23-05-2025, 08:16 PM
ঘরের সবাই যেন জমে পাথর হয়ে আছে। একের পর এক নতুন তথ্যে সবাই হতচকিত হয়ে পড়েছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের গোপন সংবাদ সবার সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সংকোচও যোগ হয়েছে তার সাথে। বেশ কিছুক্ষণ পরে কথা বললো ইনস্পেকটর গড়াই। তিনি বললেন, অপরাধের হাতিয়ার যখন অদিতির কাছে পাওয়া গেছে, এবং সেই যখন ভিকটিম কে এতো রাতে ডেকে এনেছিলো, তখন প্রবলেমটা কোথায়?
তমাল উত্তর করলো, প্রবলেম আছে ইনস্পেকটর গড়াই। হাতিয়ার এক রকম দেখতে হলেই যে তা খুনের চেষ্টার হাতিয়ার হবে, তা কিন্তু নয়। পিস্তলের গুলিতে খুন তো কতোই হয়, তার মানে তো সব পিস্তল ব্যবহারকারী খুনি নয়? এই হাতিয়ারই আমার মনে প্রথম সংশয় তৈরি করে। রাহুলের উপহার পাওয়া নেপালী ছুরিটা অপরাধে ব্যবহার হবার কারণ কেউ ইচ্ছা করে খুনের দায়টা রাহুলের উপরে চাপাতে চেষ্টা করেছিলো। অপরাধী একটা মস্ত ভুল করে এখানেই। সে ভেবেছিলো রাহুল ছুরি জোড়া নেপাল থেকে আনে, তাই আসানসোলে এই ছুরি পাওয়া যাবে না বেশি। বৈশিষ্ট্য যুক্ত ছুরি, যে কেউ দেখলেই বলে দেবে ওটা রাহুলের ছুরি। সুতরাং ঠিক ওই রকম একটা ছুরি যোগাড় করতে পারলেই রাহুলকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে।
অপরাধী ঠিক তাই করলো। রাহুলের ছুরি দুটো থেকে একটা ছুরি সরানোর চেষ্টা হয়তো করেছিলো সে, কিন্তু তার আগেই রাহুল একটা ছুরি অদিতিকে দিয়ে দিয়েছিলো কোনো কাজে। অন্য ছুরিটাও পাওয়া গেছে রাহুলের বাইয়ের তাকের পিছনে ধুলো মাখা অবস্থায়। অর্থাৎ কেউ সেটা সম্প্রতি ব্যবহার করে সেখানে রেখে দেয়নি, বরং অসাবধানতায় হারিয়ে গিয়ে বহুদিন সেখানেই পড়ে আছে সেটা। এই বাড়িতেই আমার একজন গোপন সহকারী সেটা খুঁজে পায়। তাহলে একই রকম দেখতে আর একটা ছুরি এলো কোথা থেকে?
অপরাধী আসানসোলের এক কিউরিও শপ থেকে কিনে আনে ঠিক ওই রকম দেখতে এক জোড়া ছুরি। মজার কথা হলো ছুরিটা নেপালী হলেও আসানসোলে দুস্পাপ্য নয়, আমিও এক জোড়া কিনেছি সেই দোকান থেকে। এবং আমি ছাড়াও আর কে কিনেছিলো সেটাও জানতে পারি দোকানদারের কাছ থেকে। দোকানদার ছবি দেখে সনাক্ত করেছে।
কিন্তু অপরাধী যেটা জানতো না, তা হলো প্রত্যেকটা ছুরি হুবহু এক রকম দেখতে হলেও ছুরির বাটের নীচে সিরিয়াল নাম্বার খোদাই করা আছে। ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝাই যায়না এতো ছোট নাম্বার গুলো। আর নাম্বার গুলো জোড়ায় জোড়ায় লেখা। যেমন রাহুলের কাছে যে ছুরি দুটো ছিলো, তার সিরিয়াল নাম্বার হলো ছিয়ানব্বই এবং সাতানব্বই। আমি যে ছুরি দুটো কিনে আনি, সেই ছুরি দুটোর নাম্বার হলো একশো বাইশ এবং একশো তেইশ। কিন্তু রাজীবকে যে ছুরি দিয়ে খুন করার চেষ্টা করা হয়, সেটার নাম্বার হলো দুশো তেরো।
এটা থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় অপরাধী নিজের অপরাধ রাহুল বাবুর উপরে চাপাতে চেয়েছিলো। প্রশ্ন হলো, কেন? শুধু অপরাধ ঢাকার জন্য নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? এই পর্যন্ত বলে তমাল এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে নিয়ে কয়েক ঢোক জল খেলো। ঘরের ভিতরে নিরবতা নেমে এলো।
তমাল আর কোনো কথা বলছে না দেখে অধৈর্য্য হয়ে উঠছে সবাই। এতোক্ষণ সবাই পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিলো। এবারে ঘরের ভিতরে নড়াচড়া শুরু হলো। মৃদু গুঞ্জন ও টের পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত সবাই পাশের ব্যক্তির সাথে সম্ভাব্য খুনি কে হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করছে।
এবারে ধৈর্য্য হারালো মধুছন্দা দেবী। তিনি বললেন, সবই তো বুঝলাম। এও হতে পারে সেও হতে পারে, কিন্তু আসলে খুনী কে সেটা কি নিশ্চিত হতে পেরেছো তুমি তমাল? নাকি শুধুই টাকাটা নিয়ে সময় নষ্ট করছো? আমার বয়স হয়েছে, এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হয়। ওষুধ খাবার আর চোখে ড্রপ দেবারও সময় হয়ে গেছে।
তমাল জলের বোতল হাতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর বন্দনার দিকে ফিরে বললো, তুমি মায়ের আই ড্রপটা এনে দাওতো। তারপরে মধুছন্দা দেবীর দিকে ফিরে বললো, আর একটু অপেক্ষা করুন, সব জানতে পারবেন। বন্দনা প্রায় ঝড়ের গতিতে চোখের ওষুধ নিয়ে এলো। ঢাকনা খুলে ওষুধটা মধুছন্দা দেবীর চোখে দিতে গেলে তমাল সেটা হাত থেকে নিয়ে মধুছন্দা দেবীর হাতে দিয়ে বন্দনাকে বললো, আমার ঘরে টেবিলের উপরে সেই ডায়েরিটা আছে নিয়ে এসো তো? উনি নিজেই দিয়ে নেবেন ড্রপ।
মধুছন্দা দেবী বন্দনাকে আবার কাজে পাঠানোতে বিরক্ত হলেন। মুখ ব্যাজার করে নিজের দু ফোঁটা ড্রপ নিজের চোখে ঢেলে নিলেন। তারপর কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তমালের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলো কে রাজীবকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো? বুঝতে পেরেছো, নাকি পারোনি?
তমাল বললো, বুঝতে তো দুদিন পরেই পেরেছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত হলাম আপনি আমাকে চেকটা সই করে দেবার পরে। আর নিসন্দেহ হলাম এই মাত্র।
মধুছন্দা দেবী যেন থমকে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কি বলতে চাইছো পরিস্কার করে বলো। তমাল এবারে ঘরের অন্যদের দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা এই চেক সই করা আর চোখে ড্রপ দেওয়ার ভিতরে আপনারা কোনো অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছেন? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো কিন্তু কেউ কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ পরে ইন্সপেক্টর ঘোষ বললেন, উনি দুটো কাজই বা হাতে করলেন।
তমাল হাততালি দিয়ে উঠলো। সাবাস ইন্সপেক্টর ঘোষ, এই জন্যই বলে পুলিশের চোখ। একদম ঠিক বলেছেন। মধুছন্দা দেবী বাহাতি। ওনার প্রায় সব কাজই বন্দনা করে দেয়, তাই কারো চোখে পড়েনা এটা, কিন্তু এই খুনের চেষ্টায় এটা খুব বড় একটা প্রমাণ। ফরেনসিক রিপোর্ট পরিস্কার বলছে ছুরির আঘাতের ধরন এবং গতিপথ থেকে নিশ্চিত বলা যায় অপরাধী ছিলো বাহাতি। এখানে ডঃ চৌধুরী আছেন, তিনি আমার যুক্তি সমর্থন করবেন বলেই আমার ধারণা। তিনিই প্রথম এ বিষয়ে আলোকপাত করেন আমার কাছে।
অর্থাৎ অন্য কেউ নয়, রাজীবকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন আপনি, শ্রীমতি মধুছন্দা মুখার্জি! টাকার লোভে চেকটা আপনাকে দিয়ে সই করাইনি আমি ম্যাডাম, সেই জন্য ওটায় আমার নামও লেখাইনি। আমি আপনার মতো লোভি নই!
ঘরে বোমা পড়লেও বোধহয় এতো অবাক হতো না কেউ। কয়েক মুহুর্ত পরে হেসে উঠলেন মধুছন্দা দেবী। বললেন, আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো, তোমার মতো অযোগ্য লোককে তদন্তের ভার দেওয়াই আমার ভুল ছিলো। আমি খুনের চেষ্টা করলে নিজেই তোমাকে অপরাধী খোঁজার ভার দেবো কেন?
তমাল বললো, ঠিক এই কারণেই দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমি অনভিজ্ঞ শখের গোয়েন্দা, আপনার মতো ধুরন্ধর মহিলার টিকিও ছুঁতে পারবো না। আর নিজেই নিয়োগ করেছেন বলে আমি আপনাকে সন্দেহও করবো না। তার উপর এক লক্ষ টাকার লোভ তো আর সোজা কথা নয়! তবে আপনার জানা উচিৎ বেশিরভাগ অপরাধীই ঠিক এই ভুলটা করে, পুলিশ এবং গোয়েন্দা কেউই বন্ধু হয়না, তাদের যতোই ঘুষ দেবার চেষ্টা করেন না কেন?
এতোক্ষণে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে রাহুল জিজ্ঞেস করলো, আমি তো কিছুই বুঝলাম না ফরেনসিকের ব্যাপারটা। আর পিসির কি লাভ রাজীবকে খুন করে? আর উনি তো চোখেও ভালো দেখতে পাননা?
তমাল বললো, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি রাহুল বাবু। এখনি এতো অবাক হবেন না। হতবাক হবার এখনো অনেক কিছু বাকী আছে, সময় মতো জানতে পারবেন। ফরেনসিকের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি এখন। মধুছন্দা দেবী রাজীবকে খুনই করতে চেয়েছিলেন। ওনার চোখের সমস্যাটা ওনার একটা জব্বর অ্যালিবাই। আমি ডঃ চৌধুরীর সাথে কথা বলে জানলাম যে রোগটা নাম ম্যাকুলার ডিজেনারেশন। এই রোগে রুগী কখনো বেশ পরিস্কার দেখতে পান, আবার কখনো ঝাপসা। সব সময় যে কম দেখেন তা কিন্তু নয়।
সেইদিন রাতে রাজীবকে যে অদিতি ফোন করেছিলো সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু যেটা বলিনি, সেটা হলো অদিতির কল করার দশ মিনিট আগে উনি নিজেও রাজীবকে কল করেন। সম্ভবত নীচে তার ঘরে আসতে বলেন। কেন, সেটা আমি অনুমান করতে পারি, সময় মতো বলবো। শুধু এটুকু বলি, রাজীব মধুছন্দা দেবীকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো। সেই লেনদেন বিষয়ক কথা বলতেই সম্ভবত এসেছিলো রাজীব। রাজীবের লোভ দিন দিন বেড়েই উঠছিলো, তাই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন মধুছন্দা দেবী। তার একজন সঙ্গীও আছে, চিরসঙ্গীও বলা যায়, তার কথা পরে বলছি।
মধুছন্দা দেবীর সাথে কথোপকথন এর মাঝেই সম্ভবত অদিতির কলটা আসে রাজীবের কাছে। মধুছন্দা দেবী কোনো ভাবে স্ক্রিনে অদিতির নামটা দেখে ফেলেন এবং তখনি ঠিক করে ফেলেন আজই সঠিক সময় পথের কাঁটা সরিয়ে দেবার। রাজীব বেরিয়ে যেতেই তিনি কল করেন তার অপরাধ সঙ্গীকে। দুজনে মিলে প্রায় একটা নিশ্ছিদ্র প্ল্যানও বানিয়ে ফেলেন। রাজীব চলে যায় অদিতির সাথে দেখা করতে। কি রাজীব, আমার অনুমানে কোনো ভুল আছে কি?
