Thread Rating:
  • 15 Vote(s) - 2.8 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance কিছু সম্পর্ক
#92
কিছু সম্পর্কঃ ৭ ()

 
জান্নাত বাড়িতে এসে আবার নিজের পছন্দের জায়গায় জানালার ধারে এসে বসে । এখান থেকে শিকদার বাড়ির পেছনটা দেখা যায় । ছোট আম্মুর কবর যেখানে । জান্নাত দেখে রাজীব সেখানে দাড়িয়ে আছে । রাজীবের পেছনটা দেখা যাচ্ছে , কিন্তু জান্নাত বুঝতে পারে রাজীব কথা বলছে । কারন ওর মাথা নড়াচড়া করছে । রাজীবের মুদ্রাদোষ হচ্চে , ও কথা বলার সময় মাথা নারে ।
 
জান্নাত ভেবে পায় না একজন মানুষের জন্য অন্য একজন মানুষের এতো টান কি করে তৈরি হয় । যেমন টান এখন এই মুহূর্তে রাজীবের জন্য অনুভব হচ্ছে । রানীর মুখে যখন শুনেছিলো রাজীবকে রানী কথা শুনিয়েছে, তখন অনুভুত হয়েছিলো । ইচ্ছে হয়েছিলো রানী কে আরো কড়া কড়া কিছু শুনিয়ে দিতে । যদিও এই ব্যাপারে জান্নাতের নাক গলানোর কোন অদিকার নেই। কিন্তু জান্নাতের মনে হয় , কেউ অধিকার না দিলেও ও রাজীবের জন্য প্রয়োজনে দুনিয়ার সবার সাথে লড়বে । রাজীব যে কষ্ট দেবে , সে ওর জন্য শত্রু ।
 
এই মুখচোরা , অভিমানী , নরম মনের ছেলেটির মনে কেউ কষ্ট দেবে , কেউ ওর ক্ষতি করতে আসবে । সেটা ও কোনদিন হতে দেবে না । রানী ওকে যখন প্রশ্ন করেছিলো তুই কে?” তখন ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো আমি রাজীবের আর রাজীব আমার পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়েছিলো তুই কে ? আমার রাজীবকে কষ্ট দেয়ার। কিন্তু পারেনি , পারেনি কারন এই অধিকার রাজীব ই ওকে দেয়নি । তবে আজ এখন এই সিদ্ধান্ত নিলো জান্নাত ,  রাজীব অধিকার দিক আর না দিক , কাউকে পরোয়া করবে না ও । রাজীবের শরীরে বা মনে আচর কাটতেও কাউকে এলাউ করবে না ।
 
জান্নাত জানে , রাজীব আজকে থেকে রানী কে স্বাধীন করে দিলেও ও নিজে এখনো স্বাধীন হয়নি । কারন ওর মন আজকে থেকে আরো বেশি ভীত থাকবে । কারন সারাক্ষণ রাজীব ভাববে কাজটা ঠিক হলো কিনা ? রানী আবার উল্টাপাল্টা কিছু করছে কিনা? বরং আগের চেয়ে আরো বেশি বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার চেষ্টা করবে । আরো বেশি চাপ নিয়ে নিবে নিজের উপর ।
 
ধিরে ধিরে জান্নাতের অভিমান হতে থাকে , অভিমান হয় রাজীবের উপর । ভাবে , কেন রাজীব আর দশটা সাধারন ছেলের মত হলো না , কেন রাজীব এই বয়সি ছেলে মেয়েদের মত সুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না । এই দায়িত্বের চাপ এড়িয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার ই না । সুধু দরকার ইচ্ছা শক্তির । জান্নাত বিড়বিড় করে বলে  একজন মৃত মানুষের অনুরধ রাখতে গিয়ে কেন সুধু সুধু নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস?’  
 
