02-10-2025, 06:52 PM
জান্নাত হাসি মুখে কলিং বেল বাজায় , একটু পর সেই দরজা খোলে , যাকে জান্নাত আশা করেছিলো । রাজীব , জান্নাত কে দেখেই হাসে । জান্নাত ও মুচকি হাসে , সুপের বাটি দেখায় । রাজীব দরজা থেকে সরে দাড়ায় , দোতলার দিকে ইশারা করে । কোন কথা বিনিময় হয় না , জান্নাত দোতলায় উঠতে শুরু করে । আর রাজীব সেদিকে তাকিয়ে থাকে ।
যতক্ষণ দেখা জায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে । তারপর রাজীব সোফায় বসে টিভি দেখতে থাকে ।
এর মিনিট খানেক পর , উপর থেকে একটা চিৎকার শুনতে পায় , জান্নাতের গলা “ কি করছিস তুই রানী!!!”
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে রাজীব , ধক করে ওঠে বুকের ভেতর । লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকে , একেক বাড়ে দুটো করে। রানীর ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে রাজীবের চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে । রানী দু হাতে মুখ ঢেকে আছে , পরনে সুধু একটা চেমিসোল আর পা জামা । বাম বাহুতে কনুই থেকে একেবারে উপর পর্যন্ত রক্তে ভেসে যাচ্ছে । রাজীবের পা যেন বরফের মত জমাট বেধে গেছে ।
মিনিট পনেরো পর ,
রানী এখনো কাঁদছে , তবে ওর বাম বাহুতে আর রক্ত নেই । সেখানটা গজ কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো , রাজীব রানীর সামনে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে । জান্নাত রানীর পাশে । ঠিক সেই সময় নিচে দরজা খোলার শব্দ হয় । আর সেই শব্দ পেয়ে রানী চোখ খুলে চায় , চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে কাঁদতে কাঁদতে । রাজীব ও তাকায় রানীর দিকে ।
“ভাইয়া আব্বুকে বলসি না প্লিজ” রানীর চোখে মুখে প্রচণ্ড ভয়ের ছাপ । ওর আব্বু জানলে কি হবে , সেটা ভাবতেই রানীর শরীর হিম হয়ে আসে ।
কিন্তু রাজীবের চেহারাতে প্রচণ্ড রাগ , দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগে ফেটে পরছে ও । চাপা সরে হিসিয়ে ওঠে রাজীব “ কেন বলবো না , বল আমাকে কেনো বলবো না? আব্বুর কি জানার অধিকার নেই ? যে তার মেয়ে কি করছে আজকাল”
রানী দ্রুত রাজীবের হাত ধরে ফেলে , মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তাকায় , ভাইয়ের দিকে , এর আগে এমন ভাবে ক্ষেপে উঠতে রাজীব কে দেখেনি ও, ভয়ে চুপসে যায় রানী , “ আব্বু জানলে আমি আর মুখ দেখাতে পারবো না” রানী হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে
“ তুই মুখ দেখাতে পারবি না , তোর সমস্যা , সব কিছুতেই সুধু তুই আর তুই , আমি আর আব্বু তো তোর কাছে কিছুই না , যদি হতাম তাহলে আজকে এই দৃশ্য দেখতে হতো না” রাজীব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ।
এদিকে জান্নাত নিজেও রাজীবের রাগ দেখে একটু ভড়কে গেছে , তাই এতক্ষণ চুপ ছিলো , কিন্তু দ্রুত কিছু করতে হবে এই একটা তাগিদ ভেতর থেকে উপলব্ধি করে , ছোট আব্বু জানতে পারলে এটা নিয়ে অনেক কিছু হবে । সবাই জেনে যাবে , হয়তো চাপে পরে রানী জয়ের নাম বলে দিবে । আর জয়ের নাম উঠে আসলে কি হতে পারে জান্নাত আর সেটা ভাবতে চায় না ।
জান্নাত রাজীবের কাঁধে হাত রাখে , নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার যথা সম্ভব চেষ্টা করে বলে “ তুই নিচে যা , ছোট আব্বুকে এখনি কিছু বলিস না , আমি কথা বলছি” জান্নাত যতটা সম্ভব কনভেন্সিং ভাবে বলার চেষ্টা করে ।
প্রথম কয়েক মুহূর্ত জান্নাত ভাবে কাজ হয়তো হয় নি , কিন্তু এর পর রাজীবের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে । একবার রাগান্বিত , না ঠিক রাগান্বিত নয় , ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে রানী দিকে তাকিয়ে নিচে চলে যায় ।
রহিম ছেলের থমথমে মুখ দেখে , জিজ্ঞাস করে , “ কিরে কোন সমস্যা”
রাজীব কয়েক মুহূর্ত ভাবে , তারপর বলে “ নাহ তো”
“ওহ তাই, আমি ভাবলাম …” আর কথা বাড়ায় না রহিম , ধিরে ধিরে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যায় ।
রাজীব না চাইলেও রহিমের প্রতি ওর রাগ হয় , বেশ সিরিয়াস ধরনের রাগ । মনে মনে ভাবে এই লোকটার জন্যই আজকে এই অবস্থা । ছেলে না বলল অমনি উনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে জাচ্ছেন । কেন আরো একবার ভালো করে জিজ্ঞাস করলে কি হতো? অন্য বাবা মা রা কেমন জোঁকের মত লেগে থাকে ছেলে মেয়ের পেছনে । আর উনি একবার জিজ্ঞাস করেই খালাস । যেন কোন দ্বায় দায়িত্বই নেই । রাজীব বিড়বিড় করে বলে ‘ সব দায়িত্ব সুধু আমার , আর উনি দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন ‘
বাপের প্রতি অভিমানে , রাজীবের গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নিচে মেঝেতে পরে । এমন নির্দয় , নির্লিপ্ত বাপ ও জীবনেও দেখেনি । নিজের সন্তানদের মনের অবস্থা যে বাপ চোখে দেখে না সে কেমন বাপ । রাজীব ভাবে , এর চেয়ে পুরোপুরি এতীম হলেই ভালো হতো । এমন বাপ থাকার চেয়ে না থাকা ভালো ।
রাজীবের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় , ‘ আব্বু তুমি তোমার মেয়ের ভার নাও , আমি আর পারছি না , আমার নিজের ও জীবন আছে , আমিও স্বাভাবিক জীবন চাই , যেখানে আমি জান্নাতের মত কারো হাত ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনা কোন টেনশনে বসে থাকতে পারবো , আমাকে ভাবতে হবে না আমার ছোট বোন কোন লাফাঙ্গার পাল্লায় পরে গোল্লায় যাচ্ছে নাকি, আমাকে দ্রুত লেখাপড়া শেষ করে চাকরির চিন্তা করতে হবে না , অন্য ছেলেরা যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে ছাত্র জীবন উপভোগ করছে তেমনি আমিও করতে চাই , আব্বু তুমি কি অন্ধ হয়ে গেছো , এসব কি তোমার নজরে পরে না , আর কত স্বার্থপরের মত নিজেকে দূরে রাখবে’
কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে , রাজীব কি ভেবে যেন গর থেকে বেড়িয়ে যায় । নিজের বাইকে উঠে স্টার্ট দেয় । তারপর বিকট শব্দ তুলে বেড়িয়ে যায় , গলিতে থাকা লোকজন রাজীবের বাইকের স্পিড দেখে অবাক হয়ে তাকায় ।
গলির সামনে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো জয় , নিজের কিছু বন্ধুর সাথে , বিকট শব্দে সাঁ করে একটি বাইক বেড়িয়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে তাকায় , ভাবে ওকে ছাড়া এই গলি দিয়ে কে এতো স্পিডে বাইক হাঁকাচ্ছে , “ কোন বাইঞ্চো… “ বলতে গিয়েও থেমে যায় জয় , বাইকের নাম্বার ওর চেনা , বাইকের উপরে সাওয়ার ও ওর চেনা ।
বিড়বিড় করে বলে ‘ শিকদারের ব্যাটা কি কুত্তা খেয়ে পাগল হইসে নাকি?’ ঠোঁটে হাসি টানতে চেয়েও পারে না । মনে একটা অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে । জয়ের আশেপাশের ছেলে গুলোও অবাক হয় , মহল্লার ভালো ছেলে রাজীব প্রচণ্ড গতিতে বাইক হাঁকাচ্ছে এটা ওদের চিন্তার ও অতীত । সবাই জয়ের দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকায় ।
জয় মলিন হেসে বলে “ শালার মরার ইচ্ছে হইসে” তারপর আরো একটু হেসে বলে “ যাক অন্তত কিছু একটা করার তো ইচ্ছা হইসে হা হা হা”
আড্ডা আর আগের মত জমে না। তবুও জয় প্রায় ঘন্টা খানেক সেখানে থাকে । তারপর জয় বাড়ি ফিরে আসে । টেবিলে ওর আম্মু রাতের খাবারের আয়োজন করছে । জয় কে দেখেই আয়শা বলে “ এসেছেন ? আজকাল তো আপনাকে রাত বারোটার আগে বাড়িতেই পাওয়া যায় না , জান হাত মুখ দুয়ে খেতে আসেন”
জয়নাল সোফায় বসে টিভি দেখছে , আলচনায় যোগ দেয়ার কোন ইচ্ছা নেই , মারকাটারি টকশো চলছে টিভিতে ।
জয় মায়ের টিপ্পনির কোন উত্তর না দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায় , কিছুক্ষন পর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসে । তবে ওর মাথার ভেতর এখনো রাজীবের বাইক নিয়ে সাঁ করে চলে যাওয়া ঘুরছে ।
“ জান্নাত কই আম্মু?” খেতে বসে জান্নাত কে না দেখে প্রশ্ন করে জয়
“ রানীর জন্য স্যুপ পাঠিয়েছি “ আয়শা কাজের ফাঁকে উত্তর দেয়
রানীর নাম উচ্চারিত হতেই জয় কিছুক্ষন চুপ থাকে । এই নামটা শুনলেই ওর নানা রকম অনুভূতি অনভুত হয় । একি সাথে অভিমান আর অনুসুচনা এসে ঘিরে ধরে ওকে । জয় আর কোন কথা বলে না , খাওয়া শুরু করে ।
****
রানী জান্নাতের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে , আর জান্নাত অবাক হয়ে বসে আছে । জয় এই ধরনের কাজ করবে সেটা ওর ধারনার বাইরে ছিলো । রানীর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না , আবার রানী মিথ্যা বলবে এটাও মেনে নিতে পারছে না। রানী জয়ের নাম নেয়নি । কিন্তু জান্নাত জানে যে ছেলের কথা রানী বলেছে সেটা জয় ই । অবশ্য জান্নাত রানীকে বুঝতে দেয়নি যে ও জানে ।
রানী এতক্ষণ যাবত যা বলেছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে ; একটা ছেলেকে রানী খুব পছন্দ করে সেই অনেক আগে থেকেই , কিন্তু ছেলেটি ওকে তেমন একটা পাত্তা দিতো না । আর রানী ও সাহস করে কোনদিন কিছু বলেনি । কিন্তু ইদানিং ছেলেটি নানা ভাবে হিন্টস দিতে শুরু করে , এ পর্যন্ত দুজনের একজন ও নিজেদের মনের কথা খুলে বলেনি । কিন্তু ওই ছেলের আচরণে স্পষ্ট বোঝা যায় ছেলেটি রানীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় । মাঝে একবার রানী নানা রকম ভয়ে ছেলেটিকে এড়িয়ে চলতো । কিন্তু ছেলেটি নানা ছুঁতয় না না অসিলায় ওর সাথে কথা বলতো , ধিরে ধিরে রানীর মনের বাধ ভাঙ্গতে শুরু করে । কিন্তু ওই ছেলেটি মাঝে মাঝে এমন কাজ করে তাতে রানীর মনে হয় , ছেলেটি ওকে নিয়ে ঠিক সিরিয়াস নয় । এমনিতেই খেলা করছে ওকে নিয়ে। এই নিয়ে রানী মন কষ্টে ভুগেছে খুব । এরি মাঝে একদিন ছেলেটি রানীর অজান্তে রানীর শরীর স্পর্শ করতে চেয়েছে ( রানী হসপিটালের কথা চেপে গেছে)। এর পর থেকে রানীর নিজের শরীরের প্রতি ঘেন্না জন্মেছে । মাঝে মাঝে নিজের শরীর কে ওর নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় । তখন রানী নিজের শরীরের ক্ষতি করার জন্য বেল্ড দিয়ে কাটে । রানীর মনে বদ্ধ ধারনা জন্মেছে ওই ছেলেটি সুধু ওর শরীর চেয়েছে , ওকে নয় ।
জান্নাত রানীকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছে , যে সম্পর্ক সুধু দুঃখ বয়ে আনে , সেই সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকা ভালো । ওই ছেলে যদি এই ধরনের কাজ করে থাকে , তাহলে এতে রানীর কোন দোষ নেই । রানী কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দেবে । সুধু যে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে এমন নয় । রানী নিজের সাথে সাথে নিজের আশেপাশের মানুষ গুলোকেও কষ্ট দিচ্ছে । রানীর উচিৎ চেই ছেলেকে সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে যাওয়া । নিজেকে নিয়ে ভাবা , নিজের আপনজনদের নিয়ে ভাবা । ওই ছেলেকে নিয়ে ভেবে কেনো রানী নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করবে ।
কিন্তু রানী এসব কিছুই শুনতে চায় না । ওর একটাই কথা , নিজের মাঝে নারী স্বত্বার জন্ম থেকেই রানী ওই ছেলেকেই সুধু ভেবেছে , আর কাউকে কোনদিন কল্পনা করাও ওর পক্ষে সম্ভব নয় । রানী যেখানেই তাকায় সুধু ওই ছেলেকেই দেখে । নিজের জীবনের সাথী হিসেবে আর কাউকে কল্পনা করা রানীর পক্ষে সম্ভব নয় । ওর মন ঐভাবে ট্রেইন্ড নয় । ওর মন ওই একজনেই এটকে গেছে , সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় ।
সেদিন রাতে জয়ের বলা কথা গুলো মনে পরে যায় জান্নাতের , জয় বলেছিলো “ রানী আর ওর মাঝে কেউ বাধা হতে পারবে না, এমন কি জয় নিজেও জয় কে বাধা দিতে পারবে না”
আর এদিকে রানী বলছে জয় কে ছাড়া ও আর কাউকে কল্পনা করতে পারবে না । জান্নাত ভাবে এরা দুজন ই দুজনের জন্য পাগল তাহলে এতো নাটক কেনো ? আর জয় ই বা এমন কাজ কেনো করলো যাতে করে রানীর মনে এমন ধারনা জন্ম নেয়।
বোঝাতে বোঝাতে জান্নাত এক পর্যায়ে রেগে যায় , কঠিন স্বরে বলে “ যা ইচ্ছা তাই কর তুই , আমি আর এর মাঝে নেই , আমি বুঝি না একটা ছেলে তোকে এভাবে অপমান করলো , আর তুই এখনো ওই ছেলের নাম জপে যাচ্ছিস , আমি হলে ওই ছেলেকে ওই মুহূর্তে ছুড়ে ফেলে দিতাম”
রানী এর উত্তরে কিছুই বলে না , ডুকরে ডুকরে কাঁদে সুধু । এতে জান্নাত আরো ক্ষেপে যায় । রানীর কাঁধ ধরে ঝাঁকায় বলে “ তাহলে তুই কি করতে চাস , নিজেকে এভাবে নষ্ট করবি?”
