04-06-2025, 05:27 AM
(This post was last modified: 04-06-2025, 05:36 AM by ABC06. Edited 4 times in total. Edited 4 times in total.)
।।৩।।
চিংড়িহাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে বারবার বেলেঘাটার দিকের রাস্তাটায় তাকাচ্ছিল বিদিশা। দিনের ব্যস্ততম সময় এখন, একটার পর একটা অটো প্যাসেঞ্জার ভর্তি করে গন্তব্যের পথে চলে যাচ্ছে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে সেখানে ও একটার পর একটা অটো ছেড়ে দিচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে এপাশে তাকিয়ে বিদিশা দেখল ওর সামনে আরেকটা অটো এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের ভিড়ও কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে, লাইনে ওর সামনে মাত্র দুজন, ঠোঁটটা টিপে বিদিশা লাইনে ওর পেছনের লোকগুলোকে জায়গা ছেড়ে দিল।
"আজ আসবে না নাকি ?", নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে সে। অস্থিরতা, বিরক্তি আর ধৈর্য্যের অভাব ওর মনে মিলেমিশে গিয়ে রাগের জন্ম দিয়েছে। সেই রাগ এখন বাষ্পের মতো ওর চিন্তাভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
"বাড়ি থেকে বাসে ধরে কলেজ মোড়ে এসে নামলেই হতো, এভাবে চিংড়িহাটার মোড়ে নেমে অটো ধরার দরকার ছিল না" ক্ষুব্ধ মনে চিন্তা করতে করতে বিদিশা অস্থির হয়ে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে আর ওদিকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে থাকে।
একটু পরে তার দেরি করার মূর্তিমান 'কারণ'কে বেলেঘাটার দিক থেকে রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসতে দেখে বিদিশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একমুহুর্তে এতক্ষণের রাগ গলে জল হয়ে যায়। পরের মুহুর্তেই আবার ওর মুখটা ভাবলেশহীন হয়ে যায়। যে মেয়ে গত আধঘন্টা নিজের মনে রাগে বিড়বিড় করছিল সেই যদি এখন নিজের মনে কোন কারণ ছাড়া হেসে চলে, তাহলে রাস্তায় লোকজন ওকে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবে।
সুদীর্ঘ উচ্চতার অধিকারী ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি লম্বা লম্বা পা ফেলে অটোর লাইনে ঢুকে পড়ে। ততক্ষণে ভিড় আরো কমে এসেছে।
সামনে আরেকটা খালি অটো এসে দাঁড়াতেই জায়গা পেয়ে গেল ওরা দুজন। বিদিশা পেল পিছনের সিট আর ছেলেটা পেল তার পাশে বাইরের দিকে বসার জায়গাটা।
"আমায় দরজার পাশের সিটটা দিন প্লিজ।" বিদিশা যতবার তার সুদর্শন সহযাত্রীকে এরকম অনুরোধ করেছে কোনবার প্রত্যাখ্যাত হয়নি। এবারও হল না, একটু মুচকি হাসি আর তারপর সিট বদল।
"আজ একটু দেরি হয়ে গেল না ?" বসতে বসতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল বিদিশা।
"ট্রেন লেট। তার উপর আজকে ভ্যানে করে স্টেশনে আসতে হয়েছে।" পাশ থেকে সংক্ষিপ্ত জবাব এল।
"এঁদো গাঁয়ের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা, আমরা শহুরে মানুষরা বুঝব না এসব।" ঠেস দিয়ে কথাটা বলল বটে কিন্তু বিদিশার চোখেমুখে দুষ্টুমির ঝিলিক। সেটা বুঝতে পেরে ওর সহযাত্রী মৃদু হাসল।
"আপনারও তো দেরি হয়ে গেছে দেখছি।"
"হ্যাঁ, আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।", সত্যিটা চেপে গিয়ে নির্ভেজাল মিথ্যে বলল বিদিশা।
"দেরি হয়ে গেলে ক্লাস মিস হয়ে যাবে না ?"
"না, ঠিকসময়ে কলেজে ঢুকে যাব। বাদ দিন ওসব, আপনি কোনদিন নিকোপার্কে গেছেন অরুণাভবাবু ?"
"কেন বলুন তো ?"
"এমনি। বলুন না ?" সে কথা না বললে তার পাশের স্বল্পভাষী সহযাত্রী যে চুপ করে থাকবে, আগের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা খুব ভাল করে জানে বিদিশা, ও তাই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে চায়।
"না, সুযোগ হয়নি।" একটু নীরবতার পর পাশ থেকে উত্তর আসে।
ওদের কথার ফাঁকে অটো নিকো পার্ক পার করে যায়, বিদিশা সেদিকে চেয়ে থাকে। ওর মাথার চুল উড়ে এসে অরুণাভর মুখে লাগে, বিদিশার চুলে একটা সুন্দর গন্ধ আছে। কিসের গন্ধ সেটা প্রাণপণ মনে করার চেষ্টা করে অরুণাভ। মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই নীরবতা কাটায়।
"কি দেখছেন?" পাশ থেকে গলার আওয়াজে সম্বিত ফেরে বিদিশার। এখানে যে মাঝে মাঝে এক্সের সাথে আসত, সেটা একবার ও কথায় কথায় বলে ফেলেছিল।
মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "কিছু না। আচ্ছা আপনি কি খেতে ভালবাসেন বলুন তো অরুণাভবাবু ?"
আচমকা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অরুণাভ। সামলে নিয়ে উত্তর দিল, "সে অনেক কিছু। বেশ বড়ো লিস্ট।"
"তবু শুনি।" বিদিশার গলায় আবদারের সুর।
"বিরিয়ানি, মটন, ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারি..."
"আচ্ছা, বাদ দিন। আপনি চাউমিন খান ?"
"মাঝে মাঝে খাই।"
"এখন ট্রাই করবেন ?"
"মানে ?" হকচকিয়ে যায় অরুণাভ।
ততক্ষণে ব্যাগ থেকে একটা টিফিন কৌটো বার করে ফেলেছে বিদিশা। ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর দিকে টিফিন কৌটোটা এগিয়ে দেয়।
"কাল বাড়িতে ট্রাই করলাম। খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে ?"
কাঁটা চামচ দিয়ে কিছুটা মুখে দিল অরুণাভ। অনেকদিন চাউমিন কেন, কোন ফাস্ট ফুডই খাওয়া হয়না। নিমাইদার বারণ বারবার মনে এসে বাধার প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল অরুণাভ।
"দারুণ ! আপনি এত ভালো রান্না জানেন আগে বলেননি তো ?"
ও আর কি করে জানবে বিদিশা রান্নার 'র'ও জানে না। শুধু ওকে চমকে দেবে বলে ইউটিউব ঘেঁটে, মাকে বিরক্ত করে কত কসরত করে এটা বানিয়েছে। আজ অরুণাভর সঙ্গে দেখা না হলে বিদিশা কি করত কে জানে ?
"আজকে ফেরা কখন ?"
"ঠিক নেই, আশা করছি পাঁচটা নাগাদ।" একগোছা চাউমিন গলার্ধকরণ করতে করতে উত্তর দেয় অরুণাভ।
"আমারও ওইরকম হবে। আপনার আগে হয়ে গেলে অটোতে জায়গা করে রাখবেন কিন্তু।" হাসতে হাসতে বলে বিদিশা।
"কিন্তু যোগাযোগ হবে কি করে ?" অরুণাভর প্রশ্নে কৌতূহল আর দুষ্টুমি দুটোরই ছাপ রয়েছে।
"আপনার নম্বরটা দিয়ে দিন, আমি কনট্যাক্ট করে নেব।"
অরুণাভ নম্বর বলতে থাকে, "৬২৯০..."
"আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, আগে ফোনটা বের করতে দিন। আপনি অমন ফটাফট নম্বর বলে গেলে থোড়াই আমার মনে থাকবে ?"
উত্তরে ক্যাবলার মতো হেসে ফেলে অরুণাভ। একটা অচেনা মেয়ের সামনে এই ক্যাবলামোর জন্য ওর লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। অরুণাভ আবিষ্কার করল ও একটুও লজ্জা পাচ্ছে না, বরং আনন্দে ওর মন ভরে আছে। এই আনন্দ কোথা থেকে এল, কেন এল তার কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। আজকাল ওর হচ্ছেটা কি ?
"কি মশাই, নম্বরটা বলুন ?" বিদিশার প্রশ্নে হুঁশ ফেরে ওর।
নম্বরটা বলতে বলতেই অটো স্ট্যান্ডে এসে থামে।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করে অটোওয়ালাকে দুজনের ভাড়া মেটাতে বলে অরুণাভ।
"এটা কী হল ? আপনি কি আমার চাউমিনের দাম মিটিয়ে দিলেন ?"
বিদিশার রাগটা আসল না নকল বুঝতে পারে না অরুণাভ। নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তার শূন্যের কোঠায়। একটু থতমত খেয়ে বলে "না কোথায় ? এখনও খেয়ে শেষ করে উঠতে পারিনি তো।"
"লাঞ্চে ওটা শেষ করে ফেরার সময় আমায় টিফিন কৌটোটা ফেরত দিয়ে যাবেন।", বিদিশার গলায় আদেশের সুর। ওর রাগটা যে কপট সেটা বুঝতে পেরে অরুণাভর মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ে।
ফট করে পাল্টা জবাব ছুঁড়ে দেয় সে, "ভালোলাগাকে দাম দিয়ে বিচার করা যায় না ম্যাডাম।" উত্তরের অপেক্ষা না করে কলেজ মোড়ের রাস্তাটা পেরিয়ে যায় অরুণাভ।
সেদিকে তাকিয়ে বিদিশা নিজের মনে প্রিয় হিন্দি গানের কলি গুনগুন করে গেয়ে উঠল। অরুণাভর যে ওর রান্নাটা ভালো লেগেছে, এটা জেনেই ওর ইচ্ছা করছে এক্ষুণি ছুটে কোন খোলা মাঠে গিয়ে সেখানে আনন্দে চিৎকার করতে করতে গোটা মাঠ দৌড়ে বেড়াতে।
শহরের আধুনিকা মেয়ে সে, পুরুষসঙ্গে মোটেই অনভিজ্ঞ নয়। কিন্তু, অরুণাভর কাছে এলে ও আজকাল নিজের মধ্যে থাকে না। এই যে কাল সারাদিন ইউটিউব ঘেঁটে, মাকে পাগল করে দিয়ে আজ ওর জন্য চাউমিন বানিয়ে আনল, এর আগে ও নিজের কোন বয়ফ্রেন্ডের জন্য এমনটা করেনি। মাত্র মাস তিনেকের পরিচয়, অথচ এর মধ্যেই অরুণাভ ওর মনে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ওর কথা চিন্তা করলে বিদিশার মনে খুশির আলোড়ন ওঠে, সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই যে এখন পাগলামিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা ভালোবাসা কিনা বিদিশা জানে না তবে এই অনুভূতি ও এর আগে কখনো অনুভব করেনি।
**********************************************************
আজ অফিসে কাজের চাপ একটু কম থাকায় লাঞ্চটাইমে ইন্টারনেট স্ক্রল করছিল অরুণাভ। অন্যদিন এইসময়েও ফাইল নিয়ে বসতে হয়। তখনই ফোনে রিংটোন বেজে উঠল - অচেনা নম্বর। ধরতেই ওপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠ - "লাঞ্চ হল আপনার ?"
গলার স্বরটা চেনা, আজ সকালেই তার মালিকের সাথে বিস্তর কথা হয়েছে। কিন্তু, উত্তর দিতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে যায়, "হ্যাঁ, এই জাস্ট, আপনি লাঞ্চ করেছেন ?"
"হ্যাঁ, এই তো শেষ করে উঠলাম। যাক গে, এই নম্বরটা আমার, চাইলে সেভ করে নিতে পারেন।"
"কি নামে সেভ করব ?"
"বিদিশা লাহিড়ী। তাহলে আজকে পাঁচটার সময় দেখা হচ্ছে তো ?"
"অ্যাঁ ! হ্যাঁ, অবশ্যই।"
"তাহলে অটো স্ট্যান্ডে দেখা হচ্ছে। আপনি জায়গা রাখবেন কিন্তু। দেরি হলে একটা টেক্সট করে দেবেন, কেমন ?" উল্টোদিক থেকে ভেসে আসছে অনর্গল কথার স্রোত।
"ওকে।"
"রাখছি এখন।", ফোন কেটে যায় কিন্তু অরুণাভর জড়তা কাটে না। আজ ওর হঠাৎ কি হল কে জানে ?
**********************************************************
"এইজন্য তুই লাস্ট তিনমাস ধরে অটো ধরে কলেজে আসছিস ! ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস আর নিজের বন্ধুদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না ?"
উল্টোদিকে ফোনটা নামিয়ে রাখতেই বিদিশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রেয়া। বিদিশার মুখে একটা অসন্তোষের ছায়া পড়লেও সেটাকে গ্রাহ্য করে না সে।
"নিজের চরকায় তেল দে। যখন রোহনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াস তখন আমি দেখতে যাই ?" ঝাঁঝিয়ে ওঠে বিদিশা।
"এই রাগ করিস না, প্লিজ।", পাশ থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করে শ্বেতা। বিদিশা মুখ শক্ত করে বসে থাকে, ও একটুও আলগা দিতে চায় না। কিন্তু, শেষে বন্ধুদের ঝুলোঝুলিতে ওকে নরম হতেই হয়। মোবাইলে অরুণাভর নম্বরে ওর যে প্রোফাইল পিকচারটা সেভ করেছিল সেটা দেখায় সে। অরুণাভর অজান্তেই একদিন দূর থেকে ছবিটা তুলেছিল ও।
"এত পুরো হ্যান্ডু মাল রে !" উচ্ছ্বসিত শ্রেয়া।
"আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।" ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে শ্বেতা।
খুব একটা অবাক হয় না বিদিশা, "সেক্টর ফাইভে আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে, হয়তো কখনও দেখে থাকবি।"
"তাই হবে।"
"কি নাম ?" জানতে চায় শ্রেয়া।
"অরুণাভ।"
"বাঙালি ? তুই আজকাল বাঙালি ছেলেদের ডেট করছিস ?" শ্রেয়ার গলার অবাক স্বরটা নজর এড়ায় না বিদিশার।
"কেন আমি কখনো বলেছি যে বাঙালি ছেলেদের ডেট করব না ?" রক্ষণাত্মক স্বরে বলে ওঠে বিদিশা। অরুণাভর সঙ্গে সম্পর্কটা যে ডেটিং অবধি পৌঁছায়নি সেটা ও জানাতে চায় না।
"তোর লাস্ট বাঙালি বিএফ কে ?" প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে চোখ টেপে শ্রেয়া, "বাই দ্য ওয়ে, মোহিত এখনও তোর জন্য পাগল।"
অস্বস্তিতে শরীর কাঠ হয়ে যায় বিদিশার। কথাটার উত্তর দেবার কোন প্রয়োজন মনে করে না সে।
চিংড়িহাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে বারবার বেলেঘাটার দিকের রাস্তাটায় তাকাচ্ছিল বিদিশা। দিনের ব্যস্ততম সময় এখন, একটার পর একটা অটো প্যাসেঞ্জার ভর্তি করে গন্তব্যের পথে চলে যাচ্ছে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবে সেখানে ও একটার পর একটা অটো ছেড়ে দিচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে এপাশে তাকিয়ে বিদিশা দেখল ওর সামনে আরেকটা অটো এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের ভিড়ও কিছুটা পাতলা হয়ে গেছে, লাইনে ওর সামনে মাত্র দুজন, ঠোঁটটা টিপে বিদিশা লাইনে ওর পেছনের লোকগুলোকে জায়গা ছেড়ে দিল।
"আজ আসবে না নাকি ?", নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে সে। অস্থিরতা, বিরক্তি আর ধৈর্য্যের অভাব ওর মনে মিলেমিশে গিয়ে রাগের জন্ম দিয়েছে। সেই রাগ এখন বাষ্পের মতো ওর চিন্তাভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
"বাড়ি থেকে বাসে ধরে কলেজ মোড়ে এসে নামলেই হতো, এভাবে চিংড়িহাটার মোড়ে নেমে অটো ধরার দরকার ছিল না" ক্ষুব্ধ মনে চিন্তা করতে করতে বিদিশা অস্থির হয়ে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে আর ওদিকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে থাকে।
একটু পরে তার দেরি করার মূর্তিমান 'কারণ'কে বেলেঘাটার দিক থেকে রাস্তা পেরিয়ে এদিকে আসতে দেখে বিদিশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একমুহুর্তে এতক্ষণের রাগ গলে জল হয়ে যায়। পরের মুহুর্তেই আবার ওর মুখটা ভাবলেশহীন হয়ে যায়। যে মেয়ে গত আধঘন্টা নিজের মনে রাগে বিড়বিড় করছিল সেই যদি এখন নিজের মনে কোন কারণ ছাড়া হেসে চলে, তাহলে রাস্তায় লোকজন ওকে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবে।
সুদীর্ঘ উচ্চতার অধিকারী ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি লম্বা লম্বা পা ফেলে অটোর লাইনে ঢুকে পড়ে। ততক্ষণে ভিড় আরো কমে এসেছে।
সামনে আরেকটা খালি অটো এসে দাঁড়াতেই জায়গা পেয়ে গেল ওরা দুজন। বিদিশা পেল পিছনের সিট আর ছেলেটা পেল তার পাশে বাইরের দিকে বসার জায়গাটা।
"আমায় দরজার পাশের সিটটা দিন প্লিজ।" বিদিশা যতবার তার সুদর্শন সহযাত্রীকে এরকম অনুরোধ করেছে কোনবার প্রত্যাখ্যাত হয়নি। এবারও হল না, একটু মুচকি হাসি আর তারপর সিট বদল।
"আজ একটু দেরি হয়ে গেল না ?" বসতে বসতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল বিদিশা।
"ট্রেন লেট। তার উপর আজকে ভ্যানে করে স্টেশনে আসতে হয়েছে।" পাশ থেকে সংক্ষিপ্ত জবাব এল।
"এঁদো গাঁয়ের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা, আমরা শহুরে মানুষরা বুঝব না এসব।" ঠেস দিয়ে কথাটা বলল বটে কিন্তু বিদিশার চোখেমুখে দুষ্টুমির ঝিলিক। সেটা বুঝতে পেরে ওর সহযাত্রী মৃদু হাসল।
"আপনারও তো দেরি হয়ে গেছে দেখছি।"
"হ্যাঁ, আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।", সত্যিটা চেপে গিয়ে নির্ভেজাল মিথ্যে বলল বিদিশা।
"দেরি হয়ে গেলে ক্লাস মিস হয়ে যাবে না ?"
"না, ঠিকসময়ে কলেজে ঢুকে যাব। বাদ দিন ওসব, আপনি কোনদিন নিকোপার্কে গেছেন অরুণাভবাবু ?"
"কেন বলুন তো ?"
"এমনি। বলুন না ?" সে কথা না বললে তার পাশের স্বল্পভাষী সহযাত্রী যে চুপ করে থাকবে, আগের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা খুব ভাল করে জানে বিদিশা, ও তাই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে চায়।
"না, সুযোগ হয়নি।" একটু নীরবতার পর পাশ থেকে উত্তর আসে।
ওদের কথার ফাঁকে অটো নিকো পার্ক পার করে যায়, বিদিশা সেদিকে চেয়ে থাকে। ওর মাথার চুল উড়ে এসে অরুণাভর মুখে লাগে, বিদিশার চুলে একটা সুন্দর গন্ধ আছে। কিসের গন্ধ সেটা প্রাণপণ মনে করার চেষ্টা করে অরুণাভ। মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই নীরবতা কাটায়।
"কি দেখছেন?" পাশ থেকে গলার আওয়াজে সম্বিত ফেরে বিদিশার। এখানে যে মাঝে মাঝে এক্সের সাথে আসত, সেটা একবার ও কথায় কথায় বলে ফেলেছিল।
মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "কিছু না। আচ্ছা আপনি কি খেতে ভালবাসেন বলুন তো অরুণাভবাবু ?"
আচমকা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অরুণাভ। সামলে নিয়ে উত্তর দিল, "সে অনেক কিছু। বেশ বড়ো লিস্ট।"
"তবু শুনি।" বিদিশার গলায় আবদারের সুর।
"বিরিয়ানি, মটন, ইলিশ, চিংড়ির মালাইকারি..."
"আচ্ছা, বাদ দিন। আপনি চাউমিন খান ?"
"মাঝে মাঝে খাই।"
"এখন ট্রাই করবেন ?"
"মানে ?" হকচকিয়ে যায় অরুণাভ।
ততক্ষণে ব্যাগ থেকে একটা টিফিন কৌটো বার করে ফেলেছে বিদিশা। ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর দিকে টিফিন কৌটোটা এগিয়ে দেয়।
"কাল বাড়িতে ট্রাই করলাম। খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে ?"
কাঁটা চামচ দিয়ে কিছুটা মুখে দিল অরুণাভ। অনেকদিন চাউমিন কেন, কোন ফাস্ট ফুডই খাওয়া হয়না। নিমাইদার বারণ বারবার মনে এসে বাধার প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে। আজ সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল অরুণাভ।
"দারুণ ! আপনি এত ভালো রান্না জানেন আগে বলেননি তো ?"
ও আর কি করে জানবে বিদিশা রান্নার 'র'ও জানে না। শুধু ওকে চমকে দেবে বলে ইউটিউব ঘেঁটে, মাকে বিরক্ত করে কত কসরত করে এটা বানিয়েছে। আজ অরুণাভর সঙ্গে দেখা না হলে বিদিশা কি করত কে জানে ?
"আজকে ফেরা কখন ?"
"ঠিক নেই, আশা করছি পাঁচটা নাগাদ।" একগোছা চাউমিন গলার্ধকরণ করতে করতে উত্তর দেয় অরুণাভ।
"আমারও ওইরকম হবে। আপনার আগে হয়ে গেলে অটোতে জায়গা করে রাখবেন কিন্তু।" হাসতে হাসতে বলে বিদিশা।
"কিন্তু যোগাযোগ হবে কি করে ?" অরুণাভর প্রশ্নে কৌতূহল আর দুষ্টুমি দুটোরই ছাপ রয়েছে।
"আপনার নম্বরটা দিয়ে দিন, আমি কনট্যাক্ট করে নেব।"
অরুণাভ নম্বর বলতে থাকে, "৬২৯০..."
"আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, আগে ফোনটা বের করতে দিন। আপনি অমন ফটাফট নম্বর বলে গেলে থোড়াই আমার মনে থাকবে ?"
উত্তরে ক্যাবলার মতো হেসে ফেলে অরুণাভ। একটা অচেনা মেয়ের সামনে এই ক্যাবলামোর জন্য ওর লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল। অরুণাভ আবিষ্কার করল ও একটুও লজ্জা পাচ্ছে না, বরং আনন্দে ওর মন ভরে আছে। এই আনন্দ কোথা থেকে এল, কেন এল তার কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। আজকাল ওর হচ্ছেটা কি ?
"কি মশাই, নম্বরটা বলুন ?" বিদিশার প্রশ্নে হুঁশ ফেরে ওর।
নম্বরটা বলতে বলতেই অটো স্ট্যান্ডে এসে থামে।
মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করে অটোওয়ালাকে দুজনের ভাড়া মেটাতে বলে অরুণাভ।
"এটা কী হল ? আপনি কি আমার চাউমিনের দাম মিটিয়ে দিলেন ?"
বিদিশার রাগটা আসল না নকল বুঝতে পারে না অরুণাভ। নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তার শূন্যের কোঠায়। একটু থতমত খেয়ে বলে "না কোথায় ? এখনও খেয়ে শেষ করে উঠতে পারিনি তো।"
"লাঞ্চে ওটা শেষ করে ফেরার সময় আমায় টিফিন কৌটোটা ফেরত দিয়ে যাবেন।", বিদিশার গলায় আদেশের সুর। ওর রাগটা যে কপট সেটা বুঝতে পেরে অরুণাভর মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ে।
ফট করে পাল্টা জবাব ছুঁড়ে দেয় সে, "ভালোলাগাকে দাম দিয়ে বিচার করা যায় না ম্যাডাম।" উত্তরের অপেক্ষা না করে কলেজ মোড়ের রাস্তাটা পেরিয়ে যায় অরুণাভ।
সেদিকে তাকিয়ে বিদিশা নিজের মনে প্রিয় হিন্দি গানের কলি গুনগুন করে গেয়ে উঠল। অরুণাভর যে ওর রান্নাটা ভালো লেগেছে, এটা জেনেই ওর ইচ্ছা করছে এক্ষুণি ছুটে কোন খোলা মাঠে গিয়ে সেখানে আনন্দে চিৎকার করতে করতে গোটা মাঠ দৌড়ে বেড়াতে।
শহরের আধুনিকা মেয়ে সে, পুরুষসঙ্গে মোটেই অনভিজ্ঞ নয়। কিন্তু, অরুণাভর কাছে এলে ও আজকাল নিজের মধ্যে থাকে না। এই যে কাল সারাদিন ইউটিউব ঘেঁটে, মাকে পাগল করে দিয়ে আজ ওর জন্য চাউমিন বানিয়ে আনল, এর আগে ও নিজের কোন বয়ফ্রেন্ডের জন্য এমনটা করেনি। মাত্র মাস তিনেকের পরিচয়, অথচ এর মধ্যেই অরুণাভ ওর মনে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ওর কথা চিন্তা করলে বিদিশার মনে খুশির আলোড়ন ওঠে, সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই যে এখন পাগলামিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা ভালোবাসা কিনা বিদিশা জানে না তবে এই অনুভূতি ও এর আগে কখনো অনুভব করেনি।
**********************************************************
আজ অফিসে কাজের চাপ একটু কম থাকায় লাঞ্চটাইমে ইন্টারনেট স্ক্রল করছিল অরুণাভ। অন্যদিন এইসময়েও ফাইল নিয়ে বসতে হয়। তখনই ফোনে রিংটোন বেজে উঠল - অচেনা নম্বর। ধরতেই ওপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠ - "লাঞ্চ হল আপনার ?"
গলার স্বরটা চেনা, আজ সকালেই তার মালিকের সাথে বিস্তর কথা হয়েছে। কিন্তু, উত্তর দিতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে যায়, "হ্যাঁ, এই জাস্ট, আপনি লাঞ্চ করেছেন ?"
"হ্যাঁ, এই তো শেষ করে উঠলাম। যাক গে, এই নম্বরটা আমার, চাইলে সেভ করে নিতে পারেন।"
"কি নামে সেভ করব ?"
"বিদিশা লাহিড়ী। তাহলে আজকে পাঁচটার সময় দেখা হচ্ছে তো ?"
"অ্যাঁ ! হ্যাঁ, অবশ্যই।"
"তাহলে অটো স্ট্যান্ডে দেখা হচ্ছে। আপনি জায়গা রাখবেন কিন্তু। দেরি হলে একটা টেক্সট করে দেবেন, কেমন ?" উল্টোদিক থেকে ভেসে আসছে অনর্গল কথার স্রোত।
"ওকে।"
"রাখছি এখন।", ফোন কেটে যায় কিন্তু অরুণাভর জড়তা কাটে না। আজ ওর হঠাৎ কি হল কে জানে ?
**********************************************************
"এইজন্য তুই লাস্ট তিনমাস ধরে অটো ধরে কলেজে আসছিস ! ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস আর নিজের বন্ধুদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না ?"
উল্টোদিকে ফোনটা নামিয়ে রাখতেই বিদিশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রেয়া। বিদিশার মুখে একটা অসন্তোষের ছায়া পড়লেও সেটাকে গ্রাহ্য করে না সে।
"নিজের চরকায় তেল দে। যখন রোহনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াস তখন আমি দেখতে যাই ?" ঝাঁঝিয়ে ওঠে বিদিশা।
"এই রাগ করিস না, প্লিজ।", পাশ থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করে শ্বেতা। বিদিশা মুখ শক্ত করে বসে থাকে, ও একটুও আলগা দিতে চায় না। কিন্তু, শেষে বন্ধুদের ঝুলোঝুলিতে ওকে নরম হতেই হয়। মোবাইলে অরুণাভর নম্বরে ওর যে প্রোফাইল পিকচারটা সেভ করেছিল সেটা দেখায় সে। অরুণাভর অজান্তেই একদিন দূর থেকে ছবিটা তুলেছিল ও।
"এত পুরো হ্যান্ডু মাল রে !" উচ্ছ্বসিত শ্রেয়া।
"আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।" ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করে শ্বেতা।
খুব একটা অবাক হয় না বিদিশা, "সেক্টর ফাইভে আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে, হয়তো কখনও দেখে থাকবি।"
"তাই হবে।"
"কি নাম ?" জানতে চায় শ্রেয়া।
"অরুণাভ।"
"বাঙালি ? তুই আজকাল বাঙালি ছেলেদের ডেট করছিস ?" শ্রেয়ার গলার অবাক স্বরটা নজর এড়ায় না বিদিশার।
"কেন আমি কখনো বলেছি যে বাঙালি ছেলেদের ডেট করব না ?" রক্ষণাত্মক স্বরে বলে ওঠে বিদিশা। অরুণাভর সঙ্গে সম্পর্কটা যে ডেটিং অবধি পৌঁছায়নি সেটা ও জানাতে চায় না।
"তোর লাস্ট বাঙালি বিএফ কে ?" প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে চোখ টেপে শ্রেয়া, "বাই দ্য ওয়ে, মোহিত এখনও তোর জন্য পাগল।"
অস্বস্তিতে শরীর কাঠ হয়ে যায় বিদিশার। কথাটার উত্তর দেবার কোন প্রয়োজন মনে করে না সে।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)