21-05-2025, 03:50 AM
(৫২)
শেষ কথা
ছেলেকে রেখে ফেরার সময় জয়তী দেখল, দরজার বাইরে পোস্টঅফিসের লোক। ‘গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ লেখা দু’টি খাম নিয়ে দাঁড়িয়ে। সরকারি খামের চিঠি, তাই সই করে নিতে হবে। একটি ওর নামে, অন্যটি সুভদ্রার নামে। ও নিজেই সই করে চিটি দুটো নিয়ে ইশারায় সুভদ্রাকে নিয়ে সৌমাভর শোয়ার ঘরে ঢুকল। তার পর দরজা আটকে সুভদ্রাকে ইঙ্গিতে চিঠি খুলতে বলল। ‘সুভদ্রা সরকার’ নাম লেখা খামের মুখ কেটে সুভদ্রা একটা চিঠি বের করল। একপাতার মাত্র চিঠি। তাতে কয়েকটা লাইন লেখা, ‘‘স্নেহের সুভদ্রা, ভেদিয়ার বাড়িতে তোকে জড়িয়ে ধরে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। বলা ভাল, রাখলাম না। অবশ্য রেখেও খুব লাভ হত না। যাক, তোর সংসার তোর হাতেই ছেড়ে গেলাম। সবকিছু। তোকে একদিন বলেছিলাম না, আমি অতিথি। অতিথিদের বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে নেই রে। তাই চলে যাচ্ছি। তার উপর নোংরা চরিত্রের অতিথি তো, তোর কোনওদিন দুর্নাম হলে সেটা তোর পরিবারের সকলের পক্ষেই খারাপ হত। খুব ভাল থাকিস সবাই মিলে। আমি তো বেশ্যা বলে সবার কাছে পরিচিত, তাই তোর ছেলেমেয়েকে আশীর্বাদ করে যেতে পারলাম না। প্রার্থনা করি, তোরা সবাই ভাল থাকিস। ইতি ঈশিতা (বেশ্যাদের পদবী থাকে না, তাই লিখলাম না)।’’
চিঠিটা পড়ে সুভদ্রা স্তম্ভিত হয়ে গেল! ওর মনে পড়ল, ঈশিতা এ বাড়িতে এসে সব কাজ নিজে হাতে করা শুরু করার পরে ও একদিন তা নিয়ে বকাবকি করায় ঈশিতা বলেছিল, ‘‘তোর সংসার তোরই থাকবে, দেখিস। আমি তো অতিথি রে!’’ সেদিনই ওর খটকা লেগেছিল। কিন্তু বলি বলি করেও জয়তীকে বলা হয়নি। ও কেঁদে ফেলল। জয়তী ওর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কিছু না বলে ওর নাম লেখা খামটা খুলল,
‘‘জয়তীদি (আজ আর দিদি লিখলাম না, অনেক কারণে), প্রথম অনুরোধ এই চিঠি পুড়িয়ে দিও। কারও হাতে পড়লে বিপদ হবে, অকারণ থানা-পুলিশ। তার উপর তোমাদের সরকারি চাকরি, ছেলেমেয়ে তিনটের ভবিষ্যৎ, সব মিলিয়েই বললাম।
চল্লাম গো। ভাল থেকো। দেখি, ওপারে গিয়ে দেখা পাই কি না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি। দিন কয়েক আগে সুভদ্রা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমি কেন আর গুনগুন করে হলেও গান গাই না। ওকে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের গানের মানে না বুঝে গাইতাম আগে। এখন বুঝি বলে আর গাইতে পারি না। জানো, আন্দামানে বিয়ের পরে যখন সবাই আমাকে ১২ বছরের বড় ওই লোকটার কাছে রেখে চলে গেছিল, খুব কেঁদেছিলাম দু’দিন। খাইনি, ঘুমোইওনি। তিন দিনের দিন আমাকে নিয়ে সমুদ্রের বিচে বসে ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ গানটার ইতিহাস বলে গেয়ে উঠেছিল নিজের মনেই। ওই মুহূর্তে লোকটার প্রেমে পড়িনি শুধু, তার হাতে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিলাম। বিনা বাধায়। তার পরে অনেকগুলো দিন তার কাছে নিলাজের মতো নিজেকে মেলে ধরেছিলাম। আমাকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে। তার পর কলকাতায় এসে জানো, প্রথম ক’দিন ঘর গোছাতেই কেটে গেল। এত ক্লান্ত লাগত, কী বলব। আমি তো আগে তখন এসব করিনি। মাত্র ১৮ বছর হয়েছে। হাঁপিয়ে যেতাম গো। শরীর যেন ভেঙে আসত। রাতে ওর কাছে শুলেও ক্লান্তি আর নতুন জায়গার লজ্জায় নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারতাম না। তার কয়েকদিন পরে কাঁকুরগাছির বাড়িতে গিয়ে নিজের বইখাতা নিয়ে ফেরার পথে পিরিয়ডের ডেট চলে গেছে দেখে কি মনে করে ইউরিন টেস্টের জন্য টাকা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ও বাড়ি ফিরে আমি কেন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করিনি, তাই নিয়ে বিস্তর বকাবকি করল। আমার খারাপ লাগলেও কিছু বলিনি। আহারে, সারাজীবন একা থেকেছে লোকটা, সত্যিই তো ওরও ইচ্ছে করে আত্মীয় পেতে। কিন্তু তার পরেই আমাকে আন্দামানের মতো করে থাকতে বলায় খুব রাগ হয়েছিল। যা নয় তাই বলেছিলাম। কেমন গুম খেয়ে গেছিল। রাতে আদরও করেনি। আমারও রাগ হয়ে গেল শুয়ে পড়লাম। পরদিন ইউরিন রিপোর্ট পেয়ে দেখলাম, পজিটিভ। বিশ্বাস করো জয়তীদি, তখনও পর্যন্ত আমার গর্ভ অপবিত্র হয়নি। ওরা অপবিত্র গর্ভের সন্তান নয় গো। পরের দিন ডাক্তার দেখিয়ে রাতে কাঁকুরগাছির বাড়িতে গেলাম ওকে নিয়ে। ভেবেছিলাম, যে আমাকে এত দিয়েছে, তাকে আজ আন্দামানের রাত ফিরিয়ে দেব। কিন্তু নিজের আগের ঘরটায় শুতে গিয়ে কেন যেন হঠাৎ কলেজের ক্রাশের কথা মনে করে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে শুয়ে ওকে বুকে টেনে নিলেও আমার বিক্ষিপ্ত মনটা ও বুঝে ফেলেছিল। আচমকাই নেমে গিয়েছিল উপর থেকে। কিছু বলার সাহসই পায়নি। বয়সে বড় লোকটাকে সত্যি ভয়ও পেতাম তখন। রাতে শুনাম গাইছে,
‘‘নিবিড় সুখে মধুর দুখে
জড়িত ছিল সেই দিন
দুই তারে জীবনের
বাঁধা ছিল বীন,
তার ছিঁড়ে গেছে কবে......’’ কেঁদে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম, অভিভাবক হিসেবে, স্বামী হিসেবে না হোক প্রিয়তম বন্ধু হিসেবে আমাকে বলবে কিছু, বোঝাবে। জিজ্ঞাসা করবে, ভুল শুধরে দেবে। হাজার হোক, আমার সব কিছু তো ওরই হাতে, ওরই কাঁধে। আন্দামানে থাকার সময় কোনও ভুল করলে কত বোঝাত। সেই আশাতেই ছিলাম জানো। কি বোকা আমি! বুঝিনি, ও নিজেই বীনার তার কেটে দিয়েছে! তার পর থেকে আমি ভুলের পর ভুল করে গেছি, কিন্তু একটা দিনও আমাকে আর আগের মতো করে জড়িয়ে ধরে বকে, বুঝিয়ে সামলায়নি। উল্টে আমার থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেছে, আমার দু’বছরের ছোট বোনকে বরং অনেক কথা বলেছে। কিন্তু ১২ বছরের ছোট আমাকে একটা কথাও বলেনি! আমি অন্যায়, ভুল কোনওটাই অস্বীকার সেদিনও করিনি, আজও করব না। আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে বিয়ে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলেছিল। যার হাতে তুলে দিয়েছিল, তাকে আমি নিজের সর্বস্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা অষ্টাদশীর মনের ভাব লোকটা বোঝেইনি। তাই দূরত্ব বাড়ছিল। আমি বহু দিন হাউমাউ করে কেঁদেছি। কখনও ওর কাছে, কখনও মায়ের কাছে। নভেম্বরে বেলেঘাটার বাসায় ফেরার পরেও কলেজের ব্যস্ততায় ওকে সময় না দিয়ে অন্যায় করেছি ঠিক, কিন্তু ও তো একদিনও আমাকে জোর করে চেপে ধরে বলেনি, তুমি এটা কোরো না, ওটা কোরো না? উল্টে আমি জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে বারবার ওকে পুরনো সময় ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিতে গেলে একটু হেসে সরিয়ে দিত নিজের থেকে। আজ এসব কথা অবান্তর, কিন্তু বিশ্বাস কর, কলকাতায় ফিরে থেকে আমার সব ভুল ওর চোখে পড়লেও একদিনও আমাকে আগের মতো করে বোঝানো তো দূর, কাছেও আসত না। দূরত্ব বাড়াচ্ছিল রোজ। তার পরে তো একদিনে মাত্র কয়েক ঘন্টায় আমি চিরকালের জন্য বেশ্যা হয়ে গেলাম! আজও তুমি বিশ্বাস করবে না, সেদিন একটা সময় রাহুল আমায় রেপ পর্যন্ত করেছিল, হুমকি দিয়েছিল বাড়িতে, কলেজে, পাড়ায় কলঙ্ক রটাবে। সে কাজে ওর ‘সুনাম’ ছিল। শরীরর খিদের সঙ্গে ভয়— আমাকে গুলিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রের মতো সব সহ্য করেছিলাম। এবং বুঝেছিলাম, আমি প্রতারক, আমি বেশ্যা। পরে ওর চিঠি পড়ে দিদিরাও সেটা বুঝিয়েছিল, এমনকি চার মাস পরে তোমার কাছে যে দু’দিন গেছিলাম, সে দু’দিনও তুমি ঘুরিয়ে সেটাই বুঝিয়েছিলে। আমি জানতাম, একটা বেশ্যার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তাই কথাগুলো সেদিন বলতে পারিনি। আজ আমার কোনও লাজভয় নেই। চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছি। তাই একটা প্রশ্ন করছি, বিয়ের সময় বয়স ১৮ বছর, তোমার কাছে যে দু’দিন গেছিলাম, তখন আমি সদ্য ১৯। টিনএজ একটা মেয়ে ভুল, অন্যায় করলে তাকে সবাই বোঝায়। জানো, আমাকে কেউ বোঝায়নি। উল্টে পিঠে বেশ্যা ছাপ মেরে দিয়েছে অবলীলায়! কতবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও করিনি একটাই কারণে। ওকে সামনে পেলে এই প্রশ্নটাই করতাম, কেন সেদিন আমাকে বোঝাওনি আগের মতো করে? তুমি তো জানতে আমি টিন এজের একটা মেয়ে। যার অনেক বিষয়ে বোধবুদ্ধি নেই। সে ভুল করলে বোঝাবে না? ১২ বছরের বড় হয়েও? এ কি রকম অভিভাবক, স্বামী, বন্ধু তুমি। জয়তীদি, আজ বুঝি, বীনার দুটো তারই ও নিজে হাতে ছিঁড়ে দিয়েছিল কাঁকুরগাছির বাড়িতে প্রথম রাতেই। বা হয়তো তারও আগে, আমি রেগে গিয়ে চারটে উল্টোপাল্টা মুখ করেছিলাম বলেছিলাম যেদিন! কে জানে! আজ আর জেনে লাভও নেই। একটা কষ্ট কি জানো, তুমি নিজেও জানতে, আমি তখন কী রকম পাগলের মতো ওর পায়ে পড়তেও রাজি, আমার বয়স, সব তুমি জানতে। তবু তুমি আমার জন্য সে ভাবে কিছু করোনি। ওর বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে। আমার সর্বস্ব হারালেও তোমার কিছু এসে যায়নি! হয়তো খারাপ লাগবে শুনতে, আমার দুই দিদির সঙ্গে যে তোমার যোগাযোগ ছিল, সেটা বুঝেছিলাম ওর মৃত্যুর দিন। তার আট-নয় বছর আগে ও কলকাতায় ফিরে এসেছে। ততদিনে হয়তো আমার উপরে ঘৃণাটা অনেক কমে গিয়েছিল। তবু দিদিদের থেকে খোঁজ নিয়ে আমাকে একবারও লোকটার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাওনি। কেন গো? আমার দিদিরা তো জানত, আমি বিশ্বভারতীতে পড়াই। খবরটা তুমি জানতে না, তা তো নয়। তখন আমি চাকরি করছি, কারও গলগ্রহ হব না বলে। কারণ আমার পরিবারে আমার বেশ্যা পরিচয়টাই সবথেকে বড় হয়ে উঠেছিল। তাই একাকীত্বে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু চাকরি নয়, আমি সংসার করতে চেয়েছিলাম গো, বিশ্বাস কর। ছেলেমেয়ে, স্বামী সবাইকে নিয়ে জমাট সংসারের স্বপ্ন দেখতাম রোজ। ওর বুকে মাথা রেখে গান শুনব, শোনাব, ছেলেমেয়েকে বড় করব, লেখাপড়া করাব। আমি পুরোদস্তুর সংসারী হতে চেয়েছিলাম। তোমাকে একবার এসব বলেওছিলাম কলকাতায় থাকতে থাকতে। কিন্তু তুমি সব জেনেও না লোকটাকে আমার কাছে এনে দিয়েছো, না আমাকে লোকটার কাছে নিয়ে গেছো। আমি এই ক’দিনে বিস্তর খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তুমি সেই সময় কয়েকবার কর্নাটকের ভদ্রা বলে একটা জায়গায় যেতে, পরে বম্বেতে যেতে। জেনেছিলাম, ওই দুই জায়গাতেই ও থাকত তখন। তখনও মাঝেমধ্যে তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়, আমি খোঁজ নিই পাগলের মতো, কাঁদি ছেলেমেয়ের জন্য। কিন্তু লাভ হয়নি। এমনকি লোকটা চাকরি ছেড়ে শান্তিনিকেতন থেকে আধঘন্টার দূরত্বে আছে জেনেও দিদিদের বলেকয়ে ঠিকানা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগও করোনি! আমি ভেসে গেছি গত ১৮ বছর ধরে। একটা কথা বিশ্বাস করতে পারো, আমি ওই একদিনই বেশ্যা হয়েছিলাম, তার পর থেকে আমার শরীর কেউ স্পর্শও করতে পারেনি। তবু তোমাদের সবার চোখে আমি বেশ্যা! শরীরের খিদেয় যারতার সঙ্গে শুতেও পারি! কয়েক মাস আগে ১৮-য় পা দেওয়া যমজ ভাইবোনের কাছেও সেই ইমেজ । কি কপাল ভাবো তো? সেদিন মুকুট্টির অনুষ্ঠানের গান-কবিতা শুনতে শুনতে ভিতরে একটা উথালপাথাল হচ্ছিল। পরের দিন যখন বোনকে নিয়ে দাদা বাইকে চড়ে আমার দিকে তাকাল, তখন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গুঞ্জার বরের বাইকে ওদের ধাওয়া করেছিলাম। তাই শেষ ছোঁয়াটা ছুঁতে পেরেছিলাম, কেউ না চাইলেও। তার পরেও ওদের আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ওদের কাছে নিজেকে নোংরা মেয়ে বলে তুলে ধরতেও মুখে বাধেনি, ক্ষমা চেয়েছি, কেঁদেছি, বুকে টেনেছি। কিন্তু আমি তো শেষপর্যন্ত একটা বেশ্যাই, তাই না? তাই প্রথমদিন আমার হাতে খাওয়ার সময় থেকে ওদের জড়তাটা টের পেয়েছি। ভেবেছিলাম, কলকাতায় ফিরে হয়তো কেটে যাবে। যায়নি। বরং আমার হাতে খেতে ওদের অস্বস্তি বাড়ত। তাই আমি আর পরের দিকে ওদের কাছে মা ডাকটা শুনতে চাওয়ার জন্য আকুল হতাম না। সুভদ্রা বলেছিল, সময় দিতে। আজ দিয়ে গেলাম। অনন্ত সময়।
ওদের ১৮ পার হয়েছে কয়েক মাস আগে। আর কয়েক মাস পরে ওরা ১৯এ পড়বে। ওরা ভুল করলে তোমরা সবাই মিলে ঠিক করে দেবে, বকবে, জানবে কি হয়েছে, সেটার সমাধান বলবে, বুকে টেনে নেবে। এটাই স্বাভাবিক। এবং এটা আরও অন্তত পাঁচ-সাত বছর পর্যন্ত ওরা পাবে। আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো ওরা এই জায়গায় ভাগ্যবান। যে ভাগ্য আমার হয়নি। আমি ১৮য় মা হয়েছিলাম, ১৯এ সব হারিয়ে বেশ্যা পরিচয় পেয়েছিলাম। আমার কপালে এসব জোটেনি গো। সব কিছু যার হাতে দিয়েছিলাম, সে ক্রমশ দূরেই ঠেলে দিয়েছে, আমিও শ্যাওলার মতো দূরে ভেসে গেছি।
যাক অনেক কথা লিখলাম। যার সঙ্গে জীবন জুড়ে ছিল, সে দুটো তার একসঙ্গে ছিঁড়ে দিয়েছিল বহু বহু আগে। তখনও আমি কুড়িতে বুড়ির দলে ঢুকিনি। অনেক ছোট ছিলাম। তার পর থেকে জীবনটা টেনে নিয়ে গিয়েছি। রোজ কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে শুতাম, উঠতাম। আর নয় গো। সুভদ্রাকে বোলো, ওর সংসার বা ওর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিড়ম্বনা আর রইল না। আর কাউকে মা ডাকার জন্য ওদের না কারও কাছে ছোট হতে হবে, না কারও বকুনি শুনতে হবে। তা ছাড়া একটা বেশ্যাকে কি মা ডাকা যায় জয়তীদি? বেশ্যাদের তো ছেলেমেয়ে থাকতে নেই। তাই সব দুর্ভাবনা, চিন্তার জাল কেটে দিলাম। বীনার তার ছিঁড়ে গেছে ১৯ বছর হওয়ার আগেই, তারহীন বীনাটা এখন কাঁধে বোঝার মতো লাগছে। এবার সেটার বিসর্জন। বিয়ের শাড়িটা পড়ে চল্লাম জানো, যদি চিনতে পারে! জানি না, এখনও আমাকে ঘৃণা করে কি না, তবু আশা তো...
অরণ্য, মৃত্তিকা আর সমুদ্রের জন্য যেটুকু রেখেছি, সেটা আমার পড়ানোর টাকা, পৈত্রিক বাড়ি বিক্রির টাকা। বিশ্বাস করে, শরীর বিক্রির টাকা দিয়ে ওদের অমঙ্গল করিনি। তবু যদি তোমাদের দ্বিধা থাকে, তোমরা ওই টাকা কোনও অনাথ আশ্রমে বা ঘরহারানো মেয়েদের নিয়ে কাজ করে এমন কাউকে দিয়ে দিও।
ওহ একটা কথা। যার হাতে আমার বাকি সবটুকু শেষ হয়েছিল, সে তার প্রাপ্য পেয়েছে। ভেবেছিল, আমি সেই বেশ্যাই আছি। বোঝেনি, যাকে সে বেশ্যা উপাধি পাইয়ে দিয়েছিল, তার হাতেই মরতে হবে। তিন ঘন্টার বিনিময়ে একটা ছোট্ট ধাক্কা।
ভাল থেকো। ওদের ভাল রেখো, ভাল থাকতে বোলো। আর শেষ কথা, গুঞ্জাকে জানিয়ো, ওর ট্রান্সফার হয়ে গেছে। এপ্রিলে ছেলেকে নিয়ে ওর বরের কাজের জায়গাতেই যেতে পারবে। আমার সঙ্গে ওর বরের কথা হয়েছে। তাকে অনুরোধ করেছি, সংসার ভাঙা সহজ, গড়া কঠিন। একটা ঘটনায় কাউকে বিচার করতে নেই। জানো, কী আশ্চর্য, ছেলেটা বুঝেছে। ও ভাল থাক। তোমরাও। দিদিদের পরে খবর দিও।
ইতি ঈশিতা
(এমনিও চাকরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সরকার টাইটেলটাই ব্যবহার করেছি। পরে বুঝেছি, বেশ্যাদের তো টাইটেল থাকে না! তা ছাড়া গত ১৮ বছর বেশ্যা পরিচয়টাই সেঁটে গেছে পিঠে, তাই শুধু নামটাই লিখলাম) কোনও কথায় খারাপ লাগলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভাল থেকো।’’
চিঠিটা পড়া শেষ করে জয়তী যখন মুখ তুলল, ওর চোখ লাল। চোখের জল নেমে ভিজে গেছে শাড়ি-ব্লাউজের অনেকটা। একটা কথাও না বলে চিঠিটা সুভদ্রার হাতে দিয়ে বলল, পড়ে পুড়িয়ে দিস। ও সবার কথা ভাবত, কেউ ওর কথা ভাবেনি। আজ চোখে আঙুল দিয়ে সব দেখিয়ে গেল।
সুভদ্রা চিঠিটা হাতে নিতে নিতে দেখল, ঘরে ঢুকছে অরণ্য আর মৃত্তিকা। কী করবে এ বার? ওরা কি কিছু বুঝেছে? ওর মাথা কাজ করছে না। তাকিয়ে দেখল, চোখ মুছতে মুছতে জয়তী ঘর ছাড়ছে।
(শেষ)
শেষ কথা
ছেলেকে রেখে ফেরার সময় জয়তী দেখল, দরজার বাইরে পোস্টঅফিসের লোক। ‘গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ লেখা দু’টি খাম নিয়ে দাঁড়িয়ে। সরকারি খামের চিঠি, তাই সই করে নিতে হবে। একটি ওর নামে, অন্যটি সুভদ্রার নামে। ও নিজেই সই করে চিটি দুটো নিয়ে ইশারায় সুভদ্রাকে নিয়ে সৌমাভর শোয়ার ঘরে ঢুকল। তার পর দরজা আটকে সুভদ্রাকে ইঙ্গিতে চিঠি খুলতে বলল। ‘সুভদ্রা সরকার’ নাম লেখা খামের মুখ কেটে সুভদ্রা একটা চিঠি বের করল। একপাতার মাত্র চিঠি। তাতে কয়েকটা লাইন লেখা, ‘‘স্নেহের সুভদ্রা, ভেদিয়ার বাড়িতে তোকে জড়িয়ে ধরে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। বলা ভাল, রাখলাম না। অবশ্য রেখেও খুব লাভ হত না। যাক, তোর সংসার তোর হাতেই ছেড়ে গেলাম। সবকিছু। তোকে একদিন বলেছিলাম না, আমি অতিথি। অতিথিদের বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে নেই রে। তাই চলে যাচ্ছি। তার উপর নোংরা চরিত্রের অতিথি তো, তোর কোনওদিন দুর্নাম হলে সেটা তোর পরিবারের সকলের পক্ষেই খারাপ হত। খুব ভাল থাকিস সবাই মিলে। আমি তো বেশ্যা বলে সবার কাছে পরিচিত, তাই তোর ছেলেমেয়েকে আশীর্বাদ করে যেতে পারলাম না। প্রার্থনা করি, তোরা সবাই ভাল থাকিস। ইতি ঈশিতা (বেশ্যাদের পদবী থাকে না, তাই লিখলাম না)।’’
চিঠিটা পড়ে সুভদ্রা স্তম্ভিত হয়ে গেল! ওর মনে পড়ল, ঈশিতা এ বাড়িতে এসে সব কাজ নিজে হাতে করা শুরু করার পরে ও একদিন তা নিয়ে বকাবকি করায় ঈশিতা বলেছিল, ‘‘তোর সংসার তোরই থাকবে, দেখিস। আমি তো অতিথি রে!’’ সেদিনই ওর খটকা লেগেছিল। কিন্তু বলি বলি করেও জয়তীকে বলা হয়নি। ও কেঁদে ফেলল। জয়তী ওর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কিছু না বলে ওর নাম লেখা খামটা খুলল,
‘‘জয়তীদি (আজ আর দিদি লিখলাম না, অনেক কারণে), প্রথম অনুরোধ এই চিঠি পুড়িয়ে দিও। কারও হাতে পড়লে বিপদ হবে, অকারণ থানা-পুলিশ। তার উপর তোমাদের সরকারি চাকরি, ছেলেমেয়ে তিনটের ভবিষ্যৎ, সব মিলিয়েই বললাম।
চল্লাম গো। ভাল থেকো। দেখি, ওপারে গিয়ে দেখা পাই কি না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি। দিন কয়েক আগে সুভদ্রা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, আমি কেন আর গুনগুন করে হলেও গান গাই না। ওকে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের গানের মানে না বুঝে গাইতাম আগে। এখন বুঝি বলে আর গাইতে পারি না। জানো, আন্দামানে বিয়ের পরে যখন সবাই আমাকে ১২ বছরের বড় ওই লোকটার কাছে রেখে চলে গেছিল, খুব কেঁদেছিলাম দু’দিন। খাইনি, ঘুমোইওনি। তিন দিনের দিন আমাকে নিয়ে সমুদ্রের বিচে বসে ‘ভুবনজোড়া আসনখানি’ গানটার ইতিহাস বলে গেয়ে উঠেছিল নিজের মনেই। ওই মুহূর্তে লোকটার প্রেমে পড়িনি শুধু, তার হাতে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিলাম। বিনা বাধায়। তার পরে অনেকগুলো দিন তার কাছে নিলাজের মতো নিজেকে মেলে ধরেছিলাম। আমাকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবে বলে স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে। তার পর কলকাতায় এসে জানো, প্রথম ক’দিন ঘর গোছাতেই কেটে গেল। এত ক্লান্ত লাগত, কী বলব। আমি তো আগে তখন এসব করিনি। মাত্র ১৮ বছর হয়েছে। হাঁপিয়ে যেতাম গো। শরীর যেন ভেঙে আসত। রাতে ওর কাছে শুলেও ক্লান্তি আর নতুন জায়গার লজ্জায় নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারতাম না। তার কয়েকদিন পরে কাঁকুরগাছির বাড়িতে গিয়ে নিজের বইখাতা নিয়ে ফেরার পথে পিরিয়ডের ডেট চলে গেছে দেখে কি মনে করে ইউরিন টেস্টের জন্য টাকা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ও বাড়ি ফিরে আমি কেন বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করিনি, তাই নিয়ে বিস্তর বকাবকি করল। আমার খারাপ লাগলেও কিছু বলিনি। আহারে, সারাজীবন একা থেকেছে লোকটা, সত্যিই তো ওরও ইচ্ছে করে আত্মীয় পেতে। কিন্তু তার পরেই আমাকে আন্দামানের মতো করে থাকতে বলায় খুব রাগ হয়েছিল। যা নয় তাই বলেছিলাম। কেমন গুম খেয়ে গেছিল। রাতে আদরও করেনি। আমারও রাগ হয়ে গেল শুয়ে পড়লাম। পরদিন ইউরিন রিপোর্ট পেয়ে দেখলাম, পজিটিভ। বিশ্বাস করো জয়তীদি, তখনও পর্যন্ত আমার গর্ভ অপবিত্র হয়নি। ওরা অপবিত্র গর্ভের সন্তান নয় গো। পরের দিন ডাক্তার দেখিয়ে রাতে কাঁকুরগাছির বাড়িতে গেলাম ওকে নিয়ে। ভেবেছিলাম, যে আমাকে এত দিয়েছে, তাকে আজ আন্দামানের রাত ফিরিয়ে দেব। কিন্তু নিজের আগের ঘরটায় শুতে গিয়ে কেন যেন হঠাৎ কলেজের ক্রাশের কথা মনে করে বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে শুয়ে ওকে বুকে টেনে নিলেও আমার বিক্ষিপ্ত মনটা ও বুঝে ফেলেছিল। আচমকাই নেমে গিয়েছিল উপর থেকে। কিছু বলার সাহসই পায়নি। বয়সে বড় লোকটাকে সত্যি ভয়ও পেতাম তখন। রাতে শুনাম গাইছে,
‘‘নিবিড় সুখে মধুর দুখে
জড়িত ছিল সেই দিন
দুই তারে জীবনের
বাঁধা ছিল বীন,
তার ছিঁড়ে গেছে কবে......’’ কেঁদে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম, অভিভাবক হিসেবে, স্বামী হিসেবে না হোক প্রিয়তম বন্ধু হিসেবে আমাকে বলবে কিছু, বোঝাবে। জিজ্ঞাসা করবে, ভুল শুধরে দেবে। হাজার হোক, আমার সব কিছু তো ওরই হাতে, ওরই কাঁধে। আন্দামানে থাকার সময় কোনও ভুল করলে কত বোঝাত। সেই আশাতেই ছিলাম জানো। কি বোকা আমি! বুঝিনি, ও নিজেই বীনার তার কেটে দিয়েছে! তার পর থেকে আমি ভুলের পর ভুল করে গেছি, কিন্তু একটা দিনও আমাকে আর আগের মতো করে জড়িয়ে ধরে বকে, বুঝিয়ে সামলায়নি। উল্টে আমার থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেছে, আমার দু’বছরের ছোট বোনকে বরং অনেক কথা বলেছে। কিন্তু ১২ বছরের ছোট আমাকে একটা কথাও বলেনি! আমি অন্যায়, ভুল কোনওটাই অস্বীকার সেদিনও করিনি, আজও করব না। আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে বিয়ে দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলেছিল। যার হাতে তুলে দিয়েছিল, তাকে আমি নিজের সর্বস্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা অষ্টাদশীর মনের ভাব লোকটা বোঝেইনি। তাই দূরত্ব বাড়ছিল। আমি বহু দিন হাউমাউ করে কেঁদেছি। কখনও ওর কাছে, কখনও মায়ের কাছে। নভেম্বরে বেলেঘাটার বাসায় ফেরার পরেও কলেজের ব্যস্ততায় ওকে সময় না দিয়ে অন্যায় করেছি ঠিক, কিন্তু ও তো একদিনও আমাকে জোর করে চেপে ধরে বলেনি, তুমি এটা কোরো না, ওটা কোরো না? উল্টে আমি জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে বারবার ওকে পুরনো সময় ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিতে গেলে একটু হেসে সরিয়ে দিত নিজের থেকে। আজ এসব কথা অবান্তর, কিন্তু বিশ্বাস কর, কলকাতায় ফিরে থেকে আমার সব ভুল ওর চোখে পড়লেও একদিনও আমাকে আগের মতো করে বোঝানো তো দূর, কাছেও আসত না। দূরত্ব বাড়াচ্ছিল রোজ। তার পরে তো একদিনে মাত্র কয়েক ঘন্টায় আমি চিরকালের জন্য বেশ্যা হয়ে গেলাম! আজও তুমি বিশ্বাস করবে না, সেদিন একটা সময় রাহুল আমায় রেপ পর্যন্ত করেছিল, হুমকি দিয়েছিল বাড়িতে, কলেজে, পাড়ায় কলঙ্ক রটাবে। সে কাজে ওর ‘সুনাম’ ছিল। শরীরর খিদের সঙ্গে ভয়— আমাকে গুলিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রের মতো সব সহ্য করেছিলাম। এবং বুঝেছিলাম, আমি প্রতারক, আমি বেশ্যা। পরে ওর চিঠি পড়ে দিদিরাও সেটা বুঝিয়েছিল, এমনকি চার মাস পরে তোমার কাছে যে দু’দিন গেছিলাম, সে দু’দিনও তুমি ঘুরিয়ে সেটাই বুঝিয়েছিলে। আমি জানতাম, একটা বেশ্যার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তাই কথাগুলো সেদিন বলতে পারিনি। আজ আমার কোনও লাজভয় নেই। চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছি। তাই একটা প্রশ্ন করছি, বিয়ের সময় বয়স ১৮ বছর, তোমার কাছে যে দু’দিন গেছিলাম, তখন আমি সদ্য ১৯। টিনএজ একটা মেয়ে ভুল, অন্যায় করলে তাকে সবাই বোঝায়। জানো, আমাকে কেউ বোঝায়নি। উল্টে পিঠে বেশ্যা ছাপ মেরে দিয়েছে অবলীলায়! কতবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও করিনি একটাই কারণে। ওকে সামনে পেলে এই প্রশ্নটাই করতাম, কেন সেদিন আমাকে বোঝাওনি আগের মতো করে? তুমি তো জানতে আমি টিন এজের একটা মেয়ে। যার অনেক বিষয়ে বোধবুদ্ধি নেই। সে ভুল করলে বোঝাবে না? ১২ বছরের বড় হয়েও? এ কি রকম অভিভাবক, স্বামী, বন্ধু তুমি। জয়তীদি, আজ বুঝি, বীনার দুটো তারই ও নিজে হাতে ছিঁড়ে দিয়েছিল কাঁকুরগাছির বাড়িতে প্রথম রাতেই। বা হয়তো তারও আগে, আমি রেগে গিয়ে চারটে উল্টোপাল্টা মুখ করেছিলাম বলেছিলাম যেদিন! কে জানে! আজ আর জেনে লাভও নেই। একটা কষ্ট কি জানো, তুমি নিজেও জানতে, আমি তখন কী রকম পাগলের মতো ওর পায়ে পড়তেও রাজি, আমার বয়স, সব তুমি জানতে। তবু তুমি আমার জন্য সে ভাবে কিছু করোনি। ওর বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে। আমার সর্বস্ব হারালেও তোমার কিছু এসে যায়নি! হয়তো খারাপ লাগবে শুনতে, আমার দুই দিদির সঙ্গে যে তোমার যোগাযোগ ছিল, সেটা বুঝেছিলাম ওর মৃত্যুর দিন। তার আট-নয় বছর আগে ও কলকাতায় ফিরে এসেছে। ততদিনে হয়তো আমার উপরে ঘৃণাটা অনেক কমে গিয়েছিল। তবু দিদিদের থেকে খোঁজ নিয়ে আমাকে একবারও লোকটার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাওনি। কেন গো? আমার দিদিরা তো জানত, আমি বিশ্বভারতীতে পড়াই। খবরটা তুমি জানতে না, তা তো নয়। তখন আমি চাকরি করছি, কারও গলগ্রহ হব না বলে। কারণ আমার পরিবারে আমার বেশ্যা পরিচয়টাই সবথেকে বড় হয়ে উঠেছিল। তাই একাকীত্বে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু চাকরি নয়, আমি সংসার করতে চেয়েছিলাম গো, বিশ্বাস কর। ছেলেমেয়ে, স্বামী সবাইকে নিয়ে জমাট সংসারের স্বপ্ন দেখতাম রোজ। ওর বুকে মাথা রেখে গান শুনব, শোনাব, ছেলেমেয়েকে বড় করব, লেখাপড়া করাব। আমি পুরোদস্তুর সংসারী হতে চেয়েছিলাম। তোমাকে একবার এসব বলেওছিলাম কলকাতায় থাকতে থাকতে। কিন্তু তুমি সব জেনেও না লোকটাকে আমার কাছে এনে দিয়েছো, না আমাকে লোকটার কাছে নিয়ে গেছো। আমি এই ক’দিনে বিস্তর খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তুমি সেই সময় কয়েকবার কর্নাটকের ভদ্রা বলে একটা জায়গায় যেতে, পরে বম্বেতে যেতে। জেনেছিলাম, ওই দুই জায়গাতেই ও থাকত তখন। তখনও মাঝেমধ্যে তোমার সঙ্গে আমার কথা হয়, আমি খোঁজ নিই পাগলের মতো, কাঁদি ছেলেমেয়ের জন্য। কিন্তু লাভ হয়নি। এমনকি লোকটা চাকরি ছেড়ে শান্তিনিকেতন থেকে আধঘন্টার দূরত্বে আছে জেনেও দিদিদের বলেকয়ে ঠিকানা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগও করোনি! আমি ভেসে গেছি গত ১৮ বছর ধরে। একটা কথা বিশ্বাস করতে পারো, আমি ওই একদিনই বেশ্যা হয়েছিলাম, তার পর থেকে আমার শরীর কেউ স্পর্শও করতে পারেনি। তবু তোমাদের সবার চোখে আমি বেশ্যা! শরীরের খিদেয় যারতার সঙ্গে শুতেও পারি! কয়েক মাস আগে ১৮-য় পা দেওয়া যমজ ভাইবোনের কাছেও সেই ইমেজ । কি কপাল ভাবো তো? সেদিন মুকুট্টির অনুষ্ঠানের গান-কবিতা শুনতে শুনতে ভিতরে একটা উথালপাথাল হচ্ছিল। পরের দিন যখন বোনকে নিয়ে দাদা বাইকে চড়ে আমার দিকে তাকাল, তখন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে গুঞ্জার বরের বাইকে ওদের ধাওয়া করেছিলাম। তাই শেষ ছোঁয়াটা ছুঁতে পেরেছিলাম, কেউ না চাইলেও। তার পরেও ওদের আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ওদের কাছে নিজেকে নোংরা মেয়ে বলে তুলে ধরতেও মুখে বাধেনি, ক্ষমা চেয়েছি, কেঁদেছি, বুকে টেনেছি। কিন্তু আমি তো শেষপর্যন্ত একটা বেশ্যাই, তাই না? তাই প্রথমদিন আমার হাতে খাওয়ার সময় থেকে ওদের জড়তাটা টের পেয়েছি। ভেবেছিলাম, কলকাতায় ফিরে হয়তো কেটে যাবে। যায়নি। বরং আমার হাতে খেতে ওদের অস্বস্তি বাড়ত। তাই আমি আর পরের দিকে ওদের কাছে মা ডাকটা শুনতে চাওয়ার জন্য আকুল হতাম না। সুভদ্রা বলেছিল, সময় দিতে। আজ দিয়ে গেলাম। অনন্ত সময়।
ওদের ১৮ পার হয়েছে কয়েক মাস আগে। আর কয়েক মাস পরে ওরা ১৯এ পড়বে। ওরা ভুল করলে তোমরা সবাই মিলে ঠিক করে দেবে, বকবে, জানবে কি হয়েছে, সেটার সমাধান বলবে, বুকে টেনে নেবে। এটাই স্বাভাবিক। এবং এটা আরও অন্তত পাঁচ-সাত বছর পর্যন্ত ওরা পাবে। আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো ওরা এই জায়গায় ভাগ্যবান। যে ভাগ্য আমার হয়নি। আমি ১৮য় মা হয়েছিলাম, ১৯এ সব হারিয়ে বেশ্যা পরিচয় পেয়েছিলাম। আমার কপালে এসব জোটেনি গো। সব কিছু যার হাতে দিয়েছিলাম, সে ক্রমশ দূরেই ঠেলে দিয়েছে, আমিও শ্যাওলার মতো দূরে ভেসে গেছি।
যাক অনেক কথা লিখলাম। যার সঙ্গে জীবন জুড়ে ছিল, সে দুটো তার একসঙ্গে ছিঁড়ে দিয়েছিল বহু বহু আগে। তখনও আমি কুড়িতে বুড়ির দলে ঢুকিনি। অনেক ছোট ছিলাম। তার পর থেকে জীবনটা টেনে নিয়ে গিয়েছি। রোজ কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে শুতাম, উঠতাম। আর নয় গো। সুভদ্রাকে বোলো, ওর সংসার বা ওর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিড়ম্বনা আর রইল না। আর কাউকে মা ডাকার জন্য ওদের না কারও কাছে ছোট হতে হবে, না কারও বকুনি শুনতে হবে। তা ছাড়া একটা বেশ্যাকে কি মা ডাকা যায় জয়তীদি? বেশ্যাদের তো ছেলেমেয়ে থাকতে নেই। তাই সব দুর্ভাবনা, চিন্তার জাল কেটে দিলাম। বীনার তার ছিঁড়ে গেছে ১৯ বছর হওয়ার আগেই, তারহীন বীনাটা এখন কাঁধে বোঝার মতো লাগছে। এবার সেটার বিসর্জন। বিয়ের শাড়িটা পড়ে চল্লাম জানো, যদি চিনতে পারে! জানি না, এখনও আমাকে ঘৃণা করে কি না, তবু আশা তো...
অরণ্য, মৃত্তিকা আর সমুদ্রের জন্য যেটুকু রেখেছি, সেটা আমার পড়ানোর টাকা, পৈত্রিক বাড়ি বিক্রির টাকা। বিশ্বাস করে, শরীর বিক্রির টাকা দিয়ে ওদের অমঙ্গল করিনি। তবু যদি তোমাদের দ্বিধা থাকে, তোমরা ওই টাকা কোনও অনাথ আশ্রমে বা ঘরহারানো মেয়েদের নিয়ে কাজ করে এমন কাউকে দিয়ে দিও।
ওহ একটা কথা। যার হাতে আমার বাকি সবটুকু শেষ হয়েছিল, সে তার প্রাপ্য পেয়েছে। ভেবেছিল, আমি সেই বেশ্যাই আছি। বোঝেনি, যাকে সে বেশ্যা উপাধি পাইয়ে দিয়েছিল, তার হাতেই মরতে হবে। তিন ঘন্টার বিনিময়ে একটা ছোট্ট ধাক্কা।
ভাল থেকো। ওদের ভাল রেখো, ভাল থাকতে বোলো। আর শেষ কথা, গুঞ্জাকে জানিয়ো, ওর ট্রান্সফার হয়ে গেছে। এপ্রিলে ছেলেকে নিয়ে ওর বরের কাজের জায়গাতেই যেতে পারবে। আমার সঙ্গে ওর বরের কথা হয়েছে। তাকে অনুরোধ করেছি, সংসার ভাঙা সহজ, গড়া কঠিন। একটা ঘটনায় কাউকে বিচার করতে নেই। জানো, কী আশ্চর্য, ছেলেটা বুঝেছে। ও ভাল থাক। তোমরাও। দিদিদের পরে খবর দিও।
ইতি ঈশিতা
(এমনিও চাকরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সরকার টাইটেলটাই ব্যবহার করেছি। পরে বুঝেছি, বেশ্যাদের তো টাইটেল থাকে না! তা ছাড়া গত ১৮ বছর বেশ্যা পরিচয়টাই সেঁটে গেছে পিঠে, তাই শুধু নামটাই লিখলাম) কোনও কথায় খারাপ লাগলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভাল থেকো।’’
চিঠিটা পড়া শেষ করে জয়তী যখন মুখ তুলল, ওর চোখ লাল। চোখের জল নেমে ভিজে গেছে শাড়ি-ব্লাউজের অনেকটা। একটা কথাও না বলে চিঠিটা সুভদ্রার হাতে দিয়ে বলল, পড়ে পুড়িয়ে দিস। ও সবার কথা ভাবত, কেউ ওর কথা ভাবেনি। আজ চোখে আঙুল দিয়ে সব দেখিয়ে গেল।
সুভদ্রা চিঠিটা হাতে নিতে নিতে দেখল, ঘরে ঢুকছে অরণ্য আর মৃত্তিকা। কী করবে এ বার? ওরা কি কিছু বুঝেছে? ওর মাথা কাজ করছে না। তাকিয়ে দেখল, চোখ মুছতে মুছতে জয়তী ঘর ছাড়ছে।
(শেষ)


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)