23-05-2025, 08:03 PM
গ্রামের এক প্রাচীন বট গাছের নীচে একটা নড়বড়ে টেবিল পেতে খুলেছে একটা চায়ের দোকান। একটা বড় ফ্লাস্কে চা রাখা আছে। সেই ফ্লাস্কটাকে এতো যত্ন করে বেঁধে রেখেছে দোকানদার যেন সাত রাজার ধন আগলে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। একটা প্লাস্টিকের ডিব্বায় কিছু স্থানীয় বেকারিতে তৈরি করা বিস্কুট আর কয়েকটা কেক রাখা আছে, কিন্তু সেই কেক গুলোর এক্সপায়রি ডেট কবে ছিলো সেটাও ভুলে গেছে দোকানদার। কয়েকজন বৃদ্ধ সেই চা মহা উৎসাহে চুমুক দিয়ে জটিল আলোচনায় ব্যস্ত।
এ পর্যন্ত তমালদের গাড়িটা যে পৌঁছাতে পেরেছে, সেটাও অনেক ভাগ্যের কথা। রাস্তা যে খুব খারাপ তা নয়, তবে এসইউভি ঢোকার মতো যথেষ্ট প্রসস্ত নয়। তমাল নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। তমালের গাড়ি তাদের সামনে থামতেই বৃদ্ধদের আলোচনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবার মুখেই অপার বিস্ময়। বটগাছের নীচটা ইট সাজিয়ে মাটি লেপে বাঁধিয়ে নিয়েছে গ্রামের লোকজন। তাদের গ্রামের একমাত্র কফিহাউস বলে কথা! তমাল গিয়ে বসলো সেই বেদীতে। দোকানিকে দু'কাপ চা দিতে বললো সে। বিস্কুট আর কেক খাবার ইচ্ছা থাকলেও সাহসে কুলালো না। ইশারায় মদনকেও ডেকে নিলো। তমালের বেশভূষা গ্রামের লোকজনের সাথে এতোই বেমানান যে তারা তমালের সাথে সহজ হবে না। মদনকে দেখলে হয়তো তারা কিছুটা স্বস্তি পাবে বলেই তাকে ডেকে নিলো তমাল।
প্রথমেই কিছু জিজ্ঞাসা না করে দুজনে চা খেতে লাগলো। না তাকিয়েও তার পাশের বেশ কয়েক জোড়া চোখ যে তাকে কৌতুহল নিয়ে নিরীক্ষণ করে চলেছে, বেশ বুঝতে পারলো সে। তমাল তাদের দিকে ফিরে আন্তরিক হাসলো। তারপর পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলো তাদের দিকে। বৃদ্ধেরা যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। ছি ছি এ কি উপহাস রাজাধিরাজ... টাইপের একটা সম্ভ্রম তাদের চোখে। তমাল বললো, নিন না, সংকোচ কিসের?
দলটার মধ্যে একজন প্রথমে লজ্জা কাটিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট তুলে নিলো। তার দেখা দেখি একে একে সবাই এগিয়ে এলো। তমাল দোকানদারকেও একটা সিগারেট দিলো। তারপর তমাল যে তাদের থেকে আলাদা কিছু নয় বোঝাতে নিজেই উঠে গিয়ে লাইটার জ্বেলে সবার সিগারেট ধরিয়ে দিলো।
পৃথিবীতে যতো ধরনের বন্ধুত্ব আছে, তার ভিতরে দুই প্রকার বন্ধুত্ব শ্রেষ্ঠ। এক ক্লাসের বন্ধু আর এক গ্লাসের বন্ধু। তারপরেই হচ্ছে সুখটানের বন্ধু। সিগারেট শেয়ার করেই তমাল সেই গ্রাম-সভার মন জয় করে নিলো। তমাল যে সিগারেট খায়, তারাও এখন সেই সিগারেট খাচ্ছে, এই ভাব মনে আসতেই এক বৃদ্ধ একটা পা অন্যটার উপর তুলে দিয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবু কুথা থেকে এসেছেন? আপনাকে আগে তো এই ঠাঁই দেখিনি বটে!
তমাল বললো, না আমি আগে কখনো আসিনি এদিকে। আমি আসলে ব্যবসার কাজে দুমকা যাচ্ছি। আমার এক পরিচিত মহিলার বাড়ি ছিলো এই হরিপুরা গ্রামে। সে আমাকে বলেছিলো যদি কোনোদিন সুযোগ পাই যেন দেখে যাই তার গ্রামের সবাই কেমন আছে। আজ কাজ একটু কম তাই এলাম আর কি।
তমালের কথায় দামী সিগারেট খাওয়ানো দেবদূতের সাহায্য করার হিড়িক পড়ে গেলো যেন। নানা দিক থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসতে লাগলো। কে আগে তমালকে সাহায্য করবে তার প্রতিযোগিতা পড়ে গেলো বৃদ্ধদের মধ্যে। তমাল বললো, আমি সুলতাপিসির কাছ থেকে আসছি। সুলতা হো। এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, কুন সুলতা হো? সুলতা নামে তো কাউকে মুনে পড়ছেক লাই? তমাল আবার বললো, তার এক ভাইপোর নাম সুখদেব হো। ছেলেটা কয়েকবছর আগে মারা গেছে অসুখে।
হঠাৎ যেন এক নিমেষে উৎসাহ ঘুচে গেলো সবার। মুখ চোখ থমথমে হয়ে উঠলো উপস্থিত জনতার। কেউ কেউ সিগারেটের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন তমাল তাদের ঠকিয়ে বিষ খেতে দিয়েছে। নেহাত দামী দুস্প্রাপ্য বিষ, তাই দয়া করে খাচ্ছে, নাহলে কখন টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিতো! এক বৃদ্ধ বোধহয় তখনো বুঝতে পারেনি তাই পাশের জনকে নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কে বলতো বটে? সেই ভদ্রলোক কিন্তু গলা চড়িয়েই বললো, বুঝতে লারিস নাই, উও সুধণ্যর কুলাঙ্গার বড় দিদিটার কুথা বলছে! যে বেটিটা গোত্রের মুখে চুনা কালি লাগায়ে পালাই গেছিলো? এবারে প্রশ্ন কর্তা বুঝতে পেরে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো।
তাদের ভাবভঙ্গী আর থমথমে পরিবেশ দেখে তমাল বুঝতে পারলো এখানে আর বিশেষ সুবিধা হবে না। গোটা আটেক সিগারেটের বলিদানের বিনিময়ে তমাল শুধু এটুকু বুঝলো যে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। তমাল জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা এই সুধণ্য বাবুর বাড়িটা কোন দিকে? তার প্রশ্নের উত্তরে এক বৃদ্ধ বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের পিঠের পিছনে এমন একটা দিক নির্দেশ করলো যার অর্থ দিল্লীও হতে পারে আবার কেরালাও হতে পারে। তমাল বুঝলো আর কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। সে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পড়লো।
সুধণ্য বাবুর বাড়ি খুঁজে পেতে তমালকে বেশ পরিশ্রম করতে হলো। পাথরের উপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া বাড়িগুলো খাপছাড়া ভাবে একে অন্যের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব রেখেই গড়ে উঠেছে। পুরুষরা এই সময়ে কেউ বাড়িতে নেই। যুবকেরা কাজের তাগিদে বাইরে, আর বয়স্করা বটতলার আড্ডায় জড়ো হয়েছে। মহিলারা কেউই তেমন তমালের সামনে এলো না। দু একজন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতের ইশারায় জানালো তারা জানে না।
প্রায় পুরো গ্রাম ঘুরে একটা পনেরো ষোলো বছরের ছেলের কাছে সুখদেবের নাম করার পরে তমাল সন্ধান পেলো বাড়িটার। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা নির্জন বাড়ি একা সঙ্গীহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কপাল ভালো যে সুধণ্য বাবুকে বাড়িতে পাওয়া গেলো। রুগ্ন এক বৃদ্ধ, যার বটতলার আড্ডা দিতে যাবার মতো শারীরিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনিও বসে নেই, বাড়ির দাওয়ায় বসে বিড়ি বাঁধছেন।
তমাল তার সামনে গিয়ে নমস্কার করলো। বৃদ্ধ ঘোলাটে চোখ মেলে চাইলো তার দিকে। চিনতে না পেরে তাকিয়ে রইলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। তমাল তার আসার কারণটা সংক্ষেপে ব্যক্ত করলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সুধণ্য বাবুর গলা চিড়ে, বললো, কি হবে আর সে সব পুরানো কথা বলে? দিদির কারণেই আমরা আজ প্রায় একঘরে হয়ে আছি বহু বছর ধরে। দিদি যে অপরাধ করেছে সেটা আমাদের হো সমাজে অমার্জনীয় অপরাধ। গ্রামে থাকলে তাকে মেরেই ফেলা হতো। পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে সে। কিন্তু গোত্রের রাগটা এসে পড়লো আমাদের পরিবারের উপরে। একঘরে করে ধোঁপা নাপিত বন্ধ করে দিলো। সেই সময়ে কি যে দুরাবস্থার মধ্যে কাটিয়েছি, কি বলবো আপনাকে।
তমাল কিছু না বলে চুপচাপ শুনছিলো। বহু বছর পরে কেউ তার পরিবারের দুঃখের কথা শুনছে। মনের ভিতরে জগদ্দল পাথরের মতো জমে থাকা অভিমানেরা যেন পাথর সরিয়ে ঝর্ণার মতো বেরিয়ে আসতে চাইছে। তমাল জানে প্রশ্ন করলে সে শুধু সেই জিজ্ঞাসা গুলোর উত্তর পাবে, কিন্তু বাঁধা না দিলে পুরো ইতিহাস তার জানা হয়ে যাবে।
অনর্গল বলে গেলো বৃদ্ধ সুধণ্য হো। কখনো উত্তেজিত হয়ে, কখন কান্না ভেজা গলায়, কখনো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আবার কখনো থেমে থেমে। আধঘন্টার ভিতরে সব জানা হয়ে গেলো তমালের। বৃদ্ধ থামলে সে প্রশ্ন করলো, এখনো কি আপনারা একঘরে হয়েই আছেন? মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, বললেন, আমরাও দিদির সাথে যোগাযোগ রাখছি না দেখে গ্রামের প্রধানদের বোধহয় একটু দয়া হয়েছিলো। ধোঁপা নাপিতের অধিকার দিলো, কিন্তু মূল গ্রামে আর আমাদের যেতে দিলো না। এক কোনে এভাবেই পড়ে আছি।
তমাল বললো, কিন্তু সুখদেব তো যেতো সুলতা দেবীর কাছে? আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। বললেন, হ্যাঁ, আমাদের পরিবারের এই মন্দ কপাল দেখে ছেলেটা দেখা করতে চেয়েছিলো পিসির সাথে। জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলো, কেন এমন করলো? গ্রামের বাইরে গিয়ে পড়াশনা করলো। ভালো ছাত্র ছিলো। হোস্টেলে থাকতো। কিভাবে যেন দিদির ঠিকানা যোগাড় করে পৌঁছে গেছিলো তার কাছে। পিসি ভাইপোর কি কথা হয়েছিলো জানি না, কিন্তু তার মনে আর দিদির জন্য রাগ ছিলো না। বরং নিজেদের গাছের ফলটা, নারকেলটা, গুড়টা নিয়ে যেতো পিসির জন্য। গ্রামে কাউকে জানাতাম না, কিন্তু সে যেতো পিসির কাছে। তারপর সেও একদিন চলে গেলো। এখন বুড়োবুড়ি অপেক্ষায় আছি কবে সিংবোঙ্গা'র আদেশে হিমো এসে চিরভ্রমনের জন্য উঠিয়ে নিয়ে যায়।
তমাল কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে দেখে বৃদ্ধ বললেন, আমাদের হো উপজাতি হলো খুব প্রাচীন উপজাতি। আমদের ভাষা হলো মুন্ডা। আগে আমাদের গোত্র অনেক বড় ছিলো, কিন্তু আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে এই ঝাড়খণ্ড আর উড়িষ্যার কোলহান অঞ্চলেই বেঁচে আছি। আমারা বীরের জাতি। শুনেছি সাহেবদের সাথেও যুদ্ধ করেছি আমরা। সত্যি কথা বলতে কি আমরা একটু হিংস্র উপজাতি। প্রতিশোধ আমাদের রক্তে টগবগ করে। আগে বলিও দেওয়া হতো। আমরা আমাদের গোত্র ছাড়া অন্য গোত্রে বিয়ে শাদী দেই না। এমনকি অন্য গোত্রের মানুষের সাথে সম্পর্কও রাখিনা খুব একটা। সিংবোঙ্গা হলো আমাদের প্রধান দেবতা, আর হিমো হলো মৃত্যুর দেবতা। আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা জগত জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর পাপীদের আত্মাকে সিংবোঙ্গা অন্ধকূপে বন্দী করে রাখেন। জগত ভ্রমণের অধিকার থাকেনা তার।
তমাল সুধণ্য বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লো। তমাল চলে আসার আগে বিনয়ের সাথে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে তিনি দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন তা। বরং তিনি তমালের হাতে তার নিজের হাতে বানানো দুই বান্ডিল বিড়ি ধরিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ অন্য চেহারার বিড়ি। শুকনো পাতার নয়, বরং অল্প কাঁচাই রয়েছে পাতাগুলো, তাই বিড়িগুলো একটু গোলাপি রংঙের। সাধারণ তেন্ডু পাতার বিড়ির চেয়ে তিনগুন বেশি লম্বা। তমাল ফিরতে শুরু করলো বটতলায় রেখে আসা গাড়ির দিকে।
ফেরার পথে মদন বললো, আপনি যার খোঁজ করছিলেন, সেই সুধণ্য বাবুর উপরে তো এদের বেশ রাগ দেখলাম। তমাল বললো, কেন? কিছু বলছিলো বুঝি? মদন বললো, হ্যাঁ, আপনি চলে যাবার পরে নিজেদের ভিতরে আলোচনা করছিলো। সুধণ্য বাবুর দিদি নাকি একটা সাহেবদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্সের কাজ করতো। সেখানে এক লোকের.....
মুখরোচক গল্পের খোঁজ পেয়ে মদন সেটা তমালকে জানাতে উসখুশ করছিলো। কিন্তু তমাল পুরোটাই শুনে এসেছে সুধণ্য বাবুর কাছে, তাই গ্রামের লোকের জল মেশানো গল্প শুনতে আগ্রহ বোধ করলো না। সে মদনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা মদন, ঘনশ্যামের সাথে তোমার আলাপ হয়েছে?
এমন রসালো গল্পের অপমৃত্যুতে একটু মনোক্ষুণ্ণ হলেও সামলে নিলো মদন। বললো, বাপরে! ফালতু লোক একটা। দু একবার ভাব জমাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কি বিচ্ছিরি মেজাজ। অন্যদের মানুষই মনে করে না। একদিন নিজের ঘরে বসে মাল খাচ্ছিলো, আমি একটু গল্প করতে গেলাম, সে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো আমাকে।
তমাল বললো, বিনা পয়সায় মাল খাওয়ার লোভে অন্যের ঘরে হানা দিলে তো তাড়িয়ে দেবেই মদন। তুমি তো আমাকে বলতে পারতে? মদন লজ্জা পেয়ে বললো, কি যে বলেন না দাদা, আমি এমনিই গেছিলাম কথা বলতে। তমাল তাকে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিতে কথা ঘোরালো, আচ্ছা মাল খাচ্ছিলো বললে, কোন হাতে গ্লাস ধরেছিলো বলতে পারবে?
