23-09-2025, 10:17 PM
ফেরার সময় দিহানের সাথে ফেরে নি মধুমিতা। দিহান খুব জোর করেছিলো, মধুমিতা শোনে নি। লোক জন সন্দেহ করবে, বাড়ির লোকের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হবে এই বলে দিহানকে একাই যেতে বাধ্য করেছে। আসলে মধুমিতা কিছু সময় একা থাকতে চাইছিলো। হঠাৎ কেন জানি না রিতমের জন্য মন খারাপ করছিলো ওর। মনে হচ্ছিলো, আজ ও ছেলেটাকে চুড়ান্ত ভাবে ঠকালো। বুকের ভেতর ঝর বয়ে যাচ্ছিলো আত্ম ধিক্কারে। কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিজেকে, কেন অবাধ্য হচ্ছে শরীর, কামুক ভাব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
তখন রাত দশটার মতো। শীত পরছিলো খুব। কুয়াশার চাদরে আবৃত পুরো কোলকাতা। রবিবার বলে রাস্তায় গাড়ির ভিড় অন্য দিনের চেয়ে কম, লোকজনও তেমন নেই। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে দ্রুত। পথের মাঝে মাঝারি সাইজের গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে, একটু দূরে দূরে থাকা শড়ক বাতির হলদে আলোয় আলোকিত চারপাশ।
মধুমিতা এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো।আজ শহরটাকে কেমন যেন রহস্যময় লাগছিলো। জনমানুষে ঠাসা নগরী তারপরও ওর মনে হচ্ছিলো সুনসান নীরব এক শহর। যেখানে কেউ কারো কাছের না, কেউ কারো মনের কথা জানে না, সবাই সবার দূরের, নিজেকে হঠাৎ খুব একলা অনুভব করছিলো ও।
শহরের সৌন্দর্য মধুমিতাকে আজ টানছিল না, কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে ওর মন। দিহানের সাথে শুয়ে মধুমিতা খুব সুখ পাচ্ছে এতে সন্দেহ নেই, যৌন মিলনে যে এতো আরাম এটা আগে অনুভব করে নি মধুমিতা, এই অনুভূতি ওর জীবনে প্রথম। কিন্তু খারাপ লাগছিলো রিতমের কথা ভেবে। ওর কামনার জন্য রিতম মাঝখান থেকে ঠকছে। মধুমিতা জানে শুধু ওকেই ভালো রাখার জন্য, একটু খানি স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে পড়ে আছে রিতম, রাতদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে।
নাহলে ওর দরকার কি ছিল দেশের সাচ্ছন্দ্য ছেড়ে প্রবাসে পারী দেয়, কোলকাতায় তো বেশ ভালো চাকরিই করছিলো, মাইনেও খারাপ ছিলো না, ভালো মতোই চলে যেতো ওদের সংসার। বিদেশ যাওয়ার দরকার ছিলো না। মধুমিতা জানে বউকে রাজরানী করে রাখতে চায় রিতম, পৃথিবীর সমস্ত ঐশর্য্য, সকল প্রাচুর্য নিজের প্রিয়তমাকে এনে দিতে চায় ও। তাই বিদেশে পরে আছে।
রিতম ইংল্যান্ডে গেছে তিন বছর হয়ে এলো। আর সব ভারতীয়দের মতো পড়াশোন করতে সেখানে গিয়েছিলো, মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়ে। এটা ছিল ওর ডাবল মাস্টার্স। ছাত্র জীবনে রিতম বেশ কৃতী ছাত্র ছিলো, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছিলো। চাকরি পেতে সময় লাগে নি ওর, কিন্তু কেরানীগিরি ওর ভালো লাগতো না। মাঝে মধ্যে মধুমিতাকে নিজের অখুশির কথা জানাতো রিতম। সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা ছটা অফিস। ব্যাস্ত ট্রাফিকের কারণে বাড়ি ফিরতে আটটাও বেজে যেত কখনো কখনো। তারউপর অফিসে ছিল হারভাঙ্গা খাটুনি। বাড়িতে ফিরে এতো টুকু এনার্জি অবশিষ্ট থাকতো না রিতমের, চাকরি নিয়ে তাই ওর ছিল হাজার অভিযোগ। খাটুনি বেশি বেতন কম। বিদেশ পাড়ি দেওয়ার এটাও একটা কারণ।
চাকরি পেয়ে দেরি করে নি রিতম, বিয়ে করে নিয়েছিলো মধুমিতাকে। পরিস্থিতি ছিলো এমন যে তখন বিয়ে না করলে মধুমিতাকে আর পাওয়া হতো না।
ওদের জানা শোনা অনেক দিনের, যদিও প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না, তবে মধুমিতা যে ওকে পছন্দ করে তা বুঝতে পারতো রিতম। মধুমিতা ছিলো রিতমের এক বন্ধুর মামাতো বোন। বন্ধুটির সাথে অনেক বার মধুমিতাদের বাড়ি গেছিলো দিহান। সেখান থেকেই ওদের পরিচয়।
মধুমিতার বাবা মা নেই। বাপের বাড়ি বলতে দাদা আর বৌদি। মধুমিতার এই বৌদিটি মহাধুরন্ধর মহিলা। বাংলাদেশের মেয়ে, পড়ালেখা তেমন করে নি, পেট ভরা হিংসা আর মাথা ভরা শয়তানি বুদ্ধি। এনার স্বভাব পূর্ণ কলহপ্রিয়া। এমনিতে মধুমিতার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না, তবে ওকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতো, জামা কাপড় ধোয়া থেকে রান্না বান্না ঘর মোছা সব। বিনিময়ে কাজের মেয়ের মতো সম্মান পেতো মধুমিতা। কেউ একটা ভালো পোশাক কিনে দিতো না, না দিতো ভালো খাবার। অনার্স শেষ করেছিলো শত যুদ্ধ করে, তারপর সেটাও বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলো প্রেম করবে এই অজুহাত দিয়ে।
তবে মধুমিতা ছিলো খুব সুন্দরী, যেমন লম্বা চওড়া তেমন ভরাট স্বাস্থ্য, কোমড় স্পর্শি ঢেউ খেলানো দীঘল কালো চুল, আর টানা টানা চোখ–রুপবতী মধুমিতাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো রিতম, তারউপর ওকে সেই করুণ-অহসায় অবস্থায় দেখে রিতমের মায়া হয়েছিলো খুব, তখনই ঠিক করেছিলো এই মেয়েকেই বিয়ে করবে ও।
তবে মধুমিতার সাথে রিতম প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে নি। চাকরি পাওয়ার পর সম্বন্ধ করে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করেছিলো।
অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রি কাটিয়ে যেমন অরুণোদ্বয় হয়, আলোয় আলোকিত করে ধরনী, তেমনি সব খারাপ সময় শেষ হয়ে আসে ভালো সময়ের সুখানুভূতি। মধুমিতার জীবনে সেই ভালো সময় এসেছিলো রিতমের হাত ধরে।
ফুল সজ্জার রাতে রিতম যখন সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে, গলায় বেলী ফুলের মালা চরিয়ে, কপালে চন্দন লাগিয়ে ঘরের দ্বার দিলো তখন এক নজর ওকে দেখেছিলো মধুমিতা, যেন চন্দ্রদেবের মতো জ্বলজ্বল করছিলো ওর কান্তি, দেবতার থেকে কম লাগছিলো না। হাতে ছিলো লাল টকটকে একটা তাজা গোলাপ।
এরপর লজ্জায় আর ওর দিকে তাকাতে পারে নি মধুমিতা। সেদিন রাতেই রিতমকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। এতো মধুর স্বভাব ছেলেটার, এতো মিষ্টি কথার ভঙ্গি যে ওর উপর মুগ্ধ না হয়ে পারে নি।
বিয়ের পর সময় গুলো ছিলো মধুমিতার জীবনের শ্রেষ্ঠতম। প্রতিটি দিন ভালো থাকার নতুন মাধ্যম পেত ও, সেই মাধ্যমটি রিতম। যে ওর পিঞ্জর বদ্ধ জীবনে শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত আকাশের নিচে নিয়ে এসেছে।
আর মধুমিতা এতোটাই কৃতঘ্ন, এতো স্বার্থপর যে এই ভাবে ওকে ঠকাচ্ছে এখন।
বিয়ের পর রিতম জোর করে মধুমিতাকে আবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, শেষ করিয়েছিলো ওর পড়াশোনা।
মধুমিতার এখনো স্পষ্ট মনে আছে ঐ দিনের ঘটনা। সবে বিয়ে হয়েছিলো ওদের। এক মাসও পূর্ণ হয় নি তখন। শশুরবাড়িতে নতুন বউয়ের স্বাভাবিক লাজুক ভাব তখনো কেটে যায় নি, সারাক্ষণ মাথায় ঘোমটা টেনে রাখতো। তটস্থ থাকতো শাশুড়ির ভয়ে।
এক বৌদি ওকে যেই ভয় দেখিয়েছে এরফলে অবচেতনেই শাশুড়ি নিয়েও একটা ভয় কাজ করতো ওর, তবে রিতমের মা মোটেই খারাপ মানুষ না, ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্নেহশীলা।
সেদিন খুব বর্ষা ছিল, বৃষ্টি হচ্ছিলো সকাল থেকে। রিতমের মা বাবা বাড়ি ছিল না, বেড়াতে গিয়েছিলো যেন কোথায়। তাই রিতম অন্য দিনের তুলনায় একটু আগে আগেই বাড়ি চলে এসেছিলো। বিকেলের দিকে।
রিতম বাড়ি ফেরার পর মেঘে মেঘে ভারি হয়ে উঠলো আকাশ। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিন্তু আকাশ এখন এমন রুপ নিলো যেন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীকে ভাসিয়ে ফেলবে।
বৃষ্টি নামলো সন্ধ্যার দিকে। তীব্র বর্ষণ হচ্ছিলো। একসময় এমন হলো, বৃষ্টির শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছিল না চারদিকে। আর খানিকক্ষণ পর পর গুরু গম্ভীর বাঘের গর্জনের মতো শব্দ করে আকাশের বুক চিরে লেলিহান বজ্রে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলো সব কিছু।
রাতের বেলা শুয়ে রিতম কথা বলতে শুরু করলো। মধুমিতাকে দু বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মধুমিতার মাথা ওর বুকে। রিতম ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলো। বলল, এই মিতা।
মধুমিতা রিতমের বুকে মুখ গুঁজে নিজের প্রশান্তি খুঁজে নিচ্ছিলো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর পরই কারেন্ট চলে গেছিলো। পরিবেশটাকে রোমান্টিক করার জন্য কতগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে ছিল মধুমিতা। টিমটিমে স্বল্প আলোয় মধুমিতার মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলো না রিতম, মধুমিতা নিচু গলায় আদুরে কন্ঠে বলল, বলো।
এভাবে শুধু শুয়ে থেকে এমন একটা রাত নষ্ট করবো?
ভুরু কুঁচকে রিতমের দিকে তাকালো মধুমিতা, জিজ্ঞেস করলো, কোথায় নষ্ট করছি?
নষ্ট করছি না? দেখো কি রোমান্টিক একটা পরিবেশ। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়ছে, বাড়িতে কেউ নেই, শুধু তুমি আর আমি–বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? আমাদের এভাবে এ রাত নষ্ট করা উচিত নয়।
তাহলে কি করা উচিত?
লেট মি লাভ ইয়ু এন্ডলেসলি। রিতমের ঠোঁটে হাসি।
একটু আগেই তো ঐ সব করলে। রিতমকে সরিয়ে দিতে চাইলো মধুমিতা। না বাবা..... পারবো না আর.....
তখন করতে দিলে কোথায়? মধুমিতাকে যেতে দিলো না রিতম। কান্নাকাটি করলে মানুষ ঠিক মতো আদর করতে পারে?
তুমি খুব লোভী...... আমার কষ্ট হয়।
আই উইল ডু কেয়ার ফুলি..... কোমল কন্ঠে বলল রিতম। আই ওউন্ট হার্ট ইয়ু।
এরপর আর মানা করে নি মধুমিতা। নিজেই টেনে নিয়ে ছিলো রিতমকে, দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ করেছিলো ওকে।
অতঃপর ঘটে গেলো মিষ্টি সব মূহূর্ত। সুখ সাগরে ভেসে বেড়ালো দুজনই। মধুর এক যৌনমিলনের পর আবার জড়াজড়ি করে শুয়ে ছিলো ওরা।
বাইরে বৃষ্টি কিন্তু একফোঁটাও কমে নি। বাতাস বইছিলো হো হো করে সাথে তীব্র মেঘ গর্জন। বজ্রপাতের কর..কর..করাৎ শব্দে মধুমিতা ভয় পেয়ে উঠছিলো। রিতম সেটা বুঝতে পেরে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
জিজ্ঞেস করলো, ভয় পাচ্ছো?
হুম... কি জোরে বাজ পড়ছে দেখছো না...? শব্দে বুক কেঁপে উঠছে আমার।
ভয় কি? আমি আছি তো।
রিতমের কথায় মুচকি হাসলো মধুমিতা। সেটাই তো ভরসা। তুমি আছো। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মধুমিতা আবার বলল, জীবন সম্পর্কে এতো দিন বিরুপ মনোভাব ছিল, জানো রিতম? ভাগ্যকে গালাগালি করতাম প্রতিদিন, কেন আমাকে অমন একটা জীবন দিয়েছে, তার বদলে মেরে ফেললেই তো হয়। এখন আবার জীবনের অন্য রুপ দেখছি। মনে হচ্ছে এর থেকে ভালো বুঝি কিছু হতেই পারে না। ভাগ্য দেবী নিশ্চয়ই এখন আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে।
সব কিছু তুমি করেছো রিতম। তুমি আমার জীবনে এতো সুখ নিয়ে এলে। ধন্যবাদ।
রিতম মধুমিতার একটা হাত নিজের হাতে নিলো। মৃদু চাপ দিয়ে বললো, ধন্যবাদতো তোমার পাওনা, আমার জীবনে আসার জন্য।
এই কথা বলে মধুমিতার কপালে একটা চুমু একে দিলো রিতম।
এরপর অনেকক্ষন কোনো কথা নেই। বৃষ্টির শব্দ ঘরে যেন একটা খামোশি তৈরি করেছে। বাইরে শো শো, বো বো বাতাস, একটানা বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর মেঘ গর্জন।
একটু পর রিতম আবার কথা বলল, মিতা... এই মিতা?
হুম....
ঘুমিয়ে পড়লে?
না, বলো।
শোনো, কয়েক দিন ধরেই একটা কথা ভাবছিলাম, তোমাকে আর বলা হয়নি।
কি কথা।
তোমার পড়াশোনা নিয়ে– অনার্স শেষ করে তো পড়ো নি তাই না?
হ্যাঁ... পরিস্থিতি এমন ছিলো–
তোমার আবার পড়াটা শুরু করা উচিত।
কি করবো পড়ে, এই তো বেশ আছি।
দুষ্টু হাসলো রিতম, পড়া শেষ করে কাজ করবে। আমার কি ঠেকা পড়েছে নাকি সারা জীবন তোমাকে খাওয়াবো।
মধুমিতাও হাসলো রিতমের গালে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো, ঠেকা বৈকি, ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছো যে।
সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ধর কাল যদি আমি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাই, তখন তোমায় কে দেখবে? তাই আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। তুমি তো দেখেছো, অন্যের উপর নির্ভরতা কতটা অপমানজনক।
রিতম মধুমিতার মুখ দিকে না তাকিয়ে কথা বলছিলো, না হলে দেখতো কেমন কালো হয়ে গেছে ওর মুখ খানা। জল ছলছল করছে কালো চোখ দুটোতে।
যাও.... মধুমিতা ধাক্কা দিলো রিতমের বুকে। বাজে লোক। বলে অন্য দিকে ঘূরে গেল। উচ্চারণ করেছে মাত্র দুইটা শব্দ তাতেই কেঁপে উঠলো ওর কন্ঠ।
রিতম বুঝলো মধুমিতাকে খাওয়াবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এই কথা বলায় অভিমান করেছে বুঝি।
হাসলো রিতম, ওর অভিমান ভাঙানোর জন্য পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ডাকলো, এই মিতা, রাগ করলে?
অভিমানিনী উত্তর দিলো না।
রিতম আবার বলল, আচ্ছা বাবা স্যরি, ভুল হয়েছে আমার।
তুমি ঐ কথা বললে কেন? মধুমিতা ঢুকড়ে কেঁদে ফেলল।
কোন কথা?
মরে যাওয়ার কথা।
রিতম এখন বুঝলো বধূর অভিমান কোথায়।
আর বলবো না, স্যরি। কেঁদো না, সোনা।
সত্যি তো?
তিন সত্যি।
গাড়িতে বসে সেই রাতের কথা ভেবে মনে মনে শিহরিত হচ্ছিলো মধুমিতা। সেদিন মনে হচ্ছিলো রিতমকে ছাড়া বুঝি এক মূহুর্তও থাকতে পারবে না। সামান্য মরার কথা বলায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল ও। সেদিনের অনুভূতি গুলো তো সত্যিই ছিলো, প্রকৃতই কষ্ট হয়েছিল ওর। পাঁচ বছরও তো কাটে নি তারপর। মধুমিতা সেদিনও সাবালিকা ছিল আজও তাই। মাঝখান থেকে অনুভূতি গুলো পাল্টে গেল কিভাবে? কেন মনে মনে ও চাইছে রিতম আরো কিছু বছর ইংল্যান্ডেই থাক যাতে ও দিহানের সাথে বিনা বাধায় এই অবৈধ পরকিয়া বজায় রাখতে পারে। কেন এমনটা হচ্ছে? মধুমিতা বুঝতে পারছিলো, ও জোড়ালো একটা নাগপাশে জড়িয়ে পরছিলো। যেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলেই আরো শক্ত হচ্ছিলো সেই বন্ধন। মধুমিতা কি অসহায় হয়ে পড়ছে?
তখনই মধুমিতার ভেতরে থাকা একটা নির্দিষ্ট কুঠুরি থেকে ওর একটি সত্বা বলে উঠলো, কিরে বান্ধবী, তোর বুঝি মন খারাপ?
মধুমিতা বললো, হুম?
স্বামী আর প্রেমিক নিয়ে দ্বন্দ্ব বুঝি?
হ্যাঁ। তুই কি করে জানলি?
আমি তোর পেটের সব খবর জানি রে বোকা।
জানিস? তাহলে বল আমি এখন কি করবো?
কি করবি মানে?
আমি কি সঠিক কাজ করছি?
ভুলই বা কি করছিস?
রিতমকে ঠকাচ্ছি যে.... বিশ্বাসঘাতকতা করছি ওর সাথে।
ঠকাচ্ছিস? কোথায়? রিতম কি তোকে আগে ঠকায় নি?
কোথায় ঠকিয়েছে?
তোর থেকে বছরের পর বছর দূরে আছে রিতম। অথচ তোর মন, তোর ইচ্ছা, তোর কামনা–চাওয়া পূর্ণ করার দায়িত্ব তো ওরই। তোর দেহের ক্ষুধা মেটানো, তোর যৌবনের অমৃত আস্বাদন করা, তোকে আপন করে নেওয়া—এসবই তো ওর কর্তব্য।
আমার জন্যই তো বিদেশে গেছে। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে.....
ওগুলো অজুহাত মাত্র, মিথ্যে কথা। আসলে ও তোকে একা ফেলে গেছে, তুই কেমন থাকবি তা ভাবে নি এক বারও। এতো বছর স্বামী ছেড়ে শূন্যতায় থেকেছিস এখন স্বামীর জায়গা পূর্ণ করছে পরপুরুষ, এতে দোষ কোথায়? প্রকৃতির নিয়ম এটা, সে শূন্যতা বেশি দিন পছন্দ করে না। তাহলে তোর দোষ কোথায় বলতো ভাই?
স্ত্রী ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলাম যে, স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
আর স্বামীর ধর্ম? স্ত্রীর পাশে থাকা, তাকে, তার দেহকে ভালোবাসা, তার তৃষ্ণা মেটানো—সেটাও কি ধর্ম নয়? সে যদি সেই কর্তব্য না করে, ভুলে যায়, তবে তুই কেন আবদ্ধ থাকবি? শোন, নিজেকে ছেড়ে দে, বিলিয়ে দে, দেখবি পৃথিবী কি সুখময়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়—এটা বেঁচে থাকা।
কি বলছিস?
সত্যি বলছি সখি।
তার মানে দিহানের সাথে পরকিয়া করে কোনো ভুল করছি না?
পরকিয়া বলে নাম দিচ্ছিস কেন? খারাপ শোনায় এ শব্দটা। যৌবন উপভোগ বল, বা স্ত্রী ধর্ম পালন করা বলতে পারিস।
আর রিতম?
ও তো এখানে নেইরে বোকা। যখন আসবে তখন বোঝা যাবে। এখন দিহানের সাথে চুটিয়ে মজা কর।
তারপর বন্ধ হয়ে গেল সেই কুঠুরি। তবুও দ্বিধায় ভুগলো মধুমিতা। অনুশোচনা কমে এসেছিলো যদিও।
এই যে অনুভূতি গুলোর বিরোধ, কোনটা মিথ্যা? কোনটা সত্য? রিতমতো ওর হৃদয়ের অংশ জীবনেও মধুমিতা ওকে ছেড়ে দিতে পারবে না, আর দিহানের সাথে যেই সম্পর্ক ও গড়ে তুলেছে, তা চাইলেও ও ছাড়তে পারছে না, নিজের জন্য, নিজের কামনার জন্য। দিহানকে ওর চাই।
একদিকে রিতম, শান্ত সৌম্য একটা ছেলে, মধুমিতার ভালোবাসা। আরেক দিকে দিহান তীব্র আর বেপরোয়া, দিহান মধুমিতার কামনা, লালসা। কাউকেই ছাড়তে পারছে না। সিদ্ধান্তহীনতার ঘেরাটোপে অসহায় হয়ে পড়ছিলো মধুমিতা।
তখন রাত দশটার মতো। শীত পরছিলো খুব। কুয়াশার চাদরে আবৃত পুরো কোলকাতা। রবিবার বলে রাস্তায় গাড়ির ভিড় অন্য দিনের চেয়ে কম, লোকজনও তেমন নেই। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে দ্রুত। পথের মাঝে মাঝারি সাইজের গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে, একটু দূরে দূরে থাকা শড়ক বাতির হলদে আলোয় আলোকিত চারপাশ।
মধুমিতা এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো।আজ শহরটাকে কেমন যেন রহস্যময় লাগছিলো। জনমানুষে ঠাসা নগরী তারপরও ওর মনে হচ্ছিলো সুনসান নীরব এক শহর। যেখানে কেউ কারো কাছের না, কেউ কারো মনের কথা জানে না, সবাই সবার দূরের, নিজেকে হঠাৎ খুব একলা অনুভব করছিলো ও।
শহরের সৌন্দর্য মধুমিতাকে আজ টানছিল না, কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে ওর মন। দিহানের সাথে শুয়ে মধুমিতা খুব সুখ পাচ্ছে এতে সন্দেহ নেই, যৌন মিলনে যে এতো আরাম এটা আগে অনুভব করে নি মধুমিতা, এই অনুভূতি ওর জীবনে প্রথম। কিন্তু খারাপ লাগছিলো রিতমের কথা ভেবে। ওর কামনার জন্য রিতম মাঝখান থেকে ঠকছে। মধুমিতা জানে শুধু ওকেই ভালো রাখার জন্য, একটু খানি স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে পড়ে আছে রিতম, রাতদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে।
নাহলে ওর দরকার কি ছিল দেশের সাচ্ছন্দ্য ছেড়ে প্রবাসে পারী দেয়, কোলকাতায় তো বেশ ভালো চাকরিই করছিলো, মাইনেও খারাপ ছিলো না, ভালো মতোই চলে যেতো ওদের সংসার। বিদেশ যাওয়ার দরকার ছিলো না। মধুমিতা জানে বউকে রাজরানী করে রাখতে চায় রিতম, পৃথিবীর সমস্ত ঐশর্য্য, সকল প্রাচুর্য নিজের প্রিয়তমাকে এনে দিতে চায় ও। তাই বিদেশে পরে আছে।
রিতম ইংল্যান্ডে গেছে তিন বছর হয়ে এলো। আর সব ভারতীয়দের মতো পড়াশোন করতে সেখানে গিয়েছিলো, মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয়ে। এটা ছিল ওর ডাবল মাস্টার্স। ছাত্র জীবনে রিতম বেশ কৃতী ছাত্র ছিলো, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর শেষ করেছিলো। চাকরি পেতে সময় লাগে নি ওর, কিন্তু কেরানীগিরি ওর ভালো লাগতো না। মাঝে মধ্যে মধুমিতাকে নিজের অখুশির কথা জানাতো রিতম। সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা ছটা অফিস। ব্যাস্ত ট্রাফিকের কারণে বাড়ি ফিরতে আটটাও বেজে যেত কখনো কখনো। তারউপর অফিসে ছিল হারভাঙ্গা খাটুনি। বাড়িতে ফিরে এতো টুকু এনার্জি অবশিষ্ট থাকতো না রিতমের, চাকরি নিয়ে তাই ওর ছিল হাজার অভিযোগ। খাটুনি বেশি বেতন কম। বিদেশ পাড়ি দেওয়ার এটাও একটা কারণ।
চাকরি পেয়ে দেরি করে নি রিতম, বিয়ে করে নিয়েছিলো মধুমিতাকে। পরিস্থিতি ছিলো এমন যে তখন বিয়ে না করলে মধুমিতাকে আর পাওয়া হতো না।
ওদের জানা শোনা অনেক দিনের, যদিও প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না, তবে মধুমিতা যে ওকে পছন্দ করে তা বুঝতে পারতো রিতম। মধুমিতা ছিলো রিতমের এক বন্ধুর মামাতো বোন। বন্ধুটির সাথে অনেক বার মধুমিতাদের বাড়ি গেছিলো দিহান। সেখান থেকেই ওদের পরিচয়।
মধুমিতার বাবা মা নেই। বাপের বাড়ি বলতে দাদা আর বৌদি। মধুমিতার এই বৌদিটি মহাধুরন্ধর মহিলা। বাংলাদেশের মেয়ে, পড়ালেখা তেমন করে নি, পেট ভরা হিংসা আর মাথা ভরা শয়তানি বুদ্ধি। এনার স্বভাব পূর্ণ কলহপ্রিয়া। এমনিতে মধুমিতার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না, তবে ওকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করাতো, জামা কাপড় ধোয়া থেকে রান্না বান্না ঘর মোছা সব। বিনিময়ে কাজের মেয়ের মতো সম্মান পেতো মধুমিতা। কেউ একটা ভালো পোশাক কিনে দিতো না, না দিতো ভালো খাবার। অনার্স শেষ করেছিলো শত যুদ্ধ করে, তারপর সেটাও বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলো প্রেম করবে এই অজুহাত দিয়ে।
তবে মধুমিতা ছিলো খুব সুন্দরী, যেমন লম্বা চওড়া তেমন ভরাট স্বাস্থ্য, কোমড় স্পর্শি ঢেউ খেলানো দীঘল কালো চুল, আর টানা টানা চোখ–রুপবতী মধুমিতাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো রিতম, তারউপর ওকে সেই করুণ-অহসায় অবস্থায় দেখে রিতমের মায়া হয়েছিলো খুব, তখনই ঠিক করেছিলো এই মেয়েকেই বিয়ে করবে ও।
তবে মধুমিতার সাথে রিতম প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে নি। চাকরি পাওয়ার পর সম্বন্ধ করে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করেছিলো।
অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রি কাটিয়ে যেমন অরুণোদ্বয় হয়, আলোয় আলোকিত করে ধরনী, তেমনি সব খারাপ সময় শেষ হয়ে আসে ভালো সময়ের সুখানুভূতি। মধুমিতার জীবনে সেই ভালো সময় এসেছিলো রিতমের হাত ধরে।
ফুল সজ্জার রাতে রিতম যখন সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে, গলায় বেলী ফুলের মালা চরিয়ে, কপালে চন্দন লাগিয়ে ঘরের দ্বার দিলো তখন এক নজর ওকে দেখেছিলো মধুমিতা, যেন চন্দ্রদেবের মতো জ্বলজ্বল করছিলো ওর কান্তি, দেবতার থেকে কম লাগছিলো না। হাতে ছিলো লাল টকটকে একটা তাজা গোলাপ।
এরপর লজ্জায় আর ওর দিকে তাকাতে পারে নি মধুমিতা। সেদিন রাতেই রিতমকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। এতো মধুর স্বভাব ছেলেটার, এতো মিষ্টি কথার ভঙ্গি যে ওর উপর মুগ্ধ না হয়ে পারে নি।
বিয়ের পর সময় গুলো ছিলো মধুমিতার জীবনের শ্রেষ্ঠতম। প্রতিটি দিন ভালো থাকার নতুন মাধ্যম পেত ও, সেই মাধ্যমটি রিতম। যে ওর পিঞ্জর বদ্ধ জীবনে শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত আকাশের নিচে নিয়ে এসেছে।
আর মধুমিতা এতোটাই কৃতঘ্ন, এতো স্বার্থপর যে এই ভাবে ওকে ঠকাচ্ছে এখন।
বিয়ের পর রিতম জোর করে মধুমিতাকে আবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, শেষ করিয়েছিলো ওর পড়াশোনা।
মধুমিতার এখনো স্পষ্ট মনে আছে ঐ দিনের ঘটনা। সবে বিয়ে হয়েছিলো ওদের। এক মাসও পূর্ণ হয় নি তখন। শশুরবাড়িতে নতুন বউয়ের স্বাভাবিক লাজুক ভাব তখনো কেটে যায় নি, সারাক্ষণ মাথায় ঘোমটা টেনে রাখতো। তটস্থ থাকতো শাশুড়ির ভয়ে।
এক বৌদি ওকে যেই ভয় দেখিয়েছে এরফলে অবচেতনেই শাশুড়ি নিয়েও একটা ভয় কাজ করতো ওর, তবে রিতমের মা মোটেই খারাপ মানুষ না, ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্নেহশীলা।
সেদিন খুব বর্ষা ছিল, বৃষ্টি হচ্ছিলো সকাল থেকে। রিতমের মা বাবা বাড়ি ছিল না, বেড়াতে গিয়েছিলো যেন কোথায়। তাই রিতম অন্য দিনের তুলনায় একটু আগে আগেই বাড়ি চলে এসেছিলো। বিকেলের দিকে।
রিতম বাড়ি ফেরার পর মেঘে মেঘে ভারি হয়ে উঠলো আকাশ। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিলো, কিন্তু আকাশ এখন এমন রুপ নিলো যেন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীকে ভাসিয়ে ফেলবে।
বৃষ্টি নামলো সন্ধ্যার দিকে। তীব্র বর্ষণ হচ্ছিলো। একসময় এমন হলো, বৃষ্টির শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছিল না চারদিকে। আর খানিকক্ষণ পর পর গুরু গম্ভীর বাঘের গর্জনের মতো শব্দ করে আকাশের বুক চিরে লেলিহান বজ্রে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলো সব কিছু।
রাতের বেলা শুয়ে রিতম কথা বলতে শুরু করলো। মধুমিতাকে দু বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মধুমিতার মাথা ওর বুকে। রিতম ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলো। বলল, এই মিতা।
মধুমিতা রিতমের বুকে মুখ গুঁজে নিজের প্রশান্তি খুঁজে নিচ্ছিলো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর পরই কারেন্ট চলে গেছিলো। পরিবেশটাকে রোমান্টিক করার জন্য কতগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে ছিল মধুমিতা। টিমটিমে স্বল্প আলোয় মধুমিতার মুখ ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলো না রিতম, মধুমিতা নিচু গলায় আদুরে কন্ঠে বলল, বলো।
এভাবে শুধু শুয়ে থেকে এমন একটা রাত নষ্ট করবো?
ভুরু কুঁচকে রিতমের দিকে তাকালো মধুমিতা, জিজ্ঞেস করলো, কোথায় নষ্ট করছি?
নষ্ট করছি না? দেখো কি রোমান্টিক একটা পরিবেশ। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়ছে, বাড়িতে কেউ নেই, শুধু তুমি আর আমি–বুঝতে পারছো আমি কি বলছি? আমাদের এভাবে এ রাত নষ্ট করা উচিত নয়।
তাহলে কি করা উচিত?
লেট মি লাভ ইয়ু এন্ডলেসলি। রিতমের ঠোঁটে হাসি।
একটু আগেই তো ঐ সব করলে। রিতমকে সরিয়ে দিতে চাইলো মধুমিতা। না বাবা..... পারবো না আর.....
তখন করতে দিলে কোথায়? মধুমিতাকে যেতে দিলো না রিতম। কান্নাকাটি করলে মানুষ ঠিক মতো আদর করতে পারে?
তুমি খুব লোভী...... আমার কষ্ট হয়।
আই উইল ডু কেয়ার ফুলি..... কোমল কন্ঠে বলল রিতম। আই ওউন্ট হার্ট ইয়ু।
এরপর আর মানা করে নি মধুমিতা। নিজেই টেনে নিয়ে ছিলো রিতমকে, দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ করেছিলো ওকে।
অতঃপর ঘটে গেলো মিষ্টি সব মূহূর্ত। সুখ সাগরে ভেসে বেড়ালো দুজনই। মধুর এক যৌনমিলনের পর আবার জড়াজড়ি করে শুয়ে ছিলো ওরা।
বাইরে বৃষ্টি কিন্তু একফোঁটাও কমে নি। বাতাস বইছিলো হো হো করে সাথে তীব্র মেঘ গর্জন। বজ্রপাতের কর..কর..করাৎ শব্দে মধুমিতা ভয় পেয়ে উঠছিলো। রিতম সেটা বুঝতে পেরে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
জিজ্ঞেস করলো, ভয় পাচ্ছো?
হুম... কি জোরে বাজ পড়ছে দেখছো না...? শব্দে বুক কেঁপে উঠছে আমার।
ভয় কি? আমি আছি তো।
রিতমের কথায় মুচকি হাসলো মধুমিতা। সেটাই তো ভরসা। তুমি আছো। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মধুমিতা আবার বলল, জীবন সম্পর্কে এতো দিন বিরুপ মনোভাব ছিল, জানো রিতম? ভাগ্যকে গালাগালি করতাম প্রতিদিন, কেন আমাকে অমন একটা জীবন দিয়েছে, তার বদলে মেরে ফেললেই তো হয়। এখন আবার জীবনের অন্য রুপ দেখছি। মনে হচ্ছে এর থেকে ভালো বুঝি কিছু হতেই পারে না। ভাগ্য দেবী নিশ্চয়ই এখন আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছে।
সব কিছু তুমি করেছো রিতম। তুমি আমার জীবনে এতো সুখ নিয়ে এলে। ধন্যবাদ।
রিতম মধুমিতার একটা হাত নিজের হাতে নিলো। মৃদু চাপ দিয়ে বললো, ধন্যবাদতো তোমার পাওনা, আমার জীবনে আসার জন্য।
এই কথা বলে মধুমিতার কপালে একটা চুমু একে দিলো রিতম।
এরপর অনেকক্ষন কোনো কথা নেই। বৃষ্টির শব্দ ঘরে যেন একটা খামোশি তৈরি করেছে। বাইরে শো শো, বো বো বাতাস, একটানা বৃষ্টি পড়ার শব্দ আর মেঘ গর্জন।
একটু পর রিতম আবার কথা বলল, মিতা... এই মিতা?
হুম....
ঘুমিয়ে পড়লে?
না, বলো।
শোনো, কয়েক দিন ধরেই একটা কথা ভাবছিলাম, তোমাকে আর বলা হয়নি।
কি কথা।
তোমার পড়াশোনা নিয়ে– অনার্স শেষ করে তো পড়ো নি তাই না?
হ্যাঁ... পরিস্থিতি এমন ছিলো–
তোমার আবার পড়াটা শুরু করা উচিত।
কি করবো পড়ে, এই তো বেশ আছি।
দুষ্টু হাসলো রিতম, পড়া শেষ করে কাজ করবে। আমার কি ঠেকা পড়েছে নাকি সারা জীবন তোমাকে খাওয়াবো।
মধুমিতাও হাসলো রিতমের গালে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো, ঠেকা বৈকি, ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছো যে।
সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ধর কাল যদি আমি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাই, তখন তোমায় কে দেখবে? তাই আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। তুমি তো দেখেছো, অন্যের উপর নির্ভরতা কতটা অপমানজনক।
রিতম মধুমিতার মুখ দিকে না তাকিয়ে কথা বলছিলো, না হলে দেখতো কেমন কালো হয়ে গেছে ওর মুখ খানা। জল ছলছল করছে কালো চোখ দুটোতে।
যাও.... মধুমিতা ধাক্কা দিলো রিতমের বুকে। বাজে লোক। বলে অন্য দিকে ঘূরে গেল। উচ্চারণ করেছে মাত্র দুইটা শব্দ তাতেই কেঁপে উঠলো ওর কন্ঠ।
রিতম বুঝলো মধুমিতাকে খাওয়াবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এই কথা বলায় অভিমান করেছে বুঝি।
হাসলো রিতম, ওর অভিমান ভাঙানোর জন্য পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ডাকলো, এই মিতা, রাগ করলে?
অভিমানিনী উত্তর দিলো না।
রিতম আবার বলল, আচ্ছা বাবা স্যরি, ভুল হয়েছে আমার।
তুমি ঐ কথা বললে কেন? মধুমিতা ঢুকড়ে কেঁদে ফেলল।
কোন কথা?
মরে যাওয়ার কথা।
রিতম এখন বুঝলো বধূর অভিমান কোথায়।
আর বলবো না, স্যরি। কেঁদো না, সোনা।
সত্যি তো?
তিন সত্যি।
গাড়িতে বসে সেই রাতের কথা ভেবে মনে মনে শিহরিত হচ্ছিলো মধুমিতা। সেদিন মনে হচ্ছিলো রিতমকে ছাড়া বুঝি এক মূহুর্তও থাকতে পারবে না। সামান্য মরার কথা বলায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল ও। সেদিনের অনুভূতি গুলো তো সত্যিই ছিলো, প্রকৃতই কষ্ট হয়েছিল ওর। পাঁচ বছরও তো কাটে নি তারপর। মধুমিতা সেদিনও সাবালিকা ছিল আজও তাই। মাঝখান থেকে অনুভূতি গুলো পাল্টে গেল কিভাবে? কেন মনে মনে ও চাইছে রিতম আরো কিছু বছর ইংল্যান্ডেই থাক যাতে ও দিহানের সাথে বিনা বাধায় এই অবৈধ পরকিয়া বজায় রাখতে পারে। কেন এমনটা হচ্ছে? মধুমিতা বুঝতে পারছিলো, ও জোড়ালো একটা নাগপাশে জড়িয়ে পরছিলো। যেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলেই আরো শক্ত হচ্ছিলো সেই বন্ধন। মধুমিতা কি অসহায় হয়ে পড়ছে?
তখনই মধুমিতার ভেতরে থাকা একটা নির্দিষ্ট কুঠুরি থেকে ওর একটি সত্বা বলে উঠলো, কিরে বান্ধবী, তোর বুঝি মন খারাপ?
মধুমিতা বললো, হুম?
স্বামী আর প্রেমিক নিয়ে দ্বন্দ্ব বুঝি?
হ্যাঁ। তুই কি করে জানলি?
আমি তোর পেটের সব খবর জানি রে বোকা।
জানিস? তাহলে বল আমি এখন কি করবো?
কি করবি মানে?
আমি কি সঠিক কাজ করছি?
ভুলই বা কি করছিস?
রিতমকে ঠকাচ্ছি যে.... বিশ্বাসঘাতকতা করছি ওর সাথে।
ঠকাচ্ছিস? কোথায়? রিতম কি তোকে আগে ঠকায় নি?
কোথায় ঠকিয়েছে?
তোর থেকে বছরের পর বছর দূরে আছে রিতম। অথচ তোর মন, তোর ইচ্ছা, তোর কামনা–চাওয়া পূর্ণ করার দায়িত্ব তো ওরই। তোর দেহের ক্ষুধা মেটানো, তোর যৌবনের অমৃত আস্বাদন করা, তোকে আপন করে নেওয়া—এসবই তো ওর কর্তব্য।
আমার জন্যই তো বিদেশে গেছে। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে.....
ওগুলো অজুহাত মাত্র, মিথ্যে কথা। আসলে ও তোকে একা ফেলে গেছে, তুই কেমন থাকবি তা ভাবে নি এক বারও। এতো বছর স্বামী ছেড়ে শূন্যতায় থেকেছিস এখন স্বামীর জায়গা পূর্ণ করছে পরপুরুষ, এতে দোষ কোথায়? প্রকৃতির নিয়ম এটা, সে শূন্যতা বেশি দিন পছন্দ করে না। তাহলে তোর দোষ কোথায় বলতো ভাই?
স্ত্রী ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলাম যে, স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
আর স্বামীর ধর্ম? স্ত্রীর পাশে থাকা, তাকে, তার দেহকে ভালোবাসা, তার তৃষ্ণা মেটানো—সেটাও কি ধর্ম নয়? সে যদি সেই কর্তব্য না করে, ভুলে যায়, তবে তুই কেন আবদ্ধ থাকবি? শোন, নিজেকে ছেড়ে দে, বিলিয়ে দে, দেখবি পৃথিবী কি সুখময়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা নয়—এটা বেঁচে থাকা।
কি বলছিস?
সত্যি বলছি সখি।
তার মানে দিহানের সাথে পরকিয়া করে কোনো ভুল করছি না?
পরকিয়া বলে নাম দিচ্ছিস কেন? খারাপ শোনায় এ শব্দটা। যৌবন উপভোগ বল, বা স্ত্রী ধর্ম পালন করা বলতে পারিস।
আর রিতম?
ও তো এখানে নেইরে বোকা। যখন আসবে তখন বোঝা যাবে। এখন দিহানের সাথে চুটিয়ে মজা কর।
তারপর বন্ধ হয়ে গেল সেই কুঠুরি। তবুও দ্বিধায় ভুগলো মধুমিতা। অনুশোচনা কমে এসেছিলো যদিও।
এই যে অনুভূতি গুলোর বিরোধ, কোনটা মিথ্যা? কোনটা সত্য? রিতমতো ওর হৃদয়ের অংশ জীবনেও মধুমিতা ওকে ছেড়ে দিতে পারবে না, আর দিহানের সাথে যেই সম্পর্ক ও গড়ে তুলেছে, তা চাইলেও ও ছাড়তে পারছে না, নিজের জন্য, নিজের কামনার জন্য। দিহানকে ওর চাই।
একদিকে রিতম, শান্ত সৌম্য একটা ছেলে, মধুমিতার ভালোবাসা। আরেক দিকে দিহান তীব্র আর বেপরোয়া, দিহান মধুমিতার কামনা, লালসা। কাউকেই ছাড়তে পারছে না। সিদ্ধান্তহীনতার ঘেরাটোপে অসহায় হয়ে পড়ছিলো মধুমিতা।