23-05-2025, 08:01 PM
সে বললো, আমি বরং মালিক মিঃ অনিমেশ দত্তকে খবর দিচ্ছি। তিনি এসে যা বলবেন, আমি সেভাবেই কাজ করবো।তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কোনো কাজ করিনা মিঃ..... তমালের দিকে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো। তমাল নিজের পরিচয় দিলো, তমাল, তমাল মজুমদার।
মিঃ তমাল মালিক সব জানেন, তিনি এলে তাকেই বলবেন আপনার কি চাই, বললো ম্যানেজার। তমাল একটু ঝুঁকে রাখাল রায়ের চোখে চোখ রেখে বললো, তিনি সব জানেন? আপনি শিওর? এই হোমের রাখাল হয়েও প্রতিদিন রাতে যে আপনি আপনার নিজের জন্য মেয়েদের চড়াচ্ছেন গেস্ট রুমে ডেকে, সেটাও জানেন? নিষেধ থাকা স্বত্তেও আপনি বন্দনাকে ডেকে যে আপনার নোংরা লালসা চরিতার্থ করতেন, সেকথাও জানেন? আমার সাথে চুপচাপ সহযোগিতা করুন মিঃ রায়, নাহলে এমন অবস্থা করবো আপনার যে হোম তো দূর, নিজের বাড়িতে যে বিয়ে করা গাই আর বাছুরেরা আছে, তাদেরও রাখাল হতে পারবেন না জীবনে। আর তারা আপনার এই জঘন্য মানসিকতার কথা জানতে পারলে কি করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো তমাল।
ঢিল যে ঠিক জায়গায় লেগেছে সেটা রাখাল রায়ের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘন ঘন কপাল আর মুখ মোছা দেখাই বুঝতে পারলো সে। ইচ্ছা করেই আর একটা কথাও বললো না তমাল, যেন এটাই শেষ কথা এমন ভাব করে বসে রইলো। ঢাকনা সরিয়ে ঢকঢক করে জল খেলো ম্যানেজার। দেখুন মিঃ মজুমদার, আমি যে আপনাকে ফাইল দেখাচ্ছি, এটা যেন কেউ জানতে না পারে প্লিজ, অনুনয় ঝরে পড়লো তার গলা দিয়ে। তমাল হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না। সে উঠে গিয়ে পিছনের আলমারি খুলে খুঁজে খুঁজে বন্দনার ফাইলটা নিয়ে এলো।
তমাল ফাইলটা নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো। একটা হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটের কোনে। মুহুর্তে অনেক জট খুলে গেলো তমালের মনের। বন্দনার ছোট বেলার বেশ কয়েকটা ফটোগ্রাফ রয়েছে। একা, এবং বাবা মায়ের সাথে। নিজের চোখে দেখলেও ফাইল সে কিছুতেই বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না জানে, তাই গম্ভীর মুখে বললো, একটু চায়ের ব্যবস্থা করুন তো মিঃ রায়, বেশ সময় লাগবে ফাইল দেখতে বুঝতে পারছি। কথা দিলাম সেরকম কিছু না পেলে আপনাকে জড়াবো না।
শেষের কথাটা শুনে বিগলিত হয়ে পড়লো, ম্যানেজার। বিন্দু দেবী রাধা আর বন্দনাকে নিয়ে ভিতরে গেছেন, তাই নিজেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো তমালের জন্য চায়ের যোগাড় করতে। শুধু যে চা নয়, আরো অনেক কিছু আসবে তমাল বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলো। ম্যানেজার রুমের বাইরে যেতেই কাজে নামলো সে। পকেট থেকে আইফোনটা বের করে দ্রুত হাতে ছবি তুলতে লাগলো ফাইলের সবগুলো পাতার। জানে সে এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই এই ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বিশেষ ছবিও সে নিজের শার্টের ভিতরে চালান করে দিলো। কাজ শেষ করে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো সে, তখনই ঘরে ঢুকলো রাখাল রায়। সাথে একটি মেয়ের হাতে প্রচুর জলখাবার!
তমাল বললো, আমি শুধু চা খাবো, এগুলো এনেছেন কেন? ম্যানেজার গদগদ হয়ে বললো, আপনি প্রথমবার আমাদের এখানে এলেন, এ তো সামান্য আয়োজন। আগে জানলে.....! তমাল যেন রাখাল বাবুর মেয়েকে বিয়ে করবে বলে দেখতে এসেছে, এমন ভাব ভঙ্গী করছে রাখাল রায়। সে খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে বললো, আমার সাথে যারা এসেছে, ওরাও সকালে বোধহয় টিফিন করেনি। ম্যানেজার রাখাল ব্যস্ত হয়ে বললো, এদের নিয়ে চিন্তা করবেন না, আপনি নিন। বলেই যে মেয়েটি খাবার নিয়ে এসেছিলো, তাকে ইশারা করলো। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলো।
তমাল খেতে খেতে বললো, আপনি কতোদিন এখানে আছেন রাখাল বাবু? তা প্রায় তিরিশ বছর হবে। আগে একজন ম্যানেজার ছিলো এখনকার মালিকের বাবার আমলে। তখন আমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম। মিঃ দত্ত মালিক হবার পরে আমাকে ম্যানেজার করে দেন, উত্তর দিলো রাখাল রায়। ঘনশ্যাম কতোদিন আপনাদের এখানে চাকরি করেছে? প্রশ্ন করলো তমাল।
ঘনশ্যাম? ও বহু বছর আছে। মাঝে সে একটা বাড়িতে ড্রাইভারি পেয়েছে জানিয়ে তার এক ভাইকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। কয়েক বছর পরে ফিরে এসে আবার কিছুদিন চাকরি করে। তারপর আবার চলে যায়, জানালো ম্যানেজার।
তার সেই ভাইকে তাহলে আবার কাজে লাগিয়ে দিয়ে যায়? সে আছে এখনো? অমলেট কেটে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জানতে চাইলো তমাল। রাখাল রায় বললো, না না, সে আর চাকরি করে না এখানে। সে তো এখন মস্ত গ্যারাজ করেছে একটা। আগে কাজ করতো ওই গ্যারাজে, এখন কিনে নিয়েছে।
তমাল এরপরে আরও অনেক্ষণ ধরে রাখাল রায়ের কাছ থেকে অনেক জরুরী ইনফরমেশন যোগাড় করলো। তারপর তাকে বললো, শুনুন মিঃ রায়, আপনার ভালোর জন্য একটা কথা বলছি। আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে হাত বাড়াবেন না। আপনার মালিক হোমের যুবতি মেয়েদের দেহ ব্যাবসায় ভাড়া খাটায়, এ তথ্য আমাদের কাছে আছে। হায়ার অথোরিটি তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে সেটা তারাই ঠিক করবে। সে বড়লোক মানুষ, টাকাপয়সা ছড়িয়ে বেঁচে গেলেও যেতে পারে, কিন্তু ফাঁসবেন আপনি। ভালো হয় যদি এই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বৌ বাচ্চা নিয়ে থেকে অন্য কোনো কাজ করেন। আর যদি সম্ভব না হয় এই বয়সে এতো বড় ভুঁড়ি নিয়ে নতুন কাজ খুঁজে নেওয়া, তাহলে অন্তত, বাকী জীবনটা ভদ্রলোকের মতো কাটান। আমাদের রাডারে যখন এসেছেন, হোমের উপর নজর থাকবে বুঝতেই পারছেন। আবার যদি শুনি আপনি মেয়েদের রাতে ফাঁকা ঘরে ডেকে পাঠাচ্ছেন, তাহলে কথা দিয়ে গেলাম আমি একরাত আপনার সাথে শোবো, এবং কোনো তেল ব্যবহার করবো না। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!
আবার রুমাল বেরিয়ে এসেছে রাখাল রায়ের হাতে। কোনো রকমে মাথা দুলিয়ে বোঝালো যে ক্লিয়ার লাইক ক্রিস্টাল! তমাল বললো, যান, এবারে মেয়ে দুজনকে ডেকে দিন, ফিরতে হবে আমাদের। রাখাল রায় নিজেই দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো রাধা আর বন্দনাকে ডাকতে। তমাল বাইরে এসে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালালো।
পাঁচ মিনিটের ভিতরে রাখাল রায় আর বিন্দু দেবী রাধা আর বন্দনাকে নিয়ে গাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। বন্দনা গাড়িতে ওঠার আগে রাখাল রায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ম্যানেজার বাবু, আপনার ওখানের সেই চুলকানিটা সেরেছে, যেটার জন্য আমি মুখে নিতে চাইতাম না? বন্দনার কথা শেষ হবার আগেই রাধা বললো, আর ভুঁড়িটা একটু কমান? একে তো যা সাইজ আপনার, ভুঁড়ির জন্য তো ইঁদুরটা গর্তে ঢুকতেই পারে না, শুধু বাইরেই সুড়সুড়ি দেয়। আপনার বৌ নিশ্চয়ই একটা অজগর জুটিয়ে নিয়েছে, নাহলে এতোদিনে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতো। রাখাল রায় লজ্জায় মুখ নীচু করে রইলো এদের কথা শুনে। গাড়ি চলতে শুরু করলে তমাল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বিন্দু দেবী রাখাল রায়ের দিকে ভর্ৎসনার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
তমাল বন্দনাকে বললো, এবারে তুমি আমাদের সেই বাড়িটায় নিয়ে চলো, যেখানে ঘনশ্যাম তোমাকে ছোট বেলায় মধুছন্দা দেবীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যেতো। বন্দনা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তমালদা, তুমি ম্যানেজার কে খুনের মামলার তদন্তে এসেছো বললে কেন? কে খুন হয়েছে? আর কে খুন করলো? তমাল তাড়াতাড়ি বললো, আরে এসব বাড়িয়ে না বললে ম্যানেজার ফাইল দেখাতো নাকি? বন্দনা তবুও তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দেখে কথা ঘোরাতে রাধার দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা আমারটা ইঁদুর না অজগর? রাধা মুচকি হেসে জানলার বাইরে মুখ ফিরিয়ে বললো, অ্যানাকোন্ডা!
বন্দনার পথ নির্দেশ অনুসরণ করে ওরা একটা ছোট একতলা বাড়িতে এসে পৌঁছালো। বাড়িটার জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে তমাল জিজ্ঞেস করলো, তুমি শিওর এই বাড়িতেই আসতে? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো বন্দনা। বললো হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর। অনেকবার এসেছি। সব কিছু মুখস্থ আমার এই বাড়ির। মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখতে পাই বাড়িটার পিছনের বাগানে ছোট্ট আমি খেলা করছি।
তমাল অনুমান করলো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এখানেই উঠেছিলো মধুছন্দা দেবী স্বামীর সাথে। গাড়ি থেকে নেমে তারা বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কড়া নাড়তে এক অতি বৃদ্ধা মহিলা এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই? ভিতর থেকে কাশতে কাশতে এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসেছে? এবাড়িতে যে অতিথি বিশেষ আসে না সেটা বলাই বাহুল্য।
তমাল বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। এতোটা না করলেও চলতো, কিন্তু ভিতরে গিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে হলে এটুকু অতিবিনয়ের প্রয়োজন হবে জানতো তমাল। বৃদ্ধা তমালের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, তারপর তমাল উঠে দাঁড়াতে তার থুতনিটা ছুঁয়ে নিজের আঙুল গুলোয় চুমু দিলেন। গুরুজনদের এই বিশেষ আশীর্বাদ ভঙ্গীটা বড় ভালো লাগে তমালের। বৃদ্ধা হেসে বললেন, তুমি।কে বাবা? তোমাকে তো চিনতে পারলাম না?
তমাল বললো, আমি তমাল মাসিমা। আমার পিসি এই বাড়িতে থাকতেন এক সময়। এই দুজন আমার পিসতুতো বোন। চিত্তরঞ্জনে একটা কাজে আসছি শুনে ওরা বায়না করলো ছোটবেলার বাড়িটা একবার দেখবে, তাই নিয়ে এলাম। আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেললাম বোধহয় তাই না? তিনি বললেন, আরে ছি ছি, কি বলছো বাবা! অতিথি নারায়ণ! বুড়োবুড়ি থাকি, কেউ আসেনা আমাদের কাছে। তা তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো বাবা! তোমরাও এসো মা!
ঘর গুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দেওয়ালের প্লাস্টার পর্যন্ত উঠে গেছে অনেক জায়গায়। তারা ভাগাভাগি করে তক্তাপোশ, টুল আর ভাঙা চেয়ারে বসলো। বন্দনা চারিদিকে চোখ ঘোরাতে লাগলো। তার ছোট বেলার স্মৃতি ছবি মেলাতে না পেরে আহত হচ্ছে তার মুখ দেখেই অনুমান করতে পারছে তমাল।
তমাল বৃদ্ধাকে বললেন, মাসিমা হাতে তো বেশি সময় নেই, যদি অনুমতি দেন, বাড়িটা আমরা একটু ঘুরে দেখবো? ছোটবেলায় আমিও দু একবার এসেছি তো এই বাড়িতে, তাই আর কি? বৃদ্ধা বললেন, যাও না বাবা, নিজের বাড়ি মনে করে ঘুরে দেখো।
প্রথমে ঘর গুলো ঘুরে দেখলো তিনজনে। একটা ঘরে মলিন তক্তপোশে রুগ্ন এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। পাশে বিভিন্ন রকম ওষুধে ছয়লাপ। সবই সস্তা হাতুড়ে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ বোঝা যাচ্ছে। তারপর তারা বেরিয়ে এলো পিছনের একচিলতে বাগানে। জংলা আগাছায় প্রায় ঢেকে ফেলেছে পুরো জায়গাটা। পিছনের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। দক্ষিন কোনায় বড় বড় দুটো জাম গাছ, একটা পুরানো অচ্ছুৎ পাতকুয়োকে যেন লজ্জা থেকে বাঁচাতে আড়াল করে রেখেছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাড়িটাকে খুঁটিয়ে দেখলো তমাল। তারপর বললো, চলো যাওয়া যাক্! আর কিছু দেখার নেই এখানে। বন্দনাও যেন পালাতে চাইছে তার স্বপ্নের বাড়িটার করুণ দশা দেখে। বললো, হ্যাঁ চলো, ভালো লাগছে না আমার। ভিতরে এসে বৃদ্ধার কাছে বাড়ির মালিকের নাম জানলো তমাল, কারণ এ বাড়ি যে তাদের নয় সেটা না বললেও চলে।
এই বাড়িটার বাড়িওয়ালাকে তার নিজের বাড়িতেই পাওয়া গেলো। তিনিও অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক, বিপত্নীক। স্ত্রী গত হয়েছেন বহু আগেই। দুজন কাজের লোক নিয়ে একাই থাকেন। দুই ছেলেই বিদেশে থাকে। দেশে ফেরায় কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ নেই। উনিও শেষ বয়সে দেশ ছেড়ে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে চান না। দেশের মাটিতেই তার অন্তিম শয্যা হোক এটাই তার একমাত্র ইচ্ছা। ওই বাড়িটা সারিয়ে নেবার কোনো উৎসাহ নেই। বিনা ভাড়ায় তাই থাকতে দিয়েছেন তার মতোই অসহায় দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে।
মধুছন্দা দেবীর কথা জিজ্ঞাসা করতে তিনি মনে করতে পারলেন। বললেন, বহুদিন আগের কথা, মধু তার স্বামীকে নিয়ে থাকতো ওই বাড়িতে। তারপর হঠাৎ একদিন স্বামী নিরুদ্দেশ হলো। তার পরেও বেশ কিছুদিন ছিলো ওই বাড়িতে। পরে অন্য কোথায় উঠে যায়, তিনি জানেন না। বন্দনা আর রাধার সামনে সব কথা জিজ্ঞেস করা যায় না বলে তমাল তার সাথে আড়ালে আরও কিছুক্ষণ কথা বললো। বৃদ্ধের স্মৃতি শক্তি এখনো বেশ টনটনে, সাল তারিখ গুলো বললেন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে। কথা শেষ করে বেরিয়ে এলো তারা।
আপাতত আর কোনো কাজ নেই যতোক্ষণ না ইনস্পেকটর গড়াই খবর পাঠাচ্ছেন, তাই হোটেলেই ফিরে এলো তমালরা। জমিয়ে একটা লাঞ্চ করে দুটো যুবতীকে দুপাশে কোলবালিশ বানিয়ে একটু গড়িয়ে নিলো তমাল। কোলবালিশ দুটো একটু চেষ্টা করেছিলো যাতে তমাল তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়, কিন্তু তাদের তুলো ভরা নরম শরীর একটু টিপে টুপে দেখা ছাড়া আর কিছুই করলো না সে। বরং আজকের পাওয়া ইনফরমেশন গুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘন্টা দেড়েক ভালোই ঘুম হলো। যখন জাগলো, দেখলো কোলবালিশ দুটো একপাশে চলে গেছে আর একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।
ইনস্পেকটর গড়াই এর ফোনটা এলো পাঁচটা নাগাদ। ততোক্ষণে রাধা আর বন্দনাও উঠে পড়েছে। তাদের বলে তমাল মদনকে নিয়ে চললো থানার দিকে। তমালকে ঢুকতে দেখে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো ইনস্পেকটর গড়াই। বললো, দুপুর নাগাদ নিয়ে এসেছি। পুলিশ তার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে দেখেই পালাবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পারেনি। তোমাকে আগেই খবর দিতাম, কিন্তু আমরা একটু আদর যত্ন করে নরম করে রেখেছি তোমার সুবিধা হবে বলে।
তমাল হেসে ধন্যবাদ জানালো ইনস্পেকটর গড়াইকে। তারপর দুজনে মিলে চললো লক আপ এ। মিঃ গড়াইয়ের লোকজন খাতির যত্ন একটু বেশিই করেছে মনে হয়, কারণ তমালকে সত্যিই বেশি কষ্ট করতে হলো না। দু একটা প্রমাণ সামনে রাখতেই গড়গড় করে বলে দিয়েছে সব। ইনস্পেকটর গড়াই সব নোট করে নিয়ে তাকে দিয়ে সই করিয়ে নিলো। থানা থেকে খুশি মনে বেরিয়ে আসার আগে তমাল বেশ কিছু সময় ধরে বাসুদেব গড়াইকে বুঝিয়ে বললো পুরো ঘটনাটা। মিঃ গড়াই শুনে বিস্মিত হবার সাথে সাথে বেশ উত্তেজিতও হয়ে পড়লেন। তারপর তমাল বললো তাকে কি কি করতে হবে এবং কোথায় খুঁজতে হবে। ইনস্পেকটর গড়াই আশ্বাস দিলেন কাল থেকেই কাজে লেগে পড়বেন। তমাল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।
রাতে রাধা বন্দনা আর তমাল এক ঘরেই শুলো। বলাই বাহুল্য রাতটা ঝঞ্ঝাবিহীন কাটলো না। আজ রাধা অনেক নির্লজ্জ এবং অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছে। দুজনের মনের অনেক লুকানো সাধ তমাল সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে পূরণ করলো। মাঝ রাত পেরিয়ে যাবার পরে ঝড় থামলে তারা ঘুমিয়ে পড়লো একে অপরকে অবলম্বন করে।
পরদিন সকালে উঠে তমাল জানালো তাকে সারাদিনের জন্য কাজে যেতে হবে। তারা দুজন চাইলে নিজেদের মতো একটু চিত্তরঞ্জন ঘুরে নিতে পারে। ইচ্ছা মতো লাঞ্চের অর্ডার করে খেয়ে নিতে পারে তারা। দুজনে তমালের সাথে যেতে চাইলে তমাল এড়িয়ে গেলো। যে কাজে তমাল যাচ্ছে সেখানে বন্দনার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়।
তমাল মদনকে দুমকার দিকে যেতে বললো। ধুৎলার রাস্তা ধরে প্রথমে জামতারা পৌঁছে ডান দিকে বেঁকে পালজোরি গেলো। সেখান থেকে জামুন্ডির দিকে মাইল দশেক এগিয়ে পথচারীদের সাহায্যে পৌঁছালো হরিপুরা গ্রামে। সুলতাপিসির আদিনিবাস। একটা আদিবাসী গ্রাম। দেশের উন্নতির সাথে তাল মেলাতে পারেনি এইসব আদিবাসী গ্রামের উন্নয়ন। এখানকার মানুষের ভোটের দাম বোধহয় শহরবাসীর চেয়ে কম, অথবা এদের মানুষই মনে করা হয়না। দারিদ্র্যের চিহ্ন এমন ভাবে লেগে আছে পুরো গ্রামটার গায়ে যে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আস্ফালন মিথ্যা মনে হয়।
মিঃ তমাল মালিক সব জানেন, তিনি এলে তাকেই বলবেন আপনার কি চাই, বললো ম্যানেজার। তমাল একটু ঝুঁকে রাখাল রায়ের চোখে চোখ রেখে বললো, তিনি সব জানেন? আপনি শিওর? এই হোমের রাখাল হয়েও প্রতিদিন রাতে যে আপনি আপনার নিজের জন্য মেয়েদের চড়াচ্ছেন গেস্ট রুমে ডেকে, সেটাও জানেন? নিষেধ থাকা স্বত্তেও আপনি বন্দনাকে ডেকে যে আপনার নোংরা লালসা চরিতার্থ করতেন, সেকথাও জানেন? আমার সাথে চুপচাপ সহযোগিতা করুন মিঃ রায়, নাহলে এমন অবস্থা করবো আপনার যে হোম তো দূর, নিজের বাড়িতে যে বিয়ে করা গাই আর বাছুরেরা আছে, তাদেরও রাখাল হতে পারবেন না জীবনে। আর তারা আপনার এই জঘন্য মানসিকতার কথা জানতে পারলে কি করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লো তমাল।
ঢিল যে ঠিক জায়গায় লেগেছে সেটা রাখাল রায়ের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘন ঘন কপাল আর মুখ মোছা দেখাই বুঝতে পারলো সে। ইচ্ছা করেই আর একটা কথাও বললো না তমাল, যেন এটাই শেষ কথা এমন ভাব করে বসে রইলো। ঢাকনা সরিয়ে ঢকঢক করে জল খেলো ম্যানেজার। দেখুন মিঃ মজুমদার, আমি যে আপনাকে ফাইল দেখাচ্ছি, এটা যেন কেউ জানতে না পারে প্লিজ, অনুনয় ঝরে পড়লো তার গলা দিয়ে। তমাল হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না। সে উঠে গিয়ে পিছনের আলমারি খুলে খুঁজে খুঁজে বন্দনার ফাইলটা নিয়ে এলো।
তমাল ফাইলটা নিয়ে খুলে দেখতে লাগলো। একটা হাসি খেলে গেলো তার ঠোঁটের কোনে। মুহুর্তে অনেক জট খুলে গেলো তমালের মনের। বন্দনার ছোট বেলার বেশ কয়েকটা ফটোগ্রাফ রয়েছে। একা, এবং বাবা মায়ের সাথে। নিজের চোখে দেখলেও ফাইল সে কিছুতেই বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না জানে, তাই গম্ভীর মুখে বললো, একটু চায়ের ব্যবস্থা করুন তো মিঃ রায়, বেশ সময় লাগবে ফাইল দেখতে বুঝতে পারছি। কথা দিলাম সেরকম কিছু না পেলে আপনাকে জড়াবো না।
শেষের কথাটা শুনে বিগলিত হয়ে পড়লো, ম্যানেজার। বিন্দু দেবী রাধা আর বন্দনাকে নিয়ে ভিতরে গেছেন, তাই নিজেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো তমালের জন্য চায়ের যোগাড় করতে। শুধু যে চা নয়, আরো অনেক কিছু আসবে তমাল বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলো। ম্যানেজার রুমের বাইরে যেতেই কাজে নামলো সে। পকেট থেকে আইফোনটা বের করে দ্রুত হাতে ছবি তুলতে লাগলো ফাইলের সবগুলো পাতার। জানে সে এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই এই ফাইল আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা বিশেষ ছবিও সে নিজের শার্টের ভিতরে চালান করে দিলো। কাজ শেষ করে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো সে, তখনই ঘরে ঢুকলো রাখাল রায়। সাথে একটি মেয়ের হাতে প্রচুর জলখাবার!