এরকম সৃষ্টিছাড়া প্রশ্ন আশা করেনি মদন। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, তা তো মনে নেই দাদা... ডান হাতেই হবে! হ্যাঁ ডান হাতেই.....! কেন জিজ্ঞেস করছেন দাদা? তমাল বললো, কিছু না, এমনি। হোটেলে ফিরে চলো।
বিকেলে তমাল রাধা আর বন্দনা দুজনকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন ঘুরতে বেরোলো। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা মদন চিনতো, কারণ সে কয়েকদিন থেকেছে এখানে। তারপরে তারা একের পর এক শপিং মলে ঢু মারতে লাগলো। বিশেষ করে রাধা এসব মার্কেটে একদমই যাবার সুযোগ পায়না। তার বিস্ময় যেন বাঁধ মানতেই চায় না। এতো ঝলমলে দোকান একই জায়গায় সে কল্পনাই করতে পারে না। তাদের নিয়ামতপুরেও মার্কেট আছে, কিন্তু সে তো একটা রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান। এরকম এত্তো বড় একটা বাড়ির পুরোটা দোকানে ভর্তি হয়, সে জানতোই না।
মূলত তার জন্যই তমাল ওদের নিয়ে সিজে মার্কেট, আমলাদহী মার্কেট, এসপি ইষ্ট মার্কেট, এসপি নর্থ মার্কেট ঘুরে দেখালো। সবশেষে আরজে মার্কেটে এসে ওদের দুজনকে অনেক উপহার কিনে দিলো তমাল। প্রসাধনী, ড্রেস, ইমিটেশন গহনা কেনা হলে তমাল তাদের নিয়ে মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকানে ঢুকলো। রাধা আগে এসব কিনতে এসেছে মায়ের সাথে। বাবা সাথে থাকলেও ঢুকতো না দোকানে, বাইরে দোকান থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো। দোকানের ভিতরেও মা যেন কেমন ফিসফিস করে আকার ইঙ্গিতে কথা বলে। তাই তমাল যখন তাদের নিয়ে বুক ফুলিয়ে দোকানে ঢুকে মহিলা দোকানদারকে জোরে জোরে কি চাই সেটা জানালো, রাধার ইচ্ছা হচ্ছিলো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে। দোকানদার মেয়েটাও বেহায়া কম না, নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে রসিকতা করছে তমালের সাথে। রাধা আর বন্দনাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো তাদের ভিতরে গার্লফ্রেন্ড কে? তমাল যখন বললো, দুজনই গার্লফ্রেন্ড, দুজনের জন্যই দেখান, মেয়েটা এমন ভাবে মুখ টিপে হাসলো যে রাধার ইচ্ছা হলো ওর মুখটা নখ দিয়ে খামচে রক্ত বের করে দেয়।
কিন্তু সে ভাষা হারিয়ে ফেললো যখন মেয়েটা পাতলা জালের প্যান্টি আর ব্রা বের করে সেটা নিজের বুকের উপর লাগিয়ে দাঁত কেলিয়ে দেখাতে লাগলো তমালকে। সেগুলোর ভিতর থেকে তমাল যেগুলো পছন্দ করলো তার নেট এতো সুক্ষ্ম আর বড় যে সব কিছুই পরিস্কার দেখা যাবে। শুধু বোঁটা দুটোর কাছে দুটো সিল্কের ফুল আর প্যান্টিতে নীচের চেরার কাছে লম্বা একটা পাতা লাগানো। এই জিনিস তো রাধা ধোবার পরে সবার সামনে শুকোতেও দিতে পারবে না! তমাল দুজনকে তিন সেট করে ব্রা প্যান্টি কিনে দিলো। তার দাম শুনে রাধার অজ্ঞান হবার মতো অবস্থা হলো।
এর পরে তারা এস্কেলেটরে চড়ে একদম টপ ফ্লোরে চলে গেলো। সেখানে ফুড কোর্টে বসে নানা রকম খাবার খেলো। এরকম একটা দিন রাধা স্বপ্নেও কাটায়নি কখনো। মনে মনে সে তমালকে কৃতজ্ঞতা জানিতেই চলেছে। বন্দনা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে কারণ মুখার্জি বাড়িতে যাবার পরে অদিতি মৌপিয়া এমন কি রাজীবের সাথেও সে অনেকবার শপিং মলে গেছে। তার কাছে এগুলো খুব নতুন কিছু নয়। নতুন শুধু তমালের সঙ্গ। সেটা সে প্রাণ ভরে উপভোগ করছে। সারাটা সময় সে তমালদের হাতটা প্রায় বগলদাবা করে রেখেছে।
সে রাতেও দুই যুবতির সাথে তমালের মন্দ কাটলো না। পরদিন দশটা নাগাদ তারা হোটেল ছেড়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরলো। নিয়ামতপুরে রাধাকে তার বাবা মা'র কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বন্দনাকে নিয়ে আসানসোলের দিকে যাত্রা করলো।
মুখার্জি বাড়িতে ফিরে তমাল প্রথমেই দেখা করলো সুলতা পিসির সাথে। তাকে তার গ্রামের খবর, সুধণ্য বাবুর খবর বিস্তারিত জানালো। সুধণ্য বাবুর দেওয়া দুই বান্ডিল বিড়ি সে সুলতা দেবীকে দিয়ে জানালো যে তার ভাই নিজের হাতে বানিয়েছে এবং মিথ্যা করে বললো যে তার জন্যই পাঠিয়েছে। এই প্রথম তার মুখে অল্প হাসি দেখতে পেলো তমাল। তারপর চোখের কোল বেয়ে জলের ধারাও নেমে আসতে দেখলো তমাল। তিনি বললেন, কতোদিন তাদের খবর পাই না! আজ জানতে পেরে ভালো লাগলো। তোমাকে আশীর্বাদ করছি বাবা, ভালো থাকো তুমি, সুখে থেকো চিরকাল।
নিজের ঘরে ফিরে চটপট কয়েকটা কল করে নিলো তমাল। ইনস্পেকটর ঘোষকে চিত্তরঞ্জনের আপডেট জানালো। গার্গীর সাথেও কথা হলো তার। অনেক কষ্টে টিকিট যোগাড় করেছে সে। আজ রাতেই ট্রেনে উঠছে সে। ট্রেন সময় মতো চললে কাল রাতে আসানসোল পৌঁছে যাবে। তমাল জানালো তার কাজ শেষ প্রায়। আশা করছে পরশু মুখার্জি বাড়ির রহস্যের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলতে পারবে। গার্গী অবশ্য আগেভাগেই অপরাধী কে জানার জন্য কিছুক্ষণ ঝোলাঝুলি করলো, কিন্তু তমাল জানালো পরশু নিজের চোখেই দেখতে পাবে সব, তার আগে কিছু বলা যাবে না।
গার্গীর ফোনটা রাখতেই এলো শালিনীর কল। জানালো কলকাতার একটা কেসে তমালের থাকাটা খুব জরুরী। তার আসানসোলে আর কতোদিন লাগবে জানতে চাইলো। বললো, তেমন হলে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ফিরে কেসটা মিটিয়ে আবার না হয় আসানসোল যেতে। তমাল বুঝলো কলকাতার কেসটা অত্যন্ত জরুরী না হলে এ'কথা শালিনী কিছুতেই বলতো না। তমাল বললো, সে দিন তিনেকের ভিতরে কলকাতা ফিরবে। ততোদিন শালিনী যেন সামলে নেয়। শালিনী জানালো সেও তমালকে ভীষণ মিস করছে। ওখানে এতো কেস জমে না থাকলে নিজেও আসানসোল চলে যেতো। তমালও যে শালিনীকে খুব মিস করছে জানিয়ে ফোন রাখলো সে।
এ পর্যন্ত তমালদের গাড়িটা যে পৌঁছাতে পেরেছে, সেটাও অনেক ভাগ্যের কথা। রাস্তা যে খুব খারাপ তা নয়, তবে এসইউভি ঢোকার মতো যথেষ্ট প্রসস্ত নয়। তমাল নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। তমালের গাড়ি তাদের সামনে থামতেই বৃদ্ধদের আলোচনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবার মুখেই অপার বিস্ময়। বটগাছের নীচটা ইট সাজিয়ে মাটি লেপে বাঁধিয়ে নিয়েছে গ্রামের লোকজন। তাদের গ্রামের একমাত্র কফিহাউস বলে কথা! তমাল গিয়ে বসলো সেই বেদীতে। দোকানিকে দু'কাপ চা দিতে বললো সে। বিস্কুট আর কেক খাবার ইচ্ছা থাকলেও সাহসে কুলালো না। ইশারায় মদনকেও ডেকে নিলো। তমালের বেশভূষা গ্রামের লোকজনের সাথে এতোই বেমানান যে তারা তমালের সাথে সহজ হবে না। মদনকে দেখলে হয়তো তারা কিছুটা স্বস্তি পাবে বলেই তাকে ডেকে নিলো তমাল।
প্রথমেই কিছু জিজ্ঞাসা না করে দুজনে চা খেতে লাগলো। না তাকিয়েও তার পাশের বেশ কয়েক জোড়া চোখ যে তাকে কৌতুহল নিয়ে নিরীক্ষণ করে চলেছে, বেশ বুঝতে পারলো সে। তমাল তাদের দিকে ফিরে আন্তরিক হাসলো। তারপর পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলো তাদের দিকে। বৃদ্ধেরা যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। ছি ছি এ কি উপহাস রাজাধিরাজ... টাইপের একটা সম্ভ্রম তাদের চোখে। তমাল বললো, নিন না, সংকোচ কিসের?
দলটার মধ্যে একজন প্রথমে লজ্জা কাটিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট তুলে নিলো। তার দেখা দেখি একে একে সবাই এগিয়ে এলো। তমাল দোকানদারকেও একটা সিগারেট দিলো। তারপর তমাল যে তাদের থেকে আলাদা কিছু নয় বোঝাতে নিজেই উঠে গিয়ে লাইটার জ্বেলে সবার সিগারেট ধরিয়ে দিলো।
পৃথিবীতে যতো ধরনের বন্ধুত্ব আছে, তার ভিতরে দুই প্রকার বন্ধুত্ব শ্রেষ্ঠ। এক ক্লাসের বন্ধু আর এক গ্লাসের বন্ধু। তারপরেই হচ্ছে সুখটানের বন্ধু। সিগারেট শেয়ার করেই তমাল সেই গ্রাম-সভার মন জয় করে নিলো। তমাল যে সিগারেট খায়, তারাও এখন সেই সিগারেট খাচ্ছে, এই ভাব মনে আসতেই এক বৃদ্ধ একটা পা অন্যটার উপর তুলে দিয়ে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবু কুথা থেকে এসেছেন? আপনাকে আগে তো এই ঠাঁই দেখিনি বটে!
তমাল বললো, না আমি আগে কখনো আসিনি এদিকে। আমি আসলে ব্যবসার কাজে দুমকা যাচ্ছি। আমার এক পরিচিত মহিলার বাড়ি ছিলো এই হরিপুরা গ্রামে। সে আমাকে বলেছিলো যদি কোনোদিন সুযোগ পাই যেন দেখে যাই তার গ্রামের সবাই কেমন আছে। আজ কাজ একটু কম তাই এলাম আর কি।
তমালের কথায় দামী সিগারেট খাওয়ানো দেবদূতের সাহায্য করার হিড়িক পড়ে গেলো যেন। নানা দিক থেকে একের পর এক প্রশ্ন আসতে লাগলো। কে আগে তমালকে সাহায্য করবে তার প্রতিযোগিতা পড়ে গেলো বৃদ্ধদের মধ্যে। তমাল বললো, আমি সুলতাপিসির কাছ থেকে আসছি। সুলতা হো। এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, কুন সুলতা হো? সুলতা নামে তো কাউকে মুনে পড়ছেক লাই? তমাল আবার বললো, তার এক ভাইপোর নাম সুখদেব হো। ছেলেটা কয়েকবছর আগে মারা গেছে অসুখে।
হঠাৎ যেন এক নিমেষে উৎসাহ ঘুচে গেলো সবার। মুখ চোখ থমথমে হয়ে উঠলো উপস্থিত জনতার। কেউ কেউ সিগারেটের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন তমাল তাদের ঠকিয়ে বিষ খেতে দিয়েছে। নেহাত দামী দুস্প্রাপ্য বিষ, তাই দয়া করে খাচ্ছে, নাহলে কখন টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিতো! এক বৃদ্ধ বোধহয় তখনো বুঝতে পারেনি তাই পাশের জনকে নীচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, কে বলতো বটে? সেই ভদ্রলোক কিন্তু গলা চড়িয়েই বললো, বুঝতে লারিস নাই, উও সুধণ্যর কুলাঙ্গার বড় দিদিটার কুথা বলছে! যে বেটিটা গোত্রের মুখে চুনা কালি লাগায়ে পালাই গেছিলো? এবারে প্রশ্ন কর্তা বুঝতে পেরে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো।
তাদের ভাবভঙ্গী আর থমথমে পরিবেশ দেখে তমাল বুঝতে পারলো এখানে আর বিশেষ সুবিধা হবে না। গোটা আটেক সিগারেটের বলিদানের বিনিময়ে তমাল শুধু এটুকু বুঝলো যে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। তমাল জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা এই সুধণ্য বাবুর বাড়িটা কোন দিকে? তার প্রশ্নের উত্তরে এক বৃদ্ধ বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের পিঠের পিছনে এমন একটা দিক নির্দেশ করলো যার অর্থ দিল্লীও হতে পারে আবার কেরালাও হতে পারে। তমাল বুঝলো আর কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। সে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পড়লো।
সুধণ্য বাবুর বাড়ি খুঁজে পেতে তমালকে বেশ পরিশ্রম করতে হলো। পাথরের উপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া বাড়িগুলো খাপছাড়া ভাবে একে অন্যের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব রেখেই গড়ে উঠেছে। পুরুষরা এই সময়ে কেউ বাড়িতে নেই। যুবকেরা কাজের তাগিদে বাইরে, আর বয়স্করা বটতলার আড্ডায় জড়ো হয়েছে। মহিলারা কেউই তেমন তমালের সামনে এলো না। দু একজন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতের ইশারায় জানালো তারা জানে না।
প্রায় পুরো গ্রাম ঘুরে একটা পনেরো ষোলো বছরের ছেলের কাছে সুখদেবের নাম করার পরে তমাল সন্ধান পেলো বাড়িটার। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা নির্জন বাড়ি একা সঙ্গীহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কপাল ভালো যে সুধণ্য বাবুকে বাড়িতে পাওয়া গেলো। রুগ্ন এক বৃদ্ধ, যার বটতলার আড্ডা দিতে যাবার মতো শারীরিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনিও বসে নেই, বাড়ির দাওয়ায় বসে বিড়ি বাঁধছেন।
তমাল তার সামনে গিয়ে নমস্কার করলো। বৃদ্ধ ঘোলাটে চোখ মেলে চাইলো তার দিকে। চিনতে না পেরে তাকিয়ে রইলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। তমাল তার আসার কারণটা সংক্ষেপে ব্যক্ত করলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সুধণ্য বাবুর গলা চিড়ে, বললো, কি হবে আর সে সব পুরানো কথা বলে? দিদির কারণেই আমরা আজ প্রায় একঘরে হয়ে আছি বহু বছর ধরে। দিদি যে অপরাধ করেছে সেটা আমাদের হো সমাজে অমার্জনীয় অপরাধ। গ্রামে থাকলে তাকে মেরেই ফেলা হতো। পালিয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে সে। কিন্তু গোত্রের রাগটা এসে পড়লো আমাদের পরিবারের উপরে। একঘরে করে ধোঁপা নাপিত বন্ধ করে দিলো। সেই সময়ে কি যে দুরাবস্থার মধ্যে কাটিয়েছি, কি বলবো আপনাকে।
তমাল কিছু না বলে চুপচাপ শুনছিলো। বহু বছর পরে কেউ তার পরিবারের দুঃখের কথা শুনছে। মনের ভিতরে জগদ্দল পাথরের মতো জমে থাকা অভিমানেরা যেন পাথর সরিয়ে ঝর্ণার মতো বেরিয়ে আসতে চাইছে। তমাল জানে প্রশ্ন করলে সে শুধু সেই জিজ্ঞাসা গুলোর উত্তর পাবে, কিন্তু বাঁধা না দিলে পুরো ইতিহাস তার জানা হয়ে যাবে।
অনর্গল বলে গেলো বৃদ্ধ সুধণ্য হো। কখনো উত্তেজিত হয়ে, কখন কান্না ভেজা গলায়, কখনো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আবার কখনো থেমে থেমে। আধঘন্টার ভিতরে সব জানা হয়ে গেলো তমালের। বৃদ্ধ থামলে সে প্রশ্ন করলো, এখনো কি আপনারা একঘরে হয়েই আছেন? মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, বললেন, আমরাও দিদির সাথে যোগাযোগ রাখছি না দেখে গ্রামের প্রধানদের বোধহয় একটু দয়া হয়েছিলো। ধোঁপা নাপিতের অধিকার দিলো, কিন্তু মূল গ্রামে আর আমাদের যেতে দিলো না। এক কোনে এভাবেই পড়ে আছি।
তমাল বললো, কিন্তু সুখদেব তো যেতো সুলতা দেবীর কাছে? আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ। বললেন, হ্যাঁ, আমাদের পরিবারের এই মন্দ কপাল দেখে ছেলেটা দেখা করতে চেয়েছিলো পিসির সাথে। জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলো, কেন এমন করলো? গ্রামের বাইরে গিয়ে পড়াশনা করলো। ভালো ছাত্র ছিলো। হোস্টেলে থাকতো। কিভাবে যেন দিদির ঠিকানা যোগাড় করে পৌঁছে গেছিলো তার কাছে। পিসি ভাইপোর কি কথা হয়েছিলো জানি না, কিন্তু তার মনে আর দিদির জন্য রাগ ছিলো না। বরং নিজেদের গাছের ফলটা, নারকেলটা, গুড়টা নিয়ে যেতো পিসির জন্য। গ্রামে কাউকে জানাতাম না, কিন্তু সে যেতো পিসির কাছে। তারপর সেও একদিন চলে গেলো। এখন বুড়োবুড়ি অপেক্ষায় আছি কবে সিংবোঙ্গা'র আদেশে হিমো এসে চিরভ্রমনের জন্য উঠিয়ে নিয়ে যায়।
তমাল কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে দেখে বৃদ্ধ বললেন, আমাদের হো উপজাতি হলো খুব প্রাচীন উপজাতি। আমদের ভাষা হলো মুন্ডা। আগে আমাদের গোত্র অনেক বড় ছিলো, কিন্তু আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে এই ঝাড়খণ্ড আর উড়িষ্যার কোলহান অঞ্চলেই বেঁচে আছি। আমারা বীরের জাতি। শুনেছি সাহেবদের সাথেও যুদ্ধ করেছি আমরা। সত্যি কথা বলতে কি আমরা একটু হিংস্র উপজাতি। প্রতিশোধ আমাদের রক্তে টগবগ করে। আগে বলিও দেওয়া হতো। আমরা আমাদের গোত্র ছাড়া অন্য গোত্রে বিয়ে শাদী দেই না। এমনকি অন্য গোত্রের মানুষের সাথে সম্পর্কও রাখিনা খুব একটা। সিংবোঙ্গা হলো আমাদের প্রধান দেবতা, আর হিমো হলো মৃত্যুর দেবতা। আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা জগত জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর পাপীদের আত্মাকে সিংবোঙ্গা অন্ধকূপে বন্দী করে রাখেন। জগত ভ্রমণের অধিকার থাকেনা তার।
তমাল সুধণ্য বাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়লো। তমাল চলে আসার আগে বিনয়ের সাথে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে তিনি দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন তা। বরং তিনি তমালের হাতে তার নিজের হাতে বানানো দুই বান্ডিল বিড়ি ধরিয়ে দিলেন। সম্পূর্ণ অন্য চেহারার বিড়ি। শুকনো পাতার নয়, বরং অল্প কাঁচাই রয়েছে পাতাগুলো, তাই বিড়িগুলো একটু গোলাপি রংঙের। সাধারণ তেন্ডু পাতার বিড়ির চেয়ে তিনগুন বেশি লম্বা। তমাল ফিরতে শুরু করলো বটতলায় রেখে আসা গাড়ির দিকে।
ফেরার পথে মদন বললো, আপনি যার খোঁজ করছিলেন, সেই সুধণ্য বাবুর উপরে তো এদের বেশ রাগ দেখলাম। তমাল বললো, কেন? কিছু বলছিলো বুঝি? মদন বললো, হ্যাঁ, আপনি চলে যাবার পরে নিজেদের ভিতরে আলোচনা করছিলো। সুধণ্য বাবুর দিদি নাকি একটা সাহেবদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নার্সের কাজ করতো। সেখানে এক লোকের.....
মুখরোচক গল্পের খোঁজ পেয়ে মদন সেটা তমালকে জানাতে উসখুশ করছিলো। কিন্তু তমাল পুরোটাই শুনে এসেছে সুধণ্য বাবুর কাছে, তাই গ্রামের লোকের জল মেশানো গল্প শুনতে আগ্রহ বোধ করলো না। সে মদনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা মদন, ঘনশ্যামের সাথে তোমার আলাপ হয়েছে?
এমন রসালো গল্পের অপমৃত্যুতে একটু মনোক্ষুণ্ণ হলেও সামলে নিলো মদন। বললো, বাপরে! ফালতু লোক একটা। দু একবার ভাব জমাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কি বিচ্ছিরি মেজাজ। অন্যদের মানুষই মনে করে না। একদিন নিজের ঘরে বসে মাল খাচ্ছিলো, আমি একটু গল্প করতে গেলাম, সে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো আমাকে।
তমাল বললো, বিনা পয়সায় মাল খাওয়ার লোভে অন্যের ঘরে হানা দিলে তো তাড়িয়ে দেবেই মদন। তুমি তো আমাকে বলতে পারতে? মদন লজ্জা পেয়ে বললো, কি যে বলেন না দাদা, আমি এমনিই গেছিলাম কথা বলতে। তমাল তাকে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি দিতে কথা ঘোরালো, আচ্ছা মাল খাচ্ছিলো বললে, কোন হাতে গ্লাস ধরেছিলো বলতে পারবে?
এরকম সৃষ্টিছাড়া প্রশ্ন আশা করেনি মদন। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, তা তো মনে নেই দাদা... ডান হাতেই হবে! হ্যাঁ ডান হাতেই.....! কেন জিজ্ঞেস করছেন দাদা? তমাল বললো, কিছু না, এমনি। হোটেলে ফিরে চলো।
বিকেলে তমাল রাধা আর বন্দনা দুজনকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন ঘুরতে বেরোলো। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা মদন চিনতো, কারণ সে কয়েকদিন থেকেছে এখানে। তারপরে তারা একের পর এক শপিং মলে ঢু মারতে লাগলো। বিশেষ করে রাধা এসব মার্কেটে একদমই যাবার সুযোগ পায়না। তার বিস্ময় যেন বাঁধ মানতেই চায় না। এতো ঝলমলে দোকান একই জায়গায় সে কল্পনাই করতে পারে না। তাদের নিয়ামতপুরেও মার্কেট আছে, কিন্তু সে তো একটা রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান। এরকম এত্তো বড় একটা বাড়ির পুরোটা দোকানে ভর্তি হয়, সে জানতোই না।
মূলত তার জন্যই তমাল ওদের নিয়ে সিজে মার্কেট, আমলাদহী মার্কেট, এসপি ইষ্ট মার্কেট, এসপি নর্থ মার্কেট ঘুরে দেখালো। সবশেষে আরজে মার্কেটে এসে ওদের দুজনকে অনেক উপহার কিনে দিলো তমাল। প্রসাধনী, ড্রেস, ইমিটেশন গহনা কেনা হলে তমাল তাদের নিয়ে মেয়েদের অন্তর্বাসের দোকানে ঢুকলো। রাধা আগে এসব কিনতে এসেছে মায়ের সাথে। বাবা সাথে থাকলেও ঢুকতো না দোকানে, বাইরে দোকান থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো। দোকানের ভিতরেও মা যেন কেমন ফিসফিস করে আকার ইঙ্গিতে কথা বলে। তাই তমাল যখন তাদের নিয়ে বুক ফুলিয়ে দোকানে ঢুকে মহিলা দোকানদারকে জোরে জোরে কি চাই সেটা জানালো, রাধার ইচ্ছা হচ্ছিলো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে। দোকানদার মেয়েটাও বেহায়া কম না, নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে রসিকতা করছে তমালের সাথে। রাধা আর বন্দনাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো তাদের ভিতরে গার্লফ্রেন্ড কে? তমাল যখন বললো, দুজনই গার্লফ্রেন্ড, দুজনের জন্যই দেখান, মেয়েটা এমন ভাবে মুখ টিপে হাসলো যে রাধার ইচ্ছা হলো ওর মুখটা নখ দিয়ে খামচে রক্ত বের করে দেয়।
কিন্তু সে ভাষা হারিয়ে ফেললো যখন মেয়েটা পাতলা জালের প্যান্টি আর ব্রা বের করে সেটা নিজের বুকের উপর লাগিয়ে দাঁত কেলিয়ে দেখাতে লাগলো তমালকে। সেগুলোর ভিতর থেকে তমাল যেগুলো পছন্দ করলো তার নেট এতো সুক্ষ্ম আর বড় যে সব কিছুই পরিস্কার দেখা যাবে। শুধু বোঁটা দুটোর কাছে দুটো সিল্কের ফুল আর প্যান্টিতে নীচের চেরার কাছে লম্বা একটা পাতা লাগানো। এই জিনিস তো রাধা ধোবার পরে সবার সামনে শুকোতেও দিতে পারবে না! তমাল দুজনকে তিন সেট করে ব্রা প্যান্টি কিনে দিলো। তার দাম শুনে রাধার অজ্ঞান হবার মতো অবস্থা হলো।
এর পরে তারা এস্কেলেটরে চড়ে একদম টপ ফ্লোরে চলে গেলো। সেখানে ফুড কোর্টে বসে নানা রকম খাবার খেলো। এরকম একটা দিন রাধা স্বপ্নেও কাটায়নি কখনো। মনে মনে সে তমালকে কৃতজ্ঞতা জানিতেই চলেছে। বন্দনা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে কারণ মুখার্জি বাড়িতে যাবার পরে অদিতি মৌপিয়া এমন কি রাজীবের সাথেও সে অনেকবার শপিং মলে গেছে। তার কাছে এগুলো খুব নতুন কিছু নয়। নতুন শুধু তমালের সঙ্গ। সেটা সে প্রাণ ভরে উপভোগ করছে। সারাটা সময় সে তমালদের হাতটা প্রায় বগলদাবা করে রেখেছে।
সে রাতেও দুই যুবতির সাথে তমালের মন্দ কাটলো না। পরদিন দশটা নাগাদ তারা হোটেল ছেড়ে দিয়ে ফেরার পথ ধরলো। নিয়ামতপুরে রাধাকে তার বাবা মা'র কাছে বুঝিয়ে দিয়ে বন্দনাকে নিয়ে আসানসোলের দিকে যাত্রা করলো।
মুখার্জি বাড়িতে ফিরে তমাল প্রথমেই দেখা করলো সুলতা পিসির সাথে। তাকে তার গ্রামের খবর, সুধণ্য বাবুর খবর বিস্তারিত জানালো। সুধণ্য বাবুর দেওয়া দুই বান্ডিল বিড়ি সে সুলতা দেবীকে দিয়ে জানালো যে তার ভাই নিজের হাতে বানিয়েছে এবং মিথ্যা করে বললো যে তার জন্যই পাঠিয়েছে। এই প্রথম তার মুখে অল্প হাসি দেখতে পেলো তমাল। তারপর চোখের কোল বেয়ে জলের ধারাও নেমে আসতে দেখলো তমাল। তিনি বললেন, কতোদিন তাদের খবর পাই না! আজ জানতে পেরে ভালো লাগলো। তোমাকে আশীর্বাদ করছি বাবা, ভালো থাকো তুমি, সুখে থেকো চিরকাল।
নিজের ঘরে ফিরে চটপট কয়েকটা কল করে নিলো তমাল। ইনস্পেকটর ঘোষকে চিত্তরঞ্জনের আপডেট জানালো। গার্গীর সাথেও কথা হলো তার। অনেক কষ্টে টিকিট যোগাড় করেছে সে। আজ রাতেই ট্রেনে উঠছে সে। ট্রেন সময় মতো চললে কাল রাতে আসানসোল পৌঁছে যাবে। তমাল জানালো তার কাজ শেষ প্রায়। আশা করছে পরশু মুখার্জি বাড়ির রহস্যের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলতে পারবে। গার্গী অবশ্য আগেভাগেই অপরাধী কে জানার জন্য কিছুক্ষণ ঝোলাঝুলি করলো, কিন্তু তমাল জানালো পরশু নিজের চোখেই দেখতে পাবে সব, তার আগে কিছু বলা যাবে না।
গার্গীর ফোনটা রাখতেই এলো শালিনীর কল। জানালো কলকাতার একটা কেসে তমালের থাকাটা খুব জরুরী। তার আসানসোলে আর কতোদিন লাগবে জানতে চাইলো। বললো, তেমন হলে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ফিরে কেসটা মিটিয়ে আবার না হয় আসানসোল যেতে। তমাল বুঝলো কলকাতার কেসটা অত্যন্ত জরুরী না হলে এ'কথা শালিনী কিছুতেই বলতো না। তমাল বললো, সে দিন তিনেকের ভিতরে কলকাতা ফিরবে। ততোদিন শালিনী যেন সামলে নেয়। শালিনী জানালো সেও তমালকে ভীষণ মিস করছে। ওখানে এতো কেস জমে না থাকলে নিজেও আসানসোল চলে যেতো। তমালও যে শালিনীকে খুব মিস করছে জানিয়ে ফোন রাখলো সে।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম