23-05-2025, 08:18 PM
এভাবে চলতে চলতে একদিন সুলতা হো অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এই খবর হরিপুরা গ্রামে জানাজানি হলে দুজনেই যে খুন হবে, তা বুঝতে পেরেছিলো তারা। সুতরাং মাইকার ব্যবসা ভুলে তিনজনে প্রাণ নিয়ে পালালো। কিন্তু যাবে কোথায়? অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকা নিয়ে তো আর স্ত্রীর কাছে গিয়ে ওঠা যায় না? দায়িত্ব নিলেন সুরেশ বাবু। তার কথা রমাপতির স্ত্রী বিভাবতী দেবী বেশ মান্য করতেন। তিনি বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করলেন বিভাবতী দেবীকে। অনেক মান অভিমানের পরে রাজি হলেন তিনি। সুলতা দেবীকে নিয়ে বাড়িতে এলেন রমাপতি। যথা সময়ে জন্ম নিলো একটি কন্যা সন্তান। নাম রাখা হলো মধুছন্দা!
নৈশব্দের এমন ভয়ঙ্কর অভিঘাত হতে পারে সেটা সেই ঘরে উপস্থিত না থাকলে বোঝা যেতো না। কেউ কোনো টু শব্দটি করলো না, কিন্তু সবার চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। স্বাভাবিক রয়েছে শুধু তিন জন, সুরেশ চাকলাদার, সুলতা দেবী, আর মধুছন্দা দেবী নিজে। এরা বিষয়টা আগেই জানে, তাই নতুন করে কোনো অনুরনন হয়নি। মধুছন্দা দেবীকে সন্তান স্নেহে কখনো হয়তো কথাটা বলে থাকবেন সুলতা দেবী।
নতুন খবরটা সবাইকে হজম করতে একটু সময় দিয়ে তমাল আবার বলতে শুরু করলো। বিভাবতী দেবী কিন্তু উদার মনের মহিলা ছিলেন। স্বামী এবং বংশের অপযশের কথা ভেবে মধুছন্দা দেবীকে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়েই মানুষ করতে লাগলেন। পরে তার একটি ছেলে জন্মায়, নাম শুভেন্দু মুখার্জি, রাহুলের বাবা।
মধুছন্দা দেবী বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তার জিনে থাকা ব্যভিচারী স্বত্তাও বড় হতে থাকে। পাড়ার ছেলেদের চোখের মনি আর রাতের উষ্ণ কল্পনা হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ততোদিনে সমাজে একটা উঁচু জায়গা করে নিয়েছে মুখার্জি পরিবার। তাই বাড়ির বাইরে নিজের যৌন চাহিদা মেটাবার সুযোগ ছিলোনা তার। কিন্তু শরীরের ক্ষুধা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, সে উঁচু নীচু, মালিক কর্মচারী বোঝে না, খিদে মেটাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মুখার্জি বাড়িতেই এক যুবক কর্মচারী সনতের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মধুছন্দা দেবী। প্রেমের সম্পর্ক যখন শরীর দাবী করতে থাকে তখন তার হাত ধরে ঘর ছাড়েন তিনি।
এখানেই সে সাহায্য পায় তার বর্তমান সাথী, সব পাপ কাজের দোসর ঘনশ্যাম তিওয়ারির। বাড়ির ড্রাইভার ছিলো সে। মনে মনে মধুছন্দা দেবীর একজন মৌন পুজারী ছিলো সেও। গভীর রাতে গাড়িতে করে সনত আর মধুছন্দা দেবীকে রেখে আসে চিত্তরঞ্জনে। কিন্তু জানাজানি হবার পরেও কিছুতেই সে স্বীকার করেনা কোথায় তাদের রেখে এসেছে। সেই অপরাধে চাকরি যায় তার। ঘনশ্যাম নিজেও গিয়ে ওঠে মধুছন্দা আর সনতের বাড়িতে।
তারপরে বহু বছর আর তাদের কোনো খোঁজ খবর ছিলো না। ইতিমধ্যে রমাপতি বাবু দেহ রাখলেন। শুভেন্দু বাড়ির কর্তা হলেন। তিনি কিন্তু ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতো ভালো মানুষ। মধুছন্দা দেবী ঘর ছাড়ার পরে যখন রমাপতি ভীষণ রেগে গিয়ে সবার সামনে তাকে ত্যাজ্য কন্যা ঘোষনা করলেন, তখনো শুভেন্দু আপত্তি জানিয়েছিলো।
শুভেন্দু কিন্তু ভুললো না তার দিদিকে। সে বিশ্বস্ত কর্মচারী রামহরি কে মধুছন্দা দেবীর সন্ধান করতে লাগিয়ে দিলেন। অনেক খুঁজে রামহরি যোগাড়ও করে ফেললো তাদের ঠিকানা। সেটাই তার কাল হলো। ঠিকানা যোগাড় করতে গিয়ে রামহরি মুখার্জি বাড়ির এইসব কেচ্ছা জেনে ফেললো। ফলে চাকরি গেলো তারও।
ওদিকে সনত ছিলো অকর্মণ্য প্রকৃতির। কাজকর্ম কিছুই করতো না, বসে বসে খেতো। মধুছন্দা দেবী বাড়ি ছাড়ার সময় অনেক টাকাকড়ি গয়নাগাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো ভেঙেই চলতে লাগলো সংসার। ঘনশ্যামই বরং আনন্দভবন হোমে একটা ড্রাইভারের চাকরি জুটিয়ে সংসার চালাতে লাগলো। পাশাপাশি কাজ করতো একটা গ্যারেজে। সনতের অপদার্থতা ধীরে ধীরে যুবক ঘনশ্যামের প্রতি আকৃষ্ট করে তুললো মধুছন্দা দেবীকে। তখনি খবর পেলো ঘনশ্যাম যে গ্যারেজে কাজ করতো সেটা বিক্রি হবে। তিনি নিজের গয়না বিক্রি করে গ্যারেজটা কিনে নেবার জন্য টাকা দিলেন ঘনশ্যাম কে। ঘনশ্যাম গ্রাম থেকে ডেকে নিলো ছোট ভাই জগন তিওয়ারি কে।
এই গয়না বিক্রি কিন্তু সহ্য হলোনা সনতের। সে অশান্তি শুরু করলো। রোজ অশান্তি হতে লাগলো। ক্রমে সেটা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছালো। তখনি একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হলো সনত। কেউ তাকে আর কোনোদিন দেখেনি। মধুছন্দা দেবী আর ঘনশ্যামের ভিতরে আর কোনো বাঁধা রইলো না। তারা স্বামী স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করলো। সনতের নিরুদ্দেশ হবার দু বছরের মাথায় মধুছন্দা দেবীর কোল আলো করে একটা কন্যা সন্তান এলো। স্বামী নিরুদ্দেশ হবার দুবছর পরে সন্তান এলে সেই সন্তান যে স্বামীর নয়,সেই সময় চিত্তরঞ্জনের ছাব্বিশ নম্বর রাস্তায় এই ঘটনা যে বিস্তর আলোড়ন তুলেছিলো তা মধুছন্দা দেবীর প্রাক্তন বাড়িওয়ালা বেশ পরিস্কার মনে করতে পারলেন।
কিন্তু কোথায় গেলো সনত? তার বাড়ি থেকেও কোনো খোঁজ করা হয়নি, মুখার্জি বাড়ি থেকে খোঁজ করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। সবাই জানলো ঝগড়া করে নিরুদ্দেশ হয়েছে সনত। কিন্তু পাপ কখনো চাপা থাকে না। আর মদের নেশার মতো এতো খারাপ জিনিস আর নেই। পেটে বেশি পরিমান পড়লে অনেক গোপন কথাই বেরিয়ে আসে বমির মতো। আমার ড্রাইভার মদনকে পাঠিয়ে সেই টোপই দিয়েছিলাম আমি। সে ও ড্রাইভার, তাই জগনের গ্যারেজে গাড়ি সারানোর বাহানায় তার সাথে বন্ধুত্ব করতে দেরি হয়নি মদনের। তারপরে মদের ঠেকে একটু ভালো মদ বেশি পরিমান খাইয়ে দিতেই অনেক খবর বেরিয়ে এসেছে। পরিস্কার খবর নয়, একটু আভাস মাত্র। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট।
