23-05-2025, 08:14 PM
পরদিন....
সময় বিকেল চারটে। মুখার্জি বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য। এতো মানুষ একসাথে অনেকদিন আসেনি এ বাড়িতে। সাধারণত কোনো উৎসবে এভাবে সবাই সম্মিলিত হয়, তফাৎ শুধু আজ কোনো মুখরতা নেই। মৃদু গুঞ্জনে ফিসফিস করে এ ওর সাথে কথা বলে চলেছে। একটা চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠেছে সবার মুখে। সুরেশ চাকলাদার, রামহরি আর সুলতা দেবী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হয়তো পুরানো দিনের স্মৃতিচারণ করছে। রাজীব চুপচাপ এক কোনে বসে আছে। বন্দনা বসেছে মধুছন্দা দেবীর পাশে। মৌপিয়া, গার্গী আর অদিতি পাশাপাশি ঘরের এক কোনে বসে আছে। গার্গী আজ সকালেই ফিরেছে। কাল রাতেই ফেরার কথা থাকলেও ট্রেন ভীষণ লেট থাকায় সকালেই নেমেছে আসানসোলে। রাহুল আর রিনি অরোরাও পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু রাহুল মুখ নীচু করে মোবাইলে ব্যস্ত। ঘনশ্যাম, দারোয়ান গনেশ আর বিনোদ একটা আলাদা দলে বসে আছে।
সবাই অপেক্ষা করছে দুজন মানুষের জন্য, চিত্তরঞ্জনের ওসি ইন্সপেক্টর বাসুদেব গড়াই এবং ডাঃ চৌধুরী। হোমের ম্যানেজার রাখাল রায়কে নিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর গড়াই। অনেকটা দূর থেকে এসেছেন বলে চুলগুলো উসখোখুসকো। কিন্তু তার মুখে একটা বিশ্বজয়ের হাসি লেগে আছে। তমালকে দেখে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিলেন। অবশ্য কাল রাতেই তমালের সাথে তার কথা হয়ে গেছে। জগনকেও সাথে করে এনেছেন, তবে সে আছে নীচে পুলিশের গাড়িতে। প্রয়োজন হলে উপরে আনা হবে। ইন্সপেক্টর ঘোষ উঠে গিয়ে তার সাথে করমর্দন করে তাকে নিজের পাশে সোফায় বসালেন। রাখাল রায় মোটা শরীর নিয়ে এই ঠান্ডা ঘরেও দরদর করে ঘামছে। বারবার রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময়ের পরে তমাল ইন্সপেক্টর ঘোষের কানে কানে কিছু বলতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
এতোক্ষণ একটা ঘরোয়া পুনর্মিলন এর মতো ছিলো, কিন্তু পুলিশের উপস্থিতি একটু ভারী করে তুললো ঘরের পরিবেশ। তাছাড়া নীচেও বেশ কিছু কনস্টেবল নিয়ে তিনখানা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ায়ও একটা কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছে জিপগুলো। এবাড়িতে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কানাঘুষো শুনলেও আসল খবর কেউ জানতো না। আজ পুলিশের আগমন সেই কৌতুহল অনেক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে বাড়ির সামনে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত বাড়ি, তাই গেটের সামনে লোকজন নেই। তারা বিভিন্ন বাহানায় সময় কাটাচ্ছে মুখার্জি বাড়ির সামনে। আশে পাশের ছোট দোকানগুলোর বেচাকেনা আজ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সিগারেটের দোকানের, যেন আজ আসানসোলের এই দোকান থেকে সিগারেট কিনলে লটারি পাওয়া যাবে,এরকম একটা ভিড় দেখা যাচ্ছে।
তমাল ইচ্ছা করেই কোনো কথা বলছে না। মুখে একটা কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলেছে জোর করে। সে যেন বোঝাতে চাইছে এই ক'দিন মুখার্জি বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করা তমাল সে নয়, বরং দায়িত্ববান কর্মসচেতন একজন সত্য সন্ধানী সে। এমনকি অদিতি, মৌপিয়া আর বন্দনার কাছেও তাকে কেমন অচেনা, অজানা, রহস্যময় লাগছে।
ফোন থেকে মুখ তুলে রাহুল বললো, আমরা কি এবার শুরু করতে পারিনা তমাল বাবু, আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? তমাল বললো, বহু বছর অপেক্ষা করে আছে একটা প্রশ্ন, তার উত্তর কি এতো সহজে পাওয়া যায় রাহুল বাবু? একটু ধৈর্য্য ধরুন। তমাল প্রথমদিকে রাহুলকে রাহুল বাবু বললেও ইদানিং বলছিলো না। রাহুল এবং তুমিতেই নেমে এসেছিলো আলাপচারিতা। তার মুখে বাবু এবং আপনি সম্বোধন শুনে এবং গলার রুক্ষতা অনুভব করে একটু চমকে উঠলো রাহুল। মুখ নীচু করে নিলো। রিনি অরোরা তার হাতে হাত রেখে মৃদু একটা চাপ দিলো।