“ না , আমি ওকে চাই , আর কিছুই চাই না” রানী কান্নার মাঝে অস্ফুস্ট স্বরে বলে , তারপর একা একাই বলতে থাকে “ কেন তুমি এমন করেল , তুমি কি বঝো না আমার সব কিছুই তোমার জন্য”
জান্নাত আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না । একবার ইচ্ছে হয় রাজীব কে কল করে সব বলে দেয় । কিন্তু রাগের মাথায় আসা এই চিন্তা নিজেই বাতিল করে দেয় । প্রচণ্ড রাগ নিয়ে রানীর দিকে তাকায় , দাঁতে দাঁত চেপে বলে ।
“ তাহলে যা ওই ছেলের কোলে উঠে বসে থাক গে , আর যাওয়ার আগে ছোট আব্বুকে , রাজীব কে বলে যা তোকে নিয়ে যেন আর না ভাবে, সুধু সুধু ওদের কেন বিরম্বনা দিচ্ছিস”
রানী এবার সোজা হয়ে বসে , দু হাতে চোখের পানি মোছে , তারপর শক্ত গলায় বলে “ আমার জন্য কারো দুঃখ হোক আমি চাই না , আমিই চলে যাবো দূরে , আম্মু যেমন চলে গেছে “
“ বাহ বাহ “ হাত তালি দিয়ে ওঠে জান্নাত , “ তাহলে যাওয়ার আগে ছোট আব্বুর এই ১৮ বছর ফিরিয়ে দিয়ে যা , রাজীবের কথা না হয় বাদ ই দিলাম , আমরা তো আরো দুরের , তোর জন্য সুধু ওই ছেলেই বড় হয়ে গেলো”
জান্নাতের কথা শুনে রানী আবার কাঁদতে শুরু করে । জান্নাত একটু শান্ত হয় , বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয় । তারপর রানীর পাশে বসে , নরম স্বরে বলে “ রানী বোন আমার , আমার কথা শোন , আমার মনে হয় তোদের মাঝে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে , প্রথমে তুই শক্ত হ , তারপর ওই ছেলের সাথে খলাখুলি কথা বল , প্রয়োজনে আমি তোর সাথে থাকবো”
জান্নাতের কথা শুনে রানী কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে । ওর মনে আরো একটি ভয়ের উদয় হয় । রানী ভাবে , যদি সত্যি সত্য ও জয় কে ভুল বুঝে থাকে , তাহলে বিনা অপরাধে জয় কে এতো বড় অপবাদ দেয়ার পর কিভাবে জয় কে মুখ দেখাবে । রানী চোখে সেদিনের দৃশ্য আবার ভেসে ওঠে । ও সন্দেহের দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো , আর জয়ের চোখে মুখে ছিলো ভয় । হ্যা জয় ভয় পেয়েছিলো । জয় কেন ভয় পেলো , রানী ভাবে । আর জয় হাত বাড়িয়ে ওকে কি বলতে চেয়েছিলো ? আর জয়ের সেই ফ্রাস্টেশন , সেটা কি কারনে , নিশ্চয়ই জয়েকে নিয়ে ওর মনে ভুল ধারনার কারনে এই জয় অনম করেছিলো । রানী যতই ভাবে ততই ভয় কুঁকড়ে ওঠে । না বুঝে এতো বড় একটা অপবাদ ও জয় কে দিয়েছে । এখন ও কি করবে ? জয় কি ওকে মাফ করবে ।
অস্থির হয়ে ওঠে রানীর মন , রানীর কাছে মনে হয় ও শ্বাস নিতে পারছে না । বার বার নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয় । কেন এতদিন ওর মাথায় এলো না , যে ব্যাপারটা একটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে । কেন জয়কে অবিশ্বাস করলো ও ।
জয়ের বলা শেষ কথা গুলো মনে পরে যায় , “ হ্যা আমি খারাপ ছেলে ………” রানী আর ভাবতে পারে না , দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠে । কতটা দুঃখ পেলে জয় ওই কথা গুলো বলেছে।
“ কি হলো আবার কাঁদছিস কেনো? আমি বললাম তো এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে । আর আমি তোকে হেল্প করবো ওই ছেলের সাথে কথা বলতে ” জান্নাত রানী কে আবার কাঁদতে দেখে একটু অবাক হয়েই বলে ।
রানী কাঁদতে কাঁদতেই বলে “ যদি সত্যি সত্যি ভুল বুঝে থাকি আমি , তাহলে কি হবে?”
“ কি হবে আবার , লায়লা মজনুর মিলন হবে , তুই তোর সখের পুরুষের গলায় ঝুলে থাকবি” জান্নাত একটু হাসতে হাসতে বলে
“ না না আমি ওর সামনে দাড়াতে পারবো না , কত বড় মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি , আমি মুখ দেখাবো কি করে” এই বলে রানী আবার কাঁদতে শুরু করতেই , জান্নাত রানীর মুখ চেপে ধরে , বলে “ খবরদার একদম কাদবি না , কাঁদলে আমি তোর ওই ছেলেকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো , আর মুখ দেখাতে না মারলে মাস্ক পরে যাস , এখন থাম আমার মা”
“ শোন , নিজেকে স্থির কর , তারপর সামনে গিয়ে দাড়া , সোজা প্রশ্ন কর , প্রয়োজনে আমি থাকবো, তুই নিজেকে কখনো একা ভাব্বি না , জানিস সবাই তোকে নিয়ে কত চিন্তায় আছে “
রানী ধিরে ধিরে একটু শান্ত হয় , তারপর জান্নাত কে জড়িয়ে ধরে ।
জান্নাত রানীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে “ তুই এতো চোখের পানি কথায় পাসরে ,আমাকে একটু ঠিকানা দিবি , যদি কোনদিন লাগে কিনে আনবো”
জান্নাতের কথা শুনে রানীও এই দুঃখের মাঝে হেসে ওঠে ।
জান্নাত মনে মনে ভাবে , এই ভুল বোঝাবুঝি কথাটা আগে কেন মাথায় এলো না । তাহলে আর এতো ঝামেলা হতো না । রানী তো এই কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলো ।
বেশ কিছুক্ষন পর জান্নাত প্রশ্ন করে “ রাতের খাবারের কি অবস্থা?”
আর তখনি রানীর হুঁশ হয় , বলে “ এখন তো ভাইয়া রান্না করে , আমি জানি না”
“ দাড়া আমি দেখছি “ এই বলে জান্নাত উঠে যায় । রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কিছুই রান্না হয়নি । জান্নাত ভাবে তাহলে এখন ছোট আব্বু কি খাবে ? আর কি জবাব দেবে রান্না না হওয়ার । জান্নাত রাজীব কে খোঁজে , কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না । রাজীবের মোবাইলে কল করে , কিন্তু সেটাও নিরুত্তর ।
জান্নাত ভেবে পায় না কি করবে ? আসলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোন দিন পরতে হয়নি । পরিবারের মানুষ কি খাবে সেটা ওর চিন্তার বিষয় নয় । তাই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে অথৈ সাগরে পরে জান্নাত । একবার ভাবে মা কে গিয়ে বলবে , মা কোন না কোন বেবস্থা করে দেবে । কিন্তু সেই চিন্তাও বাদ দেয় । নানা ধরনের প্রশ্ন উঠবে । জান্নাত আবার কল করে রাজীব কে , কিন্তু এবারো রাজীব কল রিসিভ করে না । রাজীব কে নিয়েও চিন্তা হয় ।
কিছুক্ষন নখ কামড়ানোর পর হঠাত জান্নাতের মাথায় বুদ্ধি আসে । দ্রুত উপরে উঠে রানীর কাছে যায় । জিজ্ঞাস করে রানীর কাছে টাকা আছে কিনা । রানী জান্নাতের টাকা চাওয়া দেখে একটু অবাক হলেও নিজের কাছে থাকা কিছু টাকা বের করে দেয়। জান্নাত সেই টাকা নিয়ে দ্রুত গলির মাথায় গিয়ে খাবার কিনে নিয়ে আসে ।
****
রাজীব অনেকক্ষণ বাইক চালিয়ে একটা নির্জন জায়গায় পেয়ে সেখানে বসে থাকে । প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে ওর , সব অভিমান নিজের বাপ আর মৃত মায়ের উপর । কেনো ওরা ওকে এই ধরনের পরস্থিতি তে ফেলে দিলো । বার বার এই প্রস্নই করেছে একা একা । ওরা কি বোঝে না , ও একটা মানুষ , যার কিছু সখ আহ্লাদ আছে , আর কতদিন বাপ মায়ের দায়িত্ব ওকে বহন করতে হবে। ওর কি এই বয়সে ছোট বোনের জন্য চিন্তা করার কথা ?
বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে জান্নাতের সাথে কাটানো এই কয়দিনের সৃতি গুলো । রাজীব ভাবে ওর কি এই ধরনের জীবন কাটানোর অধিকার নেই ? মনে মনে বাবা মায়ের কাছে জবাব চায় । কিন্তু রাজীব চাইলেও সেরকম কিছু করতে পারছে না । ওর জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্চে রানীর পেছনে । আর কতদিন এভাবে চলবে , রাজীবের ইচ্ছে হয় সব কিছু ছেরেছুরে কোথাও চলে যায় ।
নিজের বাবা মা কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় ও রানীর বাবা কিনবা মা নয় , রানীকে ও জন্ম দেয়নি । তাহলে কেন রানীর দায়িত্ব ওর নিতে হবে । কেন ও আর দশটা ছেলের মত নিজের জীবন চালাতে পারবে না । কেন জান্নত কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারবে না । বার বার পারিবারিক বাধা এসে দাঁড়াবে ওর সামনে ।
তাও যদি সফল ভাবে রানীর দেখাশোনা করতে পারতো , সেটাও হচ্ছে না ওকে দিয়ে । মাত্র কয়েক দিন জান্নাতের প্রতি কিছুটা মনযোগী হয়েছে , আর তাতেই সব কিছু অগোছালো হয়ে গেছে । কত দিন যাবত এই ধরনের কাজ করছে রানী কে জানে। ওর নাকের ডগায় বসে রানী এসব করছে আর ও টের পায়নি । এছাড়া কোন ধরনের নেশা ধরেছে কিনা সেটাও দেখতে হবে । রাজীব শুনেছে এভাবে কাঁটা ছেরা নাকি নেশা গ্রস্থ ছেলে মেয়েরা করে থাকে । ভার্সিটি তে নেশার বড় রেকেট আছে বলে রাজীব জানে । ভালো ভালো ছেলে মেয়েরা এই নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে । রানীও কি জড়িয়ে গেছে কিনা কে জানে ।
এসব ভাবতে ভাবতে রাজীবের নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে । জীবনটা ধিরে ধিরে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে । কতদিন এই বিষাক্ত জীবনের ভার বহন করতে পারবে সেটা রাজীবের কাছে পরিস্কার নয় । রাজীব নিজের ভাগ্য নিয়ে অনেকক্ষণ নিজের সাথেই যুদ্ধ করে , ভাবে ও চাইলেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে । সুধু এতটুকুই করতে হবে যে , কেউকে নিয়ে না ভেবে সুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে । যেমন জয় সুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে , রানী যেমন নিজেকে নিয়ে ভাবে তেমন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজীব পরাজিত হয় , মেনে নেয় পরাজয় ই ওর ভাগ্য । জয় যেমন ওকে লুজার বলে , আসলেই ও লুজার । রাজীব ফিরতি পথ ধরে , ভবেছিলো আজকে বাসায় ফিরবে না । কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে না। নিজের ভাগ্য কে মেনে নিয়ে ফিরে আসে বাসায় । ও চাইলেও নির্লিপ্ত ভাবে থাকতে পারবে না , এটা ওর ভাগ্যের লিখন ।
রাজীব যখন বাসায় ঢোকে তখন জান্নাত টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে । রাজীব কে দেখে জান্নাত মিস্টি করে হাসে , ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাস করে কোথায় ছিলো ও । কিন্তু রাজীব হাসতে পারে না , ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চায় । ভাবে এতো সুন্দর একটা দৃশ্য প্রতিদিন দেখার সৌভাগ্য ওর কোনদিন ও হবে না । জান্নাত হয়তো এভাবেই টেবিলে খাবার সাজাবে , কিন্তু সেটা ওর জন্য নয় , অন্য কারো জন্য । কারন ওর মত লুজারের জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না । সব দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করে রাজীব যখন প্রস্তুত হবে , তখন জান্নাত হয়তো অনেক দূর চলে যাবে । ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
রাজীব জিজ্ঞাস করে “ খাবার এলো কিভাবে”
“ উড়ে এসেছে , তুই কোথায় ছিলি , কেউ একজন ঠিক ই বলেছে , শিকদার বাড়ির সব কটা একেকটা চিড়িয়া , বলা নেই কওয়া নেই হাওয়া হয়ে গেলি” জান্নাত হালকা ঝাঁজের সাথে বলে ।
রাজীব উত্তরে কিছু বলে না , তবে মনে মনে বলে ‘ আরো কিছু বল প্লিজ , শুনতে ভালো লাগছে’
কিছুক্ষন পর রানী আর রহিম নিচে নেমে আসে , জান্নাত কে টেবিল সাজাতে দেখে রহিম খুশি হয়ে বলে “ একদম আমার মায়ের মত হয়েছে রে , বেঁচে থাকো মা , অনেক কষ্ট করলি আজকে”
“ কি কষ্ট করলাম , নিজে তো আর রাধি নি , দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছি , এটা যে কেউ করতে পারে “ জান্নাত হেসে বলে , ওর কাছে নিজেকে কেমন জানি বউ বউ লাগছে ।
“ কিন্তু যেভাবে সাজিয়েছিস , খাবার গুলো আর দোকানের মত লাগছে না রে , আমার মায়ের হাতে ছোঁয়া পেয়ে ঘরের খাবার হয়ে গেছে” জান্নাত যখন রহিমের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলো তখন রহিম এ কথা বলে ।
জান্নাতের একটু লজ্জা লজ্জা লাগে , জান্নাত কোনদিন ভাবেনি এভাবে কোনদিন খাবার পরিবেশন করবে ও । তবে করতে খারাপ লাগছে না । মনে হচ্ছে ও শিকদার পরিবারের অংশ হয়ে নিজেও চিড়িয়া হয়ে গেছে ।
জান্নাত নিজেও খেতে বসে , টুকটাক যা কথা হয় , তা জান্নাত আর রহিমের মাঝেই হয় । রানী একদম মাথা নিচু করে চোরের মত খেতে থাকে । আর রাজীব খেতে খেতে মন ভরে জান্নাত কে দেখে নেয় । কারন ও শিওর এই দৃশ্য আর দেখা হবে না ওর ।
*****
যতক্ষণ দেখা জায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকে । তারপর রাজীব সোফায় বসে টিভি দেখতে থাকে ।
এর মিনিট খানেক পর , উপর থেকে একটা চিৎকার শুনতে পায় , জান্নাতের গলা “ কি করছিস তুই রানী!!!”
তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে রাজীব , ধক করে ওঠে বুকের ভেতর । লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে থাকে , একেক বাড়ে দুটো করে। রানীর ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে রাজীবের চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে । রানী দু হাতে মুখ ঢেকে আছে , পরনে সুধু একটা চেমিসোল আর পা জামা । বাম বাহুতে কনুই থেকে একেবারে উপর পর্যন্ত রক্তে ভেসে যাচ্ছে । রাজীবের পা যেন বরফের মত জমাট বেধে গেছে ।
মিনিট পনেরো পর ,
রানী এখনো কাঁদছে , তবে ওর বাম বাহুতে আর রক্ত নেই । সেখানটা গজ কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো , রাজীব রানীর সামনে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে । জান্নাত রানীর পাশে । ঠিক সেই সময় নিচে দরজা খোলার শব্দ হয় । আর সেই শব্দ পেয়ে রানী চোখ খুলে চায় , চোখ দুটো লালচে হয়ে উঠেছে কাঁদতে কাঁদতে । রাজীব ও তাকায় রানীর দিকে ।
“ভাইয়া আব্বুকে বলসি না প্লিজ” রানীর চোখে মুখে প্রচণ্ড ভয়ের ছাপ । ওর আব্বু জানলে কি হবে , সেটা ভাবতেই রানীর শরীর হিম হয়ে আসে ।
কিন্তু রাজীবের চেহারাতে প্রচণ্ড রাগ , দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগে ফেটে পরছে ও । চাপা সরে হিসিয়ে ওঠে রাজীব “ কেন বলবো না , বল আমাকে কেনো বলবো না? আব্বুর কি জানার অধিকার নেই ? যে তার মেয়ে কি করছে আজকাল”
রানী দ্রুত রাজীবের হাত ধরে ফেলে , মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তাকায় , ভাইয়ের দিকে , এর আগে এমন ভাবে ক্ষেপে উঠতে রাজীব কে দেখেনি ও, ভয়ে চুপসে যায় রানী , “ আব্বু জানলে আমি আর মুখ দেখাতে পারবো না” রানী হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে
“ তুই মুখ দেখাতে পারবি না , তোর সমস্যা , সব কিছুতেই সুধু তুই আর তুই , আমি আর আব্বু তো তোর কাছে কিছুই না , যদি হতাম তাহলে আজকে এই দৃশ্য দেখতে হতো না” রাজীব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ।
এদিকে জান্নাত নিজেও রাজীবের রাগ দেখে একটু ভড়কে গেছে , তাই এতক্ষণ চুপ ছিলো , কিন্তু দ্রুত কিছু করতে হবে এই একটা তাগিদ ভেতর থেকে উপলব্ধি করে , ছোট আব্বু জানতে পারলে এটা নিয়ে অনেক কিছু হবে । সবাই জেনে যাবে , হয়তো চাপে পরে রানী জয়ের নাম বলে দিবে । আর জয়ের নাম উঠে আসলে কি হতে পারে জান্নাত আর সেটা ভাবতে চায় না ।
জান্নাত রাজীবের কাঁধে হাত রাখে , নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার যথা সম্ভব চেষ্টা করে বলে “ তুই নিচে যা , ছোট আব্বুকে এখনি কিছু বলিস না , আমি কথা বলছি” জান্নাত যতটা সম্ভব কনভেন্সিং ভাবে বলার চেষ্টা করে ।
প্রথম কয়েক মুহূর্ত জান্নাত ভাবে কাজ হয়তো হয় নি , কিন্তু এর পর রাজীবের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে । একবার রাগান্বিত , না ঠিক রাগান্বিত নয় , ব্যাথা ভরা দৃষ্টিতে রানী দিকে তাকিয়ে নিচে চলে যায় ।
রহিম ছেলের থমথমে মুখ দেখে , জিজ্ঞাস করে , “ কিরে কোন সমস্যা”
রাজীব কয়েক মুহূর্ত ভাবে , তারপর বলে “ নাহ তো”
“ওহ তাই, আমি ভাবলাম …” আর কথা বাড়ায় না রহিম , ধিরে ধিরে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যায় ।
রাজীব না চাইলেও রহিমের প্রতি ওর রাগ হয় , বেশ সিরিয়াস ধরনের রাগ । মনে মনে ভাবে এই লোকটার জন্যই আজকে এই অবস্থা । ছেলে না বলল অমনি উনি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে জাচ্ছেন । কেন আরো একবার ভালো করে জিজ্ঞাস করলে কি হতো? অন্য বাবা মা রা কেমন জোঁকের মত লেগে থাকে ছেলে মেয়ের পেছনে । আর উনি একবার জিজ্ঞাস করেই খালাস । যেন কোন দ্বায় দায়িত্বই নেই । রাজীব বিড়বিড় করে বলে ‘ সব দায়িত্ব সুধু আমার , আর উনি দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন ‘
বাপের প্রতি অভিমানে , রাজীবের গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নিচে মেঝেতে পরে । এমন নির্দয় , নির্লিপ্ত বাপ ও জীবনেও দেখেনি । নিজের সন্তানদের মনের অবস্থা যে বাপ চোখে দেখে না সে কেমন বাপ । রাজীব ভাবে , এর চেয়ে পুরোপুরি এতীম হলেই ভালো হতো । এমন বাপ থাকার চেয়ে না থাকা ভালো ।
রাজীবের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় , ‘ আব্বু তুমি তোমার মেয়ের ভার নাও , আমি আর পারছি না , আমার নিজের ও জীবন আছে , আমিও স্বাভাবিক জীবন চাই , যেখানে আমি জান্নাতের মত কারো হাত ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনা কোন টেনশনে বসে থাকতে পারবো , আমাকে ভাবতে হবে না আমার ছোট বোন কোন লাফাঙ্গার পাল্লায় পরে গোল্লায় যাচ্ছে নাকি, আমাকে দ্রুত লেখাপড়া শেষ করে চাকরির চিন্তা করতে হবে না , অন্য ছেলেরা যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে ছাত্র জীবন উপভোগ করছে তেমনি আমিও করতে চাই , আব্বু তুমি কি অন্ধ হয়ে গেছো , এসব কি তোমার নজরে পরে না , আর কত স্বার্থপরের মত নিজেকে দূরে রাখবে’
কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে , রাজীব কি ভেবে যেন গর থেকে বেড়িয়ে যায় । নিজের বাইকে উঠে স্টার্ট দেয় । তারপর বিকট শব্দ তুলে বেড়িয়ে যায় , গলিতে থাকা লোকজন রাজীবের বাইকের স্পিড দেখে অবাক হয়ে তাকায় ।
গলির সামনে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো জয় , নিজের কিছু বন্ধুর সাথে , বিকট শব্দে সাঁ করে একটি বাইক বেড়িয়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে তাকায় , ভাবে ওকে ছাড়া এই গলি দিয়ে কে এতো স্পিডে বাইক হাঁকাচ্ছে , “ কোন বাইঞ্চো… “ বলতে গিয়েও থেমে যায় জয় , বাইকের নাম্বার ওর চেনা , বাইকের উপরে সাওয়ার ও ওর চেনা ।
বিড়বিড় করে বলে ‘ শিকদারের ব্যাটা কি কুত্তা খেয়ে পাগল হইসে নাকি?’ ঠোঁটে হাসি টানতে চেয়েও পারে না । মনে একটা অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে । জয়ের আশেপাশের ছেলে গুলোও অবাক হয় , মহল্লার ভালো ছেলে রাজীব প্রচণ্ড গতিতে বাইক হাঁকাচ্ছে এটা ওদের চিন্তার ও অতীত । সবাই জয়ের দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকায় ।
জয় মলিন হেসে বলে “ শালার মরার ইচ্ছে হইসে” তারপর আরো একটু হেসে বলে “ যাক অন্তত কিছু একটা করার তো ইচ্ছা হইসে হা হা হা”
আড্ডা আর আগের মত জমে না। তবুও জয় প্রায় ঘন্টা খানেক সেখানে থাকে । তারপর জয় বাড়ি ফিরে আসে । টেবিলে ওর আম্মু রাতের খাবারের আয়োজন করছে । জয় কে দেখেই আয়শা বলে “ এসেছেন ? আজকাল তো আপনাকে রাত বারোটার আগে বাড়িতেই পাওয়া যায় না , জান হাত মুখ দুয়ে খেতে আসেন”
জয়নাল সোফায় বসে টিভি দেখছে , আলচনায় যোগ দেয়ার কোন ইচ্ছা নেই , মারকাটারি টকশো চলছে টিভিতে ।
জয় মায়ের টিপ্পনির কোন উত্তর না দিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায় , কিছুক্ষন পর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসে । তবে ওর মাথার ভেতর এখনো রাজীবের বাইক নিয়ে সাঁ করে চলে যাওয়া ঘুরছে ।
“ জান্নাত কই আম্মু?” খেতে বসে জান্নাত কে না দেখে প্রশ্ন করে জয়
“ রানীর জন্য স্যুপ পাঠিয়েছি “ আয়শা কাজের ফাঁকে উত্তর দেয়
রানীর নাম উচ্চারিত হতেই জয় কিছুক্ষন চুপ থাকে । এই নামটা শুনলেই ওর নানা রকম অনুভূতি অনভুত হয় । একি সাথে অভিমান আর অনুসুচনা এসে ঘিরে ধরে ওকে । জয় আর কোন কথা বলে না , খাওয়া শুরু করে ।
****
রানী জান্নাতের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে , আর জান্নাত অবাক হয়ে বসে আছে । জয় এই ধরনের কাজ করবে সেটা ওর ধারনার বাইরে ছিলো । রানীর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না , আবার রানী মিথ্যা বলবে এটাও মেনে নিতে পারছে না। রানী জয়ের নাম নেয়নি । কিন্তু জান্নাত জানে যে ছেলের কথা রানী বলেছে সেটা জয় ই । অবশ্য জান্নাত রানীকে বুঝতে দেয়নি যে ও জানে ।
রানী এতক্ষণ যাবত যা বলেছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে ; একটা ছেলেকে রানী খুব পছন্দ করে সেই অনেক আগে থেকেই , কিন্তু ছেলেটি ওকে তেমন একটা পাত্তা দিতো না । আর রানী ও সাহস করে কোনদিন কিছু বলেনি । কিন্তু ইদানিং ছেলেটি নানা ভাবে হিন্টস দিতে শুরু করে , এ পর্যন্ত দুজনের একজন ও নিজেদের মনের কথা খুলে বলেনি । কিন্তু ওই ছেলের আচরণে স্পষ্ট বোঝা যায় ছেলেটি রানীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় । মাঝে একবার রানী নানা রকম ভয়ে ছেলেটিকে এড়িয়ে চলতো । কিন্তু ছেলেটি নানা ছুঁতয় না না অসিলায় ওর সাথে কথা বলতো , ধিরে ধিরে রানীর মনের বাধ ভাঙ্গতে শুরু করে । কিন্তু ওই ছেলেটি মাঝে মাঝে এমন কাজ করে তাতে রানীর মনে হয় , ছেলেটি ওকে নিয়ে ঠিক সিরিয়াস নয় । এমনিতেই খেলা করছে ওকে নিয়ে। এই নিয়ে রানী মন কষ্টে ভুগেছে খুব । এরি মাঝে একদিন ছেলেটি রানীর অজান্তে রানীর শরীর স্পর্শ করতে চেয়েছে ( রানী হসপিটালের কথা চেপে গেছে)। এর পর থেকে রানীর নিজের শরীরের প্রতি ঘেন্না জন্মেছে । মাঝে মাঝে নিজের শরীর কে ওর নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় । তখন রানী নিজের শরীরের ক্ষতি করার জন্য বেল্ড দিয়ে কাটে । রানীর মনে বদ্ধ ধারনা জন্মেছে ওই ছেলেটি সুধু ওর শরীর চেয়েছে , ওকে নয় ।
জান্নাত রানীকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছে , যে সম্পর্ক সুধু দুঃখ বয়ে আনে , সেই সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকা ভালো । ওই ছেলে যদি এই ধরনের কাজ করে থাকে , তাহলে এতে রানীর কোন দোষ নেই । রানী কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দেবে । সুধু যে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে এমন নয় । রানী নিজের সাথে সাথে নিজের আশেপাশের মানুষ গুলোকেও কষ্ট দিচ্ছে । রানীর উচিৎ চেই ছেলেকে সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে যাওয়া । নিজেকে নিয়ে ভাবা , নিজের আপনজনদের নিয়ে ভাবা । ওই ছেলেকে নিয়ে ভেবে কেনো রানী নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করবে ।
কিন্তু রানী এসব কিছুই শুনতে চায় না । ওর একটাই কথা , নিজের মাঝে নারী স্বত্বার জন্ম থেকেই রানী ওই ছেলেকেই সুধু ভেবেছে , আর কাউকে কোনদিন কল্পনা করাও ওর পক্ষে সম্ভব নয় । রানী যেখানেই তাকায় সুধু ওই ছেলেকেই দেখে । নিজের জীবনের সাথী হিসেবে আর কাউকে কল্পনা করা রানীর পক্ষে সম্ভব নয় । ওর মন ঐভাবে ট্রেইন্ড নয় । ওর মন ওই একজনেই এটকে গেছে , সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় ।
সেদিন রাতে জয়ের বলা কথা গুলো মনে পরে যায় জান্নাতের , জয় বলেছিলো “ রানী আর ওর মাঝে কেউ বাধা হতে পারবে না, এমন কি জয় নিজেও জয় কে বাধা দিতে পারবে না”
আর এদিকে রানী বলছে জয় কে ছাড়া ও আর কাউকে কল্পনা করতে পারবে না । জান্নাত ভাবে এরা দুজন ই দুজনের জন্য পাগল তাহলে এতো নাটক কেনো ? আর জয় ই বা এমন কাজ কেনো করলো যাতে করে রানীর মনে এমন ধারনা জন্ম নেয়।
বোঝাতে বোঝাতে জান্নাত এক পর্যায়ে রেগে যায় , কঠিন স্বরে বলে “ যা ইচ্ছা তাই কর তুই , আমি আর এর মাঝে নেই , আমি বুঝি না একটা ছেলে তোকে এভাবে অপমান করলো , আর তুই এখনো ওই ছেলের নাম জপে যাচ্ছিস , আমি হলে ওই ছেলেকে ওই মুহূর্তে ছুড়ে ফেলে দিতাম”
রানী এর উত্তরে কিছুই বলে না , ডুকরে ডুকরে কাঁদে সুধু । এতে জান্নাত আরো ক্ষেপে যায় । রানীর কাঁধ ধরে ঝাঁকায় বলে “ তাহলে তুই কি করতে চাস , নিজেকে এভাবে নষ্ট করবি?”
“ না , আমি ওকে চাই , আর কিছুই চাই না” রানী কান্নার মাঝে অস্ফুস্ট স্বরে বলে , তারপর একা একাই বলতে থাকে “ কেন তুমি এমন করেল , তুমি কি বঝো না আমার সব কিছুই তোমার জন্য”
জান্নাত আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না । একবার ইচ্ছে হয় রাজীব কে কল করে সব বলে দেয় । কিন্তু রাগের মাথায় আসা এই চিন্তা নিজেই বাতিল করে দেয় । প্রচণ্ড রাগ নিয়ে রানীর দিকে তাকায় , দাঁতে দাঁত চেপে বলে ।
“ তাহলে যা ওই ছেলের কোলে উঠে বসে থাক গে , আর যাওয়ার আগে ছোট আব্বুকে , রাজীব কে বলে যা তোকে নিয়ে যেন আর না ভাবে, সুধু সুধু ওদের কেন বিরম্বনা দিচ্ছিস”
রানী এবার সোজা হয়ে বসে , দু হাতে চোখের পানি মোছে , তারপর শক্ত গলায় বলে “ আমার জন্য কারো দুঃখ হোক আমি চাই না , আমিই চলে যাবো দূরে , আম্মু যেমন চলে গেছে “
“ বাহ বাহ “ হাত তালি দিয়ে ওঠে জান্নাত , “ তাহলে যাওয়ার আগে ছোট আব্বুর এই ১৮ বছর ফিরিয়ে দিয়ে যা , রাজীবের কথা না হয় বাদ ই দিলাম , আমরা তো আরো দুরের , তোর জন্য সুধু ওই ছেলেই বড় হয়ে গেলো”
জান্নাতের কথা শুনে রানী আবার কাঁদতে শুরু করে । জান্নাত একটু শান্ত হয় , বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয় । তারপর রানীর পাশে বসে , নরম স্বরে বলে “ রানী বোন আমার , আমার কথা শোন , আমার মনে হয় তোদের মাঝে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে , প্রথমে তুই শক্ত হ , তারপর ওই ছেলের সাথে খলাখুলি কথা বল , প্রয়োজনে আমি তোর সাথে থাকবো”
জান্নাতের কথা শুনে রানী কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে । ওর মনে আরো একটি ভয়ের উদয় হয় । রানী ভাবে , যদি সত্যি সত্য ও জয় কে ভুল বুঝে থাকে , তাহলে বিনা অপরাধে জয় কে এতো বড় অপবাদ দেয়ার পর কিভাবে জয় কে মুখ দেখাবে । রানী চোখে সেদিনের দৃশ্য আবার ভেসে ওঠে । ও সন্দেহের দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো , আর জয়ের চোখে মুখে ছিলো ভয় । হ্যা জয় ভয় পেয়েছিলো । জয় কেন ভয় পেলো , রানী ভাবে । আর জয় হাত বাড়িয়ে ওকে কি বলতে চেয়েছিলো ? আর জয়ের সেই ফ্রাস্টেশন , সেটা কি কারনে , নিশ্চয়ই জয়েকে নিয়ে ওর মনে ভুল ধারনার কারনে এই জয় অনম করেছিলো । রানী যতই ভাবে ততই ভয় কুঁকড়ে ওঠে । না বুঝে এতো বড় একটা অপবাদ ও জয় কে দিয়েছে । এখন ও কি করবে ? জয় কি ওকে মাফ করবে ।
অস্থির হয়ে ওঠে রানীর মন , রানীর কাছে মনে হয় ও শ্বাস নিতে পারছে না । বার বার নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হয় । কেন এতদিন ওর মাথায় এলো না , যে ব্যাপারটা একটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে । কেন জয়কে অবিশ্বাস করলো ও ।
জয়ের বলা শেষ কথা গুলো মনে পরে যায় , “ হ্যা আমি খারাপ ছেলে ………” রানী আর ভাবতে পারে না , দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠে । কতটা দুঃখ পেলে জয় ওই কথা গুলো বলেছে।
“ কি হলো আবার কাঁদছিস কেনো? আমি বললাম তো এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে । আর আমি তোকে হেল্প করবো ওই ছেলের সাথে কথা বলতে ” জান্নাত রানী কে আবার কাঁদতে দেখে একটু অবাক হয়েই বলে ।
রানী কাঁদতে কাঁদতেই বলে “ যদি সত্যি সত্যি ভুল বুঝে থাকি আমি , তাহলে কি হবে?”
“ কি হবে আবার , লায়লা মজনুর মিলন হবে , তুই তোর সখের পুরুষের গলায় ঝুলে থাকবি” জান্নাত একটু হাসতে হাসতে বলে
“ না না আমি ওর সামনে দাড়াতে পারবো না , কত বড় মিথ্যা অপবাদ দিয়েছি , আমি মুখ দেখাবো কি করে” এই বলে রানী আবার কাঁদতে শুরু করতেই , জান্নাত রানীর মুখ চেপে ধরে , বলে “ খবরদার একদম কাদবি না , কাঁদলে আমি তোর ওই ছেলেকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো , আর মুখ দেখাতে না মারলে মাস্ক পরে যাস , এখন থাম আমার মা”
“ শোন , নিজেকে স্থির কর , তারপর সামনে গিয়ে দাড়া , সোজা প্রশ্ন কর , প্রয়োজনে আমি থাকবো, তুই নিজেকে কখনো একা ভাব্বি না , জানিস সবাই তোকে নিয়ে কত চিন্তায় আছে “
রানী ধিরে ধিরে একটু শান্ত হয় , তারপর জান্নাত কে জড়িয়ে ধরে ।
জান্নাত রানীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে “ তুই এতো চোখের পানি কথায় পাসরে ,আমাকে একটু ঠিকানা দিবি , যদি কোনদিন লাগে কিনে আনবো”
জান্নাতের কথা শুনে রানীও এই দুঃখের মাঝে হেসে ওঠে ।
জান্নাত মনে মনে ভাবে , এই ভুল বোঝাবুঝি কথাটা আগে কেন মাথায় এলো না । তাহলে আর এতো ঝামেলা হতো না । রানী তো এই কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলো ।
বেশ কিছুক্ষন পর জান্নাত প্রশ্ন করে “ রাতের খাবারের কি অবস্থা?”
আর তখনি রানীর হুঁশ হয় , বলে “ এখন তো ভাইয়া রান্না করে , আমি জানি না”
“ দাড়া আমি দেখছি “ এই বলে জান্নাত উঠে যায় । রান্না ঘরে গিয়ে দেখে কিছুই রান্না হয়নি । জান্নাত ভাবে তাহলে এখন ছোট আব্বু কি খাবে ? আর কি জবাব দেবে রান্না না হওয়ার । জান্নাত রাজীব কে খোঁজে , কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না । রাজীবের মোবাইলে কল করে , কিন্তু সেটাও নিরুত্তর ।
জান্নাত ভেবে পায় না কি করবে ? আসলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোন দিন পরতে হয়নি । পরিবারের মানুষ কি খাবে সেটা ওর চিন্তার বিষয় নয় । তাই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে অথৈ সাগরে পরে জান্নাত । একবার ভাবে মা কে গিয়ে বলবে , মা কোন না কোন বেবস্থা করে দেবে । কিন্তু সেই চিন্তাও বাদ দেয় । নানা ধরনের প্রশ্ন উঠবে । জান্নাত আবার কল করে রাজীব কে , কিন্তু এবারো রাজীব কল রিসিভ করে না । রাজীব কে নিয়েও চিন্তা হয় ।
কিছুক্ষন নখ কামড়ানোর পর হঠাত জান্নাতের মাথায় বুদ্ধি আসে । দ্রুত উপরে উঠে রানীর কাছে যায় । জিজ্ঞাস করে রানীর কাছে টাকা আছে কিনা । রানী জান্নাতের টাকা চাওয়া দেখে একটু অবাক হলেও নিজের কাছে থাকা কিছু টাকা বের করে দেয়। জান্নাত সেই টাকা নিয়ে দ্রুত গলির মাথায় গিয়ে খাবার কিনে নিয়ে আসে ।
****
রাজীব অনেকক্ষণ বাইক চালিয়ে একটা নির্জন জায়গায় পেয়ে সেখানে বসে থাকে । প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে ওর , সব অভিমান নিজের বাপ আর মৃত মায়ের উপর । কেনো ওরা ওকে এই ধরনের পরস্থিতি তে ফেলে দিলো । বার বার এই প্রস্নই করেছে একা একা । ওরা কি বোঝে না , ও একটা মানুষ , যার কিছু সখ আহ্লাদ আছে , আর কতদিন বাপ মায়ের দায়িত্ব ওকে বহন করতে হবে। ওর কি এই বয়সে ছোট বোনের জন্য চিন্তা করার কথা ?
বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে জান্নাতের সাথে কাটানো এই কয়দিনের সৃতি গুলো । রাজীব ভাবে ওর কি এই ধরনের জীবন কাটানোর অধিকার নেই ? মনে মনে বাবা মায়ের কাছে জবাব চায় । কিন্তু রাজীব চাইলেও সেরকম কিছু করতে পারছে না । ওর জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্চে রানীর পেছনে । আর কতদিন এভাবে চলবে , রাজীবের ইচ্ছে হয় সব কিছু ছেরেছুরে কোথাও চলে যায় ।
নিজের বাবা মা কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় ও রানীর বাবা কিনবা মা নয় , রানীকে ও জন্ম দেয়নি । তাহলে কেন রানীর দায়িত্ব ওর নিতে হবে । কেন ও আর দশটা ছেলের মত নিজের জীবন চালাতে পারবে না । কেন জান্নত কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারবে না । বার বার পারিবারিক বাধা এসে দাঁড়াবে ওর সামনে ।
তাও যদি সফল ভাবে রানীর দেখাশোনা করতে পারতো , সেটাও হচ্ছে না ওকে দিয়ে । মাত্র কয়েক দিন জান্নাতের প্রতি কিছুটা মনযোগী হয়েছে , আর তাতেই সব কিছু অগোছালো হয়ে গেছে । কত দিন যাবত এই ধরনের কাজ করছে রানী কে জানে। ওর নাকের ডগায় বসে রানী এসব করছে আর ও টের পায়নি । এছাড়া কোন ধরনের নেশা ধরেছে কিনা সেটাও দেখতে হবে । রাজীব শুনেছে এভাবে কাঁটা ছেরা নাকি নেশা গ্রস্থ ছেলে মেয়েরা করে থাকে । ভার্সিটি তে নেশার বড় রেকেট আছে বলে রাজীব জানে । ভালো ভালো ছেলে মেয়েরা এই নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে । রানীও কি জড়িয়ে গেছে কিনা কে জানে ।
এসব ভাবতে ভাবতে রাজীবের নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে । জীবনটা ধিরে ধিরে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে । কতদিন এই বিষাক্ত জীবনের ভার বহন করতে পারবে সেটা রাজীবের কাছে পরিস্কার নয় । রাজীব নিজের ভাগ্য নিয়ে অনেকক্ষণ নিজের সাথেই যুদ্ধ করে , ভাবে ও চাইলেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে । সুধু এতটুকুই করতে হবে যে , কেউকে নিয়ে না ভেবে সুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে । যেমন জয় সুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে , রানী যেমন নিজেকে নিয়ে ভাবে তেমন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজীব পরাজিত হয় , মেনে নেয় পরাজয় ই ওর ভাগ্য । জয় যেমন ওকে লুজার বলে , আসলেই ও লুজার । রাজীব ফিরতি পথ ধরে , ভবেছিলো আজকে বাসায় ফিরবে না । কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে না। নিজের ভাগ্য কে মেনে নিয়ে ফিরে আসে বাসায় । ও চাইলেও নির্লিপ্ত ভাবে থাকতে পারবে না , এটা ওর ভাগ্যের লিখন ।
রাজীব যখন বাসায় ঢোকে তখন জান্নাত টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে । রাজীব কে দেখে জান্নাত মিস্টি করে হাসে , ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাস করে কোথায় ছিলো ও । কিন্তু রাজীব হাসতে পারে না , ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চায় । ভাবে এতো সুন্দর একটা দৃশ্য প্রতিদিন দেখার সৌভাগ্য ওর কোনদিন ও হবে না । জান্নাত হয়তো এভাবেই টেবিলে খাবার সাজাবে , কিন্তু সেটা ওর জন্য নয় , অন্য কারো জন্য । কারন ওর মত লুজারের জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না । সব দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করে রাজীব যখন প্রস্তুত হবে , তখন জান্নাত হয়তো অনেক দূর চলে যাবে । ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
রাজীব জিজ্ঞাস করে “ খাবার এলো কিভাবে”
“ উড়ে এসেছে , তুই কোথায় ছিলি , কেউ একজন ঠিক ই বলেছে , শিকদার বাড়ির সব কটা একেকটা চিড়িয়া , বলা নেই কওয়া নেই হাওয়া হয়ে গেলি” জান্নাত হালকা ঝাঁজের সাথে বলে ।
রাজীব উত্তরে কিছু বলে না , তবে মনে মনে বলে ‘ আরো কিছু বল প্লিজ , শুনতে ভালো লাগছে’
কিছুক্ষন পর রানী আর রহিম নিচে নেমে আসে , জান্নাত কে টেবিল সাজাতে দেখে রহিম খুশি হয়ে বলে “ একদম আমার মায়ের মত হয়েছে রে , বেঁচে থাকো মা , অনেক কষ্ট করলি আজকে”
“ কি কষ্ট করলাম , নিজে তো আর রাধি নি , দোকান থেকে কিনে নিয়ে এসেছি , এটা যে কেউ করতে পারে “ জান্নাত হেসে বলে , ওর কাছে নিজেকে কেমন জানি বউ বউ লাগছে ।
“ কিন্তু যেভাবে সাজিয়েছিস , খাবার গুলো আর দোকানের মত লাগছে না রে , আমার মায়ের হাতে ছোঁয়া পেয়ে ঘরের খাবার হয়ে গেছে” জান্নাত যখন রহিমের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলো তখন রহিম এ কথা বলে ।
জান্নাতের একটু লজ্জা লজ্জা লাগে , জান্নাত কোনদিন ভাবেনি এভাবে কোনদিন খাবার পরিবেশন করবে ও । তবে করতে খারাপ লাগছে না । মনে হচ্ছে ও শিকদার পরিবারের অংশ হয়ে নিজেও চিড়িয়া হয়ে গেছে ।
জান্নাত নিজেও খেতে বসে , টুকটাক যা কথা হয় , তা জান্নাত আর রহিমের মাঝেই হয় । রানী একদম মাথা নিচু করে চোরের মত খেতে থাকে । আর রাজীব খেতে খেতে মন ভরে জান্নাত কে দেখে নেয় । কারন ও শিওর এই দৃশ্য আর দেখা হবে না ওর ।
*****
সব প্রশ্নের উত্তর নেই,
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)