Thread Rating:
  • 11 Vote(s) - 2.64 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romantic Thriller শেষ ট্রেনের যাত্রী/ সমাপ্ত
#16
পর্ব ২

ট্রেনের জানালার কাচে একটানা বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। মায়া বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু মন তার হাজার মাইল দূরে। পাশের সিটে বসে থাকা লোকটি মাথা ঘুরিয়ে এক-আধবার তাকে দেখছে। অস্বাভাবিক নয়,তবে মায়া জানে, সে একজন অনুসন্ধানী মানুষ। হয়তো পেশায় সাংবাদিক, কিন্তু চোখ দুটো ঠিক গোয়েন্দার মতো কাজ করে—চুপচাপ পড়ে নিচ্ছে তার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি, চোখের অশান্তি, ঠোঁটের কম্পন। মায়া জানে তার অস্থিরতাই তাকে সন্দেহের তালিকায় তুলে দিয়েছে। “সত্যিই কি লোকটা তাকে সন্দেহ করছে?” নিজেকেই প্রশ্ন করে সে। উত্তর খুঁজে পায় না। বরং অস্থিরতা আরো বারে। মায়া শুনেছে মেয়েরা নাকি পুরুষদের মন পড়তে পারে! তবে সে কেন পারছে না?

–“ আপনি এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ঘামছেন? আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? মানে, আপনি ঠিক আছেন তো?”

বলতে বলতে আরিশ একটি রুমাল এগিয়ে দেয়। মায়া কিছুই না বলে বাঁ হাতে গ্রহণ করে এগিয়ে দেওয়া রুমালটি। মনে মনে বলে, “ না আমি ঠিক নেই! কোন কিছুই ঠিক নেই!” কপালের ঘাম  মুছে রুমালটি কোলের কাছে নামিয়ে আনা মাত্র হঠাৎ তার নিঃশ্বাস আটকে আসে।

সাদা কাপড়, লাল সুতোয় সূচিকর্ম। সেই পুরনো নকশা—তার নিজের হাতে তোলা ডিজাইন। হ্যাঁ সে! সেই ত বছর সাত আগে এই রুমালটা নিজে বানিয়েছিল। কিন্তু... নামটা! নামটা বদলে গেল কেন? “ মহামায়া ” সূক্ষ্মভাবে সেলাই করে লেখা, “কি-কিন্তু মায়া জানে, এই রুমালে সে লিখেছিল শুধুই "মায়া"

সে জিজ্ঞেস করল, গলা কাঁপিয়ে,–"এই রুমাল... তুমি কোথায় পেয়েছো?"

আরিশ মৃদু হেসে বলল,–"আমার মা দিয়েছিলেন। অনেক বছর আগে।"

মায়ার বুক ধক করে উঠল। তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগল,“এই রুমাল তো সে রুদ্রকে দিয়েছিল! তাহলে? সে আবার তাকায় সেই লেখার দিকে—"মহামায়া" — যেন “মায়া” কে ঘিরে একটা অভিশপ্ত ছায়া। না,মায়ার জীবনে ভগবানের কোন অস্তিত্ব বাকি নেই....নেই তার প্রতি কোন বিশ্বাস! তবুও সে ভাবে... পরক্ষণেই তার দৃষ্টি হয়ে আসে ঘোলাটে... মনে পর আজকের মতো অন্ধকার একটি রাত্রি, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যমুখী এক মধ্যবয়সী মহিলা,আর দরজার ভেতরে অসহায় একটি মেয়ের চিৎকার... কামের তাড়নায় পাগল প্রায় কতগুলো পুরুষ মানুষ – না নেকড়ে বাঘ! 

–“ চা খাবেন?” 

আরিশের ডাকে চমক ভাঙ্গে মায়ার। বোঝে নিজের অজান্তেই হাতের রুমাল সহ নিজেকে দুহাতে জড়িয়ে সে গুটিয়ে গেছে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। ভেতরের আবহাওয়ার উত্তাপও যেন হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নেমে গেছে অনেকটা।মায়া নিজেকে যেন সামলে নিতেই রুমালটা শক্ত করে ধরে, কিন্তু মনে হয় যেন সেটা নিজের হাতেই একটু একটু করে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

– "তুমি কে?" ফিসফিস করে সে বলে।

ছেলেটি কিছু বলে না। সে তাকিয়ে আছে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে। পেছনে ক্যান্টিন স্টাফ একজনকে চা দিচ্ছে । বোধহয় মায়ার ফিসফিস কথা আরিশ শোনেনি.... তাও ভালো! মায়া ভাবে, তবুও নিজের ক্ষণকালীন এই দূর্বলতায় লজ্জায় মাথা নত করে সে। আরিশ এবার মায়ার অনুমতি না নিয়েই স্টাফকে ডেকে বলে,

— “দুটি রং চা... আর শোনো! খাবারের কোন ব্যবস্থা হবে? খিচুড়ি কি ডাল ভাত?

মায়া চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু কারো কিছু বলার আগেই আরিশ একটা নোট স্টাফবয়ের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। চা এগিয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় বলে-

–“ ট্রেনের খাবার যদিও বিশেষ ভালো কিছু নয়, তাছাড়া বারোটার সময় সে কিছু পাওয়া যাবে তাই ত আশ্চর্যের।”

মায়া দৃষ্টিতে কাঠিন্য আনার চেষ্টা চালিয়ে হয় ব্যর্থ, জড়ানো গলায় বলে করে,

–“ এ- সবের প্রয়োজন ছিল না”

–“কি যে বলেন,আপনি অভুক্ত তা দেখেই বোঝা যায়...ও এক মিনিট!

বললেই ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে হয়ে ব্যাগ নামায়, পরক্ষণেই ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসে একটি নীল রঙের পাতলা চাদর। মায়াকে হতভম্ব করে দিয়ে আরিশ নিজেই সেটি জড়িয়ে দিয়ে বলে,

–“ এমন বৃষ্টি বাদলের দিনে ফিনফিনে শাড়ি পরে রাতে ট্রেন যাত্রা কে করে বলুন তো?”

মায়া রেগে যায় এবার–“ শোন তুমি অত্যন্ত গায়ে পড়া অসভ্য একটি ছেলে....”

মায়া শেষ না করেই থেমে যায়। উত্তেজিত হয়ে সে উঠে দাড়িয়ে ছিল। সবাই তাকিয়ে ছিল তার দিকে..... এতটাই জোড়ালো ছিল তার কথা যে দরজার পাশে বসে থাকা একটি লোক....বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল...সেও চোখ তুলে তাকায়। লজ্জিত মেয়েটি "ধপ" করে বসে পরে সিটে, গায়ের নীল চাদরটা দুহাতে আকড়ে যেন নিজেকেই লুকিয়ে নিতে চায় তার আড়ালে। তার খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে..সে নিজেও জানে না আজ হঠাৎ তার এমন হচ্ছে কেন? খেয়াল করে দেখে সে নিজেই কখন যেন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।


–“ আমি সত্যিই দুঃখিত! তবে আমি একটূ গায়ে পড়া হলেও বাজে লোক নই মোটেও... আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারেন... সত্যি বলছি!"

মায়ার বিশ্বাস হয়না এই লোকটি সাংবাদিক..... খানিকটা পাগলই মনে হয় যেন। সে আরিশের অনর্গল কথা বলা থামাতে কিছু বলতে চায়। কিন্তু তখনি আরিশের ফোনে বেজে ওঠে ধর্মীয় সংগীত— মোবাইলের রিংটোন। 

– “আসসালামু আলাইকুম। রাফি! বল কি বলবে?”

–“-------------”

–“ এই বিষয়ে আমি এখনো নিশ্চিত নই....ও আচ্ছা! আমি শুনছি বলে যাও”

–“------------”

–“ হা! হা!হা! সব কথা কিছু সময় বলা যায় না, রাফি। কিছু কথা কেবল নির্দিষ্ট মুহূর্তেই বলা যায়। ফোন রাখো, আগামী সপ্তাহে তোমার সাথে দেখা হচ্ছে।”


মায়া আরিশের কথা শুনতে শুনতে তাকিয়ে ছিল রুমালের লেখাটার দিকে,“মহামায়া” লেখাটা স্পষ্ট। 

– “আপনার তো এর অর্থ জানার কথা, ।। যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ।। দেবী দুর্গার টাইটেল নেইম”

মায়া অবাক হয়,মাথার ভেতরের সব কেমন জট পাকিয়ে যেতে শুরু করেছে। আরিশের মুখে আবার সেই হাসি।

–“ আমার ছেলেবেলাটা খানিক অদ্ভুত। আমার মা ছিলেন পশ্চিম বঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত *  পরিবারে মেয়ে। বাবা যদিও ব্যবসায়ী লোক, তবুও মা- বাবার সম্পর্ক যেন বামন হয়ে চাঁদে হাত বারানো.....”


মায়াকে কিছুই বলতে হয়নি। রুমাল হাতে নিয়ে সে শুধু অবাক হয়ে সবটা শুনছিল। মনে মনে ভাবছিল কতটা পাগলাটে লোক হলে অজানা অচেনা একটি মেয়েকে সামনে বসিয়ে এমন নিজের গুণগান করা সম্ভব! তবে শুনতে মন্দ লাগে না.. ছেলেটির কন্ঠস্বরের গম্ভীর্য যেন উদাও হয়ে এখন বেশ সহজ হয়ে এসেছে। নিজের অজান্তেই সহজ হয়ে এসেছে মায়াও। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই হয়তো সে বুঝতো আগে কখনোই তার এমন হয়নি। দীর্ঘদিন এই কাজে যুক্ত থেকে সে অনেক সতর্ক ও সচেতন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ!..আজ চারপাশে চোখ বুলালেই সে দেখতে পারতো ট্রেনের হালকা আলোতে কতগুলো চোখের দৃষ্টি শুধুমাত্র তাদেরই দিকে নিবদ্ধ!


ঘুম ভাঙলো ট্রেন থামার ঝাকিতে। সম্মুখে তাকিয়ে প্রথম চোখে পরলো আরিশ সেখানে নেই। ধুক করে কেঁপে উঠলো তার বুকের ভেতরটা। ব্যস্ত হয়ে ব্যাগ হাতরে দেখলো ভেতরটা। না, খামটা সেখানেই আছে, একই ভাবে পড়ে আছে ব্যাগে রাখা জিনিস গুলোর তলায়।আরিশের ব্যাগটাও রাখা এখন সিটের একপাশে। ট্রেনটা কিছু খালি। 

মায়ার শরীরটা যেন কেমন ভারি ভারি ঠেকছে। তবুও সে উঠে দাঁড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে খোঁজে আজ রাতের চেনা মুখানি। তবে খুঁজে পায় না। মাথাটা অল্প বথ্যা করছে,আবারও বসে পরে সে। মোবাইল স্ক্রিনে সময় ৪:১৮। বৃষ্টি থেমেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই একটি দৃশ্য চোখে পরে মায়ার।

না মায়া আর অবাক হয় না! তার অবাক হওয়া কেটে গিয়েছিল যখন ছেলেটা দুজনের জন্যে সাত প্যাকেটে খিচুড়ি অর্ডার করেছিল! তাই বরং একটুকরো হাসি খেলে যায় তার ঠোঁটে। ওদিকে আরিশ স্টেশনের এক প্রান্তে নিচু হয়ে বসে একটি নোংরা কুকুরকে খিচুড়ি খাওয়াছে..তার পাশেই একটু দূরে মাটিতে বসে দুটি ছোট ছোট ছেলে খাচ্ছে তৃপ্তি সহকারে।

– “ পাগলের কান্ড দেখ!"

পেছনে কেউ যেন বললো কথাটা।  মায়া নিজেও ভাবলো.... হ্যাঁ! পাগলই বটে, পরক্ষণেই আবারও চোখ গেল সেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলে দুটির দিকে। ওদের সাথে কোথাও কি মিল আছে মায়ার..মায়ার মনে পড়ে যায় একটি সন্ধ্যা — আজ থেকে বোধ হয় সাত বছর আগের।

তখন সে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবা-মা তখন প্রায় এক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। অনাথ মেয়ে,তাই হয়তো করুণা দেখিয়েই মায়ার মামা তাকে শহরে নিয়ে আসেন, আর মামি? তিনি যেন সবসময়ই চেয়েছেন মায়াকে নিচে নামাতে, দমিয়ে রাখতে। চোখে চোখ পড়লেই বলতেন, “তুই একটা বোঝা মায়া। একটাও কাজের না। তোর মা তোকে ঠিক মতো মানুষ করে যায়নি। শুধু রূপ থাকলেই হয় না,কাজও জানতে হয়।”

মামা ছিল মামির হাতে ধরা। তাই প্রথমদিকে রুদ্র ছিল মায়ার একমাত্র আশ্রয়। মামার এক পরিচিতের ছেলে, পাড়ার মাঠে খেলতে আসতো । চুপচাপ, পড়াশোনায় ভালো, তবে চোখে একটা অভিমানের ছায়া সবসময়।

রুদ্র আর মায়ার বন্ধুত্ব যেন নিজের ছায়ার মতো — খেয়াল না করেই দিনে দিনে ঘন হয়ে ওঠে। কলেজ ছুটির পর মাঝে মাঝে তারা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলত, কখনোবা কোনো চায়ের দোকানে বসে।

কিন্তু এই সম্পর্ককে প্রথমেই বাঁধা দেয় মায়ার মামি। একদিন সন্ধ্যায়, মায়া ঘরে ফিরতেই মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখে ড্রয়িং রুমে।

–“এই যে, এখনি এত! ছেলেমানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস! বজ্জাত লম্পট ছেলেদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেরাছিস!  তুই ভাবছিস আমি কিছু বুঝি না?”

–“কী বলছেন আপনি?” — হতবাক হয় মায়া।

–“ওই ছেলের সাথে দেখা করিস না বললাম! ছেলেটা ভালো না। তা ছাড়া, আমি ঠিক করেছি তোর বিয়ে এক মাসের মধ্যে দিয়ে দেব!”

মায়া কেঁদে ফেলে। কিন্তু ততদিনে মামি তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় রুদ্রের সঙ্গে। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়, কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

একটা সন্ধ্যায়, মামা যখন বাইরে, এক অপরিচিত ভদ্রমহিলা ঘরে এসে বসেন। মুখে মিষ্টি হাসি, হাতে দামি পারফিউমের গন্ধ, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। মামি বলেন, “এই খালামণি তোকে একটা চাকরির অফার দিতে এসেছে। খুব ভালো মাইনে। শুধু একটু মালামাল নিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাবি।”

মায়া তখন নরম মাটির মতো, অবুঝ, ভাঙা মন আর একাকিত্বে জর্জরিত। সে জানত না এই ‘মালামাল’ কী, জানত না সে কী নরকের দিকে পা বাড়াচ্ছে। 

প্রথমবার চট্টগ্রাম, তারপর খুলনা। একটার পর একটা কাজ। গাড়ির ভেতর, ট্রেনের ভিতরে, এমনকি একবার গর্ভবতী সেজেও এক প্যাকেট ওষুধ বহন করতে হয়েছিল, যেটা আদতে মাদক। তারপর ধীরে ধীরে তার মনবল ভেঙ্গে শুরু হয় শরীরের নোংরা খেলা....তখন সে বুঝে যায়, মামি-ই তাকে এই পথ দেখিয়ে দিয়েছে। সে যেন একটা পণ্য হয়ে গেছে — যার দাম ঠিক করে অন্যেরা।

ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে চলে। মায়া ফিরে আসে বর্তমানে। ব্যাগ হাতে উঠে দাড়ায় সে। আরিশ এসে বসেছে কখন মায়া টের পায়নি। সে সেদিকে তাকাতেও চায় না...তার কেমন যেন লাগছে হঠাৎ — মাথা ঘুরছে, শরীরের অভ্যন্তরে প্রবল এক ঘৃণা যেন সব কিছু মুচড়ে উঠে আসতে চাইছে। এমন সময় ট্রেনের গতি বাড়ছে, হঠাৎই একটা মোড়। বেসামাল মায়ার পক্ষে এই ঝাঁকি সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পরে... ভারসাম্য হারায় সে।

আরিশ  কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাল ফিনফিনে  শাড়ি পড়া মেয়েটি তার ওপর প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে যেন। পরক্ষণেই মায়ার চেতনা নড়ে ওঠে। দ্রুত নিজেকে সামলাতে গিয়ে নিজের হাত আরিশের কাঁধে রেখে উঠে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু সেই তাড়াহুড়োয় তার ব্যাগটি আটকে গেছে কিছুতে... হলকা শরীরটা  চেপে বসেছে আবারও।

মোলায়েম রেশমের ব্লাউজের নিচে কোমল স্তনের স্পর্শ—নিতান্তই এক দুর্ঘটনার অপ্রস্তুত পরিণতি। স্পর্শটা ছিল না কামনার, বরং হতবুদ্ধি এক অসংলগ্নতায় মোড়ানো। কিন্তু নিঃশ্বাস যেন থেমে গেছে মায়ার। দু জোড়া দৃষ্টির ধাক্কাই নয়... যেন সবেগে  নাড়া দিয়েছে কেউ হৃদপিন্ডে! 

তারপর এক মুহূর্ত— যেন চোখের নিমেষেই আরিশের একটি বলিষ্ঠ হাত চেপে বসে মায়ার কোমরে... এক প্রবল ঝাঁকির পর মায়া নিজেকে আবিষ্কার করে ট্রেনের সিটে শায়িতা অবস্থায়। আরিশ তার পাশেই মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসেছে...মুখে তার একরাশ উৎকন্ঠা... কিন্তু কেন? মায়া ত তার আপন কেউ নয়!

– “আপনি ঠিক আছেন ত?”

আরিশের হাতখানি এখনো মায়ার কোমরে.... লম্বা আঙুল গুলো যেন নিজেদের অধিকার করা জায়গায় দখল নিতে চেপে বসেছে লাল শাড়িটার ওপড় দিয়ে। মায়া কিছু বলতে চায়...পাতলা ঠোঁট দুটো মৃদ কেঁপে ওঠে, কিন্তু মুখের কথা আঠকে গেছে কন্ঠনালীতেই...চোখ নামিয়ে নেয় সে.. আরিশ হঠাৎ বুঝতে পারে যেন,হাত সরিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ভাবে বলে,

–  "আমি... আমি দুঃখিত!" 


মায়ার ওঠার প্রয়োজন, তবুও উঠে দাড়াতে ইচ্ছে হয় না তার।আরিশ আলতো ভাবে হাত ছোঁয়ায় মায়ার কপালে! তৎক্ষণাৎ চোখের পাতা দুটি মেলে তাকায় মায়া। নিঃশ্বাস তার ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে উঠছে নামছে ভাড়ি বুক....পাতলা শাড়ি ও লাল ব্লাউজ খানি মেয়েটার লজ্জা ঢাকার বদলে আরো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরেছে।


আরিশের কপালে ভাঁজ পড়ে— মায়ার দেহে হালকা জ্বরের আভাস,চোখে ভয়ের। তবুও ছেলেটি তার হাত থেকে ব্যাগটা নেবার সময় সে বাধা দিতে পারে না,“ওই ব্যাগেই ত খামটা...যদি...যদি..” আর ভাবতে পারে না মায়া, শুধু আবারও কানে লাগে আরিশের কন্ঠস্বর,

– “ এটা খেয়ে নিন”

মায়ার ঠোঁটে কাছে কিছু একটা তুলে ধরেছে আরিশ।

– “ জ্বর আসছে বুঝি?”– মায়ার ক্লান্ত কন্ঠস্বর ।

– “ খুব বেশি না, কিন্তু এখনই কিছু না করলে বেড়ে যাবে।"

গলার স্বরটা কেমন আবেগ মাখানো মিষ্টি শোনায় মায়ার কানে...মনে হয় যেন বহুকাল কেউ এমন আদর করে কোন কথা বলেনি মায়াকে। সে আপত্তি জানায় না। ওষুধ খাওয়ানো পর আরিশ মায়াকে নিজে নিয়ে যায় বাথরুমে।

ফিরে এসে তাকে সিটে বসিয়ে নীল চাদরটা ভালো মতো জড়িয়ে দেয় গায়ে। পাশে বসতেই মায়া না জানি কেন আরিশের কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়। শুধু একবার ক্লান্ত দু'চোখের দৃষ্টি পরে অপর পাশের সিটে রুদ্রর উপহার দেওয়া পুরোনো ব্যাগটা..... তারপর শুধু অনুভব— ট্রেন চলছে, সামনে গন্তব্য এখনো অনেকটা দূর!


যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥


Like Reply


Messages In This Thread
RE: শেষ ট্রেনের যাত্রী / ছোট গল্প - by কালপুরুষ - 09-06-2025, 11:24 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)