02-10-2025, 06:50 PM
কিছু সম্পর্কঃ ৭ (ক)
সন্ধার পর রাজীব নিজের পড়ার টেবিলে বসে আছে , তবে বইয়ে ওর মন নেই । কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত জান্নাত ওর আর রানীর সাথেই ছিলো । কিছুক্ষনের জন্য রানী রান্না ঘরে চা করতে গিয়েছিলো । রানী নিজে থেকে চা করতে যেতে চাওয়ায় রাজীব খুশিই হয়েছিলো । খুশি হওয়ার করান দুটো , প্রথম কারন হচ্ছে রানী ধিরে ধিরে নিজের স্বাভাবিক লাইফে ফিরছে । আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে জান্নাতের সাথে কিছুটা একা সময় পাওয়া । পরন্ত বিকেলে এমন নরম রোদে বারান্দায় জান্নাতের সাথে একা বসতে পারা রাজীবের জন্য আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত ব্যাপার । এমন নয় যে , রাজীব এই সুযোগে জান্নাতের হাত ধরে বসে , দু লাইন প্রেমের কবিতা শুনিয়ে দেবে । সেই ক্ষমতা এখনো রাজীবের হয়নি । তবে দুজন মুখোমুখি বসে থাকাও ওর জন্য অনেক পাওনা ।
রাজীব চুপ করে বসে থাকেই তুষ্ট ছিলো , কথা শুরু করেছিলো জান্নাত । হঠাত রাজীব কে অবাক করে দিয়ে পুরনো দিনের কথা তুলে এনেছিলো । জান্নাত বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলেছিলো “ রাজীব তোর মনে আছে একদিন তুই আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলি?” কথাটা বলার সময় জান্নতের ঠোঁটের কোনে একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকা , যেন ও সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে দেখতে পারছে ।
রাজীব মাথা চুলকায় , তারপর লজ্জিত ভাবে হেসে বলে “ হ্যা মনে আছে , সেদিন একটু বেশি ই করে ফেলেছিলাম”
ঘটনাটা এই শিকদার বাড়ির সামনেই ঘটেছিলো। বিকেল বেলায় রাজীব রানী জান্নাত আর জয় আরো কিছু ছেলে পেলের সাথে খেলছিলো । সেই সময় জান্নাত আর রাজীবের মাঝে ঝগড়া লেগে গিয়েছিলো । জান্নাতের দাবি রাজীব আর জয় চিট করেছে । আর রাজীবের দাবি ওরা চিট করেনি । জয় চুপ ছিলো পুরো সময় । আসলে চিট করেছিলো জয় । ঝগড়ার এক পর্যায়ে জান্নাত রাজীব কে ধাক্কা দেয় , আর তখন রাজীব ক্ষেপে গিয়ে জান্নাতকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় , তার তাতে জান্নাতের হাটুর কাছে অনেকটা ছিঁড়ে গিয়েছিলো । দরদর করে রক্ত পরছিলো । রাজীব যদিও তখন রাগে গরগর করছিলো , কিন্তু রক্ত দেখে ভড়কে গিয়েছিলো ।
এর পর বেশ কয়েকদিন রাজীবের সাথে জান্নাতের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিলো । তারপর একদিন রাজীব দুপুর বেলায় জান্নাতদের বাড়ি গিয়ে জান্নাত কে ডেকে আনে । ডেকে আনে বললে ভুল ই হবে , রাজীব জান্নাত কে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে । জান্নাত কিছুতেই আসবে না । রাজীবের হাতে ধুম ধাম কিল ঘুষি লাগিয়ে যাচ্ছিলো লাগাতার । শেষে এক পর্যায়ে বাড়ির নির্জন একটি কোনে এনে ছেড়ে দেয় জান্নাত কে । রাগে ফুঁসতে থাকা জান্নাত রাজীবের উপর কিল ঘুষির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করে দিয়েছিলো ছাড়া পেয়ে । কিন্তু রাজীব ছিলো একদম নিথর । যখন জান্নাত একটু শান্ত হয়ে আসে , তখন রাজীব ওকে একটা কাগজ আর কিছু চকলেট দেয় ।
জান্নাত তখনো রাজীবের দিকে সন্দেহর চোখে তাকাচ্ছিলো , ও ভাবছিলো রাজীব নিশ্চয়ই কোন প্রাঙ্ক করার মতলবে আছে । ধিরে ধিরে জান্নাত কাগজ খোলে । সেখানে ছেলেমানুষি হাতের লেখা “ মাফ করে দে আর কোনদিন তোকে মারবো না, কানে ধরলাম”
জান্নাত হেসে রাজীব কে মাফ করে দিয়েছিলো , মাফ করে দেয়ার মুক্ষ কারন চকলেট ছিলো না , ওই কানে ধরার কথাটাই জান্নাতকে বেশি খুশি করেছিলো । তবে সেই খুশির অনুভূতি খুব দ্রুত চলে গিয়েছিলো । কারন রাজীব তখন হঠাত করেই জান্নাত এর গালে একটা চুমু খেয়ে দৌর দিয়েছিলো । সিনেমায় নায়ক নাইকার চুমু খাওয়া দেখে ওই সময়ের কম বয়সি রাজীবের মনে হয়েছিলো জান্নাত কে চুমু খাওয়া উচিৎ ।
জান্নাত অবাক হয়ে রাজীবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো । তবে হাতের চকলেট বেশিক্ষণ জান্নাত কে ওই চুমুর কথা ভাবতে দেয়নি । এর পর বেশিদিন রাজীবরা এই বাড়িতে থাকেনি । আর এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর রাজীব আর আগের রাজীব ছিলো না ।
“ ধাক্কাটাই কি সুধু বেশি বেশি ছিলো না আরো কিছু ছিলো সাথে ” জান্নাত রাজীবের লাজুক হাসি দেখে ওকে আরো একটু বিব্রত করার জন্য বলে , বিব্রত অবস্থায় রাজীব কে খুব কিউট লাগে দেখতে ।
রাজীব অবাক হয়ে জান্নাতের দিকে তাকায় , ওই কথা যে জান্নাতের মনে থাকবে সেটা রাজীব ভাবেনি , কারন ওই সময়কার বেশিরভাগ কথাই রানীর মনে নেই , জান্নাত তো রানীর বয়সিই ।
রাজীব হাঁসে , বলে “ তখন ছোট ছিলাম তাই কত কিছুই ত না বুঝে করে ফেলতাম”
“ এর পর যে প্রায় প্রতিদিন আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতি সেটা কি না বুঝেই করতি?” জান্নাত একটু মন মরা হয়ে বলে ।
জান্নাত কে হঠাত এমন মন মরা হয়ে উঠতে দেখে রাজীব অস্থির হয়ে ওঠে , নিজেকে নিজেক গালি দেয় , মনে মনে ভাবে কি দরকার ছিলো অমন করে বলার , কথা গুছিয়ে বলতে না পারার জন্য আরো এক দফা গালি দেয় নিজেকে ।
“ আরে না না আমি ওভাবে বলতে চাইনি” রাজীব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলে
“ তাহলে কিভাবে বলতে চেয়েছিস?”
“ কি বলবো , এর পর জীবনে কত কিছু ঘটে গেলো , সময়ের সাথে সাথে আমি আর আগের রাজীব থাকতে পারলাম না, সব কিছুতেই সংকোচ সব কিছুতেই দ্বিধা “ রাজীব একটু উদাস হয়ে বলে ।
রাজীবকে হঠাত এমন উদাস হয়ে যেতে দেখে জান্নাত দ্রুত পরিস্থিতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করে , বলে “ এখন যদি আমি আমার পাওনা চকলেট গুলো সুদ সমেত ফেরত চাই। তাহলে কেমন হবে?” কথা গুলো বলে জান্নাত মাথা নিচু করে লাজুক ভাবে হাসে ।
রাজীব জান্নাতের কথা শুনে অবাক হয়ে জান্নাতের দিকে তাকায় , জান্নাত একটু লাজুক ভাবে হাসছে , কিন্তু ওর চোখ জোড়া অন্য কথা বলছে , ওরা জেন চাইছে রাজীব কিছু একটা বলুক , জেনতেন ভাবে নয় খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়ে বলুক । রাজীব চেষ্টা করে , কিন্তু কিছুতেই ওর মুখ থেকে শব্দ বের হয় না ।
কিন্তু রাজীবের উত্তর দেয়ার সুযোগ হয় না , কারন রানী চা নিয়ে ফিরে আসে , জান্নাতের শেষ কিছু কথা রানী শুনে ফেলে, “ কিসের সুদ , কি কেমন হবে? তোরা কি সুদি কারবার চালু করতে যাচ্ছিস নাকি?”
হঠাত এমন করে রানীর আগমনে রাজীব আর জান্নাত দুজনেই একটু অনভিপ্রেত হয়ে যায় , দুজন দুদিকে তাকিয়ে বলে “ আরে না না । তেমন কিছু না”
রানীর কাছে দুজনের আচরণ ই কেমন যেন ঠেকে , কপাল কুঁচকে দুজনের দিকেই তাকায় , এদিকে জান্নাত আলোচনার মোড় অন্যদিকে ফেরানোর জন্য বলে “ চায়ে চিনি কম হয়েছে রে, একটু চিনি এনে দে না”
“ তুই নিয়ে আয় , চা বানিয়ে খাওয়াবো আবার চিনিও এনে দেবো , যাহ” রানী একটু ক্ষেপে গিয়ে বলে । আর জান্নাত যেন এই সুজগেই ছিলো , দ্রুত চিনি আনার জন্য । আর রাজীব অন্য দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেয় । রানী রাগান্বিত ভাবে জিজ্ঞাস করে , “ তোর ও কি চিনি লাগবে?”
রানী নিজের চায়ের বদনাম সহ্য করতে পারে না । তাই রাজীব বলে “ নাহ ঠিক আছে”
এখন পড়ার টেবিলে বসে সেই দৃশ্য মনে পরে রাজীবের মনটা ভালোলাগায় ভরে ওঠে । নিজের ডায়রি নেয় , আগামি কালের to do লিস্টে একটা কাজ যোগ করে , লেখে , ‘জান্নাতের জন্য চকলেট কেনা’ ।
****
জান্নাত বিছানায় হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে এনে বসে আছে , না চাইতেও ঠোঁটে বার বার একটা হাসি চলে আসছে । ছোট বেলার সেই ঘটনাটা আজকে ও ইচ্ছে করেই তুলেছে । রাজীব কে হিন্টস দেয়ার জন্য । রাজীব ভেবেছে ও সেই ঘটনা ভুলে গিয়েছিলো , হ্যা একটা সময় পর্যন্ত ওই ঘটনা জান্নাত ভুলেই গিয়েছিলো । কিন্তু রাজীব যখন আবার ফিরে এলো পাকাপাকি ভাবে তখন হঠাত একদিন , সেই নির্জন কোনটা দেখেই জান্নাতের ওই ঘটনা মনে পরে গেলো । জান্নাতের মনে পরে গেলো , ওর ফার্স্ট কিস আসলে এই লাজুক ছেলেটি । কথা মনে পরতেই জান্নাতের এতো আনন্দ হয়েছিলো যে জান্নাত নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো । বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো , ছোট বেলায় ওই ছোট্ট একটা ঘতনাকে নিজের প্রথম চুম্বন ভেবে এতো আহ্লাদী হওয়ার কি আছে ? কিন্তু কোন কিছুই জান্নাত কে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি । জান্নাত অবউঝ বয়সেই সেই চুম্বনকেই নিজের প্রথম চুম্বন ভেবে নিয়েছে ।
এমন নয় যে জান্নাত এর পর আর চুম্বনের স্বাদ নেয়নি , দশম শ্রেণীর শেষের দিকে একটা ছেলেকে ওর ভালো লেগেছিলো , খুব যে ভালো লেগেছিলো তেমন নয় , তবে কিউরিসিটি থেকে দুজনে চুমু খেয়েছিলো । একাদশ শ্রেণিতেও একজনের সাথে অল্প কিছুদিনের সম্পর্ক ছিলো , সেই সম্পর্ক ও চুম্বন পর্যন্ত গড়িয়েছিলও । কিন্তু ওই ছেলদের সাথে সৃতি গুলো জান্নাতের মনে কোন রকম দাগ কাটতে পারেনি , যেমনটা কেটেছে অবুঝ বয়সের সেই অবুঝ চুমু ।
আর তাইতো আজকে সব লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নিজে থেকেই সেই পুরোনো সৃতি রাজীব কে মনে করিয়ে দিয়ে এলো, যদি পুরনো সৃতি মনে হতে রাজীবের মনেও কিছুটা স্পৃহা জেগে ওঠে ।
“ কিরে এই ভর সন্ধ্যায় লাইট বন্ধ করে রেখছিস কেন?” এই বলে আয়শা জান্নাতের ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয় ।
আয়শার কথা গুলো , আর লাইটের আলো , জন্নাতের ধ্যান সেই প্রথম চুম্বন থেকে সরিয়ে বর্তমানে নিয়ে আসে ।
“ আহা আম্মু , খালি বিরক্ত করো” বিরক্ত হয় জান্নাত । আধো অন্ধকারে একটা রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো , আয়শা এসে সেটা ভেস্তে দিলো
“ হ্যা আমি তো সুধু বিরক্তই করি , যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝবি” আয়শা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ।
মায়ের এমন নিঃশ্বাস ফেলা দেখে , জান্নাতের বিরক্তি কিছুটা কমে আসে , মা না থাকার পরিণতি রাজীব আর রানী কে দেখেই কিছুটা আঁচ করতে পারে ও। বিছানা থেকে উঠে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে , বলে “ ইশ আমার আম্মুটারে , একদম ননীর পুতুল টা , কিছু বললেই মন খারাপ করে “ হাসতে হাসতে মায়ের গালে গাল ঠেকায় ।
মেয়ের এমন আহ্লাদি আচরণে আয়শার মনটাও কিছুটা আপ্লূত হয় , তবুও কপট রাগের সাথে বলে “ হ্যা তোমারা তো আমাকে ননীর পুতুল বানিয়েই রেখছো , সারাদিন চুলার কাছে দাড়িয়ে রান্না তো তুমি , তোমার আব্বু আর তোমার ভাই করে”
“ ইশিরে আমার অভিমানি আম্মুটা রাগ করেছে , তুমি বোঝ না , এই বয়সি মেয়েদের ঘরের লাইট কখন বন্ধ থাকে ? এই বয়স কি তুমি পার করনি খুকি?” এই বলে জান্নাত মায়ের থুতনি আঙুল দিয়ে ধরে নাড়িয়ে দেয় ,
“ হুম , তোমার বয়স আসার আগেই ান্ধবীর বিয়েতে গিয়ে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে , আমাকে কেউ জিজ্ঞাস ও করেনি” আয়শা এখনো কপট রাগ ধরে রাখে , “ আমরা এইসব লাইট বন্ধ করাকরি কারবার কিছুই বুঝতাম না” যদিও আয়শা জানে ও ডাহা মিথ্যা বলছে । এই সময় ওর ও গিয়েছে । তবে বিয়ের পর ।
“ তাই নাকি !! তবে আমার আব্বুর মত একটা হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড পেয়ে নিশ্চয়ই মনে আর দুঃখ ছিলো না?”
এবার আয়শা হেসে ফেলে , বলে “ হয়েছে হয়েছে , এহ আমার হ্যান্ডসাম রে , এর চেয়ে অনেক হ্যান্ডসাম ছেলে আমার পেছনে ঘুরতো , তোমার আব্বু বোঝে কি , বোঝে সুধু কত বস্তা গমে কত বস্তা আটা ময়দা হয়”
“ এই যে আয়শা বেগম একদম মিথ্যা বলবে না আমার আব্বুর নামে, কতবার দেখছি রাতে ফেরার সময় বেলি ফুলের মালা আনতে”
আয়শা হাসে , তবে চোর ধরা পরার পর যেমন হাসি দেয় তেমন হাসি , মেয়ে নিজের রোম্যান্টিক লাইফের সন্ধান পেয়ে গেছে জেনে কিছুটা লজ্জাও পায় । তাই দ্রুত টপিক চেঞ্জ করতে চায় , বলে “ ওই সব রাখো , আমার মেয়ের হঠাত লাইট বন্ধ রাখতে মন চাইলো কেনো সেটা বলো, কোন বদ ছেলে কি পেছনে লেগেছে” বলার সময় আয়শা ভ্রু নাচিয়ে হাসে , মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ওর দুশ্চিন্তা ছেলে কে নিয়ে । ছেলের কীর্তি কলাপ ভাসা ভাসা কিছুটা জানে , কিন্তু ছেলের সাথে তো এসব নিয়ে আলোচনা করাও যায় না।
“ আমি কি আর তোমার মত টুস্টুসি ফুল্টুশি নাকি যে ছেলেরা আমার পেছনে লাইন দেবে। আমি হলাম কালো বোঁচা মেয়ে” জান্নাত মিথ্যা মন খারাপ করে বলে ।
“ এই খবরদার , আমার মেয়েকে কালো বোঁচা বলবি না , আমার মেয়ে দেখতে কি মিষ্টি , এমন চোখ কজনের আছে হ্যা , আর কি সুন্দর লাগে হাসলে” আয়শা রেগে যায় , সত্যি বলতে মেয়ে কালো হয়েছে বলে প্রথম প্রথম আয়শার মনে দুঃখ ছিলো , রানী অমন ফর্সা আর জান্নাত হয়েছে কালো । কোনদিন ঈর্ষা না হলেও একটা চাপা দুঃখ ছিলো । আর থাকবেই বা না কেন আশেপাশের মেয়েরা , এমন কি জান্নাতের ফুপুরাও জান্নাত কে কালো বলতো ।
তবে আফরোজা ওকে একদিন কড়া ভাবে শাসন করেছিলো এর জন্য । বুঝিয়েছিলো , যদি মা হয়ে ও নিজেই হীনমন্যতায় ভোগে তাহলে এই মেয়ে কোনদিন নিজেকে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারবে না , সব সময় সংকোচ থাকবে কালো বলে । সেই থেকে আয়শা কোনদিন মেয়েকে বুঝতে দেয়নি যে মেয়ে কালো । কেউ যদি কোনদিন বলতো তাহলে আফরোজা আর ও দুজনে মিলে ঝগড়া লাগিয়ে দিতো । এর পর থেকে পাড়া পড়শি তো দুরের কথা কোনদিন জান্নাতের ফুপুরাও জান্নতের গায়ের রং নিয়ে কথা তুলতে সাহস করেনি ।
“ তাই নাকি ? তাহলে বলছো , ওই হাবা ছেলেটা তোমার মেয়েকে পছন্দ করবে” জান্নাত মা কে আরো টাইট করে জড়িয়ে ধরে ।
“ কোন হাবা ছেলে , একদিন নিয়ে আয় না আমার সামনে , আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি”
“ সময় হলে নিয়ে আসবো , এখন বলো তুমি কি কাজে এসেছিলে “ জান্নাত এই বিসয়ে মায়ের সাথে আর কথা বলতে চায় না । নইলে মা ছাড়বে না ।
“ ওহ দেখ ভুলেই গেছি , রানীর জন্য সুপ রান্না করেছি , কিন্তু আজকে হাটুতে এতো ব্যাথা করছে যে যেতে পারছি না , তুই দিয়ে আয় না মা “ আয়শা করুন স্বরে বলে , সাধারনত জান্নাত এই কাজ করতে চায় না । সেই ভয় থেকেই আয়শা এমন ভাবে বলল ।
“ ওকে মাম্মি জাচ্ছি , যাও তুমি রেডি করে আনো” কিন্তু আয়শা কে অবাক করে দিয়ে জান্নাত একবারেই রাজি হয়ে যায় ।
আয়শা একটু অবাক হলেও কিছু বলে না । সুপ রেডি করার জন্য চলে যায় । আর মা চলে যেতেই জান্নাত আয়নার সামনে দাড়ায় । চুল গুলো গুছিয়ে নেয় , পোশাক পরিপাটি করে নেয় । নিজেকে বার বার আয়নায় দেখে নিজেই হাসে । বলে ‘রেডি থাকো হাবা ছেলে , আমি আসছি’
সুপের বাটি নিয়ে জান্নাত কে সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে আয়শার মনে একটা ব্যাপার কাঁটার মত বিঁধে । মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে , ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে । মেয়ে আর বেশিদিন ওর সাথে থাকবে না । তখন বাড়িতে আয়শার সময় কিভাবে কাটবে সেটা ভেবে আয়শার মন ভার হয়ে আসে । এই বাড়িতে এক মাত্র জান্নত ই মায়ের সাথে খোলা মনে গল্প করে । জয়নাল আর আগের মত সময় দেয় না । ব্যাবসার কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই খাওয়াদাওয়া করে টিভিতে টকশো দেখে । আর জয় তো জয় ই কথন বাড়িতে থাকে কখন থাকে না সেটাই বলা মুশকিল । আজকাল তো আরো বেশি বাড়িতে পাওয়া যায় না । কি রাজনীতিতে ঢুকেছে , কত ভাবে বুঝিয়েছে আয়শা কিন্তু লাভ হয়নি । মাঝে মাঝে আয়শা ভাবে ছেলের একটা বিয়ে করিয়ে দিবে , পাত্রীও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে , কিন্তু জয়ের আচরণ দেখে সাহস হয় না ।