জান্নাত জানে রাজীব কি সমসার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে । রানীর প্রতি রাজীবের কর্তব্য দায়িত্ব আছে , কিন্তু অধিকার নেই ।  আর এই কারনেই ওদের এই সম্পর্ক ধিরে ধিরে ইম্ব্যালান্স হয়ে যাচ্ছে । জান্নাত যদি এমন কিছু করতো তাহলে ওর বাবা ওকে যেভাবে টেক কেয়ার করতে পারতো , ঠিক একি ভাবে শাসন ও করতে পারতো , শাসন না মানলে হুমকি দিতে পারতো। কিন্তু রাজীবের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন । রাজীব টেক কেয়ার তো নিজের তাগিদে করছে , কিন্তু শাসন করতে গিয়েই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে , প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে , অপমানিত হতে হচ্ছে । এসব ভেবে ভেবে জান্নাত অস্থির হয়ে ওঠে । ওর এই অস্থিরতার কারন , সুধু চুপচাপ দেখা ছাড়া ও রাজীবের জন্য কিছুই করতে পারছে না ।  
 
জান্নাত দেখে রাজীব ধিরে ধিরে কবরের পাশে বসে পড়েছে । এখনো কথা বলে যাচ্ছে , জান্নাত রাজীবের কথা না শুনেই অনুমান করতে পারে , রাজীব কি বলছে । রাজীব ওর মায়ের দেয়া দায়িত্ব নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলছে । নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেই এখনো শিওর নয় , তাই কৈফিয়ত দিচ্ছে ।
 
জান্নাটের পক্ষে এই দৃশ্য দেখা সম্ভব হয় না । জানালা থেকে সরে দাড়ায় । তারপর নিজের ঘর থেকেই বেড়িয়ে যায় । আয়শা তখন বসে বসে একটা উলের টুপি বুনছে । জান্নাত আয়শার পাশে গিয়ে বসে । মেয়ের মুখ দেখেই আয়শা বুঝতে পারে , মেঘ জমেছে । সেই সন্ধ্যায় মেয়ে ওকে ধরে কাঁদার পরে আয়শা বেশ কয়েক দিন চেষ্টা করেছে ওই ছেলের সম্পর্কে কিছু জানতে। কিন্তু জান্নাতের মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারেনি । জান্নাত সুধু এটুকু বলছে ,  ওই ছেলে আর ও সাগরের এপার ওপার দাড়িয়ে আছে , মাঝের সাগরটি দ্বিধা সংকোচ আর ভয়ের বিশাল বিশাল ঢেউএ ভরপুর।  মাঝের ওই সাগর পারি দেয়ার ক্ষমতা ওই ছেলের নেই , তাই জান্নাত এখন মাঝ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে,, কিন্তু ওই ছেলে জান্নাতকেও নিজের কাছে আসার অনুমতি দিচ্ছে না।  যদি জান্নাত  কোনদিন পুরো সাগর পারি দিতে পারে তবেই ওই ছেলের সাথে ওর মিলন হবে।
 
আয়শা এই কথা থেকে সুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছে , যে মেয়ে কোন ছেলের জন্য পাগল হয়ে বসে আছে । কিন্তু সেই ছেলে কোন ধরনের সীমা বদ্ধতার জন্য জান্নাত কে আপন করে নিতে পারছে না । আর জান্নাত কেও নিজের কাছে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না। মেয়ের এমন দুরবস্থা দেখে আয়শার মন ব্যাথায় ভরে ওঠে । কিন্তু ওর অসহায় ভাবে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই । মেয়ে কিছুতেই সেই ছেলের নাম বলবে না , ঠিকানা বলবে না । আয়শা অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে । বলেছে , ও নিজে ওই ছেলেকে দেখবে কথা বলবে , এমনকি ওই ছেলেকে সাহায্য করবে , সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ।  
 
কিন্তু জান্নাত কিছুতেই রাজি নয় । জান্নাতের সাফ কথা , কারো সাহায্য নিয়ে , অথবা কারো কাছ থেকে সাহস ধার করে যদি ওই ছেলে ওকে আপন করতে চায় , তাহলে জান্নাত নিজেই ওই ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করবে । ওই ছেলের নিজে থেকেই বুঝতে হবে, জান্নাত ওর জন্য বাড়তি কোন দায়িত্ব নয় , বাড়তি কোন বোঝা নয় । বরং ওর পথ চলার সাথী , সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার ান্ধব । যেদিন ওই ছেলে নিজে এটা উপলব্ধি করতে পারবে । এবং নিজে থেকে এসে জান্নাতের হাত ধরবে । সেদিন ই জান্নাত খুশি মনে সেই ছেলের হাত ধরবে । এর আগে নয় । না হলে আজ না হয় কাল আবার ওই ছেলে এই দ্বিধা দণ্ডে পরবে । আর জান্নাত সেটা কোনভাবেই চায় না।
 
কিরে মা কিছু বলবি?’ আয়শা মুখে হাসি টেনে বলে । আয়শা চেষ্টা করে মেয়েকে খুশি রাখতে । সেই দিনের পর থেকে আয়শার মনে এই কথা গেঁথে গেছে যে মেয়ে আর বেশিদিন ওর সাথে নেই । তাই এখন আর খুব বেশি রাগ না হলে মেয়ের সাথে চেঁচামেচি করে না । যথা সম্ভব ভালো আচরণ করার চেষ্টা করে ।
 
না মা কিছু বলবো নাএই বলে জান্নাত চুপ করে দাড়িয়ে থাকে , কিছুক্ষন পর  জান্নাত আয়শা কে জিজ্ঞাস করে  তোমার সাথে একটু বসবো?”  
 
ওরে আমার মা রে , আমার সাথে বসতে তোর আবার অনুমতি লাগবে!!! বস নাআয়শা হাত বাড়িয়ে মেয়েকে টেনে নেয়, নিজের পাশে বসায় ।
 
কি করছো?” কিছুক্ষন পর মা কে উল দিয়ে কিছু তৈরি করতে দেখে  জান্নাত জিজ্ঞাস করে ।
 
সামনে শীত আসছে , তাই তোর আব্বুর জন্য একটা কান টুপি , জানিস তো তোর আব্বুর কেমন ঠাণ্ডা সর্দির সমস্যা আছেআয়শা দুই হাতে কাঁটা চালাতে চালাতেই বলে । কথাটা বলার সময় আয়শার অজান্তেই একটা অন্য রকম হাসি চলে আসে। জান্নাত মায়ের ঠোঁটে সেই হাসি লক্ষ্য করে । এবং অভিজ্ঞতা না থাকলেও জান্নাত এই হাসির অর্থ বুঝতে পারে । জান্নাত বুঝতে পারে এই হাসি তৃপ্তির হাসি । নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু তৈরি করতে পারার  আনন্দ । জান্নাত মুগ্ধ হয়ে দেখছে এই হাসিতে ওর মায়ের চেহারার ঔজ্জ্বল্য কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে । ওর মা কে এই মুহূর্তে দেখে মনে হচ্ছে এই মানুষটির মনে কোন দুঃখ নেই । থাকবে কি করে , পুরোটা মন যে ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে আছে । দুঃখের জন্য সেখানে কোন জায়গাই যে অবশিষ্ট নেই।
 
কিরে ? এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?” আয়শা মেয়েকে নিজের দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়।
 
তোমাকে দেখিজান্নাত ছোট করে হেসে বলে ।
 
মেয়ের কথা শুনে আয়শা কপাল কুঁচকে তাকায় , তারপর বলে আমাকে কি নতুন দেখছিস নাকি আজকে?”
 
তা বলতে পারো , তোমার এই দিকটা আগে দেখা হয়নিজান্নাত রহস্য করে হাসে । মায়ের কাছে কিছুক্ষন বসার পর ওর মন ধিরে ধিরে ভালো হতে শুরু করেছে । মায়েদের এই এক অলৌকিক ক্ষমতা থাকে । তাদের শরীরের ঘ্রান , স্পর্শ এসব থেকে অদৃশ্য কোন শক্তি নিঃসৃত হয় । আর সেই শক্তি মন থেকে সব দুঃখ ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয় । সুধু মনই না শরীর ও সুস্থ করার ঔষধি গুন আছে মায়েদের ।
 
