08-05-2025, 03:56 AM
(৩৭)
দিন তো চলি গেল
কেটে গেছে আরও ১৭ বছর। এর মধ্যে কেন্দ্রে, রাজ্যে সরকার বদল এবং আরও নানা বদল এসেছে। আর ঈশিতাদের পরিবারে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা না লিখলেই নয়। ঈশিতার বাবা কাকদ্বীপ থেকে ঘুরে ঘুরে শেষে বাঁকুড়ায় যান। সেখানেই রিটায়ারমেন্টের কয়েকদিন আগে নিজের সব সম্পত্তি এবং টাকা স্ত্রী ও মেয়েদের নামে করে উইল করে সেটা কলকাতার এক বন্ধুকে পাঠিয়ে দেন। এবং অদ্ভুত ভাবে তার কয়েক দিনের মধ্যে তিনি লরি চাপা পড়ে মারা যান। কেউ কেউ বলে, উনি ইচ্ছে করেই সেদিন গাড়ি চাপা পড়েন। দেহ হাসপাতালে পাঠিয়ে লোকজন যখন ব্যাঙ্কে খবর দেয় এবং তার পরে বহু খুঁজে তাঁর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়, ততক্ষণে বিশ্বজিৎবাবুর দেহে পচন ধরতে শুরু করেছে। স্থানীয় হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের পরে বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়েছিলেন বহুক্ষণ। ব্যাঙ্কের কর্মীরাই তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যায়। চিতায় তোলার একটু আগে পরিবারের সকলে এসেছিল, ঈশিতাও। পোস্টমর্টেমের পরে আগাগোড়া কাপড়ে মোড়া ছিল দেহটা। বহু অনুরোধেও শেষবারের মতো তাঁর মুখটাও দেখতে পায়নি ওরা কেউ। একপ্রকার নীরবেই নিজের জীবন শেষ করে বরাবরের মতো রায়চৌধুরী পরিবার থেকে চলে গেলেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
ঈশিতা রবীন্দ্রভারতীর পড়া শেষ করে মাস্টার্স এবং তার পরে পিএইচডি করে। তার পরে একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করে। সেখানে ভাল না লাগায় চলে যায় বিশ্বভারতীতে। সেখানেই রতনপল্লীতে একজনের পুরনো একটা বাড়ি কিনে ফেলে। বেশ বড় জায়গা নিয়ে বাড়িটা। একটা স্থানীয় মেয়ে সকাল-বিকেল এসে কাজ করে দেয়। বাকি সময়টা একাই থাকে। বছরখানেক হল সময় কাটাতে একটা গানের কলেজ চালু করেছে। নিজের মতো গান আর পড়াশোনা নিয়েই থাকে। চোখমুখের সেই মলিনতা মুছে এখন আগের মতোই সুন্দরী হয়ে উঠেছে। তবে শরীরটা একটু ভারী হয়েছে, যদিও তাতে রূপ যেন আরও বেড়েছে। সৌমাভ চলে যাওয়ার প্রথম দশ বছর কেটে যাওয়ার পরে আর শাঁখা-সিঁদুর পড়ে না। যার জন্য পরা, তারই যখন খোঁজ নেই, কী হবে ও সব করে? ওদিকে গুঞ্জা জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ে মাস্টার্স করে একটা কলেজে পড়ানোর চাকরি পেয়েছে। ওর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন একটা চিঠি পেয়েছিল। তাতে শুধু লেখা ছিল, ‘‘কনগ্র্যাচুলেশনস গুঞ্জাবতী। পারলে ডক্টরেট করে নে, কলেজে পড়াতে পারবি।’’ সঙ্গে একটা মোটা টাকার চেক। আর কিচ্ছু না। ওরা সবাই বুঝেছিল, আড়ালে থেকে হলেও সব খবর রাখে সৌমাভ, শুধু নিজের বা কুট্টি-মুট্টির খবর যাতে ওরা না পায়, সেটার দিকে খেয়াল রাখে অনেক বেশি। তাই কোনও চিঠিতেই পোস্ট অফিসের ছাপও থাকে না। আর কোনও চিঠি পায়নি গুঞ্জা তার সৌমদার কাছ থেকে। ঈশিতার সঙ্গে গুঞ্জার দূরত্ব এই ক’বছরে অনেক কেটেছে। ঈশিতা আসার কয়েক বছর পরে সেও বিশ্বভারতীতে পড়ানোর চাকরি নিয়ে চলে আসে। তবে দিদির বাড়িতে থাকে না, পাশেই একটা ছোট বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকে। কয়েক বছর পরে বিয়ে করে স্থানীয় একটি ছেলেকে। বিশ্বভারতীরই কর্মচারী সে। বয়সে গুঞ্জার থেকে বেশ বড়, তবে ‘মাস্টারনী’ বউ এবং তার ‘বিয়ে না হওয়া মাস্টারনী’ দিদিকে বেশ সমীহ করে। ভয়ও পায় মনে মনে। দুই দিদির ছেলেমেয়েরা এখন বেশ বড়। বড়দির ছেলে যাদবপুরে মাস্টার্স করার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশুনা করে। মেজদির মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলকাতারই নামী কলেজে বিএসসি পড়ছে। দুই দিদিই সময় পেলে চলে আসে ঈশিতার বাড়িতে। থাকার জায়গার অভাব নেই, এলে মনটাও ভাল হয়ে যায়। ওই কদিন গুঞ্জাও এসে থাকে ওদের কাছে। ওর বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরে একটা ছোট বাক্স এসেছিল, উপরে লেখা ছিল ‘প্রতি, ঐশী রায়চৌধুরী’। কে পাঠিয়েছে এটা, বুঝতে না পেরে গুঞ্জা বাক্সটা খুলে দেখেছিল, একটা ছোট বাক্সে একজোড়া ভারী সোনার দুল আর একটা পাতায় সেই মুক্তোর মতো হাতের লেখায় কবিতা—
‘‘.....একটা জন্ম জোড়াতালির, ভাত কাপড়ের তক্কে তক্কে
একটা জীবন মাথা গোঁজার ফন্দি খুঁজে,
একটা জীবন বাক্স মাথায় ভুল শহরে
ভুল ঠিকানায় ঘুরে ঘুরে,
একটা জন্ম এমনি এমনি কেটে গেলো,
একটা জীবন দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।
তোমার (তোর) সঙ্গে ভালো করে কথা বলাই হলো না।’’
বিয়ে করেছিস, ভাল থাকিস। আনন্দে থাকিস। — সৌমাভ সরকার।
কবিতাটা আগে একবার কোথাও পড়েছিল, মনে হয় তারাপদ রায়ের লেখা। ওর ঠিক মনে পড়ল না। কিন্তু চিঠিটা পড়তে গিয়ে গুঞ্জা অবাক হয়ে গিয়েছিল। সৌমাভদা ওকে এ বার আর গুঞ্জাবতী বলে সম্বোধন করেনি? এমনকি চিঠির শেষেও সৌমদা না লিখে সৌমাভ সরকার লিখেছে! শেষ পর্যন্ত ওকেও ঈশিতার মতো দূরে সরিয়ে দিল সৌমদা? কীসের অভিমানে? তবে সৌমাভর ওই চিঠির খবরে ভিতরে ভিতরে আনন্দ পেয়েছিল ঈশিতা। গুঞ্জার প্রতি সৌমাভর টানকে একসময় ওর প্রেম মনে হয়েছিল। আজ ওর নিজের ধারণা কত বড় ভুল, নতুন করে বুঝল ঈশিতা। দুচোখ ভরে গিয়েছিল জলে।
জয়তীর সঙ্গে ঈশিতার যোগাযোগ সেদিনের পর থেকে অনেকটা বেড়েছে। তবে ঈশিতা বিশ্বভারতীতে চলে আসায় সেই যোগাযোগে ভাঁটা পড়লেও মোবাইলে যোগাযোগ আছে। ঈশিতারা যেদিন ওর কাছে গেছিল, তার মাসখানেক পরেই এপ্রিলে জয়তী বিয়ে করে তাদেরই কলেজের এক বছরের এক সিনিয়রকে। জয়তীর একটি ছেলে হয় বিয়ের নয় মাসের মধ্যেই। জয়তীদির বর রঙ্গনদা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে বেশ উঁচু পদে আছেন। পার্টি এবং অন্যান্য নানা ছুতোয় প্রচুর মদ খান। বছর দুয়েকের মধ্যে তাঁর মেয়েঘটিত দোষের কথাও কানে এল জয়তীর। সেটা নিয়ে সে বেশ বিরক্ত। মাঝে একদিন নিজের খেয়ালে গল্প করতে করতেই ঈশিতাকে বলেছিল, ‘‘রঙ্গনেরও এর ওর সঙ্গে চোদানোর বাতিক আছে বলে শুনেছি। যেদিন ধরতে পারব, সৌমাভদার মতোই লাথি মেরে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাব। তবে ছেলেকে নিজের কাছেই রাখব।’’ কথাটা বলে একটু পরেই খেয়াল হতে ঈশিতার হাত ধরে বলেছিল, ‘‘তোকে মিন করে কিছু বলিনি, প্লিজ বিশ্বাস কর। ছেলের দিব্যি দিয়ে বলছি।’’ ঈশিতাও বুঝেছিল, বেখেয়ালেই এর ওর সঙ্গে শোয়ার কথাটা বলে ফেলেছিল জয়তীদি। জেনেছিল, ছেলের নাম রেখেছে সমুদ্র। তবে জয়তী এটা ঈশিতাকে বলেনি যে, ওই নামটা বেছে দিয়েছিল সৌমাভই। বিয়েতে না এলেও পরে এসে দেখা করে গিয়েছিল সৌমাভ। অনেক উপহারও দিয়েছিল। ওর সঙ্গে এসেছিল সুভদ্রা এবং কুট্টি-মুট্টিও। ওরা ততদিনে প্রায় ন’মাসের হয়ে গিয়েছে। সুভদ্রার যত্নে দু’জনের শরীরস্বাস্থ্য বেশ ভাল। জঙ্গলের নির্মল পরিবেশে ওদের গড়নও সুন্দর হয়েছে। সুভদ্রাকে দেখে রীতিমতো চমকে গেছিল জয়তী। মাত্র কয়েক মাসেই কী পরিবর্তন! ঢেঙ্কানলের সেই আদিবাসী মেয়েটার এখন ঝকঝকে চোখমুখ, হাঁটাচলায় বেশ স্মার্ট, ফিগারও হয়েছে দেখার মতো। যত্নে থাকার কারণে গায়ের রং এখন বেশ উজ্জ্বল। তবে ওকে দেখে আগের মতোই নিচু হয়ে প্রণাম করে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘‘তোমার জন্যই নতুন জীবন পেয়েছি, এটা আমি ভুলব না।’’ জয়তী দেখেছিল, সব কিছুর মধ্যেও কুট্টি-মুট্টির দিকে কড়া নজর সুভদ্রার। দুটোর খাওয়া নিয়ে বিস্তর ঝামেলা, কিন্তু সুভদ্রা হাসিমুখেই ওদের সামলাত।
সে বারে কলকাতায় এসে সুভদ্রাদের জয়তীর কাছে জিম্মা রেখে আর একটা কাজ করেছিল সৌমাভ। বর্ধমানে ওর পৈত্রিক গ্রাম ভেদিয়ায় গিয়েছিল। যদিও আসলে সেটা ভেদিয়া থেকেও বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে, প্রায় বীরভূমের সীমানায়। অজয় বাঁধের কাছে একটা গ্রামে। সেখানে নিজেদের বাড়ি খুঁজে বের করে। প্রায় ভাঙাচোরা বাড়িটা মেরামত করে এবং আশপাশ মিলিয়ে বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। তার পরে জমির সীমানা বরাবর বেশ কয়েকটা গাছ লাগায়। এমনিই গাছ ওর প্রাণ। বরাবর জঙ্গলকে ভালবেসেছে। তাই অনেক গাছ লাগিয়েছিল। তার মধ্যে গোটা পাঁচেক আমগাছ ছাড়াও কাঁঠাল, জামের মতো ফলের গাছের পাশাপাশি শিমূল, সেগুন, জারুল, পলাশের মতো গাছও ছিল। আর লাগিয়েছিল পাশাপাশি তিনটে নিমগাছ ও দুটো কৃষ্ণচূড়া ও দুটো রাধাচূড়া। দুটো ছোট পুকুরও কাটিয়েছিল পরে একবার এসে। সে কারণে প্রয়োজনে নিজের বাড়ির সীমানা বাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা জমি কিনেছিল। একই সঙ্গে বম্বের স্টাফ-বন্ধুদের থেকে জেনে পরের কয়েক বছরে ধাপে ধাপে নিউটাউনে প্রায় জলের দরে চার-পাঁচ কাঠা করে বেশ কয়েকটা প্লট কিনে ফেলেছিল। কয়েক বছর পরে সুভদ্রা কলকাতায় চাকরি সূত্রে মেসে থাকছে দেখে ওকে জোর করে লোন নিতে বাধ্য করে একটা ছোট বাড়িও তুলিয়েছিল তারই একটায়। অবশ্য সৌমাভ নিজেও বেশ কিছু টাকা দিয়েছিল। পরে বাড়িটা দোতলা করা হয়। সেখানেও প্রচুর গাছ লাগায় সৌমাভ। এই সব জমিজমার দলিল, কাগজ সব সুভদ্রার কাছে রেখে দিয়েছিল সৌমাভ। কয়েক বছর পরে ওকে নমিনিও করে দিয়েছিল, বহু আপত্তি সত্ত্বেও।
ভদ্রা থেকে এক বছর পরে বদলি হয়ে বম্বে আসে সৌমাভ। জয়রাজন স্যারকে ধরাকরা করে সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কে জয়েন করে। প্রথমে তড়োবায় যাওয়ার কথা ভাবলেও ছেলেমেয়ে এবং সুভদ্রার পড়াশোনার কথা ভেবেই বম্বে বেছে নিয়েছিল। বম্বে আসার কয়েক মাস পরে সুভদ্রাকে ভদ্রার মিশনারি কলেজ থেকেই ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা দিতে নিযে গিয়েছিল সৌমাভ। সে সময় কুট্টি-মুট্টিও স্বাভাবিক ভাবেই ওদের সঙ্গে ছিল। বম্বেতে এসে সৌমাভ একটা পুরনো মারুতি গাড়ি কেনে আর্মি অকশন থেকে। বম্বের বাসা থেকে গাড়িতে অফিস যেতে ওর বেশি সময় লাগে না। সুভদ্রা ভালভাবেই পাশ করে সায়েন্স নিয়ে বম্বের একটা কলেজে ভর্তি হয়। তখন সৌমাভর ছেলেমেয়ের বয়স প্রায় দুই। সুভদ্রার জেদাজেদিতেই দুই ছেলেমেয়েকে কাছেই একটা প্রাইভেট নার্সারি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিল। বছর খানেক পরে সেই কলেজটা ওঠে যাওয়ায় একটা নামকরা মিশনারি কলেজে ভর্তি করতে গিয়ে সৌমাভ এমন একটা কান্ড করে বসল, যা ওর মতো সব কাজে নিখুঁত মানুষের কাছে আশা করা যায় না। ছেলেমেয়ের বয়সের হিসেব না করেই চার বছর কয়েক মাসের অরণ্য এবং মৃত্তিকাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিল। সব শুনে মাথায় হাত পড়ল সুভদ্রার। ও বিস্তর চেঁচামেচি তো করলই সেই সঙ্গে বোঝাল, হিসেব মতো ১৪ বছরে ক্লাস টেন এবং ১৬ বছরে ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা দেবে দু’জন। এত কম বয়সে চাপ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ল দু’জনেই। তার পরে ঠিক করা হল, দেখা যাক। ওদের অবাক করে দিয়ে ক্লাসের সবচেয়ে ছোট দুই ছেলেমেয়ে প্রতিবারই ভাল রেজাল্ট করে সুভদ্রার হিসেব মতোই ১৪ এবং ১৬ বছরে দুটো বড় পরীক্ষা পাশ করে ফেলল।
সুভদ্রার জীবন এখন আমূল বদলে গেছে। ঢেঙ্কানল থেকে বাবার হাত ধরে অনেক অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করে ভুবনেশ্বরের হোটেলে এসে কাজ নিয়ে চিল-শকুনের নজর এড়িয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে একসময় বারিপদায় জয়ন্ত-জয়তীর সংসাররে ঠাঁই হয়েছিল ওর। সেখান থেকে আজ সে বড় সরকারি অফিসার। সৌমাভ ভদ্রায় আসার পর থেকেই ওর দুই খুদে সন্তান এবং সংসারের সব ভার কাঁধে নিয়ে রীতিমতো গিন্নি হয়ে উঠেছে। সৌমাভর উৎসাহে এবং চেষ্টায় মাস্টার্স শেষ করে সৌমাভর কথাতেই সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বড় পদেই চাকরি করছে সে। এদিকে দুই ছেলেমেয়ে বড় হলেও সুভদ্রার মন পড়ে থাকত ওদের দিকেই। তাই টাকাপয়সার পরোয়া না করেই প্রথম কয়েক বছর প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর শুক্রবার অফিস থেকে বেরিয়ে ফ্লাইট ধরে বম্বে যেত, সোমবার সকালের ফ্লাইটে ফিরে অফিস জয়েন করত। কলেজে ছুটি থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে সৌমাভ কলকাতায় আসত। তখন জয়তীও এসে আড্ডা মেরে যেত ওদের সঙ্গে। জয়তীর ছেলের সঙ্গে কুট্টি-মুট্টির বয়সের ফারাক বেশি না। তবে ও পড়ে নিচু ক্লাসে। দুই ছেলেমেয়ে ক্লাস টেন পাশ করার পরে জয়তী ও সুভদ্রার জেদাজেদিতে বোম্বের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় ফিরল সৌমাভ। জয়েন করল সল্টলেকের অফিসে।
সুভদ্রার বয়স এখন প্রায় ৩৬। সৌমাভ যখন ওকে প্রথম দেখে, তখন ও হিসেব মতো ও ঈশিতার থেকে সামান্য ছোট ছিল। দুই ছেলেমেয়ে এবং সৌমাভকে নিয়ে তার ভরা সংসার। সৌমাভর পদবীই ব্যবহার করে। তবে একটা চাপা কষ্ট আর অভিমান ওর আছে। সৌমাভর কাছে সব রকম ভাবে ধরা দিতে চেয়েও পারেনি। এমনকি বহুবার মুখে বলে কাজ না হওয়ায় নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে সৌমাভর বিছানায় রাতে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেও সাড়া পায়নি। বরং সৌমাভ খুব স্নেহের সঙ্গে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, ‘‘পরে তোকে সব বলব, তুই ভুল বুঝিস না।’’ সুভদ্রা গ্র্যাজুয়েশন করার পরে একদিন রাতে ওকে পাশে বসিয়ে ঈশিতা এবং ওর নিজের সব কথা খুলে বলেছিল। প্রায় ভোররাত অবধি সব বলেছিল সৌমাভ আর সুভদ্রা অঝোরে কেঁদেছিল প্রায় পুরো সময়টাই। আরও বেশি টান অনুভব করেছিল সৌমাভর জন্য, কুট্টি-মুট্টির জন্য। তার পরে সৌমাভর বহু অনুরোধ, রাগারাগি, অভিমানেও ও বিয়ে করেনি। ও কুট্টি-মুট্টিকে প্রথম দিন থেকে সন্তানের মতো পালন করেছে। আজও করে। কুট্টি-মুট্টি ওকে ছোট থেকেই মামন বলে ডাকে। তবে ওকে ‘গার্ডি’ বলে খেপায় দু’জনেই। গার্ডিয়ান থেকে ‘গার্ডি’। এত বড় হয়েও ভুল করলে দু’জনেই মারধর খায় সুভদ্রার কাছে। মুখে না বললেও এবং সামাজিক স্বীকৃতি না পেলেও সুভদ্রা মনে মনে নিজেকে সৌমাভর স্ত্রী হিসেবেই মেনে নিয়ে সংসারের সব ভার হাতে নিয়েছে। ও চাইলে, বিশেষ করে চাকরি পাওয়ার পরে বিয়ে করতেই পারত অন্য কাউকে। কিন্তু সেটা ও করেনি। সৌমাভর শরীরটা পায়নি বটে, কিন্তু দুই ছেলেমেয়ে, সংসার, সম্মান, টাকাপয়সা, জমি, বাড়ি— সব আছে ওর। এমনকি সৌমাভকে জড়িয়ে শুয়েও থাকে বহু দিন। কিন্তু তাতে যৌনতা থাকে না। প্রথম প্রথম সুভদ্রা চাইলেও সৌমাভর সব কথা শোনার পরে আর এ নিয়ে এগোয় না। জয়তীও ওকে বলেছিল, সেও পেয়ে চেয়েছিল, কিন্তু পায়নি। সুভদ্রা এটা মেনে নিয়েই আছে। প্রথম কয়েক বছর যৌবনের চাহিদা, শরীরের টান ওকে ভিতরে ভিতরে জ্বালাত। কিন্তু পরে ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অরণ্য এবং মৃত্তিকা দু’জনেই বাবার কাছে গান শিখেছে যত্ন করে। দারুণ ভাল ছবিও আঁকে। বিশেষ করে ক্যানভাসে রং-তুলি দিয়ে ছবি ফুটিয়ে তোলায় দু’জনেরই হাত অসাধারণ। এখন তারা কলেজে পড়ছে।
ছেলেমেয়ের ১৮ বছরের জন্মদিনের কয়েক দিন আগে সৌমাভ জয়তী এবং সুভদ্রা দু’জনের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। জয়তীর সঙ্গে রঙ্গনের ততদিনে ডিভোর্স হয়ে গেছে। জয়তীর আশঙ্কা মতোই নিজের বাড়িতে একটি মেয়ের কামিজের ভিতরে হাত ঢোকানো অবস্থায জয়তীর কাছে ধরা পড়ে যায়। খোরপোষ হিসেবে টাকা নেয়নি জয়তী, তবে সল্টলেকে রঙ্গনদের পৈত্রিক বাড়িটা নিজের নামে করে নিয়েছিল। জয়তীর বাড়ি থেকে সুভদ্রার বাড়ি বেশি দূরে নয়। কুট্টি-মুট্টি ওকে পিসি বলে ডাকে। আলাদা করে দু’জনের সঙ্গে কথা বলার পরে এক দিন দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে কথা বলল সৌমাভ। জানাল, আর কয়েক মাস পরে ও পঞ্চাশে পা দেবে। সৌমাভ স্পষ্ট করেই বলল, ‘‘ছেলেমেয়ে অ্যাডাল্ট হয়েছে, এবার সত্যিগুলো জানুক। না হলে পরে যদি কোনও সমস্যা হয়।’’ অনেকক্ষণ ইতস্তত করে দু’জনেই তাতে সায় দিল। ঠিক হল, ওদের সামনেই সব জানাবে সৌমাভ। যে সব কথা সৌমাভ বলতে পারবে না, সেগুলো জয়তী কিছুটা বাকিটা সুভদ্রা জানাবে দু’জনকে। সৌমাভ এই বার ওর লেখা একটা মোটা ডায়েরি তুলে দিল জয়তীর হাতে বলল, ‘‘ভদ্রায় যাওয়া থেকে লেখা শুরু করেছি। আগের সব কথাও আছে। এই ক’বছরের কথাও। যতটা পেরেছি, মনে করে করে লিখেছি। তোমাদের দু’জনের কাছে আমার লজ্জা নেই। তোমাদের দু’জনকেই আমি ছুঁয়ে থেকেছি এত বছর। তাই সব তোমাদের কাছে বলতে পারি। এটা তুমি পড়ে পরে সুভদ্রাকে দিও। সুভদ্রা মনে করলে ছেলেমেয়েকে দেবে পড়তে।’’ আরও দু’টো খবর ও জানাল, যা চমকে দিল জয়তী ও সুভদ্রা দু’জনকেই। ১৮ বছর আগে ঈশিতার কীর্তিকলাপ জানতে পেরে বেলেঘাটার যে বাড়ি থেকে ও কুট্টি-মুট্টিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল, সেই বাড়ি ও পরের বছর জানুয়ারিতে ছেলেমেয়ের মুখেভাত উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসে কিনে নিয়েছিল। পুরো বাড়িটাই। দোতলার বাড়িওয়ালা তাঁর পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন কয়েক মাস পরে। নীচ তলার দোকানগুলোর ভাড়া জমা পড়ে একটা অ্যাকাউন্টে। আর তিনতলার ওদের সেই ফ্ল্যাটটা একই রকম ভাবে বন্ধই ছিল। সেটাকে ও একাধিক তালা মেরে প্রায় সিল করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়টা হল, বছর কয়েক আগে সামার ভেকেশনে কুট্টি-মুট্টি কলকাতায় তাদের মামনের কাছে এসেছিল। ওই সময় বম্বেতে অফিসেই একটা হার্ট অ্যাটাক হয় সৌমাভর। দিন কয়েক হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেলেও বহু দিন ওষুধ খেতে হয়েছে। ব্লাড সুগারও ধরা পড়েছে। শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। ১৮-১৯ বছর আগেই সেই ঝকঝকে, চনমনে, নীরোগ, সৌমাভ বদলাতে শুরু করেছিল বহু বছর আগেই। এখন নানা রোগে শরীর ভেঙে একটা জীর্ণ দশা তার। আরও নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। তাই ও এবার ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নেবে। সেই ২৩-২৪ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছে। ২৫ বছর ধরে নিজের শরীর ও মনের উপর অনেক অত্যাচার চেয়ে বা না চেয়ে করেছে। তার ফল এখন বেরোচ্ছে। ও আর চাকরি করতে চায় না। এ বার বিশ্রাম নেবে। চাকরি ছাড়লেও যে পেনশন পাবে, তা নেহাত কম নয়। প্রথম খবরটায় চমকে গেলেও দু’জনেই বুঝেছিল, বাড়িটার প্রতি মায়া আছে সৌমাভর। কলকাতায় এসে ওই বাড়িতেই ঈশিতাকে নিয়ে উঠেছিল, ওই বাড়িতেই ঈশিতাকে এবং দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিল, তাই ওটা হাতছাড়া করতে চায়নি ও। কিন্তু দ্বিতীয় খবরটা শুনে দু’জনেই প্রচন্ড কেঁদেছিল। কেন বলেনি, ওরা কি কেউ নয়, এই সব নানা কথা উঠেছিল। সৌমাভ উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে দু’জনে বুকে টেনে বলেছিল, ‘‘তোমাদের থেকে আপনজন আমার কেউ নেই দুনিয়ায়। ছেলেমেয়ের সঙ্গে রক্তের টান, আর তোমাদের সঙ্গে আমার প্রাণের টান। তোমরা দু’জনেই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে, কিন্তু তা করোনি। তোমরাই আমার সবকিছু। আমি ওটা বলিনি, কারণ তোমাদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি।’’ সৌমাভর চাকরি ছাড়ার খবরে অবশ্য বেশি খুশি হয়েছিল সুভদ্রা। এবার সব সময় কাছে পাবে নিজের মানুষটাকে। খুশি হয়েছিল কুট্টি-মুট্টিও।
দিন তো চলি গেল
কেটে গেছে আরও ১৭ বছর। এর মধ্যে কেন্দ্রে, রাজ্যে সরকার বদল এবং আরও নানা বদল এসেছে। আর ঈশিতাদের পরিবারে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা না লিখলেই নয়। ঈশিতার বাবা কাকদ্বীপ থেকে ঘুরে ঘুরে শেষে বাঁকুড়ায় যান। সেখানেই রিটায়ারমেন্টের কয়েকদিন আগে নিজের সব সম্পত্তি এবং টাকা স্ত্রী ও মেয়েদের নামে করে উইল করে সেটা কলকাতার এক বন্ধুকে পাঠিয়ে দেন। এবং অদ্ভুত ভাবে তার কয়েক দিনের মধ্যে তিনি লরি চাপা পড়ে মারা যান। কেউ কেউ বলে, উনি ইচ্ছে করেই সেদিন গাড়ি চাপা পড়েন। দেহ হাসপাতালে পাঠিয়ে লোকজন যখন ব্যাঙ্কে খবর দেয় এবং তার পরে বহু খুঁজে তাঁর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়, ততক্ষণে বিশ্বজিৎবাবুর দেহে পচন ধরতে শুরু করেছে। স্থানীয় হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের পরে বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়েছিলেন বহুক্ষণ। ব্যাঙ্কের কর্মীরাই তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যায়। চিতায় তোলার একটু আগে পরিবারের সকলে এসেছিল, ঈশিতাও। পোস্টমর্টেমের পরে আগাগোড়া কাপড়ে মোড়া ছিল দেহটা। বহু অনুরোধেও শেষবারের মতো তাঁর মুখটাও দেখতে পায়নি ওরা কেউ। একপ্রকার নীরবেই নিজের জীবন শেষ করে বরাবরের মতো রায়চৌধুরী পরিবার থেকে চলে গেলেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
ঈশিতা রবীন্দ্রভারতীর পড়া শেষ করে মাস্টার্স এবং তার পরে পিএইচডি করে। তার পরে একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করে। সেখানে ভাল না লাগায় চলে যায় বিশ্বভারতীতে। সেখানেই রতনপল্লীতে একজনের পুরনো একটা বাড়ি কিনে ফেলে। বেশ বড় জায়গা নিয়ে বাড়িটা। একটা স্থানীয় মেয়ে সকাল-বিকেল এসে কাজ করে দেয়। বাকি সময়টা একাই থাকে। বছরখানেক হল সময় কাটাতে একটা গানের কলেজ চালু করেছে। নিজের মতো গান আর পড়াশোনা নিয়েই থাকে। চোখমুখের সেই মলিনতা মুছে এখন আগের মতোই সুন্দরী হয়ে উঠেছে। তবে শরীরটা একটু ভারী হয়েছে, যদিও তাতে রূপ যেন আরও বেড়েছে। সৌমাভ চলে যাওয়ার প্রথম দশ বছর কেটে যাওয়ার পরে আর শাঁখা-সিঁদুর পড়ে না। যার জন্য পরা, তারই যখন খোঁজ নেই, কী হবে ও সব করে? ওদিকে গুঞ্জা জিওগ্রাফি নিয়ে পড়ে মাস্টার্স করে একটা কলেজে পড়ানোর চাকরি পেয়েছে। ওর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন একটা চিঠি পেয়েছিল। তাতে শুধু লেখা ছিল, ‘‘কনগ্র্যাচুলেশনস গুঞ্জাবতী। পারলে ডক্টরেট করে নে, কলেজে পড়াতে পারবি।’’ সঙ্গে একটা মোটা টাকার চেক। আর কিচ্ছু না। ওরা সবাই বুঝেছিল, আড়ালে থেকে হলেও সব খবর রাখে সৌমাভ, শুধু নিজের বা কুট্টি-মুট্টির খবর যাতে ওরা না পায়, সেটার দিকে খেয়াল রাখে অনেক বেশি। তাই কোনও চিঠিতেই পোস্ট অফিসের ছাপও থাকে না। আর কোনও চিঠি পায়নি গুঞ্জা তার সৌমদার কাছ থেকে। ঈশিতার সঙ্গে গুঞ্জার দূরত্ব এই ক’বছরে অনেক কেটেছে। ঈশিতা আসার কয়েক বছর পরে সেও বিশ্বভারতীতে পড়ানোর চাকরি নিয়ে চলে আসে। তবে দিদির বাড়িতে থাকে না, পাশেই একটা ছোট বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকে। কয়েক বছর পরে বিয়ে করে স্থানীয় একটি ছেলেকে। বিশ্বভারতীরই কর্মচারী সে। বয়সে গুঞ্জার থেকে বেশ বড়, তবে ‘মাস্টারনী’ বউ এবং তার ‘বিয়ে না হওয়া মাস্টারনী’ দিদিকে বেশ সমীহ করে। ভয়ও পায় মনে মনে। দুই দিদির ছেলেমেয়েরা এখন বেশ বড়। বড়দির ছেলে যাদবপুরে মাস্টার্স করার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখাশুনা করে। মেজদির মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলকাতারই নামী কলেজে বিএসসি পড়ছে। দুই দিদিই সময় পেলে চলে আসে ঈশিতার বাড়িতে। থাকার জায়গার অভাব নেই, এলে মনটাও ভাল হয়ে যায়। ওই কদিন গুঞ্জাও এসে থাকে ওদের কাছে। ওর বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরে একটা ছোট বাক্স এসেছিল, উপরে লেখা ছিল ‘প্রতি, ঐশী রায়চৌধুরী’। কে পাঠিয়েছে এটা, বুঝতে না পেরে গুঞ্জা বাক্সটা খুলে দেখেছিল, একটা ছোট বাক্সে একজোড়া ভারী সোনার দুল আর একটা পাতায় সেই মুক্তোর মতো হাতের লেখায় কবিতা—
‘‘.....একটা জন্ম জোড়াতালির, ভাত কাপড়ের তক্কে তক্কে
একটা জীবন মাথা গোঁজার ফন্দি খুঁজে,
একটা জীবন বাক্স মাথায় ভুল শহরে
ভুল ঠিকানায় ঘুরে ঘুরে,
একটা জন্ম এমনি এমনি কেটে গেলো,
একটা জীবন দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।
তোমার (তোর) সঙ্গে ভালো করে কথা বলাই হলো না।’’
বিয়ে করেছিস, ভাল থাকিস। আনন্দে থাকিস। — সৌমাভ সরকার।
কবিতাটা আগে একবার কোথাও পড়েছিল, মনে হয় তারাপদ রায়ের লেখা। ওর ঠিক মনে পড়ল না। কিন্তু চিঠিটা পড়তে গিয়ে গুঞ্জা অবাক হয়ে গিয়েছিল। সৌমাভদা ওকে এ বার আর গুঞ্জাবতী বলে সম্বোধন করেনি? এমনকি চিঠির শেষেও সৌমদা না লিখে সৌমাভ সরকার লিখেছে! শেষ পর্যন্ত ওকেও ঈশিতার মতো দূরে সরিয়ে দিল সৌমদা? কীসের অভিমানে? তবে সৌমাভর ওই চিঠির খবরে ভিতরে ভিতরে আনন্দ পেয়েছিল ঈশিতা। গুঞ্জার প্রতি সৌমাভর টানকে একসময় ওর প্রেম মনে হয়েছিল। আজ ওর নিজের ধারণা কত বড় ভুল, নতুন করে বুঝল ঈশিতা। দুচোখ ভরে গিয়েছিল জলে।
জয়তীর সঙ্গে ঈশিতার যোগাযোগ সেদিনের পর থেকে অনেকটা বেড়েছে। তবে ঈশিতা বিশ্বভারতীতে চলে আসায় সেই যোগাযোগে ভাঁটা পড়লেও মোবাইলে যোগাযোগ আছে। ঈশিতারা যেদিন ওর কাছে গেছিল, তার মাসখানেক পরেই এপ্রিলে জয়তী বিয়ে করে তাদেরই কলেজের এক বছরের এক সিনিয়রকে। জয়তীর একটি ছেলে হয় বিয়ের নয় মাসের মধ্যেই। জয়তীদির বর রঙ্গনদা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে বেশ উঁচু পদে আছেন। পার্টি এবং অন্যান্য নানা ছুতোয় প্রচুর মদ খান। বছর দুয়েকের মধ্যে তাঁর মেয়েঘটিত দোষের কথাও কানে এল জয়তীর। সেটা নিয়ে সে বেশ বিরক্ত। মাঝে একদিন নিজের খেয়ালে গল্প করতে করতেই ঈশিতাকে বলেছিল, ‘‘রঙ্গনেরও এর ওর সঙ্গে চোদানোর বাতিক আছে বলে শুনেছি। যেদিন ধরতে পারব, সৌমাভদার মতোই লাথি মেরে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাব। তবে ছেলেকে নিজের কাছেই রাখব।’’ কথাটা বলে একটু পরেই খেয়াল হতে ঈশিতার হাত ধরে বলেছিল, ‘‘তোকে মিন করে কিছু বলিনি, প্লিজ বিশ্বাস কর। ছেলের দিব্যি দিয়ে বলছি।’’ ঈশিতাও বুঝেছিল, বেখেয়ালেই এর ওর সঙ্গে শোয়ার কথাটা বলে ফেলেছিল জয়তীদি। জেনেছিল, ছেলের নাম রেখেছে সমুদ্র। তবে জয়তী এটা ঈশিতাকে বলেনি যে, ওই নামটা বেছে দিয়েছিল সৌমাভই। বিয়েতে না এলেও পরে এসে দেখা করে গিয়েছিল সৌমাভ। অনেক উপহারও দিয়েছিল। ওর সঙ্গে এসেছিল সুভদ্রা এবং কুট্টি-মুট্টিও। ওরা ততদিনে প্রায় ন’মাসের হয়ে গিয়েছে। সুভদ্রার যত্নে দু’জনের শরীরস্বাস্থ্য বেশ ভাল। জঙ্গলের নির্মল পরিবেশে ওদের গড়নও সুন্দর হয়েছে। সুভদ্রাকে দেখে রীতিমতো চমকে গেছিল জয়তী। মাত্র কয়েক মাসেই কী পরিবর্তন! ঢেঙ্কানলের সেই আদিবাসী মেয়েটার এখন ঝকঝকে চোখমুখ, হাঁটাচলায় বেশ স্মার্ট, ফিগারও হয়েছে দেখার মতো। যত্নে থাকার কারণে গায়ের রং এখন বেশ উজ্জ্বল। তবে ওকে দেখে আগের মতোই নিচু হয়ে প্রণাম করে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘‘তোমার জন্যই নতুন জীবন পেয়েছি, এটা আমি ভুলব না।’’ জয়তী দেখেছিল, সব কিছুর মধ্যেও কুট্টি-মুট্টির দিকে কড়া নজর সুভদ্রার। দুটোর খাওয়া নিয়ে বিস্তর ঝামেলা, কিন্তু সুভদ্রা হাসিমুখেই ওদের সামলাত।
সে বারে কলকাতায় এসে সুভদ্রাদের জয়তীর কাছে জিম্মা রেখে আর একটা কাজ করেছিল সৌমাভ। বর্ধমানে ওর পৈত্রিক গ্রাম ভেদিয়ায় গিয়েছিল। যদিও আসলে সেটা ভেদিয়া থেকেও বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে, প্রায় বীরভূমের সীমানায়। অজয় বাঁধের কাছে একটা গ্রামে। সেখানে নিজেদের বাড়ি খুঁজে বের করে। প্রায় ভাঙাচোরা বাড়িটা মেরামত করে এবং আশপাশ মিলিয়ে বেশ কয়েক বিঘা জমি কিনে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। তার পরে জমির সীমানা বরাবর বেশ কয়েকটা গাছ লাগায়। এমনিই গাছ ওর প্রাণ। বরাবর জঙ্গলকে ভালবেসেছে। তাই অনেক গাছ লাগিয়েছিল। তার মধ্যে গোটা পাঁচেক আমগাছ ছাড়াও কাঁঠাল, জামের মতো ফলের গাছের পাশাপাশি শিমূল, সেগুন, জারুল, পলাশের মতো গাছও ছিল। আর লাগিয়েছিল পাশাপাশি তিনটে নিমগাছ ও দুটো কৃষ্ণচূড়া ও দুটো রাধাচূড়া। দুটো ছোট পুকুরও কাটিয়েছিল পরে একবার এসে। সে কারণে প্রয়োজনে নিজের বাড়ির সীমানা বাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা জমি কিনেছিল। একই সঙ্গে বম্বের স্টাফ-বন্ধুদের থেকে জেনে পরের কয়েক বছরে ধাপে ধাপে নিউটাউনে প্রায় জলের দরে চার-পাঁচ কাঠা করে বেশ কয়েকটা প্লট কিনে ফেলেছিল। কয়েক বছর পরে সুভদ্রা কলকাতায় চাকরি সূত্রে মেসে থাকছে দেখে ওকে জোর করে লোন নিতে বাধ্য করে একটা ছোট বাড়িও তুলিয়েছিল তারই একটায়। অবশ্য সৌমাভ নিজেও বেশ কিছু টাকা দিয়েছিল। পরে বাড়িটা দোতলা করা হয়। সেখানেও প্রচুর গাছ লাগায় সৌমাভ। এই সব জমিজমার দলিল, কাগজ সব সুভদ্রার কাছে রেখে দিয়েছিল সৌমাভ। কয়েক বছর পরে ওকে নমিনিও করে দিয়েছিল, বহু আপত্তি সত্ত্বেও।
ভদ্রা থেকে এক বছর পরে বদলি হয়ে বম্বে আসে সৌমাভ। জয়রাজন স্যারকে ধরাকরা করে সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কে জয়েন করে। প্রথমে তড়োবায় যাওয়ার কথা ভাবলেও ছেলেমেয়ে এবং সুভদ্রার পড়াশোনার কথা ভেবেই বম্বে বেছে নিয়েছিল। বম্বে আসার কয়েক মাস পরে সুভদ্রাকে ভদ্রার মিশনারি কলেজ থেকেই ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা দিতে নিযে গিয়েছিল সৌমাভ। সে সময় কুট্টি-মুট্টিও স্বাভাবিক ভাবেই ওদের সঙ্গে ছিল। বম্বেতে এসে সৌমাভ একটা পুরনো মারুতি গাড়ি কেনে আর্মি অকশন থেকে। বম্বের বাসা থেকে গাড়িতে অফিস যেতে ওর বেশি সময় লাগে না। সুভদ্রা ভালভাবেই পাশ করে সায়েন্স নিয়ে বম্বের একটা কলেজে ভর্তি হয়। তখন সৌমাভর ছেলেমেয়ের বয়স প্রায় দুই। সুভদ্রার জেদাজেদিতেই দুই ছেলেমেয়েকে কাছেই একটা প্রাইভেট নার্সারি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিল। বছর খানেক পরে সেই কলেজটা ওঠে যাওয়ায় একটা নামকরা মিশনারি কলেজে ভর্তি করতে গিয়ে সৌমাভ এমন একটা কান্ড করে বসল, যা ওর মতো সব কাজে নিখুঁত মানুষের কাছে আশা করা যায় না। ছেলেমেয়ের বয়সের হিসেব না করেই চার বছর কয়েক মাসের অরণ্য এবং মৃত্তিকাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দিল। সব শুনে মাথায় হাত পড়ল সুভদ্রার। ও বিস্তর চেঁচামেচি তো করলই সেই সঙ্গে বোঝাল, হিসেব মতো ১৪ বছরে ক্লাস টেন এবং ১৬ বছরে ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা দেবে দু’জন। এত কম বয়সে চাপ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে পড়ল দু’জনেই। তার পরে ঠিক করা হল, দেখা যাক। ওদের অবাক করে দিয়ে ক্লাসের সবচেয়ে ছোট দুই ছেলেমেয়ে প্রতিবারই ভাল রেজাল্ট করে সুভদ্রার হিসেব মতোই ১৪ এবং ১৬ বছরে দুটো বড় পরীক্ষা পাশ করে ফেলল।
সুভদ্রার জীবন এখন আমূল বদলে গেছে। ঢেঙ্কানল থেকে বাবার হাত ধরে অনেক অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করে ভুবনেশ্বরের হোটেলে এসে কাজ নিয়ে চিল-শকুনের নজর এড়িয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে একসময় বারিপদায় জয়ন্ত-জয়তীর সংসাররে ঠাঁই হয়েছিল ওর। সেখান থেকে আজ সে বড় সরকারি অফিসার। সৌমাভ ভদ্রায় আসার পর থেকেই ওর দুই খুদে সন্তান এবং সংসারের সব ভার কাঁধে নিয়ে রীতিমতো গিন্নি হয়ে উঠেছে। সৌমাভর উৎসাহে এবং চেষ্টায় মাস্টার্স শেষ করে সৌমাভর কথাতেই সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বড় পদেই চাকরি করছে সে। এদিকে দুই ছেলেমেয়ে বড় হলেও সুভদ্রার মন পড়ে থাকত ওদের দিকেই। তাই টাকাপয়সার পরোয়া না করেই প্রথম কয়েক বছর প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর শুক্রবার অফিস থেকে বেরিয়ে ফ্লাইট ধরে বম্বে যেত, সোমবার সকালের ফ্লাইটে ফিরে অফিস জয়েন করত। কলেজে ছুটি থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে সৌমাভ কলকাতায় আসত। তখন জয়তীও এসে আড্ডা মেরে যেত ওদের সঙ্গে। জয়তীর ছেলের সঙ্গে কুট্টি-মুট্টির বয়সের ফারাক বেশি না। তবে ও পড়ে নিচু ক্লাসে। দুই ছেলেমেয়ে ক্লাস টেন পাশ করার পরে জয়তী ও সুভদ্রার জেদাজেদিতে বোম্বের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় ফিরল সৌমাভ। জয়েন করল সল্টলেকের অফিসে।
সুভদ্রার বয়স এখন প্রায় ৩৬। সৌমাভ যখন ওকে প্রথম দেখে, তখন ও হিসেব মতো ও ঈশিতার থেকে সামান্য ছোট ছিল। দুই ছেলেমেয়ে এবং সৌমাভকে নিয়ে তার ভরা সংসার। সৌমাভর পদবীই ব্যবহার করে। তবে একটা চাপা কষ্ট আর অভিমান ওর আছে। সৌমাভর কাছে সব রকম ভাবে ধরা দিতে চেয়েও পারেনি। এমনকি বহুবার মুখে বলে কাজ না হওয়ায় নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে সৌমাভর বিছানায় রাতে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেও সাড়া পায়নি। বরং সৌমাভ খুব স্নেহের সঙ্গে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, ‘‘পরে তোকে সব বলব, তুই ভুল বুঝিস না।’’ সুভদ্রা গ্র্যাজুয়েশন করার পরে একদিন রাতে ওকে পাশে বসিয়ে ঈশিতা এবং ওর নিজের সব কথা খুলে বলেছিল। প্রায় ভোররাত অবধি সব বলেছিল সৌমাভ আর সুভদ্রা অঝোরে কেঁদেছিল প্রায় পুরো সময়টাই। আরও বেশি টান অনুভব করেছিল সৌমাভর জন্য, কুট্টি-মুট্টির জন্য। তার পরে সৌমাভর বহু অনুরোধ, রাগারাগি, অভিমানেও ও বিয়ে করেনি। ও কুট্টি-মুট্টিকে প্রথম দিন থেকে সন্তানের মতো পালন করেছে। আজও করে। কুট্টি-মুট্টি ওকে ছোট থেকেই মামন বলে ডাকে। তবে ওকে ‘গার্ডি’ বলে খেপায় দু’জনেই। গার্ডিয়ান থেকে ‘গার্ডি’। এত বড় হয়েও ভুল করলে দু’জনেই মারধর খায় সুভদ্রার কাছে। মুখে না বললেও এবং সামাজিক স্বীকৃতি না পেলেও সুভদ্রা মনে মনে নিজেকে সৌমাভর স্ত্রী হিসেবেই মেনে নিয়ে সংসারের সব ভার হাতে নিয়েছে। ও চাইলে, বিশেষ করে চাকরি পাওয়ার পরে বিয়ে করতেই পারত অন্য কাউকে। কিন্তু সেটা ও করেনি। সৌমাভর শরীরটা পায়নি বটে, কিন্তু দুই ছেলেমেয়ে, সংসার, সম্মান, টাকাপয়সা, জমি, বাড়ি— সব আছে ওর। এমনকি সৌমাভকে জড়িয়ে শুয়েও থাকে বহু দিন। কিন্তু তাতে যৌনতা থাকে না। প্রথম প্রথম সুভদ্রা চাইলেও সৌমাভর সব কথা শোনার পরে আর এ নিয়ে এগোয় না। জয়তীও ওকে বলেছিল, সেও পেয়ে চেয়েছিল, কিন্তু পায়নি। সুভদ্রা এটা মেনে নিয়েই আছে। প্রথম কয়েক বছর যৌবনের চাহিদা, শরীরের টান ওকে ভিতরে ভিতরে জ্বালাত। কিন্তু পরে ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অরণ্য এবং মৃত্তিকা দু’জনেই বাবার কাছে গান শিখেছে যত্ন করে। দারুণ ভাল ছবিও আঁকে। বিশেষ করে ক্যানভাসে রং-তুলি দিয়ে ছবি ফুটিয়ে তোলায় দু’জনেরই হাত অসাধারণ। এখন তারা কলেজে পড়ছে।
ছেলেমেয়ের ১৮ বছরের জন্মদিনের কয়েক দিন আগে সৌমাভ জয়তী এবং সুভদ্রা দু’জনের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। জয়তীর সঙ্গে রঙ্গনের ততদিনে ডিভোর্স হয়ে গেছে। জয়তীর আশঙ্কা মতোই নিজের বাড়িতে একটি মেয়ের কামিজের ভিতরে হাত ঢোকানো অবস্থায জয়তীর কাছে ধরা পড়ে যায়। খোরপোষ হিসেবে টাকা নেয়নি জয়তী, তবে সল্টলেকে রঙ্গনদের পৈত্রিক বাড়িটা নিজের নামে করে নিয়েছিল। জয়তীর বাড়ি থেকে সুভদ্রার বাড়ি বেশি দূরে নয়। কুট্টি-মুট্টি ওকে পিসি বলে ডাকে। আলাদা করে দু’জনের সঙ্গে কথা বলার পরে এক দিন দু’জনকে পাশাপাশি বসিয়ে কথা বলল সৌমাভ। জানাল, আর কয়েক মাস পরে ও পঞ্চাশে পা দেবে। সৌমাভ স্পষ্ট করেই বলল, ‘‘ছেলেমেয়ে অ্যাডাল্ট হয়েছে, এবার সত্যিগুলো জানুক। না হলে পরে যদি কোনও সমস্যা হয়।’’ অনেকক্ষণ ইতস্তত করে দু’জনেই তাতে সায় দিল। ঠিক হল, ওদের সামনেই সব জানাবে সৌমাভ। যে সব কথা সৌমাভ বলতে পারবে না, সেগুলো জয়তী কিছুটা বাকিটা সুভদ্রা জানাবে দু’জনকে। সৌমাভ এই বার ওর লেখা একটা মোটা ডায়েরি তুলে দিল জয়তীর হাতে বলল, ‘‘ভদ্রায় যাওয়া থেকে লেখা শুরু করেছি। আগের সব কথাও আছে। এই ক’বছরের কথাও। যতটা পেরেছি, মনে করে করে লিখেছি। তোমাদের দু’জনের কাছে আমার লজ্জা নেই। তোমাদের দু’জনকেই আমি ছুঁয়ে থেকেছি এত বছর। তাই সব তোমাদের কাছে বলতে পারি। এটা তুমি পড়ে পরে সুভদ্রাকে দিও। সুভদ্রা মনে করলে ছেলেমেয়েকে দেবে পড়তে।’’ আরও দু’টো খবর ও জানাল, যা চমকে দিল জয়তী ও সুভদ্রা দু’জনকেই। ১৮ বছর আগে ঈশিতার কীর্তিকলাপ জানতে পেরে বেলেঘাটার যে বাড়ি থেকে ও কুট্টি-মুট্টিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল, সেই বাড়ি ও পরের বছর জানুয়ারিতে ছেলেমেয়ের মুখেভাত উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসে কিনে নিয়েছিল। পুরো বাড়িটাই। দোতলার বাড়িওয়ালা তাঁর পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন কয়েক মাস পরে। নীচ তলার দোকানগুলোর ভাড়া জমা পড়ে একটা অ্যাকাউন্টে। আর তিনতলার ওদের সেই ফ্ল্যাটটা একই রকম ভাবে বন্ধই ছিল। সেটাকে ও একাধিক তালা মেরে প্রায় সিল করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়টা হল, বছর কয়েক আগে সামার ভেকেশনে কুট্টি-মুট্টি কলকাতায় তাদের মামনের কাছে এসেছিল। ওই সময় বম্বেতে অফিসেই একটা হার্ট অ্যাটাক হয় সৌমাভর। দিন কয়েক হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেলেও বহু দিন ওষুধ খেতে হয়েছে। ব্লাড সুগারও ধরা পড়েছে। শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। ১৮-১৯ বছর আগেই সেই ঝকঝকে, চনমনে, নীরোগ, সৌমাভ বদলাতে শুরু করেছিল বহু বছর আগেই। এখন নানা রোগে শরীর ভেঙে একটা জীর্ণ দশা তার। আরও নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। তাই ও এবার ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নেবে। সেই ২৩-২৪ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছে। ২৫ বছর ধরে নিজের শরীর ও মনের উপর অনেক অত্যাচার চেয়ে বা না চেয়ে করেছে। তার ফল এখন বেরোচ্ছে। ও আর চাকরি করতে চায় না। এ বার বিশ্রাম নেবে। চাকরি ছাড়লেও যে পেনশন পাবে, তা নেহাত কম নয়। প্রথম খবরটায় চমকে গেলেও দু’জনেই বুঝেছিল, বাড়িটার প্রতি মায়া আছে সৌমাভর। কলকাতায় এসে ওই বাড়িতেই ঈশিতাকে নিয়ে উঠেছিল, ওই বাড়িতেই ঈশিতাকে এবং দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিল, তাই ওটা হাতছাড়া করতে চায়নি ও। কিন্তু দ্বিতীয় খবরটা শুনে দু’জনেই প্রচন্ড কেঁদেছিল। কেন বলেনি, ওরা কি কেউ নয়, এই সব নানা কথা উঠেছিল। সৌমাভ উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে দু’জনে বুকে টেনে বলেছিল, ‘‘তোমাদের থেকে আপনজন আমার কেউ নেই দুনিয়ায়। ছেলেমেয়ের সঙ্গে রক্তের টান, আর তোমাদের সঙ্গে আমার প্রাণের টান। তোমরা দু’জনেই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে, কিন্তু তা করোনি। তোমরাই আমার সবকিছু। আমি ওটা বলিনি, কারণ তোমাদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি।’’ সৌমাভর চাকরি ছাড়ার খবরে অবশ্য বেশি খুশি হয়েছিল সুভদ্রা। এবার সব সময় কাছে পাবে নিজের মানুষটাকে। খুশি হয়েছিল কুট্টি-মুট্টিও।


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)