ, সেটা জান্নাত একদম স্পষ্ট বুঝতে পারে।ওর মনে হয়, জয় নিশ্চয়ই রানীর উপর রেগে গেছে, হয়তো বকাঝকা ও করেছে । আর এখন রানী জয়ের সাথে নেই ।এই ভাবনাটা জান্নাতকে আরও ভীত করে তোলে।
জান্নাত ভাবে এই অবস্থায় রানী একা একা কি করবে কে জানে ? প্রশ্নটা করেই জান্নাত উত্তর খুজতে যায় না । কারন উত্তর ওর পছন্দ হবে না । জান্নাত সময় নষ্ট করে না , সরাসরি নিউজ টা দেয় জয় কে আর বলে , জয় যেন দ্রুত রানী কে নিয়ে চলে আসে।
জয় যখন নিউজটা শুনেই কল কেটে দেয় , তখন জান্নাত আবারো পাইচারি করতে থাকে । আর বার বার প্রার্থনা করতে থাকে , জয় যেন রানীকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় চলে আসতে পারে । জান্নাত আর জয় কে কল করে না , কিন্তু অধির হয়ে জয়ের কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ।
মাঝের তিন চার মিনিট জান্নাতের কাছে তিন চার ঘণ্টা মনে হয় । কিন্তু জয় যখন আবার ফোন করে ঠিকানা চায় , তখন আবার শান্ত হয় জান্নাত । মনে মনে ভাবে যাক শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়েছে । জয় কে জিজ্ঞাস করতে যাবে রানীর কি অবস্থা তখন জয় আবার কল কেটে দেয় । জান্নাত পাশের চেয়ারে বসে , একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে । ডান হাতে কলাপ চেপে ধরে ভাবে , দিন দিন ওর কি হয়ে যাচ্ছে ? এমন ইরেস্পন্সিবল আচরণ ও কেন করছে বার বার ।
হ্যাঁ রাজীব কে এভাবে কাঁদতে দেখে , ওর নিজের মনের অবস্থা ভালো নেই । নিজে রাজীবের জন্য কিছু করতে না পাড়ায় নিজের উপর ও কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু এসব তো আর এমন নিরবুদ্ধিতার এস্কিউজ হতে পারে না । দিন দিন নিজের মাঝে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় জান্নাত কিছুটা ভীত হয় ।
আবার রাজীবের চিন্তা ওর মনে ফিরে আসে , ভাবে রাজীব কি করে পারে ? বা এতোদিন কিভাবে পেড়েছে ? আশ্চর্য হয় জান্নাত । সেই সাথে রাজীবের প্রতি স্রদ্ধাও বৃদ্ধি পায় । শত চাপেও কোনদিন রাজীব কে নিজের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হতে দেখেনি ও। জান্নাত আড় চোখে কিছুদুর দাঁড়ানো রাজীব কে দেখে । একেবারে শান্ত দেখাচ্ছে রাজীব কে , এখনো ওর বড় আব্বুর সাথে কথা বলছে । দেখে মনে হচ্ছে জয়নালের আব্বু অসুস্থ আর রাজীব জয়নাল কে সান্তনা দিচ্ছে ।
জান্নাত উঠে দাড়ায় , হেটে হেটে আবার সবাই যেখানে আছে , সেখানে চলে আসে । কিছুটা নির্ভার লাগছে এখন নিজেকে ।
“ জয় কে কল করেছি , ও রানী কে নিয়ে আসছে” কথাটা জান্নাত ওর বাবা মায়ের দিকেই তাকিয়ে বলে । কিছুক্ষন আগে নিজের আচরণের কারনে কিছুটা লজ্জিত লাগে ।
“ আসুক আজকে লাফাঙ্গাটা , ওর লাফাঙ্গা গিরি আমি ছুটিয়ে দেবো” জয়নাল চাপা গর্জন করে ,
“ আব্বু এখানে কি চেঁচামেচি করে কোন লাভ হবে ? আরো অসুবিধা হবে, প্লিজ এখানে কিছু বলো না” জান্নাত এবার খুব ধীরেসুস্থে জয়নাল কে বুঝিয়ে বলে। রেগে বা বিরক্তি নিয়ে নয় ।
জয়নাল ও জান্নাতের কথায় কিছুটা শান্ত হয় । মেয়ের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন দেখে হয়তো জয়নালের আচরনেও পরিবর্তন আসে । একটু নরম দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে ।
রাজীবের সাথে চোখাচোখি হয়ে জান্নাতের রাজীব হালকা ইশারায় যেন বলতে চায় , “হ্যাঁ এবার ঠিক আছে”
উত্তরে জান্নাতও শুষ্ক হাসি হাসে , মনে মনে প্রার্থনা করে , রানী যেন আসতে আসতে স্বাভাবিক হয়্যে যায় , নইলে এই ছেলেটার উপর আরেক বিপদ এসে পরবে । তখন রানীকে সামলাতে হবে । তবে জান্নাতের মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে । এতক্ষণ কি আর রানী এমন অবস্থায় থাকবে ?
“ তোমারা সবাই চা খাবে?” জান্নাত সবার উদ্দেশ্যে বলে , কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না । ঠিক আছে , আমি নিয়ে আসছি , এই বলে জান্নাত আবার চলে যায় চা আনতে । আসল উদ্দেশ্য জয় কে আর একবার কল করবে। রানীর কি অবস্থা সেটা জানার চেষ্টা করবে ।
****
জয় সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসেছে , আর রানী পেছনে , জয়ের সাথে বসতে চাচ্ছিলো না । জয় যখন নরম স্বরে বলল “ তোর আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো” তখন রাজি হয়েছে । জয় সামনে বসলেও তাকিয়ে আছে পেছনে , রানীর প্রতিটা মুভমেন্ট লক্ষ্য করছে। সময়ের সাথে সাথে জয়ের উদ্বেগ বেড়েই চলছে । কারন রানীর হাত কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে । চোখে ভয় , চোখের মনি স্থির নয় , এদিক সেদিক দেখছে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঠিক কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না ।
জয় দুই একবার কথা বলার চেষ্টা করেছে , কিন্তু এতে কাজ তো হয়ই নি উল্টো আরো ভয় পেয়ে গেছে । তাই সেই চেষ্টা বাদ দিয়েছে । ঠিক সেই মুহূর্তে জান্নাতের কল আসে , জয় রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে জান্নাত প্রশ্ন করে “ রানীর অবস্থা এখন কেমন ? তোদের আসতে আর কত সময় লাগবে?”
“ রাস্তা ফ্রি আছে , হয়তো আর পনেরো মিনিট, কিন্তু আমি রানীর অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছি না , মনে হচ্ছে আমাকে ভয় পাচ্ছে , আমি একটু রাগ হয়েছিলাম , কি করবো বল , একটা রেস্টুরেন্টে ছিলাম , ওয়াশ রুমে গেলো ভালো , ফিরে এসে যেন আমাকে চেনেই না , রাগ উঠে গিয়েছিলো” জয় কথা গুলো খুব নিচু স্বরে বলে ,
“ আমিও যে কোন আক্কেলে ওকে বলতে গেলাম…… উফ…”
“ আচ্ছা চিন্তা করিস না , হস্পিটালেই তো আসছি , যা হবে দেখা যাবে” জয় জান্নাত কে আশ্বস্ত করার জন্য বলে ।
“ ঠিক আছে আমি গেটে দাঁড়াচ্ছি” এই বলে জান্নাত কল কেটে দেয়
জয় আবার রানীর দিকে তাকায় , দেখে রানী আড় চোখে ওকে দেখছে , কিন্তু সরাসরি চাইছে না । জয় রানীর দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি হাসে , চেষ্টা করে রানীকে আশ্বস্ত করতে । কিন্তু কোন কাজ হয় বলে মনে হয় না । উল্টো রানী আরো কুঁচকে যায় , নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় জয়ের । নিজেকে বড্ড অপ্রয়োজনীয় মনে হয় । ওর সবচেয়ে পছন্দের মানুষটি এমন কষ্ট পাচ্ছে , ও কিছু তো করতেই পারেনি , উল্টো আরো সমস্যা তৈরি করেছে ।
রানীর এমন ভয়ার্ত অসহায় মুখের দিকে তাকাতে পারছে না , বুকের ভেতরটা বার বার মোচড় দিচ্ছে । নিজেকে এতো ছোট কোনদিন মনে হয়নি । জয় আর পেছনে তাকিয়ে থাকতে পারে না , সামনের দিকে তাকায় । রাস্তা ফাঁকা , দুপুরে লাঞ্চের সময় ঘণ্টা খানেকের জন্য রাস্তা ফাঁকা থাকে । আর সেই সময়টাই ওরা পেয়েছে । জয় ড্রাইভার কে ইংগিত করে একটু দ্রুত চালানোর জন্য
****
জান্নাত গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছিল জয়ের বাইক খুঁজে।তাই ওদের গাড়িটা যখন এসে সামনে থামল, প্রথমে বুঝতেই পারেনি।জয় যখন গেট খুলে নেমে জান্নাতের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল তখন জান্নাত ওদের দেখতে পেলো। বাইক না দেখে জান্নাতের মুখে হালকা বিস্ময় ফুটল, চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল “বাইক বাদ দিয়ে গাড়ি কেন?”
জয় কোনো কথা না বলে শুধু চোখের ইশারায় রানীর দিকে দেখিয়ে দিল। ওর মুখের গম্ভীর ভাব, আর বাইকের বদলে গাড়ি, সব মিলিয়ে জান্নাতের বুঝতে বাকি রইল না, রানীর অবস্থা ও যা ভেবেছিল, তার চেয়েও খারাপ।হাত নাড়িয়ে জান্নাত রানীর কথা জানতে চাইল।জয় মৃদু স্বরে বলল, “গাড়ির ভেতর দেখ, বের করতে পারিস কিনা।”
জান্নাত দরজা খুলতে গেল, কিন্তু লক করা। ড্রাইভারকে বলতেই সে লক খুলে দিল। দরজা খুলে জান্নাত রানীর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। রানীর চোখের দৃষ্টি যেন অচেনা, অস্বাভাবিক, শূন্য। একটু ভয়ও পেল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিল।
হাসি মুখে নরম স্বরে বলল, “তুই এসেছিস, চল, তোকে ছোট আব্বুর কাছে নিয়ে যাই।”
জান্নাত নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়।দেখে, রানী কিছুটা ইতস্তত করছে।এমন সময় সামনে থেকে ড্রাইভার বলে ওঠে, “ম্যাডাম, উনার কি মাথায় সমস্যা?”
জান্নাত এক মুহূর্তে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ড্রাইভারের দিকে।ওর সেই দৃষ্টিতে ড্রাইভারের সব দাঁত যেন মুহূর্তেই আবার মুখের ভেতর ঢুকে যায়।তারপর জান্নাত আবার রানীর দিকে ঘুরে তাকায়, হাসি মুখে বলে,“ছোট আব্বু কতক্ষণ যাবত তোর জন্য অপেক্ষা করছে জানিস? আয়, আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।”
“আব্বু” শব্দটা শুনতেই রানীর ভেতর হালকা চাঞ্চল্য আসে।একবার ভালো করে জান্নাতের দিকে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে নিজের কম্পিত হাত বাড়িয়ে দেয়।জান্নাত খুব আলতো করে সেই হাত ধরে, যেন স্পর্শে নিশ্চয়তা দেয়ার চেষ্টা করছে , বলার চেষ্টা করছে, ভয় পাস না, আমি আছি।
রানী ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে আসে। নেমেই রানীর চোখে জয়ের দিকে যায় , জয় ও রানীর দিকে তাকায় । দুজনার চোখ এক হতেই রানী দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে রানী , যেন জয়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় ।
জয় আর জান্নাত দুজনেই বিষয়টা টের পায়। জান্নাত হাত তুলে ইশারা করে, “এখন আসিস না।” প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও জয় মেনে নেয়, শুধু রানীর জন্য। রানী আর জান্নাত ভেতরে চলে যায় ।
এই মুহূর্তে রানীর ওর প্রয়োজন নেই, এই ভাবনাটা জয়ের বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিঁধে যায়। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে জয় কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরায়, লম্বা একটা টনে ধোয়া গুলো সব বুকের ভেতর নিয়ে নেয়। আগুনে তামাক পোড়ার পট পট মৃদু শব্দ শুনতে পায় , সেই সাথে জয় টের পায়, ওর ভেতরেও কিছু একটা জ্বলছে।না আছে ধোঁয়া, না আছে শব্দ, তবু সেই আগুনের জ্বলন টের পায় জয় ।
****
কিছু প্রশ্নের উত্তর নেই,
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)