29-07-2025, 07:01 PM
(This post was last modified: 01-08-2025, 07:42 PM by gungchill. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
কিছু সম্পর্কঃ ১
জয়নাল চৌধুরী আর রহিম সিকদার দুজন ছোট বেলার বন্ধু । দুজনের বাড়ি ও পাশাপাশি , তাই বন্ধুত্ব ছোট বেলা থেকে যৌবন শেষ হয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত অটুট আছে । দুজনে হরিহর আত্মা , দুজন কে দেখেলে বলবে এরা দুই ভাই , নাহ ভাইদের মাঝেও এতো ভালো সম্পর্ক থাকে না যা এদের দুজনের মাঝে আছে । জয়নাল চৌধুরী বংশ পরম্পরায় ধনী , বাপ দাদার বিজনেস সামলায় । আর রহিম শিকদার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে , যদিও বাপ দাদার রেখে যাওয়া যে বাড়ি আছে তার দাম অনেক । কিন্তু রহিম সিকদার এই বাড়িকে মূল্য দিয়ে বিবেচনা করে না । সে নিজে সারাজীবন শিক্ষকতা করেছে , টাকার কষ্ট করেছে কিন্তু কোনদিন বাড়ি বিক্রি বা ডেভ্লপার কে দেয়ার চিন্তা করেনি । তাই এই আধুনিক যুগেও শহর অঞ্চলে পাশাপাশি দুটো দোতলা বাড়ি রয়ে গেছে । একটি বেশ জমকালো অন্যটি একটু জীর্ণ । জয়নাল চৌধুরী আর রহিম শিকদার মাঝে অবশ্য দুজনের আর্থিক অবস্থা দেয়াল হয়ে দাড়ায় নি । কেউ কাউকে টকায় হিসাব করে না ।
বাকি সব কাজের মত দুই বন্ধু বিয়েও করেছে এক সাথেই প্রায় । রহিম শিকদারের বিয়েতেই জয়নালের মা জয়নালের জন্য পাত্রি পছন্দ করে । আর তার এক সপ্তার মাঝেই বিয়ে হয়ে যায় । দুজনের স্ত্রী একে অন্যের বান্ধবি । আর এই কারনে এই দুজনার বন্ধুত্ব যেন আরো গভির হয়ে যায় ।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুই পরিবারে নতুন অতিথি চলে আসে তাও এক মাসের কম সময়ের ব্যাবধানে । জয়নার চউধুরির ছেলে জন্মানোর দশ দিনের মাথায় রহিম শিকদারের ছেলে জন্ম নেয় । দুই পরিবারেই খুশির বন্যা বয়ে যায় । দুই বন্ধু ডিসিশন নেয় যে তাদের সন্তানেরা কোন দিন যেন দুই বাড়ির মাঝে তফাৎ না করে , একে অন্যের বাড়ি কে নিজের বাড়ি মনে এমন ভাবে এদের মানুষ করবে । তাদের দুই সন্তান ভাইয়ের মত বড় হবে । কাকে বড় আব্বু বলবে আর কাকে ছোট আব্বু সেই নিয়ে দুই বন্ধুর মাঝে ছোট খাটো যুদ্ধ ও লেগে যায় । শেষে ডিসাইড হয় যেহেতু রহিম শিকদার কিছুদিন পর বাবা হয়েছে তাই রহিম শিকদার হবে ছোট আব্বু , আর জয়নাল চৌধুরী বড় আব্বু ।
রহিম শিকদার কোনদিন বন্ধুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়নি , আর জয়নাল চৌধুরী ও কোনদিন যেচে পরে আর্থিক সাহায্যর কথা বলেনি , বন্ধুর প্রতি সম্মান দেখিয়ে । কিন্তু ছেলের ক্ষেত্রে জয়নাল চৌধুরী এই অলিখিত নিয়ম মানতে একদম নারাজ , নিজের ছেলে জয়ের জন্য যা যা কিনেছে বন্ধুর ছেলে রাজীবের জন্যও ঠিক তাই কিনেছে । রহিম শিকদার এর বিরোধিতা করতে এলে একপ্রকার তেড়ে গিয়েছে বলেছে “ খবরদার যদি আমাকে আমার ছেলের জন্য কিছু কিনতে বাধা দিস” । রহিম শিকদার ও হার মেনে নিয়েছে । আসলে দুই বন্ধুর মাঝে ইগো বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই ।
রাজিব আর জয় ও সেই ছোট বেলা থেকেই ভাইয়ের মত বড় হতে থাকে ।
দুই বছর পর দুই পরিবারে আবারো আনন্দের জোয়ার ওঠে , রহিম শিকদারের স্ত্রী আফরোজা আর জয়নাল চৌধুরীর স্ত্রী আয়শা আবারো গর্ভবতী হয় । এবারো দুজনের মাঝে অল্প দিনের তফাৎ । এবং আশ্চর্যের বিষয় এবার দুজনের ঘরে ফুটফুটে দুটো মেয়ে হয় । রহিম সেখের মেয়ের নাম রাখা হয় রানী , আর তার ঠিক পনেরো দিন পর জম্ন নেয়া জয়নাল চৌধুরীর মেয়ের নাম রাখা হয় জান্নাত ।
হাসি আনন্দে , সুখে দুঃখে দুই পরিবারের দিন কাটতে থাকে ।
কিন্তু খুশির দিন সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না । রানীর বয়স যখন ছয় আর রাজীবের আট তখন হঠাত আফরোজার এক দুরারোগ্য রোগ ধরা পরে । রানীর জন্মের সময় এই কমপ্লিকেসন তৈরি হয়েছিলো বলে ডাক্তারের ধারনা , কিন্তু তখন ধরা পরেনি, যতদিনে ধরা পরলো ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে । কিন্তু রহিম হাল ছাড়তে নারাজ , পানির মত টাকা খরচ করতে লাগলো। প্রচুর খরচ হয় সেই চিকিৎসায় , রহিম শিকদারের জমানো টাকা শেষ হয় চোখের পলকে । জীবনে এই প্রথমবার রহিম শিকদার নিজের গরিব হওয়া নিয়ে কোন প্রকার হীনমন্যতায় ভোগে । সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি বিক্রি করে দেবে। এ কথা শুনে জয়নাল চৌধুরী হন্তদন্ত ছুটে আসে বন্ধুর কাছে । অনেক বোঝায় , টাকা ধার দেয়ার কথা বলে , শেষে না পেরে ঝগড়া বাধাতে যায় । কিন্তু রহিম শিকদার নিসচুপ থাকে । এক পর্যায়ে রহিম শিকদার খপ করে জয়নাল চৌধুরীর দুহাত চেপে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে “ আমাকে মাফ করে দাও বন্ধু, আমাকে মাফ করে দাও” এর পর জয়নাল চৌধুরী আর কিছু বলে না । মাথা নিচু করে সেদিন রহিম শিকদারের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় ।
সেদিন রাতে দুই বাড়িতে কারো চোখে ঘুম হয় না । এমন কি ছোট্ট জান্নাত আর রানী ও বোঝে যে খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। বয়সে কিছুটা বড় রাজিব আর জয় ও বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছে । দুই বন্ধু সেদিন এক ঘরে ঘুমায় , যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে পরে ততক্ষণ দুই বন্ধুর মাঝে কথা চলে । শেষে ঘুমানোর ঠিক আগে দুই বন্ধু প্রতিজ্ঞা করে যত কিছুই হোক , কোন কিছুতেই ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না । মরে গেলেও না ।
রহিম শিকদার ও সারারাত চোখ বুজতে পারে না । সকালে উঠেই বন্ধুর কাছে যায় । জয়নাল খাঁ তখন নিজ বাড়ির নিচ তলায় বারান্দায় বসে । দু চোখ লালা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি । রহিম চুপ চাপ বন্ধুর পাশে এসে বসে , বেশ কিছুক্ষন নীরব থাকার পর বলে “ টাকাটা আমি তোর কাছ থেকেই নেবো” কথাটা বলে চুপ হয়ে যায় রহিম , এদিকে জয়নাল আনন্দে লাফিয়ে চেঁচামেচি করতে শুরু করে ।
সেই চেঁচামেচি শুনে আয়শা বেড়িয়ে আসে রান্না ঘর থেকে , কি হয়েছে জিজ্ঞাস্ করলে জয়নাল আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে
“ যাও আয়শা আমাদের জন্য চা আর নাস্তা নিয়ে এসো , ভেবেছিলাম এই হারামি শালাকে চা অফার করবো না ,কিন্তু হারামি ভালো হয়ে গেছে “
আয়শাও বেশ খুশি হয়ে আবার রান্না ঘরে ফিরে যায় । কিছুক্ষন পর চা আর টোস্ট নিয়ে হাজির হয় । বলে “রহিম ভাই আমি খুব খুশি হয়েছি”
নাস্তা শেষে রহিম বলে , “ কিন্তু আমার একটা সর্ত আছে”
“ কি সর্ত বল ব্যাটা” জয়লান উৎফুল্ল স্বরে জানতে চায়
“ বাড়িটা তুই রাখবি “ রহিম বেশ শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলে ।
রহিমের কথা শুনে জয়নাল ওর দিকে অবাক চোখে তাকায় , জয়নালের চোখে মুখে অবিশ্বাস , কিছুক্ষন এভাবেই চুপ থেকে জয়নাল হঠাত উঠে দাঁড়ালো , ওর চোখ মুখ থমথমে । কয়েক মুহুরতপর জয়নাল একদম শান্ত স্বরে বলল “ বেড়িয়ে যা , তোর চেহারা আমি দেখতে চাই না , তুই আমার বন্ধুত্বকে অপমান করেছিস”
জয়নালের শেষ কথা আয়শা শুনে ফেললো , এই মাত্র বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে স্বামী আর রহিম কে সঙ্গ দেয়ার জন্য বারান্দায় এসেছিলো ।
“ কি ব্যাপার তুমি এমন কথা বলছো কেন” হন্তদন্ত হয়ে বলল আয়শা , তারপর আবার রহিমের দিকে তাকিয়ে আকুতি মিশিয়ে বলল “ ভাই প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না”
“ নাহ ভাবি আমি কিছুই মনে করিনি , আমি এর যোগ্য, জয়নাল আমাকে আমার প্রাপ্য ই বুঝিয়ে দিয়েছে” এই বলে রহিম উঠে গেলো , বেশ ধির তালে হেটে হেটে গেঁটের দিকে চলতে লাগলো রহিম । মাথাটা নিচের দিকে ঝুকে আছে ।
রহিম সত্যিই মনেমনে বেশ লজ্জিত , কিন্তু এ ছাড়া ওর কোন উপায় নেই । যে পরিমান টাকা দরকার সেটা রহিমের পক্ষে কোনদিন ফেতর দেয়া সম্ভব হবে কিনা তা ওর জানা নেই । তাই বন্ধুর কাছে এই সর্ত নিয়ে এসেছিলো । এতে যে জয়নাল এতো রাগান্বিত হবে সেটাও ওর জানা ছিলো ।
সেদিনি রাতে জয়নাল আর আয়শা দুজনে রহিমের বাড়ি আসে । জয়নালের মুখ তখনো থমথমে , দেখে বোঝা যাচ্ছে আয়শা ওকে বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এসেছে । বন্ধুকে দেখে রহিম একটি শুকনো হাসি দেয় । রহিমের ভাব এমন যে ও জানতো যে জয়নাল আসবে ।
বেশ কিছুক্ষন আফরোজার সাথে সময় কাটায় আয়শা আর জয়নাল । পুরোটা সময় রহিম ওদের সামনে বসে থাকলেও জয়নাল একটি কথাও বলে না রহিমের সাথে । পুরো কথা বার্তা হয় আফরোজার সাথে । এক পর্যায়ে দুর্বল আফরোজা বেশ কষ্ট করে জয়নালের উদ্দেশ্যে বলে “ ভাই আপনার বন্ধুকে ক্ষমা করে দেন , ওর মাথা ঠিক নেই , কি বলতে কি বলে ফেলছে”
“ না ভাবি , এর মাঝে আপনি আসবেন না , এই বদের হাড্ডি কে আমি ছোট বেলা থেকেই চিনি , এর বড় অহঙ্কার” এই বলে জয়নাল চুপ হয় , তবে পরক্ষনেই বলে “ আরে তুই কার সামনে আত্মগরিমা দেখাচ্ছিস , আমার সামনে , তোর ভাইয়ের সামনে” শেষ কথা গুলো বলার সময় জয়নালের গলা একটু ধরে আসে ।
সেটা দেখে রহিম উঠে জয়নালের কাধে একটা হাত রাখে , কিন্তু জয়নাল সেই হাত কাধ ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দেয় । আবারো ধরা গলায় বলে “ আমারো একটা সর্ত আছে ভাবি , আপনি ওই অহংকারী কে বলে দেন”
“ কি সর্ত ?” যদিও কথা গুলো জয়নাল আফরোজাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো , কিন্তু উত্তর রহিম ই দেয় ।
“ বাড়ি আমি নেবো , এবং নেয়ার পর এই বাড়ি নিয়ে আমি কি করবো সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার , কেউ যেন নাক গলাতে না আসে , যদি আসে তাহলে আমি সেই নাক ভেঙ্গে দেবো,”
এই কথা শুনে রহিম মুচকি হেসে বলে “ কেউ নাক গলাতে আসবে না “
বাড়ির যথার্থ মূল্য দিয়েই জয়নাল বাড়ি কিনে রাখে , একটা সাদা দলিলে রহিমের সিগনেচার রেখে দেয় । তারপর একদিন রহিম শিকদার তার পরিবার নিয়ে অন্য শহরে চলে যায় । যাওয়ার সময় সেই এক আবেগ ঘন পরিবেশ ।
বাড়ি বিক্রির এক বছরের মাথায় আফরোজা মৃত্যু বরন করে । খবর পেয়ে জয়নাল আর আয়শা ছুটে যায় । আফরোজার মরদেহ রহিম শিকদারের পুরন বাড়ির পাশেই দাফন হয় । বেশ কিছুদিন রহিম শিকদার ছেলে মেয়ে নিয়ে জয়নাল চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থান করে । এই কয় দিন জয়নাল চৌধুরী অনেক বলেও রহিম শিকদার কে এখানেই থেকে যেতে রাজি করাতে পারে না ।
<><><>
জয়নাল চৌধুরী আর রহিম সিকদার দুজন ছোট বেলার বন্ধু । দুজনের বাড়ি ও পাশাপাশি , তাই বন্ধুত্ব ছোট বেলা থেকে যৌবন শেষ হয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত অটুট আছে । দুজনে হরিহর আত্মা , দুজন কে দেখেলে বলবে এরা দুই ভাই , নাহ ভাইদের মাঝেও এতো ভালো সম্পর্ক থাকে না যা এদের দুজনের মাঝে আছে । জয়নাল চৌধুরী বংশ পরম্পরায় ধনী , বাপ দাদার বিজনেস সামলায় । আর রহিম শিকদার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে , যদিও বাপ দাদার রেখে যাওয়া যে বাড়ি আছে তার দাম অনেক । কিন্তু রহিম সিকদার এই বাড়িকে মূল্য দিয়ে বিবেচনা করে না । সে নিজে সারাজীবন শিক্ষকতা করেছে , টাকার কষ্ট করেছে কিন্তু কোনদিন বাড়ি বিক্রি বা ডেভ্লপার কে দেয়ার চিন্তা করেনি । তাই এই আধুনিক যুগেও শহর অঞ্চলে পাশাপাশি দুটো দোতলা বাড়ি রয়ে গেছে । একটি বেশ জমকালো অন্যটি একটু জীর্ণ । জয়নাল চৌধুরী আর রহিম শিকদার মাঝে অবশ্য দুজনের আর্থিক অবস্থা দেয়াল হয়ে দাড়ায় নি । কেউ কাউকে টকায় হিসাব করে না ।
বাকি সব কাজের মত দুই বন্ধু বিয়েও করেছে এক সাথেই প্রায় । রহিম শিকদারের বিয়েতেই জয়নালের মা জয়নালের জন্য পাত্রি পছন্দ করে । আর তার এক সপ্তার মাঝেই বিয়ে হয়ে যায় । দুজনের স্ত্রী একে অন্যের বান্ধবি । আর এই কারনে এই দুজনার বন্ধুত্ব যেন আরো গভির হয়ে যায় ।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুই পরিবারে নতুন অতিথি চলে আসে তাও এক মাসের কম সময়ের ব্যাবধানে । জয়নার চউধুরির ছেলে জন্মানোর দশ দিনের মাথায় রহিম শিকদারের ছেলে জন্ম নেয় । দুই পরিবারেই খুশির বন্যা বয়ে যায় । দুই বন্ধু ডিসিশন নেয় যে তাদের সন্তানেরা কোন দিন যেন দুই বাড়ির মাঝে তফাৎ না করে , একে অন্যের বাড়ি কে নিজের বাড়ি মনে এমন ভাবে এদের মানুষ করবে । তাদের দুই সন্তান ভাইয়ের মত বড় হবে । কাকে বড় আব্বু বলবে আর কাকে ছোট আব্বু সেই নিয়ে দুই বন্ধুর মাঝে ছোট খাটো যুদ্ধ ও লেগে যায় । শেষে ডিসাইড হয় যেহেতু রহিম শিকদার কিছুদিন পর বাবা হয়েছে তাই রহিম শিকদার হবে ছোট আব্বু , আর জয়নাল চৌধুরী বড় আব্বু ।
রহিম শিকদার কোনদিন বন্ধুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়নি , আর জয়নাল চৌধুরী ও কোনদিন যেচে পরে আর্থিক সাহায্যর কথা বলেনি , বন্ধুর প্রতি সম্মান দেখিয়ে । কিন্তু ছেলের ক্ষেত্রে জয়নাল চৌধুরী এই অলিখিত নিয়ম মানতে একদম নারাজ , নিজের ছেলে জয়ের জন্য যা যা কিনেছে বন্ধুর ছেলে রাজীবের জন্যও ঠিক তাই কিনেছে । রহিম শিকদার এর বিরোধিতা করতে এলে একপ্রকার তেড়ে গিয়েছে বলেছে “ খবরদার যদি আমাকে আমার ছেলের জন্য কিছু কিনতে বাধা দিস” । রহিম শিকদার ও হার মেনে নিয়েছে । আসলে দুই বন্ধুর মাঝে ইগো বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই ।
রাজিব আর জয় ও সেই ছোট বেলা থেকেই ভাইয়ের মত বড় হতে থাকে ।
দুই বছর পর দুই পরিবারে আবারো আনন্দের জোয়ার ওঠে , রহিম শিকদারের স্ত্রী আফরোজা আর জয়নাল চৌধুরীর স্ত্রী আয়শা আবারো গর্ভবতী হয় । এবারো দুজনের মাঝে অল্প দিনের তফাৎ । এবং আশ্চর্যের বিষয় এবার দুজনের ঘরে ফুটফুটে দুটো মেয়ে হয় । রহিম সেখের মেয়ের নাম রাখা হয় রানী , আর তার ঠিক পনেরো দিন পর জম্ন নেয়া জয়নাল চৌধুরীর মেয়ের নাম রাখা হয় জান্নাত ।
হাসি আনন্দে , সুখে দুঃখে দুই পরিবারের দিন কাটতে থাকে ।
কিন্তু খুশির দিন সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না । রানীর বয়স যখন ছয় আর রাজীবের আট তখন হঠাত আফরোজার এক দুরারোগ্য রোগ ধরা পরে । রানীর জন্মের সময় এই কমপ্লিকেসন তৈরি হয়েছিলো বলে ডাক্তারের ধারনা , কিন্তু তখন ধরা পরেনি, যতদিনে ধরা পরলো ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে । কিন্তু রহিম হাল ছাড়তে নারাজ , পানির মত টাকা খরচ করতে লাগলো। প্রচুর খরচ হয় সেই চিকিৎসায় , রহিম শিকদারের জমানো টাকা শেষ হয় চোখের পলকে । জীবনে এই প্রথমবার রহিম শিকদার নিজের গরিব হওয়া নিয়ে কোন প্রকার হীনমন্যতায় ভোগে । সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি বিক্রি করে দেবে। এ কথা শুনে জয়নাল চৌধুরী হন্তদন্ত ছুটে আসে বন্ধুর কাছে । অনেক বোঝায় , টাকা ধার দেয়ার কথা বলে , শেষে না পেরে ঝগড়া বাধাতে যায় । কিন্তু রহিম শিকদার নিসচুপ থাকে । এক পর্যায়ে রহিম শিকদার খপ করে জয়নাল চৌধুরীর দুহাত চেপে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে “ আমাকে মাফ করে দাও বন্ধু, আমাকে মাফ করে দাও” এর পর জয়নাল চৌধুরী আর কিছু বলে না । মাথা নিচু করে সেদিন রহিম শিকদারের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় ।
সেদিন রাতে দুই বাড়িতে কারো চোখে ঘুম হয় না । এমন কি ছোট্ট জান্নাত আর রানী ও বোঝে যে খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। বয়সে কিছুটা বড় রাজিব আর জয় ও বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছে । দুই বন্ধু সেদিন এক ঘরে ঘুমায় , যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে পরে ততক্ষণ দুই বন্ধুর মাঝে কথা চলে । শেষে ঘুমানোর ঠিক আগে দুই বন্ধু প্রতিজ্ঞা করে যত কিছুই হোক , কোন কিছুতেই ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না । মরে গেলেও না ।
রহিম শিকদার ও সারারাত চোখ বুজতে পারে না । সকালে উঠেই বন্ধুর কাছে যায় । জয়নাল খাঁ তখন নিজ বাড়ির নিচ তলায় বারান্দায় বসে । দু চোখ লালা দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি । রহিম চুপ চাপ বন্ধুর পাশে এসে বসে , বেশ কিছুক্ষন নীরব থাকার পর বলে “ টাকাটা আমি তোর কাছ থেকেই নেবো” কথাটা বলে চুপ হয়ে যায় রহিম , এদিকে জয়নাল আনন্দে লাফিয়ে চেঁচামেচি করতে শুরু করে ।
সেই চেঁচামেচি শুনে আয়শা বেড়িয়ে আসে রান্না ঘর থেকে , কি হয়েছে জিজ্ঞাস্ করলে জয়নাল আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে
“ যাও আয়শা আমাদের জন্য চা আর নাস্তা নিয়ে এসো , ভেবেছিলাম এই হারামি শালাকে চা অফার করবো না ,কিন্তু হারামি ভালো হয়ে গেছে “
আয়শাও বেশ খুশি হয়ে আবার রান্না ঘরে ফিরে যায় । কিছুক্ষন পর চা আর টোস্ট নিয়ে হাজির হয় । বলে “রহিম ভাই আমি খুব খুশি হয়েছি”
নাস্তা শেষে রহিম বলে , “ কিন্তু আমার একটা সর্ত আছে”
“ কি সর্ত বল ব্যাটা” জয়লান উৎফুল্ল স্বরে জানতে চায়
“ বাড়িটা তুই রাখবি “ রহিম বেশ শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলে ।
রহিমের কথা শুনে জয়নাল ওর দিকে অবাক চোখে তাকায় , জয়নালের চোখে মুখে অবিশ্বাস , কিছুক্ষন এভাবেই চুপ থেকে জয়নাল হঠাত উঠে দাঁড়ালো , ওর চোখ মুখ থমথমে । কয়েক মুহুরতপর জয়নাল একদম শান্ত স্বরে বলল “ বেড়িয়ে যা , তোর চেহারা আমি দেখতে চাই না , তুই আমার বন্ধুত্বকে অপমান করেছিস”
জয়নালের শেষ কথা আয়শা শুনে ফেললো , এই মাত্র বাচ্চাদের নাস্তা দিয়ে স্বামী আর রহিম কে সঙ্গ দেয়ার জন্য বারান্দায় এসেছিলো ।
“ কি ব্যাপার তুমি এমন কথা বলছো কেন” হন্তদন্ত হয়ে বলল আয়শা , তারপর আবার রহিমের দিকে তাকিয়ে আকুতি মিশিয়ে বলল “ ভাই প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না”
“ নাহ ভাবি আমি কিছুই মনে করিনি , আমি এর যোগ্য, জয়নাল আমাকে আমার প্রাপ্য ই বুঝিয়ে দিয়েছে” এই বলে রহিম উঠে গেলো , বেশ ধির তালে হেটে হেটে গেঁটের দিকে চলতে লাগলো রহিম । মাথাটা নিচের দিকে ঝুকে আছে ।
রহিম সত্যিই মনেমনে বেশ লজ্জিত , কিন্তু এ ছাড়া ওর কোন উপায় নেই । যে পরিমান টাকা দরকার সেটা রহিমের পক্ষে কোনদিন ফেতর দেয়া সম্ভব হবে কিনা তা ওর জানা নেই । তাই বন্ধুর কাছে এই সর্ত নিয়ে এসেছিলো । এতে যে জয়নাল এতো রাগান্বিত হবে সেটাও ওর জানা ছিলো ।
সেদিনি রাতে জয়নাল আর আয়শা দুজনে রহিমের বাড়ি আসে । জয়নালের মুখ তখনো থমথমে , দেখে বোঝা যাচ্ছে আয়শা ওকে বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এসেছে । বন্ধুকে দেখে রহিম একটি শুকনো হাসি দেয় । রহিমের ভাব এমন যে ও জানতো যে জয়নাল আসবে ।
বেশ কিছুক্ষন আফরোজার সাথে সময় কাটায় আয়শা আর জয়নাল । পুরোটা সময় রহিম ওদের সামনে বসে থাকলেও জয়নাল একটি কথাও বলে না রহিমের সাথে । পুরো কথা বার্তা হয় আফরোজার সাথে । এক পর্যায়ে দুর্বল আফরোজা বেশ কষ্ট করে জয়নালের উদ্দেশ্যে বলে “ ভাই আপনার বন্ধুকে ক্ষমা করে দেন , ওর মাথা ঠিক নেই , কি বলতে কি বলে ফেলছে”
“ না ভাবি , এর মাঝে আপনি আসবেন না , এই বদের হাড্ডি কে আমি ছোট বেলা থেকেই চিনি , এর বড় অহঙ্কার” এই বলে জয়নাল চুপ হয় , তবে পরক্ষনেই বলে “ আরে তুই কার সামনে আত্মগরিমা দেখাচ্ছিস , আমার সামনে , তোর ভাইয়ের সামনে” শেষ কথা গুলো বলার সময় জয়নালের গলা একটু ধরে আসে ।
সেটা দেখে রহিম উঠে জয়নালের কাধে একটা হাত রাখে , কিন্তু জয়নাল সেই হাত কাধ ঝাঁকিয়ে সরিয়ে দেয় । আবারো ধরা গলায় বলে “ আমারো একটা সর্ত আছে ভাবি , আপনি ওই অহংকারী কে বলে দেন”
“ কি সর্ত ?” যদিও কথা গুলো জয়নাল আফরোজাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলো , কিন্তু উত্তর রহিম ই দেয় ।
“ বাড়ি আমি নেবো , এবং নেয়ার পর এই বাড়ি নিয়ে আমি কি করবো সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার , কেউ যেন নাক গলাতে না আসে , যদি আসে তাহলে আমি সেই নাক ভেঙ্গে দেবো,”
এই কথা শুনে রহিম মুচকি হেসে বলে “ কেউ নাক গলাতে আসবে না “
বাড়ির যথার্থ মূল্য দিয়েই জয়নাল বাড়ি কিনে রাখে , একটা সাদা দলিলে রহিমের সিগনেচার রেখে দেয় । তারপর একদিন রহিম শিকদার তার পরিবার নিয়ে অন্য শহরে চলে যায় । যাওয়ার সময় সেই এক আবেগ ঘন পরিবেশ ।
বাড়ি বিক্রির এক বছরের মাথায় আফরোজা মৃত্যু বরন করে । খবর পেয়ে জয়নাল আর আয়শা ছুটে যায় । আফরোজার মরদেহ রহিম শিকদারের পুরন বাড়ির পাশেই দাফন হয় । বেশ কিছুদিন রহিম শিকদার ছেলে মেয়ে নিয়ে জয়নাল চৌধুরীর বাড়িতে অবস্থান করে । এই কয় দিন জয়নাল চৌধুরী অনেক বলেও রহিম শিকদার কে এখানেই থেকে যেতে রাজি করাতে পারে না ।
<><><>
সব প্রশ্নের উত্তর নেই,
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।
তবু প্রশ্নগুলো বেঁচে থাকে,
ঠিক আমার মতো —
অর্ধেক জেগে, অর্ধেক নিঃশব্দ।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)