আমি নিজে গিয়ে দেখে আসি বাড়িটা। কোথায় খুঁজতে হবে বলে দিতেই বাকী কাজ করেছেন ইন্সপেক্টর বাসুদেব গড়াই। পাঁচিলের পাশের এক পরিত্যক্ত পাতকুয়ো থেকে উদ্ধার হয়েছে নরকঙ্কাল। সনতের মা এখনো জীবিত আছেন। আশাকরি তার সাথে ডিএনএ ম্যাচ করালেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে যে সনত নিরুদ্দেশ হয়নি, ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে তাকে। এখন খুনটা মধুছন্দা দেবী নিজে করেছিলেন, না কি ঘনশ্যাম অথবা জগন, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব দুই থানার মহিলা এবং পুরুষ পুলিশ কর্মীদের। শুনেছি থানায় এতো খাতির যত্ন করা হয় যে কিছুই গোপন থাকে না।
একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে তমাল। বললো, একটু চায়ের ব্যবস্থা হলে মন্দ হতো না। দুজন মানুষ আর কখনো মুখার্জি বাড়ির চা খাবেন কি না ঠিক তো নেই? কথাটা শুনে মৌপিয়া উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলো ডাইনিংয়ে।
মধুছন্দা দেবী যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। এমনকি তিনি যে নিশ্বাস নিচ্ছেন সেটাও ভালো করে ঠাহর না করলে বোঝা যায় না। ঘনশ্যাম কিন্তু জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তমালের দিকে। দেখলে মনে হয় যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর। অল্প সময়ের ভিতরেই চা এসে গেলো। পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে তমাল আবার শুরু করলো।
- এতোক্ষণ যা বললাম, সেসব খবর মুখার্জি বাড়িতে না পৌঁছালেও মধুছন্দা দেবীর মা হবার খবর কিন্তু ঠিকই পৌঁছালো। বাচ্চার বাবা কে, সেটাও অনুমান করতে পারলো তারা। শুভেন্দু বাবু আর ঠিক থাকতে পারলেন না। একদিন ছুটে গেলেন দিদির কাছে। তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু বাচ্চাটার সাথে মুখার্জি বাড়ির কোনো রকম সম্পর্ক অস্বীকার করলেন তিনি। অনেক বুঝিয়েও লাভ হলো না। মেয়েকে ছাড়া মধুছন্দা দেবী ফিরতে চাইলেন না।
অনেক বুঝিয়ে শুভেন্দু বাবু বাচ্চাটাকে আনন্দভবন বলে একটা হোমে পাঠিয়ে দিতে মধুছন্দা দেবীকে রাজি করালেন। সেখানে বাচ্চার নাম রাখা হলো বন্দনা। পিতার নাম ঘনশ্যাম তিওয়ারি, মা মধুছন্দা তিওয়ারি। শুভেন্দু বাবু বাচ্চাটার সমস্ত রকম দায়িত্ব নিলেন। এমনকি নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে হোমে তার সুরক্ষার ব্যবস্থা ও করে দিলেন।
তমাল এই পর্যন্ত বলে বন্দনার দিকে তাকালো। দেখলো সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মধুছন্দা দেবীর দিকে। মধুছন্দা দেবী তখন মুখ নীচু করে আছেন। ঘরের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বন্দনার দিকে। এতোদিন যে নিজেকে যার পালিতা কন্যা ভেবেছে, হঠাৎ সে তার আত্মজা জানার পরে কি অবস্থা হতে পারে মেয়েটার মনে, সেটা অনুভব করে বন্দনার জন্য কষ্ট হলো তমালের।
কিন্তু গল্প যে এখনো শেষ হয়নি! তাই তমাল ভাবাবেগ বাদ দিয়ে কর্তব্যে মনোনিবেশ করলো। সে বলতে লাগলো, শুভেন্দু বাবু অনেক চেষ্টা করেছিলো দিদিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বন্দনাকে মুখার্জি বাড়িতে জায়গা দেবেন না, এই ছিলো তার শর্ত। কিন্তু অন্তরের বন্ধন যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত বন্ধন! মধুছন্দা দেবী কিছুতেই বন্দনাকে ছাড়া ফিরতে রাজি হলো না।
মুখার্জি বাড়ির সম্পদ লক্ষ্মী তখন কল্পতরু হয়ে উঠেছেন। সম্পদে ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিয়েছেন। সেই খবর মধুছন্দা দেবীর কানেও পৌঁছালো। কন্যা স্নেহে অন্ধ হলেও প্রকৃতিগত লোভকে তিনি জয় করতে পারলেন না। মনে মনে এই অতুল ঐশ্বর্য ভোগ করার বাসনা জেগে উঠলো। পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন তার একান্ত অনুচর ঘনশ্যামের সাথে। ঠিক করলেন শুভেন্দুকে সরিয়ে দিয়ে মুখার্জি বাড়ির সম্রাজ্ঞী হয়ে বসবেন তিনি নিজে।
পরের বার শুভেন্দু বাবুকে সস্ত্রীক যেতে বললেন চিত্তরঞ্জনে। বোধহয় বলেছিলেন যে তিনি বন্দনাকে ছাড়া ফিরে যেতে রাজি। ভালোমানুষ শুভেন্দু এই গভীর চক্রান্তের কিছুই জানতে পারলেন না। স্ত্রীকে নিয়ে দিদিকে ফিরিয়ে আনতে চিত্তরঞ্জনে গেলেন। মধুছন্দা দেবীরা তখন আগের পুরানো বাড়ি ছেড়ে ঘনশ্যাম আর জগনের গ্যারেজের পাশেই একটা বাড়িতে উঠে এসেছেন। সেখানে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া সারলেন তারা। ড্রাইভারকে অন্য কোনো কাজে পাঠিয়ে জগনকে নিয়ে ঘনশ্যাম কারগরি ফলালো গাড়িতে। তারপরে কোনো বাহানায় একাই ফেরত পাঠালেন তাদের। ফেরার পথে হাই রোডে উঠে গাড়ি গতি তুললেই ব্রেক এবং স্টিয়ারিং ফেল করে সোজা ধাক্কা মারে ছুটন্ত লরির সাথে। সাথে সাথে মারা যান শুভেন্দু বাবু আর তার স্ত্রী এবং ড্রাইভার।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো রাহুল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তমাল তুমি যা বললে, তা কি সত্যি না তোমার অনুমান? তমাল তাকে শান্ত হতে বললো। রিনি তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সে বসলো না। দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু মেলে তাকাতে লাগলো মধুছন্দা এবং ঘনশ্যামের দিকে। তমাল বললো, যা বললাম, সব সত্যি। আমি কয়েকদিন আগে কুলটি যাবো বলে চিত্তরঞ্জন গিয়েছিলাম। আগে থেকে জানালে জগনকে ধরা যেতো না। সেখানে জগনকে গ্রেফতার করেছেন ইন্সপেক্টর গড়াই। সে সব কিছু স্বীকার করেছে। জগন এখন এই বাড়ির নীচেই পুলিশের গাড়িতে অপেক্ষা করছে, ইচ্ছা হলে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। রাহুল চিৎকার করে বললো, আমিও দেখবো এরা ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচে কিভাবে। এতো বড় নৃসংস কাজ মানুষ কিভাবে করতে পারে?
