09-05-2025, 04:05 AM
(৩৮)
এ বছর শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব একেবারে জলে গেছে। কলকাতা থেকে আসা বড়লোক বাবু-বিবি এবং তাদের নেকা ও বখাটে মেয়েবাজ ছেলেদের নানা হইচই, গোলমাল মদ খাওয়া নিয়ে মারামারি, মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি— গত কয়েক বছরে বহু গুণ বেড়েছে। তাতে উৎসবের নিজস্বতা হারিয়েছে পুরোপুরি। এ বার সে সব সীমাও ছাড়িয়ে যাওয়ায় একাধিক অনুষ্ঠান পন্ড করতে হয়েছে, বেশ কিছু অনুষ্ঠান নানা ভবনের নিজস্ব ঘরে হয়েছে। তাই পৌষমেলা নিয়ে আগে থেকে সতর্ক সবাই। ঈশিতার উপরে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মেলাপ্রাঙ্গনে একটা বড় জায়গা চাঁদোয়া দিয়ে ঢেকে মঞ্চ বেঁধে সেখানে কিছু নাচ-গান ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা হবে বলে ঠিক হয়েছে, সেটা ওকেই পরিচালনা করতে হবে। আলতু-ফালতু লোক যেন ঢুকতে না পারে, সেদিকে যতটা সম্ভব নজর রাখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টা নিয়ে স্থানীয় থানা, এমএলএ সবার সঙ্গেই কথা বলেছেন।
ঈশিতার বয়স মেঘে মেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে। গুঞ্জার মেয়ের বয়সই হতে চলল সাত। এইবার গুঞ্জা পড়ল ছোড়দির বিয়ে নিয়ে। ও একজনের খোঁজ আনল। তিনি পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তা ছাড়া অন্যান্য নানা ব্যবসাও আছে। বিপুল টাকার মালিক। একাধিক কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল টাকা দেওয়া এবং কেন্দ্রের শাসক দলকে বিপুল টাকা দিয়ে এখন উচ্চশিক্ষায় একজন কর্তাও বটে। বাঙালি না হলেও বহু বছর বাংলায় থেকে অনেকের চেয়ে ভাল বাংলা বলেন। তাঁকেই মন ধরল গুঞ্জার। এমনিই ১৭ বছর কেটে গেছে, আট বছর আগে বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরে শেষবার সৌমাভর চিঠি পেয়েছিল ও। ফলে সে যে আর ফিরবে না, ও বুঝে গেছে। তাই দিদির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশ্য ওর একটা বড় স্বার্থও আছে। এই লোকটিকে ধরলে ডিপার্টমেন্টে নিজের অবস্থান পাকা করতে ওর সুবিধা হবে। চাইকি কয়েক বছর পরে হেডডিপ পদটাও পেয়ে যাতে পারে। সব দিক ভেবে বহু বছর ধরে ঈশিতাকে ঘৃণা করা গুঞ্জা এ বারে ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল! ঈশিতা প্রথমে ভাগিয়ে দিলেও পরে গুঞ্জার কথা নিমরাজি হয়ে মেনে নিল। তা ছাড়া ওরও মেঘেমেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে ক’দিন আগে। ও জানাল, পুজোর পরে এ নিয়ে কথা হবে। এমনিই তখন গানের ক্লাস কয়েক দিন বন্ধ থাকবে, ফলে তখন কথা বলে দেখা যাবে।
ভাইফোঁটার পরের দিন সেই লোকটিকে নিয়ে ঈশিতার বাড়িতে এল গুঞ্জা ও তার বর। সঙ্গে ওর মেয়ে এবং ওদের সর্বক্ষণের কাজের বউটি। লোকটির বয়স প্রায় ৪০। নাম শুভম। দেখতে শুনতে মন্দ না। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন ক্যান্সারে। সন্তানাদি নেই। লোকটির শুধু একটিই বদঅভ্যাস, গুটখা আর পানমশলার নেশা প্রচন্ড। ছেলের নেশার বহর দেখে ঈশিতার কানেকানে গুঞ্জা বলল, ‘‘বিয়ের পরে তুই ছাড়িয়ে দিস এ সব নেশা। এগুলো ভাল না রে।’’ শুভম জানাল, গড়িয়ায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উত্তর কলকাতায় একটা একটা বড় বাড়ি খুঁজছে, সেখানেই বিয়ের পরে ঈশিতাকে নিয়ে উঠবে। ঈশিতা চাইলে যাদবপুরে ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিতে পারে। ও ব্যবস্থা করে দেবে। বড়দি এবং মেজদিও এসেছিলেন দু’জনের স্বামী-সন্তান নিয়ে। গুঞ্জার আগ্রহ দেখে কেউই কিছু বললেন না, মুখে বললেন, ভালই। ঈশিতা কিছুই বলল না। শুভমকে ভাল করে লক্ষ্যও করল না। ওর যেন কেমন লাগছে এই পুরো ব্যাপারটা। ও কড়া ভাবেই জানিয়ে দিল, পৌষমেলা অবধি ও কিছু করতে পারবে না, বিয়ে তো নয়ই। তার পরে গুঞ্জার বিস্তর অনুরোধ-আব্দারে ঠিক হল, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা কথা হবে। সব ঠিক থাকলে অঘ্রানের শেষ দিকে আঙটি বদলটা করে নেবে দু’জনে। জানুয়ারিতে বিশ্বভারতীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় মেজদির কাছে চলে যাবে ঈশিতা। এই বাড়িটা গুঞ্জাকে দিয়ে দেবে।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা দেখা হল। গুঞ্জাই কর্ত্রী হয়ে বিরাজ করল। ডিসেম্বরে আঙটি বদলও হল গুঞ্জা এবং ওর বরের উপস্থিতিতেই। কারণ দুই দিদি বা তাঁদের পরিবারের কেউ আসতে পারলেন না নানা কারণে। তবে এ সবে একদমই মন ছিল না ঈশিতার। ওর মন পড়ে অনুষ্ঠানের দিকে। ও ঠিক করে নিয়েছে, শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে এমন অনুষ্ঠান করবে, যার সুখ্যাতি বহু দিন ধরে করতে বাধ্য হবে সবাই।
পৌষমেলা শুরুর ঠিক তিনদিন আগে ‘মুকুট্টি’ বলে একটা ছোট গ্রুপের চিঠি এল ঈশিতার ডেস্কে। তারা অনুষ্ঠান করতে চায় বলে অনেক অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের দাবি, এমন অনুষ্ঠান করবে, লোকে চমকে যাবে। কথা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে কিছু করবে না, বড়জোড় একটা কি দুটো কবিতা বলতে পারে। তাও বাংলা কবিতা। তবে সেটা রবীন্দ্রনাথের নাও হতে পারে। সবই চিঠিতে লেখা। ও কী করবে, সেটা নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। এমনিই অনেক নামকরা লোক আসবেন, তার মধ্যে গ্রুপটার নাম কেমন যেন, তামিল ঘেঁষা! কী করবে ভেবে কূল পেল না। এমনিই নিয়মের কড়াকড়ি দেখে বেশ কয়েকটা কলকাতার দল জানিয়ে দিয়েছে, তারা ওই মঞ্চে অনুষ্ঠান করবে না। ফলে সময় ভরাটের জন্য এদের নেবে কি না, নিলে মুখ পুড়বে কি না, এ সব নিয়ে চিন্তায় ওর মাথা পাগল দশা তখন। তার মধ্যেই মোবাইলে ফোন করে গুঞ্জা জানাল, শুভম এই ক’দিন থাকবে বলে এসেছে। তবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় যাবে, আবার ঈশিতা রেজিগনেশন দিলে শান্তিনিকেতনে একেবারে গাড়ি নিয়ে এসে মালপত্র সব তুলে ওকে মেজদির বাড়ি পৌঁছে দেবে। জানুয়ারির মাঝামাঝি কোনও একটা শুভ দিন দেখে রেজিস্ট্রি হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে কেউই করতে রাজি নয় এই বয়সে। সেদিন তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হওয়ায় বেড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রিক্সায় উঠতে যাবে, হঠাৎ দুটো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এসে ওকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসল। দেখে মনে হল বছর কুড়ি-বাইশ হবে দু’জনের বয়স। ও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনারা কারা? কী ব্যাপার? আমি চিনতে পারছি না।’’ জিনস-পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি বলল, ‘‘ম্যাম, আমরাই মুকুট্টি থেকে চিঠি দিয়েছিলাম। প্যাডে আমাদের দু’জনেরই মোবাইল নম্বর আছে। যদি দেখেন, কথা দিতে পারি, ডোবাব না।’’ ঈশিতা ওদের মুখে স্পষ্ট বাংলা এবং অত্যন্ত মার্জিত ব্যবহারে খুশি হল। বলল, ‘‘কাল সকালে ফোনে জানিয়ে দেব। দেখি, আপনারা কেমন পারফর্ম করেন।’’ বলে রিক্সায় উঠে কিছু দূর যেতেই দেখল শুভম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। দু’জনে মিলে একটা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ কথা বলে শুভম নিজের হোটেলে চলে গেল। ওখানেই ওর তিন বন্ধুও এসে উঠেছে।
এমনিই পৌষমেলা উপলক্ষে শান্তিনিকেতন জুড়ে যেন ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ দশা। সঙ্গে গাড়ি-বাইকের উৎপাত। একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে প্রায় গাড়ি চাপা পড়ছিল ঈশিতা। ভাগ্যিস এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওর হাত ধরে টেনে সময় মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন, না হলে আজ ওখানেই গাড়ি চাপা পড়ত ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ‘আইআরসি’ ম্যাডাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে কী হত ভেবে কেঁপে উঠল ঈশিতা। ওই বয়স্ক ভদ্রলোকই ওকে হাত ধরে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে দিলেন। সেখানে চেয়ে এক বোতল জলও এনে দিলেন। জল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করল ঈশিতা। এর মধ্যে ওর কয়েক জন সহকর্মী খবরটা পেয়ে দৌড়ে এসে বিষয়টা বুঝে ওকে তড়িঘড়ি রিক্সা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। রাতে গুঞ্জা এসে এ নিয়ে বকাবকি করার পাশাপাশি একটু মশকরাও করে নিল। ঈশিতা কিছুই বলল না।
এ বছর শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব একেবারে জলে গেছে। কলকাতা থেকে আসা বড়লোক বাবু-বিবি এবং তাদের নেকা ও বখাটে মেয়েবাজ ছেলেদের নানা হইচই, গোলমাল মদ খাওয়া নিয়ে মারামারি, মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি— গত কয়েক বছরে বহু গুণ বেড়েছে। তাতে উৎসবের নিজস্বতা হারিয়েছে পুরোপুরি। এ বার সে সব সীমাও ছাড়িয়ে যাওয়ায় একাধিক অনুষ্ঠান পন্ড করতে হয়েছে, বেশ কিছু অনুষ্ঠান নানা ভবনের নিজস্ব ঘরে হয়েছে। তাই পৌষমেলা নিয়ে আগে থেকে সতর্ক সবাই। ঈশিতার উপরে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মেলাপ্রাঙ্গনে একটা বড় জায়গা চাঁদোয়া দিয়ে ঢেকে মঞ্চ বেঁধে সেখানে কিছু নাচ-গান ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা হবে বলে ঠিক হয়েছে, সেটা ওকেই পরিচালনা করতে হবে। আলতু-ফালতু লোক যেন ঢুকতে না পারে, সেদিকে যতটা সম্ভব নজর রাখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টা নিয়ে স্থানীয় থানা, এমএলএ সবার সঙ্গেই কথা বলেছেন।
ঈশিতার বয়স মেঘে মেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে। গুঞ্জার মেয়ের বয়সই হতে চলল সাত। এইবার গুঞ্জা পড়ল ছোড়দির বিয়ে নিয়ে। ও একজনের খোঁজ আনল। তিনি পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তা ছাড়া অন্যান্য নানা ব্যবসাও আছে। বিপুল টাকার মালিক। একাধিক কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল টাকা দেওয়া এবং কেন্দ্রের শাসক দলকে বিপুল টাকা দিয়ে এখন উচ্চশিক্ষায় একজন কর্তাও বটে। বাঙালি না হলেও বহু বছর বাংলায় থেকে অনেকের চেয়ে ভাল বাংলা বলেন। তাঁকেই মন ধরল গুঞ্জার। এমনিই ১৭ বছর কেটে গেছে, আট বছর আগে বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরে শেষবার সৌমাভর চিঠি পেয়েছিল ও। ফলে সে যে আর ফিরবে না, ও বুঝে গেছে। তাই দিদির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশ্য ওর একটা বড় স্বার্থও আছে। এই লোকটিকে ধরলে ডিপার্টমেন্টে নিজের অবস্থান পাকা করতে ওর সুবিধা হবে। চাইকি কয়েক বছর পরে হেডডিপ পদটাও পেয়ে যাতে পারে। সব দিক ভেবে বহু বছর ধরে ঈশিতাকে ঘৃণা করা গুঞ্জা এ বারে ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল! ঈশিতা প্রথমে ভাগিয়ে দিলেও পরে গুঞ্জার কথা নিমরাজি হয়ে মেনে নিল। তা ছাড়া ওরও মেঘেমেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে ক’দিন আগে। ও জানাল, পুজোর পরে এ নিয়ে কথা হবে। এমনিই তখন গানের ক্লাস কয়েক দিন বন্ধ থাকবে, ফলে তখন কথা বলে দেখা যাবে।
ভাইফোঁটার পরের দিন সেই লোকটিকে নিয়ে ঈশিতার বাড়িতে এল গুঞ্জা ও তার বর। সঙ্গে ওর মেয়ে এবং ওদের সর্বক্ষণের কাজের বউটি। লোকটির বয়স প্রায় ৪০। নাম শুভম। দেখতে শুনতে মন্দ না। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন ক্যান্সারে। সন্তানাদি নেই। লোকটির শুধু একটিই বদঅভ্যাস, গুটখা আর পানমশলার নেশা প্রচন্ড। ছেলের নেশার বহর দেখে ঈশিতার কানেকানে গুঞ্জা বলল, ‘‘বিয়ের পরে তুই ছাড়িয়ে দিস এ সব নেশা। এগুলো ভাল না রে।’’ শুভম জানাল, গড়িয়ায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উত্তর কলকাতায় একটা একটা বড় বাড়ি খুঁজছে, সেখানেই বিয়ের পরে ঈশিতাকে নিয়ে উঠবে। ঈশিতা চাইলে যাদবপুরে ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিতে পারে। ও ব্যবস্থা করে দেবে। বড়দি এবং মেজদিও এসেছিলেন দু’জনের স্বামী-সন্তান নিয়ে। গুঞ্জার আগ্রহ দেখে কেউই কিছু বললেন না, মুখে বললেন, ভালই। ঈশিতা কিছুই বলল না। শুভমকে ভাল করে লক্ষ্যও করল না। ওর যেন কেমন লাগছে এই পুরো ব্যাপারটা। ও কড়া ভাবেই জানিয়ে দিল, পৌষমেলা অবধি ও কিছু করতে পারবে না, বিয়ে তো নয়ই। তার পরে গুঞ্জার বিস্তর অনুরোধ-আব্দারে ঠিক হল, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা কথা হবে। সব ঠিক থাকলে অঘ্রানের শেষ দিকে আঙটি বদলটা করে নেবে দু’জনে। জানুয়ারিতে বিশ্বভারতীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় মেজদির কাছে চলে যাবে ঈশিতা। এই বাড়িটা গুঞ্জাকে দিয়ে দেবে।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা দেখা হল। গুঞ্জাই কর্ত্রী হয়ে বিরাজ করল। ডিসেম্বরে আঙটি বদলও হল গুঞ্জা এবং ওর বরের উপস্থিতিতেই। কারণ দুই দিদি বা তাঁদের পরিবারের কেউ আসতে পারলেন না নানা কারণে। তবে এ সবে একদমই মন ছিল না ঈশিতার। ওর মন পড়ে অনুষ্ঠানের দিকে। ও ঠিক করে নিয়েছে, শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে এমন অনুষ্ঠান করবে, যার সুখ্যাতি বহু দিন ধরে করতে বাধ্য হবে সবাই।
পৌষমেলা শুরুর ঠিক তিনদিন আগে ‘মুকুট্টি’ বলে একটা ছোট গ্রুপের চিঠি এল ঈশিতার ডেস্কে। তারা অনুষ্ঠান করতে চায় বলে অনেক অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের দাবি, এমন অনুষ্ঠান করবে, লোকে চমকে যাবে। কথা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে কিছু করবে না, বড়জোড় একটা কি দুটো কবিতা বলতে পারে। তাও বাংলা কবিতা। তবে সেটা রবীন্দ্রনাথের নাও হতে পারে। সবই চিঠিতে লেখা। ও কী করবে, সেটা নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। এমনিই অনেক নামকরা লোক আসবেন, তার মধ্যে গ্রুপটার নাম কেমন যেন, তামিল ঘেঁষা! কী করবে ভেবে কূল পেল না। এমনিই নিয়মের কড়াকড়ি দেখে বেশ কয়েকটা কলকাতার দল জানিয়ে দিয়েছে, তারা ওই মঞ্চে অনুষ্ঠান করবে না। ফলে সময় ভরাটের জন্য এদের নেবে কি না, নিলে মুখ পুড়বে কি না, এ সব নিয়ে চিন্তায় ওর মাথা পাগল দশা তখন। তার মধ্যেই মোবাইলে ফোন করে গুঞ্জা জানাল, শুভম এই ক’দিন থাকবে বলে এসেছে। তবে ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় যাবে, আবার ঈশিতা রেজিগনেশন দিলে শান্তিনিকেতনে একেবারে গাড়ি নিয়ে এসে মালপত্র সব তুলে ওকে মেজদির বাড়ি পৌঁছে দেবে। জানুয়ারির মাঝামাঝি কোনও একটা শুভ দিন দেখে রেজিস্ট্রি হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে কেউই করতে রাজি নয় এই বয়সে। সেদিন তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হওয়ায় বেড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রিক্সায় উঠতে যাবে, হঠাৎ দুটো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এসে ওকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসল। দেখে মনে হল বছর কুড়ি-বাইশ হবে দু’জনের বয়স। ও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনারা কারা? কী ব্যাপার? আমি চিনতে পারছি না।’’ জিনস-পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি বলল, ‘‘ম্যাম, আমরাই মুকুট্টি থেকে চিঠি দিয়েছিলাম। প্যাডে আমাদের দু’জনেরই মোবাইল নম্বর আছে। যদি দেখেন, কথা দিতে পারি, ডোবাব না।’’ ঈশিতা ওদের মুখে স্পষ্ট বাংলা এবং অত্যন্ত মার্জিত ব্যবহারে খুশি হল। বলল, ‘‘কাল সকালে ফোনে জানিয়ে দেব। দেখি, আপনারা কেমন পারফর্ম করেন।’’ বলে রিক্সায় উঠে কিছু দূর যেতেই দেখল শুভম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। দু’জনে মিলে একটা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ কথা বলে শুভম নিজের হোটেলে চলে গেল। ওখানেই ওর তিন বন্ধুও এসে উঠেছে।
এমনিই পৌষমেলা উপলক্ষে শান্তিনিকেতন জুড়ে যেন ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ দশা। সঙ্গে গাড়ি-বাইকের উৎপাত। একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে প্রায় গাড়ি চাপা পড়ছিল ঈশিতা। ভাগ্যিস এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওর হাত ধরে টেনে সময় মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন, না হলে আজ ওখানেই গাড়ি চাপা পড়ত ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ‘আইআরসি’ ম্যাডাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে কী হত ভেবে কেঁপে উঠল ঈশিতা। ওই বয়স্ক ভদ্রলোকই ওকে হাত ধরে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে দিলেন। সেখানে চেয়ে এক বোতল জলও এনে দিলেন। জল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করল ঈশিতা। এর মধ্যে ওর কয়েক জন সহকর্মী খবরটা পেয়ে দৌড়ে এসে বিষয়টা বুঝে ওকে তড়িঘড়ি রিক্সা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। রাতে গুঞ্জা এসে এ নিয়ে বকাবকি করার পাশাপাশি একটু মশকরাও করে নিল। ঈশিতা কিছুই বলল না।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)