27-09-2025, 08:45 PM
কিছু সম্পর্কঃ ৬ (ঝ)
গার্ডের চোখের সামনে দিয়ে পাশ কার্ড দেখাতে দেখাতে জয় লিফটের দিকে এগিয়ে যায় । ভিজিটিং আওয়ার নয় বলে লিফটের সামনে ভিড় নেই । দুজন নার্স সুধু জয়ের সাথে লিফটে , একজন ছেলে একজন মেয়ে । জয় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে। মেয়ে নার্সটি বেশ লজ্জা পেয়ে যায় , নিচের দিকে তাকিয়ে হাসে । সেটা দেখে পাশের ছেলে নার্সটি বেশ গম্ভির ভাবে তাকায়।
মনে মনে জয় হাসে , ভাবে ওদের মাঝে মনেহয় কোন সম্পর্ক আছে । কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময় পায় না , লিফট দ্রুত ওকে নির্ধারিত ফ্লোরে নিয়ে আসে । বের হওয়ার সময় জয় দুজনের উদ্দেশ্যে হাত নারে । করিডোর ধরে হেটে হেটে ৫০৪ লেখা দরজার সামনে এসে দাড়ায় । অবাক হয়ে খেয়াল করে ও বেশ নার্ভাস । খুব আশ্চর্য হয় , জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের সামনা সামনি হতে নার্ভাস ফিল করছে ।
জয় এক পাশের ভ্রু উঁচু করে , নিজের দিকেই তাকায় । মনে মনে বলে , ‘ ওই ব্যাটা জয় তোর আবার কি হলো? নার্ভাস হওয়া যাবে না একদম , ফ্রন্ট ফুটে খেল ব্যাটা , তুই তো বাঘের বাচ্চা’ । একটা বড় করে শ্বাস নেয় , বেশ শব্দ করে আবার সেই বাতাস ফুস্ফুস থেকে বের করে দেয় । তারপর দরজার নব ধরে মোচড় দেয় । কিন্তু সেটা ভেতর থেকে বন্ধ ।
জয় দরজায় মৃদু টোকা দেয় । দুবার টোকা দেয়ার পর জান্নাত দরজা খুলে দেয় । জয় কে দেখে বেশ অবাক হয় জান্নাত । ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে জয়ের দিকে ।
“ ঢুকতে দিবি , না দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকবি” জয় জান্নাতের অবাক দৃষ্টি দেখে হেসে বলে ।
“ তুই এখানে ?” জান্নাত দরজা থেকে দূরে গিয়ে প্রশ্ন করে । ওর কণ্ঠ শুনেই বোঝা যায় কতটা অবাক হয়েছে জান্নাত । কোন আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে থাকলে জয় কে ধরে বেধেও নেয়া যায় না । আর আজকে দুইবার চলে এসেছে । জান্নাতের ইন্টুএশন বলছে ডাল ম্যা কুছ কালা আছে , কি সেই কালা জিনিসটা কি জান্নাত বুঝতে পারে না ।
জয় প্রথমেই রানীর দিকে নজর দেয় , কিন্তু ওকে হতাশ হতে হয় , রানী ঘুমাচ্ছে । জয় সোফার দিকে এগিয়ে যায় , হাত পা ছড়িয়ে বসে পরে । তারপর জান্নাতের দিকে তাকায় । জান্নাত দু হাত বুকের কাছে ভাজ করে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে , ওর দৃষ্টিতে এখনো সেই প্রশ্ন ঝুলছে , ‘ তুই এখানে’।
“ আরে এলাম দেখতে তোর কি অবস্থা , কাল রাত থেকে আছিস ঠিক মত ঘুমাইতে পারলি কিনা , খাওয়া দাওয়া হইসে কিনা” জয় হাসতে হাসতে বলে । যদিও এখনো গত রাতে জান্নাতের বেয়াদবি এখনো ভুলতে পারেনি , তবে জয় এখন জান্নাত কে ক্ষেপাতে চায় না । গতকালের ওই প্রতিশোধ অন্য কোন একদিন নিয়ে নেবে ।
“ তাই!!! আমার প্রতি তোর এতো দরদ” জান্নাত জয়ের কথায় যতটা না অবাক হয়ে তারচেয়ে বেশি অবাক হওয়ার ভান করে। জয় কে জান্নাত হাড়ে হাড়ে চেনে , নিশ্চয়ই ওর কোন মতলব আছে , মতলব ছাড়া ও কোন কাজ করে না ।
“ তুই না স্বীকার করলে কি হবে , আমি তো আর ভুলে যেতে পারি না যে তুই আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছোট বোন” জয় আহ্লাদি একটা ভাব নিয়ে বলে ।
“ ওরে ওরে আমার বড় ভাইয়া রে” জান্নাত ও বেঙ্গ করে বলে , এখনো জয়ের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে , ও চায় কি চেতা বুঝতে চেষ্টা করছে ।
“ আচ্ছা এসব বাদ দে , তুই খেয়েছিস?”
“ না এখনো খাইনি”
“ তাহলে যা বিরিয়ানি নিয়া আয়” এই বলে মানিবেগ থেকে টাকা বের করে দেয় , তারপর আবার কি যেন ভাবে , তারপর বলে “ নাহ বিরিয়ানি না , বিরিয়ানি খেলে ঘরে গন্ধে ভরে যাবে , এক কাজ কর , সামনে পিজ্জা হাট আছে , একটা পিজা নিয়ে আয়, দুজনে খাই , আমিও খাই নাই”
“ যা ভাগ , এই রোদে আমি বের হইতে পারবো না , তুই নিয়া আসতে পারলি না” জান্নাত রেগে গিয়ে চেয়ারে বসে পরে।
“এই আমি কি শুনলাম , তোর মত একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে সামান্য রোদের ভয়ে বাইরে যেতে চায় না, কালো হয়ে যাওয়ার ভয়ে!!!” জয় সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলে । তারপর আবার বলতে শুরু করে “ আমাদের দুর্ধর্ষ সাংবাদিক জান্নাত চৌধুরী , রোদের ভয়ে বাইরে যাচ্ছে না , এই খবর বাইরে রটলে কি হইবো তুই জানিস” জয় একদম জান্নাতের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে । জয় জানে এবার আর জান্নাতের অন্য কোন পথ খোলা নেই । ওকে যেতেই হবে , কারন ওর ইজ্জতের সাওয়াল ।
জয়ের হাতে একটা হাজার টাকার নোট , জান্নাত মনে মনে হিসাব করে , একটা পিজ্জা ৮০০ বেঁচে যাবে দুশো । কিন্তু মাত্র ২০০ টাকার জন্য এই দুপুর বেলা বের হতে মন চায় না । জান্নাত বলে “ আরো টাকা লাগবে”
বলার সাথে সাথে জান্নাত কে অবাক করে দিয়ে জয় আরো একটা হাজার টাকার নোত বের করে দেয় । চোখে মুখে অবিশ্বাস নিয়ে জান্নাত জয়ের হাত থেকে টাকা নেয় । জান্নাত জানে জয় কিপ্টে না , কিন্তু সুধু ওর বেলাতেই টাকা খরচ করতে বাধে জয়ের। কিন্তু আজকে এমন উদার আচরণ দেখে অবাক না হয়ে পারে না । তার উপর গতকাল রাতে ওর সাথে বাধাবাধি হয়ে গেছে এক দফা । তারপর ও জয় এতো উদার আচরণ করছে !! জান্নাতের মন খুতখুত করতে থাকে , মাথার ভেতর টর্নেডো চলছে , ভেবে বের করার চেষ্টা করছে , জয় কি চায় , এটা কি ওর প্রতিশোধের জাল?
যদিও টাকা হাতে নেয় তারপর ও ওঠে না জান্নাত চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে ।
“ কিরে যা , এমন ইদুরের মত তাকিয়ে আছিস ক্যান?” জয় একটু বিরক্ত হয়েই বলে ।
“ সত্যি করে বল তোর কোন মতলব নাই তো?” জান্নাত জিজ্ঞাস করে , আসলে পিজ্জা খাওয়ার এই সুযোগ ও ছাড়তে চাইছে না । ওর মা যে রান্না করে নিয়ে এসেছে , সে সব খাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই । আবার বাইরেও যেতে পারছিলোনা , কারন রানী একা থাকবে, এই ভেবে ।
“ দে ভাই তুই আমার টাকা দে , তোর যাওয়া লাগবে না” জয় সত্যি সত্যি বিরক্ত হওয়ার ভান করে ।
“ না থাক জাচ্ছি , তবে তুই কিন্তু ঠিক মত খেয়াল রাখিস , আবার বের হয়ে এদিক সেদিক চলে যাস না , রানীর কাশি উঠলে ঐখানে একটা ইনহেলার আছে সেটা দিবি , এর পর ও যদি না থামে নার্স ডাকবি” জান্নাত জয় কে সব কিছু দেখিয়ে দেয় ।
“ যা রে আমার আম্মা , আমারে এতো শিখাইতে হবে না, আমি ম্যানেজ করে নিবো” জয় তাড়া দেয় , মনে মনে অবশ্য জান্নতের গুষ্ঠি উদ্ধার করছে । কারন রাজীব চলে আসলে সব ভেস্তে যাবে ।
জান্নাত নিজের ওড়না নিয়ে মাথায় স্কার্ফের মত পরে নেয় , তারপর আরো একবার জয় কে সাবধান করে বেড়িয়ে যায় ।
জান্নাত চলে যেতেই জয় রানীর বেডের পাশের চেয়ারে বসে , রানী ঘুমাচ্ছে , মলিন মুখটা দেখতে একটা নিষ্পাপ শিশুর মত লাগছে । চোখ দুটো কোটরের ভেতর চলে গেছে অনেকটা , চোখের নিচে হালকা কালির দাগ ও পরেছে । জয়ের মন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে , প্রচণ্ড দরদে , হৃদপিণ্ডে কাঁপুনি অনুভব করে । ছুঁয়ে দেখার কামন বহু কষ্টে প্রশমিত করে ।
ঘুমের মাঝে রানীর মুখতায় একটা প্রশান্তির ছাপ পরেছে । জয়ের ইচ্ছে হয় না রানীকে তুলতে । কিন্তু ওর যে রানীর সাথে কথা বলা ভীষণ জরুরি । আর সময় ও হাতে নেই , জান্নাতের সর্বমোট পঁয়তাল্লিশ থেকে এক ঘন্টা সময় লাগবে । আর রাজীব কখন চলে আসবে তার ঠিক নেই । জয় ধিরে ধিরে নিজের মুখ রানীর কানের কাছে নিয়ে যায় , প্রথমেই ডাকে না , আসলে ডাকতে পারে না । কারন এই প্রথম জয় রানীর এতো কাছাকাছি এসেছে । অসুস্থ থাকায় রানী কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যাবহার করেনি । রানীর শরীরের ন্যাচারাল সুবাস এসে জয়ের নাকে লেগেছে ।
রানীর শরীরের সুবাস যেন কোন শক্তিশালী ড্রাগের চেয়ও শক্তিশালী । মুহূর্তে জয়ের শরীর মন কে অবস করে ফেলে । এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে জয়ের উপর যে জয় সরে যেতে চেয়েও যেতে পারে না । জয় মনে মনে ভাবে রানী কি ভাবাবে যদি এখন জেগে উঠে এই অবস্থা দেখে । তাই জয় মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সরে আসার সিধান্ত নেয় , কিন্তু ওর মস্তিস্কের লাগাম যেন অন্য আর একজনের হাতে । সেই অন্য একজনটা সিদ্ধান্ত নেয় , আর একবার মন ভরে শ্বাস নেবে । লম্বা করে শ্বাস টানে , আর তখনি জেগে ওঠে রানী ।
****
জান্নাত পিজ্জার দোকানে বসে বসে ওয়েট করছে , সাধারনত এরা ২০ মিনিট সময় নেয় , কিন্তু আজকে অনেক ভিড় । তাই বোঝাই যাচ্ছে বেশ দেরি হবে । জান্নাত বসে বসে গত রাতের কথা চিন্তা করতে থাকে । ভোরে যখন রানী কাশতে কাশতে খুব পাচ্ছিলো তখন ওর ঘুম ভেঙ্গে যায় । ঘুম ভেঙ্গে দেখে রাজীব বোকার মত দাড়িয়ে আছে । কি করবে বুঝতে পারছে না । এদিকে রানী কাশতে কাশতে বার বার বুক খামছে ধরছে । এই পরিস্থিতে কি করতে হবে জান্নাতের ও তেমন কোন আইডিয়া ছিলো না। কিন্তু হঠাত করেই ওর মনে পরে যায় , একবার ওর বুকেও কফ জমে গিয়ে কাশতে খুব কষ্ট হতো , তখন ওর মা বুকে হাত দিয়ে মালিশ করে দিলে একটু আরাম হতো । তাই দ্রুত রাজীব কে সরিয়ে দিয়ে রানীর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে ।
রানীর বুকে হাত বুলাতে বুলাতে রাজীবের দিকে একবার তাকিয়েছিলো , দিশেহারা দৃষ্টি দেখতে পেয়েছিলো জান্নাত । তখন গত রাতে রাজীবের আচরণের কারনে যে রাগ হয়েছিলো সেটা চলে যায় । সেই জায়গাটা নিয়ে নেয় মায়া , হ্যা মায়ায় ভরে উঠেছিলো জান্নাতের মন রাজীবের জন্য । মায়ের আদর বঞ্চিত এই ছেলেটি সুধু যে নিজে একা একা বড় হয়েছে এমন নয় , ছোট বোন কেও বড় করেছে । জান্নাত এই ভেবে খুব কাতর হয়েছিলো যে , না জানি কতদিন এমন দিশেহারা হতে হয়েছে ছেলেটাকে। জান্নাত কিছুটা জানে যে ছোট আব্বু ওদের তেমন কোন সময় দিতে পারে নি , প্রায় ওর মা বাবা কে এ নিয়ে কথা বলতে শুনতো ও। তখন ওই কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি জন্নাত । কিন্তু রাজীবের দিশেহারা দৃষ্টি দেখে , বুঝতে পেরেছিলো , এই দুই ভাই বোন মা হীন জীবনে কত শক্ত সময় পার করেছে , যা জান্নাত বা জয় চিন্তাও করতে পারবে না ।
জান্নাত তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো , এই দুজনের সাথে ও সব সময় থাকবে । যত কঠিন সময় ই আসুক , নিজে যেখানেই থাকুক । রাজীব আর রানীর জন্য সবসময় ওর সময়ের কিছুটা হলেও বরাদ্দ থাকবে । বিশেষ করে রাজীবের জন্য , এই ছেলেটাকে ও একা থাকতে দেবে না , কিছুতেই না । জান্নাত জানে ওর চলার পথ সহজ হবে না , রাজীব জীবনেও মুখ ফুটে বলবে না । কারন ওর সমস্তটা জড়িয়ে রয়েছে দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাদর । আর রাজীব সুচারু রুপে পালন ও করছে এইসব কর্তব্য । আর এই কারনেই জান্নাত রাজীব কে এতো পছন্দ করে । জান্নাতের মনে আছে , রাজীবের এইচ এস সি পরিক্ষার রেজাল্টের পর যখন ওরা এসেছিলো । তখন জান্নাত দু থেকে দেখেছিলো , রাজীব কি সুন্দর ভাবেই মায়ের জন্য কান্নারত রানী কে হ্যান্ডেল করেছিলো। কতটা কম্প্যাশন আর সফটনেস এর সাথে ছোট বোনের মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে গিয়েছিলো । সেদিন ই জান্নাত রাজীবের জন্য প্রথম বিশেষ একটা অনুভূতি অনুভব করে । জান্নাত চায় রাজীবের মত একজন ওর জীবনেও আসুক । ওকে এভাবে ট্রিট করুক ।
নার্স এসে যখন রানীকে নেবুলাইজার দিয়ে শান্ত করে , এর কিছুক্ষন পর রানী ঘুমিয়ে পরে । এর পর রাজীবের সাথে অনেক কথা হয়েছে জান্নাতের । না রাজীব রোমান্টিক কথাও বলতে পারে না , হাস্যকর জোকস ও পারে না । রাজীব নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনিয়েছে , রানীকে নিয়ে ওর প্ল্যান শুনিয়েছে , এবং গতকাল থেকে যে একটা ব্যাপার রাজীব কে খুব ভাবাচ্ছে সেটাও শুনিয়েছে । রাজীব বলেছিলো যে রানীর সাথে কোন একটা ছেলের সম্পর্ক আছে , এবং রানী বার বার ঘুমের ঘোরে সেই ছেলের সাথে কথা বলেছে । এওং জান্নাতের সাহায্য চেয়েছে যেন কে ওই ছেলে , সেটা খুজে বের করতে পারে । রাজীব চায় না রানী কোন ভুল মানুষের পাল্লায় পরুক । জান্নাত কথা দিয়েছে , যে ও হেল্প করেবে ।
হঠাত করেই জান্নাতের মাথায় একটা প্রশ্ন আসে । সকালের রাজীব আর ওর মাঝে কনথপকথন থেকে এবং জয়ের উটভট আচরনের কারনেই প্রশ্নটা আসে মাথায় । রাজীবের বলা ওই ছেলে জয় নয় তো ? প্রশ্নটা মনে জাগতেই জান্নাত ভীষণ চিন্তায় পরে যায় ।
একে একে অনেক গুলো ব্যাপার জান্নাতের চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আগে এই ব্যাপার গুলোকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি ।আসলে তখন গুরুত্বই দেয়নি । জান্নাতে দেখছে সিএ উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই জয়রে নাম উঠেই রানীর ঠোঁটে একটা লাজুক হাসি ফুটে ওঠে । অথবা জয় কে দেখলেই কেমন লাল হয়ে যায় , চোরা চোখে তাকায় । অথবা জান্নাতদের বাড়ি আসার সময় চোখে কাজল দিয়ে আসে , কলাপে ছোট করে টিপ দেয় , একদম পরিপাটি ভাবে আসে , জান্নাত ওই সময় কোনদিন রানী কে সাধারন ঘরের পোষাকে ওদের বাড়ি আসতে দেখনি । কোনদিন যদি জান্নাত রানী কে সাথে করে নিয়ে আসতে চেয়েছে , আর তখন যদি জয়ের বাড়ি থাকার সম্ভাবনা থেকেছে , রানী কোন না কোন বাহানা দিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে , বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তবে এসেছে । এর জন্য মায়ের কাছে জান্নাত প্রচুর কথা শুনছে , ওর মা সব সময় রানী কে এমন পরিপাটি থাকার জন্য খুব পছন্দ করে , আর জান্নাত কে অগোছালো থাকার কারনে কথা শোনায় । আজ পর্যন্ত জান্নাত রানীর এসব আচরণ নিয়ে কিছু ভাবেনি ।
তা ছাড়া বেশ কয়েকবার জান্নাত লক্ষ্য করেছে , জয় আর রানীকে রানীদের ছাদের উপর । জন্নাত একবার জিজ্ঞাস করেছিলো , কিন্তু রানী কোন উত্তর দেয়নি , এড়িয়ে গিয়েছিলো । এ ছাড়া ক্যাম্পাসেও রানী আর জায় কে কয়েকবার দেখছে ।
আর আজকে জয়ের বার বার হসপিটাল চলে আসা , ওকে পিজ্জা নিতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া । জান্নাত্য যত ভাবে তত ওর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে । জয় ওর নিজের ভাই , কিন্তু রানী আর রাজীব ও ওর পর নয় । রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একি পরিবার হিসেবে বড় হয়েছে ওরা । তা ছাড়া রাজীব আর জয়ের মাঝে আগে ভাইয়ের মত সম্পর্ক থাকলেও এখন সম্পর্ক ভালো নয় । দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে , এবং দুজনেই একটু বেশি বেশি রিয়েক্ট করেছে । কিন্তু এখন যদি রাজীব জানতে পারে জয় ই রানীর সেই মিস্ট্রি বয় ফ্রেন্ড তাহলে হয়তো ওদের সম্পর্ক আর কোনদিন জোড়া লাগবে না । কারন রাজীব রানীর শরীরের এই হালের জন্য ওই ছেলেকে প্রক্ষান্তরে জয় কেই দায়ি মনে করছে ।
তা ছাড়া জয়ের ইতিহাস জান্নাত জানে , ছোট বোন বলে কোনদিন এসব নিয়ে আলাপ হয়নি । কিন্তু জান্নাত জানে , জয় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে । তাছাড়া জয়ের অতীত বাদ দিলেও জয় রানীর জন্য সঠিক ছেলে নয় । হ্যা জয় ওর ভাই , তাই বলে বোনের মত ান্ধবিকে তো জেনে শুনে এমন একজনের কাছে ছেড়ে দিতে পারে না । জয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে , কোন বিসয়ে সিরিয়াস নয় । আর রানীর মত একটা নরম মনের মেয়ে জয়ের এই আচরণ সহ্য করতে পারবে না ।
আর এমন যদি হয় , তাহলে সুধু সমস্যা জয় আর রানীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না , দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবারের সবার উপর এর প্রভাব পরবে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই অর্ডার করা পিজ্জা চলে আসে । জান্নাত দাম মিটিয়ে বেড়িয়ে এসে রিক্সা নেয় । রিক্সায় বসে বসে জান্নাতের মনে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলতে থাকে , ভেবে পায় না ও কি করবে । যদি ওর অনুমান সত্যি হয় , তাহলে কি ও রাজীব কে জানাবে ? যদি জানায় এর ফলাফল কি হবে , রাজীব কি সব জেনেশুনে রানীর সাথে জয়ের সম্পর্ক মেনে নেবে । কারন এই দুনিয়ায় জয় কে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনে রাজীব । জয়ের সব কীর্তির সাক্ষি রাজীব । কোন ভাই ই বোনের জন্য এমন ছেলে চাইবে না ।
আর এতে করে রানীর রিএকশন ই বা কি হবে , কত দূর এগিয়ে গেছে জয় আর ও? রাজীব যদি বাধা দেয় তাহলে কি রানী আর রাজীবের সম্পর্কের অবনতি হবে না? রানী কি মুখ বুজে ওর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে রাজীবকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে ?
হাসপাতালের একদম কাছাকাছি এসে জান্নাত সিদ্ধান্ত নেয় , সুধু অনুমানের উপর কোন সিদ্ধান্ত ও নেবে না । এই নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করবে । জয় বা রানী কে সরাসরি জিজ্ঞাস করে লাভ নেই । হাতে প্রমান নিয়ে ও এই দুজনের সামনা সামনি হবে।
যত দ্রুত সম্ভব জান্নাত রানীর কেবিনে চলে আসে , দরজা খোলা , ভেতরে রানী একা বসে , মুখ থমথমে , চেহারায় একটা কনফিউশন দেখা যাচ্ছে , সেই সাথে ভয় ।
জান্নাত জিজ্ঞাস করে “ জয় কোথায়?”
রানী ওর দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় “ চলে গেছে”
জান্নাত দেখে যদিও রানী উত্তর দিয়েছে , কিন্তু ওর মন এই কামড়ায় নেই । খুব সিরিয়াস কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারে জান্নাত । কিন্তু জান্নাত বুঝতে পারে না কি ঘটেছে । তবে যা ঘটেছে তা যে রানীকে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে , তা রানীর ফ্যাকাসে মুখ দেখেই বলে দেয়া যাচ্ছে । পিজ্জা খাওয়ার কথা ভুলে যায় জান্নাত । ভয়ের একটা হিম শীতল স্রোত জান্নাতের মেরুদণ্ড বেয়ে নামে । একজন মেয়ে হওয়ার কারনে ও বুঝতে পারছে , সাধারন কথাকাটা কাটি ওদের মাঝে হয়নি । একটি মেয় সুধু মাত্র ঝগড়ার কারনে এমন মুখ করে বসে থাকবে না । হ্যা কান্না করতে পারে , নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে । কিন্তু এমন ভীত আর কনফিউজড হবে না । জান্নাতের কাছে মনে হয় জয় কিছু একটা করেছে , রানী জয়ের কাছ থেকে আশা করেনি ।
ধিরে ধিরে জান্নাত রানীর দিকে এগিয়ে যায় । ওর ভাবতেও ভয় লাগে যদি জয় উল্টাপাল্টা কিছু করে থাকে তাহলে দুই পরিবারের মাঝে কি ঝড় শুরু হবে । আর ওর আর রাজীবের শুরু না হওয়া গল্পের ও বা কি এন্ডিং হবে ?
****
রাজীব হসপিটালে ফেরে প্রায় বিকেল পাঁচটায় । জান্নাত ওকে ভরসা দিয়ে পাঠিয়েছে যে , ও রানীর খেয়াল রাখবে । অবশ্য এতে রাজীবের খুব উপকার হয়েছে । জান্নাত মেয়েটার জন্য অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে রাজীবের মনে । ভাবে সব সময় যদি এমন কেউ ওর পাশে থাকতো । তাহলে জীবন কত সহজ হতো । গত রাত প্রায় নির্ঘুম কেটেছে , তারপর ও আজকে একটুও ক্লান্তি লাগেনি । বার বার মনে হয়েছে , কেউ একজন ওর পাশে আছে । যত কষ্টই হোক এমন কেউ আছে যে ওর কষ্ট ভাগ করে নেবে । ঘুম নেই গোসল নেই তবুও মন ছিলো ফুরফুরে । সেউ ফুরফুরে মন নিয়েই রাজীব ৫০৪ নাম্বার কেবিনের দরজা ঠেলে ঢোকে , মনে আশা জান্নাতের হাসি মুখটা দেখবে ।
কিন্তু রুমে ঢুকেই , মনের সেই ফুরফুরা ভাব উধাও হয়ে যায় । রুমের ভেতর যেন একটা গুমট বাতস আটকে আছে । এয়ার ফ্রেশনারের সুগন্ধ আর এসির শীতল বাতাস ছাপিয়ে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি বোঝা যাচ্ছে । রাজীব প্রথমে জান্নাতের মুখের দিকে তাকায় , ওর মুখ থমথমে । তারপর রানীর দিকে তাকায় , দেখেই বোঝা জাচ্ছে কান্না আটকে রেখছে ।
রাজীবের বুক ধড়াস করে ওঠে , কি হতে পারে এই ভাবতে ভাবতে মাথা হ্যাং করে যায় । একবার ভাবে রানীর কি অন্য কোন অসুখ ধরা পরেছে , ডাক্তার কি পরে আর কিছু টেস্ট করিয়েছে । কিন্তু এতো কম সময়ে কি এসব বুঝতে পারা সম্ভব?
রাজীব রানীর কাছে যায় , জিজ্ঞাস করে “ কিরে তোর কি হয়েছে?”
রাজীবের গলার স্বর যেন রানীর চোখের বাধে হাতুরির আঘাত করে । ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রানী , না সুধু চোখের পানিতে সীমাবদ্ধ নেই এই কান্না । শব্দ করে বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদতে থাকে , আর বার বার বলতে থাকে “ ভাইয়া আমাকে বাসায় নিয়া চল , আমি আর থাকবো না এইখানে”
রাজীব আর জান্নাত দুজনেই অনেক বোঝাতে চেষ্টা করে , কিন্তু রানী কিছুতেই মানবে না । রানী কে সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে রাজীব জান্নাতের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় । সেই দৃষ্টির উত্তরে জান্নাত সুধু লজ্জিত দৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। রাজীব কে বলেছিল রানীর খেয়াল রাখবে , কিন্তু সেই কাজ ও করতে পারেনি । তাই জান্নাত ভীষণ ভাবে লজ্জিত । সুধু রাজীবের কাছেই লজ্জিত নয় , নিজের কাছেও লজ্জিত । যদি ও তখন রানীকে জয়ের কাছে না রেখে যেতো তাহলে আর এই সমস্যা হতো না ।
কিন্তু জান্নাত রাজীব কে বুঝতে দেয় না যে ও বাইরে গিয়েছিলো , যদিও রাজীব এ ব্যাপারে কিছুই জানতে চায় নি । জানতে চাইলে কি বলবে তাই ভেবে জান্নাতের গলা শুকিয়ে আসে ।
এদিকে রাজীব পরেছে অথৈ সাগরে । রানীর এই দিকটার সাথে অনেকদিন সাক্ষাত হয় না ওর । আগে রানী প্রায় এমন জেদ করতো । কিন্তু তখন রানী ছিলো ছোট , নানা রকম ভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিতো রাজীব । এমন কি রানী মাঝে মাঝে রাজীব কে আঁচরে কামড়ে নিজেই শান্ত হয়ে যেতো । রানী এই ধরনের আচরণ করতো যখন বাইরে কেউ ওর সাথে কোন খারাপ আচরণ করতো । মুখচোরা রানী বাইরে কিছু বলতে বা করতে পারতো না , কিন্তু ঘরে এসে প্রচণ্ড জেদ করতো ।
কিন্তু বয়স বারার সাথে সাথে এই সমস্যাও কমে এসেছিলো । বেশিরভাগ সময় নিজের মাঝেই চেপে রাখতো , মাঝে মাঝে রাজীব বুঝতে পারলে , খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে সান্তনা দিতো । কিন্তু এই এডাল্ট রানীকে কি করে শান্তো করবে রাজীব বুঝে পায় না । তবুও জিজ্ঞাস করে “ কি হয়েছে তোর , কে কি বলেছে?”
প্রস্নটা করেই জান্নাতের দিকে তাকায় রাজীব , ভাবে প্রশ্নটা করা ওর উচিৎ হয়নি , কারন এখানে সুধু জান্নাত ই ছিলো । আর জান্নাত রানীকে কখনোই এমন কিছু বলবে না বা করবে না যে রানী এমন করবে । রাজীব নিজের সরবচ্চ চেষ্টা করে , রানী কে থামানোর । কিন্তু সফল হয় না ।শব্দ করে বিলাপ করে কাঁদে রানী ।
এদিকে জান্নাত ওর মা কে কল করে । শুনে আয়শা বিচলিত হয়ে ওঠে । রানীর সাথে ফোনে কথা বলতে চায় , কিন্তু রানী নারাজ । শেষে উপায় না দেখে আয়শা বলে “ তোরা থাক আমি আসছি”
আধ ঘন্টার মাঝে আয়শা, রহিম আর জয়নাল এসে হাজির হয় । কিন্তু ততক্ষণে রানী একদম চুপ হয়ে গেছে । কারো সাথে কথা বলে না । তবে বাড়ি যাওয়ার জেদ ও করে না ।
রাজীব জানে কাজটা ঠিক হয়নি , রানীর মনের ঝড় থামেনি । জাস্ট দরজা জানালা গুলো বন্ধ হয়েছে । রানী এতো মানুষের সামনে কখনোই নিজের মনের দরজা জানালা খুলবে না । আজকেও অনেক রাত পর্যন্ত সবাই থাকে । এবং আয়শা ঘোষণা করে যে আজকে ও থাকবে । আজকে আর কেউ বাধা দেয়না । বিশেষ করে জান্নাত , কারন জান্নাতের ভয় হয় সবাই চলে গেলে যদি রাজীব এই নিয়ে আলোচনা করতে চায় তাহলে ও কি উত্তর দেবে । তাছাড়া জয়ের সাথে ওর বোঝাপড়া আছে , কি এমন করেছে জয় যে রানী এমন করছে ।
****
জান্নাত বসে আছে , কান শার্প । রাত প্রায় সারে বারোটা , জয় এখনো বাসায় ফেরেনি । জয়নাল এই নিয়ে কিছুক্ষন আগে রাগারাগি করে ঘুমাতে গেছে । জেগে আছে জান্নাত নিজের নখে দাঁতে শাণ দিচ্ছে । আজকে আর বড় ভাই ছোট বোনের সম্পর্ক মাথায় রাখবে না ও । ঘটনার আকস্মিকতায় রাজীব হয়তো ওকে ঠিক ভাবে জিজ্ঞাস করেনি । কিন্তু রাজীব জিজ্ঞাস করবে । আর তখন হয়তো জান্নাত বলতে বাধ্য হবে যে ও বাইরে গিয়েছিলো , এবং তখন জয় ছিলো রানীর সাথে । জান্নাত যদি সত্যি না জানতে পারে তবে , এই নিয়ে জল অনেক দূর গড়াতে পারে । সত্যটা বের করতে পারলে জান্নাত নিজেই রানীর সাথে কথা বলে এসব মিটিয়ে নিতে পারবে । পারতেই যে হবে ওকে , কারন এই দুই পরিবারের সম্পর্ক ওর কাছে অনেক মূল্যবান । রাজীব ওর কাছে অনেক মূল্যবান । ও কিছুতেই রাজীব কে হারাতে পারবে না । ওর জীবনে রাজীবের খুব দরকার , আর রাজীবের জীবনেও ওকে দরকার ।
প্রায় মিনিট পনেরো পর দরজা খোলার খুট শব্দ শুনতে পায় জান্নাত । ঘর থেকে বের হয় , দোতলা থেকে নিচের হল ঘরের দিকে তাকায় । না দরজা বন্ধ , তাহলে কি ও ভুল শুনেছে । নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় । আর তখনি সিগারেটের গন্ধ এসে নাকে লাগে । ছাদের সিঁড়ি থেকে কেউ একজন নামছে । পরমুহুরতেই মুখোমুখি হয় জয় আর জান্নাত । জয়ের চোখ লালচে । হঠাত জান্নাত কে সামনে দেখে একটু ভড়কে যায় । দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে জয় । আর তখন জান্নাত সিগারেটের গন্ধ ছাড়াও আরো একটি গন্ধ পায় । চোখ সরু করে তাকায় ভাইয়ের দিকে । শাণ দেয়া নখ আর দাঁত বের করে আনে। নিচু কিন্তু বেশ দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞাস করে “ তুই কি করেছিস?”
******
গার্ডের চোখের সামনে দিয়ে পাশ কার্ড দেখাতে দেখাতে জয় লিফটের দিকে এগিয়ে যায় । ভিজিটিং আওয়ার নয় বলে লিফটের সামনে ভিড় নেই । দুজন নার্স সুধু জয়ের সাথে লিফটে , একজন ছেলে একজন মেয়ে । জয় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে। মেয়ে নার্সটি বেশ লজ্জা পেয়ে যায় , নিচের দিকে তাকিয়ে হাসে । সেটা দেখে পাশের ছেলে নার্সটি বেশ গম্ভির ভাবে তাকায়।
মনে মনে জয় হাসে , ভাবে ওদের মাঝে মনেহয় কোন সম্পর্ক আছে । কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময় পায় না , লিফট দ্রুত ওকে নির্ধারিত ফ্লোরে নিয়ে আসে । বের হওয়ার সময় জয় দুজনের উদ্দেশ্যে হাত নারে । করিডোর ধরে হেটে হেটে ৫০৪ লেখা দরজার সামনে এসে দাড়ায় । অবাক হয়ে খেয়াল করে ও বেশ নার্ভাস । খুব আশ্চর্য হয় , জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের সামনা সামনি হতে নার্ভাস ফিল করছে ।
জয় এক পাশের ভ্রু উঁচু করে , নিজের দিকেই তাকায় । মনে মনে বলে , ‘ ওই ব্যাটা জয় তোর আবার কি হলো? নার্ভাস হওয়া যাবে না একদম , ফ্রন্ট ফুটে খেল ব্যাটা , তুই তো বাঘের বাচ্চা’ । একটা বড় করে শ্বাস নেয় , বেশ শব্দ করে আবার সেই বাতাস ফুস্ফুস থেকে বের করে দেয় । তারপর দরজার নব ধরে মোচড় দেয় । কিন্তু সেটা ভেতর থেকে বন্ধ ।
জয় দরজায় মৃদু টোকা দেয় । দুবার টোকা দেয়ার পর জান্নাত দরজা খুলে দেয় । জয় কে দেখে বেশ অবাক হয় জান্নাত । ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে জয়ের দিকে ।
“ ঢুকতে দিবি , না দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকবি” জয় জান্নাতের অবাক দৃষ্টি দেখে হেসে বলে ।
“ তুই এখানে ?” জান্নাত দরজা থেকে দূরে গিয়ে প্রশ্ন করে । ওর কণ্ঠ শুনেই বোঝা যায় কতটা অবাক হয়েছে জান্নাত । কোন আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে থাকলে জয় কে ধরে বেধেও নেয়া যায় না । আর আজকে দুইবার চলে এসেছে । জান্নাতের ইন্টুএশন বলছে ডাল ম্যা কুছ কালা আছে , কি সেই কালা জিনিসটা কি জান্নাত বুঝতে পারে না ।
জয় প্রথমেই রানীর দিকে নজর দেয় , কিন্তু ওকে হতাশ হতে হয় , রানী ঘুমাচ্ছে । জয় সোফার দিকে এগিয়ে যায় , হাত পা ছড়িয়ে বসে পরে । তারপর জান্নাতের দিকে তাকায় । জান্নাত দু হাত বুকের কাছে ভাজ করে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে , ওর দৃষ্টিতে এখনো সেই প্রশ্ন ঝুলছে , ‘ তুই এখানে’।
“ আরে এলাম দেখতে তোর কি অবস্থা , কাল রাত থেকে আছিস ঠিক মত ঘুমাইতে পারলি কিনা , খাওয়া দাওয়া হইসে কিনা” জয় হাসতে হাসতে বলে । যদিও এখনো গত রাতে জান্নাতের বেয়াদবি এখনো ভুলতে পারেনি , তবে জয় এখন জান্নাত কে ক্ষেপাতে চায় না । গতকালের ওই প্রতিশোধ অন্য কোন একদিন নিয়ে নেবে ।
“ তাই!!! আমার প্রতি তোর এতো দরদ” জান্নাত জয়ের কথায় যতটা না অবাক হয়ে তারচেয়ে বেশি অবাক হওয়ার ভান করে। জয় কে জান্নাত হাড়ে হাড়ে চেনে , নিশ্চয়ই ওর কোন মতলব আছে , মতলব ছাড়া ও কোন কাজ করে না ।
“ তুই না স্বীকার করলে কি হবে , আমি তো আর ভুলে যেতে পারি না যে তুই আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছোট বোন” জয় আহ্লাদি একটা ভাব নিয়ে বলে ।
“ ওরে ওরে আমার বড় ভাইয়া রে” জান্নাত ও বেঙ্গ করে বলে , এখনো জয়ের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে , ও চায় কি চেতা বুঝতে চেষ্টা করছে ।
“ আচ্ছা এসব বাদ দে , তুই খেয়েছিস?”
“ না এখনো খাইনি”
“ তাহলে যা বিরিয়ানি নিয়া আয়” এই বলে মানিবেগ থেকে টাকা বের করে দেয় , তারপর আবার কি যেন ভাবে , তারপর বলে “ নাহ বিরিয়ানি না , বিরিয়ানি খেলে ঘরে গন্ধে ভরে যাবে , এক কাজ কর , সামনে পিজ্জা হাট আছে , একটা পিজা নিয়ে আয়, দুজনে খাই , আমিও খাই নাই”
“ যা ভাগ , এই রোদে আমি বের হইতে পারবো না , তুই নিয়া আসতে পারলি না” জান্নাত রেগে গিয়ে চেয়ারে বসে পরে।
“এই আমি কি শুনলাম , তোর মত একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে সামান্য রোদের ভয়ে বাইরে যেতে চায় না, কালো হয়ে যাওয়ার ভয়ে!!!” জয় সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলে । তারপর আবার বলতে শুরু করে “ আমাদের দুর্ধর্ষ সাংবাদিক জান্নাত চৌধুরী , রোদের ভয়ে বাইরে যাচ্ছে না , এই খবর বাইরে রটলে কি হইবো তুই জানিস” জয় একদম জান্নাতের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে । জয় জানে এবার আর জান্নাতের অন্য কোন পথ খোলা নেই । ওকে যেতেই হবে , কারন ওর ইজ্জতের সাওয়াল ।
জয়ের হাতে একটা হাজার টাকার নোট , জান্নাত মনে মনে হিসাব করে , একটা পিজ্জা ৮০০ বেঁচে যাবে দুশো । কিন্তু মাত্র ২০০ টাকার জন্য এই দুপুর বেলা বের হতে মন চায় না । জান্নাত বলে “ আরো টাকা লাগবে”
বলার সাথে সাথে জান্নাত কে অবাক করে দিয়ে জয় আরো একটা হাজার টাকার নোত বের করে দেয় । চোখে মুখে অবিশ্বাস নিয়ে জান্নাত জয়ের হাত থেকে টাকা নেয় । জান্নাত জানে জয় কিপ্টে না , কিন্তু সুধু ওর বেলাতেই টাকা খরচ করতে বাধে জয়ের। কিন্তু আজকে এমন উদার আচরণ দেখে অবাক না হয়ে পারে না । তার উপর গতকাল রাতে ওর সাথে বাধাবাধি হয়ে গেছে এক দফা । তারপর ও জয় এতো উদার আচরণ করছে !! জান্নাতের মন খুতখুত করতে থাকে , মাথার ভেতর টর্নেডো চলছে , ভেবে বের করার চেষ্টা করছে , জয় কি চায় , এটা কি ওর প্রতিশোধের জাল?
যদিও টাকা হাতে নেয় তারপর ও ওঠে না জান্নাত চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে ।
“ কিরে যা , এমন ইদুরের মত তাকিয়ে আছিস ক্যান?” জয় একটু বিরক্ত হয়েই বলে ।
“ সত্যি করে বল তোর কোন মতলব নাই তো?” জান্নাত জিজ্ঞাস করে , আসলে পিজ্জা খাওয়ার এই সুযোগ ও ছাড়তে চাইছে না । ওর মা যে রান্না করে নিয়ে এসেছে , সে সব খাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই । আবার বাইরেও যেতে পারছিলোনা , কারন রানী একা থাকবে, এই ভেবে ।
“ দে ভাই তুই আমার টাকা দে , তোর যাওয়া লাগবে না” জয় সত্যি সত্যি বিরক্ত হওয়ার ভান করে ।
“ না থাক জাচ্ছি , তবে তুই কিন্তু ঠিক মত খেয়াল রাখিস , আবার বের হয়ে এদিক সেদিক চলে যাস না , রানীর কাশি উঠলে ঐখানে একটা ইনহেলার আছে সেটা দিবি , এর পর ও যদি না থামে নার্স ডাকবি” জান্নাত জয় কে সব কিছু দেখিয়ে দেয় ।
“ যা রে আমার আম্মা , আমারে এতো শিখাইতে হবে না, আমি ম্যানেজ করে নিবো” জয় তাড়া দেয় , মনে মনে অবশ্য জান্নতের গুষ্ঠি উদ্ধার করছে । কারন রাজীব চলে আসলে সব ভেস্তে যাবে ।
জান্নাত নিজের ওড়না নিয়ে মাথায় স্কার্ফের মত পরে নেয় , তারপর আরো একবার জয় কে সাবধান করে বেড়িয়ে যায় ।
জান্নাত চলে যেতেই জয় রানীর বেডের পাশের চেয়ারে বসে , রানী ঘুমাচ্ছে , মলিন মুখটা দেখতে একটা নিষ্পাপ শিশুর মত লাগছে । চোখ দুটো কোটরের ভেতর চলে গেছে অনেকটা , চোখের নিচে হালকা কালির দাগ ও পরেছে । জয়ের মন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে , প্রচণ্ড দরদে , হৃদপিণ্ডে কাঁপুনি অনুভব করে । ছুঁয়ে দেখার কামন বহু কষ্টে প্রশমিত করে ।
ঘুমের মাঝে রানীর মুখতায় একটা প্রশান্তির ছাপ পরেছে । জয়ের ইচ্ছে হয় না রানীকে তুলতে । কিন্তু ওর যে রানীর সাথে কথা বলা ভীষণ জরুরি । আর সময় ও হাতে নেই , জান্নাতের সর্বমোট পঁয়তাল্লিশ থেকে এক ঘন্টা সময় লাগবে । আর রাজীব কখন চলে আসবে তার ঠিক নেই । জয় ধিরে ধিরে নিজের মুখ রানীর কানের কাছে নিয়ে যায় , প্রথমেই ডাকে না , আসলে ডাকতে পারে না । কারন এই প্রথম জয় রানীর এতো কাছাকাছি এসেছে । অসুস্থ থাকায় রানী কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যাবহার করেনি । রানীর শরীরের ন্যাচারাল সুবাস এসে জয়ের নাকে লেগেছে ।
রানীর শরীরের সুবাস যেন কোন শক্তিশালী ড্রাগের চেয়ও শক্তিশালী । মুহূর্তে জয়ের শরীর মন কে অবস করে ফেলে । এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে জয়ের উপর যে জয় সরে যেতে চেয়েও যেতে পারে না । জয় মনে মনে ভাবে রানী কি ভাবাবে যদি এখন জেগে উঠে এই অবস্থা দেখে । তাই জয় মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সরে আসার সিধান্ত নেয় , কিন্তু ওর মস্তিস্কের লাগাম যেন অন্য আর একজনের হাতে । সেই অন্য একজনটা সিদ্ধান্ত নেয় , আর একবার মন ভরে শ্বাস নেবে । লম্বা করে শ্বাস টানে , আর তখনি জেগে ওঠে রানী ।
****
জান্নাত পিজ্জার দোকানে বসে বসে ওয়েট করছে , সাধারনত এরা ২০ মিনিট সময় নেয় , কিন্তু আজকে অনেক ভিড় । তাই বোঝাই যাচ্ছে বেশ দেরি হবে । জান্নাত বসে বসে গত রাতের কথা চিন্তা করতে থাকে । ভোরে যখন রানী কাশতে কাশতে খুব পাচ্ছিলো তখন ওর ঘুম ভেঙ্গে যায় । ঘুম ভেঙ্গে দেখে রাজীব বোকার মত দাড়িয়ে আছে । কি করবে বুঝতে পারছে না । এদিকে রানী কাশতে কাশতে বার বার বুক খামছে ধরছে । এই পরিস্থিতে কি করতে হবে জান্নাতের ও তেমন কোন আইডিয়া ছিলো না। কিন্তু হঠাত করেই ওর মনে পরে যায় , একবার ওর বুকেও কফ জমে গিয়ে কাশতে খুব কষ্ট হতো , তখন ওর মা বুকে হাত দিয়ে মালিশ করে দিলে একটু আরাম হতো । তাই দ্রুত রাজীব কে সরিয়ে দিয়ে রানীর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে ।
রানীর বুকে হাত বুলাতে বুলাতে রাজীবের দিকে একবার তাকিয়েছিলো , দিশেহারা দৃষ্টি দেখতে পেয়েছিলো জান্নাত । তখন গত রাতে রাজীবের আচরণের কারনে যে রাগ হয়েছিলো সেটা চলে যায় । সেই জায়গাটা নিয়ে নেয় মায়া , হ্যা মায়ায় ভরে উঠেছিলো জান্নাতের মন রাজীবের জন্য । মায়ের আদর বঞ্চিত এই ছেলেটি সুধু যে নিজে একা একা বড় হয়েছে এমন নয় , ছোট বোন কেও বড় করেছে । জান্নাত এই ভেবে খুব কাতর হয়েছিলো যে , না জানি কতদিন এমন দিশেহারা হতে হয়েছে ছেলেটাকে। জান্নাত কিছুটা জানে যে ছোট আব্বু ওদের তেমন কোন সময় দিতে পারে নি , প্রায় ওর মা বাবা কে এ নিয়ে কথা বলতে শুনতো ও। তখন ওই কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনি জন্নাত । কিন্তু রাজীবের দিশেহারা দৃষ্টি দেখে , বুঝতে পেরেছিলো , এই দুই ভাই বোন মা হীন জীবনে কত শক্ত সময় পার করেছে , যা জান্নাত বা জয় চিন্তাও করতে পারবে না ।
জান্নাত তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো , এই দুজনের সাথে ও সব সময় থাকবে । যত কঠিন সময় ই আসুক , নিজে যেখানেই থাকুক । রাজীব আর রানীর জন্য সবসময় ওর সময়ের কিছুটা হলেও বরাদ্দ থাকবে । বিশেষ করে রাজীবের জন্য , এই ছেলেটাকে ও একা থাকতে দেবে না , কিছুতেই না । জান্নাত জানে ওর চলার পথ সহজ হবে না , রাজীব জীবনেও মুখ ফুটে বলবে না । কারন ওর সমস্তটা জড়িয়ে রয়েছে দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাদর । আর রাজীব সুচারু রুপে পালন ও করছে এইসব কর্তব্য । আর এই কারনেই জান্নাত রাজীব কে এতো পছন্দ করে । জান্নাতের মনে আছে , রাজীবের এইচ এস সি পরিক্ষার রেজাল্টের পর যখন ওরা এসেছিলো । তখন জান্নাত দু থেকে দেখেছিলো , রাজীব কি সুন্দর ভাবেই মায়ের জন্য কান্নারত রানী কে হ্যান্ডেল করেছিলো। কতটা কম্প্যাশন আর সফটনেস এর সাথে ছোট বোনের মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে গিয়েছিলো । সেদিন ই জান্নাত রাজীবের জন্য প্রথম বিশেষ একটা অনুভূতি অনুভব করে । জান্নাত চায় রাজীবের মত একজন ওর জীবনেও আসুক । ওকে এভাবে ট্রিট করুক ।
নার্স এসে যখন রানীকে নেবুলাইজার দিয়ে শান্ত করে , এর কিছুক্ষন পর রানী ঘুমিয়ে পরে । এর পর রাজীবের সাথে অনেক কথা হয়েছে জান্নাতের । না রাজীব রোমান্টিক কথাও বলতে পারে না , হাস্যকর জোকস ও পারে না । রাজীব নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনিয়েছে , রানীকে নিয়ে ওর প্ল্যান শুনিয়েছে , এবং গতকাল থেকে যে একটা ব্যাপার রাজীব কে খুব ভাবাচ্ছে সেটাও শুনিয়েছে । রাজীব বলেছিলো যে রানীর সাথে কোন একটা ছেলের সম্পর্ক আছে , এবং রানী বার বার ঘুমের ঘোরে সেই ছেলের সাথে কথা বলেছে । এওং জান্নাতের সাহায্য চেয়েছে যেন কে ওই ছেলে , সেটা খুজে বের করতে পারে । রাজীব চায় না রানী কোন ভুল মানুষের পাল্লায় পরুক । জান্নাত কথা দিয়েছে , যে ও হেল্প করেবে ।
হঠাত করেই জান্নাতের মাথায় একটা প্রশ্ন আসে । সকালের রাজীব আর ওর মাঝে কনথপকথন থেকে এবং জয়ের উটভট আচরনের কারনেই প্রশ্নটা আসে মাথায় । রাজীবের বলা ওই ছেলে জয় নয় তো ? প্রশ্নটা মনে জাগতেই জান্নাত ভীষণ চিন্তায় পরে যায় ।
একে একে অনেক গুলো ব্যাপার জান্নাতের চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আগে এই ব্যাপার গুলোকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি ।আসলে তখন গুরুত্বই দেয়নি । জান্নাতে দেখছে সিএ উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই জয়রে নাম উঠেই রানীর ঠোঁটে একটা লাজুক হাসি ফুটে ওঠে । অথবা জয় কে দেখলেই কেমন লাল হয়ে যায় , চোরা চোখে তাকায় । অথবা জান্নাতদের বাড়ি আসার সময় চোখে কাজল দিয়ে আসে , কলাপে ছোট করে টিপ দেয় , একদম পরিপাটি ভাবে আসে , জান্নাত ওই সময় কোনদিন রানী কে সাধারন ঘরের পোষাকে ওদের বাড়ি আসতে দেখনি । কোনদিন যদি জান্নাত রানী কে সাথে করে নিয়ে আসতে চেয়েছে , আর তখন যদি জয়ের বাড়ি থাকার সম্ভাবনা থেকেছে , রানী কোন না কোন বাহানা দিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে , বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তবে এসেছে । এর জন্য মায়ের কাছে জান্নাত প্রচুর কথা শুনছে , ওর মা সব সময় রানী কে এমন পরিপাটি থাকার জন্য খুব পছন্দ করে , আর জান্নাত কে অগোছালো থাকার কারনে কথা শোনায় । আজ পর্যন্ত জান্নাত রানীর এসব আচরণ নিয়ে কিছু ভাবেনি ।
তা ছাড়া বেশ কয়েকবার জান্নাত লক্ষ্য করেছে , জয় আর রানীকে রানীদের ছাদের উপর । জন্নাত একবার জিজ্ঞাস করেছিলো , কিন্তু রানী কোন উত্তর দেয়নি , এড়িয়ে গিয়েছিলো । এ ছাড়া ক্যাম্পাসেও রানী আর জায় কে কয়েকবার দেখছে ।
আর আজকে জয়ের বার বার হসপিটাল চলে আসা , ওকে পিজ্জা নিতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া । জান্নাত্য যত ভাবে তত ওর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে । জয় ওর নিজের ভাই , কিন্তু রানী আর রাজীব ও ওর পর নয় । রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একি পরিবার হিসেবে বড় হয়েছে ওরা । তা ছাড়া রাজীব আর জয়ের মাঝে আগে ভাইয়ের মত সম্পর্ক থাকলেও এখন সম্পর্ক ভালো নয় । দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে , এবং দুজনেই একটু বেশি বেশি রিয়েক্ট করেছে । কিন্তু এখন যদি রাজীব জানতে পারে জয় ই রানীর সেই মিস্ট্রি বয় ফ্রেন্ড তাহলে হয়তো ওদের সম্পর্ক আর কোনদিন জোড়া লাগবে না । কারন রাজীব রানীর শরীরের এই হালের জন্য ওই ছেলেকে প্রক্ষান্তরে জয় কেই দায়ি মনে করছে ।
তা ছাড়া জয়ের ইতিহাস জান্নাত জানে , ছোট বোন বলে কোনদিন এসব নিয়ে আলাপ হয়নি । কিন্তু জান্নাত জানে , জয় এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে । তাছাড়া জয়ের অতীত বাদ দিলেও জয় রানীর জন্য সঠিক ছেলে নয় । হ্যা জয় ওর ভাই , তাই বলে বোনের মত ান্ধবিকে তো জেনে শুনে এমন একজনের কাছে ছেড়ে দিতে পারে না । জয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে , কোন বিসয়ে সিরিয়াস নয় । আর রানীর মত একটা নরম মনের মেয়ে জয়ের এই আচরণ সহ্য করতে পারবে না ।
আর এমন যদি হয় , তাহলে সুধু সমস্যা জয় আর রানীর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না , দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবারের সবার উপর এর প্রভাব পরবে ।
এসব ভাবতে ভাবতেই অর্ডার করা পিজ্জা চলে আসে । জান্নাত দাম মিটিয়ে বেড়িয়ে এসে রিক্সা নেয় । রিক্সায় বসে বসে জান্নাতের মনে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলতে থাকে , ভেবে পায় না ও কি করবে । যদি ওর অনুমান সত্যি হয় , তাহলে কি ও রাজীব কে জানাবে ? যদি জানায় এর ফলাফল কি হবে , রাজীব কি সব জেনেশুনে রানীর সাথে জয়ের সম্পর্ক মেনে নেবে । কারন এই দুনিয়ায় জয় কে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনে রাজীব । জয়ের সব কীর্তির সাক্ষি রাজীব । কোন ভাই ই বোনের জন্য এমন ছেলে চাইবে না ।
আর এতে করে রানীর রিএকশন ই বা কি হবে , কত দূর এগিয়ে গেছে জয় আর ও? রাজীব যদি বাধা দেয় তাহলে কি রানী আর রাজীবের সম্পর্কের অবনতি হবে না? রানী কি মুখ বুজে ওর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে রাজীবকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে ?
হাসপাতালের একদম কাছাকাছি এসে জান্নাত সিদ্ধান্ত নেয় , সুধু অনুমানের উপর কোন সিদ্ধান্ত ও নেবে না । এই নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করবে । জয় বা রানী কে সরাসরি জিজ্ঞাস করে লাভ নেই । হাতে প্রমান নিয়ে ও এই দুজনের সামনা সামনি হবে।
যত দ্রুত সম্ভব জান্নাত রানীর কেবিনে চলে আসে , দরজা খোলা , ভেতরে রানী একা বসে , মুখ থমথমে , চেহারায় একটা কনফিউশন দেখা যাচ্ছে , সেই সাথে ভয় ।
জান্নাত জিজ্ঞাস করে “ জয় কোথায়?”
রানী ওর দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় “ চলে গেছে”
জান্নাত দেখে যদিও রানী উত্তর দিয়েছে , কিন্তু ওর মন এই কামড়ায় নেই । খুব সিরিয়াস কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারে জান্নাত । কিন্তু জান্নাত বুঝতে পারে না কি ঘটেছে । তবে যা ঘটেছে তা যে রানীকে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে , তা রানীর ফ্যাকাসে মুখ দেখেই বলে দেয়া যাচ্ছে । পিজ্জা খাওয়ার কথা ভুলে যায় জান্নাত । ভয়ের একটা হিম শীতল স্রোত জান্নাতের মেরুদণ্ড বেয়ে নামে । একজন মেয়ে হওয়ার কারনে ও বুঝতে পারছে , সাধারন কথাকাটা কাটি ওদের মাঝে হয়নি । একটি মেয় সুধু মাত্র ঝগড়ার কারনে এমন মুখ করে বসে থাকবে না । হ্যা কান্না করতে পারে , নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে । কিন্তু এমন ভীত আর কনফিউজড হবে না । জান্নাতের কাছে মনে হয় জয় কিছু একটা করেছে , রানী জয়ের কাছ থেকে আশা করেনি ।
ধিরে ধিরে জান্নাত রানীর দিকে এগিয়ে যায় । ওর ভাবতেও ভয় লাগে যদি জয় উল্টাপাল্টা কিছু করে থাকে তাহলে দুই পরিবারের মাঝে কি ঝড় শুরু হবে । আর ওর আর রাজীবের শুরু না হওয়া গল্পের ও বা কি এন্ডিং হবে ?
****
রাজীব হসপিটালে ফেরে প্রায় বিকেল পাঁচটায় । জান্নাত ওকে ভরসা দিয়ে পাঠিয়েছে যে , ও রানীর খেয়াল রাখবে । অবশ্য এতে রাজীবের খুব উপকার হয়েছে । জান্নাত মেয়েটার জন্য অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে রাজীবের মনে । ভাবে সব সময় যদি এমন কেউ ওর পাশে থাকতো । তাহলে জীবন কত সহজ হতো । গত রাত প্রায় নির্ঘুম কেটেছে , তারপর ও আজকে একটুও ক্লান্তি লাগেনি । বার বার মনে হয়েছে , কেউ একজন ওর পাশে আছে । যত কষ্টই হোক এমন কেউ আছে যে ওর কষ্ট ভাগ করে নেবে । ঘুম নেই গোসল নেই তবুও মন ছিলো ফুরফুরে । সেউ ফুরফুরে মন নিয়েই রাজীব ৫০৪ নাম্বার কেবিনের দরজা ঠেলে ঢোকে , মনে আশা জান্নাতের হাসি মুখটা দেখবে ।
কিন্তু রুমে ঢুকেই , মনের সেই ফুরফুরা ভাব উধাও হয়ে যায় । রুমের ভেতর যেন একটা গুমট বাতস আটকে আছে । এয়ার ফ্রেশনারের সুগন্ধ আর এসির শীতল বাতাস ছাপিয়ে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি বোঝা যাচ্ছে । রাজীব প্রথমে জান্নাতের মুখের দিকে তাকায় , ওর মুখ থমথমে । তারপর রানীর দিকে তাকায় , দেখেই বোঝা জাচ্ছে কান্না আটকে রেখছে ।
রাজীবের বুক ধড়াস করে ওঠে , কি হতে পারে এই ভাবতে ভাবতে মাথা হ্যাং করে যায় । একবার ভাবে রানীর কি অন্য কোন অসুখ ধরা পরেছে , ডাক্তার কি পরে আর কিছু টেস্ট করিয়েছে । কিন্তু এতো কম সময়ে কি এসব বুঝতে পারা সম্ভব?
রাজীব রানীর কাছে যায় , জিজ্ঞাস করে “ কিরে তোর কি হয়েছে?”
রাজীবের গলার স্বর যেন রানীর চোখের বাধে হাতুরির আঘাত করে । ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে রানী , না সুধু চোখের পানিতে সীমাবদ্ধ নেই এই কান্না । শব্দ করে বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদতে থাকে , আর বার বার বলতে থাকে “ ভাইয়া আমাকে বাসায় নিয়া চল , আমি আর থাকবো না এইখানে”
রাজীব আর জান্নাত দুজনেই অনেক বোঝাতে চেষ্টা করে , কিন্তু রানী কিছুতেই মানবে না । রানী কে সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে রাজীব জান্নাতের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় । সেই দৃষ্টির উত্তরে জান্নাত সুধু লজ্জিত দৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। রাজীব কে বলেছিল রানীর খেয়াল রাখবে , কিন্তু সেই কাজ ও করতে পারেনি । তাই জান্নাত ভীষণ ভাবে লজ্জিত । সুধু রাজীবের কাছেই লজ্জিত নয় , নিজের কাছেও লজ্জিত । যদি ও তখন রানীকে জয়ের কাছে না রেখে যেতো তাহলে আর এই সমস্যা হতো না ।
কিন্তু জান্নাত রাজীব কে বুঝতে দেয় না যে ও বাইরে গিয়েছিলো , যদিও রাজীব এ ব্যাপারে কিছুই জানতে চায় নি । জানতে চাইলে কি বলবে তাই ভেবে জান্নাতের গলা শুকিয়ে আসে ।
এদিকে রাজীব পরেছে অথৈ সাগরে । রানীর এই দিকটার সাথে অনেকদিন সাক্ষাত হয় না ওর । আগে রানী প্রায় এমন জেদ করতো । কিন্তু তখন রানী ছিলো ছোট , নানা রকম ভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিতো রাজীব । এমন কি রানী মাঝে মাঝে রাজীব কে আঁচরে কামড়ে নিজেই শান্ত হয়ে যেতো । রানী এই ধরনের আচরণ করতো যখন বাইরে কেউ ওর সাথে কোন খারাপ আচরণ করতো । মুখচোরা রানী বাইরে কিছু বলতে বা করতে পারতো না , কিন্তু ঘরে এসে প্রচণ্ড জেদ করতো ।
কিন্তু বয়স বারার সাথে সাথে এই সমস্যাও কমে এসেছিলো । বেশিরভাগ সময় নিজের মাঝেই চেপে রাখতো , মাঝে মাঝে রাজীব বুঝতে পারলে , খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে সান্তনা দিতো । কিন্তু এই এডাল্ট রানীকে কি করে শান্তো করবে রাজীব বুঝে পায় না । তবুও জিজ্ঞাস করে “ কি হয়েছে তোর , কে কি বলেছে?”
প্রস্নটা করেই জান্নাতের দিকে তাকায় রাজীব , ভাবে প্রশ্নটা করা ওর উচিৎ হয়নি , কারন এখানে সুধু জান্নাত ই ছিলো । আর জান্নাত রানীকে কখনোই এমন কিছু বলবে না বা করবে না যে রানী এমন করবে । রাজীব নিজের সরবচ্চ চেষ্টা করে , রানী কে থামানোর । কিন্তু সফল হয় না ।শব্দ করে বিলাপ করে কাঁদে রানী ।
এদিকে জান্নাত ওর মা কে কল করে । শুনে আয়শা বিচলিত হয়ে ওঠে । রানীর সাথে ফোনে কথা বলতে চায় , কিন্তু রানী নারাজ । শেষে উপায় না দেখে আয়শা বলে “ তোরা থাক আমি আসছি”
আধ ঘন্টার মাঝে আয়শা, রহিম আর জয়নাল এসে হাজির হয় । কিন্তু ততক্ষণে রানী একদম চুপ হয়ে গেছে । কারো সাথে কথা বলে না । তবে বাড়ি যাওয়ার জেদ ও করে না ।
রাজীব জানে কাজটা ঠিক হয়নি , রানীর মনের ঝড় থামেনি । জাস্ট দরজা জানালা গুলো বন্ধ হয়েছে । রানী এতো মানুষের সামনে কখনোই নিজের মনের দরজা জানালা খুলবে না । আজকেও অনেক রাত পর্যন্ত সবাই থাকে । এবং আয়শা ঘোষণা করে যে আজকে ও থাকবে । আজকে আর কেউ বাধা দেয়না । বিশেষ করে জান্নাত , কারন জান্নাতের ভয় হয় সবাই চলে গেলে যদি রাজীব এই নিয়ে আলোচনা করতে চায় তাহলে ও কি উত্তর দেবে । তাছাড়া জয়ের সাথে ওর বোঝাপড়া আছে , কি এমন করেছে জয় যে রানী এমন করছে ।
****
জান্নাত বসে আছে , কান শার্প । রাত প্রায় সারে বারোটা , জয় এখনো বাসায় ফেরেনি । জয়নাল এই নিয়ে কিছুক্ষন আগে রাগারাগি করে ঘুমাতে গেছে । জেগে আছে জান্নাত নিজের নখে দাঁতে শাণ দিচ্ছে । আজকে আর বড় ভাই ছোট বোনের সম্পর্ক মাথায় রাখবে না ও । ঘটনার আকস্মিকতায় রাজীব হয়তো ওকে ঠিক ভাবে জিজ্ঞাস করেনি । কিন্তু রাজীব জিজ্ঞাস করবে । আর তখন হয়তো জান্নাত বলতে বাধ্য হবে যে ও বাইরে গিয়েছিলো , এবং তখন জয় ছিলো রানীর সাথে । জান্নাত যদি সত্যি না জানতে পারে তবে , এই নিয়ে জল অনেক দূর গড়াতে পারে । সত্যটা বের করতে পারলে জান্নাত নিজেই রানীর সাথে কথা বলে এসব মিটিয়ে নিতে পারবে । পারতেই যে হবে ওকে , কারন এই দুই পরিবারের সম্পর্ক ওর কাছে অনেক মূল্যবান । রাজীব ওর কাছে অনেক মূল্যবান । ও কিছুতেই রাজীব কে হারাতে পারবে না । ওর জীবনে রাজীবের খুব দরকার , আর রাজীবের জীবনেও ওকে দরকার ।
প্রায় মিনিট পনেরো পর দরজা খোলার খুট শব্দ শুনতে পায় জান্নাত । ঘর থেকে বের হয় , দোতলা থেকে নিচের হল ঘরের দিকে তাকায় । না দরজা বন্ধ , তাহলে কি ও ভুল শুনেছে । নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় । আর তখনি সিগারেটের গন্ধ এসে নাকে লাগে । ছাদের সিঁড়ি থেকে কেউ একজন নামছে । পরমুহুরতেই মুখোমুখি হয় জয় আর জান্নাত । জয়ের চোখ লালচে । হঠাত জান্নাত কে সামনে দেখে একটু ভড়কে যায় । দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে জয় । আর তখন জান্নাত সিগারেটের গন্ধ ছাড়াও আরো একটি গন্ধ পায় । চোখ সরু করে তাকায় ভাইয়ের দিকে । শাণ দেয়া নখ আর দাঁত বের করে আনে। নিচু কিন্তু বেশ দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞাস করে “ তুই কি করেছিস?”
******
সব প্রশ্নের উত্তর নেই,
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)