তমাল বললো, শুধু আপনার বাবা নন, আপনাদের তিন ভাইবোনকেও সরিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। মনে করুন মৌপিয়ার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়া, অদিতির ফুড পয়জনিং, আপনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট, সবই এদের কীর্তি। সেগুলোতে সফল না হয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন মধুছন্দা দেবী। রাজীবকে খুন করে আপনাকে খুনের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া। সেই চেষ্টায় সফল হলে এর পরে পালা আসতো অদিতি আর মৌপিয়ার।
একজন মাতৃসমা নারীর এমন কুটিল মনের পরিচয় পেয়ে ভাষা হারিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো রাহুল। সুরেশ বাবু বললেন, আপনি বলুন তমাল বাবু, আমরা পুরোটা শুনতে চাই। আপনি কিভাবে এদের সন্ধান পেলেন?
তমাল বললো, ধর্মের চাকা ঘোরানোতে আপনার অবদান কম নয় সুরেশ বাবু। আপনিই প্রথম হিসাবের অসঙ্গতি ধরতে পেরেছিলেন। সেখান থেকেই এদের শেষের শুরু। শুভেন্দু বাবুকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করার পরে মুখার্জি বাড়ির শুভার্থী হয়ে এসে জুড়ে বসেন মধুছন্দা দেবী। শুভেন্দু বাবু দিদির কথা বাড়িতে আলোচনা করতেন না। তাই অন্য সদস্যরা বন্দনার কথা বা তলে তলে এতো কিছু ঘটে যাওয়ার আভাসটুকু পর্যন্ত পায়নি। পিসি ফিরে এসে সংসারের এবং ব্যবসার হাল ধরেছে বলে অদিতি মৌপিয়া এবং রাহুল বেশ নিশ্চিন্ত ছিলো। মা কে হারিয়ে মাতৃসমা পিসিকেই আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছিলো তারা।
পিসি কিন্তু তাদের আপন করে নিলো না। তার অন্তরের বন্ধন অটুট রইলো একমাত্র বন্দনার প্রতি। নাটক সাজিয়ে নিজের মেয়েকেই দত্তক নিলেন তিনি। কিন্তু খল চরিত্র বেশিদিন উৎপাত না করে থাকতে পারে না। এই পাপের ভাগীদার জগন শুরু করলো ব্ল্যাকমেইলিং। সনত এবং শুভেন্দু বাবুর খুনের কথা সে জানতো। তবে আমার মনে হয় এই কাজে জগনের সাথে ঘনশ্যামও যুক্ত। মধুছন্দা দেবী ফিরে এসেই রাণী হয়ে বসলো। অথচ তার ভাগীদার ঘনশ্যামকে ফিরিয়ে আনলো ড্রাইভার করে। কেউ জানতো না তাদের সম্পর্কের কথা। যারা জানতো তারা আর বেঁচে নেই। তার বাড়িতে নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে ঘনশ্যামকে ড্রাইভারর্স কোয়ার্টারেই রাখতে হলো। এতে অপমানিত হলো ঘনশ্যাম। বদলা নিতে ভাইয়ের সাথে ব্ল্যাকমেইলিং এর খেলায় নামলো সে।
মাসে মাসে একটা বড় অংকের টাকা ঘনশ্যাম মধুছন্দা দেবীর কাছ থেকে নিয়ে পাঠাতে লাগলো জগনের অ্যাকাউন্টে। আয় ব্যয়ের হিসাবে গড়মিল হতে লাগলো। সেই গড়বড় ধরে ফেললেন অভিজ্ঞ অ্যাকাউন্টেন্ট সুরেশ বাবু। ফলে চোর অপবাদ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করে রাজীবকে বহাল করা হলো।
রাজীবের কাছেও গোপন থাকলো না সেটা। কিন্তু সুরেশ বাবুর মতো এই পরিবারের একান্ত অনুগত ছিলো না সে। তার কৌতুহলী মন আসল কারণ খুঁজতে শুরু করলো। যেভাবেই হোক জেনে গেলো রাজীব। একজন অ্যাকাউন্টেন্ট এর কাছে ব্যাংক স্টেটমেন্ট যোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। শুধু ব্ল্যাক মেইলিং নয়, শুভেন্দু বাবুর অ্যাক্সিডেন্টও যে সাজানো সেটাও সে জেনে যায়। আমি সেটা জানতে পারি তার কম্পিউটার থেকে আর তার নিজের লেখা একটা ডায়েরি থেকে।
গুপ্ত কথা জানার পরে রাজীবও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়লো। সেও শুরু করলো ব্ল্যাকমেইলিং। ডায়েরিতে প্রথমে সে জগনের ব্ল্যাকমেইলিং এর র্যানসাম দেওয়ার তারিখ গুলো লিখেছিলো। তারপর নিজে কবে কবে কতো টাকা নিয়েছে সেটাও ডায়েরিতে শেষের দিকে লিখে রেখেছে। কিন্তু মাঝেখানে একটা পাতায় একটা তারিখ লেখা দেখে আমি খোঁজ নিয়ে জানি যে সেটা শুভেন্দু বাবুর অ্যাক্সিডেন্টের তারিখ। তখনই বুঝে যাই রাজীব কি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছিলো মধুছন্দা দেবীকে। কারণ শুধু তছরুপের জন্য ব্ল্যাকমেইল করলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিলেই চুকে যেতো, টাকা দেবার দরকার হতো না।
মধুছন্দা দেবী পড়লেন বিপদে। রাহুল ফিরে আসার পরে ব্যবসার বেশির ভাগ দায়িত্ব তার হাতে। এতো টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে লাগলেন তিনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো তার। তার উপরে নিজের মেয়ের সাথে রাজীবের শারীরিক সম্পর্কের খবর কানে যেতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মরতে হবে রাজীবকে। খুনের একটা নেশা আছে। সফল ভাবে দু দুটো খুন করে ধরা না পড়ে সাহস আর অহংকার বেড়ে গেছিলো মধুছন্দা-ঘনশ্যাম জুটির। তাই আরও একটা খুনের পরিকল্পনা করলো তারা। সাথে বাই ওয়ান গেট ওয়ান অফারের মতো রাহুলকে জড়িয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা করলেন।
সবই ঠিকঠাক চলছিলো। খুনের হাতিয়ার, যোগাড় করে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুযোগের। কিউরিও দোকান থেকে ঘনশ্যাম কিনে আনলো অবিকল একই রকম একজোড়া ছুরি। দোকানদার ঘনশ্যামের ছবি দেখে সনাক্ত করেছে।
সুযোগ এলো, কিন্তু ভাগ্য রাজীবকে সহায়তা করে মধুছন্দা দেবীর প্ল্যান ভেস্তে দিলো। পিসি হয়ে বাপ মরা ভাইপোর জন্য কিছু না করলে খারাপ দেখায় তাই পুলিশের কাছে রাহুলের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ তুলে দিয়ে ভাব করলেন তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত চান। এই সময়ে এলাম আমি। আমার বয়স দেখে উনি আরও একটু ভালো পিসি সাজবেন বলে ঠিক করলেন। ভাইপো কে বাঁচাবার জন্য আমাকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলেন। নিয়োগ করলেন আমাকে। এবং নিজের কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিলেন তখনই। আমার ট্র্যাক রেকর্ড জানলে হয়তো এই ভুল করতেন না।
তমাল থামতেই মৌপিয়া জিজ্ঞেস করলো, বন্দনা যে পিসিরই মেয়ে সেটা তুমি কিভাবে জানলে? তমাল বললো, প্রথম সন্দেহ হয় তার কথার অসংগতি দেখে। তিনি বলেছিলেন বন্দনাকে প্রথম দেখেন ঘনশ্যাম হোম থেকে নিয়ে আসার পরে। কিন্তু বন্দনা বলেছে সে ছোট বেলা থেকেই মাঝে মাঝে মধুছন্দা দেবীর বাড়িতে যেতো ঘনশ্যামের সাথে। তারপরে একদিন আমি বন্দনার ঘরে তার খুব ছোটবেলার একটা ছবি দেখতে পাই, হোমে তোলা। সেই একই বয়সের একটা ছবি মধুছন্দা দেবীর ঘরেও আছে। তখন থেকেই সন্দেহ হয়, কিন্তু শিওর হই হোমের ফাইল ঘাটতে গিয়ে। সেখানে মধুছন্দা দেবীর কোলে শিশু বন্দনার একটা ছবি পাই, পাশে ঘনশ্যাম ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়ানো। হয়তো কোনো জন্মদিনে বাবা মায়ের সাথে বন্দনার ছবি ওটা। সেই ছবিটা চুরি করি আমি, সেটা এখন আমার কাছে। বলেই নিজের পকেট থেকে ছবিটা বের করে টেবিলে রাখলো সে। রাখল রায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো তমাল, কি রাখাল বাবু, ছবিটা হোমের ফাইলে ছিলো তো? সে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
তমাল বললো, এই একই ছবি, শুধু মধুছন্দা দেবীকে কেটে বাদ দিয়ে নিজের ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছিলো ঘনশ্যাম, সেটা ইনস্পেকটর ঘোষ একটু আগেই তার ঘর থেকে নিয়ে এসেছেন। আর কিছুই বুঝতে বাকী থাকে না। তমাল থামতেই ইনস্পেকটর ঘোষ বাঁধানো ছবিটা তুলে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন।
অদিতি প্রশ্ন করলো আচ্ছা তমালদা, তুমি বললে বন্দনা পিসির মেয়ে, তাহলে পিসি বন্দনাকে দত্তক নিতে গেলো কেন? পিসির উত্তরাধিকারী তো বন্দনা এমনিতেই ছিলো?
তমাল বললো, দেখো অদিতি মধুছন্দা দেবী একজন ধুরন্ধর মহিলা। তিনি সবদিক বিচার করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জানতেন যে তিনি রমাপতি বাবুর অবৈধ সন্তান। ভারতের সংবিধানের ১৯১৫ সালের প্রণোদিত আইনে অবৈধ সন্তানও বাবা মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। কিন্তু ১৯৫৫ এর সংশোধিত ধারা ১৬(৩) অনুযায়ী অবৈধ সন্তান শুধু মাত্র বাবা মায়ের উপার্জিত ধনের উত্তরাধিকার বহন করে। তোমাদের পরিবারের সম্পত্তির সিংহভাগ উপার্জন করেছে তোমার বাবা শুভেন্দু মুখার্জি। একদিন তোমাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম নিশ্চয়ই মনে আছে? কিন্তু মধুছন্দা দেবী তো রমাপতি বাবুর অবৈধ সন্তান, শুভেন্দু বাবুর অর্জিত সম্পত্তিতে তার কোনো অধিকার নেই।
যদিও সেই পরিমানটাও কম নয়। পৈতৃক বাড়ি এবং আসানসোলের দোকান গুলো তোমার ঠাকুরদার আমলে করা। সেগুলোতে তার অধিকার আছে, যা পরবর্তীকালে বন্দনা পাবে। কিন্তু এখানেও একটা প্রবলেম আছে। বন্দনা আবার সনত বাবু এবং মধুছন্দা দেবীর বৈধ সন্তান নয়। সে ঘনশ্যাম আর মধুছন্দা দেবীর অবৈধ সন্তান। কিন্তু মধুছন্দা দেবীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ছাড়া নিজের উপার্জিত সম্পত্তি কিছু নেই। তিনি পড়ে গেলেন ধন্ধে। যদি বন্দনার জন্ম পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে তো সে কোনো সম্পত্তি পাবে না অবৈধ সন্তান হবার কারণে। সেই জন্যই নিজের সন্তানকেই মধুছন্দা দেবী দত্তক নিয়ে বৈধ বানিয়ে নিলেন যাতে মুখার্জি পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা কিছু পাবেন, পুরোটাই যেন বন্দনা পায়।
গার্গী বললো, বাপরে! উনি এতো কিছু ভেবেছেন? তাহলে বন্দনা তো এই পরিবারের সম্পত্তির একটা অংশ পাবে, কি বলো?