****
সন্ধার পর রাজীব নিজের পড়ার টেবিলে বসে আছে , তবে বইয়ে ওর মন নেই । কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত জান্নাত ওর আর রানীর সাথেই ছিলো । কিছুক্ষনের জন্য রানী রান্না ঘরে চা করতে গিয়েছিলো । রানী নিজে থেকে চা করতে যেতে চাওয়ায় রাজীব খুশিই হয়েছিলো । খুশি হওয়ার করান দুটো , প্রথম কারন হচ্ছে রানী ধিরে ধিরে নিজের স্বাভাবিক লাইফে ফিরছে । আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে জান্নাতের সাথে কিছুটা একা সময় পাওয়া । পরন্ত বিকেলে এমন নরম রোদে বারান্দায় জান্নাতের সাথে একা বসতে পারা রাজীবের জন্য আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত ব্যাপার । এমন নয় যে , রাজীব এই সুযোগে জান্নাতের হাত ধরে বসে , দু লাইন প্রেমের কবিতা শুনিয়ে দেবে । সেই ক্ষমতা এখনো রাজীবের হয়নি । তবে দুজন মুখোমুখি বসে থাকাও ওর জন্য অনেক পাওনা ।
রাজীব চুপ করে বসে থাকেই তুষ্ট ছিলো , কথা শুরু করেছিলো জান্নাত । হঠাত রাজীব কে অবাক করে দিয়ে পুরনো দিনের কথা তুলে এনেছিলো । জান্নাত বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলেছিলো “ রাজীব তোর মনে আছে একদিন তুই আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলি?” কথাটা বলার সময় জান্নতের ঠোঁটের কোনে একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকা , যেন ও সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে দেখতে পারছে ।
রাজীব মাথা চুলকায় , তারপর লজ্জিত ভাবে হেসে বলে “ হ্যা মনে আছে , সেদিন একটু বেশি ই করে ফেলেছিলাম”
ঘটনাটা এই শিকদার বাড়ির সামনেই ঘটেছিলো। বিকেল বেলায় রাজীব রানী জান্নাত আর জয় আরো কিছু ছেলে পেলের সাথে খেলছিলো । সেই সময় জান্নাত আর রাজীবের মাঝে ঝগড়া লেগে গিয়েছিলো । জান্নাতের দাবি রাজীব আর জয় চিট করেছে । আর রাজীবের দাবি ওরা চিট করেনি । জয় চুপ ছিলো পুরো সময় । আসলে চিট করেছিলো জয় । ঝগড়ার এক পর্যায়ে জান্নাত রাজীব কে ধাক্কা দেয় , আর তখন রাজীব ক্ষেপে গিয়ে জান্নাতকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় , তার তাতে জান্নাতের হাটুর কাছে অনেকটা ছিঁড়ে গিয়েছিলো । দরদর করে রক্ত পরছিলো । রাজীব যদিও তখন রাগে গরগর করছিলো , কিন্তু রক্ত দেখে ভড়কে গিয়েছিলো ।
এর পর বেশ কয়েকদিন রাজীবের সাথে জান্নাতের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিলো । তারপর একদিন রাজীব দুপুর বেলায় জান্নাতদের বাড়ি গিয়ে জান্নাত কে ডেকে আনে । ডেকে আনে বললে ভুল ই হবে , রাজীব জান্নাত কে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে । জান্নাত কিছুতেই আসবে না । রাজীবের হাতে ধুম ধাম কিল ঘুষি লাগিয়ে যাচ্ছিলো লাগাতার । শেষে এক পর্যায়ে বাড়ির নির্জন একটি কোনে এনে ছেড়ে দেয় জান্নাত কে । রাগে ফুঁসতে থাকা জান্নাত রাজীবের উপর কিল ঘুষির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করে দিয়েছিলো ছাড়া পেয়ে । কিন্তু রাজীব ছিলো একদম নিথর । যখন জান্নাত একটু শান্ত হয়ে আসে , তখন রাজীব ওকে একটা কাগজ আর কিছু চকলেট দেয় ।
জান্নাত তখনো রাজীবের দিকে সন্দেহর চোখে তাকাচ্ছিলো , ও ভাবছিলো রাজীব নিশ্চয়ই কোন প্রাঙ্ক করার মতলবে আছে । ধিরে ধিরে জান্নাত কাগজ খোলে । সেখানে ছেলেমানুষি হাতের লেখা “ মাফ করে দে আর কোনদিন তোকে মারবো না, কানে ধরলাম”
জান্নাত হেসে রাজীব কে মাফ করে দিয়েছিলো , মাফ করে দেয়ার মুক্ষ কারন চকলেট ছিলো না , ওই কানে ধরার কথাটাই জান্নাতকে বেশি খুশি করেছিলো । তবে সেই খুশির অনুভূতি খুব দ্রুত চলে গিয়েছিলো । কারন রাজীব তখন হঠাত করেই জান্নাত এর গালে একটা চুমু খেয়ে দৌর দিয়েছিলো । সিনেমায় নায়ক নাইকার চুমু খাওয়া দেখে ওই সময়ের কম বয়সি রাজীবের মনে হয়েছিলো জান্নাত কে চুমু খাওয়া উচিৎ ।
জান্নাত অবাক হয়ে রাজীবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো । তবে হাতের চকলেট বেশিক্ষণ জান্নাত কে ওই চুমুর কথা ভাবতে দেয়নি । এর পর বেশিদিন রাজীবরা এই বাড়িতে থাকেনি । আর এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর রাজীব আর আগের রাজীব ছিলো না ।
“ ধাক্কাটাই কি সুধু বেশি বেশি ছিলো না আরো কিছু ছিলো সাথে ” জান্নাত রাজীবের লাজুক হাসি দেখে ওকে আরো একটু বিব্রত করার জন্য বলে , বিব্রত অবস্থায় রাজীব কে খুব কিউট লাগে দেখতে ।
রাজীব অবাক হয়ে জান্নাতের দিকে তাকায় , ওই কথা যে জান্নাতের মনে থাকবে সেটা রাজীব ভাবেনি , কারন ওই সময়কার বেশিরভাগ কথাই রানীর মনে নেই , জান্নাত তো রানীর বয়সিই ।
রাজীব হাঁসে , বলে “ তখন ছোট ছিলাম তাই কত কিছুই ত না বুঝে করে ফেলতাম”
“ এর পর যে প্রায় প্রতিদিন আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতি সেটা কি না বুঝেই করতি?” জান্নাত একটু মন মরা হয়ে বলে ।
জান্নাত কে হঠাত এমন মন মরা হয়ে উঠতে দেখে রাজীব অস্থির হয়ে ওঠে , নিজেকে নিজেক গালি দেয় , মনে মনে ভাবে কি দরকার ছিলো অমন করে বলার , কথা গুছিয়ে বলতে না পারার জন্য আরো এক দফা গালি দেয় নিজেকে ।
“ আরে না না আমি ওভাবে বলতে চাইনি” রাজীব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলে
“ তাহলে কিভাবে বলতে চেয়েছিস?”
“ কি বলবো , এর পর জীবনে কত কিছু ঘটে গেলো , সময়ের সাথে সাথে আমি আর আগের রাজীব থাকতে পারলাম না, সব কিছুতেই সংকোচ সব কিছুতেই দ্বিধা “ রাজীব একটু উদাস হয়ে বলে ।
রাজীবকে হঠাত এমন উদাস হয়ে যেতে দেখে জান্নাত দ্রুত পরিস্থিতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করে , বলে “ এখন যদি আমি আমার পাওনা চকলেট গুলো সুদ সমেত ফেরত চাই। তাহলে কেমন হবে?” কথা গুলো বলে জান্নাত মাথা নিচু করে লাজুক ভাবে হাসে ।
রাজীব জান্নাতের কথা শুনে অবাক হয়ে জান্নাতের দিকে তাকায় , জান্নাত একটু লাজুক ভাবে হাসছে , কিন্তু ওর চোখ জোড়া অন্য কথা বলছে , ওরা জেন চাইছে রাজীব কিছু একটা বলুক , জেনতেন ভাবে নয় খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়ে বলুক । রাজীব চেষ্টা করে , কিন্তু কিছুতেই ওর মুখ থেকে শব্দ বের হয় না ।
কিন্তু রাজীবের উত্তর দেয়ার সুযোগ হয় না , কারন রানী চা নিয়ে ফিরে আসে , জান্নাতের শেষ কিছু কথা রানী শুনে ফেলে, “ কিসের সুদ , কি কেমন হবে? তোরা কি সুদি কারবার চালু করতে যাচ্ছিস নাকি?”
হঠাত এমন করে রানীর আগমনে রাজীব আর জান্নাত দুজনেই একটু অনভিপ্রেত হয়ে যায় , দুজন দুদিকে তাকিয়ে বলে “ আরে না না । তেমন কিছু না”
রানীর কাছে দুজনের আচরণ ই কেমন যেন ঠেকে , কপাল কুঁচকে দুজনের দিকেই তাকায় , এদিকে জান্নাত আলোচনার মোড় অন্যদিকে ফেরানোর জন্য বলে “ চায়ে চিনি কম হয়েছে রে, একটু চিনি এনে দে না”
“ তুই নিয়ে আয় , চা বানিয়ে খাওয়াবো আবার চিনিও এনে দেবো , যাহ” রানী একটু ক্ষেপে গিয়ে বলে । আর জান্নাত যেন এই সুজগেই ছিলো , দ্রুত চিনি আনার জন্য । আর রাজীব অন্য দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দেয় । রানী রাগান্বিত ভাবে জিজ্ঞাস করে , “ তোর ও কি চিনি লাগবে?”
রানী নিজের চায়ের বদনাম সহ্য করতে পারে না । তাই রাজীব বলে “ নাহ ঠিক আছে”
এখন পড়ার টেবিলে বসে সেই দৃশ্য মনে পরে রাজীবের মনটা ভালোলাগায় ভরে ওঠে । নিজের ডায়রি নেয় , আগামি কালের to do লিস্টে একটা কাজ যোগ করে , লেখে , ‘জান্নাতের জন্য চকলেট কেনা’ ।
****
জান্নাত বিছানায় হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে এনে বসে আছে , না চাইতেও ঠোঁটে বার বার একটা হাসি চলে আসছে । ছোট বেলার সেই ঘটনাটা আজকে ও ইচ্ছে করেই তুলেছে । রাজীব কে হিন্টস দেয়ার জন্য । রাজীব ভেবেছে ও সেই ঘটনা ভুলে গিয়েছিলো , হ্যা একটা সময় পর্যন্ত ওই ঘটনা জান্নাত ভুলেই গিয়েছিলো । কিন্তু রাজীব যখন আবার ফিরে এলো পাকাপাকি ভাবে তখন হঠাত একদিন , সেই নির্জন কোনটা দেখেই জান্নাতের ওই ঘটনা মনে পরে গেলো । জান্নাতের মনে পরে গেলো , ওর ফার্স্ট কিস আসলে এই লাজুক ছেলেটি । কথা মনে পরতেই জান্নাতের এতো আনন্দ হয়েছিলো যে জান্নাত নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো । বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো , ছোট বেলায় ওই ছোট্ট একটা ঘতনাকে নিজের প্রথম চুম্বন ভেবে এতো আহ্লাদী হওয়ার কি আছে ? কিন্তু কোন কিছুই জান্নাত কে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি । জান্নাত অবউঝ বয়সেই সেই চুম্বনকেই নিজের প্রথম চুম্বন ভেবে নিয়েছে ।
এমন নয় যে জান্নাত এর পর আর চুম্বনের স্বাদ নেয়নি , দশম শ্রেণীর শেষের দিকে একটা ছেলেকে ওর ভালো লেগেছিলো , খুব যে ভালো লেগেছিলো তেমন নয় , তবে কিউরিসিটি থেকে দুজনে চুমু খেয়েছিলো । একাদশ শ্রেণিতেও একজনের সাথে অল্প কিছুদিনের সম্পর্ক ছিলো , সেই সম্পর্ক ও চুম্বন পর্যন্ত গড়িয়েছিলও । কিন্তু ওই ছেলদের সাথে সৃতি গুলো জান্নাতের মনে কোন রকম দাগ কাটতে পারেনি , যেমনটা কেটেছে অবুঝ বয়সের সেই অবুঝ চুমু ।
আর তাইতো আজকে সব লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নিজে থেকেই সেই পুরোনো সৃতি রাজীব কে মনে করিয়ে দিয়ে এলো, যদি পুরনো সৃতি মনে হতে রাজীবের মনেও কিছুটা স্পৃহা জেগে ওঠে ।
“ কিরে এই ভর সন্ধ্যায় লাইট বন্ধ করে রেখছিস কেন?” এই বলে আয়শা জান্নাতের ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয় ।
আয়শার কথা গুলো , আর লাইটের আলো , জন্নাতের ধ্যান সেই প্রথম চুম্বন থেকে সরিয়ে বর্তমানে নিয়ে আসে ।
“ আহা আম্মু , খালি বিরক্ত করো” বিরক্ত হয় জান্নাত । আধো অন্ধকারে একটা রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো , আয়শা এসে সেটা ভেস্তে দিলো
“ হ্যা আমি তো সুধু বিরক্তই করি , যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝবি” আয়শা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ।
মায়ের এমন নিঃশ্বাস ফেলা দেখে , জান্নাতের বিরক্তি কিছুটা কমে আসে , মা না থাকার পরিণতি রাজীব আর রানী কে দেখেই কিছুটা আঁচ করতে পারে ও। বিছানা থেকে উঠে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে , বলে “ ইশ আমার আম্মুটারে , একদম ননীর পুতুল টা , কিছু বললেই মন খারাপ করে “ হাসতে হাসতে মায়ের গালে গাল ঠেকায় ।
মেয়ের এমন আহ্লাদি আচরণে আয়শার মনটাও কিছুটা আপ্লূত হয় , তবুও কপট রাগের সাথে বলে “ হ্যা তোমারা তো আমাকে ননীর পুতুল বানিয়েই রেখছো , সারাদিন চুলার কাছে দাড়িয়ে রান্না তো তুমি , তোমার আব্বু আর তোমার ভাই করে”
“ ইশিরে আমার অভিমানি আম্মুটা রাগ করেছে , তুমি বোঝ না , এই বয়সি মেয়েদের ঘরের লাইট কখন বন্ধ থাকে ? এই বয়স কি তুমি পার করনি খুকি?” এই বলে জান্নাত মায়ের থুতনি আঙুল দিয়ে ধরে নাড়িয়ে দেয় ,
“ হুম , তোমার বয়স আসার আগেই ান্ধবীর বিয়েতে গিয়ে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে , আমাকে কেউ জিজ্ঞাস ও করেনি” আয়শা এখনো কপট রাগ ধরে রাখে , “ আমরা এইসব লাইট বন্ধ করাকরি কারবার কিছুই বুঝতাম না” যদিও আয়শা জানে ও ডাহা মিথ্যা বলছে । এই সময় ওর ও গিয়েছে । তবে বিয়ের পর ।
“ তাই নাকি !! তবে আমার আব্বুর মত একটা হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড পেয়ে নিশ্চয়ই মনে আর দুঃখ ছিলো না?”
এবার আয়শা হেসে ফেলে , বলে “ হয়েছে হয়েছে , এহ আমার হ্যান্ডসাম রে , এর চেয়ে অনেক হ্যান্ডসাম ছেলে আমার পেছনে ঘুরতো , তোমার আব্বু বোঝে কি , বোঝে সুধু কত বস্তা গমে কত বস্তা আটা ময়দা হয়”
“ এই যে আয়শা বেগম একদম মিথ্যা বলবে না আমার আব্বুর নামে, কতবার দেখছি রাতে ফেরার সময় বেলি ফুলের মালা আনতে”
আয়শা হাসে , তবে চোর ধরা পরার পর যেমন হাসি দেয় তেমন হাসি , মেয়ে নিজের রোম্যান্টিক লাইফের সন্ধান পেয়ে গেছে জেনে কিছুটা লজ্জাও পায় । তাই দ্রুত টপিক চেঞ্জ করতে চায় , বলে “ ওই সব রাখো , আমার মেয়ের হঠাত লাইট বন্ধ রাখতে মন চাইলো কেনো সেটা বলো, কোন বদ ছেলে কি পেছনে লেগেছে” বলার সময় আয়শা ভ্রু নাচিয়ে হাসে , মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ওর দুশ্চিন্তা ছেলে কে নিয়ে । ছেলের কীর্তি কলাপ ভাসা ভাসা কিছুটা জানে , কিন্তু ছেলের সাথে তো এসব নিয়ে আলোচনা করাও যায় না।
“ আমি কি আর তোমার মত টুস্টুসি ফুল্টুশি নাকি যে ছেলেরা আমার পেছনে লাইন দেবে। আমি হলাম কালো বোঁচা মেয়ে” জান্নাত মিথ্যা মন খারাপ করে বলে ।
“ এই খবরদার , আমার মেয়েকে কালো বোঁচা বলবি না , আমার মেয়ে দেখতে কি মিষ্টি , এমন চোখ কজনের আছে হ্যা , আর কি সুন্দর লাগে হাসলে” আয়শা রেগে যায় , সত্যি বলতে মেয়ে কালো হয়েছে বলে প্রথম প্রথম আয়শার মনে দুঃখ ছিলো , রানী অমন ফর্সা আর জান্নাত হয়েছে কালো । কোনদিন ঈর্ষা না হলেও একটা চাপা দুঃখ ছিলো । আর থাকবেই বা না কেন আশেপাশের মেয়েরা , এমন কি জান্নাতের ফুপুরাও জান্নাত কে কালো বলতো ।
তবে আফরোজা ওকে একদিন কড়া ভাবে শাসন করেছিলো এর জন্য । বুঝিয়েছিলো , যদি মা হয়ে ও নিজেই হীনমন্যতায় ভোগে তাহলে এই মেয়ে কোনদিন নিজেকে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারবে না , সব সময় সংকোচ থাকবে কালো বলে । সেই থেকে আয়শা কোনদিন মেয়েকে বুঝতে দেয়নি যে মেয়ে কালো । কেউ যদি কোনদিন বলতো তাহলে আফরোজা আর ও দুজনে মিলে ঝগড়া লাগিয়ে দিতো । এর পর থেকে পাড়া পড়শি তো দুরের কথা কোনদিন জান্নাতের ফুপুরাও জান্নতের গায়ের রং নিয়ে কথা তুলতে সাহস করেনি ।
“ তাই নাকি ? তাহলে বলছো , ওই হাবা ছেলেটা তোমার মেয়েকে পছন্দ করবে” জান্নাত মা কে আরো টাইট করে জড়িয়ে ধরে ।
“ কোন হাবা ছেলে , একদিন নিয়ে আয় না আমার সামনে , আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি”
“ সময় হলে নিয়ে আসবো , এখন বলো তুমি কি কাজে এসেছিলে “ জান্নাত এই বিসয়ে মায়ের সাথে আর কথা বলতে চায় না । নইলে মা ছাড়বে না ।
“ ওহ দেখ ভুলেই গেছি , রানীর জন্য সুপ রান্না করেছি , কিন্তু আজকে হাটুতে এতো ব্যাথা করছে যে যেতে পারছি না , তুই দিয়ে আয় না মা “ আয়শা করুন স্বরে বলে , সাধারনত জান্নাত এই কাজ করতে চায় না । সেই ভয় থেকেই আয়শা এমন ভাবে বলল ।
“ ওকে মাম্মি জাচ্ছি , যাও তুমি রেডি করে আনো” কিন্তু আয়শা কে অবাক করে দিয়ে জান্নাত একবারেই রাজি হয়ে যায় ।
আয়শা একটু অবাক হলেও কিছু বলে না । সুপ রেডি করার জন্য চলে যায় । আর মা চলে যেতেই জান্নাত আয়নার সামনে দাড়ায় । চুল গুলো গুছিয়ে নেয় , পোশাক পরিপাটি করে নেয় । নিজেকে বার বার আয়নায় দেখে নিজেই হাসে । বলে ‘রেডি থাকো হাবা ছেলে , আমি আসছি’
সুপের বাটি নিয়ে জান্নাত কে সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে আয়শার মনে একটা ব্যাপার কাঁটার মত বিঁধে । মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে , ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে । মেয়ে আর বেশিদিন ওর সাথে থাকবে না । তখন বাড়িতে আয়শার সময় কিভাবে কাটবে সেটা ভেবে আয়শার মন ভার হয়ে আসে । এই বাড়িতে এক মাত্র জান্নত ই মায়ের সাথে খোলা মনে গল্প করে । জয়নাল আর আগের মত সময় দেয় না । ব্যাবসার কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই খাওয়াদাওয়া করে টিভিতে টকশো দেখে । আর জয় তো জয় ই কথন বাড়িতে থাকে কখন থাকে না সেটাই বলা মুশকিল । আজকাল তো আরো বেশি বাড়িতে পাওয়া যায় না । কি রাজনীতিতে ঢুকেছে , কত ভাবে বুঝিয়েছে আয়শা কিন্তু লাভ হয়নি । মাঝে মাঝে আয়শা ভাবে ছেলের একটা বিয়ে করিয়ে দিবে , পাত্রীও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে , কিন্তু জয়ের আচরণ দেখে সাহস হয় না ।
****
কেউ কথা রাখে না
আসবো বলেও আসে না।
কথা রাখে সুধু একাকীত্ব ,
কখনো ছেড়ে যায় না।
আসবো বলেও আসে না।
কথা রাখে সুধু একাকীত্ব ,
কখনো ছেড়ে যায় না।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)