Thread Rating:
  • 36 Vote(s) - 2.97 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica তার ছিঁড়ে গেছে কবে
(৪৩)


সেকি কেবলি চোখের জল



ঘরে ঢুকে দেখল, দুই ভাইবোন তখনও সৌমাভর বুকে মাথা রেখে শুয়ে। নিঃশব্দে কাঁদছে। সুভদ্রা ওদের উঠতে বলল, ওরা উঠে বাইরে চলে গেল একটা কথাও না বলে। বিছানার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল ঈশিতা! এ কাকে দেখছে ও। সেই পেটানো, ছিপছিপে চেহারা, ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, মাথাভর্তি চুল, মুখে সব সময় হাসি— কিচ্ছু নেই! একটা রোগা, বুড়োটে চেহারা বিছানায় ঘুমোচ্ছে যেন! চোখেমুখে কষ্টার ছাপ, তবু ঠোঁটের কোনে যেন একটু হাসি মাখানো। ওর আবছা মনে পড়ল, এই রকম দেখতে একটা লোকই সেদিন ওকে অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে হাত ধরে একটা দোকানে বসিয়ে ওর হাতে জলের বোতল তুলে দিয়েছিল। সেটা এই লোকটাই? এটা সেই সৌমাভ? ১৯ বছর আগের এক নভেম্বরে আগুনের সামনে বসে যার সঙ্গে জীবন কাটানোর কয়েকটা মন্ত্র পড়েছিল কিচ্ছু না বুঝে! যদিও পরে মনে মনে হাজারবার বলেছিল, ওর স্বামীর মতো স্বামী হয় না। এটা সেই লোকটা? এ কোন সৌমাভ? ঈশিতার মনে পড়ল, বহু বহু বছর আগে, ও বাপের বাড়ি চলে আসার কয়েক মাস পর থেকেই সৌমাভর শরীর খারাপ হচ্ছে দেখেও কিছু করা তো দূর, জিজ্ঞাসাও করেনি। আর তারও অনেক মাস পরে বেলেঘাটার সেই বাসায় ফিরেও তো ও নিজেকে বিশেষ বদলায়নি। প্রথমে কলেজের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত হল, তখন সৌমাভ এলেও ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে পাশের ঘরে চলে যেত। তার পর তো সেই শুক্রবারের সকালটা...। নিজের শরীরের একটু সুখের জন্য সব হারিয়েছে তো বটেই, এই লোকটাকেও যে ও নিজেই তিলে তিলে শেষ করে ফেলেছে, ওর জন্যই যে লোকটাই আজ এই পরিণতি, তা এমনিতেও সবাই জানে। তবে সবচেয়ে বেশি জানে ঈশিতা নিজে। কারণ সৌমাভর শরীর খারাপ হচ্ছে দেখেও অত বছর আগেও ও কিছুই করেনি। ততক্ষণে গুঞ্জা বাদে বাকিরা সবাই এসে ওই ঘরে ঢুকেছে। ঈশিতা আর থাকতে পারল না। সুভদ্রার হাত ছাড়িয়ে ঝাঁপ দিল সৌমাভর উপরে। ওর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া দেহটার মুখে বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে কেঁদে উঠল পাগলের মতো হাউহাউ করে। একটু আগের কুট্টি-মুট্টির মতোই বারবার ‘‘একবার চোখ খুলে দেখ, আমি এসেছি গো...’’ বলতে বলতে ডুকরে উঠতে লাগল বারবার।

এসে অবধি চুপ করে ছিলেন ঈশিতার বড় দুই জামাইবাবু। এবার ওই কান্না শুনতে শুনতে জয়তীর দিকে তাকিয়ে বড় জামাইবাবু বললেন, ‘‘সেবার কালীপুজোয় ওর জ্বর হয়েছিল। চার দিন পরে গিয়ে দেখেছিলাম শরীরটা প্রচন্ড ভেঙেছে। ওর ন্যাচারাল লুকটাই উধাও। খুব খারাপ লেগেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, নিজের যত্ন নেয় না। কিন্তু ও বলতে বারণ করেছিল কাউকে বলে আর বলিনি। তখন তো জানতাম না এই দিনটা দেখতে হবে!’’ বলে দুহাতে চোখ ঢাকলেন। ঘরের অন্যরাও কেঁদে উঠল, শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল জয়তী আর সুভদ্রা।

এরমধ্যেই কুট্টি-মুট্টির সঙ্গে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। গলায় স্টেথো দেখে বোঝা গেল ডাক্তার। তিনি মৃত্যুর সময়টা নোট করে খসখস করে একটা প্যাডে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। তার পর ঘর ছেড়ে বেরনোর আগে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ওঁর এত আত্মীয়-স্বজন আপনারা, তবু লোকটা ঠিকমতো খেত না, চিকিৎসা করাত না, এত সিগারেট খেত আর আপনারা কেউ কিছু করেননি? আশ্চর্য! যাক, পঞ্চায়েতের চিঠিটাও আমার লোকটা এসে দিয়ে যাবে। ওঁর দাহ তো এখানেই হবে শুনলাম। যাক, আপনারা ভাল থাকবেন, আমি আসি,’’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ডাক্তার বেরিয়ে যেতেই জয়তী বলে উঠল, ‘‘এত সিগারেট খেত কী বলব! বম্বেতে থাকতে একবার হার্টঅ্যাটাক হল, সেটাও কত বছর পরে জানাল আমাদের! ওষুধ ওই প্রথম কয়েক মাস খেল, ব্যাস! এখানে আসার পরে যখনই বলেছি ডাক্তার দেখাও, তখনই খিঁচিয়ে উঠত। কি রাগ! ছেলেমেয়ের কথাও শুনত না। সৌমদা বলতে গেলে সুইসাইড করল!’’ ঘরের বাকিরা তো বটেই, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সৌমাভর পায়ে মাথা রেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে কথাটা মনে মনে মেনে নিল ঈশিতা নিজেও। তার পরেই দেখল দুই ভাইবোন সুভদ্রা আর জয়তীর কানে কানে কিছু বলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

একটু পরে সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিল জয়তী, শুধু ঈশিতা আর সুভদ্রাকে রেখে। দরজা বন্ধ করার আগে বলল, ‘‘ওকে সাজিয়ে দে, শেষবারের মতো। আমি থাকতে পারব না। তোরাই কর।’’ বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুভদ্রা একটা নতুন ধুতি এনে ঈশিতাকে বলল, ‘‘ওকে পরিয়ে দাও, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। কুট্টি-মুট্টিকে বড় করে তুললেও ওদের আসল মা তো আমি নই। আর স্ত্রীও ছিলাম না ওর কোনও দিন। স্ত্রী হিসেবে ওর শরীরে তোমারই অধিকার সবচেয়ে বেশি, তাই তুমিই ওটা কর।’’ বলে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিল।

মৃত শরীরের পরনের লুঙ্গিটা আস্তে আস্তে খুলে নিল ঈশিতা। এই শরীরটা শুধুই ওর ছিল, আজও ওরই আছে। মাঝে কেটে গেছে উনিশ বছর। এই শরীরটা ওকে অনেক সুখ দিয়েছে, কিন্তু ও কিছুই ফিরিয়ে দেয়নি, উল্টে ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছে। ভাবতে ভাবতে নগ্ন দেহটায় অসংখ্য চুমু খেল। ঠান্ডা ঠোঁটে, চোখের পাতায়, গালে, কপালে, বুকে, পেটে। তার পরে লিঙ্গটা হাতে ধরে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘‘এই জন্মে তোমায় পেয়েও নিজের পাপে হারিয়েছি। পরের জন্মে যেন তোমাকেই স্বামী হিসেবে পাই, প্লিজ আজ এটুকু আশীর্বাদ করো আমায়। আজ তোমায় আমি ছুঁতে পারলেও তুমি বুঝতে পারবে না, প্লিজ এটুকু ভিক্ষা দাও’’, বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল সৌমাভর কোমরে মাথা রেখে। ওর কান্নার আওয়াজে সুভদ্রা ঘরে ঢুকে বলল, ‘‘কেঁদো না, আর এই ভাবে রেখো না। ওনার শরীরে ধুতিটা পরিয়ে দাও। এখনও অনেক কাজ বাকি। সাজাতে হবে তো!’’ ঈশিতা চোখ মুছে ধুতিটা কোমরে লুঙ্গির মত করে বেঁধে দিল। সুভদ্রা ঘরেই ছিল। ওর সামনেই করল সবটা। তার পর একটা নতুন পাঞ্জাবি এনে পিছনটা কেটে সেটা শক্ত হয়ে যাওয়া দেহটা দুজনে মিলে তুলে হাত গলিয়ে কোনও রকমে পরাল। তার পর কপালে চন্দনের ফোঁটা দিল দুজনে মিলে। ওদের দুজনের চোখের জলে সৌমাভর পাঞ্জাবি, ধুতির কত জায়গায় জলের দাগ বসে গেল। চন্দন ধুয়ে গেল কতবার! ওরা সাজানো শেষ করে বাইরে আসার পরে সবাই ভিতরে ঢুকল। সৌমাভকে ঘিরে বসল। শুধু কুট্টিকে চোখে পড়ল না, মুট্টিকেও। সুভদ্রা বাড়ির দাওয়া থেকে নেমে সামনের দিকে চলে গেল, কী করবে কে জানে!

জয়তী ঈশিতার সঙ্গেই সঙ্গেই এল। ঈশিতা ঘরের বাইরে আসতেই এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা গুঞ্জা উঠে এল। কিন্তু গুঞ্জা কিছু বলার আগেই ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে হাতের ফোনটা নিয়ে দ্রুত একটা নম্বর খুঁজতে লাগল ঈশিতা। তার পর ফোনটা কানে নিল। কিছুক্ষণ পরে খুব শান্ত এবং নরম গলায় ওপাশের কাউকে বলল, ‘‘আপনি শুভম বলছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ঈশিতা সরকার বলছি। মানে ঐশী রায়চৌধুরীর দিদি বলে চিনত আমাকে অনেকে, আপনিও। ও আমার বোন ছিল একসময়। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শান্তিনিকেতনে পড়াই। এই তো চিনতে পেরেছেন। যাক শুনুন, কাজের কথা বলি। আমার স্বামী সৌমাভ সরকার একটু আগে মারা গেছেন। আমার দুই ছেলেমেয়ে কুট্টি আর মুট্টি মানে অরণ্য আর মৃত্তিকা তাদের বাবার কাছে বসে আছে। আমার দিদি-জামাইবাবুরাও। আপনি আগে আমার কথাটা শুনুন। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা কথা হয়েছিল। সেটা মিথ্যে নাটক ছিল, বুঝলেন। তখন আপনাকে আমার ব্যাপারে মিথ্যে বলা হয়েছিল। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৯ বছর আগে। আমার দুই যমজ ছেলেমেয়ে এবার জুলাইয়ে ১৮-য় পা দিয়েছে। কয়েক বছর পরে ওদের বিয়ে দিতে হবে, এই অবস্থায় আমি নিজে কি করে বিয়ে করব বলুন তো? বুঝতেই পারছেন। আমিও তখন সবটা বলিনি, সরি। আর আপনার আঙটিটা ঐশী রায়চৌধুরীর কাছে ফেরত দিয়ে দিয়েছি। ভাল থাকবেন, আর পারলে বিয়ে করে ফেলুন এবার। তবে আমার মতো ৩৭ বছরের বিধবা এবং দুই বড় বড় ছেলেমেয়ের মা কোনও বুড়িকে নয়, অন্য কাউকে। কেমন? রাখছি।’’ বলে ফোনটা কেটে ঐশীর দিকে তাকিয়ে একই রকম শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, ‘‘আপনি প্লিজ ওই আঙটিটা শুভমবাবুকে ফেরত দিয়ে দেবেন, কেমন? আর আজ থেকে আমাকে দিদি বলে আত্মীয়তা করতে আসবেন না। নমস্কার’’, বলেই হতভম্ব ঐশীকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জয়তীর হাত ধরে দাওয়া থেকে নেমে সামনের দিকে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: তার ছিঁড়ে গেছে কবে - by Choton - 10-05-2025, 02:54 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)