Thread Rating:
  • 12 Vote(s) - 2.75 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Fantasy নীরবতার শরীর
#8
সকাল নয়টা দশ। সাদিয়া ইসলাম মৌ বাসার ব্যালকনিতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে, জাহিদ হাসান শুটিংয়ে। কাজের মেয়েটা কিচেনে। বাতাসে হালকা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। আজকের সকালটাও অন্য দিনের মতো—নীরব, শূন্য, ওজনে ভারী। হঠাৎ টেবিলে রাখা মোবাইলটা কাঁপতে শুরু করে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে: "Unknown Number". মৌ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন স্ক্রিনের দিকে, ফোনটা বেজেই যায়। প্রথমে ভেবেছিলেন অপরিচিত নাম্বারের ফোন উঠাবেন না। কিন্তু দ্বিতীয়বার হয়তো সকালের একাকীত্ব তাঁকে মনের অজান্তেই কলটা রিসিভ করিয়ে ফেলে। ফোনটা কানে তোলে নিতেই ওপাশ থেকে কেউ প্রায় চীৎকার করার ভঙ্গীতে বলে,

— “এই মধু! ফোন ধরতে এতো দেরি করিস কেন?”

সাদিয়া ইসলাম মৌ-এর চোখ কুঁচকে যায়, ঠোঁটের কোণে একরকম বিস্মিয় টান। মনে পড়ে—শেষবার এই কণ্ঠ শুনেছিলেন বছর দশেক আগে। একমাত্র তাঁর কলেজের বান্ধবী সুমিই তাঁর মৌ নামটাকে মজা করে মধু বলে ডাকে, ওপাশ থেকে সেই পুরোনো হাসির সুর:

— “এই মধু? চিনতে পারিস নি”
মৌ কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। গলার স্বর যেন ভিজে আসে।
— “সুমি? তুই... কোথা থেকে ফোন দিলি?”
— “ঢাকা থেকে। গতকাল আমি দেশে আসছি। এসেই তোর আগের নাম্বারে ফোন দিলাম। নাম্বারটা বন্ধ দেখায়। তোর নতুন নম্বর তানিয়ার কাছ থেকে পাইছি।”
মৌ উঠে দাঁড়ান। পেছনে টেবিলে রেখে আসা কফির কাপের ধোঁয়া তখনো উড়ছে।
— “তুই... তুই দেশে?”
— “হ্যাঁ রে। তিন সপ্তাহ আছি। আমেরিকার বাতাস আর সহ্য হচ্ছিলো না, রাশেদ সময় বের করতে পারলো না। তাই আমি একাই চলে এলাম। এখন আবার পুরোনো মানুষদের দেখা দরকার। আর সবচেয়ে পুরোনো তো তুই!”

সাদিয়া ইসলাম মৌ-এর গলায় এক ফোঁটা নিঃশ্বাস আটকে যায়। এই ভরসা, এই চেনা স্বরটা অনেকদিন শোনেনি। আজকাল কেউ অপ্রয়োজনে ফোন করে না। দরকার ছাড়া কেউ কথা বলে না।
— “তুই... এখন কোথায় আছিস?”
— “গুলশানে বাবার বাসায়। তোরা কি এখনো ধানমন্ডিতেই আসিছ?”
— “আছি রে...”
মৌ-এর গলা তখন একটু কেঁপে ওঠে। এই “আছি” বলার মধ্যে যেন কত অভিমান, কত শূন্যতা, কত জোর করে টিকে থাকার ইতিহাস লুকানো। ওপাশে সুমির গলা তখনও সেই আগের মতো প্রাণবন্ত:
— “তাহলে যা, রান্না বসা! আমি আসছি... আমরা বসব, গল্প করব, কাঁদব, আবার হাসবো। মধু, কতদিন মন খুলে কথা বলি নারে। থাক তবে। দেখা হলে সব কথা হবে।

ফোন কেটে যায়। মৌ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ান। নিজেকে দেখে, অনেকদিন পর মনে হয়, কেউ আছে—যার সামনে আবার নিজেকে প্রকাশ করা যাবে, হাঁটা যাবে কোনো ভান ছাড়াই। একটা ফোন কল, একটা পুরোনো বন্ধু, আর কিছু স্মৃতির খোঁচা—সাদিয়া ইসলাম মৌ-এর আচমকা নিজেকে বড্ড জীবন্ত, প্রাণবন্ত মনে হয়।

--------------------------------------------

জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো গলে পড়ছে। শীতল বাতাসে কফির গন্ধ মিশে একধরনের ঘোর তৈরি করছে। টেবিলের এক কোণে বসে আছেন সাদিয়া ইসলা মৌ—হালকা নীল সালোয়ার, সবুজাভ একটা কুর্তি, ঠোঁটে হালকা ছোঁয়া একটা গোলাপি রঙ। অনাহূত নার্ভাসনেসে মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়াচ্ছেন। সুমি এখনো আসেনি। কত বছর কেটে গেছে। শেষবার সুমির সাথে দেখা হয়েছিলো ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। কলেজ জীবনে খ্যাপাটে, লাস্যময়ী, আর দারুণ সাহসী সুমি বিয়ের পরপরই এভাবে দেশের বাইরে চলে যাবে এটা মৌ কখনো ভাবেন নি। কলেজে দুজনেই ছিলেন সবচে কাছের বন্ধু।  সুমির সকল এডভেঞ্চারের সঙ্গী ছিলেন মৌ।  আর আমেরিকা যাওয়া পর কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, তারপর আস্তে আস্তে দুজনেরই ব্যস্ততায় এতো বড় একটা গ্যাপ হয়ে যাবে সেটাও কল্পনা করেন নি।

একটা উজ্জ্বল হাসি নিয়ে দরজায় দিয়ে রুমে ঢোকে সুমি। পরিপাটি চুল, চোখে সানগ্লাস, গলায় একটা হালকা চাদর
— “মধু!!”
— “দোস্ত…!”
দীর্ঘ আলিঙ্গনে যেন দুই সময় একত্রে মিশে যায়। বসে পড়লে সুমি সরাসরি বলে,
— “তুই একদম আগের মতোই আছিস রে। শুধু চোখে মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম আর ক্লান্তি।”
কাজের মেয়েটা কফি দিয়ে যাত। মৌ কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন,
— “ক্লান্তি তো শুধু চোখে না, সুমি। মনেও জমে আছে। আমার কথা বাদ দেয়। তোর খবর বল। আচমকা দেশে!”
— “আর বলিস না। আমেরিকায় দমবন্ধ লাগে। দেশের জন্য এতো মন টানছিল!?”
— “দমবন্ধ লাগছিলো বলেই কি দশবছর পর দেশে এলি!”
— “হিহিহি, খোঁচা মারার তোর স্বভাব গেলো না রে মধু। কেন আসতে পারিনি সেতো তুই ভালোই বুঝিস। রাশেদের কাজের এতো চাপ। তাঁর উপর বাচ্চাটার পড়ালেখা, সব মিলিয়ে ইচ্ছা থাকলেও আসা হয় নাই। এইবারই দেখ না, রাশেদ পারলোই না আসতে। জামাই আর ছেলেটাকে শাশুড়ির দায়িত্ব রেখেই শেষমেশ চলেই এলাম”
— “একদম সংসারি হয়ে গেছিস তুই। কলেজে থাকার সময় বলতি ট্রাভেলার হয়ে সারাবিশ্ব ঘুরবি, জীবনে বিয়েশাদি সংসার করবি না”
— “সেতো তুইও বলতি। জাহিদ ভাই কই?
— “ওতো এখনো ফিরে নি। রাত হয় ফিরতে।
— “আর তোর ছেলে মেয়ে? ওরাতো অনেক বড় হয়ে গেছে মনে হয় রে।
— “হ্যাঁ অনেক বেশি বড় হয়ে গেছে রে। এতো বড় যে ওদের  ছায়া নিচে বসে থাকি।
— “এতো ডিপ্রেসিং কাব্যিক লাইন বলছিস যে! তুই সেলেব্রেটি মানুষ! তোর আবার কিসের প্যারা।
মৌ ঘাড় নাড়েন। একটু থেমে বলে,
— “আমার চারপাশে সবাই আছে, কিন্তু আবার কেউ নেই। আমি কাউকে আর স্পর্শ করতে পারি না। আমাকে কেউ ছোঁয় না। কার কণ্ঠে আমার জন্য ভালোবাসা টের পাই না। কেউ আমাকে যেন দেখে না। শুধু থাকার জন্য থাকা আরকি।”
সুমির চোখ একটু গভীর হয়ে ওঠে।
— “জাহিদ ভাই?”
— “নিজের আলোয় থাকে। আমি সেই আলোর সামনে একটা ছায়া মাত্র।”
— “আমাদের গল্পগুলো এমন হলো কেন রে! সংসারের জন্য এতো কিছু করেও শেষমেশ শূন্য হাত।
— “কি বলিস! তোর আবার কি হল।
সুমির চোখ জলে ভেজে যায়,
— “কাজের চাপ রাশেদ সাথে আসে নি এসব কথা মিথ্যারে। রাশেদ তাঁর সাদাচামড়া  সেক্রেটারির সাথে প্রেম করছে। আমি এক প্রকার রাগ করে চলে এসেছি। কি করবো বুঝতেই পারছিলাম না”
— “কি বলিস এসব।!!!”
— “দোষটা বোধহয় আমারই। সংসার আর সন্তান মানুষ করতে গিয়ে শরীর আর মনের চাহিদার কথা ভুলে বসেছিলাম। শেষের দিকে রাশেদ আমার দিকে এমন ভাবে তাকাতো যেন আমি মানুষ না কোনো যন্ত্র।
— “তোরা নিজেরে আলাপ করে বিষয়টা ঠিক করতে পারলি না!
— “এসব আলাপ করে ঠিক হয়য়!! তুই পারবি জাহিদ ভাইয়ের সাথে আলাপ করে সব ঠিক করতে। গত এক দেড় বছর ধরে রাশেদ আমাকে স্পর্শই করতো না। বলতো, আমার শরীরে নাকি মসলার গন্ধ। আমার চোখে নাকি প্রেম নেই, আছে শুধু ক্লান্তি। আমার কণ্ঠে প্রেম নেই, আছে শুধু অভিযোগ। শেষ কবে রাশেদ আমাকে ভালোবেসে স্পর্শ করেছে ভুলেই গেছি”

