05-09-2025, 10:56 AM
(This post was last modified: 06-09-2025, 06:56 AM by কালপুরুষ. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
পর্ব ৬
দুই চোখ বুঝে মায়া আর একবার প্রথম থেকে সবটা ভাবে। একটি চেনা, কি অচেনা মানুষের জন্যে, আর একজন মানুষের জীবনের গতি পথ পাল্টে যায়। যার জন্যে পাল্টায় সেই মানুষটি কি তার খোঁজ রাখে? এ আশ্চর্য বৈকি!
মায়ার খুব জানতে ইচ্ছে করে। উঠে দাঁড়িয়ে সে এগিয়ে যায় ব্যালকনির ধারে। সকাল আরো স্পষ্ট হয়ে এসেছে। ফোনের স্ক্রিনে সময় বলছে ১০:১২। মায়া তার হাতে থাকা সোনালী ফ্রেমের চশমাটির দিকে তাকায়।তারপর নিজের দিকে। তার মন শুধু নয়,তার সারাটা দেহ জুড়ে আরিশ নিজের ছায়া রেখে গিয়েছে। মায়া দুচোখ বোঝে,তারপর শান্ত কন্ঠেই বলে,
– “রুদ্র একটা কথা রাখবে?”
রুদ্র এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মায়ার পাশে। মুখে কিছু না বললেও আলতো করে হাত রাখে মায়ার হাতে।
– “সেই পাগলাটে ছেলেটির সাথে আর একবার দেখা করতে চাই। ওর প্রয়োজনীয় কিছু একটা রয়ে গিয়েছে আমার কাছে,আমায় নিয়ে যাবে স্টেশনে?
রুদ্র হাসিমুখে তাকিয়ে মাথা নাড়ে,বলে,
– “ এমনিতেই যেতে হবে আমাদের,তোমার গল্পটার সমাপ্তী, এখনো আরিশের হাতে!”
মায়া আর রুদ্র যখন থানা হয়ে স্টেশন পৌঁছায়,তখন স্টেশনে পুলিশ অফিসার আবির সেন,তার টেকো মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন ভাবছেন। গতকালের শেষ ট্রেনে এমন কিছু হবে তার কোন ইনফর্মেশন তার কাছে ছিল না। কিন্তু আজ সকালেই এই বিষয়টি নিয়ে তার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। ওপর মহল থেকে ফোন এসেছে ছেলেটিকে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছা দিতে, এদিকে ছেলেটি অপরাধী। তবে বোঝাই যাচ্ছে ঘটনা মোটে সাধারণ নয়।
কিন্তু এ নিয়ে তার এতো ভাবনার কারণ ছিল না। ছেলেটাকে কোন মতে ঢাকা চালান করতে পারলেই সে বেঁচে যায় আর কি। কিন্তু সমস্যা একটা হয়েছে? চার দেয়ালের মাঝে থেকে মানুষ কিভাবে উদাও হতে পারে তার মাথায় ঢুকছে না। তিনি গরম চায়ে চুমুক দিয়ে টাকমাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন,
—“ছেলেটা তো একা ছিল না… হাবিলদার রাজীব আর সুলতান তো পাহারায় ছিল!”
–“হাবিলদার সুলতান আর রাজীব,কেউ নেই সার”
কথাটা তার কানে গেল না। গাড়ির জানালা দিয়ে তিনি দেখলেন,রুদ্র সেই মেয়েটিকে নিয়ে আসছে তার দিকেই। তিনি গাড়ি থেকে নেমে বলনেন,
–“ ইমিডেটলি সব কটা বাস স্ট্যান্ডে খোঁজ নাও,সকালের সিডিউল ট্রেন গুলো চেক করো, ছেলেটি পালালে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে আমার.... আর তোমাদেরও,কথাটা মনে থাকে যেন।
তারকথা শেষ হতেই রুদ্র ও মায়া কাছে এসে পৌছালো।
–“ ভেতর এসো ওনাকে নিয়ে,কিছু কথা আছে।"
রুদ্র একটু অবাক হলো মায়ার সাথে তার মামার কথাবার্তা শুনে। আরিশ তার সাথে করে দুজন হাবিলদার সহ উধাও হয়েছে শুনে মায়াও অবাক হলো।
– “দেখুন আপনাকে ধরে রাখার মতো এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে। তা অনুযায়ী শাস্তি হয়তো খুব বেশি হবে না, তবে দিন কয়েক পেলে.... বুঝতেই পারছেন।
না! মায়া কিছুই বুঝতে পারছে না। এভিডেন্স যদি থাকে তবে তো মায়াকে লম্বা সময়ের জন্যে লকআপ ঢুকিয়ে দেওয়া চলে! সে অফিসারের চোখে চোখ রেখে ভালোমতো পরিস্থিতি তা বুঝে ওঠার চেষ্টা করলো। ভারি আশ্চর্য জনক হলেও আশিরে ওপরে এই পদ্ধতিটা কাজে আসেনি, কিন্তু অফিসারের বেলায় কিন্তু হলো!
– “ আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ তুলবেন আপনি? একটি অসহায় মেয়ে নিজের সম্মান বাঁচাতে একটা বাজে লোককে পিঠিয়েছে,এর জন্যে আমার জেল হবে না নিশ্চয়?”
– “দেখুন আপনি যে কতটা অসহায় তা আপনার সঙ্গী কে দেখলে বোঝা যায়, নেহাতই ওপর মহলে চাপ আর নয়তো...."
– “এটা তোমার বাড়াবাড়ি মামু, আরিশ পালাবে কেন?”
–“ উফৃ আবার মামু কেন? দেখ অন-ডিউটি আমি তোর মামু নই রুদ্র! আর আরিশ কেন পালাবে তা আমি কি করে বলি? কথা হলো সে পালিয়েছে,সাথে আমার দুই বিশ্বস্ত হাবিলদার নিয়ে পগারপার....না মা- মানে.......
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। অফিসার কাঁপা হাতে ফোন ধরলেন। ওপাশে থেকে কি কথা ভেসে এলো তার কিছুই জানা গেল না। অফিসার ফোন রেখে চটজলদি উঠে বেরিয়ে যেতে যেত বললে,
–“ রুদ্র,আমি আসছি, তোরা বাড়িতে অপেক্ষা কর,আর মেয়েটা যেন কোথায় না যায়, মানে পালিয়ে না যায় আবার!
রুদ্র চেয়ার পেছনে ঠেস দিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো। মায়া মুখ ঘুরিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে থাকিয়ে রইলো। অফিসার স্টেশন খানায় এসেছিল আরিশ পালিয়েছে শোনা মাত্রই। মায়ার নাম হয়তো পুলিশের খাতা আছে,তবে সে ছন্দনাম, তাছাড়া কোন ছবি নেই তার। এটা প্লাস পয়েন্ট হলেও মায়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য তো পুলিশের জানা। তাই তাকে এভাবে অবাধে ছেড়ে দেওয়ার কারণ মায়া এখনো বুঝে উঠতে পারছে না।
– “ বাড়িতে যাবে এখন? মামি তোমায় দেখলে খুব খুশি হবে।
– “এই রহস্যের শুরুটা রেলস্টেশনে হয়েছিল। আমি এখানে থেকে এটার শেষ দেখতে চাই।“
–” তা বোধ হয় সম্ভব হবে না মায়া। দেখ আরিশ পালিয়েছে এটা আমার বিশ্বাস হয় না, কারণ ওর পখলালোর কোন কারণই নেই! এদিকে তোমার সম্পর্কে কোন এভিডেন্স পুলিশের কাছে নেই,মামু যা বলেছে সব মিথ্যা! ভয় দেখানোর চেষ্টা মাত্র। তবে হ্যাঁ, আরিশ ঢাকা না পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তোমার মুক্তি নেই। সুতরাং আমি মনে করি আপাতত বাড়ি যাওয়াই ভালো নয় কি! নাকি তুমি এখানে থাকতে চাও?
মায়া আবারও ভাবে, “এই রুদ্র কি তার মনের ভাব বুঝতে পারে আরিশের মত? বোধহয় না!” প্রশ্ন জাগে মনে, উত্তর সে দেয় নিজেই। তার মনে হয়, ওই মানুষটার ভেতরে ছিল শুধুই উদ্দেশ্য, তবু তার উপস্থিতি তাকে এক অদ্ভুত নিশ্চিন্ত বোধ দিয়েছে। ভালোবাসা হয়তো নয়… কিন্তু এক ধরনের শ্রদ্ধা, আর বিশ্বাস—যা সে কাউকে দীর্ঘদিন দিতে পারেনি। টেবিলের ওপরে আরিশের চশমাটা রেখেছিল সে। প্রথম থেকেই চশমাটা মায়ার কাছে, পুলিশ হয়তো ভেবেছে এটা মায়ারই। অবশ্য ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়,ওটা মায়ার চোখেই যেহেতু ছিল।
টেবিল থেকে আবার ওরা হাতে নিয়ে মায়া নিজের মনেই বলে— “তুমি জানতেও পারবে না আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। যদি প্রশ্ন কর কেন? আমি উত্তর দিতে পারবো না, কারণ আমার নিজেও যে জানা নেই কেন!”
– “ তো কোথায় যাবো আমরা?“
–” হু!”
– “ বলছি মামির সাথে দেখা করবে? নাকি.....
মায়া উঠে পরে। হাতের চশমাটা চোখে পড়ে নিয়ে রুদ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– “ আমার একা পথ চলা শেষ হয়েছে। তবে তোমাকে দেখাতে চাই একটা জায়গা! তুমি কি যাবে আমার সাথে?
রুদ্র বুঝলো,মায়া যেখানে যেতে চায় সেই জায়গাটি এখন সব টিভি নিউজে দেখাচ্ছে। একবার কি ভাবলো সে,তার পর উঠে দাঁড়িয়ে বললে,
– “ তুমি আমাকে বিপদে ফেলবে মায়া,তবে গাড়ি যেহেতু আছে ত আর অপেক্ষা কেন?”
– উঁহু্, গাড়ি নয় ট্রেনে যাবো!
রুদ্র ঘড়ি দেখলো,তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললে,
– তবে দৌড়াতে হবে!
কিছু বোঝার আগেই মায়ার হাত ধরে রুদ্র দৌড়ে গেল বাইরে। স্টেশন প্লাটফর্মে যখন তারা এল,তখন গতকাল রাতে শেষ ট্রেন সবে গতি তুলেছে। লোহার পাতে লোহার চাকার ঘর্ষণের গাড়ি প্রায় প্লাটফর্ম ছাড়ে ছাড়ে অবস্থা। তবে রুদ্র উঠল, হাত বাড়িয়ে ধরল মায়ের হাত। এবার আর শেষ ট্রেন নয়– গতকালকের শেষ ট্রেন আজ সকালের প্রথম। যাত্রী পাল্টেছে ,পাল্টেছে গন্তব্য, গত রাতের যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো রয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে আরিশ হয়তো একজন।
............
আরিশ বসেছিল পেজন দিকটাতে। সম্মুখের দিগন্ত কেমন দ্রুত বেগে পেছনে সরে যাচ্ছে! স্টেশনে সেই গিটার বাজানো ছেলেটি একটু আগেও ফোনে বলছিল“ তুমি চিন্তা করো না মা আমি আসছি।” এখন সে গুম হয়ে বসে আছে। ছেলেটার সাথে তার বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক,ওরা আসেনি.... না ছেলেটি আসতে দেয়নি। আরিশ শুনেছিল ওদের বলা কথাগুলো ,এই ট্রাকে ওঠার আগেই।
– “স্যার!”
– “রাজীব! আমি তোমার স্যার নই।”
রাজীব কিছুই বললো না, শুধু ফোনটা এগিয়ে দিল। আরিশ দেখলো, তবে ফোন হাতে নিয়ে কল কেটে দিল। তারপর দিগন্তে চোখ রেখে বলল,
– ” আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,তাকি জানানো যায়?”
– “ প্রথমে ঢাকা। তার পর চট্টগ্রাম। এর বাইরে কিছু জানানো হয় আমাদের,তবে ভারত বা রাশিয়া এমন কিছু একটা শুনেছিলাম,তবে ওটা স্যার।”
আরিশ আর কোন প্রশ্ন করলো না। পকেট থেকে বের করলো একটা পেনড্রাইভ। চোখের সামনে ধরতেই লেখাটা ভেসে উঠলো, “প্রজেক্ট জিরো “ খুলে দেখার সুযোগ এখনো হয়নি। মারামারি পর স্টেশন পুলিশ বডি সার্চ করে সব নিয়ে নিয়েছিল। থানা পুলিশ খোলার চেষ্টা করেছে ,তবে পেনড্রাইভের ফাইল গুলো পাসওয়ার্ড লক করা। যদিও খামে শুধু এটাই ছিল না। সাথে একটা ছবি। একটি বিদেশি মেয়ে। ফর্সা টকটকে মুখ, লাল কেশরাশি কাঁধের একপাশে ছড়ানো,চোখের সানগ্লাস আর তার কাঁচে জ্বলন্ত অগ্নি শিখা।
এই দুটোর কি কোন মানে হয়। বোঝা মুশকিল যতক্ষণ না খুলে দেখা হচ্ছে পেনড্রাইভটি। কিন্তু সমস্যা একটাই পাসওয়ার্ড জানা নেই। মায়া নিজেও নিশ্চয় জানে না, খামের ভেতর কি ছিল মায়ার তা জানার কথা নয়,ওকে জানানো হয়নি। ওর কাজ ছিল পৌঁছে দেওয়া। হঠাৎ এতো গুলো বছর পর!
ভাবনাটা থামিয়ে দেয় আরিশ।আবেগী ভাবনা তার মানায় না । তবে মায়াকে জুড়ে তার কলেঝ জীবন,প্রথম ভালো লাগা কি ভালোবাসা ,তা সে এখনো জানে না।
মায়া এখন ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুটে চলা দিগন্তে তাকিয়ে অতিতের পাতা উল্টে চলেছে। পাশে বসে এক দৃষ্টিতে রুদ্র দেখছে তার প্রিয়তমার মুখ, তৃষ্ণা হয়তো তার একারই মিটেছে। ওদিকে দূরের কোন পথে আরিশ হাতের মুঠোয় পেনড্রাইভ আর ছবিটা নিয়ে বসে।
“প্রজেক্ট জিরো" ট্রাকের পেছনে বসা ছেলেটার চিন্তা ভাবনার পরবর্তী গন্তব্য। মায়া দূরের রেলপথে কোন এক কামরায় বসে আছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না—এই পথ কি মুক্তির, নাকি অন্ধকারের? ট্রেন গর্জন করে সামনে ছুটে চলেছে। পেছনে পড়ে থাকে প্রশ্ন, উত্তর আর অদেখা ভবিষ্যৎ...শেষ ট্রেনের এই দুজন যাত্রীর পথ এখন আলাদা,বাকি সবার মতোই। তবে গন্তব্য বদলায়, দূরত্ব বাড়ে, কিন্তু চেনা মুখ গুলো হয়তোবা সহজেই অচেনা হয়ে যায় না....
সমাপ্ত
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)