Thread Rating:
  • 36 Vote(s) - 2.97 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica তার ছিঁড়ে গেছে কবে
(৪০)

ধরা যে সে দেয় নাই


ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল ঈশিতার। কাল বিকেল থেকে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেন ওর। রাতে ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি। কেন এমন হচ্ছে, ও বুঝতে পারছে না। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে বারবার ঘুরেফিরে বিকেলবেলার অনুষ্ঠান, ছবি, গান এমন নানা হাবিজাবি ছবি মাথায় ঘুরেছে। সকালে ঘুম ভেঙে বিছানায় বসে বসেই শুনতে পেল একটা মিষ্টি গলা গুনগুন করে কী যেন গাইছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল, দোতলা থেকে গানটা ভেসে আসছে। তাহলে কি ওই মেয়েটা গাইছে, কী যেন নাম? মৃত্তিকা। বাবাহ! নামেরও বলিহারি। ও জানে গানটা— ‘অধরং মধুরং, বদনং মধুরং, নয়নং মধুরং, হসিতং মধুরং....। সকালেই গানটা শুনে ওর মনটা যেন ভাল হয়ে গেল।

ও ফ্রেস হয়ে আসতে আসতেই গুঞ্জা ওর বরের বাইকে চলে এল। এখন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা ডকে, সেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পরে আবার শুরু হবে। ততদিন মেলার আমেজ। এই সময়গুলোয় ও সকালেই দিদির কাছে চলে আসে। ইদানিং একটু বেশি আসছে। মেয়েকে নিয়ে কাজের দিদি আসবে একটু পরে। এর মধ্যে মৃত্তিকা নামের মেয়েটি নেমে এল। গায়ে এখনও কাল রাতের সেই টি-শার্ট আর স্কার্ট। নীচে এসে খুব কুন্ঠিত ভাবে ঈশিতাকে বলল, আমার ফোনটায় কাল চার্জ দেওয়া হয়নি, এখন দেখছি ফোনটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার এখানে একটু চার্জে বসাব? ঈশিতা ওর কুন্ঠিত ভাব দেখে হেসে বলল, ‘‘এত কিন্তু কিন্তু কোরো না। ফ্রেস হয়ে এসো, জলখাবার খাব একসঙ্গে। তুমি লুচি খাও তো সকালে?’’ এর মধ্যে মেয়েটি ফোন চার্জে বসাতেই সেটা চালু হল দেখে ও হেসে বলল, ‘‘আমার কিন্তু একটু সময় লাগবে, প্লিজ এক্সকিউজ মি’’, বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।

ঈশিতা সবাইকার জন্য চা করে গুঞ্জা আর ওর বরের হাতে দিয়ে বসল। তার পর মেয়েটির নামধাম বলল। গুঞ্জা কিছু বলল না। কী বলার আছে। এর মধ্যেই মেয়েটির ফোন বেজে উঠল। গুঞ্জার বর উঠে গিয়ে দেখে এসে বলল, ‘‘কে একটা গার্ডি বলে কেউ ফোন করেছে! কী সব নাম এখন! গার্ডি? বিদেশি কিনা কে জানে?’’ ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। মিনিট চারেক পরে আবার ফোন। এবারে গুঞ্জা উঠে দেখল, সেই গার্ডি বলে নামটা। ও এসে চেয়ারে বসল। তিন-চার মিনিট পরে মিনিট পরে আবার ফোন। এবারে গুঞ্জা উঠে দেখল দাদাই লেখা একটা নাম। সেটা বলতেই ঈশিতা বলল, কাল ওই ছেলেটা নাকি ওর দাদা। সে হয়তো বোনের খবর নিতে ফোন করেছে। ওদের কথার মধ্যে বেশ কয়েকবার কখনও গার্ডি, কখনও দাদাইয়ের ফোন এল মৃত্তিকার ফোনে। এর মধ্যে গুঞ্জার কাজের দিদি এসে গেছে। গুঞ্জার বাচ্চাটাকে তার বাবার কোলে দিয়ে তিনি রান্নাঘরে ডুকলেন ময়দা মাখতে। তাঁর পিছন পিছনই ঈশিতার কাজের মহিলাও এসে গেলে ঈশিতা তাঁকে বলল, আগে উপরের ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে দিতে। মিনিট দশেক পরে মৃত্তিকা একেবারে স্নান করে নীচে নামল। গায়ে সেই পোশাকই। ও এসে সবাইকে একগাল হেসে মিষ্টি করে ‘গুডমর্নিং’ বলতেই গুঞ্জা তড়বড় করে ওকে থামিয়ে বলে উঠল, ‘‘তোমার অনেকগুলো ফোন এসেছিল। কে একজন গার্ডি, তার পর দাদাই বেশ কয়েকবার কল করেছে। তুমি বরং একবার ফোন করো।’’ মেয়েটার মুখটা হঠাৎ যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল! ও চার্জ থেকে ফোন খুলে বাইরে গিয়ে ফোনটা কানে দিল। তার একটু পরেই, ‘ও মাই গড’ বলে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে সোজা উপরে চলে গেল!

কী হল! ঈশিতা তো বটেই গুঞ্জা এবং ওর বরও অবাক হয়ে গেল। গুঞ্জা দৌড়ে দোতলায় মেয়েটার ঘরের দিকে গেল। একটু পরে ঈশিতা দেখল মেয়েটা গত কালের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গত কালের মতোই পাঞ্জাবি আর জিনস চাপিয়ে তরতর করে নীচে নামছে। নীচে এসেই খুব অসহায় গলায় ঈশিতাকে বলল, ‘‘দাদাই বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না, একটু বলে দেবেন লোকেশনটা? ও আমাকে নিতে আসছে, খুব জরুরি দরকার।’’ ঈশিতার বদলে গুঞ্জার বর ফোনটা কানে নিয়ে বাইরে গেল, পিছনে মৃত্তিকা নামের মেয়েটিও। একটু পরে গুঞ্জার বর ঘরে এসে বলল, ‘‘এসে যাবে, দুতিন মিনিটের মধ্যে। মেয়েটি বাইরেই দাঁডিয়ে আছে। বললাম, তাও এল না। খুব ছটপট করছে। কী হল কে জানে রে বাবা।’’ এর মধ্যে ঈশিতার কাজের মহিলা নীচে এসে বকবক করতে শুরু করল। মেয়েটা নাকি খুব বেহায়া। দৌড়ে ঘরে ঢুকে সব খুলে কোনও রকমে প্যান্টটা পরেই টিশার্ট খুলে উদোম গায়ে ব্রা পরছিল। তখন ও দেখেছে কী সুন্দর চামড়া! পিঠের ঠিক মাঝখানে একটা তিলও আছে, তাতে যেন আরও সুন্দর লাগছে। এই বকবকানির মধ্যেই বাইরে ভটভট করে একটা বাইক এসে থামল। ঈশিতা দেখল, গত কালের সেই ছেলেটা। উস্কোকুস্কো চুল, পিঠে একটা ব্যাগ। বাইকের মুখটা ঘোরাতে ঘোরাতে ওর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল ছেলেটা। সেই হাসিটা গুঞ্জারও চোখে পড়ল। এর মধ্যেই মৃত্তিকা বলে মেয়েটা প্রায় লাফিয়ে বাইকে উঠে ছেলেটির মতো করেই একটু মুচকি হেসে টাটা করল ওদের। বাইক স্টার্ট নিল

বাইকটা চোখের আড়াল হতেই ঈশিতার মনের মধ্যে গত কাল থেকে চলা অস্বস্তিটা বহুগুণ বেড়ে গেল যেন। কাজের দিদির বলা মেয়েটার পিঠের মাঝখানে তিল, ছেলেমেয়ে দুটোর হাসি— কী যেন হয়ে গেল ওর। ঘরে পরা শাড়িটাই ঠিক করতে করতে গুঞ্জার বরকে বলল, ‘‘এক্ষুনি তোমার বাইক স্টার্ট করো, ওদের ধরতেই হবে।’’ গুঞ্জার বর ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিজের বাইকে উঠে বসল। ঈশিতাকে অবাক করে গুঞ্জাও চড়ল, তার পিছনে কোনও রকমে নিজেকে সেট করে ঈশিতা প্রায় ধমকের গলায় বলল, ‘‘দেরি কোরো না, ওদের দেখ ধরতে পারো কি না। যত জোরে পারবে চালাও।’’ গুঞ্জা দিদির আচরণে অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘‘তোর হঠাৎ আবার কী হল? কী করেছে ওরা?’’ ঈশিতা ওর সঙ্গে একটাও কথা না বলে ওর বরকে ধমকে বলল, ‘‘আরে তাড়াতাড়ি চলো!’’ গুঞ্জার বর বাইকে স্পিড বাড়াল।

রতনপল্লী ছাড়িয়ে মিনিটখানেক এগোতেই চোখে পড়ল, ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে সেই বাইকটা। যেন উড়ে যাচ্ছে। ও গুঞ্জার বরের পিঠে টোকা মেরে বাইকটা দেখাল। ওর ভিতরে কেমন একটা অস্থির ভাব। কী একটা যেন চোখের সামনে অথচ ও ধরতেই পারছে না। গুঞ্জার বর যতটা সম্ভব দ্রুত চালালেও ওই বাইকটাকে ধরতে পারছে না। ঈশিতা ছটপট করে যাচ্ছে সমানে। এর মধ্যে ওর হাতের ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখল, মেজদির ফোন। ও জানে মেজদি ফোন করলে বকবক করেই যাবে। ও তবু ফোনটা ধরে শুধু বলল, ‘‘পরে তোকে ফোন করছি।’’ বলেই কেটে দিয়ে সাউন্ড অফ করে দিল। ও জানে, মেজদি আবার ফোন করবে।

এর মধ্যে ওরা রজতপুর বলে একটা জায়গা ক্রস করল। এ দিকে কখনও আসেনি ঈশিতা। তবে গুঞ্জার বর এদিকগুলো বেশ চেনে। গাড়িতে স্পিড আরও বাড়াতে বাড়াতেই ও বলল, ‘‘সামনেই অজয়ের ব্রিজ। তার পরেই বর্ধমান। কোথায় যাচ্ছে এরা? এই দিক দিয়ে কলকাতায় ফেরে নাকি কেউ?’’ একটা কথাও কানে যাচ্ছে না ঈশিতার। শীতে শীর্ণ অজয়ের ব্রিজ টপকানোর সময় দুটো গাড়ির মধ্যে দূরত্ব একটু কমলেও ব্রিজ থেকে নামতেই ফের গতি বাড়াল সামনের বাইকটা। বোঝাই যাচ্ছে, ওরা এই রাস্তা দারুণ ভাল চেনে। তা হলে কাল যে বলল, ওরা নাকি কলকাতায় নিউটাউনে থাকে? কিচ্ছু মাথায় আসছে না ঈশিতার। গুঞ্জার অবস্থা ওর থেকেও খারাপ। ও শুধু ভাবছে, দিদির কী হল হঠাৎ। সামনে বিয়ে, এখন এই পাগলামি!

এর মধ্যে আরও কিছুটা পথ পেরিয়ে ওদের সামনে দিয়ে বাইকটা একটা সরু মাটির রাস্তা ধরল। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা বলে দুটো বাইকেরই গতি কমে গেল। তার মধ্যেই ওরা দেখল বাইকটা আরও একটা সরু মাটির রাস্তা দিয়ে ঢালু পথে নেমে কিছুটা দূরে একটা বড় বড় গাছে ঘেরা জায়গায় ঢুকে পড়ল। গুঞ্জার বরও কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেল। প্রথমে বাইকটা না দেখতে পেলেও একটু এগোতেই চোখে পড়ল সেটা। ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় কে জানে!

ঈশিতা বাইক থেকে নেমে ধীর পায়ে একটা কঞ্চির বেড়ার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। পিছনে গুঞ্জাও। এর মধ্যেই গুঞ্জার বরের ফোনটা বেজে উঠল। ও ফোনটা কানে নিয়ে দু’একটা কথা বলেই যেদিক থেকে ওরা এই জায়গাটায় ঢুকেছিল, সেদিকে এগিয়ে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে গেল কোথায় যেন। ঈশিতারা ভিতরে ঢুকে একটু দূরে একটা ছোট মাটির বাড়ি, চারদিকে শুধু বড় বড় গাছ। একটা ছোট পুকুর। অসাধারণ পরিবেশ। কিন্তু এখানে কেন এল ওরা? ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে দেখল একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা। সামনে আবার মাটির টেবিলের মতো করা। একদম বসার জায়গাই এটা। বাইকের পিছনে কোনওরকমে পাছা ঠেকিয়ে এতখানি পথ এসে ক্লান্ত লাগছিল ঈশিতার। ও সেখানেই বসে পড়ল। চারদিক কী নিস্তব্ধ! খুব মন ভাল করা একটা পরিবেশ। তার মধ্যেই কাদের বাড়ি থেকে যেন মাছভাজার সুন্দর গন্ধ আসছে। ততক্ষণে গুঞ্জাও এসে পড়েছে। দু’জনে মিলে ওখানে কিছুক্ষণ জিরোল। তার পর জায়গাটা ঘুরে দেখবে বলে উঠতে যাচ্ছে, দেখল একজন মহিলা গ্রাম্যরীতিতে মাথায় অনেকটা ঘোমটা, হাতে একটা চুবড়ি ঢাকা বড় থালায় করে কী যেন নিয়ে আসছে ওদের দিকে। তার পিছনে একটি ছোট মেয়ের হাতে আবার একটা কেটলি এবং একটা জলের বোতলও! ওদের কাছে এসে মহিলা চুবড়িটা তুলতেই দেখল, থালায় অনেকগুলো রুই বা কাতলা জাতীয় মাছ ভাজা আর কয়েকটা সন্দেশ। আর একটা বড় বাটি ভর্তি মুড়ি। এত খাবার দেখে ওরা চমকে গেল! তার পরেই মনে পড়ল, সকালে জলখাবার না খেয়েই উদভ্রান্তের মতো বেড়িয়ে এসেছে সকলে। খিদে পেয়েছে অনেকক্ষণই, কিন্তু কী একটা উত্তেজনায় খিদের ভাবটাই চলে গিয়েছিল সবার। এখন সামনে খাবার দেখে খিদেটা মাথাচাড়া দিল সবারই। ওদের একেবারে সামনে এসে মহিলাটি বললেন, ‘‘আমনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, এটুকখানি খেয়ে নেন।’’ বলেই পিছন ফিরে ছেলেটার থেকে জলের বোতল নিয়ে গুঞ্জার বরের হাতে দিল। ঈশিতা মৃদু গলায় মহিলাটিকে বলল, ‘‘আপনি আমাদের জন্য খাবার আনলেন কেন? কেউ বলেছে?’’ মহিলা মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘আমনারা ওই ইস্কুটারটার পিছনে এলেন না, তখনই দেখেছি। তার পরেই ভাবলাম, ঘরে অতিথ এসেছে, কিছু দিই। আর কিছু ছিল না গো।’’ ওরা কথা বাড়াল না। ঠিক করল, খেয়ে নিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর সম্পর্কে জানতে চাইবে। মহিলা কিছু তো বলতে পারবে নিশ্চয়ই। এই সব ভাবতে ভাবতে ওরা খাওয়া শুরু করল। অদ্ভুত খাবার— মুড়ি আর মাছভাজা। খিদের মুখে তাই অমৃত। ওরা খেতে শুরু করেছে দেখে মহিলা একটু হেসে কেটলিটা নামিয়ে কয়েকটা স্টিলের গ্লাসও পাশে বসিয়ে দিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘‘এতে চা আছে। যদি খান আমনারা, তাই নিয়ে এসেচি।’’ এর পরে আবার চা? ওরা যেন হাতে চাঁদ পেল। প্রায় গোগ্রাসে সব ভুলে খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষে স্টিলের গ্লাসে চা ঢেলে নিতেই মহিলা সব বাসন তুলে চলে গেলেন।

ঈশিতা আর গুঞ্জা চা খেতে খেতে পায়ে পায়ে বাড়িটার দিকে এগোল। ওদের কানে এল, এক মহিলা প্রায় চিৎকার করে কিছু বলছে কাউকে। যেন বকছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, তবে দূরের ওই বাড়িটা থেকে চিৎকারটা আসছে, এটা ঠিক। ওরা কী করবে বুঝতে না পেরে দূরের বড় বড় গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে চা শেষ, তাই সেটা ওই বসার জায়গায় রেখে ফিরতে ফিরতে দেখল, মৃত্তিকার সেই দাদাটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা বুঝল, মৃত্তিকাও তার মানে এখানেই এসেছে। কিন্তু এটা কি ওদের কোনও আত্মীয়ের বাড়ি? এই সব ভাবতে ভাবতেই ছেলেটা ওদের সামনে এল। মুখটা কেমন যেন শুকনো। তবু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘‘বুড়িদিদি আপনাদের খেতে দিয়েছে?’’ ওরা বুঝল, তা হলে ওই মহিলাই হয়তো বুড়িদিদি। ওরা মাথা নাড়ল। ছেলেটি বলল, ‘‘আপনারা জায়গাটা ঘুরে দেখুন, আমি আসছি একটু।’’ বলে আবার বাড়িটার দিকে গেল। একটু পরে মৃত্তিকা বেরিয়ে এল। ওকে দেখে চমকে গেল ঈশিতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এতক্ষণ কাঁদছিল মেয়েটা। ও এগিয়ে গেল। মেয়েটা চোখ মুছে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘‘আসলে বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে হঠাৎ, তাই ও ভাবে চলে এসেছি। আপনারা আসুন।’’ বলে একটু জোরে হেঁটে কয়েকটা বড় বড় গাছ পেরিয়ে বাড়িটার দাওয়ায় উঠল। ওদের বাইরে মোড়া পেতে বসিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেল।

কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। ভিতর থেকে এক মহিলার গোঙ্গানি মেশানো কান্নার আওয়াজ আসছে যেন। আর একটা মহিলা কন্ঠ খুব আস্তে আস্তে কিছু বলছে। বাইরে দাওয়ায় বসে একটা কথাও বোঝা যাচ্ছে না। ওদের অস্বস্তিটা বাড়ল। ওরা উঠে নিঃশব্দে দাওয়া থেকে নেমে একটু দূরে একটা বড় গাছের নীচে বসল। এমনিই শীতকাল, তার উপরে গাছের ছায়ায় চারদিক ঢাকা। বেশ শীতশীত করছে। এমন সময় একটা তারস্বর চিৎকারে ওরা চমকে উঠল, ‘‘নিজের মাকে দেখবি বলে পাঁচ দিন ধরে ওখানে পড়ে রইলি? চিনল তোদের? হুঁ! এদিকে বাবা যে হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালের মেঝেয় পড়েছিল, সে খবরটাও পাসনি! মরণ আমার। মাকে দেখতে গিয়ে বাবাটাকে শেষ করে এলি শয়তানগুলো!’’ বলেই ঠাস ঠাস করে পরপর কয়েকটা চড় মারার আওয়াজ। ওরা হতভম্ব হয়ে গেল! এ কী রে বাবা! ছেলেমেয়েদুটো ওদের মাকে খুঁজতে গেছিল মানে? এই সব ভাবতে ভাবতেই দুই ভাইবোন এসে বাইরে দাওয়ায় ওদের দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে যেখানে ওরা বসেছিল, সেদিকে এগিয়ে গেল। কাছে আসতেই দেখল, দু’জনের গালে হাতের ছাপ পড়ে গেছে, এত জোরে চড় খেয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করার আগেই গেটে একটা বাইক থামার আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, গুঞ্জার বরের পিছনে আরও দুটো বাইক থেকে নামছে গুঞ্জাদের বড়দি, মেজদি আর তাদের দুই বর। ওরা চমকে গেল! এমনকি ছেলেমেয়েদুটোও। ঈশিতার মনে পড়ল, সকালে এখানে আসার পথে মেজদি ফোন করেছিল বটে, কিন্তু কি এমন হল যে এই অবধি ধেয়ে আসতে গেল? ও প্রশ্নটা করার আগেই সেই বাড়িটা থেকে একটা প্রাণফাটানো চিৎকার এল, ‘‘কুট্টি-মুট্টি শিগগির আয়।’’ চিৎকারটা শুনেই দুই ছেলেমেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড়ল।

আর তখনই ঈশিতার এতক্ষণের অন্ধকারটা পুরোপুরি কেটে গেল! গত কাল বিকেল থেকে ঘিরে থাকা অস্বস্তিটা ওর নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেল। এই ছেলেমেয়ে দুটোর নাম কুট্টি-মুট্টি? তার মানে কি ওরা ওর নিজের ছেলেমেয়ে? ওর কুকীর্তি সহ্য করতে না পেরে যাদের নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সৌমাভ? ও কিছু না ভাবতে পারছিল না। অন্যমনস্ক ভাবেই বাড়িটার দিকে দৌড়ল। পিছনে গুঞ্জা এবং বাকি সবাই। দাওয়ায় উঠতে উঠতেই শুনল ভিতর থেকে এক মহিলার বুকফাটা আর্তনাদ, ‘‘ওগো, কিছু বল। দেখো, তোমার ছেলেমেয়েরা এসেছে। কিগো!’’ সঙ্গে দুই ছেলেমেয়ের কান্নাজড়ানো আর্তনাদ, ‘‘বাবা, কিছু বলবে? বলো না? এই তো আমরা। জল? ও পিসি, শিগগির এসো।’’ তার পরেই একটু স্তব্ধতা এবং এবার চিৎকার করে একসঙ্গে অনেকগুলো গলা কেঁদে উঠল। ছেলেটা বলে উঠল, ‘‘ও বাবা কথা বলছো না কেন? বাবা প্লিজ, এই ভাবে চলে যেও না। প্লিজ।’’ আর কথা বলতে পারল না, ডুকড়ে কেঁদে উঠল ছেলেটা। মেয়েটাও হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। সেই সঙ্গে এক অদেখা মহিলার বুকভাঙা কান্নার আওয়াজ গোটা চত্বরটা যেন কাঁপিয়ে দিল, ‘‘চলে গেল রে! ধরে রাখতে পারলাম না। তোদের বাবা চলে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না! কেন তুমি এমন করলে আমাদের সঙ্গে? আমরা তোমার কেউ নই? সব তোমার বউ?’’
Like Reply


Messages In This Thread
RE: তার ছিঁড়ে গেছে কবে - by Choton - 09-05-2025, 04:09 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)