আধ ঘন্টা খানেক পরে প্রায় একসাথেই ঢুকলেন ডঃ চৌধুরী এবং ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। তমাল তাকাতে মিঃ ঘোষ মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন। তার হাতে একটা ফোটো ফ্রেম এবং একটা পলিথিন প্যাকেট। ডঃ চৌধুরী কে ধাতস্থ হতে অল্প সময় দিলো, তারপর উঠে দাঁড়ালো তমাল। সাথে সাথে ঘরের সবাই চুপ করে গেলো, যেন এইমাত্র ক্লাস রুমে হেডস্যার ঢুকলো। নিরবতা নেমে এলো ঘরে।
তমাল এ ক'দিন মুখার্জি বাড়িতে বেশির ভাগ সময় পায়জামা পাঞ্জাবি পরেই কাটিয়েছে। বাইরে গেলে জিন্সের উপরে টিশার্ট পরেছে। কিন্তু আজ পরেছে ফর্মাল ড্রেস। একটা দামী প্যান্টের উপর মেরুন শার্ট টানটান করে গুঁজে পরেছে। ভীষণ স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। সেই সাথে যেন একটু দূরের তমাল হয়ে গেছে সবার।
এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক খেলা। তমাল জানে রাজীবকে খুনের চেষ্টা করার সময় খুনী মেরুন কালারের শার্ট পরে ছিলো। তাই কাল বিকালে সে মার্কেট থেকে শার্ট টা কিনে এনেছে অপরাধীর মনের উপরে চাপ তৈরি করার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করার আগে সে একটা দীর্ঘ বিরতি নিলো। পুরো ঘর উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
তমাল বলতে শুরু করলো, প্রথমেই এই বাড়ির সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই,কারণ যে আন্তরিক ব্যবহার এ বাড়িতে পেয়েছি তা কখনো ভুলবো না। কিন্তু একটা কাজ নিয়েই আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম। সে কাজ আমি শেষ করতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা সময় বলবে, কিন্তু সবার আগে আমি মধুছন্দা দেবীকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। তমালের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতেই তিনি মুখ তুলে তার দিকে তাকালেন।
তমাল বললো, আমি যেদিন এবাড়িতে আসি, তার পরদিন আপনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মনে আছে? আপনি বলেছিলেন, আমি যদি অপরাধিকে ধরে দিতে পারি, আপনি আমাকে পারিশ্রমিক হিসাবে এক লক্ষ্য টাকা দেবেন। সেই অফারটা কি এখনো আছে?
এই খবরটা কয়েকজন জানলেও টাকার পরিমানটা কেউ জানতো না। তাই ঘরে উপস্থিত সবাই একটু অবাক হয়ে তাকালো। মধুছন্দা দেবীর কিন্তু কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমার কথার নড়চড় হয়না তমাল, আমি তো তোমাকে সেদিনই অগ্রীম দিতে চেয়েছিলাম?
তাহলে এখন দিন। এই কেসে আমাকে শারীরিক এবং মানসিক, দুভাবেই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাই তখন মনে না হলেও এখন মনে হচ্ছে টাকাটা আমার প্রাপ্য। মধুছন্দা দেবীর মুখে একটা বাঁকা ব্যাঙ্গের হাসি ফুটে উঠলো। তিনি বন্দনার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিষ্টি, ড্রয়ার থেকে আমার চেক বইটা নিয়ে এসো তো? সাথে সাথে বন্দনা উঠে চলে গেলো ঘর থেকে।
যেখানে আজকের সমাবেশ হয়েছে এটাও দোতলায়। এটা একটা কনফারেন্স রুমের মতো বড় ঘর। আগে অফিসের কাজ কর্ম হতো, এখন ফাঁকাই পড়ে আছে। বন্দনা দু মিনিটের ভিতরে চেক বই নিয়ে ফিরে এলো। মধুছন্দা দেবীর হাতে দিতেই তিনি খসখস করে টাকার অংকটা লিখে সই করে দিয়ে তমালের দিকে তাকালেন। তমাল বললো, অ্যাকাউন্ট পেয়ী করে দিন, নামটা আমি বসিয়ে নেবো। মধুছন্দা দেবী সেটা করে তাচ্ছিল্যের সাথে চেকটা বাড়িয়ে দিলেন তমালের দিকে। তমাল হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে মধুছন্দা দেবীকে ধন্যবাদ দিয়ে বুক পকেটে রেখে দিলো চেকটা।