ওরে বাবা , আমার আবার কয়েটা দিক রে!!” আয়শা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করে ।
 
এই যে তুমি আব্বুর জন্য উলের টুপি বুনছ , এটা করার সময় তোমার চেহারায় আলাদা একটা জেল্লা চলে এসেছে , আচ্ছা আম্মু তোমার কি আব্বুর জন্য কিছু তৈরি করতে খুব আনন্দ হয়
 
মেয়ের কথা শুনে আয়শা চুপ থাকে , মিট্মিট করে হাসে । একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে আয়শার গালে হালকা লালিমা দেখা দিয়েছে । বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলে হ্যা তা তো একটু লাগেইবলেই আয়শা লিজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে । আয়শা ভাবে মেয়কে লুকিয়ে আর কি লাভ , মেয়ের এখন এমন বয়স হয়েছে , যে মেয়ে এসব বুঝতে শিখবে ।  
 
ওরে আমার আম্মুরে , দেখো কেমন লজ্জা পাচ্ছেজান্নাত বেশ মন খোলা হাসি হাসে । আম্মু জানো তোমাকে দেখে এখন কেমন লাগছে?”  জান্নাত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাস করে ।
 আয়শা আরো লজ্জা পেয়ে যায় , আর সেটা ঢাকার জন্য কপট রাগের সাথে বলে , “ আমাকে আবার কেমন লাগবে ? যেমন লাগার তেমন লাগছে
 
উহু দেখে মনে হচ্ছে কোন কিশোরী  প্রেম করে ধরা খেয়েছে হি হি হিজান্নাত খিল খিল করে হেসে ওঠে ।
 
বেশি ফাজিল হয়েছো!!!” আয়শা চাইলেও নিজের মুখ গম্ভির রাখতে পারে না । মেয়ের সাথে নিজেও হেসে ওঠে ।  তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে আমাদের সময় কি এসব ছিলো ? না না ছিলো , অনেকে শুনতাম প্রেম করছে । কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ হয়নি , বুঝে ওঠার আগেই মা জানিয়ে দিলো , আগামি সপ্তায় বিয়ে, আমাদের ওসব নেই , যা দরকার হয় করি , তোমাদের খেয়াল রাখি , ঘর বাড়ি দেখাশুনা করি , এই আমাদের প্রেম
 
একদম মিথ্যা বলবে না আম্মু , আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , কতটা রোম্যান্টিকটা তোমার মাঝে আছে , টুপিটা বোনার সময় তুমি সুধু দায়িত্ব থেকে বুনছ না , যদি তাই হতো তাহলে তোমার ঠোঁটে অমন হাসি থাকতো না , কাজ করতে কারো ভালো লাগে না , কিন্তু তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কতটা তৃপ্তি পাচ্ছো আব্বুর জন্য এই টুপি বুনে”  
 
হু তুমি তো সব বুঝে বসে আছো, তুমি তো আমার মেয়ে না তুমি আমার মা হওআয়শা কপট রাগের সাথে বলে ।
 
উহু আমি তোমার মা নই , যদি হতাম তাহলে এতো কম বয়সে বিয়ে দিতাম না, আমি তোমার ান্ধবীজান্নাত আয়শা কে জড়িয়ে ধরে বলে ।
 
আয়শা মেয়ের কপালে একটা চুমু খায় , তারপর  হেসে বলে একটা কথা ান্ধবী হিসেবে  তোকে বলে রাখি , ভবিষ্যতে কাজে দেবে। যতই তোর স্বামীর জন্য কোন কিছু করতে ভালো লাগুক , কিছুতেই সেটা বুঝতে দিবি না , সব সময় ভাব করবি যে তুই খুব বিরক্ত হচ্ছিস , যদি একবার টের পেয়ে যায় তাহলে কিন্তু জীবন শেষ করে দেবে”  আয়শার কথা শেষে মা মেয়ে দুজনেই এক সাথে হেসে ওঠে ।
 
হাসি শেষে জান্নাত বলে “ আমার কোনদিন কোন স্বামী থাকবে না,”
 
আয়শা অবাক হয়ে তাকায় , ওর মনটা ধক করে ওঠে , ভয় পেয়ে যায় , ভাবে মেয়ে এসব কি বলছে ? মেয়ে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে না ? “ সেকিরে মা তুই বিয়ে করবি না?” আয়শা ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাস করে ।
 
জান্নাত মায়ের ভয় বুঝতে পারে , তাই দ্রুত মায়ের ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয় , বলে “ না  না সেরকম কিছু না , যদি বিয়ে করি , সে আমার স্বামী হবে না “
 
“ তাহলে কি হবে?” আয়শা এখনো মেয়ের কথার মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারে না ,
 
“ শোন আম্মু , স্বামী শব্দের অর্থটা আমার কাছে ভালো লাগে না , আমি যাকে বিয়ে করবো সে আমার স্বামী নয় , আমার একজন অন্যজনের সাথী হবো , কেউ কারো স্বামী নয়, বুঝেছো, স্বামী শব্দটা শুনলেই কেমন মালিক মালিক মনে হয় আর নিজেকে সেই স্বামীর অধিন  লাগে , আমি কেন কারো অধিন হতে যাবো , আমি একজন স্বাধীন মানুষ , তোমরা কি আমাকে স্বাধীন ভাবে লালন পালন করছো না?”  
 
“ হুম” আয়শা ছোট করে বলে , ওর কাছে ভালোই লাগে , মেয়ে জ্ঞানীর মত কথা বলছে , ওর তো এমন কিছু ভাবনাতেই আসে না।
 
“ তাহলে যেখানে আমার বাবা মা আমাকে স্বাধীন ভাবে লালন পালন করছে , সেখানে আমি কেন যেচে পরে একজন কে স্বামী বানাতে যাবো? যদিও শব্দটা আজকাল আর সেই অর্থে ব্যাবহার করা হয় না , তবুও শব্দটা কলঙ্কিত হয়ে গেছে , কারন এই স্বামী শব্দটা এক সময় ভয়ংকর ছিলো , এখন নখ দাঁত হারিয়ে থুবড়ে পরেছে  যদিও। তবুও এই শব্দটা আমার কাছে একটা ক্রিমিনাল হয়েই থাকবে । এখন বুঝতে পেরেছো?”
 
“ কিছুটা” আয়শা হেসে বলে , ভাবে আজকালের ছেলে মেয়েদের চিন্তা ভাবনা কি বোঝা এতো সহজ ।
 
আরো কিছুটা সময় জান্নাত আয়শার সাথে কাটায় ।  তারপর আবার নিজের ঘরে ফেরত আসে । জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখে এখনো রাজীব আছে কিনা । না রাজীব আর সেখানে নেই । জান্নাতের বুকের ভেতর থেকে একটা ভারি নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। মনটা আবার সিক্ত হয়ে আসে রাজীবের কথা ভেবে । এই যে ও এতক্ষণ মায়ের সাথে কাটিয়ে মন হালকা করে এলো । কিন্তু রাজীবের তেমন কেউ নেই । যার কাছে দুটো কথা বলে মন হালকা করবে । তাই সান্তনার জন্য মায়ের কবরের পাশে বসে কথা বলে গেলো।
 
জান্নাত আর জানালার সামনে দাড়ায় না । ওর এখন একটা অনলাইন ওয়ার্কশপ জয়েন করার কথা । ভিডিও এডিটিং এর কাজ  শিখছে জন্নাত । ওর ইচ্ছে হয়েছে ইউ টিউবে একটা চ্যানেল খোলার । হঠাত জান্নাতের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ।  রাজীব কিছুটা এডিটিং এর কাজ আগে থেকেই জানে । ওর যখন ফটোগ্রাফির সখ ছিলো তখন শিখেছিল । রাজীব কে এই কাজটা অফার করলে কেমন হয় ? জান্নাত নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে । রাজীব তো পার্টটাইম জব করতে আগ্রহী । এই কাজ ই না হয় করলো।তা ছাড়া এই এডিটিং এর কাজ ওর মাথায় ঢুকছে না । সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে ।
 
জান্নাত ঘড়ির দিকে তাকায় , এখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটা , এর মানে রাজীব কিছুক্ষনের মাঝে বেড়িয়ে যাবে । দ্রুত আয়নার সামনে দাড়িয়ে পোশাক ঠিক করে নেয় । তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় ।
 
**** 
 
রাজিব আজকে ক্যাম্পাসে যায়নি  অবশ্য একেবারেই বিনা কারনে সেটা বলা যাবে না । আজকে একটি বিশেষ দিন । নভেম্বর মাসের তেরো তারিখ । প্রতিবছর শীতের আগে আগে এই দিনটা আসে ।
 
এমনিতে গতকাল থেকেই ওর মন ভালো ছিলো না । গত রাতে নিজের সাথে প্রচুর বোঝাপড়া হয়েছে ওর । প্রায় নির্ঘুম কেটেছে রাতটা । তবে সেই নির্ঘুম রাত বৃথা যায়নি । একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পেরেছিলো ও । এবং সকালে সেই সিদ্ধান্ত রানীকে জানাতে পেরে বেশ হলকা লেগেছিলো । এতে রাজীব খুব খুশি হয়েছে , কারন এই বিশেষ দিনে রাজীব কিছুতেই নিজের মন খারাপ রাখতে চায় না ।
 
বাইক ঠিক করে , গোসল করেছে বেশ সময় নিয়ে । সাধারনত রাজীব খুব দ্রুত গোসল সেরে নেয় । কিন্তু আজকে অনেক সময় নিয়ে , খুব ধিরে সুস্থে গায়ে সাবান লাগিয়েছে , তারপর লম্বা সময় শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে ছিলো । রাজীবের কাছে মনে হচ্ছিলো , ওর কোন তাড়া নেই । খুব রিলাক্সড লাগছিলো নিজেকে ।
 
গোসল শেষে রান্না করেছে , আজকে অনেক দিন পর রান্না করলো । নিজের পছন্দের কিছু ডিস রান্না করলো । ওদের বাড়িতে রান্না খুব বেসিক হয় , কারন কারো ই তেমন একটা সময় হয় না রান্না করার । মুখরোচক খাবার গুলো পাশের বাড়ি থেকেই আসে। তবে বিভিন্ন অকেশনে রান্না করতো রাজীব আর রানী মিলে । যেমন রাজীব অথবা রানীর জন্মদিনে , মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে । আজকে ওর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী । রানী হয়তো ভুলে গেছে , কিন্তু রাজীব এর মনে আছে । রাজীব জানে ওর আব্বুর ও মনে আছে । কারন খুব ভোরে রাজীব যখন ছাদে গিয়েছিলো , সেখান থেকে দেখছে হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে রহিম ওর মায়ের কবরের পাশে দাড়িয়ে আছে । দৃশ্যটা রাজীবের কাছে স্বর্গীয় একটা দৃশ্য বলে মনে হয়েছিলো । ভোরের আলোআঁধারিতে ধোঁয়ার মত ভাসতে থাকা কুয়াসার মাঝে ওর আব্বু দাড়িয়ে আছে । দূর থেকেই রাজীব বুঝতে পেরেছিলো ওর আব্বুর শরীরের একটা আঙুল ও নড়ছে না । তবে শরীর অনড় হলেও নিশ্চয়ই ওর আব্বুর মন ছিলো চঞ্চল । নিশ্চয়ই প্রচুর কথা হচ্ছিলো ওর মায়ের সাথে … রাজীব মনে মনে ভেবেছিলো ।
 
রাজীব জানে ওর আব্বু কখনোই ওদের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ওদের মনে করিয়ে দেয় না । যখন ওরা দুজন ছোট ছিলো তখন তো ওই দিনটা ওদের ঘুরতে নিয়ে যেতো । এখন অবশ্য সে সব করে না , তবে মুখ কোনদিন বলে না , যে আজ তোদের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী । রাজীব যখন ছোট ছিলো তখন ওর আব্বুর এমন কাজের পেছনে কি মোটিভ ছিলো তা বুঝতে পারতো না । এখনো যে খুব বোঝে এমন নয় , তবে নিজের মত একটা ধারনা করে নিয়েছে ।
 
তবে রাজীব কোনদিন ওর মায়ের মৃত্যুর দিন ভোলেনা । না ভোলার বিশেষ কারন আছে । রাজীব সব সময় মায়ের মৃত্যুদিনে হাস্খুসি থাকার চেষ্টা করে । যখন বয়স কম ছিলো তখন যে একেবারে কাঁদে নি এমন নয় । তবে হাসিখুসি থাকার চেষ্টা করেছে। রাজীবের কেন জানি মনে হয় , হাসিখুসি থাকলেই ওর আম্মু খুশি হবে । আর  এই হাসি খুশি থাকার অংশ হিসেবেই রাজীব ভালো ভালো রান্না করে ।
 
রান্না শেষে তিনটা বক্সে খাবার ভরে নেয় । গত দু বছর যাবত এই কাজ করেছে রাজীব ।  একটা বাক্স যাবে রাহিম মানে ওর আব্বুর কাছে । অন্য দুটো বাক্সের একটা চৌধুরী বাড়িতে আয়শার কাছে  , আর দ্বিতীয়টা যাবে চৌধুরী ফ্লাওয়ার মিলস এ , বড় আব্বুর কাছে । রাজীব নিজেই দিয়ে আসে ।
 
তিনজন তিন রকম অভিবেক্তি প্রকাশ করে । রাহিম খাবার পেয়ে সুধু একটু মলিন হাসে , আর কয়েক মুহূর্তের জন্য রাজীবের দিকে মমতা আর বেদনা মিশ্রিত একটা দৃষ্টিতে তাকায় ।  এর পর কি করে রহিম সেটা দেখার জন্য অবশ্য রাজীব সেখানে থাকে না । রাজীবের মনে হয় এর চেয়ে বেশিক্ষণ ও ওর আব্বুর সামনে দাঁড়ালে দুজনেই কেঁদে ফেলবে ।
 
জয়নাল ব্যাস্ত মানুষ , তাই এই দিনটির কথা ওর মনে থাকে না । তবে রাজীব কে বাক্স নিয়ে ঢুকতে দেখেই এতক্ষনের কঠিন চেহারাটা নরম হতে শুরু করে । বুঝে যায় আজকে কি দিন । রাজীবের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে ।
 
আর আয়শা রাজীব কে দেখেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না । বেশ কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে বসে থাকে । বসে বসে আফরোজার  গল্প করে , নিজদের ছোট বেলার গল্প করে । এই বিশেষ দিনে , রাজীবের জন্য আয়শার সাথে কাটানো এই সময় টুকু আরো বেশি বিশেষ । এই সময় টুকুর জন্যই রাজীব অপেক্ষা করে থাকে ।
 
তিন জায়গায় খাবার পৌঁছে দিয়ে রাজীব নিজের মায়ের দিকে একমাত্র জীবিত আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করে । রাজীবের এক মামা আছে । সে আফরোজার বিয়ের আগে থেকেই মিডল ইস্টে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে । জীবনে সেই মামা কে মাত্র তিন বার দেখেছে রাজীব । একবার নানার ম্রিতুর সময় , তখন আফরোজা জীবিত ছিলো , আর দ্বিতীয়বার নানির মৃত্যুর সময়, তখন আফরোজার মৃত্যু হয়েছে মাত্র মাস ছয়েক হয়েছে  । আর তৃতীয়বার হঠাত একদিন এসে উপস্থিত হয়েছিলো , তখন রাজীব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে । বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছিলো । রাজীবের মামাতো বোনের বিয়ে । সেই বিয়েতে রাজীব আর রানী গিয়েছিলো । কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি । কেউকেই তেমন চেনে না ওরা , অপরিচিত মানুষদের মাঝে এদিক ওদিক কিছুক্ষন ঘুরে ফিরে চলে এসেছিলো রাজীব আর রানী । ফেরার পথে রানীকে দোকানে বসিয়ে বিরিয়ানি খাইয়ে নিয়ে এসেছিলো।
 
রাজীবের মামা এখনো মধ্য প্রাচ্যে ই থাকে । রাজীবের কল পেয়ে প্রথমে চিনতে পারে না । আসলে বছরে একবার যোগাযোগ থাকলে যা হয় আরকি । রাজীব পরিচয় দিলে , তখন চিনতে পারে । কয়েক মিনিট খাপ ছাড়া কথা হয় । তারপর রাজীবের মামা জানায় এখন সে খুব ব্যাস্ত । তারপর কথা শেষ করার জন্য জিজ্ঞাস করে , রাজীবের কিছু লাগবে কিনা ? অথবা রাজীব মধ্যপ্রাচ্যে আসতে চায় কিনা ? ওনার কাছে ভালো ভিসা আছে । রাজীব কোনভাবে ছয় লক্ষ্য টাকা জোগাড় করতে পারলে উনি নিয়ে যাবেন । নিজের কাছে রাখবেন । ভালো বেতন , প্রায় ৪৫ হাজার টাকা । রাজীব হাসে এবং বলে “ না না মামা আপনার এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না , আপনি দোয়া করবেন সুধু”
 
রাজীবের মামা একটু অবাক ই হয় । তারপর সুধু বলে “ও…… ভালো থাইকো মামা”
 
“ আপনিও ভালো থাকবেন , আমাদের জন্য দোয়া করবেন” এই বলে রাজীব ফোন রেখে দেয় ।  
 
রাজীব জানে ওর মামার ওদের প্রতি তেমন আন্তরিকতা নেই । এটা জেনে বুঝেই কল করে প্রতি বছর। কল করতে ভাল লাগে, বিশেষ করে এই দিনটায় এমন একজনের সাথে কথা বলতে যে কিনা একটি ঔরসে , একি গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে যেই ঔরসে আর গর্ভ থেকে ওর মা জন্ম নিয়েছে । রাজীব এই ভেবে ভালো লাগে যে ওর আম্মু আর ওর মামা দুজনের শরীরে একি রক্ত বইছে , দুজনের ডি এন এ প্রায় একি রকম । ওর মা আর মামা একি মোল্ড থেকে তৈরি দুজন মানুষ ।  
 
মামার সাথে কথা বলার পর রাজীব আজকের দিনের বিশেষ অতিথির জন্য অপেক্ষা করে । রাজীবের বিশ্বাস ওর মা নিজের আত্মা এই মানুষটির মাঝে রেখে গেছে । এটা রাজীব নিজে নিজে ভেবে নেয়নি , ওর মা ই ওকে বলেছে । আর মায়ের কথা রাজীব বিশ্বাস করেছে , এবং এখনো বিশ্বাস করে , ভবিষ্যতেও করবে । পুরো দুনিয়ার প্রাক্টিকাল নলেজ একত্রিত করেও রাজীব কে ওর এই বিশ্বাস থেকে টলাতে পারবে না । সুধু মা বলে গেছে এই জন্য নয় , এই বিশ্বাস রাজীবের মন কে সেই শান্তি দেয় যা আর কোন কিছুই দিতে পারে না । এই বিশ্বাস নিয়ে রাজীব যখন ওই মানুষটির দিকে তাকায় তখন রাজীবের মন প্রশান্তিতে ভরে যায় । যে প্রশান্তি সুধু সন্তান মায়ের দিকে তাকিয়েই পেয়ে থাকে ।   

****
কেউ কথা রাখে না 
আসবো বলেও আসে না। 
কথা রাখে সুধু একাকীত্ব , 
কখনো ছেড়ে যায় না।
[+] 1 user Likes gungchill's post
Like Reply


Messages In This Thread
কিছু সম্পর্ক - by gungchill - 29-07-2025, 04:17 PM
RE: কিছু সম্পর্ক - by gungchill - 08-10-2025, 04:48 PM



Users browsing this thread: 2 Guest(s)