21-05-2025, 03:38 AM
(৫০)
কলকাতায় ফেরার জন্য সেদিন ভোরেই উঠে পড়েছিল সবাই। ঈশিতা এমনিও বিশেষ ঘুমোয়নি। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। পরপর প্রায় তিন রাত জাগার ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরছিল। এই সময় ঈশিতা ঘরে ঢুকে ওকে তখনও শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখল গা গরম। ও কিছু বলার আগেই ঈশিতা ওর হাত ধরে মিনতি করল, ‘‘কিছু হয়নি, প্লিজ কাউকে বলে আর বিরক্ত কোরো না। আমি ঠিক হয়ে যাব।’’ জয়তীর ভিতরে খুঁতখুঁতুনিটা বাড়লেও কিছু বলল না। ভারী জলখাবার খেয়ে সবাই সকাল সকালই গাড়িতে উঠল। ওঠার একটু আগে ঈশিতা গিয়ে নিজের গায়ের চাদরটা বিছিয়ে দিল সৌমাভর সমাধির উপরে। তার পরে চার কোণে চারটে ইঁট চাপা দিল, যেন উড়ে না যায়। তার পর অনেকক্ষণ সমাধিতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে বিড়বিড় করে কিছু কথা বলে চুপ করে এসে গাড়িতে উঠে বসল। ও এসে বসার পরে জয়তী গাড়ি থেকে নেমে বুড়িকে কয়েকটা কথা বলার জন্য গেল। তখন বুড়ি ওকে পরপর দু’দিনের ঘটনাটা বলল। জয়তী বুঝল, দ্রুত কিছু না করলে ঈশিতার সমস্যা বাড়বে। কলকাতায় ফিরেই বিষয়টা নিয়ে ঈশিতার আড়ালে সুভদ্রা এবং ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
কলকাতায় ফিরে সুভদ্রার বাড়িতে ঢোকার মুখে নামফলকে চোখ পড়তেই চমকে গেল ঈশিতা। ছোট্ট শ্বেতপাথরের টুকরোয় বাংলায় লেখা নাম ‘দেবী’। আন্দামানে থাকতে ওর নামের মানে বলতে গিয়ে সৌমাভ ওকে বুঝিয়েছিল, ঈশিতা নামের বহু অর্থের একটা হচ্ছে দেবী। তা হলে কি ওর নামেই নাম বাড়ির? অবশ্য সুভদ্রাও তো একজন দেবীরই নাম। আর এমনিতেও সুভদ্রার আচার-আচরণও দেবীর মতোই। ও প্রশ্নটা করতে গিয়েও থমকে গেল। জয়তী এবেলা এ বাড়িতেই খাবে। বিকেলে নিজের বাড়িতে ফিরবে।
দোতলা বাড়িটার দোতলাতেই উঠল সবাই। ঈশিতা দেখল, চারটে বড় শোয়ার ঘর। সুভদ্রা ওকে বলল, একটা ঘরে সৌমাভ শুত, অন্যটায় ও মেয়েকে নিয়ে শুত। বাকি দুটোর একটা কুট্টির অন্যটা জয়তী এলে থাকে ছেলেকে নিয়ে। ঈশিতা সুভদ্রার হাত ধরে অনুরোধ করল, ও সৌমাভর ঘরেই রাতে শোবে। মেয়েকে নিয়ে সুভদ্রা আগের ঘরটাতেই ঘুমোক। একটু দ্বিধা থাকলেও জয়তীর ইশারায় সুভদ্রা রাজি হল এতে। ঈশিতার সৌমাভর খাটে সেই পাতলা তোষক আর চাদরটা বিছিয়ে নিয়েছে। সেখানেই রাতে ঘুমোয়।
সেদিন থেকে ঈশিতার রুটিন হল, সকালে প্রথমে মেয়েকে তার পরে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে চা করে সবাইকে দিয়ে সবার জন্য জলখাবার বানানো। সুভদ্রার অফিস এবং ছেলেমেয়ের কলেজ খুলে গেলে সকালের রান্না থেকে ওদের টিফিন— সবই নিজের হাতে করে দিত। ছুটির দিনে খাইয়েও দিত পাশে বসিয়ে। বাকি সারা দিন ঘরের টুকটাক কাজ করত আর আপন মনে কী সব ভাবত। মাঝে একবার ফোন করেছিল মেজদিকে। শুনল, গুঞ্জার বর সেদিন ওবাড়ি থেকে ফেরার পরে কোনও কথা বলেনি। চুপচাপই ছিল। পরের দিনই ট্রান্সফারের আবেদন করে দিয়ে এসেছিল। যে কোনও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে ওর ট্রান্সফার হয়। নেতাদের ধরাকরা করে জানুয়ারির মাঝামাঝি ও চলে যায় নর্থইস্টের একটা ইউনিভার্সিটিতে। যাওয়ার আগের দিন দুই দিদি জামাইবাবুকে ফোন করে খবরটা দেয়। তার পরে ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে গুঞ্জাকে জানায়। অত কম সময়ের মধ্যে শান্তিনিকেতনের চাকরি, ছেলের কলেজ ছেড়ে গুঞ্জার পক্ষে সেখানে যাওয়া কঠিন। তা ছাড়া সেদিনের পর থেকে ওদের মধ্যে প্রচন্ড দূরত্ব বেড়ে যায়। ফলে গুঞ্জাও এ নিয়ে নিজের বরকে বেশি কিছু বলার সাহস পায়নি। ওর বর একাই চলে গিয়েছে। মেজদি শুধু একটা কথাই বলল, ‘‘গুঞ্জাও নিজের লোভের ফাঁদে পড়ে নিজের সুখের সংসার নষ্ট করল। ওই ছেলে আর ফিরবে কি না, জানি না। মনে হয়, সেদিন গুঞ্জার কীর্তি শুনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েই সব করেছে। আমি আর এই বয়সে কাউকে কিছু বলব না। আর ওর তো বয়সটা ১৮ নয়, ছত্রিশ। ফলে এমন নয় আবেগে করে ফেলেছে। যা বুঝেছে, হিসেব করেই করেছে। আমি আর বড়দি ওর খেলাটা ধরে ফেলব এবং সেটা ওই রকম ভরা হাটে বলে দেব, সেটা ভাবতে পারেনি। তাই আমাদের সঙ্গে আর কথা বলে না, ফোনও করে না। বোন বলতে তুইই রইলি, ফোন করিস। আসিস। আমরাও যাব সময় পেলে।’’ ও শুনে গেছে, কিছু বলেনি। শুধু বুঝেছে, গুঞ্জার বরের মধ্যেও কোথাও যেন একটা সৌমাভর ছায়া। অন্যায় সহ্য না করা। এ বাড়িতে আসার দিন কয়েক পর থেকে ও নিজেও কিছুটা চুপচাপ হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কাজ করে, নিজের দায়িত্ব পালন করে। ছেলেমেয়ে একই রকম। এমনিও তারা ব্যস্ত নিজেদের পড়াশোনা, কলেজ নিয়ে। বাড়ি ফিরে বেশির ভাগ কথাই বলে মামনের সঙ্গে। ঈশিতার সঙ্গে টুকটাক কথা বললেও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। ঈশিতা রোজ সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে সৌমাভর একটা বড় ছবির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপ দিয়ে কী যে বলে বিড়বিড় করে, কেউ বোঝে না। এ বাড়িতে আসার পরে প্রথম দিকে কয়েকদিন শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেছে, সুভদ্রার সঙ্গে ছেলেমেয়ে ফিসফিস করে কিছু বলতে বলতে ওকে দেখে চুপ করে গেছে। ও জানে, ছেলেমেয়ের দ্বিধা কাটতে সময় লাগবে। ও পরের দিকে বসার ঘরে বা সুভদ্রা-মুট্টির শোওয়ার ঘরে ঢোকার আগে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে ঢুকত। এর পর থেকে সংসারের প্রায় সব কাজ নিজেই ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, যাতে সুভদ্রার উপরে কোনও চাপ না পড়ে। রান্নার পাশাপাশি সুভদ্রা ও ছেলেমেয়ের জামাকাপড় কাচা বা ইস্ত্রি করার কাজ নিজেই করে। ঘরমোছা, বাসন মাজার ভারটাও নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে। সুভদ্রা বহু বকাবকি করেও ওকে থামাতে পারেনি। ঈশিতা শুধু একটাই কথা বলেছে, ‘‘এত বছর পরে সুযোগ পেয়েছি চুটিয়ে সংসার করার। করতে দে প্লিজ। তোর সংসার তোরই থাকবে, দেখিস। আমি তো অতিথি রে!’’ কথাগুলো কানে লাগল সুভদ্রার। কিন্তু কিছু বলল না।
জানুয়ারির শেষে সবাই পাঁচ দিনের জন্য গেছিল সৌমাভর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে নতুন কেনা চাদর দিয়ে সমাধি ঢেকে তার চারপাশে লোহার রেলিং বসিয়েছিল ঈশিতা। পুকুর সংস্কারও করিয়েছিল। বাড়ির টুকটাক মেরামতির কাজও একার দায়িত্বে করিয়ে নিয়েছিল। ওর আচরণে অবাক হলেও কেউ কিছু বলেনি। শুধু বুড়ি দেখেছিল, জানুয়ারির ঠান্ডাতেও এবারেও পাঁচ দিনই রাতে সৌমাভর সমাধির পাশে প্রায় সারা রাত শুয়ে থাকে গায়ে একটা চাদর দিয়ে। এবারও ফেরার পথে বিষয়টা ও জয়তীকে বলেছিল। কলকাতায় ফেরার পরে একদিন জয়তী এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঈশিতা ওর কোলে মাথা রেখে শুধু বলেছিল, ‘‘মানুষটাকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি নিজের পাপে। এখন প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করছি গো। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
ফেব্রুয়ারিতে দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়ে পিএফ এর টাকা তুলে নিল। ওখানকার বাড়ি-আসবাব বিক্রির টাকা নিয়ে কলকাতায় ফিরে কাঁকুরগাছির একটা ফ্ল্যাটও বিক্রি করে দিল। সব মিলিয়ে অনেক টাকা। ও ভাগ করে ফেলল সেগুলো। ৮০ ভাগ টাকা ছেলেমেয়ের নামে ফিক্সড করে দিল। কিছুটা রাখল সুভদ্রার নামে। একদিন জয়তীর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়ে ওর ছেলেকে অনেকক্ষণ আদর করে তার নামেও বেশ কিছু টাকা একই ভাবে রাখল। তার পর একদিন দুপুরে নিজের সব গয়না নিয়ে বসে হিসেব করে মেয়ের জন্য এবং ছেলের বউয়ের জন্য আলাদা করে দুটো ছোট বাক্সে করে রাতে সুভদ্রার হাতে তুলে দিল।
এই বারে সুভদ্রা একটু রেগে গেল। সোজা জয়তীকে ফোন করে সব বলল। জয়তী সেদিন রাতে ওদের বাড়িতে এসে রইল। রাতে ঈশিতার ঘরে বসে সুভদ্রার নালিশ শুনল। সুভদ্রার একটাই কথা, ‘‘বড়দি এ রকম তাড়াহুড়ো করছে কেন? ছেলেমেয়ের বিয়ের দেরি আছে। তা ছাড়া এই ভাবে টাকাপয়সা সব দিয়ে দিল, নিজের কিছু খরচ তো লাগে। এসে অবধি খরচ করেই গেছে, একটা টাকাও নেয়নি আজ অবধি।’’ ঈশিতা বলল, ‘‘ওরে আমি অনেক বছর চাকরি করেছি। এখনও দশ বছর নিজের খরচ চালাতে পারব। তা ছাড়া তোর বাড়িতে থেকে চারবেলা খাচ্ছিও তো তোরই পয়সায়। ইলেকট্রিকের বিলও তুই দিস। আমার খরচ কী? পিরিয়ডের প্যাড? সেটুকু কেনার মতো টাকা আছে রে। তুই ভাবিস না। আর এগুলো ব্যবস্থা করে ফেললাম, কারণ আমার কিছু হয়ে গেলে, তখন সমস্যা হবে।’’ জয়তী গোটা সময়টা চুপ করে সব শুনল। শেষের কথাটায় চমকে গেল। মানে কী? ঈশিতার কিছু হয়েছে? কিন্তু দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না। তার পরে ঈশিতাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘‘ওখানে থাকার সময় তিনদিন এবং গত বারে পাঁচ দিন— টানা তুই রাতে সৌমদার সমাধির পাশে শুয়েবসে কাটিয়েছিস। একটা দিনও ঘুমোসনি রাতে। তুই যেটুকু খাস, সেটা একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার থেকেও কম। ওখানে থাকার ক’দিন তোর মধ্যেকার সেই প্রাণটা কোথায় হারাল? এত চুপচাপ থাকিস, একমনে যন্ত্রের মত কাজ করিস, কোথাও যাস না। কী হয়েছে তোর?’’ এটা জানত না সুভদ্রা। ও চমকে গেল। ঈশিতার হাত ধরে বলল, ‘‘তুমি রুটিন মেনে ছেলেমেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দাও, আদর করো, ওদের সব কাজ করে দাও, আমারও। কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা বুঝতে পারি। জানি, ওরা এখনও তোমায় মা বলে ডাকে না, এটা নিয়ে তোমার মনের মধ্যে প্রচন্ড কষ্ট আছে। কিন্তু একটু তো সময় দেবে, বলো?’’ ঈশিতা প্রাণখুলে হেসে বলল, ‘‘ধুর, ওটা নিয়ে আর ভাবিই না। তুই আর দিদি অকারণ চিন্তা করছিস। দেখিস, ওরা ঠিক একদিন মা বলে ডাকবে, সেটা আমিও জানি।’’ বলে মুচকি হেসে একটা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শব্দটা জয়তীর কানে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। উঠে গিয়ে কুট্টিমুট্টির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
মার্চের গোড়ার দিকে ঈশিতা একদিন সুভদ্রাকে বলল, ‘‘আমার একগাদা কাজ আছে। আমি কয়েকদিন দুপুরে সব কাজ সেরে বেরোব। অনেক কাজ সারতে হবে। ফিরতে রাত হতে পারে। তবে সব গুছিয়ে রেখে যাব, শুধু খাবারটা গরম করে নিতে হবে আর সন্ধ্যাবেলা চা তোকে করে নিতে হবে ওই কটা দিন। প্লিজ, কিছু মনে করিস না। রাতের খাবার আমি করেই বেরোব, ফিরে গরম করে সবাইকে খেতে দেব।’’ সেদিন রাতে যথারীতি ছেলেমেয়েকে খাইয়ে নিজে খেয়ে ঘরে ঢুকল। সুভদ্রার কেমন যেন লাগল ওর আচরণ। ঠিক করল, পরের দিন আবার জয়তীর সঙ্গে কথা বলবে। দরকারে এ বারে ছেলেমেয়েকে একটু বকবেও। ও বুঝতে পারছে, ছেলেমেয়ের কাছে মা ডাক না শোনা, ওকে যেভাবে ছেলেমেয়ে গলা জড়িয়ে কথা বলে, সেগুলো না করা একটা প্রভাব ফেলেছে ঈশিতার উপরে।
পরের বেশ কয়েক দিন শনি-রবি বাদে ঈশিতা রোজই বেলার দিকে ঘরে তালা দিয়ে বেরোত। তার আগে সব কাজ সেরে রাখত। কুট্টি বা মুট্টি আগে ফিরলে তো বটেই, এমনকি সুভদ্রাও বহু দিন তাড়াতাড়ি ফিরে দেখেছে, ঈশিতা তখনও আসেনি। আবার কয়েকদিন এসে দেখেছে, ঈশিতা ঘরেই রয়েছে, কাজ করছে একমনে। সুভদ্রা জানে, ঈশিতা ভাল গান করে। কিন্তু আজ অবধি ওর গান শোনা হয়নি। এমনকি গুনগুনিয়ে গানও করে না। সুভদ্রা রান্নাঘরে ঢুকে ওকে একা পেয়ে একদিন প্রশ্নটা করেই ফেলল। চুপচাপ কথাটা শুনল। তার পরে দুচোখ ভরা জল নিয়ে বলল, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গানের মানে বুঝতাম না আগে। ও একা একা অনেকবার অনেক গান গেয়েছে, সেগুলোর মানে ভাল করে বুঝিনি তখন। তাই আজও মূল্য দিচ্ছি। তখন গাইতাম না বুঝে, খেয়ালখুশিতে। আজ অনেক কিছু বুঝি রে, তাই আর গাইতে পারি না।’’ বলে দুহাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল।
এ বারে দোল পড়েছে মার্চের শেষ দিকে। তার দু’তিন দিন আগে ঈশিতা বাড়ি ফিরল সুভদ্রার পরপরই। সুভদ্রা দেখল, ঈশিতার চোখমুখ অনেক খুশিখুশি। উজ্জ্বল। তার পরেই ওকে চমকে দিয়ে বলল, ‘‘অনেকগুলো কাজ বাকি ছিল, সব সেরে ফেললাম, জানিস।’’ তার পরে নিজের ঘরে ঢুকে স্নান করে একটা নতুন শাড়ি পরে ব্যাগ থেকে একটা বড় মালা বের করে বাইরের ঘরে টাঙানো সৌমাভর ছবিতে খুব যত্ন করে পরিয়ে দিল। তার পর নিজের ঘরে ঢুকে আর একটা মালা সেই ঘরে রাখা ছবিটায় পরাল। তার পর প্রদীপ জ্বেলে ছবিটার সামনে অনেকক্ষণ ধরে বিড়বিড় করে কী বলল। সুভদ্রা একবার উঁকি মেরে দেখল, ঈশিতার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরছে, কিন্তু তার মধ্যেও যেন একটা খুশির ছাপ। সেদিন দুই ছেলেমেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করে খাইয়ে সেই সৌমাভর গ্রামের বাড়ির মতো যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তার পর শুতে গেল।
পরদিন ভোরে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে সুভদ্রাকে বলল, ‘‘কাল দোল। আমি দিন সাতেকের জন্য পুরী যাচ্ছি। ফোন বন্ধ থাকলে চিন্তা করিস না। ঠিক সময়মত খবর পাবি।’’ বলে মুচকি হেসে একটা ছোট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েকে অনেকক্ষণ আদর করে সুভদ্রাকেও বুকে টেনে আদর করে ঘর ছাড়ল। সুভদ্রার আবারও কেমন যেন লাগল। ও দেখল, একবার শুধু পিছন ফিরে বাড়িটা দেখে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে ঈশিতা। মাঝে একবার শুধু চোখে হাত দিল, হয়তো কিছু পড়েছে।
কলকাতায় ফেরার জন্য সেদিন ভোরেই উঠে পড়েছিল সবাই। ঈশিতা এমনিও বিশেষ ঘুমোয়নি। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। পরপর প্রায় তিন রাত জাগার ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরছিল। এই সময় ঈশিতা ঘরে ঢুকে ওকে তখনও শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখল গা গরম। ও কিছু বলার আগেই ঈশিতা ওর হাত ধরে মিনতি করল, ‘‘কিছু হয়নি, প্লিজ কাউকে বলে আর বিরক্ত কোরো না। আমি ঠিক হয়ে যাব।’’ জয়তীর ভিতরে খুঁতখুঁতুনিটা বাড়লেও কিছু বলল না। ভারী জলখাবার খেয়ে সবাই সকাল সকালই গাড়িতে উঠল। ওঠার একটু আগে ঈশিতা গিয়ে নিজের গায়ের চাদরটা বিছিয়ে দিল সৌমাভর সমাধির উপরে। তার পরে চার কোণে চারটে ইঁট চাপা দিল, যেন উড়ে না যায়। তার পর অনেকক্ষণ সমাধিতে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে বিড়বিড় করে কিছু কথা বলে চুপ করে এসে গাড়িতে উঠে বসল। ও এসে বসার পরে জয়তী গাড়ি থেকে নেমে বুড়িকে কয়েকটা কথা বলার জন্য গেল। তখন বুড়ি ওকে পরপর দু’দিনের ঘটনাটা বলল। জয়তী বুঝল, দ্রুত কিছু না করলে ঈশিতার সমস্যা বাড়বে। কলকাতায় ফিরেই বিষয়টা নিয়ে ঈশিতার আড়ালে সুভদ্রা এবং ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
কলকাতায় ফিরে সুভদ্রার বাড়িতে ঢোকার মুখে নামফলকে চোখ পড়তেই চমকে গেল ঈশিতা। ছোট্ট শ্বেতপাথরের টুকরোয় বাংলায় লেখা নাম ‘দেবী’। আন্দামানে থাকতে ওর নামের মানে বলতে গিয়ে সৌমাভ ওকে বুঝিয়েছিল, ঈশিতা নামের বহু অর্থের একটা হচ্ছে দেবী। তা হলে কি ওর নামেই নাম বাড়ির? অবশ্য সুভদ্রাও তো একজন দেবীরই নাম। আর এমনিতেও সুভদ্রার আচার-আচরণও দেবীর মতোই। ও প্রশ্নটা করতে গিয়েও থমকে গেল। জয়তী এবেলা এ বাড়িতেই খাবে। বিকেলে নিজের বাড়িতে ফিরবে।
দোতলা বাড়িটার দোতলাতেই উঠল সবাই। ঈশিতা দেখল, চারটে বড় শোয়ার ঘর। সুভদ্রা ওকে বলল, একটা ঘরে সৌমাভ শুত, অন্যটায় ও মেয়েকে নিয়ে শুত। বাকি দুটোর একটা কুট্টির অন্যটা জয়তী এলে থাকে ছেলেকে নিয়ে। ঈশিতা সুভদ্রার হাত ধরে অনুরোধ করল, ও সৌমাভর ঘরেই রাতে শোবে। মেয়েকে নিয়ে সুভদ্রা আগের ঘরটাতেই ঘুমোক। একটু দ্বিধা থাকলেও জয়তীর ইশারায় সুভদ্রা রাজি হল এতে। ঈশিতার সৌমাভর খাটে সেই পাতলা তোষক আর চাদরটা বিছিয়ে নিয়েছে। সেখানেই রাতে ঘুমোয়।
সেদিন থেকে ঈশিতার রুটিন হল, সকালে প্রথমে মেয়েকে তার পরে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে চা করে সবাইকে দিয়ে সবার জন্য জলখাবার বানানো। সুভদ্রার অফিস এবং ছেলেমেয়ের কলেজ খুলে গেলে সকালের রান্না থেকে ওদের টিফিন— সবই নিজের হাতে করে দিত। ছুটির দিনে খাইয়েও দিত পাশে বসিয়ে। বাকি সারা দিন ঘরের টুকটাক কাজ করত আর আপন মনে কী সব ভাবত। মাঝে একবার ফোন করেছিল মেজদিকে। শুনল, গুঞ্জার বর সেদিন ওবাড়ি থেকে ফেরার পরে কোনও কথা বলেনি। চুপচাপই ছিল। পরের দিনই ট্রান্সফারের আবেদন করে দিয়ে এসেছিল। যে কোনও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে ওর ট্রান্সফার হয়। নেতাদের ধরাকরা করে জানুয়ারির মাঝামাঝি ও চলে যায় নর্থইস্টের একটা ইউনিভার্সিটিতে। যাওয়ার আগের দিন দুই দিদি জামাইবাবুকে ফোন করে খবরটা দেয়। তার পরে ঘরে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে গুঞ্জাকে জানায়। অত কম সময়ের মধ্যে শান্তিনিকেতনের চাকরি, ছেলের কলেজ ছেড়ে গুঞ্জার পক্ষে সেখানে যাওয়া কঠিন। তা ছাড়া সেদিনের পর থেকে ওদের মধ্যে প্রচন্ড দূরত্ব বেড়ে যায়। ফলে গুঞ্জাও এ নিয়ে নিজের বরকে বেশি কিছু বলার সাহস পায়নি। ওর বর একাই চলে গিয়েছে। মেজদি শুধু একটা কথাই বলল, ‘‘গুঞ্জাও নিজের লোভের ফাঁদে পড়ে নিজের সুখের সংসার নষ্ট করল। ওই ছেলে আর ফিরবে কি না, জানি না। মনে হয়, সেদিন গুঞ্জার কীর্তি শুনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েই সব করেছে। আমি আর এই বয়সে কাউকে কিছু বলব না। আর ওর তো বয়সটা ১৮ নয়, ছত্রিশ। ফলে এমন নয় আবেগে করে ফেলেছে। যা বুঝেছে, হিসেব করেই করেছে। আমি আর বড়দি ওর খেলাটা ধরে ফেলব এবং সেটা ওই রকম ভরা হাটে বলে দেব, সেটা ভাবতে পারেনি। তাই আমাদের সঙ্গে আর কথা বলে না, ফোনও করে না। বোন বলতে তুইই রইলি, ফোন করিস। আসিস। আমরাও যাব সময় পেলে।’’ ও শুনে গেছে, কিছু বলেনি। শুধু বুঝেছে, গুঞ্জার বরের মধ্যেও কোথাও যেন একটা সৌমাভর ছায়া। অন্যায় সহ্য না করা। এ বাড়িতে আসার দিন কয়েক পর থেকে ও নিজেও কিছুটা চুপচাপ হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কাজ করে, নিজের দায়িত্ব পালন করে। ছেলেমেয়ে একই রকম। এমনিও তারা ব্যস্ত নিজেদের পড়াশোনা, কলেজ নিয়ে। বাড়ি ফিরে বেশির ভাগ কথাই বলে মামনের সঙ্গে। ঈশিতার সঙ্গে টুকটাক কথা বললেও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। ঈশিতা রোজ সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে সৌমাভর একটা বড় ছবির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপ দিয়ে কী যে বলে বিড়বিড় করে, কেউ বোঝে না। এ বাড়িতে আসার পরে প্রথম দিকে কয়েকদিন শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেছে, সুভদ্রার সঙ্গে ছেলেমেয়ে ফিসফিস করে কিছু বলতে বলতে ওকে দেখে চুপ করে গেছে। ও জানে, ছেলেমেয়ের দ্বিধা কাটতে সময় লাগবে। ও পরের দিকে বসার ঘরে বা সুভদ্রা-মুট্টির শোওয়ার ঘরে ঢোকার আগে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে ঢুকত। এর পর থেকে সংসারের প্রায় সব কাজ নিজেই ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, যাতে সুভদ্রার উপরে কোনও চাপ না পড়ে। রান্নার পাশাপাশি সুভদ্রা ও ছেলেমেয়ের জামাকাপড় কাচা বা ইস্ত্রি করার কাজ নিজেই করে। ঘরমোছা, বাসন মাজার ভারটাও নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে। সুভদ্রা বহু বকাবকি করেও ওকে থামাতে পারেনি। ঈশিতা শুধু একটাই কথা বলেছে, ‘‘এত বছর পরে সুযোগ পেয়েছি চুটিয়ে সংসার করার। করতে দে প্লিজ। তোর সংসার তোরই থাকবে, দেখিস। আমি তো অতিথি রে!’’ কথাগুলো কানে লাগল সুভদ্রার। কিন্তু কিছু বলল না।
জানুয়ারির শেষে সবাই পাঁচ দিনের জন্য গেছিল সৌমাভর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে নতুন কেনা চাদর দিয়ে সমাধি ঢেকে তার চারপাশে লোহার রেলিং বসিয়েছিল ঈশিতা। পুকুর সংস্কারও করিয়েছিল। বাড়ির টুকটাক মেরামতির কাজও একার দায়িত্বে করিয়ে নিয়েছিল। ওর আচরণে অবাক হলেও কেউ কিছু বলেনি। শুধু বুড়ি দেখেছিল, জানুয়ারির ঠান্ডাতেও এবারেও পাঁচ দিনই রাতে সৌমাভর সমাধির পাশে প্রায় সারা রাত শুয়ে থাকে গায়ে একটা চাদর দিয়ে। এবারও ফেরার পথে বিষয়টা ও জয়তীকে বলেছিল। কলকাতায় ফেরার পরে একদিন জয়তী এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঈশিতা ওর কোলে মাথা রেখে শুধু বলেছিল, ‘‘মানুষটাকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি নিজের পাপে। এখন প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করছি গো। দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
ফেব্রুয়ারিতে দু’দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়ে পিএফ এর টাকা তুলে নিল। ওখানকার বাড়ি-আসবাব বিক্রির টাকা নিয়ে কলকাতায় ফিরে কাঁকুরগাছির একটা ফ্ল্যাটও বিক্রি করে দিল। সব মিলিয়ে অনেক টাকা। ও ভাগ করে ফেলল সেগুলো। ৮০ ভাগ টাকা ছেলেমেয়ের নামে ফিক্সড করে দিল। কিছুটা রাখল সুভদ্রার নামে। একদিন জয়তীর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়ে ওর ছেলেকে অনেকক্ষণ আদর করে তার নামেও বেশ কিছু টাকা একই ভাবে রাখল। তার পর একদিন দুপুরে নিজের সব গয়না নিয়ে বসে হিসেব করে মেয়ের জন্য এবং ছেলের বউয়ের জন্য আলাদা করে দুটো ছোট বাক্সে করে রাতে সুভদ্রার হাতে তুলে দিল।
এই বারে সুভদ্রা একটু রেগে গেল। সোজা জয়তীকে ফোন করে সব বলল। জয়তী সেদিন রাতে ওদের বাড়িতে এসে রইল। রাতে ঈশিতার ঘরে বসে সুভদ্রার নালিশ শুনল। সুভদ্রার একটাই কথা, ‘‘বড়দি এ রকম তাড়াহুড়ো করছে কেন? ছেলেমেয়ের বিয়ের দেরি আছে। তা ছাড়া এই ভাবে টাকাপয়সা সব দিয়ে দিল, নিজের কিছু খরচ তো লাগে। এসে অবধি খরচ করেই গেছে, একটা টাকাও নেয়নি আজ অবধি।’’ ঈশিতা বলল, ‘‘ওরে আমি অনেক বছর চাকরি করেছি। এখনও দশ বছর নিজের খরচ চালাতে পারব। তা ছাড়া তোর বাড়িতে থেকে চারবেলা খাচ্ছিও তো তোরই পয়সায়। ইলেকট্রিকের বিলও তুই দিস। আমার খরচ কী? পিরিয়ডের প্যাড? সেটুকু কেনার মতো টাকা আছে রে। তুই ভাবিস না। আর এগুলো ব্যবস্থা করে ফেললাম, কারণ আমার কিছু হয়ে গেলে, তখন সমস্যা হবে।’’ জয়তী গোটা সময়টা চুপ করে সব শুনল। শেষের কথাটায় চমকে গেল। মানে কী? ঈশিতার কিছু হয়েছে? কিন্তু দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না। তার পরে ঈশিতাকে চমকে দিয়ে বলল, ‘‘ওখানে থাকার সময় তিনদিন এবং গত বারে পাঁচ দিন— টানা তুই রাতে সৌমদার সমাধির পাশে শুয়েবসে কাটিয়েছিস। একটা দিনও ঘুমোসনি রাতে। তুই যেটুকু খাস, সেটা একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার থেকেও কম। ওখানে থাকার ক’দিন তোর মধ্যেকার সেই প্রাণটা কোথায় হারাল? এত চুপচাপ থাকিস, একমনে যন্ত্রের মত কাজ করিস, কোথাও যাস না। কী হয়েছে তোর?’’ এটা জানত না সুভদ্রা। ও চমকে গেল। ঈশিতার হাত ধরে বলল, ‘‘তুমি রুটিন মেনে ছেলেমেয়েকে ঘুম থেকে তুলে দাও, আদর করো, ওদের সব কাজ করে দাও, আমারও। কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা বুঝতে পারি। জানি, ওরা এখনও তোমায় মা বলে ডাকে না, এটা নিয়ে তোমার মনের মধ্যে প্রচন্ড কষ্ট আছে। কিন্তু একটু তো সময় দেবে, বলো?’’ ঈশিতা প্রাণখুলে হেসে বলল, ‘‘ধুর, ওটা নিয়ে আর ভাবিই না। তুই আর দিদি অকারণ চিন্তা করছিস। দেখিস, ওরা ঠিক একদিন মা বলে ডাকবে, সেটা আমিও জানি।’’ বলে মুচকি হেসে একটা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শব্দটা জয়তীর কানে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। উঠে গিয়ে কুট্টিমুট্টির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
মার্চের গোড়ার দিকে ঈশিতা একদিন সুভদ্রাকে বলল, ‘‘আমার একগাদা কাজ আছে। আমি কয়েকদিন দুপুরে সব কাজ সেরে বেরোব। অনেক কাজ সারতে হবে। ফিরতে রাত হতে পারে। তবে সব গুছিয়ে রেখে যাব, শুধু খাবারটা গরম করে নিতে হবে আর সন্ধ্যাবেলা চা তোকে করে নিতে হবে ওই কটা দিন। প্লিজ, কিছু মনে করিস না। রাতের খাবার আমি করেই বেরোব, ফিরে গরম করে সবাইকে খেতে দেব।’’ সেদিন রাতে যথারীতি ছেলেমেয়েকে খাইয়ে নিজে খেয়ে ঘরে ঢুকল। সুভদ্রার কেমন যেন লাগল ওর আচরণ। ঠিক করল, পরের দিন আবার জয়তীর সঙ্গে কথা বলবে। দরকারে এ বারে ছেলেমেয়েকে একটু বকবেও। ও বুঝতে পারছে, ছেলেমেয়ের কাছে মা ডাক না শোনা, ওকে যেভাবে ছেলেমেয়ে গলা জড়িয়ে কথা বলে, সেগুলো না করা একটা প্রভাব ফেলেছে ঈশিতার উপরে।
পরের বেশ কয়েক দিন শনি-রবি বাদে ঈশিতা রোজই বেলার দিকে ঘরে তালা দিয়ে বেরোত। তার আগে সব কাজ সেরে রাখত। কুট্টি বা মুট্টি আগে ফিরলে তো বটেই, এমনকি সুভদ্রাও বহু দিন তাড়াতাড়ি ফিরে দেখেছে, ঈশিতা তখনও আসেনি। আবার কয়েকদিন এসে দেখেছে, ঈশিতা ঘরেই রয়েছে, কাজ করছে একমনে। সুভদ্রা জানে, ঈশিতা ভাল গান করে। কিন্তু আজ অবধি ওর গান শোনা হয়নি। এমনকি গুনগুনিয়ে গানও করে না। সুভদ্রা রান্নাঘরে ঢুকে ওকে একা পেয়ে একদিন প্রশ্নটা করেই ফেলল। চুপচাপ কথাটা শুনল। তার পরে দুচোখ ভরা জল নিয়ে বলল, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গানের মানে বুঝতাম না আগে। ও একা একা অনেকবার অনেক গান গেয়েছে, সেগুলোর মানে ভাল করে বুঝিনি তখন। তাই আজও মূল্য দিচ্ছি। তখন গাইতাম না বুঝে, খেয়ালখুশিতে। আজ অনেক কিছু বুঝি রে, তাই আর গাইতে পারি না।’’ বলে দুহাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠল।
এ বারে দোল পড়েছে মার্চের শেষ দিকে। তার দু’তিন দিন আগে ঈশিতা বাড়ি ফিরল সুভদ্রার পরপরই। সুভদ্রা দেখল, ঈশিতার চোখমুখ অনেক খুশিখুশি। উজ্জ্বল। তার পরেই ওকে চমকে দিয়ে বলল, ‘‘অনেকগুলো কাজ বাকি ছিল, সব সেরে ফেললাম, জানিস।’’ তার পরে নিজের ঘরে ঢুকে স্নান করে একটা নতুন শাড়ি পরে ব্যাগ থেকে একটা বড় মালা বের করে বাইরের ঘরে টাঙানো সৌমাভর ছবিতে খুব যত্ন করে পরিয়ে দিল। তার পর নিজের ঘরে ঢুকে আর একটা মালা সেই ঘরে রাখা ছবিটায় পরাল। তার পর প্রদীপ জ্বেলে ছবিটার সামনে অনেকক্ষণ ধরে বিড়বিড় করে কী বলল। সুভদ্রা একবার উঁকি মেরে দেখল, ঈশিতার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরছে, কিন্তু তার মধ্যেও যেন একটা খুশির ছাপ। সেদিন দুই ছেলেমেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে আদর করে খাইয়ে সেই সৌমাভর গ্রামের বাড়ির মতো যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তার পর শুতে গেল।
পরদিন ভোরে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে সুভদ্রাকে বলল, ‘‘কাল দোল। আমি দিন সাতেকের জন্য পুরী যাচ্ছি। ফোন বন্ধ থাকলে চিন্তা করিস না। ঠিক সময়মত খবর পাবি।’’ বলে মুচকি হেসে একটা ছোট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েকে অনেকক্ষণ আদর করে সুভদ্রাকেও বুকে টেনে আদর করে ঘর ছাড়ল। সুভদ্রার আবারও কেমন যেন লাগল। ও দেখল, একবার শুধু পিছন ফিরে বাড়িটা দেখে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে ঈশিতা। মাঝে একবার শুধু চোখে হাত দিল, হয়তো কিছু পড়েছে।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)