Thread Rating:
  • 36 Vote(s) - 2.97 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica তার ছিঁড়ে গেছে কবে
(৪৯)

১৮ বছরের জন্মদিনে নিজের আর বোনের জন্ম, বড় হওয়া, মামন, পিসি, বাবা— সব মিলিয়ে অনেক কথা শুনেছিল অরণ্য। মৃত্তিকাও। সেদিন থেকে যে মাকে দেখার জন্য হাঁকপাঁক করছিল, কাল বাবার মৃত্যুর পর থেকে তাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে। সকালে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না, দুই ভাইবোনকে নিজে হাতে খাইয়ে দেওয়া— সব দেখেছে। একটু আগে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ওকে ছেলে বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওর পিঠে মাথা রেখে ফেলা চোখের জলও টের পেয়েছে। বুঝতে পারছে, মানুষটা নতুন জীবন পাচ্ছে ওদের দুই ভাইবোনের কাছে থাকলে। কিন্তু কি বলে ডাকবে এঁকে? মা? সত্যিই তো ওদের মা, কিন্তু তার পরেও....মামন? মামনের অভিমান হবে না তো? পিসি? ওরা দূরে সরে গেলে.... মাথার মধ্যে নানা চিন্তা পাক খাচ্ছে কুট্টির। তার উপর একটু আগে আসা পিসি আর মামনের ফোনে জেনেছে, সকালে নিজে হাতে ওদের পাশে বসিয়ে পেটভরে খাইয়ে দিলেও নিজে শুধু একটু জল খেয়েই বেরিয়েছে! বলতে গেলে কাল সকালের সেই মুড়ি, মাছভাজা আর চা বাদ দিলে গত ২৪ ঘন্টারও বেশি কিছুই খায়নি মানুষটা! তার পরেও চোখেমুখে তার কোনও চিহ্ন নেই! অবাক হয়ে প্রশ্নটা করতেই পিসি বলল, ‘‘এই প্রশ্নটা তুই করবি। আমি না। মা তোর, তোর বোনের।’’ মামনও একই কথা বলে জানিয়েছে, ‘‘দুপুরে যদি বাইরে খাস, আজ তোর দায়িত্ব নিজে হাতে মাকে খাইয়ে দেওয়া।’’  

ঈশিতা টেবিলে এসে বসে দেখল, ছেলে একমনে মাথা নিচু করে কি ভাবছে। ও বুঝতে পারছে, ছেলেমেয়ের মনের দ্বন্দ্বটা। পরিস্থিতি হালকা করতে ছেলেকে বলল, ‘‘এখান থেকে বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ লাগবে বল তো? এখন প্রায় দুটো বাজে।’’ চমকে উঠে একটা কথা বলার মতো সুযোগ পেয়ে কুট্টি খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘‘মিনিট তিরিশ-পঁয়ত্রিশ।’’ ঈশিতা বলল, ‘‘এখনই মামন আর পিসিকে বলে দে, আমরা দুপুরের খাবার নিয়ে ফিরছি। এখন তোকে শুধু একটু মাছভাত খাইয়ে বাকি সব খাবার প্যাক করে বাড়ি ফিরে সবাই মিলে খাব, কেমন?’’ কুট্টি একটু অবাক হলেও ফোন করে সবটা জানিয়ে বলল, ‘‘ঠিক আছে, তবে আজ আমি তোমাকে আগে খাইয়ে দেব, তার পর তুমি খাইয়ে দিও, কেমন?’’ ঈশিতা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর খুব নিচু গলায় বলল, ‘‘কিন্তু সোনা, আমি ক’টা দিন তো মাছ-মাংস খাব না।’’ ছেলে একই রকম শান্ত গলায় বলল, ‘‘বাবা যেটা বলে গেছে, সেটা আমরা সবাই মানব। তাই কোনও কথা শুনব না, মাছভাত তোমায় খেতেই হবে।’’ ঈশিতা মাথা নিচু করে নিল ছেলের কথা শুনে। টপটপ করে চোখের জল পড়তে লাগল টেবিলে।

এরমধ্যে একটা লোক মাছভাত আর দইয়ের পাত্র দিয়ে বলে গেল, অর্ডার প্যাক হচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে। ঈশিতা হাত বাড়ানোর আগেই প্লেটটা টেনে নিয়ে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে হাতে করে ঈশিতার মুখের সামনে ধরল কুট্টি। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দুচোখ ভরা জল মোছার চেষ্টাই করল না ঈশিতা। একগাল মাছভাত খেয়ে এবার প্রায় প্লেটটা কেড়ে নিয়ে ছেলের গালে খাবার তুলে দিল ও। মা ছেলে প্রায় যুদ্ধ করল খাওয়া নিয়ে। ঈশিতার চোখের জল সমানে গড়িয়ে পড়তে থাকল, কুট্টি অবশ্য নির্বিকার। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে প্যাকেটগুলো এসে গেল। প্যাকেটের বহর আর সাইজ দেখে কুট্টির মাথা খারাপ হয়ে গেল। এত খাবার? কতজন মিলে খাবে? ও মুখ খুলে ঈশিতার দিকে তাকাতেই বলল, ‘‘আজ সবাই মিলে একসঙ্গে খাব। তুই কয়েকটা নিয়ে বস। আমি বাকিগুলো নিচ্ছি।’’ বাইকে উঠে প্যাকেটগুলো নানা কায়দা করে ঝুলিয়ে নিল কুট্টি। ঈশিতা আগের মতোই বসে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি চল। ওরা না খেয়ে আছে।’’ শুধু ওরা? নিজে যে কিছুই না খেয়ে আছে ২৪ ঘন্টার বেশি? প্রশ্নটা মুখে এলেও গিলে নিল কুট্টি। এমনিই কথায় কথায় কাঁদছে, আবার কাঁদতে শুরু করে দেবে, বুঝতে পারছে ও। তাই কথা না বাড়িয়ে বাইক ছোটাল। আসার সময়ের থেকে একটু জোরেই। বুঝতে পারল, ওর কাঁধে মাথা রেখে ওকে শক্ত করে ধরে বসে আছে পিছনের মানুষটা।

হিসেবের থেকে কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছে গেল ওরা। বাইক থেকে নেমে ঈশিতা ব্যাগ আর কয়েকটা প্যাকেট হাতে নিয়ে এগোল। পিছনে কুট্টি। ওদের হাতে প্যাকেটের বহর দেখে চমকে উঠল সবাই। কিন্তু ঈশিতার চোখমুখের দিকে তাকিয়ে একমাত্র জয়তী বুঝতে পারল, কতটা আনন্দে ভাসছে ঈশিতা। ওর মনে পড়ল, প্রথম দিককার সেই মুখটা। লজ্জা, অপরাধবোধ, মানসিক যন্ত্রণা আর নিজের উপরে ঘৃণায় কালো ছোপ পড়া মুখটা রাতারাতি কয়েক ঘন্টায় খুশিতে যেন ঝলমল করছে। ও প্যাকেটগুলো জয়তী আর সুভদ্রার হাতে দিয়ে বলল, ‘‘তোমরা বসে পড়ো। ভাগ করো সব। বুড়িকে আর ওর মেয়েকেও ডেকে নাও। আমি মাথায় একটু জল ঢেলেই আসছি। ওদের খাইয়ে দেব।’’ বলে নিজের ব্যাগটা নিয়ে সৌমাভর সেই ঘরটায় ঢুকে পড়ল। জয়তী আর সুভদ্রা মুখ টিপে হাসল শুধু।

কোনও মতে স্নান সেরে একটা শাড়ি পড়ে খাবার ঘরটায় ঢুকেই সুভদ্রা আর জয়তীর মুখ ঝামটানি খেল ঈশিতা। এত খাবার! রাতেও তো শেষ হবে না সবাই মিলে খেলেও। ঈশিতা মুচকি হেসে বলল, ‘‘সব হবে। দাও, ওদের খাবারটা কই। কত বেলা হয়ে গেছে, ওদের খিদে পেয়ে গেছে!’’ পাশে বসা সুভদ্রা মুচকি হেসে একটা বড় থালা দেখিয়ে বলল, ‘‘ওটায় নিয়ে বস। তার পর দরকার মতো বাটি থেকে নিয়ে নিও।’’ বলে ছেলেমেয়েকে ডাকল। ওরা সকালের মতোই কিছুটা জড়োসড়ো ভাবে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কোথায় বসবে ঠিক করতে পারছে না। মামন, পিসি নাকি আবার মা? ওদের দ্বিধা দেখে জয়তী এক ধমক দিয়ে দুজনকেই ঈশিতার দু’পাশে বসিয়ে ইশারায় সুভদ্রাকে ওর পাশে ডেকে নিল। ঈশিতা বিস্মিত হয়ে প্রশ্নটা করতেই জয়তী একটু ধমকের সুরে বলল, ‘‘মুখোমুখি না বসলে কথা বলা যায়? এবার বল, তোর কাজ কতটা হল।’’ ঈশিতা থালায় অনেকটা ভাত নিয়ে একটার পর একটা পদ মেখে একবার ছেলেকে একবার মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে গল্পে মেতে উঠল। সেই সঙ্গেই কবে কলকাতায় ফিরবে, কী ভাবে যাবে এই সব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে খাইয়ে দিল দু’জনকে। সুভদ্রা খেতে খেতেই লক্ষ্য করল, ঈশিতা একগাল ভাতও খায়নি। কনুইয়ের গুঁতোয় বিষয়টা জয়তীকে দেখাল। জয়তী মুট্টিকে ইশারা করল, সে মুখ ভেটকে বলল বুঝতে পারছি না। কুট্টি তখন চিংড়ির খোলা ছাড়িয়ে খেতে ব্যস্ত। একটু পরে ও যখন মুখ তুলল, দেখল পিসি আর মামন ওকে ইশারায় কিছু বলছে। ঈশিতা তখন ওদিকে মুখ করে মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত। বিষয়টা বুঝেই লাফ দিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে দৌড়ে দিয়ে মুখটা ধুয়ে এসে ঈশিতার কোলের কাছ থেকে থালাটা প্রায় কেড়ে নিল কুট্টি। তার পরে পিসি আর মামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘হোটেলে জোর করে দু’গাল খাওয়াতে পেরেছি।’’ তার পরেই ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘নিজে যদি না খাবে, তা হলে এত আনালে কেন?’’ বলেই বেশ কিছুটা ভাত সেই থালায় দিয়ে বলল, ‘‘আগে নিজে খাবে, তার পর বাকিরা খাবে।’’ বলে মুট্টির হাত ধরে তুলে মুখ ধুতে পাঠিয়ে দিল। নিজেও দুদ্দাড় করে চলে গেল। ওর কান্ড দেখে জয়তী আর সুভদ্রা হেসে ফেলল। তার পরেই তাকিয়ে দেখল, ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে ঈশিতা। ওরা খাওয়া ছেড়ে উঠে ঈশিতার সামনে বসে গায়ে হাত দিতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ও। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। জয়তী বিষয়টা বুঝল। সকাল থেকে ছেলেমেয়েকে এ ভাবে পেয়ে, খাইয়ে দিতে পেরে অনেক দিনের চেপে রাখা আবেগ এবার বাঁধ ভেঙে দিয়েছে, নিজের খাওয়ার কথা ভুলেই গেছে ঈশিতা যেন! বিষয়টা বুঝল সুভদ্রাও। কোনও কথা না বলে ছেলেমেয়েকে ডেকে এনে সামনে বসিয়ে বলল, ‘‘এতক্ষণ ধরে তোদের খাওয়াল, এবার তোরা খাইয়ে দে। না হলে খাবে না। যত পাগল নিয়ে আমার হয়েছে জ্বালা!’’

মামনের ধমক শুনে কুট্টি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেও মুট্টি একটুও দেরি করল না। ওখানেই ধপ করে বসে থালাটা টেনে ভাত মেখে ঈশিতার মুখের সামনে ধরল। ঈশিতা চোখভরা জল নিয়ে তাকাতেই বলল, ‘‘অনেক বেলা হয়েছে, কাঁদবে পরে। আগে খাও।’’ বলে পরপর কয়েকটা গাল ভাত খাইয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে খিঁচিয়ে উঠল, ‘‘মাছটা বেছে দিতে পারছিস না? জল কোথায়?’’ ততক্ষণে জয়তী আর সুভদ্রার খাওয়া শেষ। ওরা থালাতেই হাত ধুয়ে বসে বসে দেখল, মেয়ের হাত থেকে ভাত খাচ্ছে ঈশিতা আর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অল্প কিছুটা খেয়ে অবশ্য আর খেল না। বলল, রাতে ভাল করে খাব। বলে উঠতে যেতেই মাথাটা একটু টলে গেল। কুট্টি হাত ধরে তুলে মুখ ধুইয়ে মামনের ঘরের বড় বিছানাটায় শুইয়ে দিল। সুভদ্রা একটু ভয় পেলেও জয়তীর দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হল। তার পর মুট্টিকে বলল, ‘‘যা গিয়ে দাদাকে নিয়ে মায়ের কাছে শো। মনে হয়, শরীরটা খারাপ লাগছে। তোরা থাকলে সুস্থ বোধ করবে।’’  

এই বারে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল দুই ভাইবোনেই। ছুটিছাটা থাকলে দুপুরে খেয়ে হয় মামন নয় পিসির কাছে শোয় তারা। সকালে মা গিয়ে ঘুম থেকে তুলে বুকে টেনে অনেকক্ষণ কেঁদেছে ঠিক, কিন্তু তাই বলে এখন মায়ের কাছে গিয়ে শুতে হবে? ওদের মুখ দেখে জয়তী এবং সুভদ্রা বুঝল, বড় দোটানায় পড়েছে। কিন্তু সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘‘মুট্টি রাতে মায়ের কাছে শুস আজ। আর কুট্টি এখন তুই যা। পরপর মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার উপর কাল থেকে আজ এতবেলা অবধি প্রায় না খাওয়া। ঘুমোয়ওনি রাতে।’’ কুট্টি আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ গিয়ে ঈশিতার পাশে শুল, কিন্তু ঘুমোল না।

ঈশিতা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিল। টানা বহু বছরের মানসিক চাপ ওকে ভিতরে ভিতরে অনেকটাই ক্ষইয়ে দিয়েছিল। তার উপর কাল থেকে চলা ঘটনা, আজ ছেলেকে জড়িয়ে তার বাইকে বসা, প্রথমে ছেলে এবং পরে মেয়ের হাতে ভাত খাওয়া— সব মিলিয়ে সেই চাপ আচমকা কমে যাওয়ায় ওর শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল। তবে ঘুমটা সে ভাবে হল না। একবার পাশ ফিরতে গিয়ে বুঝল, ওর পাশে কেউ শুয়ে আছে। প্রথম অনভ্যাসের ধাক্কায় চমকে উঠতে গিয়েও চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল, কুট্টি বালিশে মাথা রেখে চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে। ও কিছু না বলে পরম নিশ্চিন্তে কুট্টির গায়ের উপরে হাত দিয়ে শুয়ে রইল। কুট্টির চটকাটা ভেঙে গেলেও মামন আর পিসির ভয়ে ওই ভাবেই শুয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুভদ্রা ঘরে উঁকি মারল। বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। ও মামনকে ডেকে ফিসফিস করে বলল, ‘‘আমি উঠব, টয়লেটে যাব। তুমি এবার ওনাকে তোল।’’ ঈশিতা বুঝল, বাইরে যতই স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করুক, ছেলে বা মেয়ে কেউই ওকে এখনও মা বলে ডাকছে না। ও হাতটা আলতো করে সরিয়ে নিতে গিয়েও নিল না। ও জানে, ওই ডাক ও সহজে শুনতে পাবে না। সময় লাগবে অনেক। সুভদ্রা এবং জয়তী দু’জনেই ওকে সেটা বলেওছে। তবু এত বছর পরে ওর ভিতরের ঝড়টা কেউ বুঝতে পারছে না। সুভদ্রা আস্তে করে ওর হাতটা তুলে নিজের কোলে নিল। কুট্টি উঠে যেতেই যেন ঘুম ভেঙে গেছে, এই রকম চোখমুখ করে উঠে বসল ঈশিতা। তার পর একগাল হেসে বলল, ‘‘ভয় পাস না, আমার কিছু হয়নি।’’ সুভদ্রা পাল্টা হেসে বলল, ‘‘ওঠো, চা খাব।’’ বাইরে এসে চোখেমুখে জল দিল। ডিসেম্বরের প্রায় শেষ। শীতের কামড় এখন প্রচন্ড। তবে ওর গায়ে শুধুই একটা চাদর। জয়তী তাই নিয়ে একটু বকাবকি করল, সুভদ্রাও। ও হেসে ম্যানেজ করে বলল, ‘‘চা করো, আমি আসছি।’’ বলে সুভদ্রার থেকে একটা মোমবাতি চেয়ে নিয়ে সৌমাভর সমাধির কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে সেটাকে জ্বালিয়ে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে প্রণাম করল। তার পর সৌমাভর সমাধিতে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল। তার পর উঠে ঘরে ঢুকল। ওর চোখমুখ এখন অনেক শান্ত। দাওয়া থেকে জয়তী এবং সুভদ্রা দু’জনেই ওকে দেখছিল। ও উঠে দাঁড়াতেই দু’জনে ঘরে ঢুকে গেল। চা খেতে খেতে ঠিক হল, পরশু সবাই মিলে কলকাতা চলে যাবে। কাল একটা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া হবে, তাতেও সবাই চলে যাবে। আবার জানুয়ারির শেষের দিকে কয়েকের জন্য আসা যাবে। এমনিও গত কয়েক মাস প্রতি শুক্রবার সুভদ্রা অফিস করে চলে আসত। সোমবার গিয়ে আবার অফিস করত। মাঝেমধ্যে জয়তী এবং ছেলেমেয়েরাও ওই ভাবেই আসত। আবার সেই ভাবেই আসা-যাওয়া করতে হবে। সে দিন রাতে মুট্টি ওর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে গভীর রাত অবধি জেগে মেয়েকে অনেক আদর করল ঈশিতা। মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে নিঃশব্দে উঠে ফের সৌমাভর সমাধির উপরে মাথা রেখে অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। কাঁদল, কথা বলল, গুনগুন করে গান করল, নালিশ করল। নিশুতি রাত, তায় শীতকাল। কে দেখবে ওকে! প্রাণভরে আজ এত বছর পরে যেন স্বামীর সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলল ঈশিতা। ভোর হচ্ছে বুঝে আবার চুপিসাড়ে গিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে গায়ে কম্বলটা টেনে নিয়েছিল। মেয়ের সঙ্গে এক কম্বলের নীচেই শুয়েছিল সে রাতটা। তবে ঘুমোয়নি।

পরের দিনও ঈশিতা একই ভাবে সকালে উঠে আদর করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে ছেলেকে তুলেছিল। তার পরে সবাই মিলে চা খেয়ে জলখাবার খেয়ে ঘরের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছিল। কুট্টি-মুট্টি গেছিল গাড়ি ভাড়া করতে। এবারে পাঁচ জন মিলে যাবে, তাই বড় গাড়ি না করলে ঠাসাঠাসি হবে। ঈশিতার নিজের যা কিছু, তা শান্তিনিকেতন থেকেই একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগে করে এনেছিল। সেটা খোলেইনি। সুভদ্রা ও জয়তীর অনুমতি নিয়ে ও শুধু সৌমাভর বিছানার একটা চাদর আর সৌমাভর একটা গায়ে দেওয়ার চাদর ব্যাগে ভরে নিল। তার পরে রান্নাঘরে বুড়ির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রান্না করা, দুপুরে ছেলেমেয়েকে পাশে বসিয়ে খাওয়াল, নিজেও খেল। সবার সঙ্গে গল্পও করল। কিন্তু আজও ওর খাওয়ার পরিমাণ দেখে মনটা খুঁতখুঁত করল জয়তীর। এত কম খেলে ও যে দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়বে, সেটা নিয়ে ওর সন্দেহ নেই। ও ঠিক করল বিষয়টা নিয়ে সুভদ্রার সঙ্গে কথা বলবে আগে। আজ সবাই শুয়ে পড়লেও দুপুরে আর শুল না ঈশিতা। বরং সবাই শুয়ে পড়লে চলে এল সৌমাভর সমাধির পাশে। একসময় সেখানেই শুয়ে পড়ল। কিন্তু জয়তীর চিৎকারে উঠে এসে হাতমুখ ধুয়ে আবার গত কালের মতো মোমবাতি জ্বেলে অনেকক্ষণ প্রণাম করল। তার পর ঘরে এসে জয়তীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘অনেক দিনের না পাওয়াটা যতটা সম্ভব পাওয়ার চেষ্টা করছি গো। তাই ওর পাশ থেকে উঠে আসতে ভাল লাগে না। তার মধ্যে কাল চলে যাব, এই শীতে লোকটা একা শুয়ে থাকবে....।’’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে সময় সুভদ্রা বা ছেলেমেয়ে কেউই ঘরে ছিল না। জয়তী বুঝল, বাইরে যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, ঈশিতার আচরণে কিছু একটা অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে। কলকাতায় ফিরে এটা নিয়ে বসতে হবে বলে ঠিক করল।

সে দিন রাতেও মেয়ের পাশ থেকে নিঃশব্দে উঠে প্রায় সারারাত সৌমাভর সমাধির পাশে বসে বসে অনেকক্ষণ নিজের মনেই কথা বলে গেল ঈশিতা। ও জানতেও পারল না, পরপর দু’দিনই ওকে ওখানে প্রায় সারারাত বসে থাকতে দেখেছে একজন, বুড়ি। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে ভোরে ওঠা বরাবরের অভ্যাস বুড়ির। তার মধ্যে ওর ঘর থেকে ওই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রথম দিন ঈশিতা আর সুভদ্রা যে ওখানে অনেক রাত অবধি বসে কান্নাকাটি করেছে, সেটা ও দেখেছিল। তার পরের দু’দিন ঈশিতা রাতে যত নিঃশব্দেই ঘর থেকে বেরোক, বুড়ি ঠিকই টের পেয়েছিল। তার পরে ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়েছিল।
[+] 4 users Like Choton's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: তার ছিঁড়ে গেছে কবে - by Choton - 21-05-2025, 03:37 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)