তমাল বললো, আমি শুধু চা খাবো, এগুলো এনেছেন কেন? ম্যানেজার গদগদ হয়ে বললো, আপনি প্রথমবার আমাদের এখানে এলেন, এ তো সামান্য আয়োজন। আগে জানলে.....! তমাল যেন রাখাল বাবুর মেয়েকে বিয়ে করবে বলে দেখতে এসেছে, এমন ভাব ভঙ্গী করছে রাখাল রায়। সে খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে বললো, আমার সাথে যারা এসেছে, ওরাও সকালে বোধহয় টিফিন করেনি। ম্যানেজার রাখাল ব্যস্ত হয়ে বললো, এদের নিয়ে চিন্তা করবেন না, আপনি নিন। বলেই যে মেয়েটি খাবার নিয়ে এসেছিলো, তাকে ইশারা করলো। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলো।
তমাল খেতে খেতে বললো, আপনি কতোদিন এখানে আছেন রাখাল বাবু? তা প্রায় তিরিশ বছর হবে। আগে একজন ম্যানেজার ছিলো এখনকার মালিকের বাবার আমলে। তখন আমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম। মিঃ দত্ত মালিক হবার পরে আমাকে ম্যানেজার করে দেন, উত্তর দিলো রাখাল রায়। ঘনশ্যাম কতোদিন আপনাদের এখানে চাকরি করেছে? প্রশ্ন করলো তমাল।
ঘনশ্যাম? ও বহু বছর আছে। মাঝে সে একটা বাড়িতে ড্রাইভারি পেয়েছে জানিয়ে তার এক ভাইকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। কয়েক বছর পরে ফিরে এসে আবার কিছুদিন চাকরি করে। তারপর আবার চলে যায়, জানালো ম্যানেজার।
তার সেই ভাইকে তাহলে আবার কাজে লাগিয়ে দিয়ে যায়? সে আছে এখনো? অমলেট কেটে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে জানতে চাইলো তমাল। রাখাল রায় বললো, না না, সে আর চাকরি করে না এখানে। সে তো এখন মস্ত গ্যারাজ করেছে একটা। আগে কাজ করতো ওই গ্যারাজে, এখন কিনে নিয়েছে।
তমাল এরপরে আরও অনেক্ষণ ধরে রাখাল রায়ের কাছ থেকে অনেক জরুরী ইনফরমেশন যোগাড় করলো। তারপর তাকে বললো, শুনুন মিঃ রায়, আপনার ভালোর জন্য একটা কথা বলছি। আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে হাত বাড়াবেন না। আপনার মালিক হোমের যুবতি মেয়েদের দেহ ব্যাবসায় ভাড়া খাটায়, এ তথ্য আমাদের কাছে আছে। হায়ার অথোরিটি তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবে সেটা তারাই ঠিক করবে। সে বড়লোক মানুষ, টাকাপয়সা ছড়িয়ে বেঁচে গেলেও যেতে পারে, কিন্তু ফাঁসবেন আপনি। ভালো হয় যদি এই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বৌ বাচ্চা নিয়ে থেকে অন্য কোনো কাজ করেন। আর যদি সম্ভব না হয় এই বয়সে এতো বড় ভুঁড়ি নিয়ে নতুন কাজ খুঁজে নেওয়া, তাহলে অন্তত, বাকী জীবনটা ভদ্রলোকের মতো কাটান। আমাদের রাডারে যখন এসেছেন, হোমের উপর নজর থাকবে বুঝতেই পারছেন। আবার যদি শুনি আপনি মেয়েদের রাতে ফাঁকা ঘরে ডেকে পাঠাচ্ছেন, তাহলে কথা দিয়ে গেলাম আমি একরাত আপনার সাথে শোবো, এবং কোনো তেল ব্যবহার করবো না। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!
আবার রুমাল বেরিয়ে এসেছে রাখাল রায়ের হাতে। কোনো রকমে মাথা দুলিয়ে বোঝালো যে ক্লিয়ার লাইক ক্রিস্টাল! তমাল বললো, যান, এবারে মেয়ে দুজনকে ডেকে দিন, ফিরতে হবে আমাদের। রাখাল রায় নিজেই দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো রাধা আর বন্দনাকে ডাকতে। তমাল বাইরে এসে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালালো।
পাঁচ মিনিটের ভিতরে রাখাল রায় আর বিন্দু দেবী রাধা আর বন্দনাকে নিয়ে গাড়ির সামনে উপস্থিত হলো। বন্দনা গাড়িতে ওঠার আগে রাখাল রায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ম্যানেজার বাবু, আপনার ওখানের সেই চুলকানিটা সেরেছে, যেটার জন্য আমি মুখে নিতে চাইতাম না? বন্দনার কথা শেষ হবার আগেই রাধা বললো, আর ভুঁড়িটা একটু কমান? একে তো যা সাইজ আপনার, ভুঁড়ির জন্য তো ইঁদুরটা গর্তে ঢুকতেই পারে না, শুধু বাইরেই সুড়সুড়ি দেয়। আপনার বৌ নিশ্চয়ই একটা অজগর জুটিয়ে নিয়েছে, নাহলে এতোদিনে আপনাকে ছেড়ে চলে যেতো। রাখাল রায় লজ্জায় মুখ নীচু করে রইলো এদের কথা শুনে। গাড়ি চলতে শুরু করলে তমাল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বিন্দু দেবী রাখাল রায়ের দিকে ভর্ৎসনার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
তমাল বন্দনাকে বললো, এবারে তুমি আমাদের সেই বাড়িটায় নিয়ে চলো, যেখানে ঘনশ্যাম তোমাকে ছোট বেলায় মধুছন্দা দেবীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যেতো। বন্দনা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা তমালদা, তুমি ম্যানেজার কে খুনের মামলার তদন্তে এসেছো বললে কেন? কে খুন হয়েছে? আর কে খুন করলো? তমাল তাড়াতাড়ি বললো, আরে এসব বাড়িয়ে না বললে ম্যানেজার ফাইল দেখাতো নাকি? বন্দনা তবুও তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দেখে কথা ঘোরাতে রাধার দিকে ফিরে বললো, আচ্ছা আমারটা ইঁদুর না অজগর? রাধা মুচকি হেসে জানলার বাইরে মুখ ফিরিয়ে বললো, অ্যানাকোন্ডা!
বন্দনার পথ নির্দেশ অনুসরণ করে ওরা একটা ছোট একতলা বাড়িতে এসে পৌঁছালো। বাড়িটার জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে তমাল জিজ্ঞেস করলো, তুমি শিওর এই বাড়িতেই আসতে? মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো বন্দনা। বললো হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর। অনেকবার এসেছি। সব কিছু মুখস্থ আমার এই বাড়ির। মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখতে পাই বাড়িটার পিছনের বাগানে ছোট্ট আমি খেলা করছি।
তমাল অনুমান করলো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এখানেই উঠেছিলো মধুছন্দা দেবী স্বামীর সাথে। গাড়ি থেকে নেমে তারা বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কড়া নাড়তে এক অতি বৃদ্ধা মহিলা এসে দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই? ভিতর থেকে কাশতে কাশতে এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কে এসেছে? এবাড়িতে যে অতিথি বিশেষ আসে না সেটা বলাই বাহুল্য।
তমাল বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। এতোটা না করলেও চলতো, কিন্তু ভিতরে গিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখতে হলে এটুকু অতিবিনয়ের প্রয়োজন হবে জানতো তমাল। বৃদ্ধা তমালের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, তারপর তমাল উঠে দাঁড়াতে তার থুতনিটা ছুঁয়ে নিজের আঙুল গুলোয় চুমু দিলেন। গুরুজনদের এই বিশেষ আশীর্বাদ ভঙ্গীটা বড় ভালো লাগে তমালের। বৃদ্ধা হেসে বললেন, তুমি।কে বাবা? তোমাকে তো চিনতে পারলাম না?
তমাল বললো, আমি তমাল মাসিমা। আমার পিসি এই বাড়িতে থাকতেন এক সময়। এই দুজন আমার পিসতুতো বোন। চিত্তরঞ্জনে একটা কাজে আসছি শুনে ওরা বায়না করলো ছোটবেলার বাড়িটা একবার দেখবে, তাই নিয়ে এলাম। আপনাদের খুব অসুবিধায় ফেললাম বোধহয় তাই না? তিনি বললেন, আরে ছি ছি, কি বলছো বাবা! অতিথি নারায়ণ! বুড়োবুড়ি থাকি, কেউ আসেনা আমাদের কাছে। তা তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো বাবা! তোমরাও এসো মা!
ঘর গুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দেওয়ালের প্লাস্টার পর্যন্ত উঠে গেছে অনেক জায়গায়। তারা ভাগাভাগি করে তক্তাপোশ, টুল আর ভাঙা চেয়ারে বসলো। বন্দনা চারিদিকে চোখ ঘোরাতে লাগলো। তার ছোট বেলার স্মৃতি ছবি মেলাতে না পেরে আহত হচ্ছে তার মুখ দেখেই অনুমান করতে পারছে তমাল।
তমাল বৃদ্ধাকে বললেন, মাসিমা হাতে তো বেশি সময় নেই, যদি অনুমতি দেন, বাড়িটা আমরা একটু ঘুরে দেখবো? ছোটবেলায় আমিও দু একবার এসেছি তো এই বাড়িতে, তাই আর কি? বৃদ্ধা বললেন, যাও না বাবা, নিজের বাড়ি মনে করে ঘুরে দেখো।
প্রথমে ঘর গুলো ঘুরে দেখলো তিনজনে। একটা ঘরে মলিন তক্তপোশে রুগ্ন এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। পাশে বিভিন্ন রকম ওষুধে ছয়লাপ। সবই সস্তা হাতুড়ে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ বোঝা যাচ্ছে। তারপর তারা বেরিয়ে এলো পিছনের একচিলতে বাগানে। জংলা আগাছায় প্রায় ঢেকে ফেলেছে পুরো জায়গাটা। পিছনের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। দক্ষিন কোনায় বড় বড় দুটো জাম গাছ, একটা পুরানো অচ্ছুৎ পাতকুয়োকে যেন লজ্জা থেকে বাঁচাতে আড়াল করে রেখেছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাড়িটাকে খুঁটিয়ে দেখলো তমাল। তারপর বললো, চলো যাওয়া যাক্! আর কিছু দেখার নেই এখানে। বন্দনাও যেন পালাতে চাইছে তার স্বপ্নের বাড়িটার করুণ দশা দেখে। বললো, হ্যাঁ চলো, ভালো লাগছে না আমার। ভিতরে এসে বৃদ্ধার কাছে বাড়ির মালিকের নাম জানলো তমাল, কারণ এ বাড়ি যে তাদের নয় সেটা না বললেও চলে।
এই বাড়িটার বাড়িওয়ালাকে তার নিজের বাড়িতেই পাওয়া গেলো। তিনিও অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক, বিপত্নীক। স্ত্রী গত হয়েছেন বহু আগেই। দুজন কাজের লোক নিয়ে একাই থাকেন। দুই ছেলেই বিদেশে থাকে। দেশে ফেরায় কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ নেই। উনিও শেষ বয়সে দেশ ছেড়ে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে চান না। দেশের মাটিতেই তার অন্তিম শয্যা হোক এটাই তার একমাত্র ইচ্ছা। ওই বাড়িটা সারিয়ে নেবার কোনো উৎসাহ নেই। বিনা ভাড়ায় তাই থাকতে দিয়েছেন তার মতোই অসহায় দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে।
মধুছন্দা দেবীর কথা জিজ্ঞাসা করতে তিনি মনে করতে পারলেন। বললেন, বহুদিন আগের কথা, মধু তার স্বামীকে নিয়ে থাকতো ওই বাড়িতে। তারপর হঠাৎ একদিন স্বামী নিরুদ্দেশ হলো। তার পরেও বেশ কিছুদিন ছিলো ওই বাড়িতে। পরে অন্য কোথায় উঠে যায়, তিনি জানেন না। বন্দনা আর রাধার সামনে সব কথা জিজ্ঞেস করা যায় না বলে তমাল তার সাথে আড়ালে আরও কিছুক্ষণ কথা বললো। বৃদ্ধের স্মৃতি শক্তি এখনো বেশ টনটনে, সাল তারিখ গুলো বললেন বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে। কথা শেষ করে বেরিয়ে এলো তারা।
আপাতত আর কোনো কাজ নেই যতোক্ষণ না ইনস্পেকটর গড়াই খবর পাঠাচ্ছেন, তাই হোটেলেই ফিরে এলো তমালরা। জমিয়ে একটা লাঞ্চ করে দুটো যুবতীকে দুপাশে কোলবালিশ বানিয়ে একটু গড়িয়ে নিলো তমাল। কোলবালিশ দুটো একটু চেষ্টা করেছিলো যাতে তমাল তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়, কিন্তু তাদের তুলো ভরা নরম শরীর একটু টিপে টুপে দেখা ছাড়া আর কিছুই করলো না সে। বরং আজকের পাওয়া ইনফরমেশন গুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘন্টা দেড়েক ভালোই ঘুম হলো। যখন জাগলো, দেখলো কোলবালিশ দুটো একপাশে চলে গেছে আর একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।
ইনস্পেকটর গড়াই এর ফোনটা এলো পাঁচটা নাগাদ। ততোক্ষণে রাধা আর বন্দনাও উঠে পড়েছে। তাদের বলে তমাল মদনকে নিয়ে চললো থানার দিকে। তমালকে ঢুকতে দেখে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো ইনস্পেকটর গড়াই। বললো, দুপুর নাগাদ নিয়ে এসেছি। পুলিশ তার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে দেখেই পালাবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পারেনি। তোমাকে আগেই খবর দিতাম, কিন্তু আমরা একটু আদর যত্ন করে নরম করে রেখেছি তোমার সুবিধা হবে বলে।
তমাল হেসে ধন্যবাদ জানালো ইনস্পেকটর গড়াইকে। তারপর দুজনে মিলে চললো লক আপ এ। মিঃ গড়াইয়ের লোকজন খাতির যত্ন একটু বেশিই করেছে মনে হয়, কারণ তমালকে সত্যিই বেশি কষ্ট করতে হলো না। দু একটা প্রমাণ সামনে রাখতেই গড়গড় করে বলে দিয়েছে সব। ইনস্পেকটর গড়াই সব নোট করে নিয়ে তাকে দিয়ে সই করিয়ে নিলো। থানা থেকে খুশি মনে বেরিয়ে আসার আগে তমাল বেশ কিছু সময় ধরে বাসুদেব গড়াইকে বুঝিয়ে বললো পুরো ঘটনাটা। মিঃ গড়াই শুনে বিস্মিত হবার সাথে সাথে বেশ উত্তেজিতও হয়ে পড়লেন। তারপর তমাল বললো তাকে কি কি করতে হবে এবং কোথায় খুঁজতে হবে। ইনস্পেকটর গড়াই আশ্বাস দিলেন কাল থেকেই কাজে লেগে পড়বেন। তমাল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।
রাতে রাধা বন্দনা আর তমাল এক ঘরেই শুলো। বলাই বাহুল্য রাতটা ঝঞ্ঝাবিহীন কাটলো না। আজ রাধা অনেক নির্লজ্জ এবং অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছে। দুজনের মনের অনেক লুকানো সাধ তমাল সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে পূরণ করলো। মাঝ রাত পেরিয়ে যাবার পরে ঝড় থামলে তারা ঘুমিয়ে পড়লো একে অপরকে অবলম্বন করে।
পরদিন সকালে উঠে তমাল জানালো তাকে সারাদিনের জন্য কাজে যেতে হবে। তারা দুজন চাইলে নিজেদের মতো একটু চিত্তরঞ্জন ঘুরে নিতে পারে। ইচ্ছা মতো লাঞ্চের অর্ডার করে খেয়ে নিতে পারে তারা। দুজনে তমালের সাথে যেতে চাইলে তমাল এড়িয়ে গেলো। যে কাজে তমাল যাচ্ছে সেখানে বন্দনার উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়।
তমাল মদনকে দুমকার দিকে যেতে বললো। ধুৎলার রাস্তা ধরে প্রথমে জামতারা পৌঁছে ডান দিকে বেঁকে পালজোরি গেলো। সেখান থেকে জামুন্ডির দিকে মাইল দশেক এগিয়ে পথচারীদের সাহায্যে পৌঁছালো হরিপুরা গ্রামে। সুলতাপিসির আদিনিবাস। একটা আদিবাসী গ্রাম। দেশের উন্নতির সাথে তাল মেলাতে পারেনি এইসব আদিবাসী গ্রামের উন্নয়ন। এখানকার মানুষের ভোটের দাম বোধহয় শহরবাসীর চেয়ে কম, অথবা এদের মানুষই মনে করা হয়না। দারিদ্র্যের চিহ্ন এমন ভাবে লেগে আছে পুরো গ্রামটার গায়ে যে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আস্ফালন মিথ্যা মনে হয়।

kingsuk25@ জিমেইল ডট কম