02-11-2025, 11:41 AM
(This post was last modified: 02-11-2025, 01:54 PM by ধূমকেতু. Edited 7 times in total. Edited 7 times in total.)
ফোন শেষ করে, মধুমিতা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।হঠাৎ যেন একটা ঘন কালো মেঘ এসে ঢেকে ফেলল ওর মনের আকাশ। খারাপ লাগছিলো ওর।
দুপুরের খটখটে রোদ তখন পুরো উত্তর কোলকাতা জুড়ে। বাইরে এলাকার সরু গলি গুলো দিয়ে গরমের হল্কা দৌড়ে বেড়াচ্ছিলো। রাস্তার নেড়ি কুকুর গুলো গা ঢাকা দিয়েছে, একটা কাকও নেই কোথাও, গলি গুলো ফাকা, লোক চলাচল কম। কয়েকটা রিকশা চলছিলো মাঝে মাঝে। তবে স্বস্তির বিষয় মৃদু একটা বাতাস ভেসে আসছিলো গঙ্গার বুক থেকে। এটাই যেন এই দুঃসহ গরমে একটু প্রশান্তির ছোঁয়া।
একে বারে গঙ্গার ঘাট ঘেসে আহিরিটোলা স্ট্রিটের মুখে মধুমিতাদের এই বাড়িটা। পুরোনো কোলকাতার আর সমস্ত বাড়ির মতো শতাব্দী প্রাচীন নয়। বেশ আধুনিক ধাঁচের। চারতলা বাড়ির সবচেয়ে উপরতলায়, চার কামড়া ফ্লাটের পুড়োটা নিয়ে থাকে ওরা। বেশ বড় সাইজের ফ্লাট। তারসাথে একটা টানা বারান্দা আছে গঙ্গার দিকে মুখ করে। বিকেলের পর থেকে হুরহুর করে সতেজ হাওয়া আসে। তখন বাড়ান্দায় দাঁড়ালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
মধুমিতাকে বিয়ের পরপরই এই বাড়িতে উঠে আসে রিতম। তার আগে ওরা থাকতো বাগবাজারের কাছে বোসপাড়া লেনে— ছোট্ট, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভাড়ার ফ্ল্যাটে। নতুন বউ নিয়ে সেই বাড়িতে থাকা মুশকিল ছিলো। অফিস যাওয়া-আসাতেও রিতমের কষ্ট হতো। তাই এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিল ওরা।
মধুমিতার ঘর বারান্দার সাথে লাগোয়া, জানালা আর দরজা দুটোই খোলা, ফলে হাওয়া ঢুকছে সরাসরি, জানালার সাদা পর্দা গুলো উড়ছে মাঝে মাঝে। ওর বিছানা জানালা ঘেঁষে। মধুমিতা সেখানে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর মন ভালো নেই– ভীষণ ভারি আর অশান্ত। কেন ওর মন ভালো নেই? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে মধুমিতা। ও কি এটা জানে না রিতম কেমন? মধুমিতা জানলে কি হবে, ওর মনটা তো নাদান, বেহায়া।
রিতম যে এবারো পুজোয় আসবে না, এটা তো মধুমিতা বহুত আগেই অনুমান করতে পেরেছিল । কয়েক দিন পর ওর গবেষণা পত্র জমা দেয়ার ডেট। তার কয়েক মাস পরে ভাইবা। অনেক পড়াশোনা করতে হয় এই সময়। এগুলো রিতমই ওকে বলেছে। এই সময়ে কি কেউ কোথাও বেড়াতে যায়? বোঝা উচিত ছিলো। তারপরও মধুমিতার মনে টিমটিমে প্রদীপের আলোর মতো ক্ষীণ একটা আশা ছিলো, যে এতো গুলো বছর আসে নি, এবার হয়তো আসবে।
মধুমিতার এখন মনেহয় রিতমের কাছে ওর কিছু প্রত্যাশা করাই উচিত নয়। রিতম ওর কোনো ইচ্ছাই পুরণ করে না। কয়েক মাস আগে তো খুব কথা দিয়েছিলো যে এবার পুজোয় আসবেই, এখন কি হলো সে কথার? বোকা মেয়ে মধুমিতা। রিতম প্রতিবারই এমন কথা দেয় যে আসবে, শেষে আসে না। ওর ভুল ছিল এতোটা আশা করা।
খারাপ লাগছে রিতমের আচরণে, কথা দিয়ে কথা রাখে না ও। মধুমিতা ওকে অনেক বার বলেছে, এমনটা না করতে, যা পারবে না সে বিষয়ে যেন কথা না দেয়। তারপরও রিতম বার বার ওকে ভুলিয়ে রেখেছিলো। বলেছিলো আসবে। আর মধুমিতা আশায় বুক বেঁধেছিলো।
এর মধ্যে ভাদ্র মাস এসে পড়লো। আর এক মাস পড়েই পুজো। কষ্টে অভিযানে মধুমিতা প্রতিজ্ঞা করলো এবার পুজোয় ঘর থেকেই বের হবে না ও। শপিংও করবে না। রিতম যা পাঠাবে বাইরে ফেলে দেবে সেগুলো। রিতমের দেওয়া কিছু চাই না ওর।
সেই চার বছর আগে গেছে নতুন বিয়ে করা বউকে ফেলে এরপর একটা মানুষ অন্তত একবার তো আসে। ওর বন্ধু আশিষতো প্রতি বছর পুজোয় আসে। থাকে মাস খানেক। তাহলে রিতম আসে না কেন? বউয়ের প্রতি এমন অনাগ্রহ, এমন উদাসীনতা!
মধুমিতা ভাবে "ওর কোনো অনুভূতি নেই নাকি? ওর মনে একটুও টান জাগে না আমার জন্য? ওর কষ্ট হয় না? আমার তো খুব কষ্ট হচ্ছে?”
আসলে দিহান ঠিকই বলে, রিতম স্বার্থপর। মধুমিতার জন্য ও ইংল্যান্ডে যায় নি, গিয়েছে নিজের জন্য। মধুমিতাকে ভোলানোর জন্য বলেছে ওকে সুখী রাখতে চায় তাই যাচ্ছে। এগুলো আসলে মিথ্যে। আশিষওতো পড়তে গেছে, কিন্তু ওতো পিএইচডি করে নি। মাস্টার্স করেই ওখানে চাকরি করছে। রিতম এমন টা করতে পারলো না? পিএইডি করার কি দরকার ছিলো? মধুমিতা তো অল্পতেই সুখী হতো। না ও পিএইচডি করবেই। মধুমিতা কষ্ট পাক, পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাক তাতে ওর কি?
পাঠকরা মধুমিতাকে অকৃতজ্ঞ-বেইমান ভেবে বসবেন না আবার, শুরু থেকেই মধুমিতা স্বামীকে অনেক অনুরোধ করেছে যেন বিদেশ না যায়, ওর কাছেই যেন থাকে। রিতম শোনে নি। প্রবাসে কয়েক বছর কাটানোর পর মধুমিতা হাজার প্রার্থনা করেছে বেড়িয়ে যেতে। রিতম আসে নি। আর বছর পুজোয় তো বেচারি রীতিমতো কেঁদে কেঁদে অনুনয় করেছিলো আসতে, পাষাণ রিতম একটা আর্জিও গ্রহণ করে নি।
তাই এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় রিতম বুঝি ওকে অবহেলাই করে। এই অবহেলা সয়ে সয়ে মধুমিতা হাঁফিয়ে উঠেছে, আর ভালো লাগে না। আর পারে না। মধুমিতা এখন আর কাঁদে না। কাঁদারো একটা শেষ আছে।
কখনো আবার মনে হয় রিতম ইংল্যান্ডেই কাউকে ভালোবেসে ফেলেনি তো? এরপরই মধুমিতা শাসন করে নিজের মনকে। রিতম এমন ছেলেই নয়। রিতমকে ও চেনে।
দুরুত্ব আর নিষঙ্গতা এমনই এক জিনিস যা বেশি দিন স্থায়ী হলে ধন্দে ফেলে ব্যাক্তিকে। মানুষ তার প্রিয়তমকেও অবিশ্বাস করে ফেলে।
মধুমিতা ভেবেছিলো রিতমের সাথে কথা বলে একটু ঘুরিয়ে নেবে, কিন্তু এখন আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না। বুকে কষ্ট চেপে কে ঘুমাতে পারে? পাশেই দত্তা উপন্যাসের বইটি উল্টিয়ে রাখা। পড়তেও মন চাইছে না। বুকের ভেতর পাহাড় সমান ভার অনুভব হচ্ছিলো।
এমন সময় মধুমিতা কিছু শব্দ শুনতে পেলো, ওর মনের ভেতরে এক গোপন কুঠুরিতে থাকা ওরই একটা স্বত্ত্বা। অনেক দিন পর এ আওয়াজটা কথা বললো। মধুমিতা আগে যখন বন্দিশালার মতো বাপের বাড়ি থাকতো, যখন বৌদি ওকে কথা শোনাতো, মন খারাপ থাকতো বা খুব একা লাগতো তখন ওর মনের এই অংশটা ওকে সাহস যোগাতো, মন ভালো করতো। পাশে থাকতো সবসময়।
কি রে সখি? আবার মন খারাপ?
পাঠকরা মনে রাখবেন এটা ঐ দুর্মতি স্বত্ত্বাটি না যে মধুমিতাকে বিপথে ঠেলে দিয়ে ব্রেইন ওয়াশ করতো। সেটা আরেকটু পড়ে দৃশ্যটে পদার্পণ করবে। মধুমিতার এই অংশটা খুবই আলাদা। ধীর, স্থির আর পবিত্র। ও যখন কথা বলে মধুমিতার তখন খুব শান্তি লাগে, অন্য কোনো দুশ্চিন্তা আর থাকে না।
মধুমিতা উত্তর করলো, হ্যাঁ।
সে কি! কি হয়েছে রে?
দেখ না। রিতম কি স্বার্থপর। কতো গুলো দিন হলো আসে না। এবারো মনে হয় আসবে না। বলেই বাষ্পাদ্র হলো ওর চোখ পল্লব।
রিতম স্বার্থপর তোকে কে বললো?
আমি জানি।
তুই কিছুই জানিস না, বোকা মেয়ে।
তাহলে?
রিতম খুব ভালো রে। ওর মতো ছেলে আর কেউ নেই। তুই ভাগ্যবতী যে ওকে পেয়েছিস। মনে পড়ে? বিয়ের আগে তুই শিবরাত্রির ব্রত করতিস আর ভালো বর চাইতিস? শিব ঠাকুর ওকে পাইয়ে দিয়েছে তোকে।
তাহলে ও আসে না কেন? কেন আমাকে অবহেলা করে? কতবার বললাম এবার অন্তত এসো।
ওকি আর শুধু শুধুই আসছে না? কি পরিশ্রম করছে ছেলেটা দেখছিস তো। আর ও তোকে মোটেই অবহেলা করে না, বরং ভালোবাসে প্রচন্ড।
এই বুঝি ভালোবাসার নমুনা? এভাবে কষ্ট দিচ্ছে আমায়। অপেক্ষা করাচ্ছে বছরের পর বছর।
নিজের ভেতর একটা হাসি শব্দ শুনতে পেল মধুমিতা। হেঁসে নিয়ে সেই স্বত্ত্বাটি বললো, কষ্টের ভেতর দিয়ে গেলেই না ভালোবাসা তীব্র হয়। শোনরে সখি, ভালোবাসা হলো সাধনা, কষ্ট না করলে সাধনা সফল হয় না।
কিন্তু রিতম তো দিব্যি আছে। আমিই শুধু কষ্ট করবো কেন?
রিতমও তোর মতো কষ্ট করছে রে। উল্টো তোর থেকে বেশিই। তুই এখানে সবার সাথে আছিস, মজা করছিস, যা মন চাইছে তাই করছিস, যখন যেটা খেতে মন চাইছে তাই খাচ্ছিস। আর রিতম? ওকে তো জানিস, নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলবে না। নিজের ভেতর পুরছে ও। আত্মীয় পরিজন সবার থেকে দুরে। চাইলেই যেখানে সেখানে যেতে পারে না, জব আছে, পড়াশোনা আছে, মোট কত ঘন্টা ঘুমানোর সুযোগ পায় ও বলতো? পাঁচ ঘণ্টাও না। সারা রাত শিফট থাকে। খাবারের ও তো কষ্ট। কিছু খেতে হলে হিসেব করে খেতে হয়। কত পাউন্ড খরচা হলো তার হিসেব রাখতে হয়।
তাই বলে দূরে থাকবে? আমি ওকে বলেছি কষ্ট করতে? এই যে দেখ না পুজো আসছে, আমরা কতো কেনা কাটা করবো, ঘুড়বো, খাবো। আর ও ওখানে পড়ে থাকবে, তখন ঘুড়তে, কেনা কাটা করতে ভালো লাগবে?
তা ঠিক, এটা রিতমের ভারি অন্যায়।
ওকি ভুলে যাচ্ছে আমায়? মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো।
একটু আগেই তো ওর সাথে কথা বললি, দেখিস না, তোর সাথে কথা বলতে পেরে কত খুশি হয় ছেলেটা? ও শুধু তোকেই চায়। ওকে ভুল বুঝিস না।
সেকি? চলে যাচ্ছিস?
হ্যা রে।
এতো দিন পরে এলি, আরেকটু থাক না।
না রে। বেশিক্ষণ থাকতে পারি না এখন।
কেন, আগে তো খুব কথা বলতিস আমার সাথে।
আরেক দিন বলবো, এখন যাই রে।
মধুমিতা এই কথাগুলো নিয়ে ভাবার সুযোগ পেলো না। সাথে সাথেই ভেতর থেকে সেই স্বত্ত্বাটা কথা বলে উঠে যেটা মধুমিতাকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছিলো, ব্রেইন ওয়াশ করছিলো।
কি রে বান্ধবী?
আজ তোরা সবাই এক সাথে যে? মধুমিতা জিজ্ঞেস।
কেন আসতে মানা?
না। দীর্ঘ শ্বাস নেয় মধুমিতা। কি বলবি বল।
ঐ শাকচুন্নীর কথা শুনিস না। ও সব মিথ্যা বলেছে।
তুই বুঝলি কি করে?
বুঝবো না? ওকে আমি হারে হারে চিনি। ও আমার পড়শি যে। আমরা তোর মনে পাশাপাশিই থাকি। সে কথা থাক, এখন তুই নিজেই ভাব, ও যা বললো সেগুলো কতটা বিশ্বাস যোগ্য? সেগুলো সত্য বলে অনুভব করিস তুই?
এখনো ভেবে দেখিনি।
আর ভাবার দরকার নেই। ও তোকে ঠকানোর বুদ্ধি করেছিলো। শোন, ওর কথা শুনবি না। তুই যা করছিস বেশ করছিস। আরো করবি।
মধুমিতার মনে এখন আবার দ্বিধার উদয় হলো। একটু আগে যে অংশটা ওর সাথে কথা বললো, ওর সাথে এর কথার এতো অমিল! কিন্তু মধুমিতার মনে দিহানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে এখন আর ভালো-খারাপের প্রশ্ন আসে না। ও মেনে নিয়েছে সম্পর্কটা।
রিতম জেনে গেলে?
কোথা থেকে জানবে? ও তো এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তোর কোনো খবর রাখে? তুই কি করছিস না করছিস ও তার খেয়াল রাখে না।
মধুমিতারো তাই মনে হয়। যেখানে রিতম নিজেই ওর খেয়াল রাখে না, সেখানে এতো চিন্তা করে লাভ কি? বরং যেভাবে চলছে চলুক, মধুমিতা তো সুখ পাচ্ছে।
তা ঠিক বলেছিস। ও আমার খেয়ালই রাখে না।
এই তো বুঝেছিস। আর দিহান কে দেখ, ও তোকে দেখে, চোখে চোখ রাখে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তোকে ছোঁয়, তোকে বোঝে তুই কি চাস। ও তোকে ভালবাসে রে, আদর করে। তুই একবার ডাকলেই পাগলের মতো ছুটে আসে তোর কাছে। অন্যদিকে রিতমকে তুই হাজার বার অনুরোধ করছিস, একবারো এসেছে? উল্টো তোকে কি অবহেলাটাই না করে।
মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো, সত্যিই অবহেলা করে?
করে না? পাল্টা প্রশ্ন করে সেই স্বত্ত্বা।
জানি না। কিচ্ছু জানি না আমি।
রিতম তোকে শুধু অবহেলাই করে না, তোকে বোঝা মনে করে, শুধু বউ মনে করে তোকে। তুই ওর কাছে শুধুই দায়িত্ব, নারী নোশ। দিহান তোর মর্যাদা বোঝে, তোকে নারী ভেবে ভালোবাসে। এক মূহুর্ত মৌন থেকে সেই স্বত্ত্বাটি আবার বলল, শোন, উপভোগ কর নিজের যৌবন। কারো দিকে তাকাশ না। কোনো পিছুটান মানিস না। দিহান নিজেকে তোকে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, এই সুযোগ ব্যবহার কর, চুটিয়ে ফুর্তি কর ওর সাথে। কেউ বাধা দেবে না তোকে। কেউ জানবে না। ভয় পাশ না।
ধ্যাত, লাজুক স্বরে মধুমিতা বললো। তুই ভারি অসভ্য।
আমি তোর কামনারে সখি। একটু অসভ্যই। আবার বলছি দিহান কিন্তু খুব ভালো ছেলে, এই সুযোগে ওর মাথাটা চিবিয়ে খা।
কিভাবে চিবোবো? মধুমিতা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলো।
প্রায়ইতো খাচ্ছিস ওকে।
তুই যা তো। নির্লজ্জ কোথাকার।
খিলখিল করে হেসে উঠলো সেই অংশটা। ঠিক আছে যাচ্ছি, কিন্তু আমার কথা ভুলিস না যেন।
ওর কথা বন্ধ হলে মধুমিতা চোখ বুজলো। তাকিয়ে দেখলো নিজের ভেতরে, এই নিজের ভেতরে ঝুঁকে দেখাটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। আত্মপর্যালোচনা জরুরি।
মধুমিতা ধীরে ধীরে সব কিছু বিশ্লেষণ করে দেখলো। বিশেষ করে ওর আপনার ভূমিকাটা। কারণ ও জানে, ভবিষ্যতে ওর দিহানের সাথে এই সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। রিতম না করুক, ওর বিবেক ওকে কাঠগড়ায় তুলবেই। প্রস্তুত থাকতে হবে, কেউ যেন ওর দিকে আঙুল না তুলতে পারে। তার জন্য নিজেকে জানা প্রয়োজন। রিতমের হাত ধরে এই বাড়িতে আসার পর থেকে আজকে পর্যন্ত, মধুমিতার জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট বড় সব ঘটনা মধুমিতা পর্যালোচনা করলো।
সেই দিনটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ওর। ভাবলেই বুকের ভেতর অনাবিল প্রশান্তি ভরে ওঠে– যেদিন রিতমের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে খুশির দিনটা সেটাই।পৃথিবীর আর কোনো মুহূর্তই সেটার মতো বিশেষ না, কোনো জিনিসই ততো মূল্যবান নয়, যতটা দামি সেই দিনটি। সেদিন দুটো জিনিস পেয়েছিল মধুমিতা—একটা, অপমান-ভরা দাসীর মতো জীবনের অবসান; আরেকটা, রিতমের মতো ছেলেকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়া।
সেই মুহূর্তটি আজও ওর হৃদয়ে তাজা। ওরা দুজন তখন বিয়ের পিঁড়িতে পাশাপাশি বসে, রিতমের হাতে ওর হাত—কাশফুলের সবুজ ঘাসে বাঁধা, পুরোহিতের উচ্চারিত প্রতিটি মন্ত্র, উলুধ্বনি আর শঙ্খ ধ্বনি, যজ্ঞকুণ্ড থেকে উঠা ধোঁয়ায় যেন মায়াময় হয়ে উঠেছিল চারদিক। বিয়ের সারাটা সময় মধুমিতা মুগ্ধ চোখে বারবার রিতমের দিকে তাকাচ্ছিলো। শ্বেতবসন পরা রিতমকে ও দেবতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারছিলো না।
এরপর রিতমদের বাড়িতে নববধূ বেশে মধুমিতার প্রবেশ, ফুল সজ্জার রাত, ওদের মিষ্টি সংসার, সবকিছুই যেন চলচিত্রের সাজানো দৃশ্য। কোনো অভিযোগ ছিলো না কারো, কোনো দিন ঝগড়া হয় নি ওদের। মধুমিতা লক্ষী মেয়ের মতো রিতমের সাথে সংসার করছিলো। এক বছর। ঐ একবছর মধুমিতার কাছে স্বর্গ বাসের থেকেও বেশি সুখের ছিলো।
কিন্তু সুখের ভাটা পড়ে, চিরকাল কোথাও স্থায়ী হয় না। সুখ চলে গিয়ে আমাদের জীবনে আসে কষ্ট। স্বর্গবাসীদেরও স্বর্গের থেকে পতন হয়। মধুমিতার কপালেও তাই ঘটেছিলো।
উচ্চাভিলাসী রিতম পারী দিলো ইংল্যান্ডে, মধুমিতার যেন ভাগ্য বিপর্যয় হলো তখন। নিষঙ্গতা, একাকিত্ব আর দহন ঘিরে ধরেছিলো ওকে। প্রথম দুই বছর কঠোর ভাবে নিজেকে সামলে রেখেছিলো। তারপর শরীরের ভেতর ধীরে ধীরে জ্বলতে শুরু করেছিলো, কামনার আগুনে। যৌন জ্বালায় মধুমিতা খুব কষ্ট পাচ্ছিলো। এমন সময় দিহান প্রবেশ করলো ওর জীবনে। একেবারেই অপ্রত্যাশিত ভাবে।
মধুমিতা দিহানকে কখনো কামনা করে নি। ও এসেছিলো হঠাৎ, তখন মধুমিতা ছিল দুর্বল, ভীষণ কামুক, আর নিঃসঙ্গ। তাই হয়তো সহজেই সঁপে দিয়েছিল নিজেকে দিহানের কাছে। যেন নিয়তির পরিকল্পনা। নাহলে মধুমিতা কেন দিহানকে সুযোগ দেবে এতো সহজে?
এই যে দিহানের সাথে ওর সম্পর্ক, মধুমিতার কাছে মাদকের মতো। দিহান ওর কাছে এলেই সব কিছু ভুলে যায়, মাথা কাজ করে না, দ্রুত হয় হৃদস্পন্দন। মধুমিতা নিজেকে অনেক বার প্রশ্ন করেছে, ও কি দিহানের প্রেমে পরেছে, বার বার ও উত্তর পেয়েছে না। কিন্তু মধুমিতা এই সম্পর্ককে পরকিয়াও ভাবতে নারাজ। দিহানের প্রতি অনুভূত হওয়া ওর অনুভূতিকে অবৈধ ভাবতে খারাপ লাগে। কারণ মধুমিতা মনে করে ওর কামনা, আর ওর শরীর যদি সত্য হয়, এটা মন্থন করাও সত্য, আর সত্য কখনো অবৈধ হয় না।
প্রথমে মধুমিতার তীব্র অনুশোচনা হতো, ভাবতো বুঝি ও স্বামীকে ঠকাচ্ছে। তারপর দেখলো রিতম ওকে চার বছর ধরে ঠকাচ্ছে। মধুমিতা যদি বিপথগামী হয়ে থাকে তার জন্য রিতম দায়ি, রিতম দিহানকে ওর জীবনে আনতে ওকে বাধ্য করেছে।
মধুমিতা যত অনুশোচনায় ভূগেছে, নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, প্রতিবারই রিতমকে দুষেছে।
মধুমিতা অনুভব করছিলো রিতমের জন্য ওর মনে একটা বিরাগ ঘনিভূত হচ্ছিলো, যা ওকে রিতমের সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবতে আর বিশ্বাস করতে বাধ্য করছিলো।
আর আজকে যখন বুঝলো রিতম এবার পুজোয়ও আসবে না এই বিরাগ চরম রুপ নিলো। রাগ, ক্ষোভ, অভিমান মিলেমিশে ওর মনে রিতমের জন্য দারুণ এক বিমূখতা জন্ম দিলো। মধুমিতা মনে মনে বললো, রিতমের সাথে আর কথা বলবে না, কোনো ফোন ধরবে না। রিতম যদি ওকে অবহেলা করে তাহলে ও নিজেও তা করবে। এগুলো ভাবতে ভাবতে কষ্টে বুক ফুলে ফুলে উঠছিলো, হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথা, চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছিলো জলে।
এগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেছিলো মধুমিতা। ঘুম ভাঙ্গলো যখন, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। বিকেলের অল্প কিছুক্ষণই বাকি। আকাশে ম্লান হলদে আলো, দেখলে মন কেমন করে, মনে হয় কোনো বিষন্নতার বার্তা বয়ে বেড়াচ্ছে এই আলো। দুপুরে অনুভূত হওয়া গরম কমে গেছে। জানলা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস ছুটে আসছিলো। নিচের গলিতে রিক্সার টিংটিং বেল, গাড়ির হর্ন আর লোক চলাচলের মৃদু শব্দ। বিকেলের পর থেকে এলাকাটা গমগম করতে থাকে।
মধুমিতা বিছানার থেকে নেমে হাত পা ধুয়ে কাপড় পাল্টিয়ে নিলো। ঠাকুর পুজো করতে হবে। সকালে শাশুড়ি মা পুজো দেন। আগে দুবেলাই দিতেন। সম্প্রতি বাতের ব্যথাটা ভোগাচ্ছে ওনাকে। বিকেলের পর হাঁটা চলা করতে কষ্ট হয়। সন্ধ্যার পুজোটা তাই মধুমিতাই করে।
আসলে সারাদিন নানান কাজ, বিভিন্ন সাংসারিক আর সম্পর্কগত মানসিক জটিলতার সাথে লড়াই করে মধুমিতা অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, বিষন্নোও থাকে কখনো কখনো। সন্ধ্যার দিকে ঠাকুরের কাছে বসলে তখন খুব প্রশান্তি লাগে। কতটা ভক্তি জাগে মনে জানি না, কিন্তু এই আধা ঘন্টা মধুমিতার খুব ভালো কাটে। পুজো দেওয়ার পর ঠাকুরের সামনে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভক্তিমূলক গানও করে কয়েকটা। আজোও তাই করলো।
পুজো শেষ করে মধুমিতা আবার শাড়ি পাল্টিয়ে একেবারে নাইটি পরে নেয়। এরপর রান্না ঘরে যেতে হয়। এইসময় শশুর শাশুড়ি বসার ঘরে টিভি নিয়ে বসে যান। টিভি দেখতে দেখতে চা-টা খান তাঁরা। মধুমিতা তখন চা করতে রান্না ঘরে ছিলো। হঠাৎ শব্দ করে ফোন বেজে উঠলো ওর। ভাবলো রিতম ফোন করছে, ওর ফোন ধরবে না মধুমিতা। ফোন মিউট করতে গিয়ে দেখলো, রিতম নয় দিহান। মধুমিতার ভ্রু কুঁচকে গেলো। বিরক্ত হলো দিহানের উপর। হাজার বার বলেছে যখন তখন ফোন না দিতে। রাতের বেলা যেন ফোন করে তাও প্রতিদিন নয়, খুব প্রয়োজন হলে অর্থাৎ দিহান যদি মধুমিতার জন্য অধিক ব্যাকুল হয়ে ওঠে তখনই যেন ফোন দেয়।
মধুমিতা ফোন কেটে দিল। দিহান আর ফোন করে না। একটু পর নোটিফিকেশনের টিউন বেজে উঠলো ওর ফোনে। মধুমিতা ফোন চেক করে দেখলো দিহান ওর পূর্ন দৈর্ঘ্য বাঁড়াটার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। সাথে দুষ্টুমির ইমোজি। মধুমিতার বিরোক্তি ভাবটা আরো বাড়লো। ফোন দিয়ে বসলো দিহানকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফোনের আরেক প্রান্ত থেকে দিহানের খুশি খুশি কন্ঠ স্বর ভেসে এলো, হ্যালো, বেবি?
তুমি চুপ থাকো দিহান। কি হচ্ছে এগুলো? এমন সময়ে ফোন দিতে নিষেধ করেছি না তোমায়?
আরে রাগ করো না, এক সপ্তাহ হয়ে গেছে তোমায় দেখেছি। এর মধ্যে এক দিনো ফোন দিয়েছি? আজকে মন চাইছিল খুব। তাই ভাবলাম...... আর দেখলে তো আমার অবস্থা? থ্রোবিং লাইক হেল। এলরেডি দু'বার হাত মেরে ফেলেছি। তাও শান্ত হচ্ছে না।
টেল মি..... আর ইয়ু এ এনিম্যাল ওর সামথিং? এতো হর্নিনেস আসে কোথা থেকে।
তোমার কথা ভাবলে, সুইটহার্ট। বলে হাসলো দিহান। তোমার কথা মনে পড়লে আমার এমন বাজে অবস্থা হয়।
অফিসে এখন? গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো মধুমিতা।
হ্যাঁ।
বাড়ি গিয়ে আচ্ছা মতো বউকে লাগাও, শান্ত হয়ে যাবে।
ধুর ওকে লাগিয়ে মজা নেই।
কেন?
বিরিয়ানি খাওয়ার পর ভাত ভালো লাগে? তোমাকে পাওয়ার পর থেকে ওকে আর ভালো লাগে না। সবসময় তোমাকে কাছে পেতে মনে চায়।
আমাকে কাছে পাওয়ার উদ্দেশ্য তো তোমার কাছে একটাই। সেক্স। কিন্তু মেয়েরা সারাক্ষণ সেক্স চায় না। আমাদের কাছে সম্পর্ক মানে শুধু শরীর নয়, আরো গভীর। শরীরবাদী হলে কেউ পছন্দ করবে না তোমায় সে মেহুলই হোক বা আমি। নিজেকে কন্ট্রোল করতে শেখো দিহান। বেশি বেপরোয়া হতে নেই। দেখ এমন তো নয় তুমি আমাকে পাচ্ছো না, পাচ্ছো তো। এখন তোমার উচিত মেহুলকে হাতে রাখা। তা না করে তুমি ওকে ক্ষেপিয়ে তুলছো। সব কিছু বুঝতে হয়। তোমার জন্য সবকিছু এমন ঘোলাটে হয়েছে।
বিপরীত পাশে তখন নিরবতা। দিহান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বলল, রাগ করো না আমার উপর। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।
হুম....যা বলতে চাইছিলাম, এরপর আর ফোন দেবে না।
কেন বেবি?
তোমাকে বলি নি? মেহুল আমাদের সন্দেহ করছে।
ওর কথা বাদ দাও। কল্ড বিচ একটা। না নিজে সুখে থাকবে না আমাকে থাকতে দেবে।
না দিহান। সব কিছু হাল্কা ভাবে বিচার করলে হবে না। আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক টা কেউ জানুক। আজ মেহুল সন্দেহ করছে, কাল হয়তো রিতম করবে। সেটা আমি চাই না। রিতমের চোখে আমি ছোট হতে পারবো না।
আমি সব চ্যাট ডিলিট করে দেবো, কেও বুঝতে পারবে না।
তুমি খুব ইমপ্রাক্টিক্যাল, দিহান। শোনো, এখনি সতর্ক হতে হবে। তুমি কি চাও আমরা ধরা পরি, আর আমাদের মেলামেশা বন্ধ হয়ে যাক?
না সোনা।
তাহলে যা বলছি শোনো। এখন থেকে ঘন ঘন ফোন করবে আমায়। এই ধরনের কোনো পিকচারও পাঠাবে না।
ঠিক আছে।
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মধুমিতা জিজ্ঞেস করলো, মেহুলের সাথে লাস্ট কবে সেক্স করেছো? সত্যি কথা বলবে।
তোমার সাথে হোটেলে গেলাম না সেদিন, তার তিন দিন আগে হয়তো।
দশ দিনের বেশি হয়ে গেছে। এমনটা করা চলবে না। আজ বাড়ি ফিরে খুব আদর কোরো বউকে।
তুমি বলছো এই কথা। জেলাস হবে না?
আমি জেলাস হবো কেন? তোমার বউ। এটা তো স্বাভাবিক একটা কাজ। তো....মেহুলের দায়িত্ব তোমার। ওকে ভুলিয়ে রাখো, ওর মনে যেন কোন সন্দেহ দানা না বাঁধে। আই নো ইয়ু আর এ মাস্টার অব ম্যানুপুলেশন, ইয়ু ক্যান ডু ইট প্রপার্লি।
ঠিক আছে, বেবি তুমি যা বলবে। কিন্তু আবার কবে মিট করবো আমরা?
শনিবার দুপুরে। রবিবার একটা নেমন্তন্ন আছে। ঐ দিন হবে না।
ঠিক আছে বেবি।
ছাড়ছি....।
লাভ ইয়ু।
এখন মেহুলের কথায় আসি। আগের বার মধুমিতা দিহানের সাথে হোটেলে দেখা করেছিলো মঙ্গলবার। তার দুদিন পর মেহুল বাপের বাড়ি এসে হাজির। মেহুল মাসে এমন হঠাৎ দুচার বার এসে পড়ে। দু এক দিন থাকে, তারপর চলে যায়।
মধুমিতা ভেবেছিলো এবারো এমনিই বেড়াতে এসেছে। দুপুর বেলা হাসি আড্ডা, বিকেলে আহিরিটোলার ঘাটে ঘুরতে যাওয়া, ফুচকা খাওয়া, সন্ধ্যায় এক সাথে সিরিয়াল দেখা, সব কিছুই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু রাতের বেলা ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।
শশুর শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো তখন। রাত এগারোটার পর মেহুল মধুমিতার শোবার ঘরের দরজায় টোকা দেয়। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, ঘুমোও নি বৌদি?
না, আরেকটু পর ঘুমোবো।
মেহুল বিছানার এক প্রান্তে এসে বসেছিলো। কথা বলতে শুরু করেছিলো হালকা ভাবে। এপ্রসঙ্গ-সেপ্রসঙ্গ, গয়না-গাটি, পোশাক, রুপ চর্চা, পার্লারের নতুন ট্রিটমেন্ট এমনকি মধুমিতার চুলের প্রশংসাও করেছিল মেহুল। ইত্যাদি আলোচনার পর মেহুল দিহানের কথা উত্থাপন করেছিলো। মধুমিতার মনে হচ্ছিলো সব কিছুই মেহুলের গুছিয়ে রাখা, পূর্ব পরিকল্পিত।
একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, বৌদি?
বলো না। হেসে বলেছিলো মধুমিতা।
মেহুল জিজ্ঞেস করেছিলো, দিহান কে তুমি কেমন মনে করো?
মানে? মধুমিতা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেছিলো।
মানে, তোমার মতে কেমন ছেলে ও?
বেশ–বেশ ভালো ছেলে। মধুমিতা প্রথমটায় হকচকিয়ে গেছিলো। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে হেঁসে বলল, কত হ্যান্ডসাম। ইয়ু আর লাকি। তোমাদের একসাথে খুব ভালো লাগে, একেবারে মেইড ফর ইচ আদার।
মধুমিতা লক্ষ্য করে ছিলো মেহুল ওর ধারালো চোখ দুটো সরু করে মধুমিতার মুখের দিকে দেখছিলো।
আচ্ছা বৌদি আরেকটা কথা বলোতো, সম্রতি দিহান কি তোমায় বিরক্ত করছে? ধরো ফ্লার্টিং বা অসভ্য কোনো হিন্টস? বা কোনো পদক্ষেপ যা দেখে তোমার অনুভব হয়েছে ওর কোনো অভিসন্ধি আছে?
মধুমিতার বুকটা ধক করে উঠেছিলো, ওর মনে হচ্ছিলো মেহুল বুঝি কিছু টের পেয়েছে। আর এই ধরা পরে যাওয়ার ভয় যে কি রকম সাংঘাতিক সেটা যার বুক ধক করে উঠে সেই বলতে পারে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছিলো ওর, একটা শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে মধুমিতা বলেছিলো, কো–কোথায়? না তো। দিহান এমন কিছুই করে নি।
তেজ আর ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে মধুমিতা আর মেহুল সামানে সমান। মধুমিতার তেজ ওর নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হয় সেটা ও জানতো। কিন্তু মেহুলের টা অনিয়ন্ত্রিত, যখন তখন প্রকাশ পেয়ে যেত, আগ্নেয়গিরির মতো। তবে মধুমিতার মনে হচ্ছিলো মেহুলের বুদ্ধি ওর থেকে বেশি, নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ করেছে, তাই এমন আটঘাট বেঁধে এসেছে। মেহুলের জেরা থেকে বাঁচতে মধুমিতার এখন খুব ভালো নাটক করতে হবে।
তোমার এমনটা কেনো মনে হচ্ছে বলতো, মেহুল?
মেহুলের চোখের দৃষ্টি কিছুটা নরম হয়ে গেছিলো, বললো, দেখো তুমি আমার দাদার বউ। আবার আমি আর তুমি প্রায় সমবয়সী, তুমি আমার বান্ধবীর মতো। তাই তোমার কাছে কিছুই গোপন করবো না। আসলে–দিহানকে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না। তোমাকে সোজাসুজি বলছি শোনো, আমাদের লাভ ম্যারেজ। মাত্র ছয় মাসের সম্পর্কে ওকে বিয়ে করেছি। তুমি তো জানো। যেটা কি না আমার এখন মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে। ওকে আরো যাচাই করা উচিত ছিলো আমার। দিহান বড়লোকের ছেলে। হ্যান্ডসাম। তাই হয়তো বেশি কিছু ভাবি নি।
এক মুহুর্ত সময় নিয়ে মেহুল আবার বলল, ওকে তোমরা যতটা ভালো মনে করো ততটা ভালো ও নয়। ওকে তোমরা যতটা ভালো মনে করো ততটা ভালো ও নয়। মানে বিষয়টা কমপ্লিকেটেড। ঠিক বুঝবে কি না জানি না, আমার সাথে কখনো খারাপ কিছু করে নি বরং ও বেশ কেয়ারিং। কিন্তু একটা খারাপ দিক আছে–দিহান বহুগামী। এক জন দিয়ে ওর হয় না।
বহুগামী? মানে?
মানে ধরো প্লেবয় বা সোজা ভাষায় মাগীবাজ।
এই বিশেষ শব্দটি শুনে মধুমিতার কান গরম হয়ে গেল। নিজেকে অপমানিত বোধ করলো। কারণ দিহান তো ওর সাথেও শোয়।
মেহুল বলে চললো, বিয়ের প্রথম ছয় মাস এক বছর এই দিক টা দেখিনি। কিন্তু যখন আমার শরীরের উপর থেকে ওর লোভ শেষ হয়ে গেল তখন দেখলাম ও গার্লফ্রেন্ড পুষছে। ওরই অফিসের একটা মেয়ে। এরপর এমন আরো প্রমাণ পেয়েছি। অন্য মেয়েদের সাথেও ওর সম্পর্ক হয়েছে, ভেঙেছে। ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে অনেক। শেষে মেনে নিতে হয়েছে যখন দেখেছি ওর কামনা অনেক, যা আমি একা মেটাতে পারবো না, সে সাধ্য আমার নেই।
এ তো তোমার অপমান। ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারো।
অপমান ঠিকিই। আবার নয়ও। ও আমার থেকে একটা প্রমিজ করিয়ে নিয়েছে, যে দিন আমি ওকে স্যাটিসফাই করতে পারবো সেদিন ও আর কারো কাছে যাবে না।
তাহলে তুমি সেটা করছো না কেনো?
আমার পক্ষে ওকে পূর্ণ স্যাটিসফিকশন দেওয়া সম্ভব নয়। ইয়ু ডোন্ট নো, হি ইজ ভেরি লাস্টফুল।
মধুমিতা মনে মনে মেহুলকে ভেংচি কাটলো। কোল্ড বিচ বলে গালি দিলো। ভর্ৎসনা করলো স্বামীকে যৌন তৃপ্তি দিতে পারে না বলে।
আচ্ছা মেহুল তোমার কেন এমনটা মনে হলো যে দিহানের নজর আমার উপর পড়েছে? মধুমিতার ঠোঁটে বাঁকা হাসিঁ।
ওর ফোন দেখে, তোমার কয়েকটা মেসেজ দেখেছিলাম, তুমি ওকে ম্যাসেজ করতে নিষেধ করছিলে। তারপর উপর এই বাড়িতে ওর যাতায়াত বেড়েছে খুব। ব্যপারটা আমার ভালো লাগছে না।
মধুমিতা হঠাৎ রেগে গেলো, যেটা কি না জরুরি ছিল ওর জন্য। খেলাটা আরেক দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে তো, নাহলে মেহুল ওকে সন্দেহ করে বসবে। রাগী কন্ঠে বললো, তোমার বর এ বাড়িতে এতো আসে কেন সে তোমার বরকে বল গিয়ে, আমি এতো শত জানি না।
ঠিক আছে। মেহুলও খানিকটা রাগলো, দিহানের সম্পর্কে আমার জানানোর দরকার ছিল জানিয়ে দিলাম। আমি চাই না, আমার দাদা কষ্ট পাক। তাই তোমাকে সতর্ক করলাম।
কি বলতে চাইছো তুমি? মধুমিতার কণ্ঠে তেজ।
তুমি সত্যি বলনি আমায়। আমার সিক্স সেনন্স বলছে, দিহানের চোখ নিশ্চয়ই তোমার উপর পড়েছে। ভুল কিছু করে বসো না।
সে বিষয়ে আমি তোমার থেকে জ্ঞান নেবো না, মেহুল। এর মধ্যেই তুমি আমাকে অনেক অপমান করে ফেলেছো। ভুলে যেয়ো না সম্পর্কে আমি তোমার বড়।
ভালো উপদেশ কে যে অপমান ভাবে, তার সাথে আর কথা বলে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি।
এমনই এক তীব্র উত্তেজনার মধ্যে দুজনের কথপোকথন শেষ হয়ে ছিলো সেদিন।
মধুমিতা হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো। ভাগ্যিস মেহুল শুধু দিহান কেই সন্দেহ করেছে, আর মধুমিতাকে এসে বলেছে ব্যপারটা, নাহলে হয়তো ধরা পরতে হতো কয়েক দিনের মধ্যেই। এখন আরো সতর্ক হতে হবে, মনে মনে বলেছিলো মধুমিতা।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)