রাজীব এতোক্ষণ চুপ করে মাথা নীচু করে ছিলো। এবারে মুখ তুলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বললো, আপনি সম্পূর্ণ সঠিক বলছেন। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। ব্ল্যাকমেইলিং বন্ধ না করলে বিপদ হবে আমার, সেটাও বলেন। তখনি কল করে অদিতি। আমি উপরে চলে যাই অদিতির সাথে কথা বলতে।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, অদিতির কল আসার পরে তুমি ফোনে কিছু বলেছিলে কি? রাজীব বললো, না তো,শুধু বলেছিলাম,আসছি।
এগজ্যাক্টলী! ওই টুকুই যথেষ্ট ছিলো। অর্থাৎ তুমি যে তখনি নিজের ঘরে না গিয়ে তিনতলায় অদিতির কাছে যাবে এটা মধুছন্দা দেবী বুঝে যান। সাথে সাথেই উনি কল করেন নিজের দোসরকে। ছুরি আগেই যোগাড় করা ছিলো, দরকার ছিলো একটা আবরণ যা শাড়িতে রক্ত লাগা আটকাতে পারে। সেটা সঙ্গীই যোগাড় করে দেয়। এক্ষেত্রে সেটা ছিলো একটা মেরুন শার্ট, ওনার দোসরের।
এবার আপত্তি জানালো ইন্সপেক্টর গড়াই। তিনি বললেন, তুমি বলছো যে একজন সঙ্গী ছিলো,সঙ্গিনী নয়, অর্থাৎ পুরুষ। তাহলে সেই সঙ্গী আঘাত না করে উনি মহিলা হয়ে কেন করলেন?
তমাল বললো, আমি নিজেও এটা নিয়ে চিন্তা করেছি ইনস্পেকটর গড়াই। এর কারণ হলো, তিন তলা থেকে রাজীবকে আবার দোতলায় নিয়ে আসতে একটা ডাইভারশন দরকার ছিলো। কিছু একটা না শুনলে রাজীব নীচে আসতো না। কোনো জোরালো শব্দ টাইপের কিছু। কারণ নাম ধরে ডাকলে অদিতি সাক্ষী রয়ে যেতো। জোরালো শব্দ তৈরি করার ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীই বেশি উপযুক্ত ছিলো। তাই ছুরি চালানোর দায়িত্ব মধুছন্দা দেবী নিজের হাতে তুলে নেন।
মধুছন্দা দেবী এবং তার সঙ্গী দোতলায় কান পেতেই ছিলো। রাজীব অদিতির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পায়। সে কৌতুহলি হয়ে দোতলায় নেমে আসে। মধুছন্দা দেবী সম্ভবত নিজের দরজার পর্দার পিছনে লুকিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গী কিভাবে শব্দ করেছিলো তা জানা যায়নি। হয়তো এক তলার ল্যান্ডিংয়ে লাফিয়ে নামে। রাতে সেটা যথেষ্ট জোরে শব্দই ছিলো, আবার এতো জোরে ছিলো না যাতে অন্যেরা শুনতে পায়। মনে রাখতে হবে এই শব্দের কথা রাজীব ছাড়া কিন্তু কেউই বলেনি।
রাজীব নেমে আসে, কিন্তু দোতলায় কাউকে দেখতে পায়না। অথচ সে স্পষ্ট শুনেছে শব্দটা। এমনিতেই তার কৌতুহল বেশি, সে ঝুঁকে পড়ে শব্দের উৎস সন্ধান করতে থাকে। মধুছন্দা দেবীর জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয়না। ঝুঁকে রয়েছে রাজীব। এই অবস্থায় ছুরি মারার জন্য তার পক্ষে আদর্শ উচ্চতা। তিনি পর্দার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে গেঁথে দিলেন ছুরিটা রাজীবের পিঠের বা দিকে, হৃদপিণ্ড বরাবর। মনে রাখতে হবে মধুছন্দা দেবীর ঘরটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বা দিকে। অর্থাৎ ঝুঁকে থাকা রাজীবের ডান দিক থেকে এসেছিলেন তিনি।
এক আঘাতেই রাজীবের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো যদি না নীচে কিছু দেখতে না পেয়ে সে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াতো। টাইমিংটাই বাঁচিয়ে দিলো তাকে। একে তার পিঠের উচ্চতা বেড়ে গেলো, তার উপর অবস্থান আনুভূমিক থাকে লম্ব হয়ে গেলো। তবুও বাঁচতে পারতো না যদি আততায়ী ডানহাতি হতো। আমি ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ডঃ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে ছুরিটা পিঠের বাদিকে ঢুকে পাঁজরে ধাক্কা খেয়ে ডানদিকে সরে শিরদাঁড়ায় আটকে যায়। ভেবে দেখুন, ডানহাতি কেউ মারলে ছুরি ঢোকার পরে বাদিকে যেতো এবং হৃদপিণ্ড বিদ্ধ করতো। বাহাতি কেউ আঘাত করেছিলো বলেই ডানদিকে বেঁকে গেছিলো গতিপথ, তাই বেঁচে যায় রাজীব। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, মধুছন্দা দেবী ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ বাহাতি নেই।
তমাল একটা বিরতি নিতেই আবার গুঞ্জন উঠলো ঘরে। এবার একটু জোরেই। সত্যের আকস্মিক অভিঘাত সবাইকে চমকিত করেছে। মধুছন্দা দেবী তখন মরিয়া হয়ে বললো, এসব মনগড়া গল্প শুনিয়ে তুমি কোর্টে কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। আমার উকিল দু দিনেই আমাকে বের করে আনবে। তমাল হেসে বললো, কোর্টে প্রমাণের দায়িত্ব তো আমার নয় ম্যাডাম, সেটা ইন্সপেক্টর ঘোষের কাজ। উনি কিন্তু একটু আগে শুধু শুধু বাইরে যাননি, আপনার দোসরের ঘর খানাতল্লাশি করতে গেছিলেন। কি কি পেয়েছেন, তার কাছেই শুনুন নাহয়? তমাল ইন্সপেক্টর ঘোষের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, একটা মেরুন শার্ট, তাতে রক্তের পুরানো দাগ। অবশ্য ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট কার রক্ত সেটা বের করে ফেলবে। একটা নেপালি ছুরি পাওয়া গেছে। মিঃ তমালের কথা মতো নীচের নাম্বারটা দেখেছি আমি, দুশো বারো। তমাল বললো আর যে ছবিটা দেওয়ালে টাঙানো ছিলো, সেটা এনেছেন তো মিঃ ঘোষ? ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ তমালের প্রশ্নে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। তমাল বললো, ওটার প্রয়োজন হবে একটু পরে। মধুছন্দা দেবীর চোয়াল ঝুলে পড়লো এবার।
ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষারত মহিলা কনস্টেবল কে ডাকলেন। তাকে মধুছন্দা দেবীকে নিয়ে যেতে বলতেই তমাল বাঁধা দিলো। বললো, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান ইনস্পেকটর ঘোষ। গল্প যে সবে শুরু! এখনো যে অনেক বাকী। ওনাকে যে লাগবে এই রঙ্গমঞ্চে। শুভ কাজটা আর একটু পরেই করুন। আপনার কেসটা আরও পোক্ত হতেও পারে। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতেও তো পারে?
এবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মধুছন্দা দেবী। বললেন, না আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। নিয়ে চলুন আমাকে। বেশ করেছি মেরেছি! দু পয়সার কর্মচারী দিনের পর দিন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে যাবে আর আমি সেটা সহ্য করবো? নিয়ে চলুন আমাকে, আমি যা বলার থানায় গিয়ে আমার উকিলের সামনে বলবো। শহরের সেরা উকিল অ্যাপয়েন্ট করবো আমি। দেখি আমাকে এই সামান্য কেসে ক'দিন আটকে রাখে?
তমাল জিভ দিয়ে চুক চুক করে আওয়াজ করে বললো, এহ্ হে! কেসটা খুব সামান্য হয়ে গেলো, তাই না? তা বলে যান রাজীব আপনাকে ব্ল্যাকমেইল কেন করছিলো? কি এমন গোপন কথা জানতে পেরেছিলো সে, সেটা তো বলে যান? মধুছন্দা দেবী গজগজ করতে করতে বললো, আমি আমার উকিলের উপস্থিতি ছাড়া আর একটা কথাও বলবো না।
তমাল বললো, আরে আপনাকে তো এখনো অফিশিয়ালি গ্রেফতারই করা হয়নি? উকিল তো পাবেন গ্রেফতার হবার পরে। ততোক্ষণ আমার গল্পটাই নাহয় শুনে যান। আমি তো পাতি গোয়েন্দা, তাই ভুল ভ্রান্তি হলে ধরিয়ে দেবেন, কেমন?
তমাল এবারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘরের মাঝখানে বসলো। তারপর বলতে শুরু করলো।
এই মুখার্জি বাড়ি একটা আলিবাবার গুহার মতো। যেখানেই চিচিং ফাঁক বলেছি, সেখানেই রহস্য বেরিয়ে এসেছে। মূল গল্পটার শুরু হয়েছিলো বছর পঞ্চান্ন আগে। যখন রমাপতি মুখার্জি বলে একজন মানুষ তার বন্ধু সুরেশ চাকলাদার কে সঙ্গে নিয়ে নতুন ব্যবসা খোঁজার জন্য দুমকার পথে যাত্রা করে। তারা দুজন কারা, নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? রমাপতি হলেন রাহুলের পিতামহ আর সুরেশ বাবু তো এখানে উপস্থিত আছেনই। এই ঘটনা কিছুটা আমার সুরেশ বাবুর কাছে শোনা, বাকীটা নিজে অনুসন্ধান করে বের করেছি।
তমাল বলে চললো, রমাপতি খবর পেলো দুমকার পথে জামুন্ডির দিকে পালজোরি অঞ্চলে নতুন নতুন অভ্রখনি আবিস্কার হচ্ছে। শিক্ষিত বুদ্ধিমান রমাপতির ভবিষ্যতে মাইকা বা অভ্রের আকাশ ছোঁয়া সম্ভাবনার কথা বুঝতে দেরি হলো না। সে বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছে গেলো সেখানে। কিন্তু জায়গাটা ছিলো আদিবাসী অধ্যুষিত। থাকার ভালো হোটেল পাওয়া মুশকিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে হরিপুরা বলে একটা গ্রামে এক হো উপজাতি পরিবারে কিছুদিনের জন্য থাকার জায়গা পেলো দুই বন্ধু।
হো উপজাতিরা এমনিতে উদার মনের, নারী স্বাধীনতার অভাব নেই তাদের মধ্যে কিন্তু জাত্যাভিমান ভয়ঙ্কর। বৈবাহিক বা শারীরিক সম্পর্ক তারা অন্য গোত্রের কারো সাথে সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু রমাপতি অন্য চরিত্রের। সেখানে রমাপতির আলাপ হয় সেই বাড়ির মেয়ে সুলতা হো এর সাথে। পুরো মুখার্জি বাড়িটাই যৌনতার একনিষ্ঠ পুজারি, তাই রমাপতি এবং সুলতার ভিতরেও শারীরিক সম্পর্ক হতে বেশিদিন লাগলো না।
ওদিকে বাড়িতে রমাপতির সুন্দরী স্ত্রী রয়েছে। তাকেও অবহেলা করতে পারে না। তাই আসানসোল আর হরিপুরা যাতায়াত চলতে লাগলো। সেই সাথে দুই নারীর সাথেই চলতে লাগলো রমাপতির যৌনতা। সুরেশ চাকলাদার সবই জানতেন, কিন্তু বন্ধুকে কিছু বলতে সাহস পেতেন না কারণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো না, সংসার বলতে গেলে রমাপতির দয়াতেই চলতো।
তমাল উত্তর করলো, প্রবলেম আছে ইনস্পেকটর গড়াই। হাতিয়ার এক রকম দেখতে হলেই যে তা খুনের চেষ্টার হাতিয়ার হবে, তা কিন্তু নয়। পিস্তলের গুলিতে খুন তো কতোই হয়, তার মানে তো সব পিস্তল ব্যবহারকারী খুনি নয়? এই হাতিয়ারই আমার মনে প্রথম সংশয় তৈরি করে। রাহুলের উপহার পাওয়া নেপালী ছুরিটা অপরাধে ব্যবহার হবার কারণ কেউ ইচ্ছা করে খুনের দায়টা রাহুলের উপরে চাপাতে চেষ্টা করেছিলো। অপরাধী একটা মস্ত ভুল করে এখানেই। সে ভেবেছিলো রাহুল ছুরি জোড়া নেপাল থেকে আনে, তাই আসানসোলে এই ছুরি পাওয়া যাবে না বেশি। বৈশিষ্ট্য যুক্ত ছুরি, যে কেউ দেখলেই বলে দেবে ওটা রাহুলের ছুরি। সুতরাং ঠিক ওই রকম একটা ছুরি যোগাড় করতে পারলেই রাহুলকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে।
অপরাধী ঠিক তাই করলো। রাহুলের ছুরি দুটো থেকে একটা ছুরি সরানোর চেষ্টা হয়তো করেছিলো সে, কিন্তু তার আগেই রাহুল একটা ছুরি অদিতিকে দিয়ে দিয়েছিলো কোনো কাজে। অন্য ছুরিটাও পাওয়া গেছে রাহুলের বাইয়ের তাকের পিছনে ধুলো মাখা অবস্থায়। অর্থাৎ কেউ সেটা সম্প্রতি ব্যবহার করে সেখানে রেখে দেয়নি, বরং অসাবধানতায় হারিয়ে গিয়ে বহুদিন সেখানেই পড়ে আছে সেটা। এই বাড়িতেই আমার একজন গোপন সহকারী সেটা খুঁজে পায়। তাহলে একই রকম দেখতে আর একটা ছুরি এলো কোথা থেকে?
অপরাধী আসানসোলের এক কিউরিও শপ থেকে কিনে আনে ঠিক ওই রকম দেখতে এক জোড়া ছুরি। মজার কথা হলো ছুরিটা নেপালী হলেও আসানসোলে দুস্পাপ্য নয়, আমিও এক জোড়া কিনেছি সেই দোকান থেকে। এবং আমি ছাড়াও আর কে কিনেছিলো সেটাও জানতে পারি দোকানদারের কাছ থেকে। দোকানদার ছবি দেখে সনাক্ত করেছে।
কিন্তু অপরাধী যেটা জানতো না, তা হলো প্রত্যেকটা ছুরি হুবহু এক রকম দেখতে হলেও ছুরির বাটের নীচে সিরিয়াল নাম্বার খোদাই করা আছে। ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝাই যায়না এতো ছোট নাম্বার গুলো। আর নাম্বার গুলো জোড়ায় জোড়ায় লেখা। যেমন রাহুলের কাছে যে ছুরি দুটো ছিলো, তার সিরিয়াল নাম্বার হলো ছিয়ানব্বই এবং সাতানব্বই। আমি যে ছুরি দুটো কিনে আনি, সেই ছুরি দুটোর নাম্বার হলো একশো বাইশ এবং একশো তেইশ। কিন্তু রাজীবকে যে ছুরি দিয়ে খুন করার চেষ্টা করা হয়, সেটার নাম্বার হলো দুশো তেরো।
এটা থেকেই পরিস্কার হয়ে যায় অপরাধী নিজের অপরাধ রাহুল বাবুর উপরে চাপাতে চেয়েছিলো। প্রশ্ন হলো, কেন? শুধু অপরাধ ঢাকার জন্য নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? এই পর্যন্ত বলে তমাল এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে জলের বোতল তুলে নিয়ে কয়েক ঢোক জল খেলো। ঘরের ভিতরে নিরবতা নেমে এলো।
তমাল আর কোনো কথা বলছে না দেখে অধৈর্য্য হয়ে উঠছে সবাই। এতোক্ষণ সবাই পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিলো। এবারে ঘরের ভিতরে নড়াচড়া শুরু হলো। মৃদু গুঞ্জন ও টের পাওয়া যাচ্ছে। সম্ভবত সবাই পাশের ব্যক্তির সাথে সম্ভাব্য খুনি কে হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করছে।
এবারে ধৈর্য্য হারালো মধুছন্দা দেবী। তিনি বললেন, সবই তো বুঝলাম। এও হতে পারে সেও হতে পারে, কিন্তু আসলে খুনী কে সেটা কি নিশ্চিত হতে পেরেছো তুমি তমাল? নাকি শুধুই টাকাটা নিয়ে সময় নষ্ট করছো? আমার বয়স হয়েছে, এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হয়। ওষুধ খাবার আর চোখে ড্রপ দেবারও সময় হয়ে গেছে।
তমাল জলের বোতল হাতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর বন্দনার দিকে ফিরে বললো, তুমি মায়ের আই ড্রপটা এনে দাওতো। তারপরে মধুছন্দা দেবীর দিকে ফিরে বললো, আর একটু অপেক্ষা করুন, সব জানতে পারবেন। বন্দনা প্রায় ঝড়ের গতিতে চোখের ওষুধ নিয়ে এলো। ঢাকনা খুলে ওষুধটা মধুছন্দা দেবীর চোখে দিতে গেলে তমাল সেটা হাত থেকে নিয়ে মধুছন্দা দেবীর হাতে দিয়ে বন্দনাকে বললো, আমার ঘরে টেবিলের উপরে সেই ডায়েরিটা আছে নিয়ে এসো তো? উনি নিজেই দিয়ে নেবেন ড্রপ।
মধুছন্দা দেবী বন্দনাকে আবার কাজে পাঠানোতে বিরক্ত হলেন। মুখ ব্যাজার করে নিজের দু ফোঁটা ড্রপ নিজের চোখে ঢেলে নিলেন। তারপর কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তমালের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলো কে রাজীবকে খুন করার চেষ্টা করেছিলো? বুঝতে পেরেছো, নাকি পারোনি?
তমাল বললো, বুঝতে তো দুদিন পরেই পেরেছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত হলাম আপনি আমাকে চেকটা সই করে দেবার পরে। আর নিসন্দেহ হলাম এই মাত্র।
মধুছন্দা দেবী যেন থমকে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কি বলতে চাইছো পরিস্কার করে বলো। তমাল এবারে ঘরের অন্যদের দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা এই চেক সই করা আর চোখে ড্রপ দেওয়ার ভিতরে আপনারা কোনো অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছেন? সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো কিন্তু কেউ কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ পরে ইন্সপেক্টর ঘোষ বললেন, উনি দুটো কাজই বা হাতে করলেন।
তমাল হাততালি দিয়ে উঠলো। সাবাস ইন্সপেক্টর ঘোষ, এই জন্যই বলে পুলিশের চোখ। একদম ঠিক বলেছেন। মধুছন্দা দেবী বাহাতি। ওনার প্রায় সব কাজই বন্দনা করে দেয়, তাই কারো চোখে পড়েনা এটা, কিন্তু এই খুনের চেষ্টায় এটা খুব বড় একটা প্রমাণ। ফরেনসিক রিপোর্ট পরিস্কার বলছে ছুরির আঘাতের ধরন এবং গতিপথ থেকে নিশ্চিত বলা যায় অপরাধী ছিলো বাহাতি। এখানে ডঃ চৌধুরী আছেন, তিনি আমার যুক্তি সমর্থন করবেন বলেই আমার ধারণা। তিনিই প্রথম এ বিষয়ে আলোকপাত করেন আমার কাছে।
অর্থাৎ অন্য কেউ নয়, রাজীবকে খুনের চেষ্টা করেছিলেন আপনি, শ্রীমতি মধুছন্দা মুখার্জি! টাকার লোভে চেকটা আপনাকে দিয়ে সই করাইনি আমি ম্যাডাম, সেই জন্য ওটায় আমার নামও লেখাইনি। আমি আপনার মতো লোভি নই!
ঘরে বোমা পড়লেও বোধহয় এতো অবাক হতো না কেউ। কয়েক মুহুর্ত পরে হেসে উঠলেন মধুছন্দা দেবী। বললেন, আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো, তোমার মতো অযোগ্য লোককে তদন্তের ভার দেওয়াই আমার ভুল ছিলো। আমি খুনের চেষ্টা করলে নিজেই তোমাকে অপরাধী খোঁজার ভার দেবো কেন?
তমাল বললো, ঠিক এই কারণেই দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমি অনভিজ্ঞ শখের গোয়েন্দা, আপনার মতো ধুরন্ধর মহিলার টিকিও ছুঁতে পারবো না। আর নিজেই নিয়োগ করেছেন বলে আমি আপনাকে সন্দেহও করবো না। তার উপর এক লক্ষ টাকার লোভ তো আর সোজা কথা নয়! তবে আপনার জানা উচিৎ বেশিরভাগ অপরাধীই ঠিক এই ভুলটা করে, পুলিশ এবং গোয়েন্দা কেউই বন্ধু হয়না, তাদের যতোই ঘুষ দেবার চেষ্টা করেন না কেন?
এতোক্ষণে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে রাহুল জিজ্ঞেস করলো, আমি তো কিছুই বুঝলাম না ফরেনসিকের ব্যাপারটা। আর পিসির কি লাভ রাজীবকে খুন করে? আর উনি তো চোখেও ভালো দেখতে পাননা?
তমাল বললো, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি রাহুল বাবু। এখনি এতো অবাক হবেন না। হতবাক হবার এখনো অনেক কিছু বাকী আছে, সময় মতো জানতে পারবেন। ফরেনসিকের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি এখন। মধুছন্দা দেবী রাজীবকে খুনই করতে চেয়েছিলেন। ওনার চোখের সমস্যাটা ওনার একটা জব্বর অ্যালিবাই। আমি ডঃ চৌধুরীর সাথে কথা বলে জানলাম যে রোগটা নাম ম্যাকুলার ডিজেনারেশন। এই রোগে রুগী কখনো বেশ পরিস্কার দেখতে পান, আবার কখনো ঝাপসা। সব সময় যে কম দেখেন তা কিন্তু নয়।
সেইদিন রাতে রাজীবকে যে অদিতি ফোন করেছিলো সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু যেটা বলিনি, সেটা হলো অদিতির কল করার দশ মিনিট আগে উনি নিজেও রাজীবকে কল করেন। সম্ভবত নীচে তার ঘরে আসতে বলেন। কেন, সেটা আমি অনুমান করতে পারি, সময় মতো বলবো। শুধু এটুকু বলি, রাজীব মধুছন্দা দেবীকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো। সেই লেনদেন বিষয়ক কথা বলতেই সম্ভবত এসেছিলো রাজীব। রাজীবের লোভ দিন দিন বেড়েই উঠছিলো, তাই তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন মধুছন্দা দেবী। তার একজন সঙ্গীও আছে, চিরসঙ্গীও বলা যায়, তার কথা পরে বলছি।
মধুছন্দা দেবীর সাথে কথোপকথন এর মাঝেই সম্ভবত অদিতির কলটা আসে রাজীবের কাছে। মধুছন্দা দেবী কোনো ভাবে স্ক্রিনে অদিতির নামটা দেখে ফেলেন এবং তখনি ঠিক করে ফেলেন আজই সঠিক সময় পথের কাঁটা সরিয়ে দেবার। রাজীব বেরিয়ে যেতেই তিনি কল করেন তার অপরাধ সঙ্গীকে। দুজনে মিলে প্রায় একটা নিশ্ছিদ্র প্ল্যানও বানিয়ে ফেলেন। রাজীব চলে যায় অদিতির সাথে দেখা করতে। কি রাজীব, আমার অনুমানে কোনো ভুল আছে কি?
রাজীব এতোক্ষণ চুপ করে মাথা নীচু করে ছিলো। এবারে মুখ তুলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বললো, আপনি সম্পূর্ণ সঠিক বলছেন। উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। ব্ল্যাকমেইলিং বন্ধ না করলে বিপদ হবে আমার, সেটাও বলেন। তখনি কল করে অদিতি। আমি উপরে চলে যাই অদিতির সাথে কথা বলতে।
তমাল জিজ্ঞেস করলো, অদিতির কল আসার পরে তুমি ফোনে কিছু বলেছিলে কি? রাজীব বললো, না তো,শুধু বলেছিলাম,আসছি।
এগজ্যাক্টলী! ওই টুকুই যথেষ্ট ছিলো। অর্থাৎ তুমি যে তখনি নিজের ঘরে না গিয়ে তিনতলায় অদিতির কাছে যাবে এটা মধুছন্দা দেবী বুঝে যান। সাথে সাথেই উনি কল করেন নিজের দোসরকে। ছুরি আগেই যোগাড় করা ছিলো, দরকার ছিলো একটা আবরণ যা শাড়িতে রক্ত লাগা আটকাতে পারে। সেটা সঙ্গীই যোগাড় করে দেয়। এক্ষেত্রে সেটা ছিলো একটা মেরুন শার্ট, ওনার দোসরের।
এবার আপত্তি জানালো ইন্সপেক্টর গড়াই। তিনি বললেন, তুমি বলছো যে একজন সঙ্গী ছিলো,সঙ্গিনী নয়, অর্থাৎ পুরুষ। তাহলে সেই সঙ্গী আঘাত না করে উনি মহিলা হয়ে কেন করলেন?
তমাল বললো, আমি নিজেও এটা নিয়ে চিন্তা করেছি ইনস্পেকটর গড়াই। এর কারণ হলো, তিন তলা থেকে রাজীবকে আবার দোতলায় নিয়ে আসতে একটা ডাইভারশন দরকার ছিলো। কিছু একটা না শুনলে রাজীব নীচে আসতো না। কোনো জোরালো শব্দ টাইপের কিছু। কারণ নাম ধরে ডাকলে অদিতি সাক্ষী রয়ে যেতো। জোরালো শব্দ তৈরি করার ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীই বেশি উপযুক্ত ছিলো। তাই ছুরি চালানোর দায়িত্ব মধুছন্দা দেবী নিজের হাতে তুলে নেন।
মধুছন্দা দেবী এবং তার সঙ্গী দোতলায় কান পেতেই ছিলো। রাজীব অদিতির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পায়। সে কৌতুহলি হয়ে দোতলায় নেমে আসে। মধুছন্দা দেবী সম্ভবত নিজের দরজার পর্দার পিছনে লুকিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গী কিভাবে শব্দ করেছিলো তা জানা যায়নি। হয়তো এক তলার ল্যান্ডিংয়ে লাফিয়ে নামে। রাতে সেটা যথেষ্ট জোরে শব্দই ছিলো, আবার এতো জোরে ছিলো না যাতে অন্যেরা শুনতে পায়। মনে রাখতে হবে এই শব্দের কথা রাজীব ছাড়া কিন্তু কেউই বলেনি।
রাজীব নেমে আসে, কিন্তু দোতলায় কাউকে দেখতে পায়না। অথচ সে স্পষ্ট শুনেছে শব্দটা। এমনিতেই তার কৌতুহল বেশি, সে ঝুঁকে পড়ে শব্দের উৎস সন্ধান করতে থাকে। মধুছন্দা দেবীর জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয়না। ঝুঁকে রয়েছে রাজীব। এই অবস্থায় ছুরি মারার জন্য তার পক্ষে আদর্শ উচ্চতা। তিনি পর্দার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে গেঁথে দিলেন ছুরিটা রাজীবের পিঠের বা দিকে, হৃদপিণ্ড বরাবর। মনে রাখতে হবে মধুছন্দা দেবীর ঘরটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বা দিকে। অর্থাৎ ঝুঁকে থাকা রাজীবের ডান দিক থেকে এসেছিলেন তিনি।
এক আঘাতেই রাজীবের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো যদি না নীচে কিছু দেখতে না পেয়ে সে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াতো। টাইমিংটাই বাঁচিয়ে দিলো তাকে। একে তার পিঠের উচ্চতা বেড়ে গেলো, তার উপর অবস্থান আনুভূমিক থাকে লম্ব হয়ে গেলো। তবুও বাঁচতে পারতো না যদি আততায়ী ডানহাতি হতো। আমি ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ডঃ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে ছুরিটা পিঠের বাদিকে ঢুকে পাঁজরে ধাক্কা খেয়ে ডানদিকে সরে শিরদাঁড়ায় আটকে যায়। ভেবে দেখুন, ডানহাতি কেউ মারলে ছুরি ঢোকার পরে বাদিকে যেতো এবং হৃদপিণ্ড বিদ্ধ করতো। বাহাতি কেউ আঘাত করেছিলো বলেই ডানদিকে বেঁকে গেছিলো গতিপথ, তাই বেঁচে যায় রাজীব। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, মধুছন্দা দেবী ছাড়া এই বাড়িতে আর কেউ বাহাতি নেই।
তমাল একটা বিরতি নিতেই আবার গুঞ্জন উঠলো ঘরে। এবার একটু জোরেই। সত্যের আকস্মিক অভিঘাত সবাইকে চমকিত করেছে। মধুছন্দা দেবী তখন মরিয়া হয়ে বললো, এসব মনগড়া গল্প শুনিয়ে তুমি কোর্টে কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। আমার উকিল দু দিনেই আমাকে বের করে আনবে। তমাল হেসে বললো, কোর্টে প্রমাণের দায়িত্ব তো আমার নয় ম্যাডাম, সেটা ইন্সপেক্টর ঘোষের কাজ। উনি কিন্তু একটু আগে শুধু শুধু বাইরে যাননি, আপনার দোসরের ঘর খানাতল্লাশি করতে গেছিলেন। কি কি পেয়েছেন, তার কাছেই শুনুন নাহয়? তমাল ইন্সপেক্টর ঘোষের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, একটা মেরুন শার্ট, তাতে রক্তের পুরানো দাগ। অবশ্য ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট কার রক্ত সেটা বের করে ফেলবে। একটা নেপালি ছুরি পাওয়া গেছে। মিঃ তমালের কথা মতো নীচের নাম্বারটা দেখেছি আমি, দুশো বারো। তমাল বললো আর যে ছবিটা দেওয়ালে টাঙানো ছিলো, সেটা এনেছেন তো মিঃ ঘোষ? ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ তমালের প্রশ্নে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। তমাল বললো, ওটার প্রয়োজন হবে একটু পরে। মধুছন্দা দেবীর চোয়াল ঝুলে পড়লো এবার।
ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষারত মহিলা কনস্টেবল কে ডাকলেন। তাকে মধুছন্দা দেবীকে নিয়ে যেতে বলতেই তমাল বাঁধা দিলো। বললো, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান ইনস্পেকটর ঘোষ। গল্প যে সবে শুরু! এখনো যে অনেক বাকী। ওনাকে যে লাগবে এই রঙ্গমঞ্চে। শুভ কাজটা আর একটু পরেই করুন। আপনার কেসটা আরও পোক্ত হতেও পারে। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোতেও তো পারে?
এবারে ঝাঁঝিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মধুছন্দা দেবী। বললেন, না আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। নিয়ে চলুন আমাকে। বেশ করেছি মেরেছি! দু পয়সার কর্মচারী দিনের পর দিন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে যাবে আর আমি সেটা সহ্য করবো? নিয়ে চলুন আমাকে, আমি যা বলার থানায় গিয়ে আমার উকিলের সামনে বলবো। শহরের সেরা উকিল অ্যাপয়েন্ট করবো আমি। দেখি আমাকে এই সামান্য কেসে ক'দিন আটকে রাখে?
তমাল জিভ দিয়ে চুক চুক করে আওয়াজ করে বললো, এহ্ হে! কেসটা খুব সামান্য হয়ে গেলো, তাই না? তা বলে যান রাজীব আপনাকে ব্ল্যাকমেইল কেন করছিলো? কি এমন গোপন কথা জানতে পেরেছিলো সে, সেটা তো বলে যান? মধুছন্দা দেবী গজগজ করতে করতে বললো, আমি আমার উকিলের উপস্থিতি ছাড়া আর একটা কথাও বলবো না।
তমাল বললো, আরে আপনাকে তো এখনো অফিশিয়ালি গ্রেফতারই করা হয়নি? উকিল তো পাবেন গ্রেফতার হবার পরে। ততোক্ষণ আমার গল্পটাই নাহয় শুনে যান। আমি তো পাতি গোয়েন্দা, তাই ভুল ভ্রান্তি হলে ধরিয়ে দেবেন, কেমন?
তমাল এবারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ঘরের মাঝখানে বসলো। তারপর বলতে শুরু করলো।
এই মুখার্জি বাড়ি একটা আলিবাবার গুহার মতো। যেখানেই চিচিং ফাঁক বলেছি, সেখানেই রহস্য বেরিয়ে এসেছে। মূল গল্পটার শুরু হয়েছিলো বছর পঞ্চান্ন আগে। যখন রমাপতি মুখার্জি বলে একজন মানুষ তার বন্ধু সুরেশ চাকলাদার কে সঙ্গে নিয়ে নতুন ব্যবসা খোঁজার জন্য দুমকার পথে যাত্রা করে। তারা দুজন কারা, নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? রমাপতি হলেন রাহুলের পিতামহ আর সুরেশ বাবু তো এখানে উপস্থিত আছেনই। এই ঘটনা কিছুটা আমার সুরেশ বাবুর কাছে শোনা, বাকীটা নিজে অনুসন্ধান করে বের করেছি।
তমাল বলে চললো, রমাপতি খবর পেলো দুমকার পথে জামুন্ডির দিকে পালজোরি অঞ্চলে নতুন নতুন অভ্রখনি আবিস্কার হচ্ছে। শিক্ষিত বুদ্ধিমান রমাপতির ভবিষ্যতে মাইকা বা অভ্রের আকাশ ছোঁয়া সম্ভাবনার কথা বুঝতে দেরি হলো না। সে বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছে গেলো সেখানে। কিন্তু জায়গাটা ছিলো আদিবাসী অধ্যুষিত। থাকার ভালো হোটেল পাওয়া মুশকিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে হরিপুরা বলে একটা গ্রামে এক হো উপজাতি পরিবারে কিছুদিনের জন্য থাকার জায়গা পেলো দুই বন্ধু।
হো উপজাতিরা এমনিতে উদার মনের, নারী স্বাধীনতার অভাব নেই তাদের মধ্যে কিন্তু জাত্যাভিমান ভয়ঙ্কর। বৈবাহিক বা শারীরিক সম্পর্ক তারা অন্য গোত্রের কারো সাথে সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু রমাপতি অন্য চরিত্রের। সেখানে রমাপতির আলাপ হয় সেই বাড়ির মেয়ে সুলতা হো এর সাথে। পুরো মুখার্জি বাড়িটাই যৌনতার একনিষ্ঠ পুজারি, তাই রমাপতি এবং সুলতার ভিতরেও শারীরিক সম্পর্ক হতে বেশিদিন লাগলো না।
ওদিকে বাড়িতে রমাপতির সুন্দরী স্ত্রী রয়েছে। তাকেও অবহেলা করতে পারে না। তাই আসানসোল আর হরিপুরা যাতায়াত চলতে লাগলো। সেই সাথে দুই নারীর সাথেই চলতে লাগলো রমাপতির যৌনতা। সুরেশ চাকলাদার সবই জানতেন, কিন্তু বন্ধুকে কিছু বলতে সাহস পেতেন না কারণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো না, সংসার বলতে গেলে রমাপতির দয়াতেই চলতো।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)