Thread Rating:
  • 13 Vote(s) - 2.92 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
HORROR কালো কুয়াশার ছায়া
#75
আমার চোখ ধীরে ধীরে খোলে, যেন কোনো অতল গহ্বর থেকে উঠে আসছি। আমার শরীর এতটাই ভারী, যেন কেউ আমার বুকে শত মণ পাথর চাপিয়ে রেখেছে। আমি, আবীর, জ্ঞান ফিরে পেয়েছি, কিন্তু যা দেখলাম, তাতে আমার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। আমি হতবাক হয়ে যাই—মনে হচ্ছে সময় থমকে গেছে, চারপাশ যেন এক অলৌকিক স্তব্ধতায় ডুবে আছে। আমি সেই অভিশ্প্ত বাংলোর মেঝেতে শুয়ে আছি, পুরনো কাঠের তক্তার ঠান্ডা ছোঁয়া আমার পিঠে বিষের মতো লাগছে। ঘরের বাতাসে পচা মাংসের একটা তীব্র গন্ধ, যেন বাংলোর দেয়ালগুলো নিজেই মৃত্যুর নিশ্বাস ছাড়ছে। আমার পাশে রিনা আর নাইমা ঘুমিয়ে আছে, তাদের শ্বাসের হালকা শব্দ ঘরের নিস্তব্ধতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখ শান্ত, যেন এই ঘরে কখনো কোনো রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেনি—শরিফা, লতা, সুমন, রোহানের মৃত্যু, সেই রক্তের নকশা, সেই ফিসফিস, সেই অমানুষিক ছায়া। আমার মাথা ঘুরছে, আমার শরীর কাঁপছে। এটা কি সত্যি? সবকিছু কি আমার মনের ভ্রম? আমার হাত কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসার চেষ্টা করি, কিন্তু শরীরে যেন কোনো প্রাণ নেই। আমার দৃষ্টি ঘরের কোণে থমকে যায়—দেয়ালের ফাটলগুলো যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, যেন ফিসফিস করে বলছে, “তুই আমার কবলে, তুই কখনো পালাতে পারবি না।” আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমার হৃৎপিণ্ড এত জোরে ধুকপুক করছে যে মনে হচ্ছে বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে।

হঠাৎ বাইরে থেকে একটা বিকট গর্জন ভেসে আসে, যেন আকাশ ফেটে দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে। শব্দটা আমার কানে তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিঁধে যায়, আমার হৃৎপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা ভেঙে লাফিয়ে ওঠে। রিনা আর নাইমার ঘুম ভেঙে যায়, তাদের চোখে বিস্ময় আর আতঙ্ক মিশে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠি, আমার পা মেঝেতে ঠোক্কর খায়, পুরনো কাঠের তক্তা চিৎকার করে ওঠে। আমি জানালার দিকে ছুটে যাই, আমার শরীরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা, যেন এই শব্দ আমার মুক্তির সংকেত। জানালার ধুলোমাখা কাচের ওপারে আমি দেখি—আকাশে একটা হেলিকপ্টার ঘুরছে, তার বিশাল প্রপেলারের ঘূর্ণন জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। হেলিকপ্টারের নিচে দড়িতে ঝুলছে কয়েকজন মানুষের ছায়া, তাদের কালো ইউনিফর্ম জঙ্গলের অন্ধকারে ঝিলিক দিচ্ছে—উদ্ধারকারী দল! আমার বুকের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে ওঠে, যেন এতক্ষণের অন্ধকার, ভয়, আর রক্তের দুঃস্বপ্নের পর প্রথমবার আলোর ছোঁয়া পেলাম। আমি চিৎকার করে উঠি, “রিনা, নাইমা! উদ্ধারকারী দল এসেছে! আমরা বাঁচব!” আমার কণ্ঠ কাঁপছে, উত্তেজনায় আমার শ্বাস ভারী, আমার গলা থেকে শব্দগুলো যেন ছিঁড়ে বেরোচ্ছে।

রিনা আর নাইমা আমার পাশে ছুটে আসে, তাদের পায়ের শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলে। রিনার মুখ ফ্যাকাশে, তার চোখে একটা অদ্ভুত ঝিলিক, যেন সে এই দৃশ্য বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চুল এলোমেলো, তার ঠোঁট কাঁপছে, যেন সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু চুপ করে থাকে। নাইমা কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত ধরে, তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা, তার নখ আমার ত্বকে বিঁধে যায়। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তারা কি আমাদের খুঁজে পেয়েছে? আমরা কি সত্যিই বাঁচব?” তার কণ্ঠে আশা আর ভয় মিশে এক অদ্ভুত কম্পন, যেন সে নিশ্চিত নয় এই উদ্ধার সত্যি না কোনো মায়া। আমি তাদের দিকে তাকাই, তাদের ফ্যাকাশে মুখ, তাদের কাঁপা চোখ। আমার মনে একটা অস্বস্তি জাগে—তারা কি সত্যিই আমার মতো আশা করছে, নাকি তাদের চোখে কিছু লুকিয়ে আছে? রিনার ঠোঁটে একটা হালকা কোণ, যেন সে কিছু জানে, কিন্তু বলছে না। নাইমার হাত আমার হাতে শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরে, যেন সে আমাকে ছাড়তে ভয় পায়। আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঝলক দিয়ে যায়—তারা কি সত্যিই আমার সঙ্গে আছে, নাকি এই বাংলো আমাদের সবাইকে নিয়ে খেলছে?
 
হেলিকপ্টারের গর্জন ক্রমশ কাছে আসে, তারপর থেমে যায়। বাংলোর সামনের খোলা জায়গায় হেলিকপ্টার নামে, তার প্রপেলারের হাওয়ায় ধুলো, শুকনো পাতা, আর জঙ্গলের কাঁটা চারদিকে ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমি জানালা দিয়ে দেখি, হেলিকপ্টারের দরজা খুলে যায়, আর কয়েকজন সশস্ত্র উদ্ধারকারী দলের সদস্য দ্রুত নেমে বাংলোর দিকে ছুটে আসে। তাদের কালো ইউনিফর্ম জঙ্গলের অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে, তাদের হাতে রাইফেল, মুখে কঠিন দৃষ্টি, যেন তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তাদের নেতা, একজন মাঝবয়সী লোক, তার মুখে ঘন দাড়ি, চোখে তীক্ষ্ণতা, বাংলোর ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকে আসে। তার পায়ের বুট মেঝেতে ভারী শব্দ তুলে, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আমার হৃৎপিণ্ডে আঘাত করে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “আপনারা কে আছেন? আমরা জঙ্গলের এই বাংলোতে হারিয়ে যাওয়া দলের খোঁজে এসেছি।” তার কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত কৌতূহল, যেন সে এই বাংলোর রহস্য সম্পর্কে কিছু জানে। তার দৃষ্টি আমাদের তিনজনের উপর দিয়ে ঘুরে যায়, যেন সে আমাদের মনের গভীরে ঢুকে দেখতে চায়।

আমি দ্রুত উঠে দাঁড়াই, আমার পা কাঁপছে, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু আমি বলি, “আমরা তিনজন বেঁচে আছি—আমি আবীর, এই রিনা, আর এই নাইমা। কিন্তু বাকি সবাই… মরে গেছে। কেউ আমাদের একে একে খুন করেছে।” আমার কথা শুনে উদ্ধারকারী নেতার চোখ সরু হয়ে যায়, তার মুখে বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে। তার ভ্রু কুঁচকে যায়, তার দাড়িওয়ালা মুখে একটা কঠিন রেখা ফুটে ওঠে। সে ধীরে ধীরে বলে, “খুন? এখানে কী হয়েছে? আমরা আপনাদের নিরাপদে নিয়ে যাব, কিন্তু আপনাদের সবকিছু জানাতে হবে।” তার কণ্ঠে একটা কঠোরতা, যেন সে আমাদের উপর সন্দেহ করছে। আমি রিনা আর নাইমার দিকে তাকাই—তাদের মুখ ফ্যাকাশে, তাদের চোখে ভয়, কিন্তু তাদের নীরবতায় একটা অদ্ভুত রহস্য। আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে—তারা কি সত্যিই এই উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত, নাকি তারা কিছু লুকোচ্ছে? রিনার ঠোঁটে একটা ক্ষীণ হাসি, যেন সে কিছু জানে, কিন্তু বলতে চায় না। নাইমার হাত তার পোশাকের কোণা শক্ত করে ধরে, যেন সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে। আমার মাথায় একটা সন্দেহ জাগে—এই উদ্ধার কি সত্যিই আমাদের মুক্তি দেবে?

আমরা তিনজন তাড়াহুড়ো করে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিই। আমার হাত কাঁপছে, আমার ব্যাগের মধ্যে শুধু কয়েকটা ছেঁড়া কাপড় আর একটা পানির বোতল, যার মুখে শুকনো রক্তের দাগ লেগে আছে। আমি জানি না এটা কার রক্ত, কিন্তু আমার শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। রিনা আর নাইমা নীরবে তাদের জিনিস গোছায়, তাদের মুখে কোনো কথা নেই, তাদের হাতের নড়াচড়ায় একটা যান্ত্রিকতা। রিনার চোখ মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকায়, তার দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা। নাইমা মাথা নিচু করে কাজ করে, তার চুল তার মুখ ঢেকে ফেলেছে, যেন সে কিছু লুকাতে চায়। আমরা বাংলোর ভারী কাঠের দরজা পেরিয়ে বাইরে আসি, যেখানে হেলিকপ্টারের প্রপেলারের হাওয়া আমাদের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের পোশাক টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আমরা দ্রুত হেলিকপ্টারের দিকে ছুটি, আমার পা ধাপে ধাপে কাঁপছে, আমার হৃৎপিণ্ড যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। হেলিকপ্টারের ভেতরে ঠান্ডা ধাতব গন্ধ, সিটগুলো শক্ত, আমাদের পাশে দুজন উদ্ধারকারী সদস্য বসে, তাদের রাইফেল হাঁটুর উপর, তাদের চোখ আমাদের উপর স্থির। আমরা তিনজন পাশাপাশি বসি, আমার মাঝে রিনা আর নাইমা। হেলিকপ্টার আকাশে উঠে যায়, তার গর্জন আমার কানে বাজছে, আমার শরীরে কম্পন তুলছে। আমি জানালা দিয়ে নিচের জঙ্গলের দিকে তাকাই—বাংলোর অন্ধকার ছায়া ধীরে ধীরে ছোট হয়ে, যেন একটা দুঃস্বপ্ন পিছনে ফেলে আসছি। কিন্তু আমার মনে একটা ভারী অস্বস্তি—এই পালানো কি সত্যিই আমাদের মুক্তি দেবে? আমার মাথায় সেই পুরনো ছবি ভেসে, আমরা সবাই একসঙ্গে, শত বছর আগে—আমি কি সত্যিই এই পাপের অংশ?

হেলিকপ্টারের গর্জন আমার মাথায় গেঁথে যায়, যেন আমার চিন্তাগুলোকে চূর্ণ করে দিচ্ছে। রিনা আমার পাশে বসে, তার হাত আমার হাতে ছুঁয়ে আছে, কিন্তু তার স্পর্শ ঠান্ডা, যেন তার মধ্যে কোনো প্রাণ নেই। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, আমরা বেঁচে গেছি। কিন্তু যারা মরেছে, তাদের কী হবে? খুনী কে?” তার কণ্ঠে একটা কাঁপন, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি, যেন সে কিছু জানে। আমি তার দিকে তাকাই, তার ফ্যাকাশে মুখ, তার ক্লান্ত চোখ, তার ঠোঁটে যে হালকা হাসি। সে কি সত্যিই নির্দোষ, নাকি তার এই ভয় একটা মুখোশ? আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে—রিনা কি কিছু লুকোচ্ছে? তার হাত আমার হাতে শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরে, তার নখ আমার ত্বকে বিঁধে যায়, যেন সে আমাকে ছাড়তে ভয় পায়।

নাইমা আমার অন্য পাশে, তার হাত কাঁপছে, তার মুখ ফ্যাকাশে, তার চোখে অশ্রু ঝিলিক দিচ্ছে। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, আমি ভয় পাচ্ছি। খুনী কি আমাদের মাঝে ছিল? আমরা কি সত্যিই নিরাপদ?” তার কণ্ঠ ভেঙে যায়, তার অশ্রু তার গাল বেয়ে নামে, কিন্তু আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে—তার এই কান্না কি সত্যি, নাকি সে আমাকে কিছু বোঝাতে চায়? আমি ফিসফিস করে বলি, “রিনা, নাইমা, আমরা বেঁচে গেছি। কিন্তু এই রহস্য আমাদের তাড়া করবে। খুনী কে ছিল? আমরা কি তাকে কখনো জানতে পারব?” আমার কণ্ঠে একটা অসহায়তা, কারণ আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—খুনী কি এখনো আমাদের মাঝে? আমি রিনার দিকে তাকাই, তার চোখ আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। নাইমার হাত আমার হাতে শক্ত হয়ে আঁকড়ে, তার নখ আমার ত্বকে রক্ত তুলছে। আমার মাথায় একটা চিন্তা—তারা কি সত্যিই আমার সঙ্গে আছে, নাকি তারা এই খুনের অংশ?

রিনা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আবীর, আমি কিছু জানি না। আমি শুধু বাঁচতে চাই।” তার কণ্ঠে একটা আকুতি, কিন্তু আমার মনে একটা অস্বস্তি—সে কি সত্যিই নির্দোষ? নাইমা ফিসফিস করে, “আবীর, আমাদের পাপ আমাদের ধ্বংস করেছে। খুনী হয়তো আমাদের মাঝেই ছিল।” তার কথায় আমার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আমি চুপ করে থাকি, আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ—রিনা বা নাইমা কি কিছু লুকোচ্ছে? নাকি আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না? আমার মাথায় রোহানের সেই রহস্যময় হাসি ভেসে ওঠে, তার দিনলিপি, তার লাল চোখ। সে কি এই খুনগুলোর মাখ্টার মাই ন্ডে ছিল, নাকি?

হেলিকপ্টারের গর্জন ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে, যেন আমার মাথার ভেতরের ঝড়টাও থামতে চায়। আমরা একটা ছোট শহরের কাছে একটি সামরিক ক্যাম্পে পৌঁছাই। হেলিকপ্টার মাটি ছোঁয়ার সাথে সাথে আমাদের শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগে, যেন আমরা স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছি। দরজা খুলে যায়, আর ঠান্ডা, ধাতব গন্ধে ভরা বাতাস আমাদের মুখে আঘাত করে। আমরা নেমে পড়ি, আমার পা মাটিতে টলে যায়, আমার হাঁটু ভেঙে পড়তে চায়। আমার শরীর ক্লান্ত, যেন প্রতিটি হাড় গুঁড়িয়ে গেছে; আমার মন ভয়, সন্দেহ, আর বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে। আমি চারপাশে তাকাই—ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, সৈন্যদের ভারী বুটের শব্দ, আর দূরে তাঁবুগুলোর ছায়া। আকাশ ধূসর, যেন এখানেও মৃত্যুর ছায়া লেগে আছে। আমি রিনা আর নাইমার দিকে তাকাই—তাদের মুখ ফ্যাকাশে, চোখে ক্লান্তি আর ভয় মিশে এক অদ্ভুত শূন্যতা। তাদের পোশাক ছেঁড়া, তাদের চুল এলোমেলো, যেন তারাও আমার মতো এই অভিশপ্ত জঙ্গলের কবল থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের নীরবতায় একটা অস্বাভাবিকতা, যেন তারা কিছু লুকোচ্ছে। আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই নিরাপদ?

উদ্ধারকারী দলের একজন সদস্য, তার কালো ইউনিফর্মে ধুলো লেগে আছে, আমাদের একটা তাঁবুর দিকে নিয়ে যায়। তাঁবুটা ছোট, পুরনো ক্যানভাসের তৈরি, যার কোণে ছিঁড়ে গেছে। ভেতরে একটা পচা, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, যেন এখানে কেউ বহুদিন ধরে মরে পড়ে আছে। তাঁবুর মাঝখানে একটা ভাঙা কাঠের টেবিল, তার পাশে কয়েকটা জং ধরা লোহার চেয়ার। আমরা তিনজন টেবিলের চারপাশে বসি, আমার হাত কাঁপছে, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। উদ্ধারকারী নেতা, যার দাড়িওয়ালা মুখে কঠিন রেখা, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। তার চোখ আমাদের উপর স্থির, যেন সে আমাদের মনের গভীরে ঢুকে দেখতে চায়। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “এখানে কী হয়েছে? কারা মারা গেছে? কীভাবে মারা গেছে?” তার প্রতিটি শব্দ যেন আমার মাথায় হাতুড়ির আঘাতের মতো লাগে। আমি গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি, কিন্তু আমার কণ্ঠ যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।

আমি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করি, “আমরা… আমরা জঙ্গলের বাংলোতে ছিলাম। একে একে সবাই মারা গেছে। মিলি, কাজল, নববী, মানিক মিয়া, মিলির মা, মহিউদ্দিন, রোহান, হাবিব, শরিফা, লতা, সুমন… কেউ আমাদের খুন করেছে।” আমার কথাগুলো অসম্পূর্ণ, আমার স্মৃতি ঝাপসা। আমি শরিফার গলায় দড়ি, লতার বুকে ছুরি, সুমনের রক্তমাখা মাথার ছবি দেখতে পাই, কিন্তু কিছুই পরিষ্কার নয়। আমার মনে একটা জাল কাটছে না—কে কাকে খুন করল? কেন করল? কীভাবে করল? আমি রিনা আর নাইমার দিকে তাকাই, তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। রিনার চোখ মাটিতে, তার হাত টেবিলের উপর শক্ত হয়ে মুঠো পাকিয়ে আছে। নাইমার হাত কাঁপছে, তার ঠোঁটে একটা অদ্ভুত কম্পন। আমি বলি, “আমরা জানি না কে খুনী। আমরা শুধু বেঁচে ফিরেছি।” কিন্তু আমার কণ্ঠে একটা অসহায়তা, কারণ আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ—খুনী কি আমাদের মাঝেই ছিল?

উদ্ধারকারী নেতা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনারা নিরাপদ, কিন্তু আমাদের এই ঘটনার তদন্ত করতে হবে। আপনাদের বক্তব্যে অনেক ফাঁক আছে।” তার কথায় আমার শরীরে একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যায়। তারা কি আমাদের উপর সন্দেহ করছে? তার চোখ আমার উপর স্থির হয়, যেন সে আমার মনে কী চলছে, তা পড়তে পারছে। আমি রিনা আর নাইমার দিকে তাকাই, তাদের মুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, যেন তারা এই প্রশ্নগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিল। আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা জাগে—তারা কি কিছু জানে? তারা কি আমাকে ফাঁসাতে চায়? নাকি আমি নিজেই কিছু মিস করছি?

প্রচণ্ড ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে। আমার শরীর আর মন যেন আর সইতে পারছে না। আমি তাঁবুর এক কোণে, একটা পুরনো ক্যানভাসের উপর বসে পড়ি। মাটির ঠান্ডা আমার শরীরে প্রবেশ করে, আমার হাড়ে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমার মাথা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে, আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু ঘুমের মধ্যে আমি আবার সেই বাংলোর মেঝেতে। ঘরের বাতাসে পচা মাংসের গন্ধ, দেয়ালের ফাটলগুলো যেন আমার দিকে হাসছে। হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ আমার কানে বাজে, যেন কেউ হাজার ছুরি দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করছে। আমি চোখ খুলে দেখি, আমি সেই অভিশপ্ত বাংলোর মেঝেতে শুয়ে আছি। আমার চারপাশে শরিফা, লতা, সুমন, মিলি, কাজল, হাবিব, রোহান—সবাই দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে তাদের মৃত্যুর অস্ত্র—শরিফার হাতে দড়ি, লতার হাতে রক্তমাখা ছুরি, সুমনের হাতে রক্তাক্ত পাথর। তাদের চোখ ফাঁকা, তাদের মুখে অমানুষিক হাসি, যেন তারা জীবিত নয়, কিন্তু তবুও আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের পায়ের শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলছে, তাদের ছায়া দেয়ালে বিকৃত হয়ে নাচছে। তারা একসঙ্গে বলে, “কিরে আবীর, আর কত চুদবি? এবার আয়, তোকে আমরা মিলে খুন করি!” তাদের হাসি আমার কানে বাজছে, যেন হাজার ছুরি আমার মাথায় বিঁধছে।

তারা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের অস্ত্র দিয়ে আমাকে এলোপাথারি মারতে শুরু করে। শরিফার দড়ি আমার গলায় জড়িয়ে যায়, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমার চোখ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। লতার ছুরি আমার বুকে বিঁধে, আমার রক্ত মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে, আমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। সুমনের পাথর আমার মাথায় আঘাত করে, আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, আমার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, আমার মাংস ছিটকে বেরোচ্ছে, আমার হাড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমার শরীর থেকে কালো, আঠালো রক্ত ঝরছে, যেন আমার জীবনশক্তি গলে মেঝেতে মিশে যাচ্ছে। আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি, আমার গলা থেকে আর্তনাদ বেরোচ্ছে, কিন্তু কেউ শুনছে না। আমি চিৎকার করে উঠি, “না! আমি মরতে চাই না!” আমার কণ্ঠে আতঙ্ক আর অসহায়তা মিশে আছে, কিন্তু তাদের হাসি আরও জোরালো হয়, তাদের ফাঁকা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একটা জোরে চিৎকার দিই, আর সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে যায়!

চোখ খুলতেই আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি। আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে, আমার পোশাক আমার ত্বকে লেপটে আছে, আমার হৃৎপিণ্ড এত জোরে ধুকপুক করছে যে মনে হচ্ছে বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে। আমি দেখি, আমি সেই অভিশপ্ত বাংলোর মেঝেতে শুয়ে আছি। পুরনো কাঠের তক্তাগুলো আমার পিঠে ঠান্ডা ছোঁয়া দিচ্ছে, তাদের ফাটল থেকে যেন অন্ধকার বেরিয়ে আসছে। ঘরের বাতাসে পচা মাংসের একটা তীব্র গন্ধ, যেন এই বাংলো নিজেই আমাকে গ্রাস করতে চায়। আমার চোখ চারপাশে ঘুরছে, দেয়ালের ফাটলগুলো যেন আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে, “তুই পালাতে পারবি না।” আমার মাথা ঘুরছে, আমার মনে হচ্ছে আমি এখনো সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা। হেলিকপ্টার, উদ্ধারকারী দল, সামরিক ক্যাম্প—সবকিছু কি তবে স্বপ্ন ছিল? আমার শরীর কাঁপছে, আমার হাত আমার মুখের উপর দিয়ে বুলাই, আমার ত্বকে ঘাম আর ধুলোর আঠালো স্তর। আমার মাথায় একটা প্রশ্নের ঝড়—আমি কি সত্যিই এখানে? আমি কি এখনো সেই অন্ধকারের কবলে?

আমার পাশে রিনা আর নাইমা বসে আছে, তাদের মুখ ফ্যাকাশে, তাদের চোখে ভয় আর বিস্ময় মিশে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। তাদের পোশাক ছেঁড়া, তাদের চুলে জঙ্গলের কাঁটা আর ধুলো লেগে আছে। রিনার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু তার দৃষ্টি শূন্য, যেন সে আমাকে দেখছে না, বরং আমার ভেতর দিয়ে কিছু দেখছে। নাইমার হাত কাঁপছে, তার ঠোঁটে একটা অদ্ভুত কম্পন, যেন সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছে না। তাদের পাশে কালু, সেই দৈত্যের মতো লোকটা, যার বিশাল দেহ ঘরের কোণে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। তার মুখে কালো দাড়ি, তার চোখে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন সে আমার মনের গভীরে ঢুকে দেখতে পারছে। তার হাতে একটা পুরনো ছুরি, যার ফলায় মরচে ধরেছে, কিন্তু তবুও সেটা ভয়ঙ্কর। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমি কিছু বলতে চাই, কিন্তু আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। আমার মাথায় সেই দুঃস্বপ্নের ছবি—শরিফা, লতা, সুমন, তাদের রক্তাক্ত অস্ত্র, তাদের অমানুষিক হাসি—সবকিছু যেন আমার চোখের সামনে ঝলক দিচ্ছে। আমি কি সত্যিই বেঁচে আছি, নাকি এই বাংলো আমাকে পাগল করে দিয়েছে? 

নাইমা আমার দিকে ঝুঁকে, তার কণ্ঠে উদ্বেগ মিশে বলে, “কী ব্যাপার, আবীর? তুমি হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলে?” তার চোখে ভয়, কিন্তু তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, যেন সে আমার প্রতিটি নড়াচড়া, আমার প্রতিটি শ্বাস পর্যবেক্ষণ করছে। তার হাত আমার কাঁধে ছুঁয়ে, কিন্তু তার স্পর্শ ঠান্ডা, যেন তার মধ্যে কোনো উষ্ণতা নেই। আমার মাথা ঘুরছে, আমি কিছু বলতে চাই, কিন্তু আমার মুখ থেকে শুধু একটা অস্ফুরণ বেরোয়। আমার চোখ তার চোখে স্থির হয়, তার কালো চোখে একটা অন্ধকার গভীরতা, যেন সে আমার মনের গোপন কোণে ঢুকে পড়তে চায়। আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে—সে কি সত্যিই আমার জন্য চিন্তিত, নাকি এটা তার কোনো খেলা?

রিনা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোমাকে আমরা দুই দিন ধরে খুঁজছি, কিন্তু কোথাও পাইনি!” তার কণ্ঠে ক্লান্তি, তার শব্দগুলো যেন তার মুখ থেকে ছিঁড়ে বেরোচ্ছে। কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা, যেন সে কিছু লুকোচ্ছে। তার হাত আমার কাঁধে শক্ত হয়ে আঁকড়ে, তার নখ আমার ত্বকে বিঁধে যায়। আমি তার দিকে তাকাই, তার ফ্যাকাশে মুখে একটা হালকা হাসি, যেন সে আমাকে কিছু বোঝাতে চায়। আমার মনে একটা অস্বস্তি জাগে—তারা কি সত্যিই আমাকে খুঁজছিল? নাকি এটা তাদের একটা নাটক, আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য?

নাইমা আবার বলে, “আমরা কোনো আশা-ভরসা না পেয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম তুমি ও মরে গেছ, আবীর।” তার কণ্ঠ ভেঙে যায়, তার চোখে অশ্রু টলটল করে, কিন্তু আমার মনে একটা অস্বস্তি—তার এই কান্না কি সত্যি, নাকি একটা মুখোশ? তার অশ্রু তার গাল বেয়ে নামে, কিন্তু তার চোখে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন সে আমার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। আমি চুপ করে থাকি, আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—তারা কি আমাকে দায়ী করছে? আমার হাত কাঁপে, আমি আমার মুখে হাত বুলাই, আমার ত্বকে ঘাম আর ধুলো। আমার মাথায় একটা চিন্তা—আমি কি সত্যিই দুই দিন জঙ্গলে ছিলাম, নাকি এই বাংলো আমার মনকে নিয়ে খেলছে?

রিনা যোগ করে, “আমরা যখন প্রায় হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম, তখন দেখি কালু সেখানে উপস্থিত হয়।” তার কথায় আমার চোখ কালুর দিকে যায়। তার বিশাল দেহ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে, তার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে, যেন সে আমার প্রতিটি চিন্তা পড়তে পারছে। তার হাতে সেই ছুরি, যার ফলায় আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে। আমার শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। কালু কি? সে কি সত্যিই আমাদের বাঁচাতে এসেছে, নাকি সে এই খুনের পিছনে জড়িত?
 
কালু গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “এখানে কী হয়েছে?” তার কণ্ঠে একটা কঠোরতা, যেন সে আমাদের বিশ্বাস করে না। তার চোখ আমার উপর স্থির, যেন সে আমার মনে কী চলছে, তা পড়তে পারছে। আমার হাত কাঁপে, আমি কিছু বলতে চাই, কিন্তু আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। রিনা আর নাইমা সংক্ষেপে খুনের কথা বলে—শরিফা, লতা, সুমন, মিলি, কাজল, হাবিব, রোহান—একের পর এক মৃত্যু। তাদের কথায় আমার মাথায় সেই রক্তের নকশা ভেসে ওঠে, সেই ফিসফিস, সেই অমানুষিক ছায়া। আমি চুপ করে থাকি, আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর প্রশ্ন—কালু কি সত্যিই আমাদের বাঁচাতে এসেছে, নাকি সে এই খুনের পিছনে জড়িত? তার ছুরিটা আমার চোখে ঝলক দেয়, আমার মনে একটা ভয়। সে কি আমাদের শেষ করতে এসেছে?

কালু বলে, “আমি তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, আবীর। তুমি জঙ্গলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে।” তার কথায় আমার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আমি জঙ্গলে দুই দিন ঘুরেছি? আমার স্মৃতি ঝাপসা, আমার মাথায় কোনো ছবি নেই। আমি কী করেছি? আমি কি কাউকে… আমার চিন্তা শেষ হয় না। আমার হাত কাঁপে, আমি আমার হাতের দিকে তাকাই—তারা পরিষ্কার, কিন্তু আমার মনে একটা অন্ধকার সন্দেহ। আমি কি কাউকে মেরেছি? আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঝলক দেয়—কালু কীভাবে আমাকে পেল? আমি জঙ্গলে এত ঘুরেও রাস্তা খুঁজে পাইনি, কিন্তু কালু কীভাবে ঠিক আমার কাছে পৌঁছে গেল? তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, যেন সে জঙ্গলের প্রতিটি কোণ চেনে। আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে—কালু কি এই বাংলোর অংশ? সে কি এই খুনের পিছনে জড়িত?

নাইমা ফিসফিস করে বলে, “আমরা কোনো উপায় না পেয়ে শেষ মুহূর্তগুলো আনন্দে কাটাতে চেয়েছিলাম।” তার কথায় আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি তার দিকে তাকাই, তার চোখে একটা অদ্ভুত লজ্জা, কিন্তু তার ঠোঁটে একটা ক্ষীণ হাসি। আমার মনে একটা অস্বস্তি—তারা কি সত্যিই এতটা নির্লজ্জ, নাকি এটা আমাকে বিভ্রান্ত করার একটা খেলা?

রিনার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত শান্তি, যেন সে আমার হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি ধুকপুক শুনতে পাচ্ছে। তার চোখ আমার চোখে স্থির, কালো মণির মধ্যে একটা অন্ধকার ঝিলিক, যেন সে আমার মনের গোপন কোণে ঢুকে পড়তে চায়। সে ধীরে ধীরে বলে, “তাই আমরা দুই দিন ধরে তোমার কোনো খোঁজ না পেয়ে, পরে নিজেদের মধ্যে… চোদাচুদি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।” তার কথাগুলো আমার মাথায় তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বিঁধে, আমার শিরদাঁড়ায় একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যায়। আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাই, তার ফ্যাকাশে মুখে একটা ক্ষীণ হাসি, যেন সে আমার বিস্ময় উপভোগ করছে। তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু তার চোখে কোনো লজ্জা নেই—শুধু একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা, যেন সে আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আমার মাথা ঘুরছে, আমার হৃৎপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে, যখন মৃত্যু আমাদের চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরছে, তারা এমন কিছু করেছে?

নাইমা মাথা নিচু করে, তার চুল তার মুখ ঢেকে ফেলেছে, যেন সে আমার দৃষ্টি এড়াতে চায়। তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত লজ্জা মিশে, কিন্তু শব্দগুলো যেন তার মুখ থেকে ছিঁড়ে বেরোচ্ছে। সে ফিসফিস করে বলে, “আমরা এক রাউন্ড চোদাচুদি করে তৃপ্তি নিয়ে চুমাচুমি করছিলাম, এমন সময় হঠাৎ কালু তোমাকে নিয়ে ফিরে আসে।” তার কথাগুলো আমার কানে বিষের মতো ঢুকে, আমার শরীরে একটা অস্বস্তির ঢেউ বয়ে যায়। আমি তার দিকে তাকাই, তার ফ্যাকাশে মুখে একটা অশ্রু ঝিলিক দিচ্ছে, কিন্তু তার চোখে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন সে আমার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। তার হাত কাঁপছে, তার নখ তার পোশাকের কিনারে শক্ত করে ধরে, যেন সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে। আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ জাগে—তারা কি সত্যিই এতটা নির্লজ্জ? নাকি এটা আমাকে বিভ্রান্ত করার একটা খেলা? তাদের এই স্বীকারোক্তি কি আমার মনে বিষ ছড়ানোর একটা চাল? আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঝলক দেয়—তারা কি আমাকে এই খুনের ফাঁসে জড়াতে চায়?
রিনা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই কালুর কোলে অজ্ঞান হয়ে ছিলি।” তার হাত আমার ত্বকে ঠান্ডা, যেন তার মধ্যে কোনো উষ্ণতা নেই। তার নখ আমার ত্বকে সামান্য বিঁধে, আমার শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ। তার কণ্ঠে একটা নকল সহানুভূতি, যেন সে আমার জন্যে চিন্তিত, কিন্তু তার চোখে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন সে আমার প্রতিটি নড়াচড়া, আমার প্রতিটি শ্বাস পর্যবেক্ষণ করছে। আমি তার দিকে তাকাই, তার ফ্যাকাশে মুখে একটা হাসি, যেন সে আমাকে কিছু বোঝাতে চায়। নাইমা যোগ করে, “আর ঘুমের মধ্যে তুই আবোল-তাবোল বলছিলি—‘হেলিখ! হেলিখ!’” তার কথায় আমার শরীরে একটা ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যায়। হেলিখ? আমার মনে সেই ছবি ভেসে ওঠে—আকাশে হেলিখাবার গর্জন, প্রপেলারের ঘূর্ণন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন করে, উদ্ধারকারী দলের কালো ইউনিফর্ম জঙ্গলের অন্ধকারে ঝিলিক দেয়। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে বলি, “হেলিখ? আমি… আমি ভেবেছিলাম আমরা উদ্ধার হয়েছি।” আমার কণ্ঠ কাঁপছে, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমার মাথায় একটা ধাঁধা—সেসব কি তবে স্বপ্ন ছিল? নাকি এই বাংলো আমার মনকে নিয়ে খেলছে? আমার চোখ তাদের মুখে ঘুরছে, তাদের ফ্যাকাশে মুখে একটা অদ্ভুত শান্তি, যেন তারা আমার বিভ্রান্তি উপভোগ করছে।

তাদের কথাবার্তা আমার মাথায় হাতুড়ির মতো আঘাত করে। আমি বুঝতে পারি, দুই দিন আমি হন্যে হয়ে এই অদ্ভুত জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার স্মৃতি ঝাপসা, যেন কেউ আমার মনের ক্যানভাস থেকে রং মুছে দিয়েছে। আমার মাথায় কোনো ছবি নেই—আমি কোথায় ছিলাম? আমি কী করেছি? আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর প্রশ্ন জাগে—আমি কি কাউকে মেরেছি? আমার হাত কাঁপছে, আমি আমার হাতের দিকে তাকাই। আমার আঙুল পরিষ্কার, কিন্তু আমার নখের নিচে কালো ময়লা জমে আছে, যেন জঙ্গলের মাটি আমার ত্বকে লেপটে গেছে। আমার মনে একটা অন্ধকার সন্দেহ—এটা কি রক্তের দাগ? আমি জঙ্গল থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাইনি, গাছের ডালপালা আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল, তাদের ছায়া আমার পিছু নিয়েছিল। আমি ঘুরেফিরে শেষে এই বাংলোতেই ফিরে এসেছি। এই বাংলো যেন আমাকে টেনে আনে, যেন এটা আমার ভাগ্য। আমার মাথায় সেই পুরনো ছবির কথা ভেসে ওঠে—আমি, রিনা, নাইমা, শরিফা, লতা, সুমন, সবাই একসঙ্গে, শত বছর আগের ছবি। ছবিটার ফ্রেমে ধুলো জমে আছে, তাদের মুখে অদ্ভুত হাসি, যেন তারা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে, “তুই আমাদের অংশ।” আমি কি সত্যিই এই পাপের অংশ?
আমার শরীর কেঁপে ওঠে, আমার হৃৎপিণ্ড যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। আমি চোখ বন্ধ করি, কিন্তু অন্ধকারে শরিফার গলায় দড়ি, লতার রক্তাক্ত বুক, সুমনের ভাঙা মাথা ভেসে ওঠে। আমি চোখ খুলে তাকাই, রিনা আর নাইমার দিকে। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, তাদের চোখ আমার দিকে তাকিয়ে, যেন তারা আমার মনের ভয় পড়তে পারছে। আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে—তারা কি জানে আমি কী করেছি? তারা কি আমাকে দায়ী করতে চায়? আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, আমি কিছু বলতে চাই, কিন্তু আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কালো কুয়াশার ছায়া - by Abirkkz - 11-06-2025, 11:33 PM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)