Thread Rating:
  • 31 Vote(s) - 3.23 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica স্বামী ﴾ পর্ব নং:- ১৪ ﴿
পর্ব ৮

মাটির ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে ঘরের হালকা আলো পড়ছে রোয়াকে। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকে, মাঝে মাঝে মাটির বাড়ির দাওয়ায় ভিজে কাঠের খচখচে শব্দ—হয়তো ইঁদুর ছুটছে। ভেতরে কুপি-জ্বলা অন্ধকার। ঘরের হলুদ আলোয় সুপ্রিয়ার ভাইয়ের কপাল চকচক করে। শরীরটা পাতলা হয়ে গেছে। চোখ দুটো বসে গিয়েছে, পাঁজর বেরিয়ে এসেছে, ঠোঁট ও কেমন ফাটাফাটা। শ্বাস হাঁপাচ্ছে না, কিন্তু কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়। মাঝে মাঝে থুথু ফেলতে চাইছে কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না।

ডাক্তার সমীর কাঁধে গামছা ফেলে, স্টেথো কানে দিয়ে, মনোযোগী হয়ে বুকের আওয়াজ শুনছে। পাশের টেবিলে  কাঁচের বোতলে ওষুধ, কাপড়ে মোড়া থার্মোমিটার, একটা ছোট সিরিঞ্জ ও তার ডাক্তারী ব্যাগটা  রাখা। তার ঠোঁট চেপে আছে, চোখ কুঁচকেছে বেশ। রোগীর নাড়ি দেখার পর আবার চোখ তুলে একটু চুপ করে থাকে সে বললে,

—  একটু গরম জল আনো, 

সমীর চাপা গলায় বলল। সুপ্রিয়া অপর পাশ থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নন্দিনী বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। রান্না ঘরে ঢুকে  জলের বাটি হাতে এগিয়ে এসে সুপ্রিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। সুপ্রিয়া ঘরে ঢুকলো আবার। পেছন পেছন কুন্দনন্দিনী এসে দাঁড়ালো দুয়ার সম্মুখে।

সমীর ধীরে ধীরে কপালে জলচাপা দিলে। গলার কাছটায় কাপড় তুলে খেয়াল করলে—ঘর্মাক্ত নয়, বরং অদ্ভুত শীতল একটা ঘাম।  জ্বরটা কমে আসছে ক্রমশ, এখন চলছে গভীর দুর্বলতার লড়াই। এই সময়ই বিপদ, যদি হৃদযন্ত্র ভেঙে পড়ে। রোগী কেঁপে উঠল হঠাৎ, চোখে তাকালো কিন্তু যেন চিনতে পারছে না।

– পানি চাই?

 সমীর জিজ্ঞাসা করল। যুবক অল্প মাথা নাড়ল। তার ঠোঁটে জল ছুঁইয়ে সমীর বললে, 

– ধীরে… একেবারে ধীরে…

খাটের পাশে মেঝেতে বসে থাকা সরোজবালা চোখ নামিয়ে রেখেছে। ওর চোখে অশ্রু। সে জানে, এইরকম রাতে পুরুষ ডাক্তাররাও ঈশ্বরের মুখের পানে চেয়ে থাকেন—জ্ঞান, বিদ্যা, সাহস সবই একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে। পাঁজরের খাটখাট শব্দ, গামছায় বাঁধা কর্পূরের শিশি, বারবার জল ফুটিয়ে উষ্ণতার পরীক্ষা—এইসব চলছে রাত জেগে। ঘুম নেই এই বাড়ির কারোরই। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েছে, বাড়ির উঠানে পেয়ারা গাছের পাতায়  টুপটাপ করে জল পড়ার শব্দ। কিন্তু ঘরের ভিতর শুধুই নিঃশব্দতা আর দুশ্চিন্তার ভার।

হরিপদ দত্ত মেয়ে জামাইকে দেখে মনোবল ফিরে পেয়েছেন। সমীরের ওপরে খানিক রাগ থাকলেও মেয়ের মুখে সবটাই শুনেছেন তিনি। তবে মেয়ে জামাইয়ের সাথে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা বিশেষ হয়নি। বেশ মেয়ের মতোই হরিপদ দত্তের স্ত্রী কুন্দনন্দিনীকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। এখন মেয়েটা সবার সাথে রাত জাগছে। 

নন্দিনী শুরু থেকেই দেখছে সবটা। প্রথমটায় অস্থির অস্থির করলেও, এখন শান্ত হয়ে শুয়ে আছে সুপ্রিয়ার কাকাতো ভাই সুশীল। দু'চোখ এর জ্বরের তীব্রতা কমে আসছে ধীরে ধীরে। তবে তার স্বামীর বিশ্রাম নেই‌, সেই এসে থেকে এখন পর্যন্ত  একটি বারের জন্যও ওঠেনি। তার পাশেই মেঝেতে বসে আছে সুশীলের স্ত্রী সরোজবালা—মাথায় আঁচল টেনে কান্না গিলে ফেলে সে হঠাৎ  হঠাৎ বলছে,

— দাদা..উনি বাঁচাবেন তো?

সমীর মেয়েটার দিকে তাকায় না। শ্যালকের এই অবস্থা দেখে সে ভয়ানক বিরক্ত ও চিন্তিত। যদিও সব শুনে সে আঁচ করেছিল এখানকার অবস্থা। তাই তো রাত হলেও চলে আসতে মানা করে নি একবারও। কিন্তু এখানে এসে সে বুঝতে পারে তার দ্বিতীয় বিবাহ তাকে এখানে আগেভাগে না ডাকার প্রধান কারণ। এখন কথাটি মনে আসতেই সমীর ভাবনা বন্ধ করলো, খানিক পরে শান্ত গলায় বললে,

— দেখ সরোজ, তোমায় বলেছি না, ভয় পাবে না। এখনও সময় আছে। আমি তো দেখছি নাকি.....

একটা শ্বাস ফেলে স্বামীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপ্রিয়া চুপচাপ চোখ বুঝে তার ভগবান নাম জপে। স্বামীটি তার ভুত-ভগবান কিছুই তেমন মানে না। কিন্তু সুপ্রিয়ার ঠাকুর ভক্তি যেমন, ভুতের ভয়ও তেমনি। তবুও স্বামীর কথা গুলো শুনে, ঠিক এমন সময়েই সে যেন আবার একটু নতুন করে ভালোবেসে ফেলে—যে পুরুষটি ক্লান্ত, রাত্রির শেষ প্রহরে দাঁড়িয়ে, কারও ছেলেকে মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে আনছে। তার কথা ভেবে স্বামী গর্বে বুকটা যেন ভরে ওঠে তার। 

সুশীল এ বাড়িতে আছে সুপ্রিয়ার বিয়ের পর থেকে। মা-বাপ মরা ছেলেটা দিদিকে ভক্তি করে খুব। সুপ্রিয়াও তাকে দেখে স্নেহের চোখে। কেন না স্নিগ্ধ স্নেহের অনুভব এই রমণীর চরণ তেলে- তাই যেখানে সে উপস্থিত যেখানে স্নেহের স্পর্শে খামতি থাকে না। সে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। বাপের কোলে থেকে ছেলেকে বুকে করে পাশের ঘরে যায় শোয়াইতে।

কুন্দনন্দিনী  খানিক আগেই দুয়ার আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। আর কেউ কে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া মানা আছে সুপ্রিয়ার । সে এতখন সবটা দেখেছে— মানুষের অল্প অভিমান কত বড়  বিপদ ডেকে আনতে পারে। সমীর মুখার্জি কিছু না জানিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ করছে,আর তার  অভিমানে মারতে বসেছে সুশীল। অতিরিক্ত দিদি ভক্তি ও রাগের বশে ডাক্তার জামাই বাবুকে ডাকার ইচ্ছে পোষণ করে নি সে, কিন্তু অবস্থা এতটা খারাপ হবে বোধহয় সে নিজেও ভেবে দেখেনি।

তা সে যাইহোক,আর ঘণ্টাখানেক পর, জ্বর আরো কিছুটা নেমে আসে। ঘাম ভাঙে সুশীলের। সমীর তার নাড়ি দেখে বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

— আর ভয় নেই সরোজ,বোধ হয় এই যাত্রায় টেনে তুলতে পারবো।

এই প্রথম কুন্দনন্দিনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে খুশি হলো,কেন হলো তা কে জানে। তবে তার মনে পরে গেল নৌকায় যাত্রার কথাটা। নদীতে তখন কি প্রবল টান— হঠাৎ ওমনি নৌকা দুলে না উঠলে কুন্দনন্দিনী কি কখনো স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরতো? কিন্তু সমীর তখন মজা করার ছলেই বলেছিল,

– আরে আরে কর কি! শেষটায় কোলে উঠবে নাকি? 

 যদিও নৌকাটা একবার দুলে উঠেই থেমে গিয়েছিল,তবে নন্দিনী আর স্বামী কাছে থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি। সমীর তার শক্ত হাতে তুলি নিয়েছিল  তার হাতখানা। কুন্দনন্দিনী স্বামীর এই অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারেনি, বরং নিজের অজান্তেই আরো ঘন হয়ে ঠেসে বসেছিল স্বামীর গা ঘেঁষে। সমীর বুঝেছিল ব্যপারটা,তাই বোধহয় মজা করা রেখে শান্ত স্বরেই বলেছিল,

– ভয় নেই,এই নৌকা উল্টবে না....

এইকথায় নন্দিনীর কতটুকু আস্থা রেখেছিল তা যদিও জানা যায় নি। তবে যাত্রার সময়টা তা মোটেও ভালো কাটেনি। নৌকায় উঠে বাইরে দেখলেও, কিছু সময় পর মনে হয়েছে— পর্দার আড়াল থেকে বাইরের জগৎটা যেন অপার্থিব কোন এক স্থান। সুপ্রিয়া ঠেসে ঠেসে তার মগজে ভুতুড়ে কাহিনীর ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে ঐই কয়দিনে। এখন সে করে কি? তাই তার ভারাক্রান্ত মনটি খানিকের জন্যে কোন  মজবুত আশ্রয় হিসেবে স্বামীকেই বেছে নিয়েছিল। ‌এখন অবশ্য সে কথা ভাবলে কিছু লজ্জা লজ্জাই করছে,তবে এই লজ্জা সামিল দেওয়া চলে।


ওদিকে নন্দিনী যখন ভাবনায় ব্যস্ত,তখন ক্লান্ত সমীর একবার হাই তুললে। যদিও সে মুখে বলে নি কিছুই,তবে সুপ্রিয়া বোঝে। গতকাল  সারারাত না ঘুমিয়ে তাকে যে ভাবে জ্বালিয়ে মেরেছে। সুপ্রিয়া রাতের কথা ভাবে। ভাই খানিক সুস্থ শুনে তার মুখেও হাসি ফুটেছে। তাই এবার সে এগিয়ে এসে বললো,


— তুমি এবার একটু বিশ্রাম নাও গে। আমি আছি। সরোজ আছে। এখন এইখানে থাকলেও  তো কিছুই করার নেই।

সমীর চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। বাইরের বারান্দায় সুপ্রিয়ার মা-বাবা বসে । চিন্তায় তাদের মুখখানা কেমন হয়ে গিয়েছে। নিজের ছেলে তো নেই,তাই ভাই মরার পর থেকে ভাইয়ের ছেলেটাকেই আপন করে নিয়েছেন হরিপদ। তা সে ভাইয়ের সাথে বনিবনা তার ছিল না বললেই চলে, তবে সুশীলের ক্ষেত্রে সম্পর্কটা বড় আপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
ওদিকে সরোজবালার ঘুমন্ত চার মাসের মেয়েটা হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে গিয়েছে। মেয়েটা কাঁদছে। ঘরের বাইরে এসে হালকা বাতাসে দাঁড়িয়ে চোখ বুঝলে সমীর। এক মুহূর্ত যেন বুকে একটা অদ্ভুত খালি শূন্যতা বাজে— গতকাল সকালের মন খারাপ ভাবটা তার  এখনো কাটেনি।  


নিশীথ পেরিয়ে ভোরের আবছা আলো ফোটার ঠিক আগে— গ্রামীণ পরিবেশে এক নিঃশব্দ, কোমল মুহূর্তে—কটি মাটির ঘর যেন নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসেছে। চারদিক ঘন নীরবতা, কেবল দূরের ঝোপ থেকে মাঝেমধ্যে শোনা যায় রাতচরা পাখির হঠাৎ ডানা ঝাপটানো। মাটির দেয়ালগুলি কালচে ধূসর, তবু যেন রাতভর ঘুমিয়ে উঠে একটু জ্যোৎস্না জমে আছে তাদের গায়ে। ঘরের মাথায়  বাঁশঝারের উপর নরম অন্ধকার ছড়িয়ে রেখেছে, আর ঘরের কোণে কোণে কুয়াশার মত জমে আছে ভোরের প্রথম নিঃশ্বাস।


এক সময় হরিপদ দত্তের অবস্থা খারাপ থাকলেও,এখন আর সেই দিন নেই। ইচ্ছে করলে মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান তিনি কষ্টেসৃষ্টে দাঁড় করাতেই পারেন। তবে  সে ইচ্ছে টা তার কখনোই হয়নি। উন্নতির মোহে পরে নিজেকে তিনি ভুলতে নারাজ। তবে সমীরের এইসবে কিছুই যাই আসে না। বিশেষ করে এই বাড়ির সবগুলো ঘর মাটির হলেও খুব ঝকঝকে। ঘরের মেঝে গোবর-জল মাখানো, নরম আর পরিষ্কার, যেন কোনও গৃহিণীর নিঃশব্দ যত্নের প্রমাণ। 


– স্বামীটি ত আমারই, তোর কাছে এক রাতের জন্যে গচ্ছিত রাখলাম শুধু, রাগ করছিস না ভাই.....

তাদের ঘরে প্রবেশ করিয়ে দু কথা বলেই সুপ্রিয়া ভাইয়ের ঘরে চলে যেতে থাকে। নন্দিনীর তাকে ডাকবে কি, বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সমীর পেছন ফিরে দেখলো কুন্দনন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার পেছনে। দরজার একপাশে।

ঘরের মৃদু কুপি-আলো পড়ছে কুন্দনন্দিনীর গায়ে। সে এক পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে—চুপচাপ, অথচ সমগ্র ঘরের ছায়াপাতের কেন্দ্র যেন সে-ই। কোমরের কাছে আঁচলটা আলগা, তাতে আলোর রেখা পড়ে ধূসর কুণ্ডলীর মতো বেঁকে যাচ্ছে। তার গায়ে গাঢ় নীল শাড়ি, সস্তা কিন্তু পরিষ্কার; সেই কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আলো থমকে আছে—মুগ্ধ দৃষ্টির মতো।

সমীরের কাছে কুন্দনন্দিনী এই রূপান্তর কেমন অবাক করা লাগে। মনে পরে কলকাতার একটি বড় পাকা বাড়ির ছাদে বসা মেয়েটিকে,তখন সে হয়তো একগাদা বান্ধবী নিয়ে একপাশে বসে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। সমীর বাইরের থেকে ফিরে এসে এক নজর দেখেছিল তখন। যদিও বাবার বন্ধুর মেয়ে,তবে এর আগে সে কখনো দেখেনি তাকে। তখনকার দৃষ্টিতে এই মেয়েটি অজানা দূর দেশের বাসিন্দার মতোই। কিন্তু গেল  সকালেই ওই নারীটিকে সে কামনার চোখে দেখেছে। সেটা সমীর কখনো ভাবতেই পারিনি তা ঘটে গেল কি উপায়ে ,তা কে বলবে?


 এখন নন্দিনীর মাথায় ঘোমটা, কিন্তু মুখ পুরো ঢাকা নয়। সুপ্রিয়ার কাছে থেকে নানান উপদেশ ও কাজকর্মে দীক্ষা পেলেও,তা সে এখনো সেগুলি কাজে প্রকাশ করতে শেখে নি। সুপ্রিয়া চলে গেলেও  সে চুপচাপ  ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাড়িয়ে আছে সেখানেই।

তাই দেখে সমীর একবার কুন্দ বলে ডাকলো তাকে । ডাক শুনে সে চাইলো বটে, কিন্তু আধখোলা তার চোখের দৃষ্টি—তীব্র, স্থির। তবে দৃষ্টি  তীব্র হলেও চাহনিতে আগুন নেই। কপালের মাঝখানে এক বিন্দু সিঁদুর—রক্তজবার মতো রঙ, আলোর ছোঁয়ায় একবার জ্বলছে, একবার ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তার গলার কাছে শাড়ির ভাঁজ সরে গিয়ে হালকা কণ্ঠসন্ধির রেখা ফুটে উঠেছে। নীচু আলোর ঝাপসা ছায়ায় সেই অংশটা যেন ঠাণ্ডা বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে। 

কিছু কি বলবে? বোধহয় না। সমীর নিজেও প্রথমটা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। এই দুটি চোখের দৃষ্টি কি তার কথা ছিনিয়ে নিচ্ছে? কিন্তু ওদিকে থেকে দৃষ্টি নামালেই যে আর এক বিপদ! নিচে শাড়ির আঁচলে স্তনের বক্রতা লুকানো, কিন্তু ঢেকে রাখা সেই আড়ালটুকু আরও দৃশ্যমান—আলো ও অন্ধকারের ভেদরেখায় সে যেন নিজেকে লুকিয়ে রেখে আরও স্পষ্ট হয়েছে।

সমীর এবার নিজের ওপরে বিরক্ত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। যদিও আজকের  দৃষ্টিতে কিন্তু গতকালের কাম ভাবটি ছিল না। তবুও আলো আঁধারের মায়াতে রমণী  আকর্ষণ বরই তীব্র।

— একটু ঘুমিয়ে নাও, আরও অপেক্ষা করলে দেখতে দেখতে সুর্যদেব পাঠে বসবেন।

কুন্দনন্দিনী চটকা ভেঙ্গে কেঁপে উঠলো যেন। এতখন না জানি কি ভাবনায় ছিল সে। সমীর তার  হাত খানি ধরে মৃদু টানে নিয়ে এসেছে ঘরে। কুন্দনন্দিনী মুহূর্তে খানিকের জন্যে সুপ্রিয়ার কথা গুলো ভুলে বলে উঠলো,

— আপনি অ-আপনি এখানে....

কুন্দনন্দিনী মুখের কথা শেষ করতে পারলো না। সমীর হাত ছাড়িয়ে বিছানায় বসে ক্লান্ত গলায় বললে,

— হুম. আমি এখানেই থাকব। আজকের রাত কেটে যাক কুন্দ, বড় দূর্বল লাগছে।

বড় ভুল কথা নয়, রাত জেগে নন্দিনী নিজেই বুঝেছে ব্যপারটা। তাছাড়া  সুপ্রিয়ার কথাও মনে পরলো তৎক্ষণাৎ। সে আর কিছু বললো না। দুয়ারে আগলে দিয়ে খাটে দু'জন পাশাপাশি শুল, মাঝখানে বেশ খানিকটা দূরত্ব হলেও এতটা কাছাকাছি এই দুজনা আর কখনো শুয়েছে কি?

 কুন্দনন্দিনী মুখ ঘুরিয়ে আছে। সমীর জানে, ওই শরীরের পাশে থাকাটা তার নিজের ইচ্ছের বাইরে। কুন্দনন্দিনীর পক্ষে কবে এই সম্পর্ক মেনে নেওয়া সম্ভব হবে তা সে জানে না। অবশ্য জানার আগ্রহও তার বিশেষ নেই। তবে মেয়েটির সাথে তার বাবার সম্পর্ক সহজ করতে হবে অতি শীঘ্রই। ব্যানার্জি বাবুর শরীর ভালো নয়। বিশেষ কেরে এক মাত্র সন্তানের এমন অবহেলে বরই পিড়াদায়ক। গত মাস দুয়েক কলকাতার  আটটি চিঠির কোন উত্তর করেনি কুন্দনন্দিনী,পড়ে দেখেছে কি না তাও সন্দেহ। তবে ভাগ্য কর্মে সমীর নিজের পত্র লিখে ছিল একটি। 

কুন্দনন্দিনী তাকে মন থেকে না মেনে নিলেও সে জানে—বিবাহের রীতিতে সে এই রমণী স্বামী। গতকাল সকালে কুন্দনন্দিনী যে রূপ সে দেখেছে, তাতে কামদন্ডে উত্তেজনা অস্বাভাবিক নয়। তবুও সমীর নিজের মনকে ধমকে দামকে সে শান্ত রইলো। মনে মনে ভাবলো চিঠির ব্যাপারে আলোচনা টা অতি শিগগিরই করতে হবে তাকে, এতো দেরি করা উচিৎ হচ্ছে না।

////////

মাসখানেক ধরে শরীর ভাঙছিল সুশীলের—শুরুর দিকে হালকা জ্বর, তারপরে ক্ষুধামন্দা, নিদ্রাহীনতা, রাতের বেলায় ঘেমে ওঠা আর দিনে দুর্বলতা। প্রথমে গ্রাম্য কবিরাজ বলেছিল শরীর ‘ঠাণ্ডা’ হয়ে গেছে। সরোজ তার নববধূ, বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক। কবিরাজের আদেশে পাতার রস আর গরম চা-জল খাইয়ে গেছে দিনে রাতে। তাতে শরীর সাময়িক স্বস্তি পেলেও রোগ মূলত গভীরে গিয়ে বসে গেছে। তারপর সমীর এলো সেদিন। রাতের বেলা উঠনে পা দিয়েই সমীর যখন তার শ্যালকের ঘরে ঢুকলো, তখন তার চোখে মুখে এক রাশ রাগ আর বিরক্তি। 


এরপর একে একে চোখের কনজাংটিভা পরীক্ষা করল, জিভের ওপর পাতলা সাদা আবরণ মনদিয়ে দেখলো আর বুকে স্টেথোস্কোপ রাখল, তখন সে বুঝতে পারল তার আশঙ্কায় ঠিক—এই ছেলেটা টাইফয়েডে ভুগছে। তবে আশার কথা—মাস খানেক পেরিয়ে গেলেও রোগ এখনো নিয়ন্ত্রণ এর মধ্যে আছে, জটিলতা এখনো সৃষ্টি হয়নি, অন্ত্রে রক্তপাত বা পারফোরেশন হয়নি, যদিও শরীরের অবস্থা ভীষণ দুর্বল। 

সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হলো শুরু,সে আগেই তৈরি হয়ে এসেছিল।কেন না সমীর সবটা আগেই অনুমান করে,তবে ভয় ছিল তার ভিন্ন। গায়ের লোক তাকে দেখে অন্য চোখে,অনেকে ভাবে সমীর মুখার্জি যে বাড়িতে পা রাখে,সেখানে মরা দিব্যি গা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে ওঠে। 

এই আশ্চর্য ক্ষমতার কথা কতটুকু সত্য সমীর আজ পর্যন্ত নিজে জানে না।তবে আশপাশের দশটা গ্রামের লোক তাকে মানে খুব। তাই সন্দেহ হয় শশুর মশাই ওই ভেবে বসে শেষ সময় জামাইকে ডেকে পাঠিয়েছে। তাই বিরক্তির শেষ ছিল না তার। কিন্তু সমীর সে রাতেই অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করে এবং প্রথম রাতেই তার ফল মেলে হাতে হাতে। এরপর দিন কয়েক তার  চিকিৎসা ও সুপ্রিয়ার ঠাকুর কৃষ্ণের কৃপায়– সুশীল বেশ সুস্থ হতেই রাধাপুরে ছোট খাট একটা গুঞ্জন উঠলো। এবং এই ধাক্কায় সমীরের রোগি জুটে গেল আরো খান কয়েক। তবে সে আগে শশুর বাড়িতে স্বাস্থ্য নীতি প্রতিষ্ঠা করে তবে বাইরের রোগীদের বন্দোবস্ত করলে।

এছাড়া সমীর ও কুন্দনন্দিনী এই কদিন রইলো এক ঘরে। সম্পর্ক  সহজ না হলেও  দূরত্ব কমে এলো বেশ খানিকটা। সমীর সময় করে পুকুর পাড়ে একদিন নন্দিনীকে কলকাতার সংবাদ দিল।  বাড়ির প্রতি অভিমান থাকলেও কুন্দনন্দিনী দুই চোখে অশ্রু জল ছলছল করে উঠলো। সেদিন রাতে হারিকেনের আলোতে সে বসলো বাবার জন্যে পত্র লিখতে।

সুপ্রিয়া রাত কাটলো ভাইয়ের সেবা ও সরোজকে সাহস দিয়ে। এদিকে দিন দুই পেরুতেই বলরাম মুখার্জি সুপ্রিয়ার মেয়েকে নিয়ে এখানে হাজির হলেন। খোকা আর খুকিকে একত্রে পেয়ে হরিপদ দত্তের স্ত্রী মেয়ের সতিনের কথা একরকম ভুলেই গেলেন। তবে সমীরের মন খচখচ করতে লাগলো। এই গায়ের লোক স্বাস্থ্য নীতির ধীর ধারে না। এই অবস্থায় ছেলে মেয়ে দুটিকে এখানে আনা তার ভালো লাগলো না।

এর দিন দুই পর বৃষ্টি হীন এক সকালের রোদ তখন উঠোনে নেমে এসেছে। সরোজ মাটির হাঁড়িতে আলু কাটতে কাটতে গল্প করছিল,

– জানো তো নন্দিনীদি! আমার দিদির কৃষ্ণভক্তি কিন্তু কোন খেলা নয়। এই বাড়িতে এসে আমি শুনেছি অনেককে বলতে— তখন দিদির মাত্র ছ'বছরের মেয়ে। লোকে যতোই বলুক তোমার ডাক্তার বরেরকেরামতি, কিন্তু আমি জানি দিদির ঠাকুর ভক্তি এই যাত্রায় আমার মাথার সিঁদুরের মান রাখলো। 

রান্নাঘরের ভেতর বসে দু রমণীর মধ্যে কথা হচ্ছিল। প্রাথমিক কথা অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে।তাই আজ আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কলকাতা। অবশ্য সুদূর কলকাতা থেকে কথার বাঁক ঘুরে, এই  রাধাপুরে বাসরত ভূত ও  ভগবানদের সম্পর্কে ভালো মন্দ বিচার যে কখনো শুরু হলো, তা অবশ্য বোঝা গেল না। তবে কুন্দনন্দিনী উৎসুক চোখে চেয়ে রইল বিস্তারিত জানতে।তার কৌতুহল  সব বিষয়েই প্রভল। তাই দেখে সরোজ একটু চুপ করে পরে বলতে শুরু করল।

--~~~~~~~~~–

গাঁয়ে কোন কৃষ্ণ মন্দির তখন ছিল না। রাধাপুরে একমাত্র বড় সুদখোর গাঙ্গুলী পরিবারের বড়কর্তা নিজ বাড়িতে কৃষ্ণ মন্দির গড়ান। গাঙ্গুলী পরিবারের বড়কর্তার স্বপ্ন পাওয়া সোনার কৃষ্ণ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হয় গাঙ্গুলী বাড়ির পাশের জমিতে। বছর পর হতে না হতেই ডাকাত পরলো। এক রাতে গাঙ্গুলী পরিবারের বধূদের গহনা আর সোনার কৃষ্ণ ঠাকুর হাওয়া। 

সেদিন বড়কর্তা বাড়ি ছিলেন না। কিন্তু পরদিন সকাল সকাল সংবাদ পেয়ে বাড়ি ফিরে লোক লস্কর নিয়ে  সে এক কান্ড বটে। তবে কি ডাকাত ,আর কি গহনা, কিছুই আর পাওয়া গেল না। তখন গাঙ্গুলী মশাই শপথ করলেন, যতদিন না আবারও সোনার কৃষ্ণ মুর্তি প্রতিষ্ঠা না হয়,ততদিন এমনি পুজো হবে। হলেও তাই। ওদিকে  ডাকাতিতে  গাঙ্গুলী পরিবারের বড় রকম লোকসানে হয়ে গিয়েছিল,তা বছর পাঁচেক পর অবশ্য তারা সামলে ওঠে সবটাই।। তখন গায়ে হঠাৎ  কথা ওঠে কৃষ্ণ মন্দিরে আবারো সোনার কৃষ্ণ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হবেন। 

সুপ্রিয়া তখন বেশ বড়টি হয়েছে। হাঁটু অবধি খাটো শাড়ি পরে সে পাড়া বেরায়। অন্ধ বলে কেউ তাকে আটকে রাখতে পারতো না ঘরে। গাঁয়ের দত্ত পরিবার তখন অভাবের চূড়ান্তে। কাপড়ের ব্যবসা প্রায় উঠে যায় যায় করছে। এমন আর্থিক চিন্তায় বাকি সব চিন্তা মাথায় থাকে না। অবশ্য ছোট্ট সুপ্রিয়ার জন্যে বিশেষ চিন্তা করার কোন কারণও তখন ছিল না। দুধে আলতা দেখতে মেয়েটিকে গাঁয়ের সবাই বেশ পছন্দ করতো। সুপ্রিয়াও বাড়ি বাড়ি ফিরে সকলের সাথে কথা বলতো ও টুকিটাকি কাজকর্ম করে দিত। অন্ধ বলে তার মনে দুঃখ ছিল কি না তা বোঝা যেত না। তবে দুঃখ মেয়েটার ছিল গাঙ্গুলী পরিবারের মন্দির নিয়ে।

একে তো আর্থিক দুরবস্থা তার ওপরে জাতের বালাই। গাঙ্গুলীদের নিজস্ব মন্দিরে ছোট জাতের লোকের পুজোর অধিকার নেই বললেই চলে। কিন্তু মন্দিরে সোনার কৃষ্ণ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হবে শুনে ছোট্ট সুপ্রিয়ার মনেও দোলা দিয়েছিল। মন্দিরে ঢুকতে না পারলেও বাইরের সিঁড়িতে প্রায় সময় তাকে দেখা যেত। গাঁয়ের লোকে আদর করে বলতো কৃষ্ণ প্রিয়া। কিন্তু গাঙ্গুলী পরিবারের বধূদের কথা ছিল ভিন্ন। তারা বলতো,

"এইটা আমাদের কুলদেবতা, বাইরের লোক আসবে না। "
কেউ বলতো আরো কড়া স্বরে“ আজকাল তো জাতকুলের বালাই নেই, কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটি না— পূজোর জায়গায় সবাই উঠতে পারে না। ও মেয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি দিলে ঠাকুর অপবিত্র হবে। তারা বৈশ্য-কায়স্থ ঘরের মেয়ে। জাতের ঠিক নাই।"


 ছোট্ট মেয়েটি কিন্তু তার হাঁটু ছোঁয়া কোঁকড়ানো কেশ রাশি ও দুটি চোখের অন্ধ নিঝুম দৃষ্টি নিয়ে সিঁড়িতে বসে রইলো চুপচাপ। বসতো সে প্রায় দিন, চুপিচুপি পুরোহিতের হাতে তুলে দিতে পুজোর ফুল। তবে সেদিন গাঙ্গুলী বাড়ির বড় বউ মন্দিরে আসে খুব ভোরে। আজ সেই ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হবার দিন। তাই সুপ্রিয়া সেদিন গাঁয়ের এক মেয়েকে সঙ্গী করে ঠাকুরের চরণে অর্পণ করতে এক ঢালা পদ্ম এনেছিল তুলে। দৃষ্টি না থাকায় এই কাজ তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না বললেই চলে। তবে দূভাগ্য কর্মে তার সঙ্গী ছিল মুস'ল'মান ঘরের মেয়ে। তার উপরে বরাত এমনই খারাপ যে সেদিন গাঙ্গুলী বাড়ির বড় বধূ বিশেষ কারণ বশত অতি ভোর সকালে এলেন পূজো দিতে। অন্ধ অবুঝ ভক্তের জানা ছিল না মানুষের বুদ্ধি বিবেচনায় জাত ধর্ম হিসেব করে ঠাকুর পুজো নিয়ে থাকেন, কিন্তু গাঙ্গুলী বধূর বোধকরি তা ভালোই জানা ছিল। তাই তিনি সুপ্রিয়ার এমন তর কান্ড দেখে রোশ সামলাতে পারলেন না। সেদিনই ছোট্ট মেয়েটিকে গালে চড় মেরে কড়া স্বরে  গালমন্দ  পাঠ করে ফুলগুলো ছুড়ে ফেললেন মাটিতে।


কথা ছিল সেদিন সন্ধ্যায় পুজো করে ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত হবে,খালি মন্দিরে আবার ভগবানের পা পরবে। কিন্তু বিকেল গড়াতেই আকাশ কালো হয়ে এলো। ঝড় যদিও এলো না ,তবে ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত করায় গেল না।

এদিকে সেইদিন ভোর থেকে সুপ্রিয়াও বাড়ি ফেরেনি‌। দত্ত গিন্নী পাড়ার বাড়ি বাড়ি মেয়েকে খুঁজে শেষে বাড়ি ফিরে কান্না জুড়লেন। তখন দত্ত বাড়িতে পুরুষ বলতে নেই কেউ। হাট বারে পাড়া প্রায় খালি। হরিপদের ছোটভাই দাদার সাথে বিবাদ বাঁধিয়ে কোথায় গেছে - তা তখন প্রায় বছর সাত। অবশেষে বিকেলে বৃষ্টি মাথায় যখন কয়েকজন বেরুলো সুপ্রিয়াকে  খুঁজতে,তখন খবর এলো, নদীর তীরের জঙ্গল ভাঙা  মন্দিরে তাকে পাওয়া গিয়েছে। সাথে পাওয়া গিয়েছে গাঙ্গুলী পরিবারের বধূদের গহনা ও হারানো কৃষ্ণ ঠাকুর।

~~~~~~~~~~

খানিক পরে বাকি টুকু দিচ্ছি
[+] 7 users Like বহুরূপী's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: স্বামী ﴾ পর্ব নং:- ৭ ﴿ - by বহুরূপী - 04-07-2025, 06:28 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)