08-06-2025, 07:06 AM
(This post was last modified: 08-06-2025, 09:45 PM by কালপুরুষ. Edited 8 times in total. Edited 8 times in total.)
পর্ব ১
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন। রাত ১১টা। দিনের শোরগোল এখন ধীরে ধীরে স্তব্ধ হচ্ছে, কিন্তু নিস্তব্ধতা এখানে যেন অন্যরকম। কেবলমাত্র হালকা হালকা ঘোষণা আর কিছু দূর থেকে ভেসে আসা হকারের ক্লান্ত কণ্ঠ। বাতাস ভারী, ধোঁয়ায় মিশে থাকা ট্রেনের জ্বালানি আর পুরনো কাঠের গন্ধ।
লং শর্ট ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলে প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৪-এর একটি বেঞ্চে বসে আছে মেয়েটি। ঈগল যেমন হাজার ফুট ওপরের থেকেও শিকার ভুল করে না, তেমনি আরিশও নির্ভুলভাবে বুঝে ফেলল, কার সঙ্গে তার খেলা শুরু হয়েছে!
প্ল্যাটফর্মের উজ্জ্বল আলো নিচে বসেছিল মায়া। একা। হালকা লাল শাড়ির আড়ালে তার ত্বকের দীপ্তি যেন বৈদ্যুতিক আলোকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছিল। বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়েছিল কাঁধের ওপর, তার কপালের টিপ যেন এক তীক্ষ্ণ নির্ভরতার প্রতীক। তার চোখে ছিল এক ধরনের উদাসী ঝিলিক, যেন হাজারো অচেনা গল্পের আমন্ত্রণ। বসার ভঙ্গিতেই ছিল এক অলক্ষ্য দম্ভ—সে জানে, তাকিয়ে থাকবে সবাই, কিন্তু সে তাকাবে না কারো দিকে।
আরো কাছে এগিয়ে যেতেই এত উজ্জ্বলতার মাঝে কাঁধের পুরনো ব্যাগটি লাগে বড্ডো বেমানান। এক কৃত্রিম দম্ভ নিয়ে বসে থাকা নিষ্প্রভ মুখটি আরিশের চোখ এড়িয়ে যায় না। অন্য কারো চোখে ধরা না পড়লেও; আরিশের সতর্ক দৃষ্টিতে ঠিকই মেকআপ ভেদ করে মেয়েটির চোখে অনেক রাতের ঘুমহীন ক্লান্তি ধরা পড়ে।
মেয়েটি একভাবে তাকিয়ে আছে রেললাইনের দিকে। কেউ হটাৎ তাকালে বুঝতে পারবে না সে চিন্তিত, না কি এই ভাব ভয়ের ছায়া — কারণ তার চেহারায় এমন এক নির্লিপ্ততা, যা হয়তো কেবল দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত মানুষ অর্জন করতে পারে। আরিশ আর একবার নিজের মনে ভাবে সবটা, প্রথমটায় বিশ্বাস না করলেও সব জানার পর তার মনে দোলা দিয়েছে সন্দেহ। তা না হলে কোন মেয়ের রূপে ভুলে ভরকে যাওয়া আরিশের স্বভাবসিদ্ধ নয়!
মায়া আজকের ‘কাজে’ এসেছে। কাজ? না, এটি কোনো চাকরি নয়, নয় কোনো সম্মানজনক দায়িত্ব। এটা তার কাঁধে চাপানো, অন্যদের হাতে সাজানো এক ঘৃণিত বোঝা। ছোট্ট একটি খামে কী আছে তা সে জানে না, জানতে চায়ও না। শুধু জানে, খামটি তাকে পৌঁছে দিতে হবে সীমান্তের এক স্টেশনে — ঠিক সময়ে, ঠিক ব্যক্তির হাতে।পাশে রাখা ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খামের অস্তিত্ব টের পায় সে। যেন নিজের ভেতরেই কোনো বোমা লুকিয়ে আছে, যা একটু এদিক ওদিক হলেই ফেটে যাবে। এমন সময় ডান পাশ থেকে হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর তার কাঁধের কাছে ভেসে আসে —
– “আপনার পাশে বসতে পারি?”
মায়া চমকে তাকায়। চোখের সামনে একজন যুবক। লম্বাটে ফিটফাট দেহে কালো টিশার্ট, ডেনিম জিন্স আর চোখে সোনালী ফ্রেমের হালকা চশমা। মুখে এমন এক ধরনের আত্মবিশ্বাস আর হাসি, যা সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে — বন্ধু না শত্রু, বোঝা যায় না।
– “আপনি?” — মায়া একটু কুণ্ঠিত।
– ও হাই! আমি আরিশ। আপনাকে এই রাত্রিতে বড্ডো একা দেখাছিল। ভাবলাম পাশে একটু বসি। এই শেষ ট্রেন তো এমনিতেই লম্বা যাত্রা, তার ওপরে ট্রেন লেইট। সঙ্গী দরকার।
মায়া কিছু বলে না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। নাম বলল, কিন্তু পরিচয় দিল না। খুব স্বাভাবিক লাগছে, আবার একদমই স্বাভাবিক না। মনে মনে ভাবে সে– উঠে চলে গেলে হয় না? না! ওটা অসভ্যতা, কিন্তু.....! মায়ার ভাবনার মাঝে আরিশ ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে একটা চুমুক দেয়। তারপর বলে,
– “আমি সাংবাদিক। একটা অনুসন্ধানে বের হয়েছি। আপনি হয়তো ভাবছেন, এই রাতে এ আবার কোন আপদ! তাই আগেই বলে দিলাম,আমাকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই কিন্তু।”
মায়া মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। সে ভয় পেয়েছে! সাংবাদিক? মানে... পুলিশও হতে পারে? না, সে তো ইউনিফর্মে নেই। কিংবা... চক্রের কেউ? তাকে পরীক্ষা করতে এসেছে?
–“আপনার নাম কী?” — আবার প্রশ্ন।
“মায়া।” — উত্তর দেয় সে, ঠোঁট শক্ত করে।
“চমৎকার নাম। একটু গল্প করলে কী খুব ক্ষতি হবে?”
মায়া ঘাড় নাড়ে বলে।– “আমার গল্প খুব একটা আকর্ষণীয় না। বরং আপনি বলুন, কী অনুসন্ধান করছেন?”
ছেলেটা একটু থামে, কিন্তু মায়ার দিকে তাকায় না, দূরের অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে খানিক পরেই সে বলে,
– “চোরাচালান। সীমান্ত পেরিয়ে যে মাল যায়, মানুষ যায়, নারীরাও... আমি এসব নিয়েই কাজ করি। কিছু তথ্য আছে আমার কাছে, শুধু সেগুলো মিলিয়ে নিতে চাই।”
এইবার মায়ার মুখে কিছু একটা নড়েচড়ে ওঠে। তার ভেতরে অস্থিরতা বাড়ে। মনে হয় বুকের অস্বাভাবিক উঠানামার শব্দ ছেলেটা শুনছে স্পষ্ট? যদিও অবান্তর ভাবনা, তবুও ভাবে – সে কি কিছু ধরে ফেলেছে? না কি সে সত্যিই জানে না?
আরিশ আবার বলে, “শুনেছি, আজকের শেষ ট্রেনেই একটা বড় চালান যাচ্ছে। কেউ একজন এটা বহন করছে। শুধু ঠিক লোকটা খুঁজে পেলেই আমি অনেক এগোতে পারবো।”
কথা শেষ করেই মায়ার দিকে তাকায় সে,তারপর আবার সেই শান্ত কন্ঠে বলে— দেশলাই হবে আপনার কাছে! স্মোক করেন আপনি?
মায়া তাকিয়ে থাকে তার চোখে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, সে সব জানে। আবার মনে হয়, সবটাই যেন নাটক। ছেলেটা দিকে দৃষ্টি রেখেই মায়া ব্যাগ থেকে বের করে দেশলাই। এগিয়ে দেয় সামনে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দেশলাই হাতে নেয়,তারপর সিগারেটের প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে প্যাকেট রাখে দুজনের মাঝে। মায়ার দৃষ্টি নেমে আসে সিগারেটের প্যাকেটে ...তাতে লেখা, “ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” ছেলেটি এবার দ্বিতীয় সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলে,
– “ স্টার!..চলে?
মায়া হয়তো কিছু বলতো,তার [b]মুখের ভীতু ভাব—লাল রঙে রাঙানো পাতলা ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে অল্প কেঁপে ওঠে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে স্টেশনে মাইকে ঘোষণা আসে,“শেষ ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ৪-এ আসছে।”[/b]
দুজনের দৃষ্টি ঘুরে যার। রেলের শব্দ ধীরে ধীরে জোরে শোনা যাচ্ছে। ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে। মায়ার শরীরটা কেঁপে ওঠে। ব্যাগটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। আরিশ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে,
– “ আপনি বোধহয় আমার ব্যবহারে ঘাবড়ে গিয়েছেন। শুনুন! এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই,আপনি যদি জানেন আপনি ঠিক পথে আছেন, তাহলে কোনো বিপদই আপনাকে ছুঁতে পারবে না।”
–“আপনি কী জানেন আমি কোন পথে আছি?”
মায়া কেমন যেন অস্থিরতায় হঠাৎ বলে ফেলে কথাটা। আরিশ মুখ ফিরিয়ে চুপ করে চেয়ে থাকে ধীর গতিতে স্টেশনে ঢোকা ট্রেনের দিকে,তারপর যে ছেলেটি মায়ার দিকে ফিরে তাকায়, তার চোখে এখন আর আগের রসিকতা নেই। সেখানে এক ধরনের দৃঢ়তা, এমনকি মায়া সেটাতে কিছুটা আশ্বাসও খুঁজে পায় যেন। এক নিঃশব্দ আশ্বাস। তবে পরক্ষণেই ছেলেটির মুখে যেন ফুটে ওঠে কৌতুক। অল্প হেসে সে বলে,
– “ জানি না,তবে যদি পরবর্তী স্টেশন হয়,তবে এই ট্রেনে আপনার না ওঠাই ভালো। ওই স্টেশনে এই গাড়ি থামে না।”
এক তীব্র বিরক্তিতে মায়া চোখ নামায়। সিগারেট প্যাকেটের ওপর থেকে হাতে তুলে নেয় ছেলেটির রাখা সিগারেট। ট্রেন এসে থামে। দরজা খুলে যায়। যাত্রীরা নেমে আসে, ওঠে নতুন যাত্রীরা। সিগারেট ধরিয়ে মায়া এগিয়ে যায় ব্যাগ হাতে। ছেলেটিও দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। বোধহয় সবাই উঠে যাওয়ার অপেক্ষায়।
–“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” — আরিশ প্রশ্ন করে মায়া গাড়িতে ওঠার আগে। মায়াও ঘার ঘুরিয়ে উত্তর করে নির্দ্বিধায়।
–“নিশ্চয়ই যেখানে আপনি যাচ্ছেন না,” — বলেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে দেয়।
আরিশ হেসে বলে,– “হুম, দেখা যাক কে কার গন্তব্যে পৌঁছয়। ট্রেনে উঠি?”
দুজনেই উঠে পড়ে ট্রেনে। ট্রেনের ভিতরে আলো হালকা, জানালার কাঁচে রাতের অন্ধকার ধুয়ে যাচ্ছে। যাত্রীরা নিজেদের আসনে বসছে, কেউ ফোনে কথা বলছে, কেউ জানালার বাইরে তাকিয়ে — কেউ ভাবছে কীভাবে পালাবে, কেউ ভাবছে কোথায় যাবে।
মায়া নিজের সিটে বসে জানালার দিকে মুখ ফেরায়। মনে মনে ভাবে, সে এই ট্রেনে না উঠে যদি চলে যেত... যদি কখনো এই চক্রে না জড়াতো... যদি মামি তাকে রুদ্রের সাথে থাকতে দিত... তাহলে কি আজ সে এই পথে থাকতো?
হ্যাঁ, রুদ্র। নামটা মনে পড়লেই একটা চাপা কষ্ট বুকের মধ্যে পাথরের মতো জমে যায়। সে চেয়েছিল পালাতে, চেয়েছিল নিজের জীবন গড়তে — কিন্তু মামি সব শেষ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এমনভাবে বুঝিয়েছিল যে সে নিজেই ভুল পথে হেঁটে এসেছে।
“কখনো কি মনে হয়েছে পালিয়ে যেতে?” — হঠাৎ আরিশ বলে ওঠে।
মায়া চমকে তাকায়। এই লোকটা কি তার মনের ভেতরে পড়তে পারে? আরিশ ব্যাগ রাখতে রাখতে আবার বলে,
– “দরজার সামনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না, বৃষ্টি শুরু হয়েছে.....জানেন এই কাজটা নেওয়ার আগে ভেবেছিলাম কাজ ছেড়ে পালাবো! আমার মাঝে মধ্যেই সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে ......”
এতো চিন্তার মাঝেও ময়ার এবার অল্প হাসি পায়। সে উত্তর দেয় না।
শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বাইরে অন্ধকারের ভেতর ট্রেন চলতে শুরু করে যান্ত্রিক শব্দের ছন্দে...
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ ॥


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)