একটু থেমে, কাঁপা কণ্ঠে সাদিয়া ইসলাম মৌ বললেন,
“আমার তো একই অবস্থা রে। শেষ কবে আমি কামনা করেছি, শেষ কবে আমাকে কামনা করা হয়েছে—মনে নেই।”
সুমি হাত বাড়িয়ে মৌর হাত চেপে ধরে।
— “আমরা এখনো জীবন্ত। আমাদের ভেতর এখনো আগুন আছে। শুধু কেউ জ্বালায় না।”
— “আমরা কী দোষ করলাম রে সুমি? আমাদের শরীরটা কি পাপ? আমাদের বয়সটা কি শাস্তি?”
— “জানি না রে। শুধু জানি, আমি আর এসব দুই টাকার নৈতিকতার মাপে নেই। এসব সমাজ, রীতি, ভালো মানুষীর কপালে জুতো মারি। এতো দিন ভালো থেকে কি পেয়েছি! অবহেলা আর অপমান ছাড়া।
— “আর কি বা করার আছে বল।
— “অনেক কিছুই করার আছে। তোর জয়ের কথা মনে আছে?
— “জয় মানে! আমাদের কলেজের জয়? তোর প্রাক্তন প্রেমিক!!”
— “হ্যাঁ। আমি দেশে আসার আগেই অনেক কষ্টে ওকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে বের করছি। ব্যাটা বিয়েশাদি করে সুখেই আছে। দেশে এসেই ওর সাথে যোগাযোগ করছি।
— “বলিস কি! তারপর!!!”
— “তারপর আরকি! ওর কণ্ঠে যে দরদ, ভালোবাসা, মায়া আমার জন্য এখনো উতলে পড়ছিলো তাতেই আমার হয়ে গেছে।
— “কি হয়ে গেছে!
— “ন্যাকা!!! বুঝিস না কি হয়েছে।
— “বলিস কি!!! এখন কি করবি।
— “কি আর করবো। আগামী সপ্তাহে দুজন একসাথে কক্সবাজার যাবো। ঘুরে আসি। দেখি আনন্দ আর সুখটা কলেজ জীবনের মতো পাই কিনা।
— “তুই পারিস রে! একদম সেই কলেজের বিপ্লবী সুমি। আমি তোর মতো সাহসি হতে পারলাম না সারাটা জীবন।
— “শোন, এসব সাধু মার্কা কথা বাদ দেয়। আগামী পরশু আমাদের গুলশানের বাসায় একটা ছোট ঘরোয়া পার্টি দিচ্ছি আমার দেশে আসা উপলক্ষ্যে। তুই মাস্ট আসবি।
— “আমি বোধয়য় পারবো না। বুঝতেই পারছিস সংসারের ব্যস্ততা। তাঁর উপর পার্টি মানেই অনেক রাত। এখন আর ওসব আমাকে টানে না।
— “সংসারের কি ব্যস্ততা তোর! বসে বসে শূন্যতা উপভোগ করা আর একলা সময় কাটানোরে সংসার বলিস! শুন, এসব কিছুই আমি শুনছি না। তুই পরশু সন্ধ্যায় অবশ্যই আমার বাসায় যাবি। কলেজের আরো দু একটা ফ্রেন্ডরেও ইনভাইট করছি। সবাই আসবে বলছে। অনেক দিন পর সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবি। আর তাও যদি  না যাস! তাইলে আমি পুরো পার্টীর সবাইকে নিয়ে বাসে করে রাতে তোর বাসায় চলে আসবো। মনে থাকে যেন।

সাদিয়া ইসলাম মৌ ফিক করে হেসে ফেলেন। তিনি জানেন সুমি সত্যি একাজ করতে পারে। আর অনেকদিন পর পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়ার কথা ভেবেই মৌ রাজি হয়ে যান পার্টিতে যেতে।  




গল্পের ফিডব্যাকে কমেন্টে বা ইনবক্সে জানাতে পারেন। তবে বারবার আপডেট চেয়ে কমেন্ট করে থ্রেডের বারোটা বাজাবেন না প্লিজ। গল্পটা প্রত্যেক সপ্তাহে আপডেট হবে। যদি দেখেন সপ্তাহ শেষ তাও আপডেট নাই, তখন অভিযোগ করবেন।
[+] 9 users Like Orbachin's post
Like Reply


Messages In This Thread
নীরবতার শরীর - by Orbachin - 11-05-2025, 12:34 AM
RE: নীরবতার শরীর - by Orbachin - 14-05-2025, 01:35 AM
RE: নীরবতার শরীর - by Davit - 18-09-2025, 09:54 AM



Users browsing this thread: