10-05-2025, 02:53 AM
(৪২)
প্রেম বলে যে যুগে যুগে
মেজদির কথাগুলো শুনতে শুনতে গুঞ্জা সেই যে মাথা নামিয়েছে, আর তোলেনি। ঈশিতাও চুপ করেই বসে আছে। শূন্য দৃষ্টি। ও ভেবে যাচ্ছে, কত কথা। ওর চোখে যেন ভাসছে— ওর সঙ্গে সৌমাভর বিয়ে, সেই বালির উপর বসে গান শুনতে শুনতে জীবনের প্রথম মিলন, তার পর থেকে একমাসেরও বেশি কয়েকটা দিন সৌমাভর আদরে, ভালবাসায় ভেসে যাওয়া। তার পর? ও মনে করার চেষ্টা করতে গেল, তখনই চটকটা ভাঙল একটা চাবির গোছা সামনে পড়ার আওয়াজে। ও চমকে মুখ খুলে দেখল, জয়তী একটা চাবির গোছা গুঞ্জার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলছে, ‘‘এই নে, এটা তোর নতুন শুভাকাঙ্খী কাম নতুন ছোট জামাইবাবুর ফ্ল্যাটের চাবি। যদিও ভাড়ার ফ্ল্যাট, তবু বিয়ের পরে তোর ছোড়দিকে নিয়ে তোর নতুন ছোট জামাইবাবু সেখানেই উঠবে তো! তাই তুই সব দেখে নে বাবা। ওদের বুঝিয়ে দিস। অবশ্য ঈশিতা এর সবগুলোই চেনে, জানে। তবু তুই দেখে নে বাবা। এই দুটো চাবি বাইরের কোলাপসিবল গেটে লাগানো দুটো তালার। এর আরও দুটো চাবি তোর ছোড়দির কাছেই আছে। অন্তত সৌমদা মরার আগে অবধি আমাকে আর সুভদ্রাকে সেটাই বলে রেখেছিল। তার একটা ওর ব্যাগে বা অন্য কোথাও, আর অন্যটা তোর ছোড়দির জামাকাপড়ের আলমারির লকারে আছে। তোরা দু’জনে মিলে খুঁজে নিস, কেমন? আর এই দুটো বড় চাবি মেন গেটের দুটো ইয়েল লকের। এদুটো সৌমদার কাছে থাকত। একটা অফিসের ব্যাগে, অন্যটা সৌমদার অফিসের ড্রয়ারে। এই রকম আরও দুটো চাবি আছে। তার একটা তোর ছোড়দির ব্যাগে আছে, আর একটা তোর ছোড়দির বেডরুমের বেডসাইড ড্রয়ারে থাকার কথা। সৌমদাই বলেছিল রাখতে।’’ তার পরেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘‘অবশ্য জানি না, চাবিগুলো সেখানেই রাখা আছে না অন্য কোথাও বা অন্য কারও কাছে আছে। আর এই দুটো চাবির কোনও ডুপ্লিকেট নেই। যেবার বাড়িটা কিনে ফ্ল্যাটটা সিল করেছিল, সেবার মেন গেটে আলাদা করে লাগিয়েছিল। যাতে অন্য তালাগুলোর চাবি হাতবদল হয়ে কারও কাছে গেলেও পরে সে আর ঢুকতে না পারে।’’ কথা থামিয়ে মেজদি-বড়দির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কী কপাল দেখ লোকটার! যাকে ভালবেসে, যার সেফটির কথা ভেবে এতকিছু করেছিল, সে নিজেই ঘরে নিজের ভালবাসার লোক ঢুকিয়ে বিছানায় ফূর্তি করত, ফূর্তি করার কথা ভাবত! আর ওই লোকটা? সব হারিয়ে একা একা ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলল! জানো মেজদি, কুট্টি-মুট্টির দশ বছরের জন্মদিনের দু’দিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। তখন সুভদ্রা চাকরি পেয়ে গেছে। ফলে ভীষণ একা ফিল করত। আমাকে বলেছিল, এবার যদি পারি ঈশিতার কাছে ছেলেমেয়েকে দিয়ে দেব। পরে না হয় নিজের কথা ভাবব। আমার তখনও ডিভোর্স হয়নি, তবে হবে হবে করছে। আমি তখন বলেছিলাম, ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুমিও যাও না বাবা তার কাছে। আর এত অভিমান কেন? জানো, চুপ করে সব শুনেছিল। ওই সুন্দর চেহারাটা ভাঙতে ভাঙতে যেন কঙ্কাল হয়ে গিয়েছিল গত কয়েক মাসে। আমি বুঝে গেছিলাম, সৌমদা এবার চলে যাবে। সুভদ্রাকেও ইঙ্গিতে বলেছিলাম, তৈরি হ। আমি থাকলেও তোকেই দেখতে হবে কুট্টি-মুট্টিকে। এই ক’দিন আগে ওই ঘটনার পরে যেদিন প্রথম ঈশিতার হাত ধরল, সেদিন থরথর করে কাঁপছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আসলে ওর আশা ছিল, ঈশিতা ওকে ভালবাসে। সেটা আবারও মিথ্যে বুঝেই হার্টঅ্যাটাক করে রাস্তায় পড়ে যায়। আজ সকালেও ফিসফিস করে আমাকে বলেছে, ‘আচ্ছা ও খবর পেলে আসবে আমাকে দেখতে? অবশ্য দেখলেও তো চিনতে পারবে না! তার উপর সামনে বিয়ে। যাক ভাল থাকুক’। তার পর আর দুটো কথা শুধু আজ সকাল থেকে বলেছে। আমাকে, সুভদ্রাকে গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ভাল থাকতে বলেছে বারবার। আর ছেলেমেয়েকে বুকের উপর টেনে বলেছে, নিজেরা সৎ থেকো, অন্যের কাছেও সৎ থাকার চেষ্টা কোরো। আর পিসি ও মামনকে দেখো। আর কিছু বলতে পারেনি। ওরা মুখে জল দিল, ব্যাস! দ্যাখো, সুভদ্রা তো কেউ না ওদের। সুভদ্রা ছিল আমার বাড়ির কাজের মেয়ে। ওকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম চিল-শকুনের হাত থেকে বাঁচাতে। সেই সুভদ্রা ওদের চার মাস বয়স থেকে নিজের বুকে টেনে বড় করেছে। ওরা সুভদ্রার বুকে লেপ্টেই বড় হয়েছে। সৌমদাই শিখিয়েছিল, ওকে মামন বলে ডাকতে। অথচ নিজে সুভদ্রাকে কোনওদিন খারাপ ভাবে ছুঁয়েও দেখেনি। সুভদ্রা কতদিন কেঁদেছে এ নিয়ে আমার কাছে। আবার দেখো, সুভদ্রা লেখাপড়া শিখে চাকরি পাওয়ার পরে সৌমদা কী খুশি! বলল, আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। আর একজনের জন্যও চেয়েছিলাম, সে পিঠে ছুরি মেরে দিয়েছে। সুবি মনে হয় তা করবে না। করলেও আর নতুন করে কষ্ট পাব না। সুভদ্রা কিন্তু ছুরি মারেনি সৌমদাকে। বরং মাসে দুবার কলকাতা থেকে বম্বে ছুটত ওদের দেখবে বলে, তাও প্লেনে! ভাবতে পারো? এই একঘন্টা আগে এত বড় বড় দুই ছেলেমেয়েকে চড় মেরে গাল লাল করে দিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। ওরা কিন্তু রাগ করেনি। বরং মামনকে জড়িয়ে পাল্টা কেঁদেছে। একটা কোথাকার অচেনা, আদিবাসী মেয়ে, যার সঙ্গে ওদের রক্তের সম্পর্কও নেই, তার কতটা ভালবাসা, সততা থাকলে এটা করতে পারে? অথচ নিজের মতো আলাদা সংসার করতে পারত না সুভদ্রা? আজও চাইলে ও বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু ও করবে না। কি বলব বলো!’’ কথাগুলো শেষ করে দুহাতে চোখ ঢাকল জয়তী।
এই বার মুখ তুলে জয়তীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঈশিতা। এতক্ষণ ধরে, এতদিন ধরে ও অনেক কথা শুনেছে। কিন্তু সৌমাভ যে ওর কাছে ফিরতে চেয়েছিল, সে কথা তো জয়তী কখনও বলেনি ওকে? প্রশ্নটা করতেই পাল্টা ঝাঁঝিয়ে উঠল জয়তী। বলল, ‘‘প্রথম কয়েকটা বছর তুই যোগাযোগ রাখতিস, আমিও রাখতাম। তোদের বাবা মারা যাওয়ার পরে তোদের মাকে নিয়ে বড়দি নিজের কাছে রাখেন, তোরা বাড়িটা প্রোমোটারকে দিস। বড়দির বাড়িতেই তোদের মা মারা যান। আমি খবর পেয়ে গেছিলাম। সেদিন সৌমদা অনেক টাকার মিষ্টি আর প্রচুর ফুল আমার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল, তোদের বলিনি। তার পরে তোরা নিজেরা দুটো করে ফ্ল্যাট পেয়েছিস, টাকা পেয়েছিস। সেটা অবধি আমাকে বলেছিলি। তার পর তুই শান্তিনিকেতনে চাকরি নিয়ে আসার পর থেকে এই আট-নয় বছরে একটা ফোনও করেছিলি? তার আগের তিন বছরেও একটা ফোনও করিসনি। প্রথম প্রথম শুধু দু’একটা মেসেজ করতিস বিজয়ায় আর ইংরেজি নতুন বছরে। ব্যাস! স্বামী-সন্তানের খবর নেওয়ার দায়িত্ব শেষ? সৌমদা গত আট বছর কলকাতায় চাকরি করেছে, জানতিস? আমাদের অফিস হাজরা থেকে সল্টলেকে সরে গেছে, জানিস? কাকে বলব? তোর ফোন নম্বর যে বদলেছিস, সেটা জানানোর ভদ্রতাও দেখাসনি তুই! আজ আমাকে বলছিস? আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, জানিস? তোর কাছে ফেরার কথা ভেবে সৌমদা এই কয়েক মাস আগে চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল, জানিস? আর তুই? বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার আনন্দে মশগুল থেকেছিস। তোকে বলেছিলাম না, নিজের সংসার-স্বামী-সন্তানকে কোনওদিন তুই ভালই বাসিসনি, ভান করে গেছিস। আবারও সেই কথাই বলছি। তাই ছেলেমেয়ের প্রণাম না হয় বুঝিসনি, ধরে নিলাম, ১৭-১৮ বছরে সে স্পর্শ মনে রাখা কঠিন। ‘মুকুট্টি’ নামটা দেখে কিছু মনে হয়নি? মুট্টি-কুট্টির কথা মনে পড়েনি? মুট্টি প্রথম যে গানটা গেয়েছিল, সেটা আন্দামানে থাকতে একবার তোরা দু’জনে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলি, তোর মনে আছে আজ? তার পরে তোরা যেদিন সবাই আমার ফ্ল্যাটে গেলি সৌমদাকে খোঁজার নাটক করতে, সেদিন আমি এই গানটাই গেয়েছিলাম, তোর মনে আছে? সেদিন তুই কেঁদেছিলি? কই কাল মুট্টির গলায় সৌমদার অবিকল নিজস্ব ভঙ্গিতে গানটা শুনে তো কাঁদিসনি? নাকি মনেই পড়েনি গানটার কথা? বাদ দে! কুট্টি যে গানটা গেয়েছিল, সেটা গাওয়ার আগে দুলাইনে তার সম্পর্কে কিছু বলেছিল। এটা সৌমদা বরাবর করত, বহু গানের ক্ষেত্রে। কুট্টি কথাগুলো বলার সময় তোর কিছু মনে হয়নি? ওই ছবি আর কবিতাটা শুনেও না? ওরা স্টেজ থেকে নেমে আমাকে ফোন করেছিল। কাঁদছিল দামড়া দামড়া ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের ১৮ বছরের জন্মদিন গেছে কয়েক মাস আগে, মনে আছে তোর? মনে নেই জানি, এখন মিথ্যে বলবি যে মনে আছে। ওদের সেদিন সব কথা জানানো হয়েছিল। ওরা সৌমদার সঙ্গেও কথা বলেছিল। অনেক কান্নাকাটি, রাগারাগি, ঝগড়া করেছিল। তার পর থেকে ওরা তোকে দেখবে বলে ছটপট করত। তোদের বাড়ি থেকে দেওয়া দুটো নাম সৌমদা বদলে অরণ্য আর মৃত্তিকা করে দিয়েছিল। আমিও জেনেছি পরে। কিছু বলিনি। কিন্তু ওদের ডাকনাম বদলায়নি সৌমদা। আশা ছিল, একটু আনকমন নাম তো, তাই তুই যদি কোনওদিন অন্তত ডাক নাম শুনেও ওদের চিনতে পারিস। তুই চিনতে পারলে ওরা তোকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, এই আশায় গত একমাস ধরে লেখাপড়া, কলেজ সব চুলোয় দিয়ে এখানে পড়ে থেকেছে। আর তুই? আরও একটা নতুন লোককে বিয়ে করে স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে শোয়ার চিন্তায় মশগুল হয়ে তার দেওয়া হীরের আঙটি পরে গর্ব করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ছিঃ।’’
ঈশিতা জানে ওর কিচ্ছু বলার নেই। একটা কথারও প্রতিবাদের কোনও জায়গাই নেই। জয়তীদি প্রথম দিন থেকে ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ও কি, ও কি রকম! চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার পর হঠাৎ যেন কী মনে পড়েছে, এই রকম করে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। দুই দিদি, দুই জামাইবাবু, ছোট বোন, ছোট বোনের স্বামী— কারও উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে নিজের একটা হাত জয়তীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘‘আমি একটা বেশ্যা। নিজের স্বামী, সন্তানদের ছেড়ে অন্য লোকের বিছানায় শুয়ে বেড়াই। আমি নোংরা মেয়ে। তোমাদের সব কথা মানছি। কিন্তু দেখ, এই আঙটিটা আমি কোন আঙুলে পরেছি? জানি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমার কেমন যেন একটা লাগছিল। কালও খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই আজ সকালে ওরা বেরোতেই গুঞ্জার বরের বাইকে চেপে এখানে এসেছি ওদের পিছনে পিছনে।’’ বলে আঙটিটা খুলে মাথা নিচু করে বসে থাকা গুঞ্জার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘‘নিজের প্রমোশনের জন্য রাহুলের ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে শোশয়াতে চেয়েছিলি তো? আমি বেশ্যা, যা বলবি করব। তুই বললে, ওই বিছানাতেই আবার রাহুলের সঙ্গেও শোব। কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে বলিস না, কেমন? জানিস না, বেশ্যাদের বিয়ে করতে নেই, সংসার থাকতে নেই! তুই কি রে? এই আঙটিটা তুই রেখে দে, তোর কাজে লাগতে পারে।’’ বলে নিচু হয়ে গুঞ্জার সামনে পড়ে থাকা জয়তীর দেওয়া চাবির গোছাটা তুলে নিল সযত্নে। তার পরে জয়তীর দিকে হাতজোড় করে বলল, ‘‘জানি আমি বেশ্যা, তাও একবার তোমায় অনুরোধ করছি, আমি কি শেষবারের মতো ওকে একটু ছুঁতে পারি? ও বলেছিল, জীবিত অবস্থায় যাতে আমি ছুঁতে না পারি। তার পরে নিজেই ছুঁয়েছিল, কিন্তু আমার মতো নোংরা মেয়ে, হাজার লোকের সঙ্গে শোয়া বেশ্যা তো, তাই ওর ছোঁয়া টের পাইনি গো! বলো না, প্লিজ, একটু ছোঁব ওকে?’’
ঈশিতার ধড়মড় করে উঠে বসা থেকে পরপর সব কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল জয়তী এবং বাকিরা। জয়তী বুঝতে পারল, ঈশিতা উল্টোপাল্টা বকছে, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে খুব আস্তে আস্তে। ও দ্রুত সামনে গিয়ে ঈশিতার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে মধ্যে জোর করে টেনে নিয়ে কান্না আর মমতা মাখানো একটা গলায় বলল, ‘‘কেন তুই নিজেকে সবার কাছে ছোট করছিস এ ভাবে? তুই সৌমাভদার বিয়ে করা স্ত্রী। তুই কুট্টি-মুট্টির মা। ভুল করেছিলি, তার শাস্তিও পেয়েছিস। কিন্তু আজ যে কথাগুলো বলছিস, সেটা সৌমাভদার থেকেও বেশি তোর নিজের ছেলেমেয়ের জন্য কষ্টের, খারাপ, অপমানের। মা হয়ে এটা বোঝ! তোকে বকেছি মানে এই নয়, তুই যা খুশি ভেবে নিবি নিজেকে।’’ বলে হুহু করে কেঁদে ফেলল এতক্ষণ ধরে শক্ত থাকা জয়তী। আর ওর বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল ঈশিতা।
সেই যে জয়তীর কথায় সুভদ্রা ও কুট্টি-মুট্টি ঘরে ঢুকেছিল, তার পর থেকে তাদের দেখা যায়নি। ঈশিতা জ্ঞান হারিয়েছে বুঝেই ওর বড়দি ও মেজদিকে ডেকে জয়তী বলল, ‘‘তোমরা একটু ধরে ওকে শুইয়ে দাও। চোখেমুখে জল দাও।’’ বলেই সুবি সুবি বলে ডাকল। ওর ডাক শুনে সুভদ্রা ও মুট্টি প্রায় একসঙ্গেই বাইরে এল। ও ইশারায় কাছে আসতে বলল। সুভদ্রা আসতেই ও কানে কানে কিছু একটা বলল। তার পর মুট্টিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই ঘরটায় ঢুকল, যেখানে এখনও শুয়ে সৌমাভ, তবে মৃত।
ঈশিতার জ্ঞান ফিরতে দেখল, কার একটা কোলের মধ্যে ওর মাথাটা রাখা। চুলগুলো ভিজে, গায়ের কাপড়টাও কিছুটা ভিজে ভিজে। মুখটা তুলে দেখল, একটা অচেনা মেয়ে। প্রায় ওরই বয়সী। গায়ের রঙটা তত ফর্সা নয়, তবে চোখমুখ খুব শার্প। মুখটা ভারী মিষ্টি, তবে চোখের কোনে এখনও জল। মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর ঘুরেঘুরে দেখাটা শেষ হতেই একটু হেসে বলল, ‘‘আমাকে দেখা শেষ হলে এবার ওঠ। ও ঘরে যেতে হবে। তোমার অনেক কাজ।’’ কথাটা শুনে একটু চমকে গেল ঈশিতা। কি নরম গলা মেয়েটার? এই তাহলে সুভদ্রা? কুট্টি-মুট্টিকে মায়ের যত্ন নিয়ে সেই চার মাস বয়স থেকে এত বড় করেছে একার হাতে? ও নিজে জানে, সৌমাভর স্ত্রী হিসেবে তো বটেই, দুটো ছেলেমেয়ের শুধু জন্ম দেওয়া ছাড়া মায়ের কোনও দায়িত্বও ও পালন করেনি। উল্টে শেষদিন বেওয়ারিশের মতো ওদের বাইরের কটে রেখে ঘরে...। ওর মাথায় বারবার সেদিনের ছবিটা ঘুরে আসে আর বোঝে কী করেছিল সেদিন ও! কিন্তু ওকে কোথায় যেতে হবে? কী কাজ? মেয়েটা যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেলল। ওর মাথাটা কোল থেকে তুলে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত ধরে টেনে তুলল। তার পরে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে ঢুকল সেই ঘরটায়, যে ঘরটা থেকে ঘন্টা দেড়েক আগেই ভেসে এসেছিল সৌমাভর মৃত্যুর খবর আর কান্না।
প্রেম বলে যে যুগে যুগে
মেজদির কথাগুলো শুনতে শুনতে গুঞ্জা সেই যে মাথা নামিয়েছে, আর তোলেনি। ঈশিতাও চুপ করেই বসে আছে। শূন্য দৃষ্টি। ও ভেবে যাচ্ছে, কত কথা। ওর চোখে যেন ভাসছে— ওর সঙ্গে সৌমাভর বিয়ে, সেই বালির উপর বসে গান শুনতে শুনতে জীবনের প্রথম মিলন, তার পর থেকে একমাসেরও বেশি কয়েকটা দিন সৌমাভর আদরে, ভালবাসায় ভেসে যাওয়া। তার পর? ও মনে করার চেষ্টা করতে গেল, তখনই চটকটা ভাঙল একটা চাবির গোছা সামনে পড়ার আওয়াজে। ও চমকে মুখ খুলে দেখল, জয়তী একটা চাবির গোছা গুঞ্জার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলছে, ‘‘এই নে, এটা তোর নতুন শুভাকাঙ্খী কাম নতুন ছোট জামাইবাবুর ফ্ল্যাটের চাবি। যদিও ভাড়ার ফ্ল্যাট, তবু বিয়ের পরে তোর ছোড়দিকে নিয়ে তোর নতুন ছোট জামাইবাবু সেখানেই উঠবে তো! তাই তুই সব দেখে নে বাবা। ওদের বুঝিয়ে দিস। অবশ্য ঈশিতা এর সবগুলোই চেনে, জানে। তবু তুই দেখে নে বাবা। এই দুটো চাবি বাইরের কোলাপসিবল গেটে লাগানো দুটো তালার। এর আরও দুটো চাবি তোর ছোড়দির কাছেই আছে। অন্তত সৌমদা মরার আগে অবধি আমাকে আর সুভদ্রাকে সেটাই বলে রেখেছিল। তার একটা ওর ব্যাগে বা অন্য কোথাও, আর অন্যটা তোর ছোড়দির জামাকাপড়ের আলমারির লকারে আছে। তোরা দু’জনে মিলে খুঁজে নিস, কেমন? আর এই দুটো বড় চাবি মেন গেটের দুটো ইয়েল লকের। এদুটো সৌমদার কাছে থাকত। একটা অফিসের ব্যাগে, অন্যটা সৌমদার অফিসের ড্রয়ারে। এই রকম আরও দুটো চাবি আছে। তার একটা তোর ছোড়দির ব্যাগে আছে, আর একটা তোর ছোড়দির বেডরুমের বেডসাইড ড্রয়ারে থাকার কথা। সৌমদাই বলেছিল রাখতে।’’ তার পরেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘‘অবশ্য জানি না, চাবিগুলো সেখানেই রাখা আছে না অন্য কোথাও বা অন্য কারও কাছে আছে। আর এই দুটো চাবির কোনও ডুপ্লিকেট নেই। যেবার বাড়িটা কিনে ফ্ল্যাটটা সিল করেছিল, সেবার মেন গেটে আলাদা করে লাগিয়েছিল। যাতে অন্য তালাগুলোর চাবি হাতবদল হয়ে কারও কাছে গেলেও পরে সে আর ঢুকতে না পারে।’’ কথা থামিয়ে মেজদি-বড়দির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কী কপাল দেখ লোকটার! যাকে ভালবেসে, যার সেফটির কথা ভেবে এতকিছু করেছিল, সে নিজেই ঘরে নিজের ভালবাসার লোক ঢুকিয়ে বিছানায় ফূর্তি করত, ফূর্তি করার কথা ভাবত! আর ওই লোকটা? সব হারিয়ে একা একা ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলল! জানো মেজদি, কুট্টি-মুট্টির দশ বছরের জন্মদিনের দু’দিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। তখন সুভদ্রা চাকরি পেয়ে গেছে। ফলে ভীষণ একা ফিল করত। আমাকে বলেছিল, এবার যদি পারি ঈশিতার কাছে ছেলেমেয়েকে দিয়ে দেব। পরে না হয় নিজের কথা ভাবব। আমার তখনও ডিভোর্স হয়নি, তবে হবে হবে করছে। আমি তখন বলেছিলাম, ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুমিও যাও না বাবা তার কাছে। আর এত অভিমান কেন? জানো, চুপ করে সব শুনেছিল। ওই সুন্দর চেহারাটা ভাঙতে ভাঙতে যেন কঙ্কাল হয়ে গিয়েছিল গত কয়েক মাসে। আমি বুঝে গেছিলাম, সৌমদা এবার চলে যাবে। সুভদ্রাকেও ইঙ্গিতে বলেছিলাম, তৈরি হ। আমি থাকলেও তোকেই দেখতে হবে কুট্টি-মুট্টিকে। এই ক’দিন আগে ওই ঘটনার পরে যেদিন প্রথম ঈশিতার হাত ধরল, সেদিন থরথর করে কাঁপছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আসলে ওর আশা ছিল, ঈশিতা ওকে ভালবাসে। সেটা আবারও মিথ্যে বুঝেই হার্টঅ্যাটাক করে রাস্তায় পড়ে যায়। আজ সকালেও ফিসফিস করে আমাকে বলেছে, ‘আচ্ছা ও খবর পেলে আসবে আমাকে দেখতে? অবশ্য দেখলেও তো চিনতে পারবে না! তার উপর সামনে বিয়ে। যাক ভাল থাকুক’। তার পর আর দুটো কথা শুধু আজ সকাল থেকে বলেছে। আমাকে, সুভদ্রাকে গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ভাল থাকতে বলেছে বারবার। আর ছেলেমেয়েকে বুকের উপর টেনে বলেছে, নিজেরা সৎ থেকো, অন্যের কাছেও সৎ থাকার চেষ্টা কোরো। আর পিসি ও মামনকে দেখো। আর কিছু বলতে পারেনি। ওরা মুখে জল দিল, ব্যাস! দ্যাখো, সুভদ্রা তো কেউ না ওদের। সুভদ্রা ছিল আমার বাড়ির কাজের মেয়ে। ওকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম চিল-শকুনের হাত থেকে বাঁচাতে। সেই সুভদ্রা ওদের চার মাস বয়স থেকে নিজের বুকে টেনে বড় করেছে। ওরা সুভদ্রার বুকে লেপ্টেই বড় হয়েছে। সৌমদাই শিখিয়েছিল, ওকে মামন বলে ডাকতে। অথচ নিজে সুভদ্রাকে কোনওদিন খারাপ ভাবে ছুঁয়েও দেখেনি। সুভদ্রা কতদিন কেঁদেছে এ নিয়ে আমার কাছে। আবার দেখো, সুভদ্রা লেখাপড়া শিখে চাকরি পাওয়ার পরে সৌমদা কী খুশি! বলল, আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। আর একজনের জন্যও চেয়েছিলাম, সে পিঠে ছুরি মেরে দিয়েছে। সুবি মনে হয় তা করবে না। করলেও আর নতুন করে কষ্ট পাব না। সুভদ্রা কিন্তু ছুরি মারেনি সৌমদাকে। বরং মাসে দুবার কলকাতা থেকে বম্বে ছুটত ওদের দেখবে বলে, তাও প্লেনে! ভাবতে পারো? এই একঘন্টা আগে এত বড় বড় দুই ছেলেমেয়েকে চড় মেরে গাল লাল করে দিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। ওরা কিন্তু রাগ করেনি। বরং মামনকে জড়িয়ে পাল্টা কেঁদেছে। একটা কোথাকার অচেনা, আদিবাসী মেয়ে, যার সঙ্গে ওদের রক্তের সম্পর্কও নেই, তার কতটা ভালবাসা, সততা থাকলে এটা করতে পারে? অথচ নিজের মতো আলাদা সংসার করতে পারত না সুভদ্রা? আজও চাইলে ও বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু ও করবে না। কি বলব বলো!’’ কথাগুলো শেষ করে দুহাতে চোখ ঢাকল জয়তী।
এই বার মুখ তুলে জয়তীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঈশিতা। এতক্ষণ ধরে, এতদিন ধরে ও অনেক কথা শুনেছে। কিন্তু সৌমাভ যে ওর কাছে ফিরতে চেয়েছিল, সে কথা তো জয়তী কখনও বলেনি ওকে? প্রশ্নটা করতেই পাল্টা ঝাঁঝিয়ে উঠল জয়তী। বলল, ‘‘প্রথম কয়েকটা বছর তুই যোগাযোগ রাখতিস, আমিও রাখতাম। তোদের বাবা মারা যাওয়ার পরে তোদের মাকে নিয়ে বড়দি নিজের কাছে রাখেন, তোরা বাড়িটা প্রোমোটারকে দিস। বড়দির বাড়িতেই তোদের মা মারা যান। আমি খবর পেয়ে গেছিলাম। সেদিন সৌমদা অনেক টাকার মিষ্টি আর প্রচুর ফুল আমার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল, তোদের বলিনি। তার পরে তোরা নিজেরা দুটো করে ফ্ল্যাট পেয়েছিস, টাকা পেয়েছিস। সেটা অবধি আমাকে বলেছিলি। তার পর তুই শান্তিনিকেতনে চাকরি নিয়ে আসার পর থেকে এই আট-নয় বছরে একটা ফোনও করেছিলি? তার আগের তিন বছরেও একটা ফোনও করিসনি। প্রথম প্রথম শুধু দু’একটা মেসেজ করতিস বিজয়ায় আর ইংরেজি নতুন বছরে। ব্যাস! স্বামী-সন্তানের খবর নেওয়ার দায়িত্ব শেষ? সৌমদা গত আট বছর কলকাতায় চাকরি করেছে, জানতিস? আমাদের অফিস হাজরা থেকে সল্টলেকে সরে গেছে, জানিস? কাকে বলব? তোর ফোন নম্বর যে বদলেছিস, সেটা জানানোর ভদ্রতাও দেখাসনি তুই! আজ আমাকে বলছিস? আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, জানিস? তোর কাছে ফেরার কথা ভেবে সৌমদা এই কয়েক মাস আগে চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল, জানিস? আর তুই? বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার আনন্দে মশগুল থেকেছিস। তোকে বলেছিলাম না, নিজের সংসার-স্বামী-সন্তানকে কোনওদিন তুই ভালই বাসিসনি, ভান করে গেছিস। আবারও সেই কথাই বলছি। তাই ছেলেমেয়ের প্রণাম না হয় বুঝিসনি, ধরে নিলাম, ১৭-১৮ বছরে সে স্পর্শ মনে রাখা কঠিন। ‘মুকুট্টি’ নামটা দেখে কিছু মনে হয়নি? মুট্টি-কুট্টির কথা মনে পড়েনি? মুট্টি প্রথম যে গানটা গেয়েছিল, সেটা আন্দামানে থাকতে একবার তোরা দু’জনে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলি, তোর মনে আছে আজ? তার পরে তোরা যেদিন সবাই আমার ফ্ল্যাটে গেলি সৌমদাকে খোঁজার নাটক করতে, সেদিন আমি এই গানটাই গেয়েছিলাম, তোর মনে আছে? সেদিন তুই কেঁদেছিলি? কই কাল মুট্টির গলায় সৌমদার অবিকল নিজস্ব ভঙ্গিতে গানটা শুনে তো কাঁদিসনি? নাকি মনেই পড়েনি গানটার কথা? বাদ দে! কুট্টি যে গানটা গেয়েছিল, সেটা গাওয়ার আগে দুলাইনে তার সম্পর্কে কিছু বলেছিল। এটা সৌমদা বরাবর করত, বহু গানের ক্ষেত্রে। কুট্টি কথাগুলো বলার সময় তোর কিছু মনে হয়নি? ওই ছবি আর কবিতাটা শুনেও না? ওরা স্টেজ থেকে নেমে আমাকে ফোন করেছিল। কাঁদছিল দামড়া দামড়া ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের ১৮ বছরের জন্মদিন গেছে কয়েক মাস আগে, মনে আছে তোর? মনে নেই জানি, এখন মিথ্যে বলবি যে মনে আছে। ওদের সেদিন সব কথা জানানো হয়েছিল। ওরা সৌমদার সঙ্গেও কথা বলেছিল। অনেক কান্নাকাটি, রাগারাগি, ঝগড়া করেছিল। তার পর থেকে ওরা তোকে দেখবে বলে ছটপট করত। তোদের বাড়ি থেকে দেওয়া দুটো নাম সৌমদা বদলে অরণ্য আর মৃত্তিকা করে দিয়েছিল। আমিও জেনেছি পরে। কিছু বলিনি। কিন্তু ওদের ডাকনাম বদলায়নি সৌমদা। আশা ছিল, একটু আনকমন নাম তো, তাই তুই যদি কোনওদিন অন্তত ডাক নাম শুনেও ওদের চিনতে পারিস। তুই চিনতে পারলে ওরা তোকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, এই আশায় গত একমাস ধরে লেখাপড়া, কলেজ সব চুলোয় দিয়ে এখানে পড়ে থেকেছে। আর তুই? আরও একটা নতুন লোককে বিয়ে করে স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে শোয়ার চিন্তায় মশগুল হয়ে তার দেওয়া হীরের আঙটি পরে গর্ব করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ছিঃ।’’
ঈশিতা জানে ওর কিচ্ছু বলার নেই। একটা কথারও প্রতিবাদের কোনও জায়গাই নেই। জয়তীদি প্রথম দিন থেকে ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ও কি, ও কি রকম! চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার পর হঠাৎ যেন কী মনে পড়েছে, এই রকম করে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। দুই দিদি, দুই জামাইবাবু, ছোট বোন, ছোট বোনের স্বামী— কারও উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে নিজের একটা হাত জয়তীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘‘আমি একটা বেশ্যা। নিজের স্বামী, সন্তানদের ছেড়ে অন্য লোকের বিছানায় শুয়ে বেড়াই। আমি নোংরা মেয়ে। তোমাদের সব কথা মানছি। কিন্তু দেখ, এই আঙটিটা আমি কোন আঙুলে পরেছি? জানি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমার কেমন যেন একটা লাগছিল। কালও খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই আজ সকালে ওরা বেরোতেই গুঞ্জার বরের বাইকে চেপে এখানে এসেছি ওদের পিছনে পিছনে।’’ বলে আঙটিটা খুলে মাথা নিচু করে বসে থাকা গুঞ্জার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘‘নিজের প্রমোশনের জন্য রাহুলের ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে শোশয়াতে চেয়েছিলি তো? আমি বেশ্যা, যা বলবি করব। তুই বললে, ওই বিছানাতেই আবার রাহুলের সঙ্গেও শোব। কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে বলিস না, কেমন? জানিস না, বেশ্যাদের বিয়ে করতে নেই, সংসার থাকতে নেই! তুই কি রে? এই আঙটিটা তুই রেখে দে, তোর কাজে লাগতে পারে।’’ বলে নিচু হয়ে গুঞ্জার সামনে পড়ে থাকা জয়তীর দেওয়া চাবির গোছাটা তুলে নিল সযত্নে। তার পরে জয়তীর দিকে হাতজোড় করে বলল, ‘‘জানি আমি বেশ্যা, তাও একবার তোমায় অনুরোধ করছি, আমি কি শেষবারের মতো ওকে একটু ছুঁতে পারি? ও বলেছিল, জীবিত অবস্থায় যাতে আমি ছুঁতে না পারি। তার পরে নিজেই ছুঁয়েছিল, কিন্তু আমার মতো নোংরা মেয়ে, হাজার লোকের সঙ্গে শোয়া বেশ্যা তো, তাই ওর ছোঁয়া টের পাইনি গো! বলো না, প্লিজ, একটু ছোঁব ওকে?’’
ঈশিতার ধড়মড় করে উঠে বসা থেকে পরপর সব কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল জয়তী এবং বাকিরা। জয়তী বুঝতে পারল, ঈশিতা উল্টোপাল্টা বকছে, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে খুব আস্তে আস্তে। ও দ্রুত সামনে গিয়ে ঈশিতার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে মধ্যে জোর করে টেনে নিয়ে কান্না আর মমতা মাখানো একটা গলায় বলল, ‘‘কেন তুই নিজেকে সবার কাছে ছোট করছিস এ ভাবে? তুই সৌমাভদার বিয়ে করা স্ত্রী। তুই কুট্টি-মুট্টির মা। ভুল করেছিলি, তার শাস্তিও পেয়েছিস। কিন্তু আজ যে কথাগুলো বলছিস, সেটা সৌমাভদার থেকেও বেশি তোর নিজের ছেলেমেয়ের জন্য কষ্টের, খারাপ, অপমানের। মা হয়ে এটা বোঝ! তোকে বকেছি মানে এই নয়, তুই যা খুশি ভেবে নিবি নিজেকে।’’ বলে হুহু করে কেঁদে ফেলল এতক্ষণ ধরে শক্ত থাকা জয়তী। আর ওর বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল ঈশিতা।
সেই যে জয়তীর কথায় সুভদ্রা ও কুট্টি-মুট্টি ঘরে ঢুকেছিল, তার পর থেকে তাদের দেখা যায়নি। ঈশিতা জ্ঞান হারিয়েছে বুঝেই ওর বড়দি ও মেজদিকে ডেকে জয়তী বলল, ‘‘তোমরা একটু ধরে ওকে শুইয়ে দাও। চোখেমুখে জল দাও।’’ বলেই সুবি সুবি বলে ডাকল। ওর ডাক শুনে সুভদ্রা ও মুট্টি প্রায় একসঙ্গেই বাইরে এল। ও ইশারায় কাছে আসতে বলল। সুভদ্রা আসতেই ও কানে কানে কিছু একটা বলল। তার পর মুট্টিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই ঘরটায় ঢুকল, যেখানে এখনও শুয়ে সৌমাভ, তবে মৃত।
ঈশিতার জ্ঞান ফিরতে দেখল, কার একটা কোলের মধ্যে ওর মাথাটা রাখা। চুলগুলো ভিজে, গায়ের কাপড়টাও কিছুটা ভিজে ভিজে। মুখটা তুলে দেখল, একটা অচেনা মেয়ে। প্রায় ওরই বয়সী। গায়ের রঙটা তত ফর্সা নয়, তবে চোখমুখ খুব শার্প। মুখটা ভারী মিষ্টি, তবে চোখের কোনে এখনও জল। মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর ঘুরেঘুরে দেখাটা শেষ হতেই একটু হেসে বলল, ‘‘আমাকে দেখা শেষ হলে এবার ওঠ। ও ঘরে যেতে হবে। তোমার অনেক কাজ।’’ কথাটা শুনে একটু চমকে গেল ঈশিতা। কি নরম গলা মেয়েটার? এই তাহলে সুভদ্রা? কুট্টি-মুট্টিকে মায়ের যত্ন নিয়ে সেই চার মাস বয়স থেকে এত বড় করেছে একার হাতে? ও নিজে জানে, সৌমাভর স্ত্রী হিসেবে তো বটেই, দুটো ছেলেমেয়ের শুধু জন্ম দেওয়া ছাড়া মায়ের কোনও দায়িত্বও ও পালন করেনি। উল্টে শেষদিন বেওয়ারিশের মতো ওদের বাইরের কটে রেখে ঘরে...। ওর মাথায় বারবার সেদিনের ছবিটা ঘুরে আসে আর বোঝে কী করেছিল সেদিন ও! কিন্তু ওকে কোথায় যেতে হবে? কী কাজ? মেয়েটা যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেলল। ওর মাথাটা কোল থেকে তুলে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত ধরে টেনে তুলল। তার পরে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে ঢুকল সেই ঘরটায়, যে ঘরটা থেকে ঘন্টা দেড়েক আগেই ভেসে এসেছিল সৌমাভর মৃত্যুর খবর আর কান্না।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)