" না, এই পরিবারের এক কানাকড়িও পাবে না। মধুও পাবে না, তার মেয়েও পাবে না!" তমাল উত্তর দেবার আগেই একটা জোরালো নারী কন্ঠ শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন সুলতা দেবী। তমাল বললো, আইন কিন্তু অন্য কথা বলছে পিসি। সুলতা দেবী বললেন, এতোক্ষণ আমি সব কথাই শুনছিলাম। মধু সম্পত্তি তখনই পাবে যখন সে এই পরিবারের সন্তান হবে, বৈধ বা অবৈধ। কিন্তু সে এই পরিবারের সন্তানই নয়। রমাপতি বাবু তার বাবা নয়।
নৈশব্দের এমন ভয়ঙ্কর অভিঘাত হতে পারে সেটা সেই ঘরে উপস্থিত না থাকলে বোঝা যেতো না। কেউ কোনো টু শব্দটি করলো না, কিন্তু সবার চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। স্বাভাবিক রয়েছে শুধু তিন জন, সুরেশ চাকলাদার, সুলতা দেবী, আর মধুছন্দা দেবী নিজে। এরা বিষয়টা আগেই জানে, তাই নতুন করে কোনো অনুরনন হয়নি। মধুছন্দা দেবীকে সন্তান স্নেহে কখনো হয়তো কথাটা বলে থাকবেন সুলতা দেবী।
নতুন খবরটা সবাইকে হজম করতে একটু সময় দিয়ে তমাল আবার বলতে শুরু করলো। বিভাবতী দেবী কিন্তু উদার মনের মহিলা ছিলেন। স্বামী এবং বংশের অপযশের কথা ভেবে মধুছন্দা দেবীকে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়েই মানুষ করতে লাগলেন। পরে তার একটি ছেলে জন্মায়, নাম শুভেন্দু মুখার্জি, রাহুলের বাবা।
মধুছন্দা দেবী বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তার জিনে থাকা ব্যভিচারী স্বত্তাও বড় হতে থাকে। পাড়ার ছেলেদের চোখের মনি আর রাতের উষ্ণ কল্পনা হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ততোদিনে সমাজে একটা উঁচু জায়গা করে নিয়েছে মুখার্জি পরিবার। তাই বাড়ির বাইরে নিজের যৌন চাহিদা মেটাবার সুযোগ ছিলোনা তার। কিন্তু শরীরের ক্ষুধা যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, সে উঁচু নীচু, মালিক কর্মচারী বোঝে না, খিদে মেটাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মুখার্জি বাড়িতেই এক যুবক কর্মচারী সনতের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মধুছন্দা দেবী। প্রেমের সম্পর্ক যখন শরীর দাবী করতে থাকে তখন তার হাত ধরে ঘর ছাড়েন তিনি।
এখানেই সে সাহায্য পায় তার বর্তমান সাথী, সব পাপ কাজের দোসর ঘনশ্যাম তিওয়ারির। বাড়ির ড্রাইভার ছিলো সে। মনে মনে মধুছন্দা দেবীর একজন মৌন পুজারী ছিলো সেও। গভীর রাতে গাড়িতে করে সনত আর মধুছন্দা দেবীকে রেখে আসে চিত্তরঞ্জনে। কিন্তু জানাজানি হবার পরেও কিছুতেই সে স্বীকার করেনা কোথায় তাদের রেখে এসেছে। সেই অপরাধে চাকরি যায় তার। ঘনশ্যাম নিজেও গিয়ে ওঠে মধুছন্দা আর সনতের বাড়িতে।
তারপরে বহু বছর আর তাদের কোনো খোঁজ খবর ছিলো না। ইতিমধ্যে রমাপতি বাবু দেহ রাখলেন। শুভেন্দু বাড়ির কর্তা হলেন। তিনি কিন্তু ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতো ভালো মানুষ। মধুছন্দা দেবী ঘর ছাড়ার পরে যখন রমাপতি ভীষণ রেগে গিয়ে সবার সামনে তাকে ত্যাজ্য কন্যা ঘোষনা করলেন, তখনো শুভেন্দু আপত্তি জানিয়েছিলো।
শুভেন্দু কিন্তু ভুললো না তার দিদিকে। সে বিশ্বস্ত কর্মচারী রামহরি কে মধুছন্দা দেবীর সন্ধান করতে লাগিয়ে দিলেন। অনেক খুঁজে রামহরি যোগাড়ও করে ফেললো তাদের ঠিকানা। সেটাই তার কাল হলো। ঠিকানা যোগাড় করতে গিয়ে রামহরি মুখার্জি বাড়ির এইসব কেচ্ছা জেনে ফেললো। ফলে চাকরি গেলো তারও।
ওদিকে সনত ছিলো অকর্মণ্য প্রকৃতির। কাজকর্ম কিছুই করতো না, বসে বসে খেতো। মধুছন্দা দেবী বাড়ি ছাড়ার সময় অনেক টাকাকড়ি গয়নাগাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো ভেঙেই চলতে লাগলো সংসার। ঘনশ্যামই বরং আনন্দভবন হোমে একটা ড্রাইভারের চাকরি জুটিয়ে সংসার চালাতে লাগলো। পাশাপাশি কাজ করতো একটা গ্যারেজে। সনতের অপদার্থতা ধীরে ধীরে যুবক ঘনশ্যামের প্রতি আকৃষ্ট করে তুললো মধুছন্দা দেবীকে। তখনি খবর পেলো ঘনশ্যাম যে গ্যারেজে কাজ করতো সেটা বিক্রি হবে। তিনি নিজের গয়না বিক্রি করে গ্যারেজটা কিনে নেবার জন্য টাকা দিলেন ঘনশ্যাম কে। ঘনশ্যাম গ্রাম থেকে ডেকে নিলো ছোট ভাই জগন তিওয়ারি কে।
এই গয়না বিক্রি কিন্তু সহ্য হলোনা সনতের। সে অশান্তি শুরু করলো। রোজ অশান্তি হতে লাগলো। ক্রমে সেটা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছালো। তখনি একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হলো সনত। কেউ তাকে আর কোনোদিন দেখেনি। মধুছন্দা দেবী আর ঘনশ্যামের ভিতরে আর কোনো বাঁধা রইলো না। তারা স্বামী স্ত্রীর মতো থাকতে শুরু করলো। সনতের নিরুদ্দেশ হবার দু বছরের মাথায় মধুছন্দা দেবীর কোল আলো করে একটা কন্যা সন্তান এলো। স্বামী নিরুদ্দেশ হবার দুবছর পরে সন্তান এলে সেই সন্তান যে স্বামীর নয়,সেই সময় চিত্তরঞ্জনের ছাব্বিশ নম্বর রাস্তায় এই ঘটনা যে বিস্তর আলোড়ন তুলেছিলো তা মধুছন্দা দেবীর প্রাক্তন বাড়িওয়ালা বেশ পরিস্কার মনে করতে পারলেন।
কিন্তু কোথায় গেলো সনত? তার বাড়ি থেকেও কোনো খোঁজ করা হয়নি, মুখার্জি বাড়ি থেকে খোঁজ করার তো প্রশ্নই ওঠেনা। সবাই জানলো ঝগড়া করে নিরুদ্দেশ হয়েছে সনত। কিন্তু পাপ কখনো চাপা থাকে না। আর মদের নেশার মতো এতো খারাপ জিনিস আর নেই। পেটে বেশি পরিমান পড়লে অনেক গোপন কথাই বেরিয়ে আসে বমির মতো। আমার ড্রাইভার মদনকে পাঠিয়ে সেই টোপই দিয়েছিলাম আমি। সে ও ড্রাইভার, তাই জগনের গ্যারেজে গাড়ি সারানোর বাহানায় তার সাথে বন্ধুত্ব করতে দেরি হয়নি মদনের। তারপরে মদের ঠেকে একটু ভালো মদ বেশি পরিমান খাইয়ে দিতেই অনেক খবর বেরিয়ে এসেছে। পরিস্কার খবর নয়, একটু আভাস মাত্র। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট।
আমি নিজে গিয়ে দেখে আসি বাড়িটা। কোথায় খুঁজতে হবে বলে দিতেই বাকী কাজ করেছেন ইন্সপেক্টর বাসুদেব গড়াই। পাঁচিলের পাশের এক পরিত্যক্ত পাতকুয়ো থেকে উদ্ধার হয়েছে নরকঙ্কাল। সনতের মা এখনো জীবিত আছেন। আশাকরি তার সাথে ডিএনএ ম্যাচ করালেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে যে সনত নিরুদ্দেশ হয়নি, ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে তাকে। এখন খুনটা মধুছন্দা দেবী নিজে করেছিলেন, না কি ঘনশ্যাম অথবা জগন, সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব দুই থানার মহিলা এবং পুরুষ পুলিশ কর্মীদের। শুনেছি থানায় এতো খাতির যত্ন করা হয় যে কিছুই গোপন থাকে না।
একনাগাড়ে কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে তমাল। বললো, একটু চায়ের ব্যবস্থা হলে মন্দ হতো না। দুজন মানুষ আর কখনো মুখার্জি বাড়ির চা খাবেন কি না ঠিক তো নেই? কথাটা শুনে মৌপিয়া উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলো ডাইনিংয়ে।
মধুছন্দা দেবী যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। এমনকি তিনি যে নিশ্বাস নিচ্ছেন সেটাও ভালো করে ঠাহর না করলে বোঝা যায় না। ঘনশ্যাম কিন্তু জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তমালের দিকে। দেখলে মনে হয় যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর। অল্প সময়ের ভিতরেই চা এসে গেলো। পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে তমাল আবার শুরু করলো।
- এতোক্ষণ যা বললাম, সেসব খবর মুখার্জি বাড়িতে না পৌঁছালেও মধুছন্দা দেবীর মা হবার খবর কিন্তু ঠিকই পৌঁছালো। বাচ্চার বাবা কে, সেটাও অনুমান করতে পারলো তারা। শুভেন্দু বাবু আর ঠিক থাকতে পারলেন না। একদিন ছুটে গেলেন দিদির কাছে। তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু বাচ্চাটার সাথে মুখার্জি বাড়ির কোনো রকম সম্পর্ক অস্বীকার করলেন তিনি। অনেক বুঝিয়েও লাভ হলো না। মেয়েকে ছাড়া মধুছন্দা দেবী ফিরতে চাইলেন না।
অনেক বুঝিয়ে শুভেন্দু বাবু বাচ্চাটাকে আনন্দভবন বলে একটা হোমে পাঠিয়ে দিতে মধুছন্দা দেবীকে রাজি করালেন। সেখানে বাচ্চার নাম রাখা হলো বন্দনা। পিতার নাম ঘনশ্যাম তিওয়ারি, মা মধুছন্দা তিওয়ারি। শুভেন্দু বাবু বাচ্চাটার সমস্ত রকম দায়িত্ব নিলেন। এমনকি নিজের প্রতিপত্তি খাটিয়ে হোমে তার সুরক্ষার ব্যবস্থা ও করে দিলেন।
তমাল এই পর্যন্ত বলে বন্দনার দিকে তাকালো। দেখলো সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মধুছন্দা দেবীর দিকে। মধুছন্দা দেবী তখন মুখ নীচু করে আছেন। ঘরের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বন্দনার দিকে। এতোদিন যে নিজেকে যার পালিতা কন্যা ভেবেছে, হঠাৎ সে তার আত্মজা জানার পরে কি অবস্থা হতে পারে মেয়েটার মনে, সেটা অনুভব করে বন্দনার জন্য কষ্ট হলো তমালের।
কিন্তু গল্প যে এখনো শেষ হয়নি! তাই তমাল ভাবাবেগ বাদ দিয়ে কর্তব্যে মনোনিবেশ করলো। সে বলতে লাগলো, শুভেন্দু বাবু অনেক চেষ্টা করেছিলো দিদিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বন্দনাকে মুখার্জি বাড়িতে জায়গা দেবেন না, এই ছিলো তার শর্ত। কিন্তু অন্তরের বন্ধন যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত বন্ধন! মধুছন্দা দেবী কিছুতেই বন্দনাকে ছাড়া ফিরতে রাজি হলো না।
মুখার্জি বাড়ির সম্পদ লক্ষ্মী তখন কল্পতরু হয়ে উঠেছেন। সম্পদে ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিয়েছেন। সেই খবর মধুছন্দা দেবীর কানেও পৌঁছালো। কন্যা স্নেহে অন্ধ হলেও প্রকৃতিগত লোভকে তিনি জয় করতে পারলেন না। মনে মনে এই অতুল ঐশ্বর্য ভোগ করার বাসনা জেগে উঠলো। পরিকল্পনা করতে শুরু করলেন তার একান্ত অনুচর ঘনশ্যামের সাথে। ঠিক করলেন শুভেন্দুকে সরিয়ে দিয়ে মুখার্জি বাড়ির সম্রাজ্ঞী হয়ে বসবেন তিনি নিজে।
পরের বার শুভেন্দু বাবুকে সস্ত্রীক যেতে বললেন চিত্তরঞ্জনে। বোধহয় বলেছিলেন যে তিনি বন্দনাকে ছাড়া ফিরে যেতে রাজি। ভালোমানুষ শুভেন্দু এই গভীর চক্রান্তের কিছুই জানতে পারলেন না। স্ত্রীকে নিয়ে দিদিকে ফিরিয়ে আনতে চিত্তরঞ্জনে গেলেন। মধুছন্দা দেবীরা তখন আগের পুরানো বাড়ি ছেড়ে ঘনশ্যাম আর জগনের গ্যারেজের পাশেই একটা বাড়িতে উঠে এসেছেন। সেখানে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া সারলেন তারা। ড্রাইভারকে অন্য কোনো কাজে পাঠিয়ে জগনকে নিয়ে ঘনশ্যাম কারগরি ফলালো গাড়িতে। তারপরে কোনো বাহানায় একাই ফেরত পাঠালেন তাদের। ফেরার পথে হাই রোডে উঠে গাড়ি গতি তুললেই ব্রেক এবং স্টিয়ারিং ফেল করে সোজা ধাক্কা মারে ছুটন্ত লরির সাথে। সাথে সাথে মারা যান শুভেন্দু বাবু আর তার স্ত্রী এবং ড্রাইভার।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো রাহুল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তমাল তুমি যা বললে, তা কি সত্যি না তোমার অনুমান? তমাল তাকে শান্ত হতে বললো। রিনি তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সে বসলো না। দাঁড়িয়ে রক্তচক্ষু মেলে তাকাতে লাগলো মধুছন্দা এবং ঘনশ্যামের দিকে। তমাল বললো, যা বললাম, সব সত্যি। আমি কয়েকদিন আগে কুলটি যাবো বলে চিত্তরঞ্জন গিয়েছিলাম। আগে থেকে জানালে জগনকে ধরা যেতো না। সেখানে জগনকে গ্রেফতার করেছেন ইন্সপেক্টর গড়াই। সে সব কিছু স্বীকার করেছে। জগন এখন এই বাড়ির নীচেই পুলিশের গাড়িতে অপেক্ষা করছে, ইচ্ছা হলে ডেকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। রাহুল চিৎকার করে বললো, আমিও দেখবো এরা ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচে কিভাবে। এতো বড় নৃসংস কাজ মানুষ কিভাবে করতে পারে?
তমাল বললো, শুধু আপনার বাবা নন, আপনাদের তিন ভাইবোনকেও সরিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। মনে করুন মৌপিয়ার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়া, অদিতির ফুড পয়জনিং, আপনার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট, সবই এদের কীর্তি। সেগুলোতে সফল না হয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন মধুছন্দা দেবী। রাজীবকে খুন করে আপনাকে খুনের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া। সেই চেষ্টায় সফল হলে এর পরে পালা আসতো অদিতি আর মৌপিয়ার।
একজন মাতৃসমা নারীর এমন কুটিল মনের পরিচয় পেয়ে ভাষা হারিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো রাহুল। সুরেশ বাবু বললেন, আপনি বলুন তমাল বাবু, আমরা পুরোটা শুনতে চাই। আপনি কিভাবে এদের সন্ধান পেলেন?
তমাল বললো, ধর্মের চাকা ঘোরানোতে আপনার অবদান কম নয় সুরেশ বাবু। আপনিই প্রথম হিসাবের অসঙ্গতি ধরতে পেরেছিলেন। সেখান থেকেই এদের শেষের শুরু। শুভেন্দু বাবুকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করার পরে মুখার্জি বাড়ির শুভার্থী হয়ে এসে জুড়ে বসেন মধুছন্দা দেবী। শুভেন্দু বাবু দিদির কথা বাড়িতে আলোচনা করতেন না। তাই অন্য সদস্যরা বন্দনার কথা বা তলে তলে এতো কিছু ঘটে যাওয়ার আভাসটুকু পর্যন্ত পায়নি। পিসি ফিরে এসে সংসারের এবং ব্যবসার হাল ধরেছে বলে অদিতি মৌপিয়া এবং রাহুল বেশ নিশ্চিন্ত ছিলো। মা কে হারিয়ে মাতৃসমা পিসিকেই আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছিলো তারা।
পিসি কিন্তু তাদের আপন করে নিলো না। তার অন্তরের বন্ধন অটুট রইলো একমাত্র বন্দনার প্রতি। নাটক সাজিয়ে নিজের মেয়েকেই দত্তক নিলেন তিনি। কিন্তু খল চরিত্র বেশিদিন উৎপাত না করে থাকতে পারে না। এই পাপের ভাগীদার জগন শুরু করলো ব্ল্যাকমেইলিং। সনত এবং শুভেন্দু বাবুর খুনের কথা সে জানতো। তবে আমার মনে হয় এই কাজে জগনের সাথে ঘনশ্যামও যুক্ত। মধুছন্দা দেবী ফিরে এসেই রাণী হয়ে বসলো। অথচ তার ভাগীদার ঘনশ্যামকে ফিরিয়ে আনলো ড্রাইভার করে। কেউ জানতো না তাদের সম্পর্কের কথা। যারা জানতো তারা আর বেঁচে নেই। তার বাড়িতে নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে ঘনশ্যামকে ড্রাইভারর্স কোয়ার্টারেই রাখতে হলো। এতে অপমানিত হলো ঘনশ্যাম। বদলা নিতে ভাইয়ের সাথে ব্ল্যাকমেইলিং এর খেলায় নামলো সে।
মাসে মাসে একটা বড় অংকের টাকা ঘনশ্যাম মধুছন্দা দেবীর কাছ থেকে নিয়ে পাঠাতে লাগলো জগনের অ্যাকাউন্টে। আয় ব্যয়ের হিসাবে গড়মিল হতে লাগলো। সেই গড়বড় ধরে ফেললেন অভিজ্ঞ অ্যাকাউন্টেন্ট সুরেশ বাবু। ফলে চোর অপবাদ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করে রাজীবকে বহাল করা হলো।
রাজীবের কাছেও গোপন থাকলো না সেটা। কিন্তু সুরেশ বাবুর মতো এই পরিবারের একান্ত অনুগত ছিলো না সে। তার কৌতুহলী মন আসল কারণ খুঁজতে শুরু করলো। যেভাবেই হোক জেনে গেলো রাজীব। একজন অ্যাকাউন্টেন্ট এর কাছে ব্যাংক স্টেটমেন্ট যোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। শুধু ব্ল্যাক মেইলিং নয়, শুভেন্দু বাবুর অ্যাক্সিডেন্টও যে সাজানো সেটাও সে জেনে যায়। আমি সেটা জানতে পারি তার কম্পিউটার থেকে আর তার নিজের লেখা একটা ডায়েরি থেকে।
গুপ্ত কথা জানার পরে রাজীবও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়লো। সেও শুরু করলো ব্ল্যাকমেইলিং। ডায়েরিতে প্রথমে সে জগনের ব্ল্যাকমেইলিং এর র্যানসাম দেওয়ার তারিখ গুলো লিখেছিলো। তারপর নিজে কবে কবে কতো টাকা নিয়েছে সেটাও ডায়েরিতে শেষের দিকে লিখে রেখেছে। কিন্তু মাঝেখানে একটা পাতায় একটা তারিখ লেখা দেখে আমি খোঁজ নিয়ে জানি যে সেটা শুভেন্দু বাবুর অ্যাক্সিডেন্টের তারিখ। তখনই বুঝে যাই রাজীব কি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছিলো মধুছন্দা দেবীকে। কারণ শুধু তছরুপের জন্য ব্ল্যাকমেইল করলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিলেই চুকে যেতো, টাকা দেবার দরকার হতো না।
মধুছন্দা দেবী পড়লেন বিপদে। রাহুল ফিরে আসার পরে ব্যবসার বেশির ভাগ দায়িত্ব তার হাতে। এতো টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে লাগলেন তিনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো তার। তার উপরে নিজের মেয়ের সাথে রাজীবের শারীরিক সম্পর্কের খবর কানে যেতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মরতে হবে রাজীবকে। খুনের একটা নেশা আছে। সফল ভাবে দু দুটো খুন করে ধরা না পড়ে সাহস আর অহংকার বেড়ে গেছিলো মধুছন্দা-ঘনশ্যাম জুটির। তাই আরও একটা খুনের পরিকল্পনা করলো তারা। সাথে বাই ওয়ান গেট ওয়ান অফারের মতো রাহুলকে জড়িয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা করলেন।
সবই ঠিকঠাক চলছিলো। খুনের হাতিয়ার, যোগাড় করে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুযোগের। কিউরিও দোকান থেকে ঘনশ্যাম কিনে আনলো অবিকল একই রকম একজোড়া ছুরি। দোকানদার ঘনশ্যামের ছবি দেখে সনাক্ত করেছে।
সুযোগ এলো, কিন্তু ভাগ্য রাজীবকে সহায়তা করে মধুছন্দা দেবীর প্ল্যান ভেস্তে দিলো। পিসি হয়ে বাপ মরা ভাইপোর জন্য কিছু না করলে খারাপ দেখায় তাই পুলিশের কাছে রাহুলের বিরুদ্ধে সব প্রমাণ তুলে দিয়ে ভাব করলেন তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত চান। এই সময়ে এলাম আমি। আমার বয়স দেখে উনি আরও একটু ভালো পিসি সাজবেন বলে ঠিক করলেন। ভাইপো কে বাঁচাবার জন্য আমাকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলেন। নিয়োগ করলেন আমাকে। এবং নিজের কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিলেন তখনই। আমার ট্র্যাক রেকর্ড জানলে হয়তো এই ভুল করতেন না।
তমাল থামতেই মৌপিয়া জিজ্ঞেস করলো, বন্দনা যে পিসিরই মেয়ে সেটা তুমি কিভাবে জানলে? তমাল বললো, প্রথম সন্দেহ হয় তার কথার অসংগতি দেখে। তিনি বলেছিলেন বন্দনাকে প্রথম দেখেন ঘনশ্যাম হোম থেকে নিয়ে আসার পরে। কিন্তু বন্দনা বলেছে সে ছোট বেলা থেকেই মাঝে মাঝে মধুছন্দা দেবীর বাড়িতে যেতো ঘনশ্যামের সাথে। তারপরে একদিন আমি বন্দনার ঘরে তার খুব ছোটবেলার একটা ছবি দেখতে পাই, হোমে তোলা। সেই একই বয়সের একটা ছবি মধুছন্দা দেবীর ঘরেও আছে। তখন থেকেই সন্দেহ হয়, কিন্তু শিওর হই হোমের ফাইল ঘাটতে গিয়ে। সেখানে মধুছন্দা দেবীর কোলে শিশু বন্দনার একটা ছবি পাই, পাশে ঘনশ্যাম ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়ানো। হয়তো কোনো জন্মদিনে বাবা মায়ের সাথে বন্দনার ছবি ওটা। সেই ছবিটা চুরি করি আমি, সেটা এখন আমার কাছে। বলেই নিজের পকেট থেকে ছবিটা বের করে টেবিলে রাখলো সে। রাখল রায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো তমাল, কি রাখাল বাবু, ছবিটা হোমের ফাইলে ছিলো তো? সে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
তমাল বললো, এই একই ছবি, শুধু মধুছন্দা দেবীকে কেটে বাদ দিয়ে নিজের ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছিলো ঘনশ্যাম, সেটা ইনস্পেকটর ঘোষ একটু আগেই তার ঘর থেকে নিয়ে এসেছেন। আর কিছুই বুঝতে বাকী থাকে না। তমাল থামতেই ইনস্পেকটর ঘোষ বাঁধানো ছবিটা তুলে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন।
অদিতি প্রশ্ন করলো আচ্ছা তমালদা, তুমি বললে বন্দনা পিসির মেয়ে, তাহলে পিসি বন্দনাকে দত্তক নিতে গেলো কেন? পিসির উত্তরাধিকারী তো বন্দনা এমনিতেই ছিলো?
তমাল বললো, দেখো অদিতি মধুছন্দা দেবী একজন ধুরন্ধর মহিলা। তিনি সবদিক বিচার করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জানতেন যে তিনি রমাপতি বাবুর অবৈধ সন্তান। ভারতের সংবিধানের ১৯১৫ সালের প্রণোদিত আইনে অবৈধ সন্তানও বাবা মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। কিন্তু ১৯৫৫ এর সংশোধিত ধারা ১৬(৩) অনুযায়ী অবৈধ সন্তান শুধু মাত্র বাবা মায়ের উপার্জিত ধনের উত্তরাধিকার বহন করে। তোমাদের পরিবারের সম্পত্তির সিংহভাগ উপার্জন করেছে তোমার বাবা শুভেন্দু মুখার্জি। একদিন তোমাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম নিশ্চয়ই মনে আছে? কিন্তু মধুছন্দা দেবী তো রমাপতি বাবুর অবৈধ সন্তান, শুভেন্দু বাবুর অর্জিত সম্পত্তিতে তার কোনো অধিকার নেই।
যদিও সেই পরিমানটাও কম নয়। পৈতৃক বাড়ি এবং আসানসোলের দোকান গুলো তোমার ঠাকুরদার আমলে করা। সেগুলোতে তার অধিকার আছে, যা পরবর্তীকালে বন্দনা পাবে। কিন্তু এখানেও একটা প্রবলেম আছে। বন্দনা আবার সনত বাবু এবং মধুছন্দা দেবীর বৈধ সন্তান নয়। সে ঘনশ্যাম আর মধুছন্দা দেবীর অবৈধ সন্তান। কিন্তু মধুছন্দা দেবীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ছাড়া নিজের উপার্জিত সম্পত্তি কিছু নেই। তিনি পড়ে গেলেন ধন্ধে। যদি বন্দনার জন্ম পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে তো সে কোনো সম্পত্তি পাবে না অবৈধ সন্তান হবার কারণে। সেই জন্যই নিজের সন্তানকেই মধুছন্দা দেবী দত্তক নিয়ে বৈধ বানিয়ে নিলেন যাতে মুখার্জি পরিবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা কিছু পাবেন, পুরোটাই যেন বন্দনা পায়।
গার্গী বললো, বাপরে! উনি এতো কিছু ভেবেছেন? তাহলে বন্দনা তো এই পরিবারের সম্পত্তির একটা অংশ পাবে, কি বলো?
" না, এই পরিবারের এক কানাকড়িও পাবে না। মধুও পাবে না, তার মেয়েও পাবে না!" তমাল উত্তর দেবার আগেই একটা জোরালো নারী কন্ঠ শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন সুলতা দেবী। তমাল বললো, আইন কিন্তু অন্য কথা বলছে পিসি। সুলতা দেবী বললেন, এতোক্ষণ আমি সব কথাই শুনছিলাম। মধু সম্পত্তি তখনই পাবে যখন সে এই পরিবারের সন্তান হবে, বৈধ বা অবৈধ। কিন্তু সে এই পরিবারের সন্তানই নয়। রমাপতি বাবু তার বাবা নয়।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম