10-06-2025, 06:55 PM
সকালের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে বাংলোর ধুলোমাখা মেঝেতে একটি বিবর্ণ, কাঁপা কাঁপা রেখা ফেলেছে। আলোটি যেন এই পুরোনো, জরাজীর্ণ বাংলোর অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছে। আমি, আবীর, চোখ মেলে জেগে উঠি। আমার শরীর এখনো রাতের উন্মত্ততার চিহ্নে মাখামাখি—কামরস, ঘাম, আর বীর্যের গন্ধ আমাকে ঘিরে আছে। পাশে রিনা ঘুমিয়ে, তার শরীর ঘামে চকচক করছে, তার শ্বাসের হালকা শব্দ ছাড়া ঘর নিস্তব্ধ। কিন্তু এই নিস্তব্ধতা অশুভ, যেন কোনো অজানা শক্তি আমাদের চারপাশে লুকিয়ে আছে, আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস গুনছে। আমার মনে একটা অস্পষ্ট অস্বস্তি জাগে। “শরিফা, সুমন, লতা, নাইমা—তারা কোথায়?” আমি রিনার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডেকে বলি, “রিনা, ওঠো। বাকিরা কোথায়?”
রিনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে, তার দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি আর ভয়। সে কাঁপা গলায় বলে, “আবীর, আমি কিছু জানি না। তারা কি হলঘরে নেই?” আমি উঠে বসি, আমার হৃৎপিণ্ডে একটা অজানা আতঙ্কের ধাক্কা। বাংলোর এই নিস্তব্ধতা যেন আমাকে গ্রাস করছে। আমি দ্রুত উঠে হলঘরের দিকে যাই। সেখানে নাইমা একা বসে আছে, তার চোখে অস্থিরতা। “নাইমা, শরিফা, সুমন, লতা কোথায়?” আমার কণ্ঠে উদ্বেগ। নাইমা মাথা নাড়ে, “আমি জানি না, আবীর। আমি ভোর থেকে এখানে বসে আছি। তারা কেউ নেই।”
আমরা তিনজন—আবীর, রিনা, নাইমা—বাংলোর ঠান্ডা, অন্ধকার কামরাগুলো খুঁজতে শুরু করি। বাংলোর দেয়াল যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর গন্ধ ঘনীভূত হচ্ছে। প্রথম কামরায় আমরা শরিফার দেহ দেখি। সে মেঝেতে পড়ে আছে, গলায় একটি দড়ি শক্তভাবে পেঁচানো, তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ উলটে গেছে, যেন মৃত্যু তাকে অন্ধকারের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে। আমার বুক কেঁপে ওঠে, গলা থেকে একটি আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। “শরিফা মরে গেছে!” আমি চিৎকার করি। রিনা আমার হাত চেপে ধরে, তার শরীর কাঁপছে, তার চোখে ভয় আর অবিশ্বাস। “আবীর, এ কী হলো?” সে ফিসফিস করে।
আমরা দ্বিতীয় কামরায় ছুটি। সেখানে লতার দেহ খাটে পড়ে আছে। তার বুকে একটি ছুরি গাঁথা, রক্ত তার শরীর থেকে গড়িয়ে খাট ভিজিয়ে দিয়েছে। ছুরির ক্ষতটি নিখুঁত, যেন কোনো দক্ষ হাত তাকে নিষ্ঠুরভাবে শেষ করেছে। আমার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে। “লতাও মরে গেছে!” আমার কণ্ঠে আতঙ্ক। নাইমা ছুটে আসে, তার চোখে অশ্রু আর ভয়। “আবীর, এ কী দেখছি আমরা?” সে কাঁপা গলায় বলে।
তৃতীয় কামরায় নাইমার চিৎকার আমাদের টেনে নিয়ে যায়। সেখানে সুমন মেঝেতে পড়ে আছে, তার মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্ন। রক্ত তার মাথা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে একটি অশুভ প্যাটার্ন তৈরি করেছে। “সুমনও মরে গেছে!” নাইমা কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, মাথা ঘুরছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে বলি, “নাইমা, রিনা, এটা কীভাবে হলো? শরিফা, লতা, সুমন—তারা সবাই মরে গেছে! খুনী আমাদের একে একে শেষ করছে!”
হলঘরে ফিরে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের শরীর এখনো রাতের পাপের চিহ্নে মাখামাখি, আমাদের মনে ভয়, সন্দেহ, আর অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলোর দেয়াল যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, ছায়াগুলো নড়ছে, যেন তারা জীবন্ত। রিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আবীর, আমরা কি বাঁচব? খুনী কি আমাদেরও শেষ করবে?” নাইমা ফিসফিস করে, “এই বাংলো আমাদের পাপের ফল। আমরা এখান থেকে পালাতে পারব না।” আমি তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলি, “আমরা বেঁচে আছি। আমাদের এখনই বাংলো থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু খুনী কে, তা আমাদের জানতেই হবে।”
আমি শান্তভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। শরিফার গলার দড়ির গিঁট অস্বাভাবিকভাবে শক্ত, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বেঁধেছে। লতার বুকে ছুরির ক্ষতটি নিখুঁত, একজন দক্ষ হাতের কাজ। সুমনের মাথার আঘাতে কোনো সংগ্রামের চিহ্ন নেই, যেন তাকে ঘুমের মধ্যেই মারা হয়েছে। আমি বলি, “এই হত্যাগুলো পরিকল্পিত। খুনী আমাদের মধ্যেই ছিল।” রিনার চোখে ভয়, কিন্তু তার দৃষ্টিতে কি একটি গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে? নাইমার চোখে বিভ্রান্তি, কিন্তু সেও কি কিছু জানে?
আমার মনে রোহানের নাম বারবার ফিরে আসে। রোহান, যে গত রাতে আমাদের সঙ্গে ছিল, তার অদ্ভুত আচরণ, তার রহস্যময় উপস্থিতি—এগুলো কি এই খুনের পিছনে কোনো সূত্র? আমি রিনার দিকে তাকিয়ে বলি, “রিনা, তুমি কি রোহানের কথা কিছু জানো? সে কোথায়?” রিনা মাথা নাড়ে, “আবীর, আমি কিছু জানি না। আমি শুধু জানি আমরা এখানে আটকে আছি।” কিন্তু তার কণ্ঠে একটা অস্বাভাবিক কম্পন, যেন সে কিছু লুকোচ্ছে।
বাংলোর পরিবেশ যেন আমাদের গ্রাস করছে। প্রতিটি কোণে মৃত্যুর গন্ধ, প্রতিটি শব্দে অতিপ্রাকৃতিক আতঙ্কের আভাস। দেয়ালের ছায়াগুলো যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, যেন এই বাংলো আমাদের পাপের কারাগার। আমি বলি, “এই বাংলো আমাদের শাস্তি দিচ্ছে। খুনী আমাদের পিছনে আছে, তার ছায়া আমাদের শেষ করার জন্য লুকিয়ে আছে।” রিনা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আবীর, আমি কিছু করিনি। আমাকে বিশ্বাস করো।” নাইমা ফিসফিস করে, “আবীর, আমি আর পারছি না। এই বাংলো আমাদের ধ্বংস করেছে।”
আমার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরছে। শরিফা, লতা, সুমনকে কে মারল? আমাদের রাতের নোংরা খেলা কি এই মৃত্যুর কারণ? নাকি এই বাংলোর অন্ধকারে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি লুকিয়ে আছে? রোহানের রহস্য কি এই খুনের পিছনে কোনো সত্য লুকিয়ে রেখেছে? আমি রিনার হাত ধরে বলি, “রিনা, আমরা এখনই বাংলো থেকে বেরোব। কিন্তু খুনীকে না ধরলে আমরা কেউ নিরাপদ নই।”
আমরা বাংলোর দরজার দিকে এগোই। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে আমার মনে একটা অশুভ অনুভূতি জাগে। দরজার হাতল ধরার মুহূর্তে আমি পিছনে তাকাই। বাংলোর অন্ধকার হলঘরে একটি ছায়া নড়ে ওঠে। আমার হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। খুনী কি এখনো আমাদের পিছনে আছে? আমরা কি বাঁচব, নাকি এই অন্ধকার আমাদের গ্রাস করবে? বাংলোর দেয়াল যেন ফিসফিস করে বলছে—সত্য বেরিয়ে আসবে, কিন্তু তার মূল্য আমাদের দিতে হবে।
আমার ভেতরে কী হচ্ছে, আমি নিজেই জানি না। বুকের ভেতরটা যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে দিচ্ছে, মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে, যেন কেউ আমার মনের গভীরে হাতড়ে কিছু খুঁজছে। একটা অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে, যার কারণ আমার কাছে অস্পষ্ট। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। বাংলোর ভারী কাঠের দরজা ঠেলে হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে গেলাম। চারপাশে শুধু জঙ্গল—ঘন, অন্ধকার, গাছের ডালপালা যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আমাকে গিলে ফেলতে চায়। কোনো মানুষের পদশব্দ নেই, কোনো পাখির ডাক নেই, এমনকি বাতাসের শনশন শব্দটুকুও যেন থমকে গেছে। শুধু আমার পায়ের তলায় শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর আমার নিজের শ্বাসের হাঁপানি। আমি দৌড়াচ্ছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি? জীবন কি এমনই এক অন্ধকার জঙ্গল, যেখানে পথ খুঁজতে খুঁজতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি?
আমি হন্যে হয়ে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটছি। পায়ের তলায় মাটি যেন আমাকে টেনে ধরতে চায়, গাছের ডালপালা আমার কাপড়ে আঁচড় কাটছে। কতক্ষণ দৌড়ালাম, জানি না। শ্বাস ফুরিয়ে আসছে, পা দুটো যেন আর চলতে চায় না। ঠিক তখনই, দূরে একটা ক্ষীণ আলোর বিন্দু চোখে পড়ল। মৃদু, কাঁপা কাঁপা, যেন কেউ জঙ্গলের গভীরে টর্চ জ্বেলে আমাকে ডাকছে। কাছাকাছি গিয়ে দেখি, একটা পুরনো বাড়ি। জানালায় হলুদ আলো জ্বলছে, কিন্তু সে আলো কেমন যেন অস্বাভাবিক—যেন শতাব্দী ধরে জ্বলছে, আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল, কিন্তু সেই আনন্দের মাঝে একটা অজানা ভয় লুকিয়ে ছিল। আমি আরও জোরে দৌড়ালাম।
আমার শরীর আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রতিটি পেশী কাঁপছে, প্রতিটি শ্বাসে বুকের ভেতরে যেন হাজার ছুরি বিঁধছে। আমার হৃৎপিণ্ড যেন বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, প্রতিটি ধাক্কায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে। জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে আমার পায়ের তলায় শুকনো পাতা মচমচ করে ভেঙে যাচ্ছে। গাছের ডালপালা আমার কাপড়ে আঁচড় কাটছে, আমার হাতে-পায়ে রক্তাক্ত দাগ পড়ছে। আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা—পালাতে হবে। ওই রক্তের নকশা, ওই ফিসফিস, ওই অমানুষিক ছায়াগুলো—সবকিছু থেকে দূরে যেতে হবে। হঠাৎ আমি একটা রক্তে মাখা পায়ের ছাপ দেখি। তাজা রক্ত, এখনো চকচকে, যেন এইমাত্র কেউ এখান দিয়ে গেছে। আমার বুক কেঁপে ওঠে। এটা কি খুনীর ছাপ? আমি কাঁপতে কাঁপতে ছাপের পিছু নিই, মনে হয় এটা আমাকে খুনীর কাছে নিয়ে যাবে। পথে পথে ছড়িয়ে আছে শরিফার দড়ি, লতার ছুরি, আর সুমনের রক্তের দাগ। প্রতিটি জিনিস আমার দিকে তাকিয়ে যেন বলছে, “তুই দায়ী, আবীর।” আমার পা কাঁপছে, কিন্তু আমি এগোই। হঠাৎ জঙ্গলের মাঝে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছাই। সেখানে রিনা দাঁড়িয়ে। তার চোখে কোনো জীবন নেই, হাতে রক্তমাখা ছুরি—লতার বুকে গাঁথা ছিল যেটা। তার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি, যেন সে আমাকে চেনেই না। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, আমি এটা করিনি, কিন্তু তুই জানিস কে করেছে।” আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, “রিনা, তুই কী বলছিস? কে করেছে?” কিন্তু সে আর কিছু বলে না, শুধু ছুরিটা উঁচু করে ধরে। আমি পিছিয়ে যাই, আর দৌড়ে পালাই। আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন—রিনা কি খুনী? নাকি সে আমাকে কিছু বলতে চাইছে?
জঙ্গলের গভীরে ছুটতে ছুটতে আমি হঠাৎ একটা কালো কুয়াশার মধ্যে ঢুকে পড়ি। বাতাস ঠান্ডা, ভারী, যেন আমার ফুসফুসে বিষ ঢুকছে। কুয়াশার মধ্যে অদ্ভুত শব্দ—ফিসফিস, আর্তনাদ, আর কান্নার মিশ্রণ। আমি দম বন্ধ করে এগোই, কিন্তু হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে মিলির মুখ ভেসে ওঠে। তার চোখ ফাঁকা, দুটো কালো গর্ত, যেন সেখানে কোনো আত্মা নেই। তার মুখ থেকে কালো তরল ঝরছে, যেন তার শরীর থেকে জীবন গলে যাচ্ছে। সে অমানুষিক কণ্ঠে বলে, “আবীর, তুই এসেছিস। এখন আমরা তোকে খেয়ে নেব।” আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু কুয়াশা আমাকে ঘিরে ধরে। জঙ্গলের গাছগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে—তাদের ডালপালা আমার দিকে ছুটে আসছে, যেন অভিশপ্ত হাত আমাকে চেপে ধরতে চায়। আমি চিৎকার করি, “মিলি, তুই কোথায়? তুই কেন এমন করছিস?” কিন্তু কোনো উত্তর নেই। শুধু তার হাসি, আর কুয়াশার মধ্যে আরও ছায়া—শরিফা, লতা, সুমন—সবাই আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু ফাঁকা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমি দৌড়াই, হাত দিয়ে কুয়াশা ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার শরীর ভারী হয়ে আসছে। আমি পড়ে যাই, মাটিতে হাত দিতেই অনুভব করি—মাটি ঠান্ডা, ভিজে, যেন রক্তে ভেজা। আমি উঠে আবার দৌড়াই। আমি জানি, থামলে ওরা আমাকে ধরে ফেলবে।
জঙ্গলের মাঝে ছুটতে ছুটতে আমি একটা বিশাল, পুরনো গাছের নিচে থামি। গাছের গুঁড়ি কালো, যেন শতাব্দীর পাপ শুষে নিয়েছে। আমি কাছে যেতেই দেখি, গাছের গুঁড়িতে খোদাই করা আমার নাম—‘আবীর’। তার নিচে লেখা, “তোর পাপ তোকে ছাড়বে না।” আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে নাইমার মুখ ভেসে ওঠে। তার চোখে অশ্রু, কিন্তু তার কণ্ঠে কোনো জীবন নেই। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই জানতি আমরা কী করেছি। তুই কেন আমাদের বাঁচাসনি?” আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, “নাইমা, আমি কিছু জানি না! আমি কেন দায়ী?” কিন্তু সে শুধু মাথা নাড়ে, আর তার শরীর কুয়াশায় মিলিয়ে যায়। আমি আবার দৌড়াই, কিন্তু জঙ্গলের পথ আমাকে একটা পুরনো ছোট ঘরের দিকে নিয়ে যায়। আমি ঢুকি, আর মেঝেতে একটা পুরনো ছবি দেখি। ছবিতে আমি, রিনা, নাইমা, শরিফা, লতা, হাবিব, মিলির মা, সুমন, কাজল, মিলি—সবাই একসঙ্গে। কিন্তু ছবিটা শত বছর আগের, যেন আমরা কোনো প্রাচীন পাপের অংশ। আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি কি এই পাপের অংশ ছিলাম? আমি ছুটে বেরিয়ে যাই, কিন্তু আমার মন বলছে, এই সত্য আমাকে ছাড়বে না।
জঙ্গলের মাঝে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটা ছোট্ট ঝর্নার কাছে থামি। পানির শব্দে মনে হয় একটু শান্তি পাব। কিন্তু আমি ঝুঁকে পানিতে তাকাতেই আমার শ্বাস আটকে যায়। পানিতে রোহানের প্রতিবিম্ব, তার মুখে সেই অদ্ভুত হাসি, যেন সে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছে। তার চোখে লাল আভা, যেন কোনো ডেমন তার ভেতরে বাস করে। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু হঠাৎ পানি থেকে তার হাত বেরিয়ে আসে, আমার পা ধরে টানে। আমার গলা থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। আমি ছুটে পালাই, কিন্তু জঙ্গলের গাছগুলো যেন আমাকে পথ দেখাচ্ছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে একটা গুহার মুখে পৌঁছাই। গুহার ভেতরে ঢুকতেই দেখি, রোহান দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটা পুরনো দিনলিপি, যেখানে লেখা, “এই বাংলোর পাপের শাস্তি তুই-ই দিবি, আবীর।” তার চোখে লাল আভা, আর তার পিছনে মানিক, নববী, আর কাজলের ছায়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি চিৎকার করে বলি, “রোহান, তুই এটা কী করছিস?” কিন্তু সে শুধু হাসে, আর গুহার দেয়াল যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি পালাই, কিন্তু গুহার অন্ধকার আমাকে তাড়া করে।
জঙ্গলে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আরেকটা গুহার মুখে পৌঁছাই। গুহার ভেতর থেকে একটা গভীর গর্জন শোনা যায়, আর হাবিবের আর্তনাদ। আমার শরীর কাঁপছে, কিন্তু আমি ভেতরে তাকাই। সেখানে একটা বিশাল কালো মুখ, যার চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সে অমানুষিক কণ্ঠে বলে, “আবীর, তুই আমার পাপের শিকার।” আমার পা অবশ হয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু গুহার অন্ধকার যেন আমাকে টেনে নিতে চায়। আমি দৌড়ে পালাই, কিন্তু জঙ্গলের পথ আমাকে ফিরিয়ে আনে সেই বাংলোর দরজায়। আমি দরজা ঠেলে ঢুকি, আর যা দেখি, তাতে আমার গা শিউরে উঠল, ভয় আর বিস্ময়ে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠল মুহূর্তেই আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ভিতরের দৃশ্য দেখে নিঃশ্বাস আটকে এলো, তাতে ভয়ে বিস্ময়ে আমার রক্ত জমে গেল, আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল
হলঘরে পা রাখতেই আমার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের মাঝে রিনা আর নাইমা দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাদের রূপ আর মানুষের নয়। তাদের শরীর অর্ধেক পচে গেছে, চামড়া ঝুলছে, যেন কেউ তাদের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে। রিনার মুখের বাঁ-দিকটা গলে গেছে, তার গালের হাড় বেরিয়ে আছে, হাড়ের ফাঁকে কালো, আঠালো তরল জমে আছে। তার একটা চোখ ফাঁকা, শুধু একটা অতল কালো গর্ত, যেন সেখান থেকে অন্ধকার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নাইমার ঠোঁট ফাটা, তার দাঁত অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, ধারালো, যেন কোনো হিংস্র আত্মার। তাদের মুখ থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে, ধোঁয়ার মধ্যে যেন অসংখ্য ক্ষুদ্র মুখ ফিসফিস করছে, আমার নাম ডাকছে। আমার পা মাটিতে আটকে যায়, আমার শরীর নড়তে অস্বীকার করে। ঘরের বাতাস ভারী, যেন অদৃশ্য হাত আমার গলা চেপে ধরছে।
তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একটা অমানুষিক, অতিপ্রাকৃত নৃত্যে মগ্ন। তাদের হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে মুচড়ে যাচ্ছে, যেন তাদের হাড় ভেঙে গেছে, কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের নাচিয়ে চলেছে। নাইমা তার পচা, হাড়বেরানো হাত দিয়ে রিনার বুকে টিপ দেয়, কিন্তু তার আঙুলগুলো রিনার পচা মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। কালো, পচা তরল ছড়িয়ে পড়ে, মেঝেতে পড়তেই সেটা হিসহিস শব্দে জ্বলে ওঠে, যেন অভিশপ্ত আগুন। রিনা হাসে, একটা গভীর, গর্জনের মতো হাসি, যেন তার ভেতরে কোনো ডেমন বাস করে। সে তার হাত নাইমার গুদের দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে শুধু পচা মাংস ঝরে পড়ে, একটা বীভৎস, পচা গন্ধে ঘর ভরে যায়। গন্ধটা এত তীব্র যে আমার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে, আমি বমি করতে চাই, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ। তাদের ফাঁকা চোখ আমার দিকে তাকায়, আর তারা একসঙ্গে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই আমাদের সঙ্গে যোগ দে।” তাদের কণ্ঠ যেন আমার মাথার ভেতরে ছুরি চালাচ্ছে, প্রতিটি শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডে আঘাত করছে। ঘরের ছায়াগুলো নড়ে ওঠে, যেন অসংখ্য আত্মা আমার চারপাশে ঘুরছে।
আমি পিছিয়ে যেতে চাই, কিন্তু হঠাৎ মেঝে ফেটে একটা কালো, হাড়বিহীন হাত বেরিয়ে আসে। তার আঙুলগুলো অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, নখগুলো ধারালো, কালো, যেন শতাব্দীর পাপে মাখা। হাতটা আমার পা ধরে টানে, তার স্পর্শ এত ঠান্ডা যে আমার হাড় পর্যন্ত জমে যায়। আমি চিৎকার করি, “না! আমি এখানে থাকব না!” আমার কণ্ঠ ভেঙে যায়, আমার শ্বাস আটকে আসছে। আমি পা ছাড়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু হাতটা আরও শক্ত করে ধরে, তার নখ আমার চামড়ায় বিঁধে যায়। রক্ত ঝরে, কিন্তু রক্তটা লাল নয়—কালো, আঠালো, যেন আমার শরীর থেকে জীবন টেনে নিচ্ছে। মেঝে থেকে আরও কালো তরল বেরোচ্ছে, যেন রক্ত আর পচনের মিশ্রণ। তরলটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে, আর তার মধ্যে শরিফা, লতা, সুমনের মুখ ভেসে ওঠে, তাদের চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে, “আবীর, তুই আমাদের মেরেছিস।” আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি কি সত্যিই…?
ঘরের দেয়ালগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কাঠের ফ্রেমে ফাটল ধরছে, ফাটল থেকে কালো রক্ত ঝরছে, যেন বাংলোর শিরায় রক্ত বইছে। দেয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে, যেন অসংখ্য আত্মা আমার চারপাশে ঘুরছে, তাদের হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করি, কিন্তু আমার মনের ভেতরে তাদের ফিসফিস বাজছে: “আবীর, তুই পালাতে পারবি না।” আমার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, কিন্তু রিনা আর নাইমার পচা, বিকৃত রূপ স্পষ্ট। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের পায়ের নিচে মেঝে কাঁপছে, যেন বাংলো নিজেই তাদের আদেশ মানছে।
আমার পা আর নড়ছে না। আমার শরীর যেন অভিশপ্ত শক্তির কাছে হার মেনেছে। রিনা আর নাইমা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের পচা হাত আমার শরীর ছুঁয়ে দেয়। রিনার আঙুলগুলো আমার কাঁধে বসে, তার নখ আমার চামড়ায় ঢুকে যায়, আর আমার শরীরে একটা ঠান্ডা, বীভৎস অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমার রক্ত যেন জমে যাচ্ছে, আমার হৃৎপিণ্ড ধীর হয়ে আসছে। নাইমা তার পচা মুখ আমার মুখের কাছে নিয়ে আসে, তার নিঃশ্বাস থেকে পচা মাংসের গন্ধ আমার নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গন্ধটা এত তীব্র যে আমার চোখে জল চলে আসে। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই আমাদের মতো হয়ে যাবি। এই বাংলো তোর শেষ।” তার কণ্ঠে কোনো মানুষিকতা নেই, যেন কোনো প্রাচীন ডেমন তার ভেতর থেকে কথা বলছে।
আমি চিৎকার করতে চাই, কিন্তু আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। আমার শরীর কাঁপছে, আমার মন ভেঙে পড়ছে। আমি তাদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিই, কারণ আমার আর কোনো শক্তি নেই। তাদের পচা হাত আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে, যেন তারা আমার জীবনশক্তি চুষে নিচ্ছে। আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে, কিন্তু তাদের ফাঁকা চোখ আর পচা মুখ স্পষ্ট। আমার শরীর যেন তাদের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে, আমার মন যেন তাদের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রচণ্ড ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে। আমার শরীর আর মনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ঘরের মাঝে রিনা আর নাইমার অমানুষিক নৃত্য, মেঝের কালো হাত, দেয়ালের ফিসফিস—সবকিছু আমাকে ঘিরে ধরছে। আমার মাথার ভেতরে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরছে: শরিফা, লতা, সুমনের মৃত্যুর পিছনে কে? রিনা কি সত্যিই খুনী? জঙ্গলে তার কথা—“তুই জানিস কে করেছে”—কী বোঝাতে চায়? নাইমার অশ্রু আর অভিযোগ—“তুই কেন আমাদের বাঁচাসনি?”—এর মানে কী? রোহানের সেই লাল চোখ, তার দিনলিপি, তার হাসি—সে কি এই অভিশাপের পিছনে? আর এই বাংলো—এটা কি শুধু একটা বাড়ি, নাকি কোনো প্রাচীন ডেমনের কারাগার? আমার মনে সেই পুরনো ছবির কথা ভেসে ওঠে—আমি, রিনা, নাইমা, শরিফা, লতা, হাবিব, মিলির মা, সুমন, কাজল, মিলি—শত বছর আগের ছবি। আমি কি সত্যিই তখন ছিলাম? নাকি এই বাংলো আমার মনকে নিয়ে খেলছে, আমাকে পাগল করে দিচ্ছে?
আমার শরীর আর সইতে পারছে না। আমার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি ঘরের মধ্যে জ্ঞান হারাই। আমার শরীর মেঝেতে পড়ে যায়, কিন্তু পড়ার আগে আমি শুনতে পাই একটা গভীর, অমানুষিক কণ্ঠ, যেন বাংলো নিজেই কথা বলছে: “আবীর, তুই এখন আমার।” আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়, আর আমি অন্ধকারে ডুবে যাই।
রিনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে, তার দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি আর ভয়। সে কাঁপা গলায় বলে, “আবীর, আমি কিছু জানি না। তারা কি হলঘরে নেই?” আমি উঠে বসি, আমার হৃৎপিণ্ডে একটা অজানা আতঙ্কের ধাক্কা। বাংলোর এই নিস্তব্ধতা যেন আমাকে গ্রাস করছে। আমি দ্রুত উঠে হলঘরের দিকে যাই। সেখানে নাইমা একা বসে আছে, তার চোখে অস্থিরতা। “নাইমা, শরিফা, সুমন, লতা কোথায়?” আমার কণ্ঠে উদ্বেগ। নাইমা মাথা নাড়ে, “আমি জানি না, আবীর। আমি ভোর থেকে এখানে বসে আছি। তারা কেউ নেই।”
আমরা তিনজন—আবীর, রিনা, নাইমা—বাংলোর ঠান্ডা, অন্ধকার কামরাগুলো খুঁজতে শুরু করি। বাংলোর দেয়াল যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর গন্ধ ঘনীভূত হচ্ছে। প্রথম কামরায় আমরা শরিফার দেহ দেখি। সে মেঝেতে পড়ে আছে, গলায় একটি দড়ি শক্তভাবে পেঁচানো, তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখ উলটে গেছে, যেন মৃত্যু তাকে অন্ধকারের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে। আমার বুক কেঁপে ওঠে, গলা থেকে একটি আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। “শরিফা মরে গেছে!” আমি চিৎকার করি। রিনা আমার হাত চেপে ধরে, তার শরীর কাঁপছে, তার চোখে ভয় আর অবিশ্বাস। “আবীর, এ কী হলো?” সে ফিসফিস করে।
আমরা দ্বিতীয় কামরায় ছুটি। সেখানে লতার দেহ খাটে পড়ে আছে। তার বুকে একটি ছুরি গাঁথা, রক্ত তার শরীর থেকে গড়িয়ে খাট ভিজিয়ে দিয়েছে। ছুরির ক্ষতটি নিখুঁত, যেন কোনো দক্ষ হাত তাকে নিষ্ঠুরভাবে শেষ করেছে। আমার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে। “লতাও মরে গেছে!” আমার কণ্ঠে আতঙ্ক। নাইমা ছুটে আসে, তার চোখে অশ্রু আর ভয়। “আবীর, এ কী দেখছি আমরা?” সে কাঁপা গলায় বলে।
তৃতীয় কামরায় নাইমার চিৎকার আমাদের টেনে নিয়ে যায়। সেখানে সুমন মেঝেতে পড়ে আছে, তার মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্ন। রক্ত তার মাথা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে একটি অশুভ প্যাটার্ন তৈরি করেছে। “সুমনও মরে গেছে!” নাইমা কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, মাথা ঘুরছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে বলি, “নাইমা, রিনা, এটা কীভাবে হলো? শরিফা, লতা, সুমন—তারা সবাই মরে গেছে! খুনী আমাদের একে একে শেষ করছে!”
হলঘরে ফিরে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের শরীর এখনো রাতের পাপের চিহ্নে মাখামাখি, আমাদের মনে ভয়, সন্দেহ, আর অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলোর দেয়াল যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, ছায়াগুলো নড়ছে, যেন তারা জীবন্ত। রিনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আবীর, আমরা কি বাঁচব? খুনী কি আমাদেরও শেষ করবে?” নাইমা ফিসফিস করে, “এই বাংলো আমাদের পাপের ফল। আমরা এখান থেকে পালাতে পারব না।” আমি তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলি, “আমরা বেঁচে আছি। আমাদের এখনই বাংলো থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু খুনী কে, তা আমাদের জানতেই হবে।”
আমি শান্তভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। শরিফার গলার দড়ির গিঁট অস্বাভাবিকভাবে শক্ত, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা বেঁধেছে। লতার বুকে ছুরির ক্ষতটি নিখুঁত, একজন দক্ষ হাতের কাজ। সুমনের মাথার আঘাতে কোনো সংগ্রামের চিহ্ন নেই, যেন তাকে ঘুমের মধ্যেই মারা হয়েছে। আমি বলি, “এই হত্যাগুলো পরিকল্পিত। খুনী আমাদের মধ্যেই ছিল।” রিনার চোখে ভয়, কিন্তু তার দৃষ্টিতে কি একটি গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে? নাইমার চোখে বিভ্রান্তি, কিন্তু সেও কি কিছু জানে?
আমার মনে রোহানের নাম বারবার ফিরে আসে। রোহান, যে গত রাতে আমাদের সঙ্গে ছিল, তার অদ্ভুত আচরণ, তার রহস্যময় উপস্থিতি—এগুলো কি এই খুনের পিছনে কোনো সূত্র? আমি রিনার দিকে তাকিয়ে বলি, “রিনা, তুমি কি রোহানের কথা কিছু জানো? সে কোথায়?” রিনা মাথা নাড়ে, “আবীর, আমি কিছু জানি না। আমি শুধু জানি আমরা এখানে আটকে আছি।” কিন্তু তার কণ্ঠে একটা অস্বাভাবিক কম্পন, যেন সে কিছু লুকোচ্ছে।
বাংলোর পরিবেশ যেন আমাদের গ্রাস করছে। প্রতিটি কোণে মৃত্যুর গন্ধ, প্রতিটি শব্দে অতিপ্রাকৃতিক আতঙ্কের আভাস। দেয়ালের ছায়াগুলো যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, যেন এই বাংলো আমাদের পাপের কারাগার। আমি বলি, “এই বাংলো আমাদের শাস্তি দিচ্ছে। খুনী আমাদের পিছনে আছে, তার ছায়া আমাদের শেষ করার জন্য লুকিয়ে আছে।” রিনা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আবীর, আমি কিছু করিনি। আমাকে বিশ্বাস করো।” নাইমা ফিসফিস করে, “আবীর, আমি আর পারছি না। এই বাংলো আমাদের ধ্বংস করেছে।”
আমার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরছে। শরিফা, লতা, সুমনকে কে মারল? আমাদের রাতের নোংরা খেলা কি এই মৃত্যুর কারণ? নাকি এই বাংলোর অন্ধকারে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি লুকিয়ে আছে? রোহানের রহস্য কি এই খুনের পিছনে কোনো সত্য লুকিয়ে রেখেছে? আমি রিনার হাত ধরে বলি, “রিনা, আমরা এখনই বাংলো থেকে বেরোব। কিন্তু খুনীকে না ধরলে আমরা কেউ নিরাপদ নই।”
আমরা বাংলোর দরজার দিকে এগোই। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে আমার মনে একটা অশুভ অনুভূতি জাগে। দরজার হাতল ধরার মুহূর্তে আমি পিছনে তাকাই। বাংলোর অন্ধকার হলঘরে একটি ছায়া নড়ে ওঠে। আমার হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। খুনী কি এখনো আমাদের পিছনে আছে? আমরা কি বাঁচব, নাকি এই অন্ধকার আমাদের গ্রাস করবে? বাংলোর দেয়াল যেন ফিসফিস করে বলছে—সত্য বেরিয়ে আসবে, কিন্তু তার মূল্য আমাদের দিতে হবে।
আমার ভেতরে কী হচ্ছে, আমি নিজেই জানি না। বুকের ভেতরটা যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে দিচ্ছে, মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে, যেন কেউ আমার মনের গভীরে হাতড়ে কিছু খুঁজছে। একটা অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে, যার কারণ আমার কাছে অস্পষ্ট। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। বাংলোর ভারী কাঠের দরজা ঠেলে হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে গেলাম। চারপাশে শুধু জঙ্গল—ঘন, অন্ধকার, গাছের ডালপালা যেন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আমাকে গিলে ফেলতে চায়। কোনো মানুষের পদশব্দ নেই, কোনো পাখির ডাক নেই, এমনকি বাতাসের শনশন শব্দটুকুও যেন থমকে গেছে। শুধু আমার পায়ের তলায় শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর আমার নিজের শ্বাসের হাঁপানি। আমি দৌড়াচ্ছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি? জীবন কি এমনই এক অন্ধকার জঙ্গল, যেখানে পথ খুঁজতে খুঁজতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি?
আমি হন্যে হয়ে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটছি। পায়ের তলায় মাটি যেন আমাকে টেনে ধরতে চায়, গাছের ডালপালা আমার কাপড়ে আঁচড় কাটছে। কতক্ষণ দৌড়ালাম, জানি না। শ্বাস ফুরিয়ে আসছে, পা দুটো যেন আর চলতে চায় না। ঠিক তখনই, দূরে একটা ক্ষীণ আলোর বিন্দু চোখে পড়ল। মৃদু, কাঁপা কাঁপা, যেন কেউ জঙ্গলের গভীরে টর্চ জ্বেলে আমাকে ডাকছে। কাছাকাছি গিয়ে দেখি, একটা পুরনো বাড়ি। জানালায় হলুদ আলো জ্বলছে, কিন্তু সে আলো কেমন যেন অস্বাভাবিক—যেন শতাব্দী ধরে জ্বলছে, আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল, কিন্তু সেই আনন্দের মাঝে একটা অজানা ভয় লুকিয়ে ছিল। আমি আরও জোরে দৌড়ালাম।
আমার শরীর আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রতিটি পেশী কাঁপছে, প্রতিটি শ্বাসে বুকের ভেতরে যেন হাজার ছুরি বিঁধছে। আমার হৃৎপিণ্ড যেন বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, প্রতিটি ধাক্কায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে। জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে আমার পায়ের তলায় শুকনো পাতা মচমচ করে ভেঙে যাচ্ছে। গাছের ডালপালা আমার কাপড়ে আঁচড় কাটছে, আমার হাতে-পায়ে রক্তাক্ত দাগ পড়ছে। আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা—পালাতে হবে। ওই রক্তের নকশা, ওই ফিসফিস, ওই অমানুষিক ছায়াগুলো—সবকিছু থেকে দূরে যেতে হবে। হঠাৎ আমি একটা রক্তে মাখা পায়ের ছাপ দেখি। তাজা রক্ত, এখনো চকচকে, যেন এইমাত্র কেউ এখান দিয়ে গেছে। আমার বুক কেঁপে ওঠে। এটা কি খুনীর ছাপ? আমি কাঁপতে কাঁপতে ছাপের পিছু নিই, মনে হয় এটা আমাকে খুনীর কাছে নিয়ে যাবে। পথে পথে ছড়িয়ে আছে শরিফার দড়ি, লতার ছুরি, আর সুমনের রক্তের দাগ। প্রতিটি জিনিস আমার দিকে তাকিয়ে যেন বলছে, “তুই দায়ী, আবীর।” আমার পা কাঁপছে, কিন্তু আমি এগোই। হঠাৎ জঙ্গলের মাঝে একটা খোলা জায়গায় পৌঁছাই। সেখানে রিনা দাঁড়িয়ে। তার চোখে কোনো জীবন নেই, হাতে রক্তমাখা ছুরি—লতার বুকে গাঁথা ছিল যেটা। তার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি, যেন সে আমাকে চেনেই না। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, আমি এটা করিনি, কিন্তু তুই জানিস কে করেছে।” আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, “রিনা, তুই কী বলছিস? কে করেছে?” কিন্তু সে আর কিছু বলে না, শুধু ছুরিটা উঁচু করে ধরে। আমি পিছিয়ে যাই, আর দৌড়ে পালাই। আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন—রিনা কি খুনী? নাকি সে আমাকে কিছু বলতে চাইছে?
জঙ্গলের গভীরে ছুটতে ছুটতে আমি হঠাৎ একটা কালো কুয়াশার মধ্যে ঢুকে পড়ি। বাতাস ঠান্ডা, ভারী, যেন আমার ফুসফুসে বিষ ঢুকছে। কুয়াশার মধ্যে অদ্ভুত শব্দ—ফিসফিস, আর্তনাদ, আর কান্নার মিশ্রণ। আমি দম বন্ধ করে এগোই, কিন্তু হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে মিলির মুখ ভেসে ওঠে। তার চোখ ফাঁকা, দুটো কালো গর্ত, যেন সেখানে কোনো আত্মা নেই। তার মুখ থেকে কালো তরল ঝরছে, যেন তার শরীর থেকে জীবন গলে যাচ্ছে। সে অমানুষিক কণ্ঠে বলে, “আবীর, তুই এসেছিস। এখন আমরা তোকে খেয়ে নেব।” আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু কুয়াশা আমাকে ঘিরে ধরে। জঙ্গলের গাছগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে—তাদের ডালপালা আমার দিকে ছুটে আসছে, যেন অভিশপ্ত হাত আমাকে চেপে ধরতে চায়। আমি চিৎকার করি, “মিলি, তুই কোথায়? তুই কেন এমন করছিস?” কিন্তু কোনো উত্তর নেই। শুধু তার হাসি, আর কুয়াশার মধ্যে আরও ছায়া—শরিফা, লতা, সুমন—সবাই আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু ফাঁকা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমি দৌড়াই, হাত দিয়ে কুয়াশা ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার শরীর ভারী হয়ে আসছে। আমি পড়ে যাই, মাটিতে হাত দিতেই অনুভব করি—মাটি ঠান্ডা, ভিজে, যেন রক্তে ভেজা। আমি উঠে আবার দৌড়াই। আমি জানি, থামলে ওরা আমাকে ধরে ফেলবে।
জঙ্গলের মাঝে ছুটতে ছুটতে আমি একটা বিশাল, পুরনো গাছের নিচে থামি। গাছের গুঁড়ি কালো, যেন শতাব্দীর পাপ শুষে নিয়েছে। আমি কাছে যেতেই দেখি, গাছের গুঁড়িতে খোদাই করা আমার নাম—‘আবীর’। তার নিচে লেখা, “তোর পাপ তোকে ছাড়বে না।” আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে নাইমার মুখ ভেসে ওঠে। তার চোখে অশ্রু, কিন্তু তার কণ্ঠে কোনো জীবন নেই। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই জানতি আমরা কী করেছি। তুই কেন আমাদের বাঁচাসনি?” আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, “নাইমা, আমি কিছু জানি না! আমি কেন দায়ী?” কিন্তু সে শুধু মাথা নাড়ে, আর তার শরীর কুয়াশায় মিলিয়ে যায়। আমি আবার দৌড়াই, কিন্তু জঙ্গলের পথ আমাকে একটা পুরনো ছোট ঘরের দিকে নিয়ে যায়। আমি ঢুকি, আর মেঝেতে একটা পুরনো ছবি দেখি। ছবিতে আমি, রিনা, নাইমা, শরিফা, লতা, হাবিব, মিলির মা, সুমন, কাজল, মিলি—সবাই একসঙ্গে। কিন্তু ছবিটা শত বছর আগের, যেন আমরা কোনো প্রাচীন পাপের অংশ। আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি কি এই পাপের অংশ ছিলাম? আমি ছুটে বেরিয়ে যাই, কিন্তু আমার মন বলছে, এই সত্য আমাকে ছাড়বে না।
জঙ্গলের মাঝে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটা ছোট্ট ঝর্নার কাছে থামি। পানির শব্দে মনে হয় একটু শান্তি পাব। কিন্তু আমি ঝুঁকে পানিতে তাকাতেই আমার শ্বাস আটকে যায়। পানিতে রোহানের প্রতিবিম্ব, তার মুখে সেই অদ্ভুত হাসি, যেন সে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছে। তার চোখে লাল আভা, যেন কোনো ডেমন তার ভেতরে বাস করে। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু হঠাৎ পানি থেকে তার হাত বেরিয়ে আসে, আমার পা ধরে টানে। আমার গলা থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। আমি ছুটে পালাই, কিন্তু জঙ্গলের গাছগুলো যেন আমাকে পথ দেখাচ্ছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে একটা গুহার মুখে পৌঁছাই। গুহার ভেতরে ঢুকতেই দেখি, রোহান দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটা পুরনো দিনলিপি, যেখানে লেখা, “এই বাংলোর পাপের শাস্তি তুই-ই দিবি, আবীর।” তার চোখে লাল আভা, আর তার পিছনে মানিক, নববী, আর কাজলের ছায়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি চিৎকার করে বলি, “রোহান, তুই এটা কী করছিস?” কিন্তু সে শুধু হাসে, আর গুহার দেয়াল যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি পালাই, কিন্তু গুহার অন্ধকার আমাকে তাড়া করে।
জঙ্গলে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি আরেকটা গুহার মুখে পৌঁছাই। গুহার ভেতর থেকে একটা গভীর গর্জন শোনা যায়, আর হাবিবের আর্তনাদ। আমার শরীর কাঁপছে, কিন্তু আমি ভেতরে তাকাই। সেখানে একটা বিশাল কালো মুখ, যার চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সে অমানুষিক কণ্ঠে বলে, “আবীর, তুই আমার পাপের শিকার।” আমার পা অবশ হয়ে যায়। আমি পিছিয়ে যাই, কিন্তু গুহার অন্ধকার যেন আমাকে টেনে নিতে চায়। আমি দৌড়ে পালাই, কিন্তু জঙ্গলের পথ আমাকে ফিরিয়ে আনে সেই বাংলোর দরজায়। আমি দরজা ঠেলে ঢুকি, আর যা দেখি, তাতে আমার গা শিউরে উঠল, ভয় আর বিস্ময়ে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠল মুহূর্তেই আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ভিতরের দৃশ্য দেখে নিঃশ্বাস আটকে এলো, তাতে ভয়ে বিস্ময়ে আমার রক্ত জমে গেল, আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল
হলঘরে পা রাখতেই আমার শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের মাঝে রিনা আর নাইমা দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাদের রূপ আর মানুষের নয়। তাদের শরীর অর্ধেক পচে গেছে, চামড়া ঝুলছে, যেন কেউ তাদের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে। রিনার মুখের বাঁ-দিকটা গলে গেছে, তার গালের হাড় বেরিয়ে আছে, হাড়ের ফাঁকে কালো, আঠালো তরল জমে আছে। তার একটা চোখ ফাঁকা, শুধু একটা অতল কালো গর্ত, যেন সেখান থেকে অন্ধকার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নাইমার ঠোঁট ফাটা, তার দাঁত অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, ধারালো, যেন কোনো হিংস্র আত্মার। তাদের মুখ থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে, ধোঁয়ার মধ্যে যেন অসংখ্য ক্ষুদ্র মুখ ফিসফিস করছে, আমার নাম ডাকছে। আমার পা মাটিতে আটকে যায়, আমার শরীর নড়তে অস্বীকার করে। ঘরের বাতাস ভারী, যেন অদৃশ্য হাত আমার গলা চেপে ধরছে।
তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে একটা অমানুষিক, অতিপ্রাকৃত নৃত্যে মগ্ন। তাদের হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে মুচড়ে যাচ্ছে, যেন তাদের হাড় ভেঙে গেছে, কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের নাচিয়ে চলেছে। নাইমা তার পচা, হাড়বেরানো হাত দিয়ে রিনার বুকে টিপ দেয়, কিন্তু তার আঙুলগুলো রিনার পচা মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। কালো, পচা তরল ছড়িয়ে পড়ে, মেঝেতে পড়তেই সেটা হিসহিস শব্দে জ্বলে ওঠে, যেন অভিশপ্ত আগুন। রিনা হাসে, একটা গভীর, গর্জনের মতো হাসি, যেন তার ভেতরে কোনো ডেমন বাস করে। সে তার হাত নাইমার গুদের দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে শুধু পচা মাংস ঝরে পড়ে, একটা বীভৎস, পচা গন্ধে ঘর ভরে যায়। গন্ধটা এত তীব্র যে আমার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে, আমি বমি করতে চাই, কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ। তাদের ফাঁকা চোখ আমার দিকে তাকায়, আর তারা একসঙ্গে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই আমাদের সঙ্গে যোগ দে।” তাদের কণ্ঠ যেন আমার মাথার ভেতরে ছুরি চালাচ্ছে, প্রতিটি শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডে আঘাত করছে। ঘরের ছায়াগুলো নড়ে ওঠে, যেন অসংখ্য আত্মা আমার চারপাশে ঘুরছে।
আমি পিছিয়ে যেতে চাই, কিন্তু হঠাৎ মেঝে ফেটে একটা কালো, হাড়বিহীন হাত বেরিয়ে আসে। তার আঙুলগুলো অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, নখগুলো ধারালো, কালো, যেন শতাব্দীর পাপে মাখা। হাতটা আমার পা ধরে টানে, তার স্পর্শ এত ঠান্ডা যে আমার হাড় পর্যন্ত জমে যায়। আমি চিৎকার করি, “না! আমি এখানে থাকব না!” আমার কণ্ঠ ভেঙে যায়, আমার শ্বাস আটকে আসছে। আমি পা ছাড়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু হাতটা আরও শক্ত করে ধরে, তার নখ আমার চামড়ায় বিঁধে যায়। রক্ত ঝরে, কিন্তু রক্তটা লাল নয়—কালো, আঠালো, যেন আমার শরীর থেকে জীবন টেনে নিচ্ছে। মেঝে থেকে আরও কালো তরল বেরোচ্ছে, যেন রক্ত আর পচনের মিশ্রণ। তরলটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে, আর তার মধ্যে শরিফা, লতা, সুমনের মুখ ভেসে ওঠে, তাদের চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করছে, “আবীর, তুই আমাদের মেরেছিস।” আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি কি সত্যিই…?
ঘরের দেয়ালগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কাঠের ফ্রেমে ফাটল ধরছে, ফাটল থেকে কালো রক্ত ঝরছে, যেন বাংলোর শিরায় রক্ত বইছে। দেয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে, যেন অসংখ্য আত্মা আমার চারপাশে ঘুরছে, তাদের হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করি, কিন্তু আমার মনের ভেতরে তাদের ফিসফিস বাজছে: “আবীর, তুই পালাতে পারবি না।” আমার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, কিন্তু রিনা আর নাইমার পচা, বিকৃত রূপ স্পষ্ট। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের পায়ের নিচে মেঝে কাঁপছে, যেন বাংলো নিজেই তাদের আদেশ মানছে।
আমার পা আর নড়ছে না। আমার শরীর যেন অভিশপ্ত শক্তির কাছে হার মেনেছে। রিনা আর নাইমা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তাদের পচা হাত আমার শরীর ছুঁয়ে দেয়। রিনার আঙুলগুলো আমার কাঁধে বসে, তার নখ আমার চামড়ায় ঢুকে যায়, আর আমার শরীরে একটা ঠান্ডা, বীভৎস অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমার রক্ত যেন জমে যাচ্ছে, আমার হৃৎপিণ্ড ধীর হয়ে আসছে। নাইমা তার পচা মুখ আমার মুখের কাছে নিয়ে আসে, তার নিঃশ্বাস থেকে পচা মাংসের গন্ধ আমার নাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গন্ধটা এত তীব্র যে আমার চোখে জল চলে আসে। সে ফিসফিস করে বলে, “আবীর, তুই আমাদের মতো হয়ে যাবি। এই বাংলো তোর শেষ।” তার কণ্ঠে কোনো মানুষিকতা নেই, যেন কোনো প্রাচীন ডেমন তার ভেতর থেকে কথা বলছে।
আমি চিৎকার করতে চাই, কিন্তু আমার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। আমার শরীর কাঁপছে, আমার মন ভেঙে পড়ছে। আমি তাদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিই, কারণ আমার আর কোনো শক্তি নেই। তাদের পচা হাত আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে, যেন তারা আমার জীবনশক্তি চুষে নিচ্ছে। আমার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে, কিন্তু তাদের ফাঁকা চোখ আর পচা মুখ স্পষ্ট। আমার শরীর যেন তাদের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে, আমার মন যেন তাদের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রচণ্ড ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছে। আমার শরীর আর মনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ঘরের মাঝে রিনা আর নাইমার অমানুষিক নৃত্য, মেঝের কালো হাত, দেয়ালের ফিসফিস—সবকিছু আমাকে ঘিরে ধরছে। আমার মাথার ভেতরে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরছে: শরিফা, লতা, সুমনের মৃত্যুর পিছনে কে? রিনা কি সত্যিই খুনী? জঙ্গলে তার কথা—“তুই জানিস কে করেছে”—কী বোঝাতে চায়? নাইমার অশ্রু আর অভিযোগ—“তুই কেন আমাদের বাঁচাসনি?”—এর মানে কী? রোহানের সেই লাল চোখ, তার দিনলিপি, তার হাসি—সে কি এই অভিশাপের পিছনে? আর এই বাংলো—এটা কি শুধু একটা বাড়ি, নাকি কোনো প্রাচীন ডেমনের কারাগার? আমার মনে সেই পুরনো ছবির কথা ভেসে ওঠে—আমি, রিনা, নাইমা, শরিফা, লতা, হাবিব, মিলির মা, সুমন, কাজল, মিলি—শত বছর আগের ছবি। আমি কি সত্যিই তখন ছিলাম? নাকি এই বাংলো আমার মনকে নিয়ে খেলছে, আমাকে পাগল করে দিচ্ছে?
আমার শরীর আর সইতে পারছে না। আমার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি ঘরের মধ্যে জ্ঞান হারাই। আমার শরীর মেঝেতে পড়ে যায়, কিন্তু পড়ার আগে আমি শুনতে পাই একটা গভীর, অমানুষিক কণ্ঠ, যেন বাংলো নিজেই কথা বলছে: “আবীর, তুই এখন আমার।” আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়, আর আমি অন্ধকারে ডুবে যাই।