তারপর তমাল ঘরের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, এখন আমি যে যে কথা গুলো বলবো, বা আপনারা যা বলবেন, সবই রেকর্ড করা হবে পুলিশের খাতায়। তাই জানা থাকলে কেউ সত্য গোপন করবেন না, তাতে বিপদ বাড়বে। ইতিমধ্যেই এই বাড়ির প্রায় সকলেই আমাকে বেশ কিছু মিথ্যা কথা বলেছে। কিছু মিথ্যা নিস্পাপ, নিজের লজ্জা বা সংকোচ আড়াল করতে, কিছু মিথ্যা গুরুতর। আজ আমার কথায় হয়তো অনেক গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবে, কিন্ত একটা বড় অপরাধের উপর থেকে পর্দা সরাতে গিয়ে সেইসব ব্যক্তিগত ক্ষতির জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন সকলে।
কেউ কোনো কথা বললো না দেখে তমাল আবার বলতে লাগলো, এই বাড়িতে একটা অপরাধ ঘটেছে, খুনের চেষ্টা। কিন্তু খুনের চেষ্টা আসলে খুনই। ইচ্ছা করে খুনের চেষ্টা করা যায়না। অপরাধী খুনই করতে চায়, কিন্তু ভাগ্যজোরে ভিকটিম বেঁচে যায়। তাই এই অপরাধের গুরুত্ব কিছু কম হয়না তাতে।
এই অপরাধের শিকার হয় রাজীব বাবু। কিন্তু কেন? কি তার অপরাধ? তিনি তো এই বাড়ির একজন সাধারণ কর্মচারী মাত্র, ফ্যাক্টরির অ্যাকাউন্টেন্ট। তাকে খুনী কেন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে চাইবে? খুনের কেসের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মোটিভ। খুনির মোটিভ খুঁজে বের করতে শুরু করি আমি, কারণ অনেক সময় আত্মরক্ষার জন্যেও খুন হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
রাজীব বাবু সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে থাকি। তিনি নিসন্দেহে একজন প্রতিভাবান হিসাবরক্ষক। খোঁজ নিয়ে জেনেছি তার একাডেমিক রেজাল্টও খুব ভালো। কিন্তু তার অনেকগুলো দুর্বলতাই তার এই পরিনতির জন্য দায়ী। প্রথমত তিনি মাত্রাতিরিক্ত কৌতুহলি, নিজের সীমা ছাড়িয়ে যান কৌতুহল মেটাতে। সেই সাথে ভীষন রকম লোভী। দ্বিতীয়ত তিনি নারী শিকারি। মেয়েদের দেখলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। ব্যাঙ্গালোরে পড়াশুনা করার সময়ও তিনি অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেও তার বেশ বদনাম হয়,এমনকি একটা মানসিক প্রতারণা কেসে পুলিশের খাতায় নামও আছে তার। পরে অবশ্য মিটমাট হয়ে যায়। তাই ব্যাঙ্গালোর তার জন্য নিরাপদ ছিলো না। নিজের রাজ্যে ফিরে আসাই ভালো, এটা বুঝতে পারেন।
ভাগ্য তার ভালোই বলতে হবে, এক পরিচিত জনের কাছ থেকে খোঁজ পান মুখার্জিরা একজন অ্যাকাউন্টেন্ট খোঁজ করছে। সুযোগটা সে লুফে নেয়। কাজ শুরু করে মুখার্জি বাড়িতে থেকেই। কিছুদিনের মধ্যেই সে ধরে ফেলে হিসাবে গড়বড় আছে। তার কৌতুহলি মন শুধু হিসাব ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর পৌঁছে যায়। সেই সাথে এই বাড়িতেই পেয়ে যায় তিন তিনজন যুবতী নারী। কাজের সাথে সাথে শিকারেও ব্যস্ত হয়ে পরে সে। নিজের আকর্ষণীয় চেহারা, মধুর স্বভাব আর যৌন আকর্ষনের জাল ছড়িয়ে জড়িয়ে ফেলে তাদের।
কিন্তু লোভী স্বভাবের দোষে অল্পতে খুশি হতে সে শেখেনি। একজনে খুশি হতে পারলো না সে। সবার দিকেই হাত বাড়ালো। এমনকি তাতেও খুশি না হয়ে নাটক সাজিয়ে সে ডেকে আনলো প্রাক্তন প্রেমিকা রিনি অরোরা কে ব্যাঙ্গালোর থেকে। সে বুঝেছিলো এই বাড়িতে অনেক রহস্য আছে। ব্ল্যাকমেইল করে প্রচুর ধনলাভ সম্ভব। তারজন্য তার একজন সহকারী হলে ভালো হয়। রিনিকে প্রস্তাব দেয় এবং রিনিও সেটা গ্রহন করে। ব্যাঙ্গালোরে থাকতেই রিনি ভালোবাসার মিথ্যা অভিনয়ে সম্পর্ক তৈরি করে রাহুলের সাথে। পরে রাহুল ফিরে এলে তাকে চাকরির প্রয়োজন জানিয়ে নিজেও চলে আসে এখানে। রাহুল বাবুও প্রণয়ীকে নিজের পিএ হিসাবে নিযুক্ত করেন।
এই পর্যন্ত বলে তমাল একটু থেমে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। অদিতি, মৌপিয়া আর বন্দনা লজ্জায় মুখ নীচু করে আছে। তাদের জন্য খারাপ লাগলেও তমাল নিরুপায়, সত্য তাকে প্রকাশ করতেই হবে, তবে খেয়াল রাখবে যাতে খুব বেশি অপমানিত না হয় তারা। এতোক্ষন রিনি অরোরা রাহুলের হাত ধরে ছিলো। এবারে সেও হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নতমস্তকে বসে আছে। রাজীব যেন কিছুই হয়নি এভাবে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তমাল আবার বলতে শুরু করলো।
-এখন প্রশ্ন হলো রাজীবের উপর এই আক্রমণ আসলে কোন দিক থেকে এসেছে? তার অতিরিক্ত কৌতুহলে গোপন কথা জেনে যাবার জন্য? নাকি প্রেমের বিশ্বাসঘাতকতায় তৈরি হওয়া যৌন ঈর্ষা? দুটোই খুব শক্ত মোটিভ। মেয়েরা প্রেমে আঘাত পেয়ে বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, এরকম উদাহরণের অভাব নেই অপরাধ জগতে। তাহলে কে হতে পারে সেই আততায়ী? লিস্টে আছে বন্দনা, অদিতি, মৌপিয়া এবং রিনি অরোরা। রিনিকে বাদ দেওয়া যেতে পারে কারণ খুনের চেষ্টা হয়েছিলো মুখার্জি বাড়িতে, গভীর রাতে, যে সময়ে রিনি এখানে উপস্থিত ছিলো না। কিন্তু রাহুলের সেই মোটিভ ছিলো।
রাজীবের কথায় রিনি রাহুলের সাথে প্রেমের অভিনয় শুরু করলেও ধীরে ধীরে সে সত্যিই রাহুলের প্রেমে পড়ে যায়। রাজীবকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। সে জানতো রাজীব বড় কোনো ষড়যন্ত্র করছে, তাই রাজীব ছুরিতে আহত হবার পরে ফ্যাক্টরিতে আমি যেদিন যাই সেদিন রাজীবের ঘরে সে প্রমাণ খুঁজছিলো অবশ্য রাহুলের ক্ষতি করতে নয়, তাকে বাঁচাতে। রিনি জানতো কি ধরনের কাজ রাজীব করছিলো।
লক্ষনীয় বিষয় হলো, বাড়ির সবাই এবং পুলিশ এই অপরাধের জন্য রাহুল বাবুকেই দোষী মনে করছে। ক্রাইম সিনে তাকে রাজীবের রক্ত মেখে ছুরি হাতে বসে থাকতে দেখা গেছে। ছুরিটিও তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের ছুরি। কিন্তু তার মোটিভটা কি? দিদি এবং বোনের উপরে রাজীবের অশালীন অনধিকার হস্তক্ষেপ? নাকি অফিসের কোনো ব্যাপার? সেই কি টাকা সরাচ্ছিলো? রাজীব জানতে পেরেছিলো বলে তাকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো? অথবা রাহুল যদি রিনির সাথে রাজীবের পূর্ব প্রনয়ের কথা কোনোভাবে জেনে গিয়ে থাকে তাহলে ঈর্ষা এবং প্রতারণার জন্য রাজীবের উপর প্রতিহিংসা মেটাতেই পারে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ চিৎকার করে বলছে যে সেই খুনি, আই মিন খুনের চেষ্টাকারী। কিন্তু প্রমাণ গুলো বড্ড বেশি চিৎকার করছিলো। যেন সারা পৃথিবীকে গলা তুলে বলতে চাইছিলো, যে দেখো, আমি খুন করেছি, তোমরা আসছো না কেন? আমি আর কতোক্ষণ তোমাদের প্রমাণ দেবার জন্য ভিকটিমের মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকবো তারই রক্ত মেখে নিজের কেনা ছুরি হাতে নিয়ে। এসো গ্রেফতার করো আমাকে।
তবুও তাকে ছুরি চালাতে কেউ দেখেনি,অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই। সুতরাং শুধু অনুমান ভিত্তিক অভিযোগে এবং সারকমস্টেনশিয়াল এডিডেন্সের ভিত্তিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। হতেও পারে অপরাধ অন্য কেউ করেছে, সে হয়তো বাইরে এসে ভিকটিমের অবস্থা দেখে হতবুদ্ধি হয়ে তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো, কারণ খুনের চেষ্টাটা হয় ঠিক তার ঘরের সামনে। এছাড়া রাজীবের বর্ননা অনুযায়ী অপরাধী খুনের চেষ্টার সময় একটি মেরুন শার্ট পরে ছিলো। সেরকম শার্ট রাজিবের ঘরে পাওয়া যায়নি। অবশ্য সে সরিয়েও ফেলতে পারে।
তাহলে বাকী রইলো এ বাড়ির তিন যুবতী মেয়ে। আমার প্রথম সন্দেহ পড়ে অদিতির উপরে। মৌপিয়া স্বামী পরিত্যক্তা। জৈবিক চাহিদায় হয়তো জড়িয়ে পড়ে রাজীবের সাথে, কিন্তু তার সামাজিক কলঙ্কের ভয় আছে। সে প্রতারিত হলেও সরাসরি খুনের সাথে নিজেকে জড়াতে চাইবে কেন? বিশেষ করে যখন তার একটি ছোট মেয়ে আছে? তবে তাকেও ক্লিন চিট দেওয়া সম্ভব নয় কারণ তার আলমারিতে একটি মেরুন শার্ট আছে। যদিও তাতে কোনো রক্তের দাগ আমি খুঁজে পাইনি।
বন্দনা অল্প বয়সী মেয়ে। চপলতা এবং অপরিনত বুদ্ধি তাকে রাজীবের দিকে আকর্ষিত করতে পারে, কিন্তু খুন করতে হলে সে অন্য কোথাও করতে পারতো। সে সুযোগ তার ছিলো আমি জানি। তাছাড়া সে এই বাড়িতে আশ্রিতা। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো বড় দাও খেলবে কি?
অদিতি কিন্তু এতো দুর্বল নয়। সে বুদ্ধিমতি, শিক্ষিতা, শারীরিক ভাবেও দূর্বল নয়, এবং বহুদিন হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে। এবং ফোন কল রেকর্ড বলছে সেই রাতে অদিতি ফোন করেছিলো রাজীবকে। হয়তো তাকে ডেকে আনে নীচে। তারপর সুযোগ বুঝে ছুরি বসিয়ে দেয় রাজীবের পিঠে। তার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তার কাছে রাহুলের সেই ছুরির মতো একটি ছুরি আছে। এছাড়া তার কাছে একটি লাল রঙের শার্টও আছে। কম আলোতে লাল রঙকে মেরুন বলে ভুল হতেই পারে। অদিতিই প্রথমে রাজীবের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরে অন্য মেয়েদের সাথে, বিশেষ করে নিজের দিদি এবং আশ্রিতা বন্দনার সাথে রাজীবের সম্পর্ক সে মেনে নিতে না পারলে খুনের শক্ত মোটিভ তার আছে।
সময় বিকেল চারটে। মুখার্জি বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য। এতো মানুষ একসাথে অনেকদিন আসেনি এ বাড়িতে। সাধারণত কোনো উৎসবে এভাবে সবাই সম্মিলিত হয়, তফাৎ শুধু আজ কোনো মুখরতা নেই। মৃদু গুঞ্জনে ফিসফিস করে এ ওর সাথে কথা বলে চলেছে। একটা চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠেছে সবার মুখে। সুরেশ চাকলাদার, রামহরি আর সুলতা দেবী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হয়তো পুরানো দিনের স্মৃতিচারণ করছে। রাজীব চুপচাপ এক কোনে বসে আছে। বন্দনা বসেছে মধুছন্দা দেবীর পাশে। মৌপিয়া, গার্গী আর অদিতি পাশাপাশি ঘরের এক কোনে বসে আছে। গার্গী আজ সকালেই ফিরেছে। কাল রাতেই ফেরার কথা থাকলেও ট্রেন ভীষণ লেট থাকায় সকালেই নেমেছে আসানসোলে। রাহুল আর রিনি অরোরাও পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু রাহুল মুখ নীচু করে মোবাইলে ব্যস্ত। ঘনশ্যাম, দারোয়ান গনেশ আর বিনোদ একটা আলাদা দলে বসে আছে।
সবাই অপেক্ষা করছে দুজন মানুষের জন্য, চিত্তরঞ্জনের ওসি ইন্সপেক্টর বাসুদেব গড়াই এবং ডাঃ চৌধুরী। হোমের ম্যানেজার রাখাল রায়কে নিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর গড়াই। অনেকটা দূর থেকে এসেছেন বলে চুলগুলো উসখোখুসকো। কিন্তু তার মুখে একটা বিশ্বজয়ের হাসি লেগে আছে। তমালকে দেখে একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিলেন। অবশ্য কাল রাতেই তমালের সাথে তার কথা হয়ে গেছে। জগনকেও সাথে করে এনেছেন, তবে সে আছে নীচে পুলিশের গাড়িতে। প্রয়োজন হলে উপরে আনা হবে। ইন্সপেক্টর ঘোষ উঠে গিয়ে তার সাথে করমর্দন করে তাকে নিজের পাশে সোফায় বসালেন। রাখাল রায় মোটা শরীর নিয়ে এই ঠান্ডা ঘরেও দরদর করে ঘামছে। বারবার রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময়ের পরে তমাল ইন্সপেক্টর ঘোষের কানে কানে কিছু বলতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
এতোক্ষণ একটা ঘরোয়া পুনর্মিলন এর মতো ছিলো, কিন্তু পুলিশের উপস্থিতি একটু ভারী করে তুললো ঘরের পরিবেশ। তাছাড়া নীচেও বেশ কিছু কনস্টেবল নিয়ে তিনখানা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ায়ও একটা কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছে জিপগুলো। এবাড়িতে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কানাঘুষো শুনলেও আসল খবর কেউ জানতো না। আজ পুলিশের আগমন সেই কৌতুহল অনেক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে বাড়ির সামনে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত বাড়ি, তাই গেটের সামনে লোকজন নেই। তারা বিভিন্ন বাহানায় সময় কাটাচ্ছে মুখার্জি বাড়ির সামনে। আশে পাশের ছোট দোকানগুলোর বেচাকেনা আজ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে সিগারেটের দোকানের, যেন আজ আসানসোলের এই দোকান থেকে সিগারেট কিনলে লটারি পাওয়া যাবে,এরকম একটা ভিড় দেখা যাচ্ছে।
তমাল ইচ্ছা করেই কোনো কথা বলছে না। মুখে একটা কাঠিন্য ফুটিয়ে তুলেছে জোর করে। সে যেন বোঝাতে চাইছে এই ক'দিন মুখার্জি বাড়িতে আতিথ্য গ্রহন করা তমাল সে নয়, বরং দায়িত্ববান কর্মসচেতন একজন সত্য সন্ধানী সে। এমনকি অদিতি, মৌপিয়া আর বন্দনার কাছেও তাকে কেমন অচেনা, অজানা, রহস্যময় লাগছে।
ফোন থেকে মুখ তুলে রাহুল বললো, আমরা কি এবার শুরু করতে পারিনা তমাল বাবু, আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? তমাল বললো, বহু বছর অপেক্ষা করে আছে একটা প্রশ্ন, তার উত্তর কি এতো সহজে পাওয়া যায় রাহুল বাবু? একটু ধৈর্য্য ধরুন। তমাল প্রথমদিকে রাহুলকে রাহুল বাবু বললেও ইদানিং বলছিলো না। রাহুল এবং তুমিতেই নেমে এসেছিলো আলাপচারিতা। তার মুখে বাবু এবং আপনি সম্বোধন শুনে এবং গলার রুক্ষতা অনুভব করে একটু চমকে উঠলো রাহুল। মুখ নীচু করে নিলো। রিনি অরোরা তার হাতে হাত রেখে মৃদু একটা চাপ দিলো।
আধ ঘন্টা খানেক পরে প্রায় একসাথেই ঢুকলেন ডঃ চৌধুরী এবং ইন্সপেক্টর ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। তমাল তাকাতে মিঃ ঘোষ মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন। তার হাতে একটা ফোটো ফ্রেম এবং একটা পলিথিন প্যাকেট। ডঃ চৌধুরী কে ধাতস্থ হতে অল্প সময় দিলো, তারপর উঠে দাঁড়ালো তমাল। সাথে সাথে ঘরের সবাই চুপ করে গেলো, যেন এইমাত্র ক্লাস রুমে হেডস্যার ঢুকলো। নিরবতা নেমে এলো ঘরে।
তমাল এ ক'দিন মুখার্জি বাড়িতে বেশির ভাগ সময় পায়জামা পাঞ্জাবি পরেই কাটিয়েছে। বাইরে গেলে জিন্সের উপরে টিশার্ট পরেছে। কিন্তু আজ পরেছে ফর্মাল ড্রেস। একটা দামী প্যান্টের উপর মেরুন শার্ট টানটান করে গুঁজে পরেছে। ভীষণ স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। সেই সাথে যেন একটু দূরের তমাল হয়ে গেছে সবার।
এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক খেলা। তমাল জানে রাজীবকে খুনের চেষ্টা করার সময় খুনী মেরুন কালারের শার্ট পরে ছিলো। তাই কাল বিকালে সে মার্কেট থেকে শার্ট টা কিনে এনেছে অপরাধীর মনের উপরে চাপ তৈরি করার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করার আগে সে একটা দীর্ঘ বিরতি নিলো। পুরো ঘর উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
তমাল বলতে শুরু করলো, প্রথমেই এই বাড়ির সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই,কারণ যে আন্তরিক ব্যবহার এ বাড়িতে পেয়েছি তা কখনো ভুলবো না। কিন্তু একটা কাজ নিয়েই আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম। সে কাজ আমি শেষ করতে পেরেছি কি পারিনি, সেটা সময় বলবে, কিন্তু সবার আগে আমি মধুছন্দা দেবীকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। তমালের মুখে তার নাম উচ্চারিত হতেই তিনি মুখ তুলে তার দিকে তাকালেন।
তমাল বললো, আমি যেদিন এবাড়িতে আসি, তার পরদিন আপনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, মনে আছে? আপনি বলেছিলেন, আমি যদি অপরাধিকে ধরে দিতে পারি, আপনি আমাকে পারিশ্রমিক হিসাবে এক লক্ষ্য টাকা দেবেন। সেই অফারটা কি এখনো আছে?
এই খবরটা কয়েকজন জানলেও টাকার পরিমানটা কেউ জানতো না। তাই ঘরে উপস্থিত সবাই একটু অবাক হয়ে তাকালো। মধুছন্দা দেবীর কিন্তু কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমার কথার নড়চড় হয়না তমাল, আমি তো তোমাকে সেদিনই অগ্রীম দিতে চেয়েছিলাম?
তাহলে এখন দিন। এই কেসে আমাকে শারীরিক এবং মানসিক, দুভাবেই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাই তখন মনে না হলেও এখন মনে হচ্ছে টাকাটা আমার প্রাপ্য। মধুছন্দা দেবীর মুখে একটা বাঁকা ব্যাঙ্গের হাসি ফুটে উঠলো। তিনি বন্দনার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিষ্টি, ড্রয়ার থেকে আমার চেক বইটা নিয়ে এসো তো? সাথে সাথে বন্দনা উঠে চলে গেলো ঘর থেকে।
যেখানে আজকের সমাবেশ হয়েছে এটাও দোতলায়। এটা একটা কনফারেন্স রুমের মতো বড় ঘর। আগে অফিসের কাজ কর্ম হতো, এখন ফাঁকাই পড়ে আছে। বন্দনা দু মিনিটের ভিতরে চেক বই নিয়ে ফিরে এলো। মধুছন্দা দেবীর হাতে দিতেই তিনি খসখস করে টাকার অংকটা লিখে সই করে দিয়ে তমালের দিকে তাকালেন। তমাল বললো, অ্যাকাউন্ট পেয়ী করে দিন, নামটা আমি বসিয়ে নেবো। মধুছন্দা দেবী সেটা করে তাচ্ছিল্যের সাথে চেকটা বাড়িয়ে দিলেন তমালের দিকে। তমাল হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে মধুছন্দা দেবীকে ধন্যবাদ দিয়ে বুক পকেটে রেখে দিলো চেকটা।
তারপর তমাল ঘরের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো, এখন আমি যে যে কথা গুলো বলবো, বা আপনারা যা বলবেন, সবই রেকর্ড করা হবে পুলিশের খাতায়। তাই জানা থাকলে কেউ সত্য গোপন করবেন না, তাতে বিপদ বাড়বে। ইতিমধ্যেই এই বাড়ির প্রায় সকলেই আমাকে বেশ কিছু মিথ্যা কথা বলেছে। কিছু মিথ্যা নিস্পাপ, নিজের লজ্জা বা সংকোচ আড়াল করতে, কিছু মিথ্যা গুরুতর। আজ আমার কথায় হয়তো অনেক গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবে, কিন্ত একটা বড় অপরাধের উপর থেকে পর্দা সরাতে গিয়ে সেইসব ব্যক্তিগত ক্ষতির জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন সকলে।
কেউ কোনো কথা বললো না দেখে তমাল আবার বলতে লাগলো, এই বাড়িতে একটা অপরাধ ঘটেছে, খুনের চেষ্টা। কিন্তু খুনের চেষ্টা আসলে খুনই। ইচ্ছা করে খুনের চেষ্টা করা যায়না। অপরাধী খুনই করতে চায়, কিন্তু ভাগ্যজোরে ভিকটিম বেঁচে যায়। তাই এই অপরাধের গুরুত্ব কিছু কম হয়না তাতে।
এই অপরাধের শিকার হয় রাজীব বাবু। কিন্তু কেন? কি তার অপরাধ? তিনি তো এই বাড়ির একজন সাধারণ কর্মচারী মাত্র, ফ্যাক্টরির অ্যাকাউন্টেন্ট। তাকে খুনী কেন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে চাইবে? খুনের কেসের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মোটিভ। খুনির মোটিভ খুঁজে বের করতে শুরু করি আমি, কারণ অনেক সময় আত্মরক্ষার জন্যেও খুন হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
রাজীব বাবু সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে থাকি। তিনি নিসন্দেহে একজন প্রতিভাবান হিসাবরক্ষক। খোঁজ নিয়ে জেনেছি তার একাডেমিক রেজাল্টও খুব ভালো। কিন্তু তার অনেকগুলো দুর্বলতাই তার এই পরিনতির জন্য দায়ী। প্রথমত তিনি মাত্রাতিরিক্ত কৌতুহলি, নিজের সীমা ছাড়িয়ে যান কৌতুহল মেটাতে। সেই সাথে ভীষন রকম লোভী। দ্বিতীয়ত তিনি নারী শিকারি। মেয়েদের দেখলেই তার মাথা ঠিক থাকে না। ব্যাঙ্গালোরে পড়াশুনা করার সময়ও তিনি অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেখানেও তার বেশ বদনাম হয়,এমনকি একটা মানসিক প্রতারণা কেসে পুলিশের খাতায় নামও আছে তার। পরে অবশ্য মিটমাট হয়ে যায়। তাই ব্যাঙ্গালোর তার জন্য নিরাপদ ছিলো না। নিজের রাজ্যে ফিরে আসাই ভালো, এটা বুঝতে পারেন।
ভাগ্য তার ভালোই বলতে হবে, এক পরিচিত জনের কাছ থেকে খোঁজ পান মুখার্জিরা একজন অ্যাকাউন্টেন্ট খোঁজ করছে। সুযোগটা সে লুফে নেয়। কাজ শুরু করে মুখার্জি বাড়িতে থেকেই। কিছুদিনের মধ্যেই সে ধরে ফেলে হিসাবে গড়বড় আছে। তার কৌতুহলি মন শুধু হিসাব ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর পৌঁছে যায়। সেই সাথে এই বাড়িতেই পেয়ে যায় তিন তিনজন যুবতী নারী। কাজের সাথে সাথে শিকারেও ব্যস্ত হয়ে পরে সে। নিজের আকর্ষণীয় চেহারা, মধুর স্বভাব আর যৌন আকর্ষনের জাল ছড়িয়ে জড়িয়ে ফেলে তাদের।
কিন্তু লোভী স্বভাবের দোষে অল্পতে খুশি হতে সে শেখেনি। একজনে খুশি হতে পারলো না সে। সবার দিকেই হাত বাড়ালো। এমনকি তাতেও খুশি না হয়ে নাটক সাজিয়ে সে ডেকে আনলো প্রাক্তন প্রেমিকা রিনি অরোরা কে ব্যাঙ্গালোর থেকে। সে বুঝেছিলো এই বাড়িতে অনেক রহস্য আছে। ব্ল্যাকমেইল করে প্রচুর ধনলাভ সম্ভব। তারজন্য তার একজন সহকারী হলে ভালো হয়। রিনিকে প্রস্তাব দেয় এবং রিনিও সেটা গ্রহন করে। ব্যাঙ্গালোরে থাকতেই রিনি ভালোবাসার মিথ্যা অভিনয়ে সম্পর্ক তৈরি করে রাহুলের সাথে। পরে রাহুল ফিরে এলে তাকে চাকরির প্রয়োজন জানিয়ে নিজেও চলে আসে এখানে। রাহুল বাবুও প্রণয়ীকে নিজের পিএ হিসাবে নিযুক্ত করেন।
এই পর্যন্ত বলে তমাল একটু থেমে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। অদিতি, মৌপিয়া আর বন্দনা লজ্জায় মুখ নীচু করে আছে। তাদের জন্য খারাপ লাগলেও তমাল নিরুপায়, সত্য তাকে প্রকাশ করতেই হবে, তবে খেয়াল রাখবে যাতে খুব বেশি অপমানিত না হয় তারা। এতোক্ষন রিনি অরোরা রাহুলের হাত ধরে ছিলো। এবারে সেও হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নতমস্তকে বসে আছে। রাজীব যেন কিছুই হয়নি এভাবে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তমাল আবার বলতে শুরু করলো।
-এখন প্রশ্ন হলো রাজীবের উপর এই আক্রমণ আসলে কোন দিক থেকে এসেছে? তার অতিরিক্ত কৌতুহলে গোপন কথা জেনে যাবার জন্য? নাকি প্রেমের বিশ্বাসঘাতকতায় তৈরি হওয়া যৌন ঈর্ষা? দুটোই খুব শক্ত মোটিভ। মেয়েরা প্রেমে আঘাত পেয়ে বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে, এরকম উদাহরণের অভাব নেই অপরাধ জগতে। তাহলে কে হতে পারে সেই আততায়ী? লিস্টে আছে বন্দনা, অদিতি, মৌপিয়া এবং রিনি অরোরা। রিনিকে বাদ দেওয়া যেতে পারে কারণ খুনের চেষ্টা হয়েছিলো মুখার্জি বাড়িতে, গভীর রাতে, যে সময়ে রিনি এখানে উপস্থিত ছিলো না। কিন্তু রাহুলের সেই মোটিভ ছিলো।
রাজীবের কথায় রিনি রাহুলের সাথে প্রেমের অভিনয় শুরু করলেও ধীরে ধীরে সে সত্যিই রাহুলের প্রেমে পড়ে যায়। রাজীবকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। সে জানতো রাজীব বড় কোনো ষড়যন্ত্র করছে, তাই রাজীব ছুরিতে আহত হবার পরে ফ্যাক্টরিতে আমি যেদিন যাই সেদিন রাজীবের ঘরে সে প্রমাণ খুঁজছিলো অবশ্য রাহুলের ক্ষতি করতে নয়, তাকে বাঁচাতে। রিনি জানতো কি ধরনের কাজ রাজীব করছিলো।
লক্ষনীয় বিষয় হলো, বাড়ির সবাই এবং পুলিশ এই অপরাধের জন্য রাহুল বাবুকেই দোষী মনে করছে। ক্রাইম সিনে তাকে রাজীবের রক্ত মেখে ছুরি হাতে বসে থাকতে দেখা গেছে। ছুরিটিও তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের ছুরি। কিন্তু তার মোটিভটা কি? দিদি এবং বোনের উপরে রাজীবের অশালীন অনধিকার হস্তক্ষেপ? নাকি অফিসের কোনো ব্যাপার? সেই কি টাকা সরাচ্ছিলো? রাজীব জানতে পেরেছিলো বলে তাকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো? অথবা রাহুল যদি রিনির সাথে রাজীবের পূর্ব প্রনয়ের কথা কোনোভাবে জেনে গিয়ে থাকে তাহলে ঈর্ষা এবং প্রতারণার জন্য রাজীবের উপর প্রতিহিংসা মেটাতেই পারে। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ চিৎকার করে বলছে যে সেই খুনি, আই মিন খুনের চেষ্টাকারী। কিন্তু প্রমাণ গুলো বড্ড বেশি চিৎকার করছিলো। যেন সারা পৃথিবীকে গলা তুলে বলতে চাইছিলো, যে দেখো, আমি খুন করেছি, তোমরা আসছো না কেন? আমি আর কতোক্ষণ তোমাদের প্রমাণ দেবার জন্য ভিকটিমের মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকবো তারই রক্ত মেখে নিজের কেনা ছুরি হাতে নিয়ে। এসো গ্রেফতার করো আমাকে।
তবুও তাকে ছুরি চালাতে কেউ দেখেনি,অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই। সুতরাং শুধু অনুমান ভিত্তিক অভিযোগে এবং সারকমস্টেনশিয়াল এডিডেন্সের ভিত্তিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। হতেও পারে অপরাধ অন্য কেউ করেছে, সে হয়তো বাইরে এসে ভিকটিমের অবস্থা দেখে হতবুদ্ধি হয়ে তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো, কারণ খুনের চেষ্টাটা হয় ঠিক তার ঘরের সামনে। এছাড়া রাজীবের বর্ননা অনুযায়ী অপরাধী খুনের চেষ্টার সময় একটি মেরুন শার্ট পরে ছিলো। সেরকম শার্ট রাজিবের ঘরে পাওয়া যায়নি। অবশ্য সে সরিয়েও ফেলতে পারে।
তাহলে বাকী রইলো এ বাড়ির তিন যুবতী মেয়ে। আমার প্রথম সন্দেহ পড়ে অদিতির উপরে। মৌপিয়া স্বামী পরিত্যক্তা। জৈবিক চাহিদায় হয়তো জড়িয়ে পড়ে রাজীবের সাথে, কিন্তু তার সামাজিক কলঙ্কের ভয় আছে। সে প্রতারিত হলেও সরাসরি খুনের সাথে নিজেকে জড়াতে চাইবে কেন? বিশেষ করে যখন তার একটি ছোট মেয়ে আছে? তবে তাকেও ক্লিন চিট দেওয়া সম্ভব নয় কারণ তার আলমারিতে একটি মেরুন শার্ট আছে। যদিও তাতে কোনো রক্তের দাগ আমি খুঁজে পাইনি।
বন্দনা অল্প বয়সী মেয়ে। চপলতা এবং অপরিনত বুদ্ধি তাকে রাজীবের দিকে আকর্ষিত করতে পারে, কিন্তু খুন করতে হলে সে অন্য কোথাও করতে পারতো। সে সুযোগ তার ছিলো আমি জানি। তাছাড়া সে এই বাড়িতে আশ্রিতা। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো বড় দাও খেলবে কি?
অদিতি কিন্তু এতো দুর্বল নয়। সে বুদ্ধিমতি, শিক্ষিতা, শারীরিক ভাবেও দূর্বল নয়, এবং বহুদিন হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে। এবং ফোন কল রেকর্ড বলছে সেই রাতে অদিতি ফোন করেছিলো রাজীবকে। হয়তো তাকে ডেকে আনে নীচে। তারপর সুযোগ বুঝে ছুরি বসিয়ে দেয় রাজীবের পিঠে। তার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তার কাছে রাহুলের সেই ছুরির মতো একটি ছুরি আছে। এছাড়া তার কাছে একটি লাল রঙের শার্টও আছে। কম আলোতে লাল রঙকে মেরুন বলে ভুল হতেই পারে। অদিতিই প্রথমে রাজীবের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরে অন্য মেয়েদের সাথে, বিশেষ করে নিজের দিদি এবং আশ্রিতা বন্দনার সাথে রাজীবের সম্পর্ক সে মেনে নিতে না পারলে খুনের শক্ত মোটিভ তার আছে।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম