Thread Rating:
  • 11 Vote(s) - 2.64 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romantic Thriller শেষ ট্রেনের যাত্রী/ সমাপ্ত
#51
পর্ব ৫

– "ছেলেটা সত্যি হতভাগা!"

কথাটা রুদ্র বলল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এতগুলো বছর পেরিয়ে মায়া আবারও রুদ্র কে দেখবে,এটি তার জন্যে একে বারেই অপ্রত্যাশিত। আরিশ যদিও বলেছিল সবটা। কিন্তু কেন যেন বিশ্বাস হয়নি মায়ার।। বা হয়তো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি তার।

– "কাকিমার কথা তোমার মনে আছে মায়া?"

– “হু....!” মায়া ধাক্কাটা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। তাই রুদ্র প্রশ্নের কোন বিশেষ উত্তর তার কাছে থেকে পাওয়া গেল না।

– “শুধু হু্! কাকিমার কথা মনে নেই তোমার? কাকু- কাকিমার প্রেম নিয়ে তুমি আমায় কত কথা শুনিয়েছো। তাছাড়া.....”

– “কেমন আছেন উনি?”— এই প্রথম বার মায়া মুখ তুলে চাইলো রুদ্রর দিকে, শান্ত ও ক্লান্ত চোখের দৃষ্টিতে।

– “ভালো নেই মায়া! আসলে ওদের পুরো পরিবারটাই ভালো নেই।..... মাত্র এক বছর মায়া, মাত্র এক বছরে পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেছিয়েছে...”

রুদ্র বলতে লাগলো,মায়া তার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন দেখছিল সবটা,এই গভীর কালো চোখের মণিতে....



– শুরুটা হয় আফরোজা দিদির বিয়ে দিয়ে।ভেতরের খবর আমি খানিক জানি দাদা পুলিশ বলে। তবে তোমায় প্রথম থেকে বলি— দিদি বর ছিল রাজনীতিক দলের বড় কর্মকর্তা,তার স্বভাব চরিত্র বিশেষ ভালো ছিল না। এখন ভাবলে খুব আফসোস হয় মায়া। যদি কোন ভাবে সেই দিনটা ফিরিয়ে আনা যেত,তবে বিয়েটা আমি নিজে আঁটকে দিতাম।

– “তাই?” 

মায়া ভালো করেই জানে রুদ্রর প্রথম ভালো লাগা আফরোজা। হয়তো কিশোর বয়সে ছেলে সিনিয়র দিদির....না! মনটাকে আবার ফিরিয়ে আনে মায়া।দেখে আর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রুদ্রর বুকের গভীর থেকে। তারপর রুদ্র বলতে লাগলো আবারও

– “ লোকে বলে ছেলেটির পিতার মৃত্যুর পর ও বাড়িতে নানান লোকজনের আসা যাওয়া শুরু হয়। রাজনীতিতে পাকা দাপুটে নেতা, তাছাড়া বাপে টাকা ছিল যথেষ্ট। অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধুবান্ধব মিলে মদতট খেয়ে যা তা অবস্থা। রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে এইসব অসম্ভব নয় যদিও। কিন্তু এক রাতে আফরোজাদি খুন হয় ও বাড়িতে! প্রথমটা চালানো হয় আত্মহত্যা হিসেবে, কিন্তু ওরা সন্দেহ করে দিদির বরকেই। এরপর পুলিশ-কোটকাচারী, কিন্তু কোন লাভ হয়নি।

এ কথা মায়ার অজানা নয়। বিশেষ করে সে নিজেও অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে টাকার সামনে মাথা নত করতে দেখেছে,মায়ার নগ্ন দেহের সামনেও! তবে মায়া চমকে উঠলো রুদ্রর পরবর্তী কথা গুলো শুনে,

– “ আসলে আফরোজা দিদিকে ওরা সবাই মিলে.... মানে। ( বলতে বলতেই রুদ্রর চোখ মুখটা কেমন কঠিন হয়ে গেল, দাঁতে দাঁত লেগে একটু থমকে গেল যেন।) মেয়ের মৃত্যু সইতে না পেরে কাকিমা কেমন যেন হয় গিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম পুলিশ কাকামণিকে খুনের দায়ে থানায় আটকেছে। অনেক রকম কথা উঠলেও আমার মনে হয় কাকামণি রাগের বসে আফরোজা দিদি বরকে গলা টিপে হত্যা করে। উনার ফাঁসির আদেশ শুনে কাকিমা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেনে....“

এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু নেমে এলো চোখের কোণ বেয়ে। মায়া চেয়ে ছিল একদৃষ্টিতে। অবশেষে যখন শুনলো আরিশের মাকে পশ্চিমবঙ্গে তার বাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ছেলের সাথে দেখা করার অধিকার টুকুও তার নেই, তখন সত্যিই তারও দুই চোখ জল টলমল করে উঠলো।

এতখন মনে তার কিছুই ছিল না,থাকার কথাও নয়। অনেক সময় নিয়ে সে সবটি ভুলে ছিল এতোদিন। শুধু...... শুধু ভুলতে পারেনি রুদ্রকে,তবে ভুলতে শুরু করেছিল একথা মিথ্যে নয়। এখন রুদ্রর চোখের কোনে জল দেখে আচমকা সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ার।

আশ্চর্য লাগল—সে আগে কেন আরিশকে চিনতে পারেনি?
কলেজের সেই রোগা-পাতলা, পাগলাটে ছেলেটি!
হাঁ! সেই তো! ছেলেটি  রুদ্রর বন্ধুদের মধ্যে ছিল একেবারে আলাদা স্বভাবের। অনেক বার মায়া তো নিজেও দেখেছিল আরিশ নিজের খাবারও ভাগ করে দিত বন্ধুদের। আসলে কাকিমার রান্নার হাত ছিল এক কথায় সোনা বাঁধানো। তাই আরিশ না দিলে বন্ধু-বান্ধবেরা একরকম কাড়াকাড়ি করে ছিনিয়ে নিত।

ছেলেটা কী বোকা দেখতে ছিল তখন। বোকা বোকা চেহারা, অথচ চোখে-মুখে ছিল এক অন্য রকমের উচ্ছ্বাস—যেন নিজের এক আলাদা দুনিয়ায় বাস করত সে। আজ দেখলে অবাক লাগে। সেই ছেলেই এখন এক সুপুরুষ যুবক! 
ভাবা যায় এমনটা সম্ভব? 

 প্রশ্ন জাগে মনে,তবে উত্তর দেয় তার নিজের অতিত। সময় মানুষকে কতটুকু পাল্টে দিতে পারে! শেষটায় ওই পাগলটার সাথেও তার এই সব লেখা ছিল তা হলে। আগেকার সময় হলে মায়া লজ্জায় লাল হতো এখন।আফজোরা দিদির কথা শুনে মনে জমাট বেঁধে নামতে ঈর্ষা। কিন্তু আজ চোখের জলে দুই গাল ভেসে গেল তার।

মনে মনে সে ভাবলে, হয়তো ওই সোনালি ফ্রেমের চশমাটিই চিনতে না পারার অন্যতম কারণ। পরক্ষনেই নিজের মনে বলে না....তা নয় মোটেও—ওর চোখের ভেতর তাকালেই বোঝা যায়,এ সেই আরিশ। কারণ পাগলাটে স্বভাবটাও যে আজও ছেলেটার  যায়নি মোটে। তবে আজ তার মুখে নতুন করে লেগে আছে এক শান্ত স্থির হাসি। যেন জীবনের অনেক কিছু জেনে ফেলেছে, তবু কিছুই হারায়নি সে—বরং আরও কিছু পেয়েছে। 

মায়া খানিকের জন্যে অতীতের গভীরতায় ভেসে যায়, খানিক আগে তারা কোথায় ছিল? এখন আরিশ কোথায়?  কোথায় সেই অল্প কিন্তু সুন্দর সুখময় সময় টুকু? মায়া জানে না,তবে ভাবে কিছু সময় কি নাছোড়বান্দা! তাই না? মনের গহীনে লুকিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সর্বক্ষণ~~~~~



চুম্বন থেমে গিয়েছিল অনেক আগেই, এরপর ঘটেছে অনেক কিছুই। কিন্তু চোখে-মুখে এখনো তার রেশ লেগে রয়েছে। ভেতরের ঘনীভূত উত্তাপ যেন নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ছে। আরিশ মায়ার চোখে তাকিয়ে হঠাৎ কাঁপা গলায় বলে—

– “মায়া! আমি.....আ... আমি!

এক মুহূর্তের জন্য সময় যেন স্থির হয়ে যায়। জীবনে হয়তো এই প্রথম আরিশের কথাগুলি কন্ঠেই আটকে গেছে। কিছু বুঝে উঠতে পারে নাসে কেন হচ্ছে এমন? তবে মায়া যে ভেঙ্গে পড়েছে তা সে বুঝেছিল। কিন্তু তার প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পরেছে তা আরিশ ভাবেনি। অবশ্য তখন আর এই সব ভাবনা সময় কই। স্টেশন থেকে লোকজনের সাথে ছুটে এসেছে রেল পুলিশ। আরিশের হাত পিস্তল ছিল। সুতরাং তাকে গান পয়েন্টে রেখে বলা হলো হাত ওপরে তুলতে। তারপর যা হয়েছে তা এই দুজনের প্ল্যানে না থাকলেও বোধকরি খোদাতাল্লার চিন্তাধারায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা ছিল।

তখনও ওই আধোআলোয় ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেনটি। বাইরের নিস্তব্ধতা যেন নিঃশব্দে পেঁচিয়ে ধরেছিল কেবিনটিকে। বাইরে শুধু টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ… আর ভেতরে দু’জন মানুষের ঘন ঘন নিঃশ্বাস।

আরিশ ও মায়া—একই হাতকড়ায় বাঁধা, পাশাপাশি বসে। বৃষ্টির পানি জানালার কাঁচ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। যেন তাদের অন্তরের ভেতরটাও ধুয়ে দিচ্ছিল সে জল। মায়ার দেহে এখনো হালকা জ্বরের ছাপ, কিন্তু চোখদুটো... তীব্র, জ্বলন্ত! যেন কোনো এক অন্তর্জ্বালায় পুড়ে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে আরিশের দিকে ঘুরে বসে। কেবল একটি অঙ্গুলির দূরত্ব—তাদের শরীর, নিঃশ্বাস, ইচ্ছা—সব একরকম জমাট হয়ে আছে। 


তাদের এই কেবিনে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। এই ছোট্ট স্টেশনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা আর কোথায়? থানা তো দূরের কথা। ট্রেনের লোকেরাও আশ্চর্য বটে, মোবাইল হাতে পিস্তলধারির ভিডিও করতে ভয় নেই,অথচ হাতকড়া বন্দি দুই অপরাধীর পাশে বসতে ভয়ে কাতর। তাই অগত্যা ফাঁকা কেবিনে মায়া ও আরিশের আশ্রয়। অবশ্য একটু প্রাইভেসি পেয়ে মন্দ হয়নি। খানিক আগেই আরিশ মায়াকে বলেছে সব। বলেছে একমাত্র রুদ্রর অনুরোধে মায়ার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েছিল আরিশ, কিন্তু এই কথা বিশ্বাস হয়নি মায়ার। আরিশ বলেছে রুদ্র এখনো তাকে ভালোবেসে। এখনো তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে। এই ট্রেনের শেষ গন্তব্যে হয়তো এখন রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে শুধু তার জন্যই।

এই সব শোনার পর আরিশের ধারণা ছিল মায়া খুশী হবে।একরাশ আনন্দ উচ্ছলতা ফুটে উঠবে মায়ার মুখে। কিন্তু হয়েছে উল্টো,মায়া বিষণ্ণ মুখে বসে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটাকি বিশ্বাস খরছে না তাকে?

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে......দূরত্ব কম আসছে তীব্র গতিতে.. কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই অনেকক্ষণ। এরপর একসময় নিজের অনুভুতি গুলো সামলে নিয়ে হঠাৎই মায়া বলে উঠলো,

– "তুমি কেন এসেছিলে আমার জন্য? যেমনটি ছিলাম তেমনি থাকতে দিলে না কেন?" মায়ার কণ্ঠ জড়ানো, কিন্তু গভীর।

আরিশ কোনো কথা বলে না। তার চোখে কেবল মায়ার মুখ, অগোছালো চুল, অশ্রুর ফোঁটায় ভেজা গাল, আর অদ্ভুত নরম এক আলো ছড়ানো ঠোঁট—যার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই অপরাধ মনে হয়, অথচ চোখ ফেরানো যায় না।

হাতকড়ায় বাঁধা হাত ধীরে ধীরে মায়ার দিকে সরিয়ে আনে আরিশ। ওদের কনুই ছুঁইছে, তবু যেন দুজনের মাঝখানে হাজার মাইল দূরত্ব বেয়ে গিয়েছে। তবে আরিশকে অবাক করে মায়া দূরত্বটা কমিয়ে আনে,ওর কাঁধে মাথা রাখে । আরিশ অনুভব করে কাঁধের ওপরে ছোট ছোট কাঁপুনি। তা কি জ্বরের, না ভেতরের কোনো দহন—সে জানে না।

– "তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে..." মায়া কাঁপা গলায় বলে, "আমি হয়তো এই অন্ধকারে হারিয়ে যেতাম। কিন্তু তুমি ....."

মায়া কথা শেষ করতে পারে না,আরিশের কাধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আবারও। রুদ্রর প্রতি তার ভালোবাসা হয়তো এখনো আছে মনের গভীরে। কিন্তু আরিশের উপস্থিতিতে সেই অনুভূতি এতটাই চাপা পরে গিয়েছে- যে তারা আর ঠেলে বেরুবার পথ পাচ্ছে না।

আরিশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে একসময় ওর চিবুক ধরে তুলে নেয়। চোখে চোখ পড়ে। কান্নার দমকে মৃদুমন্দ কাঁপছে ঠোঁট—তীব্র এক চুম্বনের অপেক্ষা করছে যেন!

মায়া নিজেই চোখ বন্ধ করে ঠোঁট বাড়ায়। এবার আরিশ থামে না।তাদের ঠোঁট এক হয়ে যায়—ভেজা, কাঁপা, কিন্তু গভীর। যেন দুই ভাঙা আত্মা একে অপরকে জুড়ে দিচ্ছে। চুম্বনের ভেতর দিয়ে মায়ার কন্ঠস্বরে ...আহহহ্.. ধ্বনি বেরিয়ে আসে। একরাশ জমে থাকা বিষণ্নতা যেন ঘন বর্ষার হয়ে ঝড়ে পড়ে। আলতোভাবে আরিশের আঙুল মায়ার ঘাড় ছুঁয়ে যায়, সেখান থেকে সরে আসে গালের পেছনে, ভিজে চুলের গোঁড়ায়। মায়া একটু পিছিয়ে এসে বলে,

– "এই হাতকড়া না থাকলে আমি তোমার গলা জড়িয়ে ধরতাম।"

আরিশ হাসে, তারপর চোখে চোখে রেখে তাকায়,– "হাতকড়া থেকেও তুমি পারো…"

মায়া হঠাৎ ঘন হয়ে আসে। বুকের কাছে ঠেসে ধরে আরিশকে, পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে, যেন এই মুহূর্তে সে ছুঁড়ে ফেলতে চায় সব অতীত, সব শঙ্কা। মায়া ধীরে ধীরে বলে, 

– “তোমার শরীরের গন্ধটা যেন আমার সমস্ত শীত লাগা দূর করে দেয়,সব অতীত বর্তমান এক নিমিষেই ভুলিয়ে দেয়… দোহাই তোমার না বলো না,এর পর হয়তো.....হয়তো.....

হাতকড়ার শেকল টেনে উঠে একবার। ওদের হাতে ব্যথা লাগে সামান্য, কিন্তু সে ব্যথার মাঝে আনন্দের হালকা শিহরণ। দুজনেই কিছু বলে না, শুধু নিঃশ্বাস বদল করে। টি-শার্টের পাতলা আচ্ছাদনের নিচে মায়ার যুবতী দেহের উঁচুনিচু অবয়বে ঘোরাফেরা করে আরিশের হাত দুটি। ওদিকে মায়া যেন কোন মানবী নয়–এক হিংস্র বাঘিনী! 

সে প্রবল উত্তেজনায় দুহাতের লাল নেল পলিশ পড়া নখে ছিন্নভিন্ন করে দেয় আরিশের দেহের কাপড়। মায়াকে সামলাবার চেষ্টা করে আরিশ। কিন্তু হঠাৎ করে আজ মায়া যেন মহা মায়ার মতই শক্তিধর হয়ে উঠেছে। আরিশের গালের দুই পাশে হাতরেখে মায়া গভীর চুম্বনে ডুবিয়ে দেয় তাকে। দুজনের নিঃশ্বাস হয় ওঠে তীব্র থেকে তীব্রতর। কামের তাড়না ছুয়ে যায় সকল বাস্তবতার উর্ধ্বে। চুম্বনের সাথে চলে এলোমেলো কামড়, যদিও কামড় শুধু আরিশের দেহতেই পড়ে। আর মায়ার পাতলা দেহটি ট্রেনের লোহার দরজায় চেপে বসে এক সময়।

তখন কামের উত্তেজনা ছুয়ে গেছে আরিশকেও। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল একজন। চলন্ত ট্রেনের ঝনঝন শব্দে হয়তো তার কানে ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে মায়ার কামার্ত আর্তনাদ।আর নয়তো অজানা ভয়ে একবার দরজা ঠেলেই সে ছুটেছে সামনে সহকর্মীকে ডাকতে। ভেতর তখন প্রতিটি ধাক্কায় ধাক্কায় সারা দেহ কেঁপে উঠেছে মায়ার। টি-শার্টে ওপরে আরিশের একটি হাত ক্রমাগত চেপে বসছে মায়া স্তনে। হয়তো প্রবল তৃপ্তিতেই স্তনবৃন্ত দুটি টনটন করে উঠছিল তার।হাতকড়া বন্দি দুজনের হাত দুটি আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে।

সময় কিভাবে পেরিয়ে যায় তারা জানে না। একটি কেবিন দুই নর নারী এই মুহূর্তে আদিম লীলায় মত্ত। তাদের জন্যে এখন সময় কোন মূল্য রাখেনা। পুরুষাঙ্গ ও যোনির মিল বন্ধন তো হাজার হাজার বছর পুরনো চিরন্তন বাস্তবতা। তার সাথে ভালোবাসা মিশে গেলে.. তা কি আর দুনিয়াদারির খেয়াল রাখে?

এরপর এক সময় বাইরে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। ভেতরে সময় থেমে থাকে তখনো। ট্রেনের কম্পনে জানালায় জমা বিন্দু বিন্দু জল ঝরে পড়ে। বাতির আলোর আভায় মায়ার মুখটা রহস্যময় ছায়ার মতো লাগছে। চুম্বন ও মিলন ভেঙে সে চুপচাপ বসে, এক হাতে শক্ত করে ধরেছে সে আরিশের হাত। যদিও আরিশ বলেছে  “কোন ভয় নেই মায়া....আমি আছি তো,সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।” এরপর শুধু ট্রেনের যান্ত্রিক শব্দ আর দু'জনের নিরবতা। 

তবে আরিশ নিরব থাকলেও চোখে তার সতর্কতা, আর মস্তিষ্কে চলমান বিশ্লেষণ। মায়ার মুখ পড়ার চেষ্টা করছে সে—শুধু সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল নয়, বরং একজন সত্য সন্ধানীর নিরব,শান্ত কিন্তু চতুর দৃষ্টি! সে খোঁজার চেষ্টা করছে কিছু,তবে মুখে সেটি বলতে পারে না।

–“এতো ভয় পাচ্ছো কেন?” — আরিশ হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

–“জানি না কেন, ওকথা আর জিগ্গেস করো না আরিশ।” 

মায়া বলল। ঠোঁটে জড়ানো নিঃসঙ্গতা আর দু'চোখে চাপা অস্থিরতা ও ভয় নিয়ে। উত্তেজনা কেটে গেল এক সময় সবাইকে ফিরতে হয় বাস্তবতাতে। এখন মায়ার মনে ও তাই নিয়ে চলছে চিন্তা ধারা।

আরিশ তাকায়, কিন্তু আর কেন প্রশ্ন করে না। সে জানে, এই মেয়েটার ভেতর একটা ধ্বংসস্তূপ আছে—ভেঙে পড়া দেয়াল, জ্বলন্ত ছায়া। তাড়াহুড়ো করলে সব ভেঙে যাবে, নীরব থাকলে সে নিজের মতো বেরিয়ে আসবে। গন্তব্য এখনো খানিক দূরে। আরিশ মায়ার মাথাটা টেনে আনে,মায়া প্রতিবাদ করে না, বরং রতিকান্ত মেয়েটি আরিশের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে পা গুটিয়ে।

তার চোখ জানালার বাইরে — ছুটে চলা রাত, অস্পষ্ট স্টেশন, দূরের কোনো ঘোষণা শোনার আশায়। সে ভাবে: ভাবে এই মানুষটা কে? তার মনে হয়—আরিশ যেন তার জীবনের এক নিঃশব্দ সংলাপ। যা সে কখনো বলতে পারেনি, কিন্তু বুঝতে পারছে। খুব কাছের কেউ, কিন্তু তবুও চিনতে পারেনি। আচ্ছা! একজনের পরিচয় না জেনে কি এতটা কাছে আসা সম্ভব,নাকি এই লোকটাই তার চির চেনা কেউ?


এই ভাবনা চিন্তা করতে করতে আজও চেতনার মধ্যে সময় পেরিয়ে যায়। মায়ার ভাবনার মাঝেই ট্রেন ধীরে ধীরে থামে।আলো-আঁধারির মাঝখানে এটি হয়তো এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য,তবে মায়ার জীবনের জন্যে এটি এক অজানা স্টেশন। এই মুহূর্তে তার সব কিছুই অন্ধকার,একমাত্র আরিশ ছাড়া। তাই ট্রেন থামতেই মায়া আরিশর বাহু জরিয়ে ধরে।

ওদিকে সবাই এখন নামছে। আরিশও দাঁড়িয়ে পড়ে। পরক্ষণেই দু'জন পুলিশ ঢোকে কেবিনে। বড় কর্মকর্তাদের কেউ নয়,থাকার কথাও না। থাকলে নর-নারীর ওই প্রলয় কর্মকান্ডে ব্যাঘাত অবশ্যই দিত,ভয়ে আরেকজনকে ডাকতে যেত না! তবে লোক দুটি অচেনা,আগের দুজন নয়।

–“উঠে পরুন,এখন নামতে হবে।” 

তাদের গলায় শান্ত,অন্য সব সাধারণ মানুষের সাথে এমনটা অধিকাংশ সময়ই থাকে না। আরিশের মুখে শান্ত হাসিটা আবারো ফিরে এসেছে। মায়ার হাত খানি শক্ত করে ধরে সে বলেছিল

 – “ ভয় পেওনা। তোমার কিছু হবে না, কথা দিলাম।”


আরিশের এই কথার পর তিন ঘন্টা কিভাবে কাটলো মায়া নিজেও জানে না। আরিশ বললেও ভয় তার মনে ছিল। সে বিশ্বাস না করলেও, মনের অবচেতনে সে জানে আজ এই স্টেশনে কেউ তার অপেক্ষায়। ভাবতেই মায়ার বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। কাউকে সে চায়নি, কাউকে সে আশা করেনি!

না! নিজের মনেই বলে ওঠে সে– আজ আর মিথ্যা নয়, রুদ্র প্রতি ভালোবাসা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি আরিশের প্রতি এই দুর্বল অসহায় অনুভুতি গুলোও মিথ্যা নয়। সে এখনো জানে না আরিশ কে? কি তার আসল নাম ....কি তার পরিচয়? এই ভাবনার মাঝেও বন্ধ ঘরে একজন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে ঢোকে রুদ্র। মুখে তার হাসি,প্রবল উত্তেজনা যেন সেই হাসিতেই ফুটে উঠেছে। 

পরিচিত মানুষের সান্নিধ্যেও মায়ার ভয় কাটে না। আর কেউ না জানুক,সে নিজে তো জানে সে একজন অপরাধী। আচ্ছা! সবটা নিজে থেকে স্বীকার করে নিলে হয় না? এই কঠিন জীবনের বাস্তবতা থেকে একটু আড়ালে জীবনটা যদি কেটে যেতে ! তবে তো মন্দ হতো না!

না,মায়া পারেনা কিছু বলতে, বলার সুযোগও সে পায়নি। রুদ্র তার হাত শক্ত হাতে ধরে তাকে বের করে নিয়ে আসে বাইরে.... দ্রুত বেগে। আশেপাশের শত লোকজনের দৃষ্টি কে উপেক্ষা করে তারা বেরিয়ে আসে স্টেশনের বাইরে। তারপর গাড়িকরে দোতলায় এই কফি হাউজে। গাড়িতে কাঁচের ভেতর থেকে সে দেখেছিল হাতকড়া পরিয়ে বন্দি আরিশকে বের করে আনছে পুলিশ। ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে সত্যটা সে বলে সবার সামনে। চিৎকার করে স্বীকারোক্তি দিতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা অধিকাংশ সময়েই করে উঠতে পানে না~~~~~~


যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥


[+] 1 user Likes কালপুরুষ's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: শেষ ট্রেনের যাত্রী - by কালপুরুষ - 05-09-2025, 10:55 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)